৩. হোটেল কোলামবাস

হোটেল কোলামবাসে এসে গাড়ি থামলো পীরজাদার। রাত তখন সাড়ে তিনটে। দূর থেকে সমুদ্রের ক্ষুব্ধ গর্জন ভেসে আসছে। একবার ভাবলো, ক্লিফটন থেকে বেড়িয়ে আসে। অমন কত রাতে একা একা সে হেঁটেছে ক্লিফটনের বালুবেলায়, কী গাড়িতে চুপ করে বসে থেকে সমুদ্রকে শুনেছে।

আজ একটু বেশি পান করে ফেলেছে পীরজাদা। কেমন যেন ঘুম জড়িয়ে আসছে। থাক ক্লিফটন।

পোর্টার বসে বসে ঝিমুচ্ছিল। সালাম করে উঠে দাঁড়াল তাকে তেতলা অবধি পৌঁছে দেয়ার জন্য। পীরজাদা হাতের ইশারায় তাকে নিরস্ত করে একাকী সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। নিঃসঙ্গতা কাটাবার জন্যে কিছু একটা আবৃত্তি করতে ইচ্ছে করল তার। কিন্তু কিছুই মনে পড়ল না। কেবল কতগুলো অসম্বদ্ধ অর্থহীন শব্দ গড়িয়ে পড়ল মুখ থেকে।

রজনীর কামরার সমুখে এসে থমকে দাঁড়াল পীরজাদা। এতরাতেও ঘরে আলো জ্বলছে। স্কাইলাটের কাঁচের ভেতর দিয়ে চৌকো সোনার পাতের মতো আলো পড়ে আছে তার পায়ের কাছে। ভেতরে কোনো শব্দ নেই, সাড়া নেই। পীরজাদা সোনার পাতের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালো। এত রাতে তো কোনদিন ওদের ঘরে আলো জ্বলে না।

মাথার মধ্যে অত্যধিক সুরা ছিল বলেই বোধ হয় সে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। একটা যুগও চলে যেতে পারতো। হঠাৎ ঘরের মধ্যে মৃদু পায়ের শব্দে কান খাড়া করে তাকাল। ঘরের মধ্যে বাতি নিবলো। পীরজাদা তখন চলে যাবার উদ্যোগ করবে, এমন সময় দপ্ করে আবার সেই সোনার পাত এসে তার পায়ের ওপর পড়লো। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল সে। বাতি আর নিবলো না।

এসে নিজের ঘরে সটান শুয়ে পড়ল বিছানায়। সঙ্গে সঙ্গে বিছানাটা দুলে উঠলো কেয়ামারির সাম্পানের মতো। আলো, চেয়ার, টেবিল, পর্দা, জাগ, সমস্ত কিছু নিয়ে এক প্রচণ্ড টানে সাঁতারুর মতো সোজা তলিয়ে গেল সে ঘুমের ভেতর।

রজনী ভেবেছিল অন্ধকারে শুয়ে থাকতে পারবে। বুকের মধ্যে তো ঢিপঢিপ করছিল। বাতি নেভানোর সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো হৃদয়টা এখুনি ছিঁড়ে যাবে ভয়ে। তক্ষুণি আবার বাতি জ্বালিয়ে ঘরের মধ্যখানে সে দাঁড়িয়ে রইলো। সর্ব অঙ্গ তার থরথর করে কাঁপছে। আরো শঙ্কা হলো যখন বাইরে শুনল পায়ের শব্দ। কে যেন দাঁড়াল, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল। একবার মনে হয়েছিল, দরোজা খুলে দেখে। কিন্তু সাহস হয়নি। পরে সে শুনল, পায়ের আওয়াজটা একেবারে শেষ মাথায় গিয়ে থামল, তারপর দরোজা খোলার শব্দ। তখন বুঝলো পীরজাদা ফিরেছে।

সব রাত পোহায়। দুঃখের রাতও শেষ হয়। সূর্য ওঠে। সারাটা রাত জেগে বসেছিল রজনী। রাতের বেলায় তবু সব কেমন যেন দুঃস্বপ্ন বলে মনে হচ্ছিল। দিনের আলোয় তা নিষ্ঠুর সত্য হয়ে ফুটে উঠল।

রাতে শুয়ে ছিল দুজনে। মাঝরাতে পাশে হাত পড়তেই রজনী চমকে উঠেছে। মহসিন নেই। প্রথমে মনে করেছিল বাথরুমে গেছে। কিন্তু পনেরো বিশ মিনিট কেটেছে, সাড়া নেই। তখন সে উঠে বসেছে। নাম ধরে ডেকেছে। সাড়া আসেনি। বাতি জ্বালিয়ে দরোজা খুলে দেখে শাওয়ার থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে নিত্যকার মতো সে নেই। সারাটা ঘর। শূন্য। তখন ভীষণ ভয় করলো রজনীর। চোখের সামনে সব দেখেও কিছুই যেন সে দেখতে পারছে না। তার মাথায় কিসসু ঢুকছে না। মহসিন তাকে ফেলে পালিয়ে গেছে, এ সত্যটা কিছুতেই সে যেন বুঝতে পারছিল না। কেবল কী রকম একটা অতল ভয় করছিল। আর কিছু না।

বেয়ারা এসে সকালের চা দিয়ে গেল। চা স্পর্শ করলো না। কিছুক্ষণ পর ব্রেকফাস্ট আনলো, যেমন রোজ আনে, দুজনের জন্যে। দুজনের ব্রেকফাস্টের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলো সে। সব কিছু দুজনের। কিন্তু একজন নেই। মায়ার মতো একবার আশা হলো হয়ত ফিরে আসবে মহসিন। কিন্তু দুপুর হয়ে গেল, সে এলো না।

অবাক হলো বেয়ারা। জিগ্যেস করল, মেমসাব কা তবিয়ৎ কেয়া ঠিক নেহি?

বুড়ো পাঠানের কণ্ঠে এমন একটা মমতা ছিল, রজনীর মনে হলো এখুনি তার চোখে পানি এসে পড়বে। তাড়াতাড়ি সে কোন রকমে মাথা নেড়ে একটা হা–না গোছের জবাব দিল। বেয়ারা জিগ্যেস করল, সাহেব কি ভোরে ভোরেই কাজে বেরিয়ে গেলেন? তারও জবাব সে দিল না। বরং একটা কথা জিগ্যেস করার ফলে সে যে পরিত্যক্ত এইটে প্রকট হয়ে উঠলো তার মনের মধ্যে। বুড়ো পাঠান কী বুঝলো কে জানে, ট্রে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। জাগে ভরে দিয়ে গেল নতুন পানি।

সে যাবার পর টসটস করে দুফোঁটা উষ্ণ অশ্রু গড়িয়ে পড়ল রজনীর গালে। তা মুছে ফেলার। কথা মনে হলো না। ফোঁটা হলো প্রস্রবণ। অনেকক্ষণ নিঃশব্দে বসে বসে কাদলো রজনী। উঠে দাঁড়াতেই জানালা দিয়ে দূরে শহর চোখে পড়ল তার। রুক্ষ ধূসর মাটিতে ছোট বড় দালান, একটা দুটো গাছ, গাড়ি চলছে, কয়েকটা ছেলেমেয়ে স্মার্ট পোশাক পরে রোদের। মধ্যে কুটিপাটি হাসতে হাসতে রাস্তা পার হচ্ছে। এ সবের যেন কোন মানে বোঝা যাচ্ছে না। এ যেন আরেকটা পৃথিবীতে ঘটছে, আর সে, রজনী, তার কোনো শক্তি নেই সেখানে যেতে পারে।

আস্তে আস্তে দরোজা খুলে বেরুলো রজনী। করিডরে কেউ নেই। ইতস্তত করল একবার। চারদিক দেখল। তারপর হঠাৎ সাহস সঞ্চয় করে কুড়ি নম্বরের দরোজায় মৃদু টোকা দিল। বুকের স্পন্দনটা যেন হঠাৎ বেড়ে গেছে, তাকে আর কিছুতেই শান্ত করা যাবে না। অনেকক্ষণ পর আবার আঘাত করল দরোজায়। অস্পষ্ট উচ্চারণও করল, শুনুন। তার তখন এটুকু বোঝার মতো জ্ঞান নেই যে তার বাংলা কেউ বুঝবে না।

ভেতর থেকে এবারে বিজড়িত কণ্ঠে উত্তর এলো, কাম ইন।

লোকটার কণ্ঠ শুনে তার গা কাঁটা দিয়ে উঠল। চলে যাবার জন্যে ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল। মুখ ফেরাবে এমন সময় দরোজা খুলে পীরজাদা বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেল। অনেকক্ষণ সাড়া না পেয়ে কে লোকটা দেখবার জন্যে বিরক্ত হয়ে উঠে এসেছিল সে। কোনো রকমে উচ্চারণ করতে পারল, আপনি!

রজনীর কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে সে আবার শুধালো, আমাকে কিছু বলবেন?

জামার বোতাম ছিল খোলা। পীরজাদা সেগুলোকে কোনো রকমে বন্দি করতে করতে পর্দা সরিয়ে ভেতরে আসবার পথ করে দিল। এবং আশেপাশে মহসিনকে না দেখে উৎকণ্ঠিত হলো। রজনীকে একবার ডাক্তার ডেকে এনে দিয়েছিল বলে লোকটা বিষ চোখে কয়েকদিন তাকে দেখেছে। এখন ঘরে আমন্ত্রণ জানানোর জন্যে হয়ত খুন করতে আসবে।

সোফার ওপরে পরিত্যক্ত পোশাক ছিল ছড়ানো। সেগুলো সলজ্জ হয়ে গুছোতে গুছোতে পীরজাদা বলল, বসুন। এ ঘরটা খুব আগোছালো। কিছু মনে করবেন না।

রজনী বসলো না। তার স্বল্প জানা উর্দু আর বইয়ের ইংরেজি মিশিয়ে কোন রকমে যা বলল তার অর্থ—- সে বসবে না, একটা কথা বলতে এসেছে।

নিশ্চয়ই সে কথা বলবে, কিন্তু বসবে না এটা কেমন কথা? অতএব বসতে হলো। কথাটা বলবার জন্যে যে শক্তির দরকার তা সেই মুহূর্তে রজনীর ছিল না বলে বসে পড়া ছাড়া পথ ছিল না তার।

আর পীরজাদা তার ভাষার অস্বাচ্ছন্দ্যে এতদূর অস্বস্তি বোধ করল যে, বাংলা না জানার জন্যে নিজেকে অপরাধী বলে মনে হলো। বলল, আপনি বলুন আমি বুঝতে পারছি।

রজনী বলল, আমি বড় বিপদে পড়েছি। আপনি ছাড়া এখানে কাউকে চিনিনে। কাল রাত থেকে ওকে দেখছি না।

কথাটা অপ্রত্যাশিত। পীরজাদা প্রথমে কিসসু বুঝতে পারল না। হা করে তাকিয়ে রইল রজনীর দিকে! তা, শ্যামল মুখের ওপর ইতস্তত দ্রুত কী যেন খুঁজে বেড়াল চোখ। বোকার মতো জিগ্যেস করল, কাকে দেখছেন না?

রজনী চকিতে একবার চোখ তুলে চোখাচুখি হতেই দৃষ্টি নামিয়ে নিল। বলল, ওকে। আপনার স্বামীকে?

রজনী মাথা নিচু করে রইল।

তখন সব কিছু স্পষ্ট হলো পীরজাদার কাছে। পায়ের আসন বদল করে বসলো সে। তখন রজনীকে সম্পূর্ণ করে দেখল। তার ভীত রক্তশূন্য মুখের পরে বেশিক্ষণ দৃষ্টি রাখতে পারল না। করতলে মাথা রেখে ভাবতে চেষ্টা করল পীরজাদা।

আবার যখন চোখ তুলল, দেখল, রজনী তার দিকে ছলোছলো চোখে তাকিয়ে আছে। সে চোখে অবোধ আকুলতা দেখে পীরজাদার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো, বড় অক্ষম মনে হলো নিজেকে। চকিতে মনে পড়ল তার স্ত্রীর পালানো এবং বীভৎস মৃত্যুর কথা। তখন প্রবল ইচ্ছে হলো, উঠে গিয়ে সমুখে বসে থাকা ঐ ভয়ার্ত মেয়েটাকে নির্ভয় করে তোলে তার শরীর স্পর্শ করে। হয়ত সে উঠেই যেত, কিন্তু বাধা পড়ল।

মনের মধ্যে চাবুক পড়ল যেন। একী করতে যাচ্ছিল সে? রজনীর জন্যে এতদিন দূর থেকে যে দুর্বলতা গড়ে উঠেছিল, আজ তা–ই যেন আগল ভেঙ্গে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আরেক মানুষের স্ত্রী রজনী, তার জন্যে এতটুকু মমতা করাও যে পাপ।

যেখানে তার উচিত ছিল রজনীর বিপদ দেখে সাহায্য করবার জন্যে উদ্বুদ্ধ হওয়া, সেখানে পীরজাদা স্বার্থপরের মতো নিজেরই মমতাকে প্রকাশ করবার জন্যে উদ্বেল হয়ে উঠেছে!

স্তব্ধ হয়ে ভাবলো, যদি আজ রজনী না হয়ে অন্য কোনো মেয়ে হতো তাহলে কি সে এতখানি বিচলিত বোধ করত? করত না। অন্য কোনো সময়ে হলে সে এর সিকিও অনুভব করতে। পারত না—-এইটে বুঝতে পেরে চুপ হয়ে গেল সে। তার মুখ কঠিন হলো। হৃদয়কে সে পাথর করে তুললো, যে পাথরের হৃদয় নিয়ে সে এই আড়াইটে বছর বেঁচে আছে; বলল, আমাকে মাফ করবেন, আমি কিছু করতে পারব না। আপনার বিপদের কথা শুনে আমি দুঃখিত ও মর্মাহত। আমার কিছু করবার নেই। আপনি ম্যানেজারকে খবর দিন, তিনিই ব্যবস্থা করবেন।

শুনে রজনী স্তম্ভিত হয়ে গেল। যে লোকটা তার অসুখে বিনি ডাকে এগিয়ে এসেছিল, সেই একই লোকের সমুখে সে বসে আছে বিশ্বাস হলো না। পীরজাদাকে তার মনে হয়েছিল সহানুভূতিশীল। সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি, তার বিপদের মুহূর্তে অমন রুক্ষ কথা শুনতে হবে। মানুষের ওপর রজনীর যে ভালো ধারণাগুলো ছিল তা খান খান হয়ে ভেঙ্গে গেল। পশুর মতো মনে হলো পীরজাদাকে। উঠে দাঁড়াল রজনী।

পীরজাদা বুঝতে পারল, সে অন্যায় করেছে। সে একচোখা বিচার করেছে। মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি যে কর্তব্য তা সে করতে পারল না। ক্ষমাহীন অপরাধ বোধ নিয়ে সেও উঠে দাঁড়াল এবং বিনীতকণ্ঠে বললো, আপনি হয়ত আমাকে অমানুষ ভাবছেন। আমি যে কথাগুলো বলেছি তা কোনো বিশেষ কারণে বলেছি যার সঙ্গে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই, তাই বুঝিয়ে বলতে পারব না।

তার কণ্ঠস্বরের আন্তরিকতাটুকু রজনীকে স্পর্শ করল। তাকে আবার ভরসা করতে মনটা ইচ্ছুক হয়ে উঠল। রজনীর মন থেকে তিক্ততার খানিকটা যেন অপসারিত হয়ে গেল। বলল, আমি আর কাউকে চিনিনে বলেই আপনার কাছে এসেছিলাম।

আমাকেও আপনি চেনেন না। সে যাক, এখন আমার মনে হচ্ছে ম্যানেজারের সঙ্গে আপনার দেখা করাই ভালো।

কেন?

সে বিষয়ী মানুষ। প্রথমেই তার মনে পড়বে হোটেলে বাকি বিলের কথা। সেটা আপনার মাথায় আরেক বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

রজনী ভাবেনি। এবারে সে চোখে মুখে দিশে দেখতে পেল না। বলল, তাহলে?

একটা কাজ করতে পারবেন? আপনি দোতলায় নেমে ননম্বর কামরায় যান। ওখানে লালা স্বরাজ থাকেন, আমার বন্ধু সাংবাদিক। আমি টেলিফোনে তাঁকে বিস্তারিত জানিয়ে দিচ্ছি। আমার মনে হয়, সে নিশ্চয়ই একটা কিছু করতে পারবে।

তার সমুখেই পীরজাদা টেলিফোন করল লালা স্বরাজকে। স্বরাজ সৌভাগ্যবশত তার কামরাতেই ছিল। আজ তার ছুটিবার। পীরজাদা নিজে রজনীকে দিয়ে এলো লালা স্বরাজের কামরায়। বসলো না। ঘরে এসে পরপর দুটো নির্জলা বড় হুইস্কি পান করল। রজনীর কথা বারবার মনে পড়ছে অথচ সে মনে করতে চায় না। রজনীর জন্যে তার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে, অথচ কষ্টটাকে কিছুতেই দাবিয়ে রাখা যাচ্ছে না।

লালা স্বরাজ বাঙালি মেয়ে শুনে উৎসাহ বোধ করল। কিছুদিন হলো বাংলার জন্যে তার একটা অনুরাগ দেখা দিয়েছে। সেটার শুরু রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর সময়ে। কিনেছিল নৃত্যনাট্য শ্যামার রেকর্ড। বুঝতে পারেনি একবর্ণ, কিন্তু ভাষাটার প্রতি ভালোবাসা জন্মে গেল। কেনা হলো সুনীতি বাবুর বাংলা শেখার বই। ভাষার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতি, মানুষ সব কিছুর জন্যে আগ্রহটা প্রবল হলো তার।

এতদিন একটি মেয়ে, বাঙালি মেয়ে এ হোটেলে আছে এটা সে জানে না ভেবে অবাক হলো। সে পীরজাদাকে টেলিফোনে বলল, তুমি এখুনি ওকে নিয়ে এসো।

পীরজাদা এসে রজনীকে পৌঁছে দিয়ে গেল তার কামরায়। আড়ালে ডেকে বলল, থানা পুলিশে খবর দিয়ে অনর্থক হাঙ্গামা বাধানো রজনী পছন্দ করছে না। তুমি সাংবাদিক মানুষ, যে করে হলে হৈচৈ কম হয়, লোকটার সন্ধান এনে দাও।

রজনীকে দেখে প্রথমেই যে কথাটা মনে হলো লালা স্বরাজের তা হচ্ছে মেয়েটা বোকা। শিশুর মতো একটা মমতা মাখানো সারা মুখে। রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলির ছবি খুঁজে পেল সে। আরো ভালো লাগল, একেবারে নতুন লাগল, তার পরনে নানা রংয়ের বরফি করা তাঁতের সবুজ শাড়িটা।

সাংবাদিক মানুষ লালা স্বরাজ। তার দৃষ্টিই আলাদা। প্রথম পরিচয়ের আবেশটুকু পার হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে রজনীকে পরিমাপ করল। জিগ্যেস করল, এ হোটেলে কদ্দিন?

দেড় মাস।

করাচিতে এই প্রথম?

হ্যাঁ।

আপনার স্বামী?

রজনী চোখ তুলে তাকাল। বলল, হ্যাঁ।

এতক্ষণে রজনীর মনের মধ্যে একটু সাহস দেখা দিচ্ছে।

লালা স্বরাজ আচমকা প্রশ্ন করল, আপনার কি মনে হয় আপনি সত্যি কথা বলছেন?

কোনটা!

যে উনি আপনার স্বামী?

কথাটা বলে লালা স্বরাজ উঠে দাঁড়াল। বেল টিপল। বেয়ারা এলে তাকে চায়ের জন্যে পাঠাল। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে রজনীকে বলল, আমার ধারণা, উনি আপনার স্বামী নন। রজনী প্রতিবাদ করতে গেল। কিন্তু কী বলল ভালো করে বোঝা গেল না। বাংলা উর্দু ইংরেজি মিশেলে সব তালগোল পাকিয়ে গেল। নাজেহাল হয়ে বলল, আমি আপনাদের ভাষায় ভালো করে কথা বলতে পারিনে। আমি কিছুই বুঝিয়ে বলতে পারছি না।

লালা স্বরাজ বলল, আপনি বাংলাতেই বলুন। ইদানীং আমি আপনাদের ভাষা শেখবার চেষ্টা করছি। বলতে না পারলেও মোটামুটি বুঝতে পারি।

কিন্তু রজনী আর কিছু বলতে পারল না। লালা স্বরাজ বুঝতে পারল রজনীর স্বামী নয়। তবু একসঙ্গে একই হোটেলের কামরায় দেড়মাস তারা থেকেছে। রজনীর রূপে নেই প্রখরতা, দৃষ্টিতে নেই বিদ্যুৎ, ভঙ্গিতে নেই আজাদ–জেনানার দম্ভ। রজনী শান্ত, আত্মস্থ, নির্ভরশীলা নারী। তবে কি সে ভালবাসত লোকটাকে? আর এই ভালবাসাই তাকে আকুল করে তুলেছে পালিয়ে যাওয়া লোকটার সন্ধানে সম্পূর্ণ অপরিচিত পুরুষের কাছে সাহায্য চাইতে? কুণ্ঠাহীনা করেছে? আর লোকটা যদি সত্যি সত্যি ভালোবেসে থাকত রজনীকে, তাহলে পালিয়ে গেল কেন? কেন ওরা এসেছিল করাচিতে? কেন এ হোটেলে উঠেছিল? রজনীর দিকে আবার ভালো করে তাকাল লালা স্বরাজ। কিছুই বোঝা গেল না। তার একটা প্রশ্নেরও উত্তর সেখানে নেই। কেবল লোকটার জন্যে ভালবাসার স্পন্দন যেন মেয়েটার মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।

এমন কাণ্ড সে জীবনে দেখেনি। ভালবাসার এই পরোক্ষ পরিচয়ে বিস্মিত হলো সে। বলল, কিছু মনে করবেন না। আমারই বুঝতে ভুল হয়েছিল। কাল অধিক রাত অবধি কাজ করতে হয়েছে, মাথা গুলিয়ে আছে। আপনার স্বামীর সন্ধান আমি যথাসাধ্য করব। আশা করি সফল হবো। আপনি ঘরে যান। দরকার হলে আমাকে খবর দেবেন।

রজনী চলে গেলে সে ভাবতে বসলো, সন্ধানটা কিভাবে নেয়া যেতে পারে। মহসিনের চেহারা তার জানা নেই, একটা ছবি পেলে কাজ হতো। তক্ষুণি সে রজনীর কামরায় এসে ফটো চাইল। মেয়েটা অনেকক্ষণ সুটকেস খুঁজল, মহসিনের কাগজপত্র ঘাটলো, কিন্তু ছবি পাওয়া গেল না। বলল, তাহলে?

কোনো রকমে একটা বর্ণনা দিল তার। লালা বেরিয়ে এসে কী ভেবে পীরজাদার দরোজার দিকে গেল। দেখল, ঘর বন্ধ। পীরজাদা বেরিয়ে গেছে।

সন্ধ্যের সময় ফিরে এসে লালা স্বরাজ দেখল, তখনো পীরজাদার ঘর বন্ধ। দুপুর থেকে শহরের সর্বত্র তার যেখানে যত বন্ধু আছে সবার কাছে সে ঘুরেছে পুলিশের ছোট বড় কর্তা থেকে শুরু করে হাসপাতাল, হোটেল, বাঙালিদের আড্ডা, ক্লাব, সংঘ কিছুই বাদ রাখেনি। কিন্তু সে নিজেও জানতো, এ করে কিছুই হবে না। একটা সুস্থ সজ্ঞান লোক এত বড় শহরে গা ঢাকা দিয়ে থাকলে তাকে খুঁজে বার করা শক্ত। হয়ত আদৌ সে এ শহরেই নেই। হয়ত ঢাকা চলে গেছে। কিন্তু গেল কেন রজনীকে ফেলে?

দরোজায় টোকা দিতেই বেরিয়ে এলো রজনী। যেন এতক্ষণ তার জন্যেই সে অপেক্ষা করছিল। ভেতরে এসে বসল লালা স্বরাজ। বলল, সে সর্বত্র খবর নিয়েছে। এখনো হদিশ মেলেনি। জিগ্যেস করল, আচ্ছা উনি ঢাকা চলে যান নি তো?

না, আমার মনে হয় না।

আশ্চর্য!

কী?

আপনাকে ফেলে কোথায় যেতে পারেন? আমি হাসপাতালেও খোঁজ নিয়েছি।

মাথার ওপরে বিরাট চক্রের মতো বাতি জ্বলছে। সেই আলোয় লালা স্বরাজ দেখল রজনী সারাটা বিকেল কেঁদেছে। তার মুখ কান্না শেষে পাথরের মতো ভার হয়ে আছে। সে বলল, আপনি দেশে ফিরে যান।

চমকে উঠল রজনী। দ্রুত মাথা নাড়ল। অস্পষ্ট উচ্চারণ করল, না, সে হয় না।

কেন?

দেশে আমার কেউ নেই।

কেউ নেই?

যেন প্রতিধ্বনি করে উঠল লালা স্বরাজ।

বাবা মা ভাই বোন কেউ নেই? আপনার স্বামীর কেউ নেই? তারও কেউ নেই?

না।

সে ভাবল মেয়েটা মিথ্যে কথা বলছে। কিন্তু মিথ্যে বলার মতো মেয়ে বলেও মনে হচ্ছে না। একদিকে তার সাংবাদিক মন রহস্য ভেদের জন্যে ব্যগ্র হয়ে উঠল, অন্যদিকে এই মেয়েটার জন্যে মমতা করতে লাগল, সেই মমতা তাকে বারণ করল মেয়েটাকে আর কোন প্রশ্ন করতে। তার মনে হলো রজনী ভেঙে পড়বে।

জীবন যে কী অসামান্য অগোচর এক শক্তির চক্রে আবর্তিত, উৎক্ষিপ্ত, জটিল হয়ে ওঠে, মানুষ তার এক নগন্য ভগ্নাংশও জানতে পারে না, এ কথা লালা স্বরাজ জানে। তার নিজের জীবনটাও তো ওই। কে তার কতটুকু জানে, তাকে কতটুকু কে বুঝতে পারে? এই মেয়েটার কোমল চোখের সমুখে বসে তার নিজের অতীতের ছবি দেখতে পেল লালা স্বরাজ। তার বাবা ছিল করাচি পোর্টের অসংখ্য ঝাড়ুদারের একজন। ছোটবেলার কথা এখনো স্পষ্ট মনে আছে তার। বাবার সঙ্গে সেই ভোরে বেরুতো ভিজে ন্যাকড়া আর বালতিভরা পানি নিয়ে। বাবা ঝাড় দিয়ে যেতেন আর সে ন্যাকড়া ভিজিয়ে ভিজিয়ে মেঝে মুছতো। বাবা বলতেন, মুছতে মুছতে যখন নিজের চেহারা দেখতে পাবি তখন বুঝবি কাম ভালো হয়েছে। মেঝেতে নিজের চেহারা সে কোনদিন দেখতে পায়নি। কথাটা ভয়ে বাবাকে বলত না সে।

সারাদিনের কাজ ছিল এই। সকাল দুপুর সন্ধ্যে। একটা দিন হপ্তায় ছুটি মিলত। কিন্তু বস্তি থেকে বেরুনো ছিল তার নিষেধ। বাবা ভয় করতেন, ছেলে অস্পৃশ্যের সন্তান, পথে বেবিয়ে কোথায় কোন ব্রাহ্মণের ছায়া মাড়াবে, চোখে পড়বে, অভিশাপ কুড়োতে হবে। ভালো করে বুঝতো না স্বরাজ ব্যাপারটা। বাবাকে দেখত বেরুতে। জিগ্যেস করলে তিনি বলতেন, তুই এখনো ছেলেমানুষ, কখন কী করে বসবি, তাই বেরুনো মানা। তখন নিজেকে হাত পা বাঁধা কুকুরের মতো মনে হতো স্বরাজের। ব্রাহ্মণকে মনে হতো অতিমানব। কল্পনা করত দৈত্যের মতো দীর্ঘ তারা, অসুরের মতো শক্তি তাদের, চোখ দিয়ে বেরুচ্ছে আগুন—-যে আগুন তাকে পুড়িয়ে মারবার জন্যে সারাক্ষণ লকলক করছে।

রজনীর কণ্ঠস্বর হঠাৎ কানে এলো!

কী ভাবছেন?

লালা স্বরাজ তার অতীত থেকে ফিরে এসে ধরা পড়ে যাওয়ার হাসিতে বিব্রত হলো। বলল, কিছু না।

রজনী কী বুঝলো, মন ছোট করে বলল, আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি। আমার জন্যে সারাটাদিন আপনার নষ্ট হলো।

না, না, সে কী?

আপনার কি মনে হয়, ওকে খুঁজে পাওয়া যাবে?

যাবে, নিশ্চয়ই যাবে, কেন যাবে না? তারপর কী ভেবে লালা স্বরাজ যোগ করল, মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, কেমন কথা? একমাত্র মরে গেলেই মানুষ সত্যি সত্যি হারিয়ে যায়। বেঁচে যে থাকে তাকে আজ হোক কাল হোক পাওয়া যাবেই। আমার তো মনে হয় উনি নিজেই ফিরে আসবেন। হয়ত আজ রাতেই আসবেন। নিশ্চয়ই কাল রাতে আপনাদের ঝগড়া হয়েছিল?

তার কথা মরমে গিয়ে স্পর্শ করল রজনীকে। পরম একটা নিশ্চিন্ত স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে এলো তার। সত্যি তো মহসিন আজ রাতেও ফিরে আসতে পারে। বরং এইটেই সম্ভব। রজনীর তখন খুব ভালো লাগল। মনটা তার আরো সহজ হয়ে উঠল। সলজ্জ হয়ে মাথা নেড়ে মুখে বলল, না, ঝগড়া কী!

মানুষ বেঁচে থাকলে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবেই, এই কথা লালা স্বরাজ বলেছে, কিন্তু সত্যি সত্যি সে কি তা বিশ্বাস করে? তার নিজের জীবনে কি এটা মিথ্যে হয়ে যায়নি। কিন্তু যখন সে বলেছে তখন এত অনুভব করে বলেছে যে তার মন ভীষণ রকমে আচ্ছন্ন হয়ে রইল এক আশ্চর্য কোমলতায়। রজনীকে তার খুব আপন বলে মনে হলো। সুন্দর একটা পরিবেশ রচিত হলো তার হৃদয়ের মধ্যে। সে বলল, সারাদিন ঘরে বসে থাকলে আপনার মন খারাপ করবে যে, কাঁদেন নি তো?

রজনীর ভালো লাগল কান্নার উল্লেখে। লোকটাকে কাছের মনে হলো। সত্যি সে কেঁদেছে। কিন্তু মুখে বলল, না।

তাহলে চলুন, শহরে বেরিয়ে আসবেন। এই সময়টা কার্নিভালের মতো খুশিতে ভরে থাকে বাইরে। যাবেন? আপনার সঙ্গে বাংলায় কথা বলে এই আধঘণ্টায় রীতিমত পণ্ডিত হয়ে গেছি। কেমন বাংলা বলি বলুন তো?

ভালো।

কি, যাবেন?

সারাটা দিন ঘরের মধ্যে ছটফট করেছে রজনী। কতবার যে উঠেছে, বসেছে, শুয়েছে, হেঁটেছে, দাঁড়িয়ে থেকেছে তার ইয়ত্তা নেই। ঢাকা থেকে পালিয়ে আসার সময় বুকের মধ্যে যতটা না কাঁপুনি লেগেছিল, আজ সারা দিনে তার চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা তাকে দুর্বল করে তুলেছে। দুর্ভাগ্য তার নতুন নয়। তিনবার আই এ ফেল করা, কয়েকবার তাকে দেখতে এসে পছন্দ না করা, মা–বাবার বকুনি, এ সব তাকে যথেষ্ট পাথর করে ফেলেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যকে দূর করবার জন্যে পেছনে ফেরার পথ বন্ধ করে শেষ বারের মতো যাকে সে অবলম্বন করেছিল, সে চলে যাবার পর আজ সত্যি সত্যি নিজেকে বড় রিক্ত মনে হয়েছিল তার। রিক্ততা যখন চরমে গিয়ে পৌঁছয়, তখন আশ্চর্য রকমে মানুষ মুক্ত বোধ করতে থাকে। ইন্দ্রিয়ের একটা সহন–সীমা আছে, সেটা পেরিয়ে গেলে দুর্বহ ভারও আর ঠাহর হয় না। রজনীর হয়েছে সেই দশা। তার মনে হলো, জন্মজন্মান্তরে এমন সহানুভূতি সে পায়নি। সে বলল, এখন কি বাইরে বেরুনোর সময় আছে?

নিশ্চয়ই আছে। শহরে বেড়াতে হলে এই তো সময়। প্রকৃতিকে দেখতে হলে দিন, আর শহর—- রাতে। চলুন, আপনার কিছুতেই মন খারাপ করে বসে থাকা চলবে না। আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি। আপনি কাপড় বদলে নিন।

লালা স্বরাজ বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বেশ সুন্দর একটা বাতাস দিচ্ছে। চাঁদ উঠেছে। কেবল উঠেছে। কেবল উঠেছে বলে অনেক বড় আর লাল দেখাচ্ছে চাঁদটাকে; মনে হচ্ছে জন্মের কষ্ট হচ্ছে চাঁদটার। মাঝরাতে যখন আকাশের মাঝখানে এসে পড়বে, তখন ঝকঝক করতে থাকবে, আনন্দের মতো দেখাবে।

একটা চিরকুট লিখল স্বরাজ। লিখল—-আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। তুমিও দ্যাখো। তুমিও খোঁজ করো। কেবল আমার ভরসায় থেকো না।

লিখে কাগজটা পীরজাদার দরোজার ভেতরে চালিয়ে দিল। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইল সে।

নিচে লনে চেয়ার পেতে কেউ কেউ বসেছে। মনে হচ্ছে, অন্ধকারের মধ্যে শাদা শাদা শরীরগুলো কে যেন এঁটে রেখে গেছে চাবি দিয়ে।

একটা গাড়ি এসে থামল, কেউ নামলো, গাড়িটা গড়িয়ে অন্ধকারের মধ্যে গিয়ে বসে রইল হামা দিয়ে।

মানুষ যদি বেঁচে থাকে তো একদিন না একদিন তাকে খুঁজে পাওয়া যাবেই। লালা স্বরাজ অবাক হয়ে ভাবল, যে কথাটা সে অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে বহুদিন আগে থেকেই, আজ সেটাই কী করে সে এত বিশ্বাস নিয়ে উচ্চারণ করতে পারল?

সেই যে সমাজের অস্পৃশ্য হরিজন বলে বাবা বেরুতে দিতেন না, তাতে কী? স্বরাজ ছুটিবারে যেত সায়েবদের বাংলার পেছনে মালি খানসামাদের কোয়ার্টারে। সেখান থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত একটা নতুন জগৎ। স্বর্গের মতো। ফুলের মতো ছেলেমেয়েরা, তারই বয়সী, খেলছে, লাফাচ্ছে, দৌড়াদৌড়ি করছে। মা তাদের লাল চুলে বো বেঁধে দিচ্ছেন ছেলেটাকে ডেকে গানের মতো গলায় কথা বলছেন। চটপট মাকে কী যেন বলছে সে ছেলে। হাসছে। তার পোকায় খাওয়া দাঁত খুশিতে কী সুন্দর দেখাচ্ছে। খুব ঝিলিক দিয়ে রোদ উঠেছে। মাঠ খুব সবুজ হয়েছে। শাদা হাফ প্যান্ট পরে সায়েব বাগানে ঘুরছেন। বক্লস বাধা কুকুরটা তার পেছনে পেছনে যাচ্ছে।

এক আধদিন সায়েবের মুখোমুখি পড়ে গেলে চোরের মতো পালাতে চেষ্টা করত স্বরাজ। কিন্তু পরক্ষণেই দেখত, না, তাকে তাড়া করছেন না উনি। বরং কাছে ডেকে প্রথম দিনই নাম পরিচয় জিগ্যেস করেছিলেন; এবং দ্বিতীয় দিনে কুকুরটা একটা বেড়াল দেখে খুব লাফাচ্ছিল, বেড়ালটাকে ধরে বেঁধে দূরে কোথাও ফেলে দিতে বলেছিলেন সায়েব। এ বেড়ালটা জ্বালাত রোজ। একটা কাজ পেয়ে স্বরাজ সেদিন মহাখুশি। তাকে কায়দা করে মাখা রুটির লোভ দেখিয়ে, ধরে, বস্তাবন্দি করে পিঠে ঝুলিয়ে স্বরাজ একটা চলন্ত ট্রাকের ওপর তুলে দিয়েছিল।

এমনি করে চেনা হয়ে উঠেছিল স্বরাজ সেই সায়েব পরিবারে।

এখন ছুটিবারে তার কাজ সায়েবের ছোট দুই ছেলে আর মেয়েটার সঙ্গে খেলার যোগান দেয়া। পাখির ছানা পেড়ে আনা, লুকিয়ে দুপয়সার তেলেভাজা এনে খাওয়ানো, চাচার নতুন মাদল চুরি করে ওদের উপহার দেয়া এই চলছিল। একদিন মেয়েটা, পাঁচ বছরও হবে না, স্বরাজকে ডেকে নিয়ে খেলার ছোট অর্গান দেখাচ্ছিল, উপুড় হয়ে বসে রীডে টুং টুং আওয়াজ করছিল। অতটুকু যন্ত্র থেকে অমন মিঠে সুর বেরুতে পারে দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল স্বরাজ। আরো অবাক হয়েছিল ঐটুকু মেয়ের বাজানোর ক্ষমতা দেখে। তারপর কী হয়েছিল মনে নেই তার। বাঁ কানের ওপর একটা প্রচন্ড থাপ্পর খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল সে। জ্ঞান ফিরলে শুনেছে খানসামা নাকি তাকে দেখেছে সায়েবের মেয়েকে সে বদ মতলবে ফোঁসলাচ্ছিল। দেখে ধাপ্পর মেরেছে। সেই থেকে তার ও বাড়িতে যাওয়া বন্ধ। সেই থেকে বাঁ কানে আজ অবধি কিছু শুনতে পায় না লালা স্বরাজ।

ঐ ঘটনার পর ভীষণ এক আক্রোশ আর জেদ জন্ম নিয়েছিল তার মনে। মনে আছে, বাবা তাকে বেরুতে দিতেন না ছুটিবারেও।

একদিন বাবা খুব সাজ পোশাক করে বেরুলেন। বলে গেলেন, দূরে যাচ্ছেন তিনি। এ দুদিন যেন ভালো ছেলে হয়ে স্বরাজ তার চাচার সঙ্গে ঝাড়ামোছার কাজ করে। বাঁদরামো করলে বেঁধে রাখবেন শুয়োরের খোয়ারে।

পরদিন সকালে চাচার সঙ্গে কাজ করেছে স্বরাজ। চাচা হঠাৎ ঝাড়ু থামিয়ে বলল, এই শুনেছিস, তোর বাবা বর সেজে বিয়ে করতে গেছে।

যাহ।

বিশ্বাস হলো না, না? শালা যখন সত্যার হাতে পয়জার খাবি তখন বিশ্বাস হবে। নে বালতি তোল, কাজ কর।

বলেই পেটে এক লাথি। স্বরাজ বসে বসে মেঝে ঘষছিল, ঘোৎ করে মাটিতে পড়ে গেল। বালতি আঁকড়ে ধরে সামলাতে গিয়ে ময়লা পানিতে টাবুটুবু হয়ে গেল ঘর। তার জন্যে সায়েবের কাছে বকুনি খেতে হয়েছিল চাচাকে। বাবা সত্যি সত্যি বিয়ে করে ফিরলেন। চাচা শোধ নিল কথাটা লাগিয়ে। এমনিতেই নতুন মাকে দেখে ভয়ে ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল স্বরাজ। আর বিয়ের তাড়ি খেয়ে বাবার মেজাজ টং। স্বরাজকে ধরে এমন মার মারলেন, সে সেই যে বাড়ি থেকে বেরুলো আর ফিরল না।

বছর খানেক পশুর মতো এদিক ওদিক ঘুরে দশ বছরের স্বরাজ কী করে দৈবচক্রে পড়ে মালের জাহাজে পৌঁছুলো ত্রিনিদাদ। সেখানে সে বুঝতেও পারল না, এক পাদ্রীর পাল্লায়। পড়ে তার দীক্ষা হলো খ্রিষ্টান ধর্মে। এক রুটির দোকানে চাকরি করতে গিয়ে নিঃসন্তান মালিক তাকে নিলেন দত্তক পুত্র। তারই কল্যাণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ধাপ পর্যন্ত পড়াশোনা হলো স্বরাজের। রুটির দোকানের মালিক তাকে তার লালা উপাধি ছাড়া আর কিছুই দিয়ে যেতে পারেননি। লালা স্বরাজ তার মৃত্যুর পর দোকান বিক্রি করে লণ্ডনে এসে গায়ে গতরে খেটে শিখলো সাংবাদিকতা।

ত্রিনিদাদে যেদিন পা দিয়েছিল সেদিনই সে নিজেকে অনাথ বলে পরিচয় দেয়। লালা বিক্রমদেব তাকে অনাথ জেনেই দত্তক নিয়েছিল। অথচ স্বরাজ জানতো তার বাবা দশরথ আজো বেঁচে আছেন। বাবার জন্যে থেকে থেকে মনের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠত, লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত কিশোর স্বরাজ। কিন্তু কাউকে বলতে পারেনি। এটুকু জ্ঞান তার সেই বয়সেই হয়ে গিয়েছিল যে, পিতৃপরিচয় দিলে তাকে লালা বিক্রমদেবের আশ্রয় থেকে বেরিয়ে পথে। না খেয়ে মরতে হবে। সেটা দুকারণে। প্রথমত তার পিতা জীবিত। দ্বিতীয়ত, সে হরিজনের সন্তান। লালা বিক্রমদেব নিজে খ্রিষ্টান হলেও হরিজন থেকে যে ছেলে খ্রিষ্টান হয়েছে তাকে। পুত্র হিসেবে কেন, চাকর হিসেবেও বাড়িতে রাখবেন না।

সাংবাদিকতায় পাশ করে লালা স্বরাজ আর ত্রিনিদাদে ফিরল না। দীর্ঘ কুড়ি বছর পর ফিরে এলো করাচিতে। কাজ নিল এ শহরেই। আর খুঁজল তার বাবা দশরথকে। গিয়ে দেখল, সে। বস্তি কবে উঠে গেছে। কেউ বলতে পারল না দশরথের কথা।

সম্ভাব্য অসম্ভাব্য সমস্ত জায়গায় ঘুরেছে, করাচির একটা গলি খুঁজতে বাদ রাখেনি, কিন্তু সন্ধান পাওয়া যায়নি দশরথের। সমাজের যে স্তরে সে আছে, সেখান থেকে কুলি ধাঙড় ঝাড়ুদারের সমাজ অনেক দূরে। এ দূরত্ব হলো তার অনুসন্ধানের আরেক বাধা। মুখ ফুটে সে বলতে পারল না, আমি আমার বাবা দশরথকে খুঁজছি। দশরথের নাম চিহ্ন পরিচয় যেন এ পৃথিবী থেকে চিরদিনের মতো মুছে গেছে।

আজো সে কোন ধাঙড় ঝাড়ুদার দেখলে দাঁড়ায়। চোরের মতো চারদিক দেখে হাতে পয়সা গুঁজে দিয়ে জিগ্যেস করে দশরথ বলে কোনো বুড়োকে তারা চেনে কিনা। ঠিকানা দেয় নিজের। বলে দেয়, খোঁজ দিতে পারলে পাঁচ শ টাকা দেবে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে কেউ আর আসে না। আজ পাঁচ বছর হয়ে গেছে কেউ আসেনি।

তন্ময় হয়ে ভাবছিল লালা স্বরাজ। পেছনে একটা মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে সচকিত হয়ে ঘুরে দাঁড়াল। দেখল, রজনী। চাপা রংয়ের শাড়ি পরে, সজ্জা করে, চুলের বেণি বুকের পরে দুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নত চোখে। মধুর হেসে স্বরাজকে আপ্যায়ন করল সে। স্বরাজ বলল, অনেকক্ষণ লাগলো।

কই না তো।

শাড়ির আঁচল দিয়ে সারা শরীর ঢেকে কুণ্ঠার সঙ্গে উত্তর করল রজনী। কাজটা দেখে স্বরাজ শুধালো, আপনার কি খুব ঠাণ্ডা লাগছে?

কেন, না।

অমন জড়সড় হয়ে আছেন, তাই বললাম।

না, একটুও না।

বেশতো। তাহলে ভালো করে গুছিয়ে নিন আঁচলটা। বাঙালি মেয়ের শাড়ি পরা সারা বিশ্বের মেয়েরা লুফে নিচ্ছে, আর তার নমুনা এই!

রজনী অবাক হলো। তার সজ্জাই বা কী? যতটুকু আছে তা–ই যে একটা মানুষের মনোযোগ কেড়ে নেবে এটা তাকে সলজ্জ করল। মনটা উসখুস করে উঠল, যেন ভারী অপরাধ করে ফেলেছে সে। মৃদুকণ্ঠে বলল, কেন, এইতো ঠিক আছে।

উঁহু, ঠিক নেই। আঁচলটা অমন করে থাকবে কেন? বড় আনস্মার্ট লাগবে যে। শাড়ি অমন করে পরে নাকি কেউ? বাইরে দেখলে হাসবে।

কারা?

যারা হাসে। পোশাক তো সবাই পরে, তাই বলে সেটা সুন্দর করে পরতে হবে না?

আচ্ছা।

রজনী ভেতরে গিয়ে ঢং বদল করে এলো। এবারে সে আঁট করে পরেছে। হালকা লাগছে শরীর। আর বদলেছে গায়ের জামা। কেমন লজ্জা করছে তার। লালা স্বরাজ দেখে বলল, চমৎকার। এতক্ষণে মনে হচ্ছে, আপনার সব দুশ্চিন্তা গেছে। আগে মনে হচ্ছিল স্নান, প্রাণহীন। চলুন।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে লালা স্বরাজ তাকে হাত বাড়িয়ে সাহায্য করল। সংকোচ করতে গিয়ে তা জয় করল রজনী। লোকটার সবকিছুর মধ্যে এমন এক আন্তরিকতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে যা বিশ্বাস করতে মন সায় দিচ্ছে। তার মুঠোর মধ্যে রজনীর হাত এতটুকু কাঁপল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *