৩. ইয়াহিয়া তুমনে ইয়ে কিয়া কিয়া

২১. ইয়াহিয়া তুমনে ইয়ে কিয়া কিয়া

কাজলায় এসে ইতোমধ্যে সাঈদ এবং আনোয়ার স্থানীয় যুবকদের সংগঠিত করতে শুরু করেছেন। চেষ্টা করছেন দেশের ভেতরে থেকে কি করে অস্ত্র সংগ্রহ করা যায়। ডালিয়া আর জুলিয়াকেও ভারতেশ্বরী হোমস থেকে নিয়ে আসা হয়েছে কাজলায়। আর লুৎফা চেনা অচেনা মানুষের ভিড়ে বুকের ভেতর, চাপা আশঙ্কা, জীতি আর দুশ্চিন্তা নিয়ে শিশু জয়াকে দুধ খাওয়াচ্ছেন, শামলায় বসিয়ে গোসল করাচ্ছেন। তখনও জানেন না কোথায়, কি অবস্থায় আছেন তাহের? বিশাল এক কড়াইয়ে আশরাফুনেসা ডাল রান্না করেন বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া বিশাল একদল মানুষের জন্য। তার সহকারী মতির মাকে ধমকান, ডালটা ঠিক মতো বাগাড় দাও, ছেলেমেয়েগুলো আর কিছু তো খেতে পাবে না, সামান্য কিছু ভাল আর ভাত, এই তো।

জোৎস্না রাতে গোল হয়ে মাদুরে বসে লো ভলিউমে সবাই মিলে শোনেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। বাজে সমর দাসের গান-পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল, রক্ত লাল … একটা নিস্তব্ধতা নেমে আসে চারদিক, ঘন হয়ে আসে সবার নিঃশ্বাস। শুরু হয় এম আর আখতার মুকুলের চরমপত্র। মুখে চাপা হাসি নিয়ে শোনেন সবাইঃ

‘… লড়াইয়ের শুরুতে হেগো আরে চাপা রে চাপা, ওয়ার্ড এর বেস্ট সোলজারগো কাছে এরকম লড়াই এককোরে পানি পানি, দুশমনগো হাতে কোনো যন্ত্রপাতি নাইক্যা। নিয়াজি, টিক্কা, মিঠঠার দল ঘন ঘন সেনাপতি ইয়াহিয়ার কাছে মেসেজ পাঠাইলো বাহাত্তর ঘন্টার মইধ্যে সব কুছু ঠিক কবজা কইর লেংগে। তার পর বুড়িগঙ্গা দিয়া কত পানি গেলো, কত যে হত্তর ঘন্টা শেষ হইলো তার ইয়ত্তা নাই। কিন্তক বাংলাদেশ কন্ট্রোল হওয়া তো দূরের কথা অহন ডি কন্ট্রোল হইতে চলছে। পশ্চিম পাকিস্তান থনে মোট পাঁচ ডিভিশান সোলর আইছিল এর মধ্যে আড়াই ডিভিশান লাপাত্তা। পনের হাজার পুলিশ আনছে, টাঙ্গাইলে আতকা মাইর খাওয়ানের পর মুক্তি বাহিনীর নাম হুনলেই হেগো খালি পাও কাঁপে। নর্দান রেঞ্জের গিলগিট স্কাউট আর লাহোর রেঞ্জের বেটাগুলি ক্যান জানি না বাংলাদেশের দেড় হাতের মধ্যে যাইতেই চায় না। রাইত হইলেই খালি কান্দে। এই চার মাস ধইরা পিআই এর প্লেনগুলি পাকিস্তানের ফ্রাগ দিয়া ঢাকা ভোমা ভোমা লাশ গুলারে ঠেওয়াইতে ঠেওয়াইতে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড কইরা বইছে। আর হাসপাতাল গুলাতে নো ভেকেনসি। গতরে ব্যান্ডেজ বান্ধা বেটা গুলি খালি হুই হুই চিল্লাইতেছে আরে ইয়াহিয়া তুমুনে কিয়া কিয়া’।

পরিকল্পনা মতো ইতোমধ্যে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং শুরু হয়ে গেছে। ভারতীয় এবং বাংলাদেশের সেনা কর্মকর্তারা মিলে যুদ্ধের ট্রেনিং দিচ্ছেন ছাত্র, শ্রমিক, কৃষকসহ নানা পেশার তরুণদের। হাজার হাজার তরুণ সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছেন ওপারে প্রশিক্ষন নেবার জন্য। ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোতে তাদের জায়গা সংকুলান দূরহ হয়ে পড়ছে। হাতে রাইফেল আর স্টেনগান নিয়ে বিশাল প্রান্তরে শত শত যুবক সমস্বরে মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করছেন আমি শপথ করিতেছি যে, মাতৃভূমি শত্রুমুক্ত করার জন্যে জীবন উৎসর্গ করিব। বলকানো ঢেউ এর মতো অগণিত মানুষের টানা স্লোগান ওঠছে, জ…য় বাংলা।

কাজলার তরুণদের কাছে ঐ প্রশিক্ষণের খবর পৌঁছায়। বাহার আর বেলাল সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেবার জন্য ভারত যাবেন। আনোয়ার এবং সাঈদকে বললে তারা বিশেষ আগ্রহ দেখান না। আনোয়ার বলেন : আরেকটু বুঝে শুনে তারপর যাবে। তাহের ভাই আমাকে লিখেছিলেন যুদ্ধের ট্রেন্ডটার দিকে লক্ষ রাখতে। শুনেছি ইন্ডিয়ায় নাকি কমিউনিস্ট ছেলেদের ট্রেনিং এ নিতে চায় না। তোমরা যাও পরে আমি খোঁজ খবর নিয়ে আসছি।

মা আশরাফুন্নেসাকে জানালে তিনি বলেন : যা, তাড়াতড়ি ভালো মতো ট্রেনিং নিয়া পাঞ্জাবিগুলারে তাড়া।

ভারতের পথে রওনা দেন বেলাল আর বাহার। যেতে যেতে দেখেন মিলিটারির তাড়া খেয়ে শত শত মানুষ ঢলের মতো এগিয়ে চলেছে সীমান্তের দিকে। প্রতিদিনই হাজার হাজার উদ্ধাত্র মানুষ দেশ ছেড়ে তখন আশ্রয় নিচ্ছেন ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গে। অন্তহীন শরণার্থীর স্রোত হাজারের কোঠা ছাড়িয়ে পোঁছাছে লাখে।

এর মধ্যে একদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবরে শোনা যায়, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চার জন বাঙালি সেনা অফিসার পালিয়েছেন। তারা পালিয়ে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য ভারতে এসে পৌঁছেছেন। পালিয়ে আসা অফিসারদের নাম বলা হয় না। লুৎফা উৎফুল্ল হয়ে বলেন : আমি ঠিক জানি এই চার জনের মধ্যে একজন তাহের। আনোয়ার বলেন : ঠিকই বলেছেন ভাবী। আমরাও তাই মনে হচ্ছে।

আশরাফুন্নেসা বলেন অন্য কথা; আমারও মন বলতেছে নান্টু ঐ চার জনের মধ্যে আছে। কিন্তু তোমরা এত খুশি হইও না। বিপদও আছে। পাকিস্তান আর্মির কাছে নিশ্চয় নান্টুর গ্রামের বাড়ির ঠিকানা আছে, ওরা যখনই দেখবে নান্টু পালায়ে আসছে তখন ওরা ঠিকই কাজলায় খোঁজ করতে আসবে। ওরে না পাইলে ওর বৌ বাচ্চারে ধরেও নিয়ে যেতে পারে।

সম্বিৎ হয় সবার। তাই তো, এমন তো হতেই পারে!

আশরাফুন্নেসা লুৎফাকে বলেনঃ বউ মা তুমি আরও ভেতরের কোনো গ্রামে চলে যাও। এইখানে নিরাপদ না।

তাহেরের বাবার বন্ধু খাজা নেওয়াজ খান প্রত্যন্ত বুরবুরা সুনাই গ্রামে তার এক পরিচিতের বাড়িতে থাকবার ব্যবস্থা করেন। নেত্রকোণার শেষপ্রান্তে কলমা কান্দা থানার শনির হাওড়ের মাঝখানে দ্বীপের মতো বুরবুরা সুনাই গ্রাম। শিশু জয়া আর তাহেরের দুই বোন ডালিয়া ও জুলিয়াকে নিয়ে একটা ভাঙ্গা স্যুটকেসসহ সুক্ষা রওনা দেন পরদিনই। হাতে সামান্য কিছু টাকা, সুটকেসে দুটো মাত্র শাড়ি আর গ্রামের এক মহিলার কাছ থেকে ধার নেওয়া একটা বোরকা। দুর্গম পথ। প্রথমে ট্রেনে করে ঠাকুরাকোনা সেখান থেকে নৌকায় সাগরের মত উঁচু ঢেউয়ের শনির হাওর পাড়ি দিয়ে বুরবুরা সুনাই।

২২. অন্ধকার থেকে আলোয় অথবা অন্ধকারে

কোয়েটায় নজরবন্দি হয়ে আছেন তাহের। কোর্স বন্ধ হওয়াতে এক এক করে সবাই যার যার ইউনিটে ফিরে গেছেন। সিনিয়র টেকনিক্যাল কোর্সের অফিসাররা গিয়ে উঠেছেন কোয়েটার বিলাসবহুল হোটেল চিলতানে। কেবল একা সেখানে রয়ে গেছেন তাহের। সারাদিন বসে তিনি বিভিন্ন দেশের রেডিও শোনেন। কান পেতে থাকেন কোথাও বাংলাদেশের কোনো খবর পাওয়া যায় কিনা। মনে মনে খুঁজতে থাকেন পালাবার পথ। তিনি জানেন তাকে পালাতে হবে হয় আফগানিস্ত নি, নয়তো ভারতের মধ্য দিয়েই। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ পুরোপুরি শুরু হয়ে গেলে ভারত বা আফগানিস্তান কি ভূমিকা নেবে, সেটি বুঝে উঠবার চেষ্টা করেন তিনি। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সব খবর ভালোমত পাচ্ছেন না। এদিকে সামরিক ইন্টেলিজেন্সের লোকজন সবসময় নজর রাখছেন তাহেরের উপর।

কদিন পর তাহেরকে খারিয়ার পথে কোয়েটা এয়ারপোর্টে প্লেনে তুলে দেওয়া হয়। তাহের প্রতি মুহূর্তেই পালিয়ে যাবার সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। প্লেনে অল্প কয়জন যাত্রী। যাত্রীদের ব্যাপক তল্লাসি করা হয়। আগে ঠিক স্পষ্ট করে ভাবেননি কিন্তু প্লেনে উঠে হঠাৎ প্লেনটিকে ছিনতাইয়ের একটা সম্ভাবনার কথা ভাবতে থাকেন তাহের। প্লেনের একজন স্টুয়ার্ড বাঙালি। স্টুয়ার্ডটি কিছুক্ষণ পর এসে তাহেরের পাশে বসেন। দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করেন তাঁরা। একপর্যায় তাহের নিচুস্বরে স্টুয়ার্ডকে বলেন : ককপিটে ঢুকে পাইলটকে বাধ্য করা যায় না প্লেনটাকে ইন্ডিয়া নিয়ে ল্যান্ড করাতে? যাত্রী তো অল্প কয়জন, আমরা দুজন যদি ককপিটে ঢুকি একটা কিছু কিন্তু করে ফেলা সম্ভব।

স্টুয়ার্ড বলেন : একেবারে খালি হাতে তো এসব করা যাবে না। অস্ত্র ছাড়া এমন রিস্ক নেওয়া সম্ভব?

তাহের : আপনার কিচেনে ছুড়ি আছে না? স্রেফ দুটো ছুড়ি নিয়ে আসেন দেখেন আমি কি করি। 

স্টুয়ার্ডটি ককপিটের ভেতরে যান। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন তাহের। স্টুয়ার্ড আর ফেরেন না। প্লেন পৌঁছে যায় খারিয়ায়।

খারিয়ায় পৌঁছে তাহের খোঁজ পান ইতোমধ্যে আটক ফোর্টে তার ইউনিট দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়ান চলে গেছে পূর্ব পাকিস্তানে। খারিয়াতে একটা আর্টিলারি রেজিমেন্টের সঙ্গে কিছুদিন রাখা হয় তাহেরকে। তাহের তার পালানোর পরিকল্পনা অব্যহত রাখেন।

খারিয়ার বাঙালি অফিসারদের সঙ্গেও আলাপ করেন তাহের। পালানোর ব্যাপারে আগ্রহও দেখায় কয়জন কিন্তু চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে সাহসী হয় না কেউ। একদিন বাঙালি ক্যাপ্টেন দেলোয়ার খারিয়াতে এসে উপস্থিত। তিনি ছিলেন ঢাকার ইপিআর এ। ২৫ মার্চ রাতে তাকে গ্রেফতার করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। তাহের যান তার কাছে টাকার পরিস্থিতি জানতে।

ক্যাপ্টেন দেলোয়ার বলেন : ঢাকার অবস্থা আপনি চিন্তা করতে পারবেন না স্যার। রীতিমতো জেনোসাইড। বাঙালিরা পাল্টা আক্রমণের জন্য অর্গানাইজড হচ্ছে। উই মাস্ট জয়েন।

তাহের : আমি তো সেই প্রিপারেশনই নিচ্ছি, পালাবার পথ খুঁজছি। কেউ তো সাহস পাচ্ছে না। আমার উপর কড়া নজর রাখা হয়েছে।

দেলোয়ার বলেন : আমি আছি স্যার আপনার সঙ্গে। লেটস প্লান।

অনেক বুঝিয়ে ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী নামে আরেক বাঙালি অফিসারকে তারা এই পালাবার দলে আনতে সক্ষম হন। ক্যাপ্টেন দেলোয়ার আর পাটোয়ারী বিবাহিত। তাহের যদিও লুৎফাকে আগে পাঠিয়ে দিয়েছেন কিন্তু তিনি জানেন তার বিপদ দু রকমের পালাতে গিয়ে যদি ধরা পড়েন তাহলে কোনো বিচারের প্রশ্ন তো আসবেই না, স্রেফ হত্যা করা হবে তাকে আর পালাবার পর বর্বর নির্যাতন নেমে আসবে দেশে আত্মীয়স্বজন, স্ত্রী পরিবারের ওপর। তবু তাহের বোঝেন যে এই ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় নেই।

তাহের ক্যাপ্টেন দেলোয়ার আর পাটোয়ারীর সঙ্গে বসে নানাভাবে পালাবার রাস্তা খুঁজতে থাকেন। খরিয়াতে আসার সপ্তাহ দুয়েক পরই হঠাৎ তাহেরকে আবার বদলি করা হয় এবোটাবাদ বেলুচ রেজিমেন্টাল সেন্টারে। তাহের বুঝতে পারেন পাকিস্তানিরা তাকে সন্দেহ করছে সবসময়। তিনি ঠিক করেন খারিয়া থেকে এবোটাবাদ যাওয়ার এই পথেই পালিয়ে যাবার একটা ব্যবস্থা তাকে করতে হবে। ক্যাপ্টেন দেলোয়ার আর পাটোয়ারীর সঙ্গে আবার বসেন তাহের। এক পর্যায়ে চূড়ান্ত করেন পরিকল্পনা।

ঠিক করেন ক্যাপ্টেন দেলোয়ার আর পাটোয়ারী এসময় রাওয়ালপিন্ডি বেড়াতে যাওয়ার নামে কয়েকদিনের ছুটি নেবেন। তাহের যাবেন বদলি হতে, বাকি দুজন ছুটি কাটাতে, এই পরিকল্পনায় একসঙ্গে রওনা দেবেন তারা। তারপর আজাদ কাশ্মীর হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে যাবেন ভারত। তাহের ইতিমধ্যে ইসলামাবাদে তার বড় ভাই আরিফকে এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। আরিফ তখন সরকারের প্ল্যানিং কমিশনে কাজ করছেন। আরিফ লেখেন-আমিও ছুটি নিয়ে দেশে ফিরবার ব্যবস্থা করছি, হয়তো ছুটি পাবো, কিন্তু তোমাদের তো ছুটি দেবে না। তোমরা পালানোর চেষ্টা করো।

সব পরিকল্পনা শুনবার পর আরিফ নিজে উদ্যোগ নিয়ে সীমান্ত এলাকার পাঠানদের কাছ থেকে তিনটি রিভলবার কেনেন এবং তা এসে তুলে দেন ঐ তিন অফিসারের হাতে। বলেন, সঙ্গে রাখো কাজে লাগবে।

২৯ এপ্রিল বিকাল তিনটা। মেজর তাহের, ক্যাপ্টেন দেলোয়ার আর ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী তিনজনের এই দল শুরু করেন তাদের যাত্রা। সঙ্গে কিছু খাবার আর পানি। প্রথমে বাসে চড়ে তারা পৌঁছান মঙ্গলা বাঁধের পাশে আজাদ কাশ্মীরের ছোট্ট শহর মীরপুরে। ক্যান্টনমেন্টের অনারা জানেন তাহের যাচ্ছেন বদলির ব্যবস্থা করতে আর বাকি দুজন ছুটি কাটাতে।

তাদের পরিকল্পনা মীরপুরে নেমে বিকালটা কাটাবেন এক পরিচিত বাঙালি ইঞ্জিনিয়ারের বাড়িতে, তারপর সন্ধ্যা নামলে অন্ধকারে শহর ছেড়ে পাহাড়ের পথ ধরে সীমান্ত অতিক্রম করবেন। মীরপুর থেকে সীমান্ত ত্রিশ মাইলের মতো পথ, হেঁটেই ঐ পথ পাড়ি দেবেন বলে ঠিক করেন তারা। বাঙালি ইঞ্জিনিয়ারকে তাদের পরিকল্পনার কথা আগেই বলা ছিল কিন্তু মীরপুরে পৌঁছে দেখেন সেই ইঞ্জিনিয়ারের বাড়িতে তালা ঝুলছে। জানা গেল সপরিবারে রাওয়ালপিন্ডি বেড়াতে গেছেন তারা। ভয় পেয়েছেন বোধহয়? ভাবেন তিনজন। অগত্যা বিকালটা সেই লোকের বারান্দায় বসে গল্প করে কাটান তারা।

সন্ধ্যা নামে। এবার তাদের রওনা দেবার পালা। একটা ভয় কাজ করে সবার মধ্যে। অচেনা শহর। সীমান্তের দিকে যেতে হবে একটা বস্তি এলাকার ভেতর দিয়ে। কেউ যদি সন্দেহ করে বসে? প্রশ্ন করে বসে, কোথায় যাচ্ছে? কিন্তু পিছু হটবার আর কোনো উপায় নেই এখন। বস্তি পেরিয়ে যান তারা। সৌভাগ্যক্রমে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করে না। রাত নামে। মূল রাস্তা ছেড়ে সীমান্তের দিকে পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্য দিয়ে হাঁটতে শুরু করেন তিনজন। কিছুদূর হাঁটবার পর কোথাও আর কোনো আলোর রেশ নেই। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার চারদিকে, নির্জন, নিস্তব্ধ। অন্ধকারে দিক ঠাহর করে করে পাথুরে পাহাড়ের উঁচু নিচু পথ ধরে এগুতে থাকেন তারা। এলাকাটি যে এতটা পাথুরে ঠিক ধারণা ছিলনা তাদের। কিন্তু এভাবে অন্ধকারে পাথুরে পাহাড়ের পথ ধরে ত্রিশ মাইল পথ হাঁটা অসম্ভব একটি ব্যাপার তা অচিরেই টের পান তারা। ভাবেন মূল রাস্তা ধরেই আরও কিছুদূর হাঁটা যাক। মূল রাস্তা ধরে কিছুদূর গিয়ে তারা রাস্তার পাশে একটা সাইনবোর্ড দেখতে পান। অন্ধকারে বোঝা যায় না ভালো। এগিয়ে যান তাহের। দেখেন সাইনবোর্ডটিতে তীর চিহ্ন দিয়ে সাপ্লাই ইউনিটের পথ দেখানো আছে। এই সাপ্লাই ইউনিট সীমান্ত ঘাঁটিগুলোতে খাবার এবং অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করে থাকে। তারা বুঝতে পারেন খুব কাছাকাছি এই ইউনিটটি রয়েছে। ক্যাপ্টেন দেলেয়ার বলেন, স্যার আর এগুলে নির্ঘাত মারা পড়ব, সামনেই সাপ্লাইয়ের লোকজন।

তাহের : তাহলে কি করা যায়?

দেলোয়ার : ফিরে যাই চলেন।

তাহের : বল কি? এতটা পথ এসে ফিরে যাব? চুল আবার পাহাড়ের পথটায় চেষ্টা করি।

পাটোয়ারী : স্যার, থার্টি মাইলস ঐ পাথুরে পাহাড়ের রাস্তায়, সিম্পলি ইম্পসিবল। তাছাড়া আশপাশেই সাপ্লাই ইউনিট। খুব রিস্কি। লেট আস গো ব্যাক। অন্যভাবে চেষ্টা করি।

তাহের বলেন : প্রবাবলি ইউ আর রাইট। আমাদের রুটটা ঠিক হয়নি। নতুন করে ভাবতে হবে।

তারা মীরপুরে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। রাস্তায় একটা বাস পেয়ে যান ভাগ্যক্রমে। সে বাসে চড়ে তারা পৌঁছান লাহোর পিন্ডি গ্রান্ডট্রাঙ্ক রোডে। অচিরেরই আবার যোগাযোগ হবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তাহের চলে যান এবোটাবাদে আর ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী আর দেলোয়ার ফিরে যান খারিয়া ক্যান্টনমেন্টে। পশ্চিম। পাকিস্তান থেকে পালাবার প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হয় তাদের।

তাহের তার পালাবার পরিকল্পনা অব্যহত রাখেন। কোয়েটায় পারেননি, খারিয়ায় পারেননি, এবার এবোটাবাদে এসে চেষ্টা শুরু করেন। একা এতটা পথ যাবার ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয় তাই এবোটাবাদের বাঙালি অফিসারদেরও পালাতে উঁহুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাঙালি অফিসাররা ড্রইংরুমে চা, কফি খেতে খেতে পাকিস্তান আর্মির ওপর বিষোদগার করলেও অধিকাংশই পাকিস্তান থেকে পালাবার ব্যাপারে উৎসাহ দেখান না।

তাহের ওদিকে ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী আর দেলোয়ারের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখেন। রোববার ছুটির দিনে তাহের চলে যান পিন্ডিতে আর সেখানে খারিয়া থেকে আসেন ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী আর দেলোয়ার। তারা দেখা করেন ক্যাপ্টেন দেলোয়ারের বড় ভাই সাত্তার সাহেবের বাসায়। তিনিও সরকারি চাকরি করেন। তাহেরদের আলাপ শুনতে শুনতে সাত্তার সাহেবও এক পর্যায়ে তাদের সঙ্গে পালাবার সিদ্ধান্ত নেন। পরিকল্পনা মতো সাত্তার সাহেব তার ব্রিটিশ স্ত্রীকে পাঠিয়ে দেন লন্ডনে। দল ভারী করবার জন্য নানাদিকে আলাপ চালিয়ে যান তাহের।

রাওয়ালপিন্ডির জেনারেল হেডকোয়ার্টারে তখন চাকরি করেন মেজর জিয়াউদ্দীন। তাহেরের সঙ্গে আলাপের পর মেজর জিয়াউদ্দীনকেও পালিয়ে যাবার ব্যাপারে রাজি করাতে সক্ষম হন তাহের। তাহের, ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী, ক্যাপ্টেন দেলোয়ার, দেলোয়ারের ভাই সাত্তার এবং মেজর জিয়াউদ্দীন, পাঁচ জনের একটি দল দাঁড়ায় এবার। শুরু হয় আবার পালিয়ে যাবার পরিকল্পনা। এবার তারা ঠিক করেন শিয়ালকোটের পথে সীমান্ত অতিক্রম করবেন। মেজর জিয়াউদ্দীন জেনারেল হেডকোয়ার্টারস থেকে একটা ম্যাপ যোগাড় করেন। দিক নির্ণয়ের জন্য একটা জাপানি খেলনা কম্পাস কেনেন তাহের। সিদ্ধান্ত হয় প্রথমে তারা বাসে যাবেন শিয়ালকোট।

তাহের বলেনঃ কিন্তু এভাবে পাঁচ জন বাঙালি একসঙ্গে একটা বাসে যাচ্ছে এতে কি একটা সন্দেহ তৈরি হতে পারে না? কথা ঠিক-সমর্থন করেন সবাই। বাসে যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ হয়।

তাহের বলেনঃ সবাই মিলে নিজেরাই একটা পুরোন গাড়ি কিনে ফেললে কেমন হয়? ওটা নিয়েই চলে যাব বর্ডার?

জিয়াউদ্দীন বলেন : গুড আইডিয়া, লেট আস অল কন্ট্রিবিউট।

এরপর যার যার সাধ্যমতো টাকা দিয়ে কিনে ফেলেন একটা পুরনো ভক্সওয়াগন। সিদ্ধান্ত হয় ঐ ভক্সওয়াগন চড়েই বেড়াবার নাম করে সবাই চলে যাবেন সীমান্তের কাছে। তারপর পাড়ি দেবেন সীমান্ত। পুরো ব্যাপারটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ধরা পড়লে ফায়ারিং স্কোয়াড। সর্তকতার সাথে সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকেন তারা।

এর মধ্যে একদিন বেলুচ রেজিমেন্টের সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ওসমান ডেকে পাঠান তাহেরকে। তাহেরকে তিনি বলেন, তোমার স্ত্রীকে এখানে নিয়ে আস্ না কেন। ঢাকায় তো নানা গন্ডগোল হচ্ছে, এখানে সে নিরাপদে থাকবে।

বাঙালি অফিসারদের পালানোর ব্যাপারটি নিয়ে আর্মিতে তখন বেশ কথা হচ্ছে। তাহের টের পান, সে যাতে পালাতে না পারেন ব্রিগেডিয়ার ওসমান সেজন্যই তাগাদা দিচ্ছেন তার স্ত্রীকে নিয়ে আসবার জন্য।

তাহের বলেঃ দেখি স্যার চেষ্টা করছি।

এসময় হঠাৎ করেই কাকুল মিলিটারি একাডেমীতে এসে কয়েকদিনের জন্য থাকেন জেনারেল ইয়াহিয়া, জেনারেল হামিদসহ আরও কয়েকজন জেনারেল। গুজব রটে যে শেখ মুজিবর রহমানকে কাবুলে আনা হচ্ছে আলোচনার জন্য। তেমন কিছু অবশ্য ঘটে না।

জুলাই মাস চলে আসে। উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে তাহেরের। এই সময় তাহের বাড়ি থেকে একটা চিঠি পান। ২৫ মার্চের পর প্রথম চিঠি। প্রথম বাড়ির খোঁজ পান তাহের। জানতে পারেন ছয় এপ্রিল জয়ার জন্ম হবার খবর। জানতে পান তাদের দুর্দশা আর যুদ্ধের ভয়াবহতার খবর। মন আরও বিষণ্ণ, ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে তাহেরের। তাদের প্রথম সন্তানের মুখ দেখার জন্য মন উচাটন হয়ে ওঠে তার। তাহের সিদ্ধান্ত নেন যে করে হোক এই জুলাই মাসের মধ্যেই তাকে পালাতে হবে।

কদিন পর তাহের ব্রিগেডিয়ার ওসমামকে গিয়ে এক মিথ্যা খবর দেন। বলেন, স্যার আমি আমার স্ত্রীকে এখানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছি। তেইশে জুলাই আমার স্ত্রী করাচিতে আসছে। আমি তাকে রিসিভ করতে যেতে চাই।

ব্রিগেডিয়ার ওসমান খুবই উৎফুল্প হয়ে উঠেন : ভেরি গুড। তৎক্ষণাৎ তাহেরকে দশ দিনের ছুটি দিয়ে দেন তিনি। তাহের স্থির করে ফেলেন এই দশ দিনের মধ্যেই তাকে পালাতে হবে পাকিস্তান থেকে।

তেইশ তারিখেই তাহের এবোটাবাদ থেকে রওনা দিয়ে বিকেলে পোঁছান পিন্ডি। সেখানে মেজর জিয়াউদ্দীনকে সঙ্গে নিয়ে তাহের দেখা করেন ব্রিগেডিয়ার খলিলের সঙ্গে। ব্রিগেডিয়ার খলিল সামান্য কয়জন বাঙালি অফিসারদের একজন যিনি ব্রিগেডিয়ারের মতো আর্মির ঐ উঁচু র‍্যাঙ্কে উঠতে পেরেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। তার অবস্থানের কারণে সে সময় তার পক্ষে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ছিল দুষ্কর কিন্তু জুনিয়র অফিসারদের পালিয়ে যাবার ব্যাপারে তিনি সহায়তা করছিলেন। ব্রিগেডিয়ার খলিল তাহেরকে। বলেন, কাছাকাছি তোরখান সীমান্ত দিয়ে পার হলে তোমরা সহজে কাবুল পৌঁছাতে পারবে।

ব্রিগেডিয়ার খলিল আরও বলেন, তাদের গাইড হিসেবে তিনি একজন পাঠান ন্যাপ কর্মীকে সঙ্গে দিয়ে দেবেন। তাছাড়া কাবুলের ভারতীয় দূতাবাসে সাত্তার সাহেবের একজন পরিচিত লোক ছিলেন, তিনি তাদের নির্বিঘ্নে ভারত হয়ে বাংলাদেশ চলে যাবার ব্যবস্থা করে দেবেন বলেও জানান।

এ পরিকল্পনায় জিয়াউদ্দীন বেশ উৎফুল্ল হলেও তাহের বিশেষ উত্সাহ বোধ করেন না। বিশেষ করে একজন পাঠান গাইডকে বিশ্বাস করতে মন সায় দেয় না

তাহের ব্রিগেডিয়ার খলিলকে বলেন; আমরা বরং আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী অগ্রসর হই। শিয়ালকোট সীমান্তটা জিয়াউদ্দীনের ভালো চেনা আছে। এদিকে যদি ফেইল করি তাহলে কাবুলের পথে চেষ্টা করব আবার।

ব্রিগেডিয়ার খলিলকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাহের এবং জিয়াউদ্দীন বেরিয়ে পড়েন শহরে। তাহের এবং জিয়াউদ্দীন সে রাতে একবার পিন্ডি ক্লাব, একবার পিডি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে হৈ হৈ করে বেড়ান। তাদের মনে গোপন উত্তেজনা। তারা জানেন এটাই পাকিস্তানে তাদের শেষ রাত, কাল ভোরেই সীমান্ত পাড়ি দেবেন তারা। অনেক রাতে পিন্ডি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে এসে উপস্থিত হন ক্যাপ্টেন দেলোয়ার এবং আর তার ভাই সাত্তার। তাদের সঙ্গে বিস্ত রিত আলাপ হয় তাহের এবং জিয়াউদ্দীনের। ক্যাপ্টেন দেলোয়ার এবং তার ভাই সাত্তার কাবুল হয়ে পালানোর পথটিকেই উপযুক্ত মনে করেন। বিস্তারিত আলাপের পর সিদ্ধান্ত হয় ক্যাপ্টেন দেলোয়ার এবং তার ভাই কাবুলের পথেই যাবেন আর তাহেররা যাবেন শিয়ালকোটের পথে।  

মধ্যরাত পেরিয়ে তারা দুজন ফিরে আসেন জিয়াউদ্দীনের কোয়ার্টারে। এসে দেখেন জিয়াউদ্দীনের রুমে ঘুমিয়ে আছেন আরেক বাঙালি ক্যাপ্টেন মুজিব। অন্য শহর থেকে রোববারের ছুটির দিনে সাধারণত এমন অনেক অফিসার চলে আসেন জিয়াউদ্দীনের বাসায়। ক্যাপ্টেন মুজিবকে দেখে বেশ বিরক্ত দুজন, বাঙালি হলেও মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানি ঘেষা। তাকে সব কিছু খুলেও বলা যাবে না। পরদিন ভোরে পালাবেন তাঁরা অথচ এই মুহূর্তে সে এসে হাজির। মুজিবকে তারা আর ঘুম থেকে তোলেন না। পাশের ঘরে চুপচাপ শুয়ে পড়েন দুজন। ঘুম আসে না কাবোরই। তার মধ্যে কাটে খানিকটা সময়।

অনেক ভোরে তাহের উঠে যান, ডেকে তোলেন জিয়াউদ্দীনকে। সঙ্গে কিছু নেবার উপায় নেই। যদিও তারা গাড়িতে যাবেন অনেকটা পথ কিন্তু সীমান্তের কাছে গিয়ে তাদের বন বাদাড়, খানাখন্দের মধ্যে দিয়েই হেঁটে যেতে হবে অনেক মাইল। কোনো বোঝা বওয়া তখন সম্ভব নয়। সঙ্গে টাকা রইল প্রয়োজনে ভারত থেকে কিনে নেবেন। তবে এবোটাবাদ থেকে একটা জিনিস কিছুতেই ফেলে আসতে মন চায় না তাহেরের। লন্ডন থেকে লুৎফার জন্য কেনা শখের সেই কার্ডিগেন দুটো যা লুত্যা সঙ্গে করে নিয়ে যায়নি, বলেছে তাকে নিয়ে যেতে। ঘর থেকে বেরুবার সময় কার্ডিগেন দুটো একটা ব্যাগে ভরে নেন তাহের আর সঙ্গে নেন আরিফ ভাইয়ের দেওয়া পিস্তলটি।

ঘরে ক্যাপ্টেন মুজিবকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে সন্তর্পণে বেরিয়ে পড়েন তাহের আর জিয়াউদ্দীন। বাইরে পার্ক করা তাদের সদ্য কেনা পুরনো ভক্সওয়াগনটি। ড্রাইভিং সিটে তাহের। একটু একটু করে ভোরের আলো ফুটছে। শাঁ শাঁ করে এগিয়ে চলে গাড়ি। ভক্সওয়াগনটি পুরনো হলেও চলছে বেশ ভালো। সকালে নাস্তা কিছু খাওয়া হয়নি। গুজরাওয়ালার কাছাকাছি এসে গাড়ি থামিয়ে রাস্তার পাশে একটা দোকান থেকে চা বিস্কুট খেয়ে নেন তারা। পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলে কি বলবেন, গাড়িতে যেতে যেতে তার একটা গল্পও বানিয়ে রাখে দুজন। ঠিক হয় জিয়াউদ্দীন বলবেন তিনি যাচ্ছেন লাহোরে ছুটি কাটাতে আর তাহের বলবে, তিনি যাচ্ছেন শাহোর থেকে পি আই এর নাইট কোচ ধরে করাচি গিয়ে আর স্ত্রীকে আনতে।

ইতোমধ্যে তাদের আরেক সঙ্গী ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী খারিয়া থেকে বদলি হয়েছেন ঝিলমে। তাহের এবং জিয়াউদ্দীন ঠিক করেন শিয়ালকোট যাবার পথে ঝিলম থেকে তুলে নেবেন পাটোয়ারীকে। কিন্তু সেদিন যে ওরা পাটোয়ারীর ওখানে যাচ্ছেন সে খবর পৌঁছাতে পারেননি আগে। সেদিন রোববার সকাল। তাহের এবং জিয়াউদ্দীন ঝিলমে পাটোয়ারীর ওখানে পৌঁছে দেখেন ছুটির দিনে কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদের নিয়ে গল্প করছেন পাটোয়ারী। মুস্কিলে পড়ে যান, কি করে এখন পাটোয়ারীকে ওখান থেকে তুলে আনা যাবে? তাহের শেষে ওদের মধ্যে গিয়ে বলেন : তোমরা কিছু মনে করো না, আমরা একটা নতুন গাড়ি কিনেছি, পাটোয়ারীকে ওটা একটু দেখাতে চাই। একটা রাউন্ড ঘুরিয়েই ওকে আবার পৌঁছে দিয়ে যাবো তোমাদের কাছে।

পাটোয়ারী গাড়িতে উঠতেই তাহের বলেন : আমরা কিন্তু আর ফিরছি না। আমরা এখন শিয়ালকোটের পথে, ওখান থেকে বর্ডার ক্রস করব।

পাটোয়ারী বলেন তাই? ঠিক আছে কিন্তু আমার একটু ব্যাংকে যেতে হবে। হাজার পাঁচেক টাকা আছে ওগুলো তুলে নেই।

জিয়াউদ্দীন : আজকে তুমি টাকা তুলবে কি করে, আজ তো রোববার, সব বন্ধ।

পাটোয়ারী : ও ড্যাম। এতগুলো টাকা?

তাহের : বাদ দাও। আমাদের কাছে টাকা আছে বাংলাদেশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারব।

এভাবেই একেবারে খালি হাতে বন্ধুদের আড্ডা থেকে উঠে এসে পাটোয়ারী যোগ দেন সীমান্ত অতিক্রমের অভিযানে। দুপুর নাগাদ তারা পৌঁছান শিয়ালকোট সীমান্তের কাছাকাছি। তারা জানেন যে এ এলাকায় পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়ান এবং একটি আর্টিলারি রেজিমেন্ট সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে। ওখান থেকে রাস্তা ছেড়ে পায়ে হেঁটে মাইল দশেক পুবে হাঁটলে তারা সীমান্ত অতিক্রম করে ঢুকে যেতে পারবেন ভারতীয় অঞ্চলে। দুই দিকে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে গভীর রাতে এই পথটুকু অতিক্রম করবেন তারা। শিয়ালকোট ক্যান্টনমেন্টে তখন আছেন মেজর মঞ্জুর। তারা ঠিক করেন দিনের বাকিটা সময় মেজর মঞ্জুরের ওখানে কাটিয়ে সন্ধ্যার পর রওনা দেবেন সীমান্তের দিকে। জিয়াউদ্দীন, তাহের আয় পাটোয়ারীকে দেখে খুবই খুশি হন মঞ্জুর। মঞ্জুরের স্ত্রী তাদের আপ্যায়ণ করেন। বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করেন তারা। এক পর্যায়ে তাহের মজুরকে জানান তাদের পুরো পরিকল্পনার কথা। বলেন, ইন ফ্যাক্ট, আজ রাতেই আমরা বর্ডার ক্রস করছি? তাহের মরকে বলেন, তুমি যাবে আমাদের সঙ্গে?

মজুরের ঘরে তখন তিন বছরের একটি মেয়ে আর মাস কয়েকের একটি ছেলে।

মঞ্জুর বলেন : এই ছোট ছোট বাচ্চাগুলো নিয়ে কি করে এতবড় একটা রিস্ক নেই।

এসময় মঞ্জুরের স্ত্রী ঘুরে এসে দাঁড়ান : এখানেও কি কম রিস্ক? আপনারা সত্যি সত্যি যাচ্ছেন? আমি যাব আপনাদের সঙ্গে।

মঞ্জুর : রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে দশ মাইল হাঁটতে হবে। এই বাচ্চাগুলো নিয়ে সেটা সম্ভব?

মঞ্জুরের স্ত্রী : খুব সম্ভব। আমি পারব। তুমি না যাও আমি ওনাদের সঙ্গে চলে যাবো।।

মঞ্জুর তার স্ত্রীকে শান্ত হতে বলেন। অন্যদের বলেন : যেতেই যদি হয় তাহলে তোমরা যে রুটের কথা বলছ তার চেয়েও সহজ একটা রুট আছে।

মঞ্জুর ঘর থেকে একটা ম্যাপ নিয়ে আসেন। দেখান তারা যদি শিয়ালকোট-জাফরওয়ালার সীমান্ত রাস্তা দিয়ে এগোন তাহলে একটা জায়গায় পৌঁছাবেন যেখান থেকে ভারতের সীমান্ত খুবই কাছে। ম্যাপে জায়গাটি দেখান মঞ্জুর। বলেন ওখান দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেওয়া সহজ হবে। তাহের, জিয়াউদ্দিন সে পথেই যাবেন বলে ঠিক করেন। কিন্তু মধুর তখনও মনস্থির করতে পারেননি আদৌ যাবেন কিনা। আলাপে আলাপে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত তখন আটটা। তাহের অধৈর্য হয় উঠেন, বলেন, নষ্ট করার সময় আমাদের হতে নাই। রাত নটার আগে বেরুতেই হবে। তুমি স্পষ্ট বলে দাও যাবে কি যাবে না?

মরের স্ত্রী তখন বলে উঠেন : অবশ্যই যাবে। আমরা সবাই যাবো।

মঙুর খানিকটা দ্বিধান্বিত থাকলেও তার স্ত্রীর উদ্দীপনা এবং সাহসের কাছে পরাজিত হন। যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তড়িঘড়ি করে সবাই কিছু খেয়ে নেন। সঙ্গে করে বেশি কিছু নেবার সুযোগ নেই। তারা শুধু বাচ্চার কিছু পোশাক আর খাবার সঙ্গে নিয়ে নেন। বেরুতে যাবেন এমন সময় সমস্যা বাঁধে মঞ্জুরের ব্যাটম্যান আলমগীর খানকে নিয়ে। আলমগীর বাঙালি কিন্তু তাকে এর আগে এসব নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। জানলে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে বুঝতে পারছিলেন না তারা। কিন্তু না বলে উপায় নেই। শেষে সবার সামনে তাকে পালাবার ব্যাপারটি বলা হয়। সব কিছু শুনে আলমগীরও তাদের সঙ্গে সীমান্ত পাড়ি দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আলমগীরকে বলা হয় তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নিতে। এবার ছুটিতে বাড়ি গিয়ে আলমগীরের বিয়ে করার কথা, হবু বউয়ের জন্য কটা শাড়ি কিনেছেন তিনি, তাড়াতড়ি সেগুলো একটা ব্যাগে ভরে নেন আলমগীর আর সঙ্গে নেন একটা ছুড়ি।

রাত পৌনে নয়টায় কোনো রকম চাপাচাপি করে সবাই উঠে যান। ভক্সওয়াগানে। গাড়ি রওনা দেয়। গাড়িতে উঠবার আগে মিসেস মঞ্জুর বাচ্চা দুটাকে শান্ত রাখবার জন্য ঘুমের ঔষধ খাইয়ে নেন। যাতে কোনো সন্দেহ না জাগে সেজন্য মিসেস মঞ্জুর নিজে পড়ে নেন একটি বোরকা। গাড়ি চলছে শিয়ালকোট থেকে জাফরওয়ালার পথে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার চারদিকে। একটু আধটু বৃষ্টিও হচ্ছে। হেড লাইটে ভেজা পথ। পালাবার জন্য উপযুক্ত সময়। শিয়ালকোট ক্যান্টনমেন্ট পার হয়েই একটা এমপি চেক পোস্ট অতিক্রম করতে হবে তাদের। ভাব দেখান যেন তারা সেখানকারই বাসিন্দা, জাফরওয়াল যাচ্ছেন বেড়াতে। সন্দেহ এড়াবার জন্য বেশ কিছু পাঞ্জাবি শব্দও রপ্ত করে নেন তাহের। তখন বেশ বৃষ্টি হচ্ছে বলে চেকপোস্টের মিলিটারি পুলিশ রাস্তায় না দাঁড়িয়ে চেকপোস্টের ভেতরে বসে আছেন। পুলিশেরা ওদের গাড়িকে দাঁড়াতে না বলে ভেতর থেকেই হাত দিয়ে ইশারা করে বলেন, যাও যাও। গাড়ির সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

শিয়ালকোট জাফরওয়ালের মাঝামাঝি জায়গায় এসে তারা পৌঁছান রাত পৌনে দশটার দিকে। রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করে রাখেন। এখান দিয়েই পায়ে হেঁটে সীমান্ত পাড়ি দিতে হবে সবার। তখনও টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে, অন্ধকার চারদিকে। সবাই নীরব, কেউ নামছেন না গাড়ি থেকে। চাইলে এখনও শিয়ালকোট ক্যান্টনমেন্ট ফিরে যেতে পারেন। সিদ্ধান্তের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সবাই। একটা লরি হেডলাইটের তীব্র আলো ফেলে দ্রুত পেরিয়ে যায় তাদের গাড়ি। তাহের সবাইকে তাড়া দেন। এভাবে এখানে বেশিক্ষণ বসে থাকা ঠিক না, আমাদের এখনই নেমে পড়া উচিত। এক এক করে সবাই গাড়ি থেকে নেমে অন্ধকারে মাঠের পাথে হাঁটতে শুরু করেন। সদ্যকেনা ভক্সওয়াগন পড়ে থাকে রাস্ত রি পাশে।

শিয়ালকোট জায়গাটা বেশ নিচু। ভালো ধান হয় বলে এ অঞ্চলের খ্যাতি আছে। ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়েই হাঁটতে শুরু করেন তারা। মাঠ কাদায় ভরা। বেশ কিছুদূর হাঁটার পর রাতের অন্ধকারে সবাই দিক হারিয়ে ফেলেন। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, দিক বুঝবার জন্য ধ্রুবতারাটিও দেখা যাচ্ছে না। এসময় আসবার আগে কেনা জাপানি খেলনা কম্পাসটি বেশ কাজে দেয়। মঞ্জুর বলেন উত্তর দিকে মাইল তিনেক হাঁটলেই ঢুকে পড়া যাবে ভারতীয় সীমান্তে। সবার আগে তাহের। আর এক হাতে কম্পাস, অন্য হাতে রিভলবার। একটু পরে সহসা মঞ্জুরের ঘোট বাচ্চাটি কেঁদে ওঠে। ভয় পেয়ে যান সবাই। মঞ্জুরের স্ত্রী মুখ চেপে ধরবার চেষ্টা করে। এসময় প্রচণ্ড জোরে বাজ পড়ে একটি। বাজের প্রকট শব্দে ভয় পেয়ে চুপ হয়ে যায় শিশুটি। আর কাঁদে না। কিছুদূর যাবার পর আরেক বিপত্তি ঘটে। মিসেস মঞ্জুরের একটি ক্যানভাসের জুতা এমনভাবে কাদার ভেতর ঢুকে যায় যে সেটাকে আর তুলে আনা সম্ভব হয় না। খালি পায়ে ঐ মাঠে হাঁটা নেহাতই অসম্ভব। শেষে মঞ্জুর কাঁধে তুলে নেন স্ত্রীকে। একটা বাচ্চাকে কোলে নেন তাহের আরেকটিকে ব্যাটম্যান আলমগীর। কিন্তু একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষকে কাঁধে নিয়ে ঐ কাদায় দীর্ঘক্ষণ হাটা দুরূহ ব্যাপার। এক পর্যায়ে তাহের বলেন : ভাবী ইফ ইউ ভোন্ট মাইন্ড, আমার কাঁধে চলে আসুন, মরকে একটু রিলিফ দেই।

ঐ দুর্যোগে মাইন্ড করবার কোনো পরিস্থিতি নেই। বাচ্চাটিকে মঞ্জুরের কোলে দিয়ে আহত সহযোদ্ধাকে বয়ে নেওয়ার কমভো কায়দায় তাহের কাঁধে তুলে নেন মিসেস মঞ্জুরকে। তাহেরের কাঁধে ছিল সেই ব্যাগ যাতে গোপনে নিয়ে আসা সুক্ষার প্রিয় কার্ডিগেন দুটো। কিন্তু মিসেস মঞ্জুরকে কাঁধে নিয়ে ঐ ব্যাগ বহন করা হয়ে ওঠে দুষ্কর। তাহের ব্যাগটিকে ফেলে দিতে বাধ্য হন। অক্সফোর্ড থেকে কেনা সোনালি স্মৃতিময় কার্ডিগেন পড়ে থাকে শিয়ালকোট সীমান্তের অন্ধকার ধানক্ষেত।

পাকিস্তানি দুটি ঘাঁটির মাঝখান দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করছেন তারা। ঘণ্টা খানেক হাঁটবার পর তাহের বলেন, মনে হচ্ছে বর্ডার ক্রস করে গেছি। মঞ্জুর বলেন, না, এখনও পাকিস্তান এরিয়ার মধ্যেই আছি, আমাদের আরও ডান দিকে হাঁটতে হবে। মঞ্জুর কাজের সুত্রে এ এলাকায় আগেও এসেছেন, ফলে তার কথা মেনে সবাই ডানদিকে হাঁটতে শুরু করেন। আরও ঘণ্টা খানেক হাঁটার পর হঠাৎ আবিষ্কার করেন তারা একটি পাকিস্তানি সীমান্ত ঘাঁটির কাছে চলে এসেছেন। সবাইকে ঝোঁপের আড়ালে বসিয়ে রেখে, তাহের এগিয়ে গিয়ে সন্তর্পণে এলাকাটি দেখে আসেন। তিনি দূরে সীমান্ত ঘাঁটির আলো দেখতে পান, কাছাকাছি একটা সীমান্ত খুঁটিও দেখা যায়। এই খুঁটি পেরিয়েই তাদের আস্তে আস্তে ঢুকে পড়তে হবে ভারতীয় এলাকায়। ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে সবাই হাঁটতে শুরু করেন আবার। এবার পথ শুকনো হওয়াতে মিসেস মঞ্জুর নিজেই হাঁটতে শুরু করেন। বাচ্চা দুটোকে অদলবদল করে কোলে নেন মঞ্জুর, জিয়াউদ্দীন, পাটোয়ারী, আলমগীর। বহু বছর পর একদিন আবার এমনি স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে মঞ্জুর চট্টগ্রামের জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াবেন এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর। ধরা পড়বেন মঞ্জুর এবং হত্যা করা হবে তাকে। সে এক ভিন্ন প্রেক্ষাপট।

কিন্তু এখন তারা সীমান্ত খুঁটি পেরিয়ে ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছেন ভারতীয় এলাকায়। ঝুঁকি আছে তখনও। যে কোনো মুহূর্তে ধরা পড়ে যেতে পারেন সীমান্ত টহলকারীদের হাতে। ঐ অঞ্চলের মানুষেরা ক্ষেতে কাজ করবার জন্য মাঠের মধ্যেই ছোট ছোট ঘর বানিয়ে রাতে থাকেন, তাদের সামনেও পড়ে যেতে পারেন। তারা নিঃশব্দে একগ্র চিত্তে লাইন ধরে সোজা এগিয়ে যেতে থাকেন উত্তরের দিকে। বাত দুটার দিকে তারা একটা শুকনো খালের পাড়ে এসে উপস্থিত হন। খালের ভেতর নেমে টর্চ জ্বালিয়ে আবার হাতের ম্যাপটিকে দেখে নেন তাহের। টের পান ঠিক পথেই এসেছেন। পাকিস্তান সীমান্ত পেরিয়ে প্রায় মাইল তিনেক ভারতীয় এলাকার ভেতরে ঢুকে গেছেন তারা। বেশ কিছুটা দূরে দেখতে পান ভারতের দেবীগড়ের সীমান্ত ঘাঁটি। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন সবাই। মিসেস মঞ্জুর তার ঘুমন্ত বাচ্চা দুটোকে শুইয়ে দেন একটা গাছের নিচে। ক্লান্তিতে অন্যরাও বসে পড়েন। সকাল হলেই তারা যোগাযোগ করবেন দেবীগড় সীমান্ত ঘাঁটির সঙ্গে। এক অচেনা গাছের নিচে সবাই অধীর আগ্রহে বসে থাকেন ভোরের আলো ফুটবার আশায়।

একটি ঘোর লাগা পতঙ্গের মতো তাহের যেন ছুটে চলেছেন আলোর শিখার দিকে, তার জন্য নির্দিষ্ট ভবিতব্যের দিকে।

২৩. রাতের কড়া নাড়া

একদিন অনেক রাতে কাজলার বাড়িতে কড়া নাড়ার শব্দ। আশ্রাফুন্নেসা দরজা খুলে দেখলেন অন্ধকারে কাঁধে স্টেনগান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজন যুবক। একে একে ঘুম থেকে উঠে অন্যরাও–সাইদ, আনোয়ার, তাহেরের বাবা। মুক্তিযোদ্ধা দুইজন জানান তারা ভারত থেকে এসেছেন। ময়মনসিংহের সীমান্তের ১১ নং সেক্টরের অধিনায়কের দ্বায়িত্ব নিয়েছেন মেজর তাহের। তিনি তাদের পাঠিয়েছেন সবাইকে ভারতে নিয়ে যাবার জন্য।

মনে মনে এমন একটা সংবাদের জন্য পরিবারের সবাই অপেক্ষা করছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতারে পাকিস্তান থেকে বাঙালি অফিসারের পালানোর খবর শুনবার পর থেকেই। সবার ঘুম ভাঙ্গা চোখ কিন্তু মনে প্রশান্তি। তবে তাহেরের বাবা, মা কাজলা ছেড়ে কোথাও যেতে চাইলেন না। আশরাফুন্নেসা বললেন : বিপদ যাই হোক আমি এই ভিটা ছেড়ে যাব না। সাঈদ তুই লুৎফাকে নিয়ে চলে যা ইন্ডিয়ায়।

ঠিক হলো সাঈদ এবং লুৎফার ভাই সাবির লুৎফাকে বুরবুরা সোনাই গ্রাম থেকে নিয়ে ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করবেন। আর আনোয়ার ইউসুফ ভায়ের স্ত্রীকে তাদের নানা বাড়ি কটিয়াদির পিরগাও গ্রামে রেখে তারপর রওনা দেবেন ভারতে। ইউসুফ ভাইয়ের কোনো খবর তখনও তারা কেউ জানেন না।

এদিকে বুরবুরা সোনাই গ্রামেও আরও একটি রাত নামে। সেখানে আত্মগোপন করে আছেন সুফা। যেমন করে কাজলায় সেভাবেই একদিন গভীর রাতে লুৎফার ঘরে কড়া নাড়ার শব্দ। তখন পুরো দেশের মানুষ যে যেখানে আছেন সবাই আধো ঘুমের ভেতর রাত কাটান। সবাই সর্বক্ষণ যে কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য প্রস্তুত। লুকা উঠে দেখেন তার ঘরের উঠানে দেবর সাঈদ আর ছোট ভাই সাব্বির চাদর মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে। ভেতরে গিয়ে বসেন তারা। ঘুম ঘুম চোখে তাদের কাছ থেকেই লুৎফা প্রথমে জানতে পারেন তাহেরের ময়মনসিংয়ের সীমান্ত এলাকা ভারতের তুরায় আসবার খবর।

কথামতো তারা সীমান্ত পাড়ি দেবার আয়োজন করেন। সাঈদ, সাব্বির মিলে লুৎফা আর তাহেরের বোন ডালিয়া আর জুলিয়া ওরফে ডেলি, জলিকে তুরায় পৌঁছে দিয়ে আসবার প্রস্তুতি নেন। নৌকা ভাড়া করা হয়। যাবার দিন গ্রামের মহিলার কাছ থেকে ধার করা বোরাটি পড়ে নেন ফা। ডলি আর জলি গায়ে পড়ে নেয় ছেঁড়া, ফাটা দুটো জামা যাতে তাদের দেখায় দরিদ্র ঘরের মেয়েদের মতোই। সঙ্গে তিন মাসের শিশু জয়া। রওনা দেন সাগরের মতো বিশাল ঢেউয়ের সেই শনির হাওর পাড়ি দিতে। হাতে অল্প কিছু টাকা আর সাথে নেওয়া চিড়া আর গুড়। দিনের বেলা তখন নৌকা বাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ কারণ হাওরের কিনারে নিয়মিত পাহারায় দাঁড়ানো পাকিস্তানিদের দেশীয় দোসর রাজাকাররা। মাঝি নৌকা বান রাতে রাতে। লুৎফা ছইয়ের ভিতর। ডলি আর জলি বসেন গলুইয়ের সামনে। তারা শাপলা নিয়ে খেলে। সাইদ আর সাব্বির শুয়ে পড়েন পাটাতনের নিচে।

দ্বিতীয়দিন রাতের অন্ধকারে নদীর কিনারা থেকে রাজাকাররা নৌকা থামিয়ে চিৎকার করে ডাকে। নৌকায় কেড়া, যায় কই?

মাঝি নৌকা থেকে মিথ্যা জবাব দেয় : সোবহানের বউ যাইবো নিশানদিয়া গ্রামে।

হাওরের বিরাট বিরাট ঢেউয়ে নৌকায় পানি উঠে যায়। অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে পাটাতনের নিচ থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে পালা করে পানি সেচেন সাব্বির আর সাঈদ। এভাবে তিন রাত চলার পর শেষ হয়ে যায় তাদের হাতের চিড়া আর মুড়ি। ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ে জলি আর ডলি। মাঝি কাছের গ্রামে মাঝরাতে এক পরিচিতের বাড়ির কাছে নৌকা ভেড়ান। ভয় পেয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়েন বাড়ির লোক। দরিদ্র গৃহস্ত। বাড়িতে খাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু অতিথিকে পানি মুখে বিদায় করেন না তারা। ঘরে চাল ছাড়া আর কিছু নেই। ভাত রান্না হয়। ঘরে পাওয়া যায় ঝোলা গুড়। অভূক্ত পেটে গভীর রাতে ঝোলা গুড় দিয়ে মাখানো ঐ ভাতই সবার কাছে মনে হয় অমৃত! দ্রুত কিছু মুখে দিয়ে আবার রওনা দেন তারা। ভোর হবার আগে যতটা পথ এগোন যায় ততই লাভ।

ছপ ছপ ছপ ছপ বৈঠা বায় মাঝি। রাতের অন্ধকারে হাওরের বিশাল ঢেউ কেমন ভীতিকর মনে হয় লুৎফার কাছে। নৌকায় নিস্তব্ধ কয়েকটি প্রাণী। হঠাৎ হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেদ করে কেঁদে ওঠে জয়া। তন্দ্রা ভেঙ্গে চমকে ওঠেন লুৎফা। মনে হয় যেন অন্তহীন পথ পাড়ি দিচ্ছেন। হইয়ের ভেতর মাদুরে ঘুমে কাদা হয়ে আছে ডলি, জলি। সঙ্গে করে আনা খাওয়ার পানি শেষ হয়ে যায় একসময়। বাচ্চাকে বার্লি খাওয়াবেন তার জন্য পরিষ্কার কোনো পানি নেই আর। শেষে হাওরের পানিতে বার্লি গুলিয়ে জয়াকে খাওয়াতে থাকেন লুৎফা। লুৎফার মনে হয় এই নৌকাতেই বুঝি মারা যাবে মেয়েটা। ক্লান্তি, আতঙ্ক চারপাশ থেকে চেপে থাকে লুৎফাকে। মাঝে মাঝে নিচুস্বরে জিজ্ঞাসা করে; সাঈদ, সাব্বির তোমরা ঠিক আছ তো? পাটাতনের নিচ থেকে ওরা জবাব দেয় : আপনি চিন্তা কইরেন না, আমরা ঠিক আছি।

রাতে রাতে নৌকা বেয়ে পাঁচদিন পর অবশেষে তারা পৌঁছান তুরা বর্ডারে।

 নেীকা মেঘালয়ের কাছে পৌঁছালে লুৎফা দেখেন তখনও শত শত মানুষ মালপত্র ঘটি বাটি নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছেন। চলছে শরণার্থীদের স্রোত। সীমান্ত থেকে তুরা ক্যাম্প অনেক পথ। জানতে পারেন পাহাড়ি ঢলে রাস্তা বন্ধু ফলে সেদিন আর তুরা ক্যাম্পে যাওয়া হবে না। কাছেই কালাচান নামে এক ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশ থেকে যে আসছেন তারই আশ্রয় আর খাবার ব্যবস্থা করছেন। লুৎফারাও ঐ কালাচানের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। দুদিন সেখানে থেকে আবার রওনা দেন তুরার পথে। পাহাড়ি আঁকা বাঁকা পথ, দূরে ঝর্ণা। মেঘ নেমে আসছে মাথার উপর। জীপে যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে আসে। লংরা নামে একটি জায়গায় ভারতীয় আর্মির ক্যাম্পে অফিসাররা তাদের রাতে থাকবার ব্যবস্থা করেন। বহুদিন পর একটা নরম বিছানায় শোয় সবাই। তুরা তখনও দূরের পথ। পরদিন রওনা দেন আবার। সারাদিন জীপে যেতে যেতে আবার সন্ধ্যা নামলে তুরার কাছাকাছি এক মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পে কাতান তারা। পরদিন ভোরে রওনা দিয়ে তিনদিন টানা যাত্রা শেষে দুপুরের দিকে তুরায় পৌঁছান ঐ ছোষ্ট্র দল। তাদের থাকবার জন্য টানানো হয়েছে একটা বড় তাবু। দীর্ঘযাত্রায় সবাই ক্লান্ত, তাঁবুর ভেতরে ঢুকে পড়েন বিশ্রামের জন্য। খোঁজ পান সেদিন বিকালেই আসবেন তাহের। অধীর আগ্রহে থাকেন লুৎফা। তাঁবুর ভেতর গা এলিয়ে দিতেই অজান্তে ঘুমে ঢলে পড়েন সবাই।

বিকেলের দিকে বিকই শব্দে ধুলো উড়িয়ে একটি জীপ এসে থামে লুৎফাদের তাবুর কাছে। তাবু থেকে বেরিয়ে আসেন সবাই। লুৎফা দেখেন জীপ থেকে নামছে তাহের। দীর্ঘদিন পর তাহেরকে দেখছেন লুৎফা। আগের মতোই আত্মবিশ্বাসী কিন্তু চোখে মুখে পরিশ্রমের ছাপ। তাহেরের হাতে একটা গলফ স্টিক। তাহের প্রথমেই ছুটে এসে কোলে তুলে নিতে চান জয়াকে।

গলফ স্টিকটা পাশে রেখে বলেন : দেখি দেখি কই মেয়েটাকে দাও একটু কোলে নিই।

কিন্তু জয়া তাহেরকে দেখে ভয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। তাহের বলেন : এই বোকা মেয়ে আমি তো তোর বাবা!

একটু কোলে নিয়েই আবার জয়াকে ফিরিয়ে দেন লুৎফার কোলে। তাঁবুর ভেতর ঢুকে সবার সঙ্গে আলাপ শুরু করেন তাহের। কত দিনের জমে থাকা গল্প। গল্প শেষ হয় না তাদের। লুৎফা শোনান কাজলা থেকে তুরা পৌঁছানোর দীর্থযাত্রার কাহিনী। তাহের শোনান তার পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার নাটকীয় গল্প। তাহের বলেন : ১১ নাম্বার সেক্টরের দায়িত্ব নিয়েছি। যুদ্ধটা আসলে অন্য ট্রাকে চলে যাচ্ছে, চেষ্টা করছি এর গতিটা পাল্টানো যায় কিনা।

ডলি, জলি, জয়া ঘুমিয়ে পড়ে একসময়। অজানা প্রান্তরের এক তাঁবুতে রাত জেগে থাকেন তাহের আর লুৎফা! যেন এক বেদুঈন দম্পতি। ছুটে চলেছেন প্রান্তর থেকে প্রান্তরে। ধু ধু মরুর বুকে যেন তাদের কিন্তু অভিসার।

পরদিন সকালে বি এস ক্যাম্পে দুই রুমের টিনের একটি ঘরের ব্যবস্থা করা হয় মুত্যাদের জন্য। ঐ ঘরটি কিছুদিন আগেও ব্যবহার হতো গরুর গোয়াল হিসেবে। এছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই, ঐ গোয়াল ঘরই পরিষ্কার করে প্রস্তুত করা হয় তাদের থাকার ঘর হিসেবে।

তাহের লুৎফাকে বলেন : যুদ্ধের মধ্যে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করো না।

লুৎফা বলেন : শরণার্থী শিবিরে যা দেখে এসেছি এতো তার চেয়ে হাজার গুণ ভালো।

লুৎফাদের তুরার মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পে রেখে তাহের আবার রওনা দেন ১১ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার মহেন্দ্রগঞ্জে।

২৪. সেক্টর ১১

পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে রুদ্ধশ্বাস এক পলায়নপর্ব অতিক্রম করে ভারতে পৌঁছে তাহের প্রথম দেখা করেন মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল ওসমানীর সাথে। বাঙালি সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে মেজর তাহের অন্যতম একজন। দেশে যে সিনিয়র অফিসাররা ছিলেন তাদের বিভিন্ন সেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাহের এসে পৌঁছালে ওসমানী বলেন : বিফোর ইউ স্টার্ট, সব সেক্টর গুলো ঘুরে দেখ এবং এখানকার সমস্যাগুলো আইডেন্টিফাই করো। দেন ইউ মাস্ট টেক কমান্ড অফ এ সেক্টর।

একটি জীপ নিয়ে ধুলা উড়িয়ে কাছাকাছি সেক্টরগুলো ঘুরে দেখতে শুরু করেন তাহের। ক্যাম্পে ক্যাম্পে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেবার জন্য বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা উদ্দীপ্ত তরুণদের লম্বা লাইন দেখে আপ্লুত হন তাহের। কথা বলেন অপেক্ষমাণ তরুণদের সঙ্গে, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে, বাংলাদেশী এবং ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে। বুঝে নেবার চেষ্টা করেন যুদ্ধের সাম্প্রতিক অবস্থা।

সেক্টর কমান্ডারদের মিটিংয়ে তাহের তুলে ধরেন তার পর্যবেক্ষণ। তাহের বলেন : আমি যা অবজার্ভ করলাম তাতে দেখতে পাচ্ছি আমাদের দিক থেকে তিন ধরনের স্ট্রিমে যুদ্ধটা হচ্ছে। প্রথমত, আপনারা ইন্ডিয়ান আর্মির হেল্প নিয়ে রেগুলার ব্রিগেড তৈরি করার চেষ্টা করছেন আর কে ফোর্স, জেড ফোর্স অ্যান্ড সে অন, এর ভেতর স্বতঃস্ফূর্তভাবে নানা পেশার তরুণরা যোগ দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এই ফোর্সগুলোর বাইরে নানা জায়গায় বেশ কিছু স্পন্টেনিয়াস ওয়ার লর্ডস সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন, এরা অনেকটাই ইন্ডিপেন্ডেন্ট। আমি কাদের সিদ্দিকীর নাম শুনেছি। তৃতীয়ত, আরেকটি স্ট্রিমের কথা জানলাম, যেখানে ছাত্রলীগের কিছু নেতা, মুজিববাহিনী নামে একটা স্বতন্ত্রবাহিনী তৈরি করেছে। তারা খুব একটা একটিভ না হলেও, ইন্ডিয়ার শেল্টারেই তারা পৃথকভাবে ট্রেনিং নিচ্ছে।

এখন ইফ ইউ আসক মি, আমার কিছু ক্লিয়ার প্রপোজাল আছে। আমি মনে করি রেগুলার ব্রিগেড তৈরি করার দিকে বেশি মনোযোগ দিয়ে উই আর ওয়েস্টিং আওয়ার টাইম। আমাদের সাধারণ কৃষক, ছাত্র এদের আরও বেশি বেশি ট্রেনিং দিয়ে গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলা দরকার। পাকিস্তান আর্মির মতো একটা অ্যাডভান্সড আর্মির সঙ্গে গেরিলা ওয়ার ফেয়ার ছাড়া আর কোনোভাবে আমরা পারব না। আমি হিসাব করে দেখেছি সাত আট মাসের মধ্যে কৃষক, ছাত্রদের নিয়ে প্রায় ২০ ডিভিশনের একটা বিরাট গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলা যায়। এতে করে ইন্ডিয়ান আর্মির ওপর আমাদের ডিপেন্ডেন্সিও কমবে। আমি এটাও স্ট্রংলি ফিল করি যে আমাদের সেক্টর কমান্ডারদের হেডকোয়ার্টারগুলো ইন্ডিয়ার মাটি থেকে সরিয়ে যতটা সম্ভব বাংলাদেশের ভেতরে নিয়ে ওয়া দরকার। ফাঁইনালি আই অলসো ফিল দ্যাট উই সমুড হ্যাভ মোর কন্টাক্ট উইথ দি স্পন্টেনিয়স ওয়ার লর্ডস।

অকৃতদার, পাকানো গোঁফ, পাপা টাইগার নামে পরিচিত ওসমানী মনোযোগ দিয়ে তাহের কথা শোনেন এবং বলেন, ওয়েল তাহের আই অ্যাপ্রেশিয়েট ইউর আইডিয়াস বাট আই মাস্ট সে দ্যাট আই ডিসএগ্রি উইথ ইউ। আমি মনে করি আমাদের রেগুলার ব্রিগেড তৈরি করার দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। উই ক্যান নট জাস্ট ডিপেন্ড অন গেরিলাস। আর এখনই বাংলাদেশের ভেতরে হেডকোয়ার্টার করারও কোনো পরিস্থিতি নাই।

এখানে আবির্ভূত হন শেখ মুজিবের পক্ষে চট্টগ্রামে স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়া মেজর জিয়া, যিনি তখন জেড ফোর্সের অধিনায়ক। তিনি মিটিংয়ে ওসমানীর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন : বাট আই থিঙ্ক তাহের হ্যাজ এ পয়েন্ট।

ওসমানী রেগে যান। বলেন : নো দি পয়েন্ট ইজ ইনভ্যালিড়। আমরা একটা রেগুলার আর্মির সাথে যুদ্ধ করছি, এখানে আমাদের আগে রেগুলার ব্রিগেড এক্সপান্ড করতে হবে।

জিয়া বাদে অন্যান্য সেক্টর কমান্ডাররা ওসমানীকেই সমর্থন করেন।

তাহের বলেন : ওয়েল ইন দ্যাট কে, এজ ইউ প্রোপোজড আমাকে একটা সেক্টরের দায়িত্ব দিন, দেখি আমি কি করতে পারি।

তাহের ১১ নং সেক্টরের দায়িত্ব নিতে চান। ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর অঞ্চল নিয়ে গড়ে উঠা এই ১১ নম্বর সেক্টর ভৌগোলিক এবং সামরিক বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর বলে মনে করেন তাহের। মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী কামালপুর পাকিস্তানিদের সবচাইতে শক্তিশালী সীমান্ত ঘাঁটি। তাহের হিসাব করে দেখেন কামালপুর ঘটিকে যদি ধ্বংস করা যায় আর মুক্তিযুদ্ধে যদি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে জয় হয় তাহলে এই ১১ নম্বর সেক্টর থেকেই বকশিগজ্ঞ, শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল হয়ে সবার আগে ঢাকা পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরটির দায়িত্বে তখনও রয়েছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সৃন্ত সিং। দ্রুত এই সেক্টরটি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে চান তাহের। ওসমানী তাহেরকে ১১ নং সেক্টরের কমান্ডার নিয়োগ করেন।

ময়মমনসিংহ সীমান্তবর্তী কিছু এলাকা মেজর জিয়ার দায়িত্বে থাকলেও তাহের আসবার পর জিয়াকে ওসমানী সে অঞ্চল থেকে সরিয়ে পাঠিয়ে দেন তোলা অঞ্চলে। সেখানে মেজর জিয়াকে নিয়মিত আরকটি ব্রিগেড তৈরি করতে বলেন ওসমানী।

তাহের জিয়ার সঙ্গে দেখা করেন পৃথকভাবে। বলেন : থ্যাঙ্কু স্যার ফর সাপোর্টিং মি।

জিয়া বলেন : তাহের আই ডোন্ট থিংক পাপা টাইগার ইজ গোয়িং টু লিসেন টু ইউ। জাস্ট গো এহেড ইউথ ইউর প্লানস।

তাহের : আই অ্যাম ডেফিনিটলি গোয়িং টু ডু ইট।

সতীৰ্থ সামরিক অফিসারদের মধ্যে একমাত্র মেজর জিয়া তাহেরের মতামতকে সমর্থন করেন বলে তার প্রতি একটা দুর্বলতা তৈরি হয় তাহেরের। অবশ্য এই দুর্বলতার রন্ধ্রপথেই অজান্তে ঢুকে যায় এক ক্রুর সরীসৃপ।

২৫. গলফস্টিক হাতে সেনানায়ক

দায়িত্ব পেয়ে তাহের সিদ্ধান্ত নেন অন্যরা যাই করুক, তিনি তার নিজের মতো করে ১১ নম্বর সেক্টরটি গড়ে তুলবেন। সাইলেন্সরবিহীন সশব্দ জি-ফাইভ একটি জীপ নিয়ে ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে ছুটে বেড়ান তাহের। ঐ জীপটি যেন তার সাক্ষর, অনেক দূর থেকে মানুষ টের পান মেজর তাহের যাচ্ছেন। সেই সঙ্গে তার হাতে সবসময় একটি গলফ স্টিক। এটি কোনো গলফ খেলার মাঠ নয় কিন্তু তবুও নিচের দিকে বাঁকানো লম্বা ঐ লাঠিটি নিয়ে সর্বক্ষণ ঘোরেন তাহের। কে জানে ঐ লাঠির মধ্য দিয়ে তিনি তার আত্মবিশ্বাস, প্রত্যয় আর আশাকে প্রসারিত করে রাখেন কিনা?

তাহের ইতোমধ্যে বদলে গেছেন অনেক। তার সেই কেতাদূরস্ত ভাব আর নেই, ভালো শার্ট আর চকচকে জুতার দিকে যার ছিল আকর্ষণ তিনি এখন একটা মলিন শার্ট, প্যান্ট আর একটা ছেঁড়া কেডস পরে ঘুরে বেড়ান নানা কাম্পে। যান মাহেন্দ্রগজ্ঞ, মানকার চর, ভালু। পাহাড়ী আঁকাবাঁকা পথ, চারপাশে ঘন জঙ্গল, গভীর খাদ আর গাছে গাছে তুলার মতো ঝুলে থাকা মেঘ। কখনো কখনো জীপ থামিয়ে পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে আসা কলকল ঝরনার দৃশ্য দেখেন। নয়নাভিরাম মেঘালয়ের ক্যাম্পে ক্যাম্পে তখন যুদ্ধের নেশা লাগা তরুণদের ভীড়।

বিভিন্ন ইয়ুথ ক্যাম্পে দিনের পর দিন অপেক্ষা করছে ছেলেরা, প্রশিক্ষণের সুযোগ পেতে বিলম্ব হচ্ছে দেখে তারা অস্থির। ক্যাম্পে গেলেই ছেলেরা ঘিরে ধরেন তাহেরকে, সবার একই প্রশ্ন আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে? যেন অপেক্ষা করছে কখন তাদের জীবন দেবার ডাক আসে।

পরিকল্পনামতো নিজের সেক্টরটিকে সাজাতে শুরু করেন তাহের। প্রথমত সেক্টরের হেডকোয়ার্টারটিকে তিনি নিয়ে যান যতটা সম্ভব সীমান্তের কাছে। তাহের তার হেডকোয়ার্টার বসান পাকিস্তানিদের কামালপুর ঘাঁটির মাত্র ৮০০ গজের মধ্যে। মাঝখানে শুধু কয়েকটি ট্রেঞ্চ। শত্রু ঘাঁটির এত কাছে অন্য আর কোনো সেক্টরের হেডকোয়ার্টার তখন নেই। যেমন বাঙালিরা তেমনি পাকিস্তানিরাও জানেন যে কামালপুরের পতন ঘটলে পাকিস্তানিদেরও পতন ঘটবে দ্রুত।

তাহের তার মূল ভাবনায় ফিরে আসতে চান। অন্তত তার সেক্টরের যুদ্ধকে তিনি পরিণত করতে চান একটি জনযুদ্ধে। নিয়মিত বাহিনীর ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে যত দ্রুত সম্ভব আরও বেশি সংখ্যক সাধারন মানুষদের তিনি যোদ্ধায় পরিণত করতে চান। সেইসঙ্গে যোদ্ধা এবং জনগণের মধ্যে গড়ে তুলতে চান আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এমনকি নিয়মিত বাহিনীর ভেতরেও সিপাই এবং অফিসারদের মধ্যে দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলতে চান তিনি। সর্বপরি তিনি ক্রমশ অগ্রসর হতে চান তার গোপন অভিপ্রায় নিয়ে, যার জন্য তার প্রতি দীর্ঘদিনের। স্বাধীনতার জন্য এই যুদ্ধকে তিনি ক্রমশ ধাবিত করতে চান সমাজতন্ত্রের জন্য যুদ্ধে। সেজন্য এই যুদ্ধের একটা রাজনৈতিক মাত্র যোগ করাও খুব জরুরি মনে করেন তিনি।

একটি মহাযজ্ঞের সংকল্প নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন তাহের। প্রথমত তিনি ঘুচিয়ে দিতে চান সেক্টর কমান্ডার এবং যোদ্ধার দূরত্ব। ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে ঘুরে আপনজনের মতো তিনি মিশে যেতে থাকেন তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে। তাদের সঙ্গে বসে খাওয়া দাওয়া করেন, রাত কাটান, গল্প করেন। কথার ফাঁকে ফাঁকে তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার ভাবনার কথা জানান তাদের। বলেন : মনে রেখো মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে গণ মানুষের যুদ্ধ, রাজা রাজরাদের যুদ্ধ না। এটা কোনো কনভেনশনাল ওয়ার না, এই যুদ্ধ হচ্ছে একটা জাতির স্বাধীনতার যুদ্ধ। নিজের দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা হাতিয়ার তুলে নেবার সুযোগ পায় তাদের মতো ভাগ্যবান আর ইতিহাসে নেই। নিজেদের ভাগ্যবান মনে করবে। তোমরা তো জীবিকার জন্য অস্ত্র তুলে নাওনি, নিয়েছ দেশ প্রেমে। বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হয় এবং আমি নিশ্চিত যে হবে একদিন আর তা হবে তোমাদের জন্য, সেনাবাহিনীর সদস্যদের জন্য না?

তাহের যুদ্ধের মধ্যে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করবার ওপর গুরুত্ব দেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ভাত খেতে খেতে বলেন; যেখানে অপারেশন চালাবে তার চারপাশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করবে। তোমাদের আচরণ দিয়ে তাদের মন জয় করতে হবে। যেহেতু তোমরা গেরিলা আক্রমণ করাতে যাচ্ছ স্থানীয় লোকজনের সহায়তা ছাড়া তোমরা কিছু করতে পারবে না। মনে রাখবে যে জায়গায় যাচ্ছ সে জায়গাটা সবচেয়ে ভালো চেনে স্থানীয় মানুষ। সুতরাং আক্রমণ পরিকল্পনাটা তাদের সাথে মিলেই করতে হবে, শত্রুর অবস্থান তারাই সবচেয়ে ভালো বলতে পারবে। দেখবে এমন নিখুঁত পরিকল্পনা তারা বলে দিচ্ছে যা হয়তো সেনাবাহিনীর কোনো জেনারেলও বলতে পারবে না। একটা মুক্তিযুদ্ধের সাথে নিয়মিত যুদ্ধের তফাতটা এখানেই।

যার যার অন্ত্রের উপর হাত রেখে গভীর মনোযোগের সঙ্গে তাহেরের কথা শোনেন মুক্তিযোদ্ধারা। এক কোম্পানি কমান্ডার বলেন, সরিষাবাড়িতে যে অপারেশনটা করলাম স্যার, গ্রামের মানুষের সাহায্য ছাড়া কিছুতেই তা সম্ভব হতো না। কৃষকরাই স্যার তাদের লাকরি ঘরে, গোয়াল ঘরে আমাদের লুকিয়ে রেখেছে।

তাহের : তবে আমি খোঁজ পেয়েছি কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধা কৃষকদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে তার খাসি আর মুরগি খেয়ে চলে আসে। মনে রাখবে এভাবে গেরিলা যুদ্ধ হয় না। কৃষকের কাছে যে সহযোগিতা তুমি পাবে তার প্রতিদান দেবার চেষ্টা করবে। যদি কোনো কৃষকের গোয়ালে রাত কাটাও তাহলে সকালে গোবরটা পরিষ্কার করে দিও। যেদিন অপারেশন থাকবে না সেদিন তোমার আশ্রয়দাতাকে একটা ডিপ ল্যাট্রিন তৈরি করে দাও, তাদের সঙ্গে ধান কাটো, ক্ষেত নিড়াও। এভাবেই তুমি তাদের আস্থা অর্জন করতে পারবে।

ক্যাম্পে ক্যাম্পে এ মন্ত্র ছড়িয়ে দিয়ে বেড়ান তাহের। তিনি মুক্তিযযাদ্ধাদের প্রশিক্ষণের গতিও বাড়িয়ে দেন। তাহের যখন ১১ নম্বর সেক্টরে যোগ দিয়েছেন তখন সেখানে নিয়মিত বাহিনীর যোদ্ধা হাজার তিনেক আর সাধারণ মানুষদের নিয়ে গড়া অনিয়মিত জনযোদ্ধার সংখ্যা হাজার দশেক। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি জনযোদ্ধার সংখ্যা বাড়িয়ে তোলেন দ্বিগুণ। শুধু কৃষকদের নিয়েই তাহের গড়ে তোলেন একটি বিশেষ প্লাটুন।

গেরিলা আক্রমণের সংখ্যা এবং তীব্রতাও বহুলাংশে বাড়িয়ে দেন তিনি। বিশেষ কৌশল হিসেবে কৃষক, ছাত্রদের নিয়ে গড়া জনযোদ্ধাদের সাথে নিয়মিত সেনাবাহিনীর যোদ্ধাদের মিলিয়ে তাহের তৈরি করেন মিশ্র দল। কৃষক, ছাত্রদের আছে স্বতঃস্ফূর্ততা আর সেনাসদস্যদের আছে অভিজ্ঞতা। এ দুইয়ের সমন্বয়ে শক্তিশালী গেরিলা কোম্পানি তৈরি করেন তিনি এবং অপারেশনে পাঠিয়ে দেন দেশের ভেতর। অপারেশনে যাবার আগে মেঘালয়ের আকাশ ছুঁয়ে থাকা পাহাড়ের উপত্যকায় দাঁড়ান মুক্তিযোদ্ধা দল। তাহের তার গলফ স্টিক হাতে সবার সামনে এসে দাঁড়ান। বলেন : মনে রাখবে যুদ্ধক্ষেত্রে হয়তো তোমাদের মৃত্যু হবে, লাশ পড়ে থাকবে সেখানেই। তুমি যে দেশের জন্য প্রাণ দিলে সে খবর হয়তো কেউ জানবে না কোনোদিন কিন্তু এটাই হচ্ছে যুদ্ধের বাস্তবতা। মনে রেখো তোমরা এই আত্মত্যাগ করবে বলেই একটা নতুন দেশের জন্ম হবে।

তাহেরের বক্তৃতা ছাপিয়ে শোনা যায় সন্ধ্যার ঘরে ফেরা পাহাড়ি পাখিদের কলর।

পাশাপাশি তাহের তার দ্বিতীয় লক্ষ্য, যোদ্ধাদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলার জন্য নিতে থাকেন নানা পদক্ষেপ। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পাঠ থেকে তাহের জানেন সেখানে যোদ্ধাদের শিক্ষা দিতেন রাজনৈতিক নেতারা। গেরিলা যুদ্ধের অভিধানে যাদের বলা হয় পলিটিক্যাল কমিশার। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তেমন কেউ নেই। তাহের তাই তার সেক্টরের সব কোম্পানি এবং প্লাটুনগুলোতে বেছে বেছে রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছেলেদেরকে নিয়োগ দেবার চেষ্টা করতে থাকেন। তার সব প্লাটুন কিংবা কোম্পানিতে অন্তত একজন করে ছেলে তিনি নিয়োগ দেন যিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। মূলত বাম রাজনীতি এবং বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে। প্রতিটি প্লাটুনে সামরিক ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্লাসের ব্যবস্থা করেন তিনি। অস্ত্র চালানোর নানা ট্রেনিং এর পাশাপাশি প্রতিটি যোদ্ধা ইউনিটে একজনকে তিনি দায়িত্ব দেন রাজনৈতিক ক্লাস নেবার জন্য। সেই রাজনৈতিক প্রশিক্ষক মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্ববিপ্লব, বাংলাদেশের জনযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা সর্বোপরি সমাজতান্ত্রিক সগ্রাম বিষয়ে দীক্ষা দিতে থাকেন।

এভাবেই আর সবকটি সেক্টরের চাইতে স্বতন্ত্র একটি ধারায় এগিয়ে যেতে থাকে ১১ নম্বর সেক্টর।

২৬. ব্রাদার্স প্লাটুন

বাহার আর বেলাল হালুয়াঘাট সীমান্ত পেরিয়ে যখন ভারতে গেছেন তাহের তখনও পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসেননি। তুরারই এক ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা চলে যান সীমান্তবর্তী শিববাড়ি এলাকায়। সেখানে দুজনে মিলে গড়ে তোলেন শতাধিক সৈন্যের এক কোম্পানি। শিববাড়ির একটি ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে শুরু হয় বেলালের নেতৃত্বে সফল অপারেশন। সাহসী, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হিসেবে বাহার আর বেলালের নাম তখন চারদিকে। একটি অপারেশন ব্যর্থ হয় তাদের। ভুল একটি সিন্ধান্তের কারণে এক অপারেশনে মর্মান্ত্রিকভাবে নিহত হন তার কোম্পানির ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বেলাল আর বাহার। তারা হয়ে উঠেন আরও এক ধাপ অভিজ্ঞ যোদ্ধা।

একদিন শিববাড়িতে তাদের কমান্ডার ভারতীয় ক্যাপ্টেন মুরালি বেলাল, বাহারকে এসে বলেন : ডু ইউ নো ইয়োর ব্রাদার হ্যাজ কাম?

বেলাল জিজ্ঞাসা করে : হুইচ ব্রাদার ইউ আর টকিং এবাউট?

ক্যাপ্টেন মুরালি বলেন : ইয়োর ব্রাদার, মেজর তাহের। ডু ইউ নো হয়াট হি ইজ নাও?

বেলাল : হোয়াট?

মুরালি : হি ইজ নাউ দি সেক্টর কমান্ডার অব ইলেভেন সেক্টর।

আনন্দে বুক ভরে উঠে দুই ভাই এর। তারা জানতে পারেন তাহের আছেন মহেন্দ্রগঞ্জে। সামনের অপারেশন শেষ করেই যাবেন তাহেরের সাথে দেখা করতে সিদ্ধান্ত নেন তারা।

এদিকে তাহেরের মহেন্দ্রগঞ্জে আসবার খোঁজ পেয়ে আনোয়ারও কাজলা থেকে রওনা দেন ভারতে ইউসুফ ভাই এর স্ত্রীকে তাদের গ্রামের বাড়িতে রেখে আনোয়ার হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়েই প্রথমে উঠেন ভারতের বাগমারা শরণার্থী শিবিরে। সেখানে শুনতে পান কাছাকাছি শিববাড়ি ক্যাম্পে আছেন বেলাল আর বাহার। খুঁজতে খুঁজতে ক্যাম্পে চলে যান আনোয়ার। দূর থেকে দেখেন বেলাল আর বাহার তাবুর বাইরে বসে আপন মনে পরিষ্কার করছে তাদের এসএলআর। আনোয়াকে লক্ষ করেননি তারা। অস্ত্র হাতে দুই ভাইকে অবাক চোখে দেখেন আনোয়ার। তার মনে হয় তার কৈশোর পেরোনো ভাই দুটি অল্প দিনের ব্যবধানে যেন অনেক বড় হয়ে গেছে। যেন কত বিশাল দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে তারা।

আনোয়ার বলেন : তাহের ভাই ত সেক্টর কমান্ডার তোমরা যাবা না দেখা করতে?

বেলাল বলে : হ্যাঁ, আমরা তো খোঁজ পাইছি আগেই, তাহের ভাই মহেন্দ্রগঞ্জ আছে। আমাদের দুই জনেরই জরুরি একটা অপারেশন আছে সামনে, ঐটা শেষ কাইরাই যাবো।

আনোয়র : আমি আগে তুরায় ভাবীদের ওখানে যাচ্ছি।

বেলাল, বাহারকে পেছনে রেখে পায়ে হেঁটে, বাসে, জীপে নানা পথ ঘুরে আনোয়ার শেষে পৌঁছান তুরায় গোয়াল ঘরকে বদলে নেওয়া সেই দুটি ঘরের ছোষ্ট্র বাসায়, যা তখন লুৎফা, ভুলি, জলিদের আশ্রয়। লুৎফার মুখেই আনোয়ার শোনেন তাহেরের পাকিস্তান পালানোর গল্প।

পরদিন সকালে আবার শোনা যায় সাইল্যান্ডারবিহীন সেই জীপের শব্দ। জলি দৌড়ে এসে বলে। ঐ যে ভাইজান আসে।

আনোয়ার তাহেরাকে দেখবার জন্য রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়ান। বহুদিন পর তাহেরকে দেখে বুকটা ভরে ওঠে আনোয়ারের। একটু রোগা হয়েছেন কিন্তু তার সপ্রতিভ ভাব কমেনি একটুও। তাহেরের হাতে সেই গলফ স্টিক। তাহেরকে আলিঙ্গন করেন আনোয়ার। আনোয়ার তার ভাই তো বটেই দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক বন্ধুও। পাকিস্তান থেকে দুজনের মধ্যে চিঠি চালাচালি হয়েছে নিয়মিত। আনোয়ারের কাছ থেকে বাবা-মায়ের খোঁজ নেন তাহের। তার সঙ্গে দেখা হয় সাঈদেরও। সবার সাঞ্চে বসে দুপুরের খাবার খান তাহের। গ করেন নানা অপারেশনের। তারা খাবার খেতে খেতেই দেখেন দূরে পাহাড়ের ঢালে দুটো লাশ কবর দেওয়া হচ্ছে।

লুৎফা বলেন : প্রায়ই দেখি এমন ডেডবডি আসে।

তাহের বলেন : এ দুজন গতকালের এক অপারেশনে মারা গেছে। এদের চিনি আমি। জামালপুরের ছেলে। খুবই ক্লোজ ফ্রেন্ড। এক ট্রেঞ্চে বসে ফাইট করছিল। বলেছিলাম দুজনকে একই ট্রেঞ্চে না থাকতে। কিন্তু কথা শুনল না। বলে, মরলে দুজন একই সঙ্গে মরব। ওদের ট্রেঞ্চেই শেলটা পড়লো।

খেতে খেতে তাহের আনোয়ার আর সাঈদকে বলেন; আমি কিন্তু তোমাদের ব্যাপারে ডিসঅ্যাপয়েন্টেড। তোমাদের আরও অ্যাকটিভ রোলে দেখতে চেয়েছিলাম আমি। কত আগে তোমাদের গেরিলা ট্রেনিং দিয়েছি। যুদ্ধে তো তোমাদেরই লিভ করার কথা। আমাদের মূল মিশনটা তো ভুলে গেলে চলবে না। সে টার্গেটেই গ্র্যাজুয়েলি কাজ করতে হবে আমাদের। সাঈদ তুমি ইমিডিয়েটলি একটা কোম্পানি দাঁড় করাও। নেমে পড় ফুল ফ্লেজেডলি। আর আনোয়ার তুমি যাবে আমার সঙ্গে মহেন্দ্রগঞ্জ। ব্যাগ এ্যান্ড ব্যাগেজ চলো। আজ থেকে তুমি আমার সেক্টরের স্টাফ অফিসার। তুমি মহেন্দ্রগঞ্জেই থাকবে।

আনোয়ার : ভাইজান আমরা ওয়েট করছিলাম আপনার জন্য। আমরা জানতাম আপনি একদিন জয়েন করবেন যুদ্ধে, তারপর আপনার সাথে মিলে সব পরিকল্পনা করব।

তাহের : যাহোক এখন থেকে কাজশুরু করা যাক। আর বাই দা ওয়ে, এখন থেকে আমি তোমার ভাই না, আমি তোমার কমান্ডার। তুমি আমার সেক্টরের একজন যোচ্ছ। নো মোর ভাইজান। অন্যদের মতো তুমিও আমাকে স্যার ডাকবে।

খাওয়ার পর তাহের আবার রওনা দেন মহেন্দ্রগঞ্জের দিকে। রণাঙ্গনেই বিচিত্র সংসার লুৎফার। অল্প সময়ের জন্য তাহেরকে কাছে পান তিনি। সে সময়টুকু জুড়ে থাকে যুদ্ধ, মৃত্যু, জয় আর পরাজয়ের কথা। জয়াকে কোলে নিয়ে ধুলা উড়িয়ে দূরে চলে যাওয়া জীপের দিকে তাকিয়ে থাকেন লুৎফা। যেন পেছনে শাহজাদী আর উদ্বিগ্ন বেগমকে রেখে ঘোড়া ছুটিয়ে রণক্ষেত্রের দিকে ধেয়ে চলেছেন বাদশা।

জীপে যেতে যেতে তাহের আনোয়ারকে বলেন : শোন, আমি নিজেই যুদ্ধে যোগ দিতে দেরি করে ফেলেছি। সময় আমাদের হাতে খুব বেশি নাই। এভাবে যুদ্ধ চলতে থাকলে ক্রমশ আমাদের আরও বেশি বেশি করে ইন্ডিয়ান আর্মির উপর ডিপেন্ডেন্ট হয়ে যেতে হবে। আমাদেরকে দ্রুত এই যুদ্ধ নিয়ে আসতে হবে আমাদের নিয়ন্ত্রণে। এখানে নানা স্তরের মানুষের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার যে উদ্দীপনা দেখছি পৃথিবীর ইতিহাসে তুমি এমনটা খুঁজে পাবে না। ভিয়েতনাম, কিউবাতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার পেছনে ছিল ব্যাপক রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রস্তুতি। আমাদের তো তেমন কোন প্রস্তুতিই ছিলো না।

আনোয়ার : কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমরা পুরো জাতি একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছি অথচ আমাদের সামনে কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেই। রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যুদ্ধক্ষেত্রে আমরা কোনো নেতা পাচ্ছি না।

তাহের : এক্সাক্টলি। শুধু তাই না, সামরিকভাবে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের অধিকংশেরই তেমন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নাই। সুতরাং এই যুদ্ধের রাজনৈতিক ডাইমেনশনটা মিসিং হয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধের এই পলিটিকাল টার্নিংটা ধীরে ধীরে আমাদের ঘটাতে হবে। যেভাবে প্ল্যান করেছিলাম আমরা সেইভাবে এই আর্মস স্ট্রাগলটাতে সোসালিস্ট ডাইমেনশনটা আনতে হবে। আমি আমার সেক্টরে সব কোম্পানিগুলোতে পলিটিক্যাল কমিশার অ্যাপয়েন্ট করেছি। এ ব্যাপারগুলো তোমাকে দেখাশোনা করতে হবে। যুদ্ধ যদি লিঙ্গার করে তাহলে হয়তো আমরা অন্য সেক্টরগুলোকেও আস্তে আস্তে ইনফ্লুয়েন্স করতে পারব।

সাইলেন্সারবিহীন জীপ সশব্দে আঁকাবাকা পাহাড়ি পথ বেয়ে এগিয়ে যায়। উত্তেজিত তাহের গলা চড়িয়েই কথা বলতে থাকেন আনোয়ারের সঙ্গে; পাশাপাশি আমাদের গেরিলা যুদ্ধকে আরও জোরদার করে তুলতে হবে। আমি সেক্টর কমান্ডারস মিটিংয়ে গেরিলা ওয়ার ফেয়ারের ওপর জোর দেওয়ার কথা বলেছি কিন্তু এরা তাতে ইন্টারেস্টেড না, তারা রেগুলার ব্রিগেড তৈরিতে ব্যস্ত। তাছাড়া গেরিলা ওয়ার কেয়ারের ওপর আমার মতো এদের কারো এতো থিওরিট্যাল এবং প্রাকটিক্যাল ট্রেনিংও নাই। আমি তাই ইলেভেন সেক্টরে আমার স্ট্রাটেজিতে যুদ্ধ চালাচ্ছি। গেরিলা যোদ্ধাদের তৈরি করার মধ্য দিয়েই আস্তে আস্তে এই যুদ্ধটাকে আমাদের রেগুলার মিলিটারি ওয়ার থেকে পিপলস ওয়ারে পরিণত করতে হবে। এ রকম যুদ্ধে একপর্যায়ে একটা গেরিলা বাহিনী নিজেই ক্রমশ একটা নিয়মিত বাহিনীতে পরিণত হয়। আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধটাকে আমরা কিন্তু পৃথিবীতে একটা দৃষ্টান্ত হিসাবে দাঁড় করাতে পারি। স্রেফ সাধারণ মানুষের শক্তির ওপর ভর করে যে একটা যুদ্ধ জয় করা যায় সেটা আমরা প্রমাণ করে দিতে পারি।

সেই থেকে আনোয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে তাহেরের সর্বক্ষণিক সঙ্গী। তার হাতে বিভিন্ন যুদ্ধ ম্যাপ আর কাঁধে একটি চাইনিজ সাবমেশিনগান। রাত জেগে তাহের কোনো রেইড কিম্বা অ্যাসের পরিকল্পনা করছেন, ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে ঘুরে ট্রেনিং পর্যবেক্ষণ করছেন, আনোয়ার আছেন পাশে। বিশেষ করে যোদ্ধাদের পলিটিক্যাল ক্লাসগুলোর ওপর নজর রাখছেন আনোয়ার।

ওদিকে সাঈদ নেমে পড়েছেন তার নেতৃত্বাধীন নতুন একটি কোম্পানি তৈরিতে।

কিছুদিন পর শিববাড়ি থেকে বেলাল এবং বাহারও চলে আসেন মহেন্দ্রগঞ্জ। তাহেরের সাথে দেখা হতেই সরাসরি দুই ভাইকে জিজ্ঞাসা করেন তাহের : কি শিখেছো এ পর্যন্ত, বলো?

বেলাল এবং বাহার দুইজনই উত্তেজিত কারণ তারা এক্সপ্লোসিভ এর ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সে কথা তারা বেশ উদ্দীপনার সাথে বলেন তাহেরকে।

তাহের জিজ্ঞাসা করেন : এক্সপ্লোসিভ তৈরিতে তোমরা কোনো ফর্মুলা ইউজ করো?

বেলাল বলেন : আমরা থ্রি বাই থারটি টু ইউজ করি।

তাহের : এখানেই তো ভুল। ঐ ফর্মুলায় গেলে তো এক্সপ্লোসিভ তৈরিতে খরচ অনেক বেশি হবে।

বেলাল : এটাই তো আমাদের শিখাইছে এইখানে।

তাহের বলেন : আরে এদের তো এক্সপ্লেসিভের অভাব নাই। কিন্তু মুক্তিবাহিনী সবমসয় এত এক্সপ্লোসিভ কোথায় পাবে। এই ফর্মুলায় এক্সপ্লেসিভ বানালে আমার সব এক্সপ্লোসিভ তো দুই দিনেই শেষ হয়ে যাবে। অলটারনেটিভ ফর্মুলাটা ইউজ করবে।

তাহের বেলাল, বাহারকে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দেন সবার সাথে। বলেন : এরা হচ্ছে এক্সপ্লসিভ এক্সপার্ট। তোমাদের তো এক্সপ্লেসিভ এক্সপার্ট নেই, এরা তোমাদেরকে সবকিছু শিখিয়ে দেবে।

১১ নম্বর সেক্টরে এভাবেই এক এক করে যোগ দেন আনোয়ার, সাঈদ, বেলাল, বাহার। এদের সবার কাছে তাহের আর সেজ ভাইজান নয়, কমান্ডার, স্যার। আরও কিছুদিন পর সৌদি আরব থেকে পালিয়ে বড় ভাই আবু ইউসুফও লন্ডন হয়ে চলে আসেন ভারতে। যোদ্ধা হিসেবে তিনিও যোগ দেন ১১ নম্বর সেক্টরেই। একমাত্র বড়ভাই আরিফ ছাড়া তাহেরের সবকটি ভাই তখন যুদ্ধক্ষেত্রে, তাহেরের অধীনস্থ যোদ্ধা। লোকে বলে ব্রাদার্স প্লাটুন।

আরিফ ইতিমধ্যে পাকিস্তান থেকে ছুটি নিয়ে চলে এসেছেন কাজলায়। দায়িত্ব নিয়েছেন মা, বাবার দেখাশোনার।

একদিন শশব্দ জীপ নিয়ে তাহের যখন তুরায় হাজির, কিশোরী বোন ডলি তখন এসে বলে : সেজ ভাইজান আমিও যুদ্ধে যেতে চাই।

তাহের : ভেরি শুভ। তুমি আর বাদ থাকবে কেন? কিন্তু এই পোশাক পরে তো যুদ্ধ করা যাবে না। দিস ইস নট এ প্রপার অ্যাটায়ার টু বি এ ফ্রিডম ফাইটার। দাঁড়াও দেখি তোমার কি ব্যবস্থা করা যায়।

ডলির পরনে তখন পুরনো মলিম ফ্রক। বুরবুরা সোনাই থেকে আসবার সময় তারা বেছে বেছে পুরনো ফ্রকগুলিই নিয়ে এসেছে যাতে তাদের দরিদ্র ঘরের মেয়ের মতোই দেখায়, নৌকায় যাতে ধরা না পড়ে যায়।

সমাধান একটি পাওয়া যায়। সৌদি আরব থেকে আসবার সময় ইউসুফ যখন লন্ডন হয়ে আসছেন তখন তাহেরের বোন শেলী ইউসুফের হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়ার জন্য পাঠিয়ে দেন প্রচুর কাপড়চোপড় আর ওষুধ পত্র। লন্ডনে থাকলেও এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে কোনো একভাবে অংশগ্রহণ করবার সুযোগ নেন শেলী। শেলীর পাঠানো সেই কাপড়ের স্তূপ থেকে একটা ট্রাউজার আর টি শার্ট তুলে নেয় ডলি। দেখা যায় দুটোই বেশ বড়। ঘরে বসে কাঁচি দিয়ে কেটে আর সুই সুতোয় সেলাই করে সেই টি-শার্ট আর ট্রাউজার নিজের মাপমতো করে নেয় ডলি। লুৎফাকে বলে : ভাবী আমাকে একজোড়া কেডস্ কিনে দেন।

পাশের বাজার থেকে ডলিকে একজোড়া কেডস কিনে দেন লুৎফা।

কিছুদিন পর তাহেরের জীপ আসবার শব্দ শুনে ট্রাউজার, টি-শার্ট আর কেডস্ পরে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ডলি। তাহের ডলিকে দেখে বলেন : ইনি কে? আমি তো চিনতেই পাচ্ছি না। নাউ ইউ লুক লাইক এ ফ্রিডম ফাইটার, এখন আপনাকে দিয়ে যুদ্ধ হবে।

ছোটবোনদের আপনি করে ডাকার অভ্যাসিটি তাহের কখনই ছাড়েননি।

মহেন্দ্রগঞ্জ যাবার সময় তাহের জীপে তুলে নেন ডলিকে। ক্যাম্পে গিয়ে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন : আমাদের তো অনেক গেরিলা আছে, এ হচ্ছে তোমাদের নতুন গেরিলি।

ভাইদের সঙ্গে এবার তার সেক্টরে যোদ্ধা হিসেবে যোগ দেয় তাহেরের বোনও। ভাইদের মতো ডলির ওপরও নির্দেশ থাকে তাহেরকে ভাইজান ডাকা যাবে না, ডাকতে হবে স্যার।

তাহের প্রায়ই ডলিকে নিয়ে রেকি করতে যান। ডলিকে চিনিয়ে দেন সব ক্যাম্পগুলো। একদিন দূরের একটি ক্যাম্প থেকে একটি তথ্য আনবার জন্য ডলিকে একা একা পাঠান তাহের। বলেন : এই যে ফিফটি সিসি মোটরসাইকেলটা দেখছেন, আপনি এই মোটরসাইকেলটা চালিয়ে ঐ ক্যাম্পে যাবেন।

ডলি বলে : আমিতো কোনোদিন মোটরসাইকেল চালাইনি।

তাহের : আপনি তো সাইকেল চালিয়েছেন। বসেন, বসলেই হয়ে যাবে।

তাহেরের সাহস আর উৎসাহে ডলি মোটরসাইকেলে বসে কয়েকবার চেষ্টা করতেই চালানো শিখে যায়। পরবর্তীতে ঐ মোটরসাইকেল চালিয়ে ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে খবর আদান প্রদানের কাজ করতে থাকে তাহেরের মহিলা গেরিলি ডলি।

ডলি আবদার করে : আমাকে রাইফেল চালানো শেখান।

তাহের বলে : শিখাব, কিছুদিনের মধ্যেই।

ইতোমধ্যে মহেন্দ্রগঞ্জে আসেন আওয়ামীলীগের নেতা সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শওকত আলী। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা এবং সংসদ সদস্যরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে কলকাতায় থাকলেও বেশ কিছু নেতা নিজে আগ্রহী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধক্ষেত্রে এবং হাতে তুলে নেন অস্ত্র। শওকত আলী তেমনি একজন। তিনি ১১ নম্বর সেক্টরে গিয়ে তাহেরকে অনুরোধ করেন তাকে অস্ত্র চালানো শেখাতে। শওকত আলী এবং ডলি এই দুই অসম বয়সী যোদ্ধার অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেন তাহের। ডলি এবং ব্যারিস্টার শওকত দুজনে মিলে এক এক করে চালানো শেখে সাব মেশিনগান, ভারী এমএমজি, গ্রেনেড।

তাহেরের সব অপারেশনে সঙ্গে আছেন আনোয়ার। একদিন রাতে খবর এলো হাতিভাঙ্গা এলাকায় সবুজপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটির পতন ঘষ্টেছে। পাকিস্ত নিরা নির্বিচারে হত্যা চালাচ্ছে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে। সারাদিন বেশ কয়েকটা সাব সেক্টর ঘুরে অত্যন্ত পরিশান্ত হয়ে ফিরেছেন তাহের। কিন্ত্র খবর শোনার পর তাহের আনোয়ারকে বলেন, দেরি করা যাবে না, রাতের মধ্যেই অপারেশন চালাতে হবে।

অপারেশন টিম ঠিক করে ফেলতে বলেন আনোয়ারকে। দ্রুত দলকে প্রস্তুত করে ফেলেন আনোয়ার। তাহের কোনো বিশ্রাম না নিয়ে শেষ রাতের দিকেই রওনা দেন। সাথে আনোয়ার এবং আরও সহযোদ্ধারা। প্রায় মাইল দশেক পথ হাঁটেন তারা। তাহেরের হাতে গল্ফ স্টিক। তার পাশে আনোয়ার চলেন যথারীতি একটি চায়না এসএমজি কাঁধে নিয়ে। লক্ষ্যস্থলের কাছাকাছি এসে দলের প্রধান অংশটাকে একটি নদীর ধারে রেখে ছোট একটি স্কাউট টিম নিয়ে এগিয়ে যান তাহের। তাদের আসার খবরে গ্রামের চাষীরা এগিয়ে আসেন। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে তাহের জেনে নেন পাকিস্তানিদের অবস্থান। মুক্তিযোদ্ধারা নদীর ধারে যে স্কুল ঘরটিতে ঘাঁটি গেড়েছিল পাকিস্তানিরা সেটি দখল করে নিয়েছে। গ্রামবাসীদের মধ্য থেকে একজন চাষী তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। জলমগ্ন ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে ঘরবাড়ির আড়ালে আড়ালে ঐ চাষী পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেন তাদের। আনোয়ারের মনে হঠাৎ সন্দেহ হয় এই লোকটি আবার পাকিস্তানিদের চর না তো? তাদের আবার কোনো ফাঁদে ফেলছে না তো? তাহেরকে কথাটা বলেন আনোয়ার।

তাহের বলেন : শোন আনোয়ার তোমাকে আগেও বলেছি, মানুষকে বিশ্বাস করতে হবে, তা না হলে আমরা একটুও আগাতে পারব না।

চাষী গাইড শত্রু অবস্থানের খুব কাছে তাদের নিয়ে আসেন। চারদিকের ঘরবাড়ি তখনও পুড়ছে। তাহের আড়াল থেকে লক্ষ করেন পাকিস্তানিরা লুটের মাল নিয়ে লঞ্চে উঠছে। নদীর ধারে যে অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের রেখে আসা হয়েছে লঞ্চটা সে পথেই যাবে। এতকাছে শত্রু সৈনাদের দেখে হাত নিশপিশ করতে থাকে দলের ছেলেদের। কিন্তু তাহের বলেন এখন কিছুতেই গুলি করা যাবে না। লঞ্চটা কিছুদূর এগিয়ে গেলে পেছন থেকে গুলি করতে হবে যাতে করে লঞ্চটা আরও দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যাবে এবং সামনের মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁদে পড়বে। এসময় সেই চাষী গাইড তাহেরকে একটি ঝোঁপের কাছে নিয়ে গিয়ে কতকগুলো গুলি আর গ্রেনেড দেখান।

চাষী বলেন : মিলিটারিরা আতকা যখন আক্রমণ করছে মুক্তিযোদ্ধারা দৌড়াইয়া আরেক জাগায় লুকাইছে, যাওনের সময় এই গুলিগুলা সঙ্গে নেওনের। টাইম পায় নাই। আমি ভাবলাম, এইগুলি তো নিব গা পাকিস্তানিয়া, তাই এই জঙ্গলে লুকায় রাখছি।

তাহের আনোয়ারকে বলেন : দেখলে তো। মানুষকে বিশ্বাস করতে হয়। এজন্যই আমি সবসময় বলি সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা ছাড়া এ যুদ্ধে আমরা জিততে পারব না।

অবশ্য মানুষকে বিশ্বাস করার এই মন্ত্র যে সবসময় অব্যর্থ হবে না তার প্রমাণ পাওয়ার জন্য তাহেরকে অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েকটা বছর।

পাক সেনাদের লঞ্চটা এগিয়ে যায়। পেছন থেকে তখন-ফায়ার শুরু করেন তাহেরের দল। লঞ্চটা দ্রুত এগিয়ে যায় সামনে এবং যথারীতি গিয়ে পড়ে সেখানে অপেক্ষমাণ মুক্তিযোদ্ধাদের হতে। অনেক পাক সেনা হতাহত হয় সেদিন, মুক্তিযোদ্ধারা দখল করেন সেই লঞ্চ।

কখনো কখনো সবকটি ভাইই একসাথে যোগ দেন কোনো অপারেশনে। তেমনি একদিনের ঘটনা। ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনেই সাঈদ ইতোমধ্যে তৈরি করে ফেলেছেন তার কোম্পানি। তাহের একবার সাঈদকে বলেন ধানুয়া কামালপুরের একটা ডিফেন্স রক্ষা করবার জন্যে তার কোম্পানি নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তার কোম্পানির অধিকাংশ ছেলেরাই পরপর কয়েকদিন অপারেশন করে ক্লান্ত। তারা বিশ্রাম নিতে চাই। কিন্তু ব্যাপারটা জরুরি, যেতে হবেই। অনেক রাত। সাঈদ বলেন, যারা যারা অপারেশনে যাইতে চাও ক্যাম্পের বাইরে আইসা লাইন দিয়া দাঁড়াও।

ভাই বাহার সবার আগে এসে দাঁড়ান। আনোয়ার সাধারণত সম্মুখযুদ্ধে যান। না কিন্তু সেদিনের পরিস্থিতি বুঝে আনোয়ারও এসে দাঁড়ান লাইনে। সাঈদ প্রণে দেখেন মোট বিশ জন। বিশ জনকে নিয়েই ধানুয়া কামালপুরের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন সাঈদ। যাবার আগে শেষ বারের মতো সবাইকে শুনতে গিয়ে দেখেন এবার দলে একুশ জন। আবারও গোনেন, তখনও একুশ জন। ব্যাপার কি ভেবে পনি না সাঈদ। অন্ধকারে সবাইকে ভালোমতেচেনাও যায় না। তৃতীয় বার গুনতে গিয়ে দেখেন লাইনের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছেন বেলাল। কোন ফাঁকে আনোয়ার, বাহারের পর বেলালও এসে যোগ দিয়েছেন সেই দলে টের পাননি সাঈদ।

ব্রাদার্স প্লাটুন রওনা দেয় অপারেশনে।

২৭. জেড ফোর্স

একদিন জীপে আনোয়ারকে নিয়ে তেলঢালায় যান তাহের।

তাহের : চলো তোমাকে মেজর জিয়ার কাছে নিয়ে যাই, জিয়ার নাম শুনেছে

আনোয়ার বলেন : হ্যাঁ, শুনেছি। রেডিওতে শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।

তাহেরঃ তেলঢালাতে তার ব্রিগেড আছে। ওসমানীর কথামতো তিনি রেগুলার ব্রিগেড তৈরি করছেন। তবে সেক্টর কমান্ডার মিটিংয়ে আমি যে গেরিলা এয়ার ফেয়ারের ব্যাপারে বলেছিলাম, হি ওয়াজ দি ওনলি ওয়ান হু সাপোর্টেট মি। সে জন্য তার সাথে যোগাযযাগটা রাখি। তাকে ইনফ্লুয়েন্স করার চেষ্টা করি যাতে তার সেক্টরেও গেরিলা ফাঁইটারের সংখ্যা বাড়ান। মোস্ট ইম্পর্টেন্টলি আমরা যুদ্ধের যে পলিটিক্যাল টার্নিংয়ের কথা বলছি, এটাকে একটা পিপলস সোসালিস্ট ওয়ারের দিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছি, সেটা তো শুধু আমাদের সেক্টরে করলে হবে না। অন্যান্য সেক্টরে, ব্রিগেডে ছড়িয়ে দিতে হবে। মেজর জিয়াকে রিলেটিভলি ওপেন মনে হয়, তার এই ব্রিগেডকে হয়তো ইন কোর্স অব টাইম আমরা সাথে পেতে পারি।

তেলাঢালা ব্রিগেড কমান্ডারের অফিসে জীপ থামে তাদের। আনোয়ার দেখেন চারদিকে খুব ছিমছাম সাজানো, গোছানো। তাবুর ভেতর কার্পেট। সেক্টর এগারোর হেডকোয়ার্টারে কার্পেট তো দূরের কথা ঠিকমতো বসবার ব্যবস্থাও নাই। তাঁবুর ভেতর থেকে মাঝারি উচ্চতার হালকা পাতলা এক ভদ্রলোক এসে দাঁড়ান আনোয়ারের সামনে। তাহের আনোয়ারকে বলেনঃ মিট মেজর জিয়া।

জিয়াকে বলেনঃ দিস ইজ মাই ব্রাদার আনোয়ার। আমার সেক্টরের কাজ করছে।

জিয়া হাত মেলান আনোয়ারের সঙ্গে।

জিয়া বলেন, তোমাদের ব্রাদার্স প্লাটুনের খবর আমি পেয়েছি। তোমরা সব ভাই একসাথে অপারেশনে যাও সে খোঁজও পেয়েছি। বাট দিস ইজ নট রাইট। ইউ অ্যাড নট মুভ টুগেদার। তাহের তোমার এই ভাইটাকে বরং আমার ব্রিগেডে দিয়ে দাও।

তাহের হেসে বলেন : ও তো এখন আমার স্টাফ অফিসার। সেক্টরের ইম্পর্টেন্ট লোক, ওকে ছাড়া যাবে না।

তাঁবুতে বসে জিয়ার সাথে আলাপ করেন তাহের। বলেন : আমি কিন্তু স্যার আমার হেডকোয়ার্টার একেবারে বর্ভারের কাছে নিয়ে গেছি। আমি ভেতরে ঢুকে যেতে চাই। আপনার হেডকোয়ার্টারও মুভ করা উচিত। চলেন বাংলাদেশের ভেতরে চলে যাই। সিএনসি তো এগ্রি করবেন না। আপনি তো ব্রিগেড কমান্ডার, আপনি চাইলে সিএনসিকে ডিফাই করতে পারেন। আপনি ইনডিপেনডেন্ট। আপনি এগিয়ে আসলে আমিও একটা সাপোর্ট পেতে পারি।

জিয়া : তাহের তোমার মতো এতগুলো ভাই থাকলে আমিও অনেক সাহসী হতে পারতাম।

তাহেরঃ প্রয়োজন হলে আমার ভাইদের আমি পাঠাবো আপনার এখানে কিন্তু চলেন আমরা গেরিলা ওয়ার ফেয়ারটাকে আরও ট্রেন্থেন করি। এত বড় একটা রেগুলার ব্রিগেড বানিয়ে কোনো লাভ নেই স্যার।

জিয়াঃ প্রবাবলি ইউ আর রাইট। বাট লেট আস ওয়েট এ্যান্ড সি।

কিছুক্ষন আলাপ সেরে ফিরতি পথে রওনা দেন তারা। জীপে বসে তাহের বলেন : মেজর জিয়ার এই এক সমস্যা, তাকে কিছু বললেই বলে লেট আস ওয়েট অ্যান্ড সি। লোকটা আমাকেও সাপোর্ট করেন আবার ওসমানীর সঙ্গেও ডিফার করেন না। সব দরজাই খোলা রাখেন।

আনোয়ার : ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে কার্পেট-টার্পেট সাজিয়ে বেশ রাজসিক হালে আছেন মনে হয়।

তাহের : রিয়েল ওয়ার ফিল্ড থেকে এত দূরে থাকলেই এসব বিলাসিতা করার সুযোগ হয়। আই হোপ হি আন্ডারস্টান্ডস দি সিচুয়েশন।

সূত্রপাত ঘটে তাহের আর জিয়ার বিশ্বাস, অবিশ্বাসের জটাজালে জড়ানো এক জটিল সম্পর্কের।

২৮. যুদ্ধসম্রাট

তাহের কৌশল হিসেবে সিদ্ধান্ত নেন দেশের ভেতরে থেকে যে সব যোদ্ধারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুদ্ধ করছেন তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবেন। রৌমারীতে সুবেদার আফতাব, টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকী, ভালুকায় সৈনিক আফসার। এরা এক এক জন স্থানীয় যুদ্ধসম্রাট।

সুবেদার আফতাব রৌমারি থানার কোদালকাঠি এলাকার ভেতরে থেকে খুবই সফলভাবে যুদ্ধ করছেন। অনেকগুলো চর নিয়ে গড়া রৌমারীর বিশাল এলাকা যুদ্ধের প্রায় পুরো সময়টাই মুক্ত রেখেছেন আফতাব। জেনারেল ওসমানী আফতাবকে বলেছেন বিদ্রোহী কারণ ওসমানী এবং জিয়া বেশ অনেকবার আফতাবকে ভারতে ডেকে পাঠালেও তিনি যাননি। বলে পাঠিয়েছেন যে, তাদের সাহায্য ছাড়া তিনি নিজেই বাংলাদেশের মাটিতে বসে যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। তাহের আফতাবের ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে উঠেন। তার সাথে দেখা করবার পরিকল্পনা করেন। সীমান্ত থেকে কোদালকাঠি যাওয়ার পথ দুর্গম। তারপরও একদিন তাহের আঠারো মাইল পথ হেঁটে কোদালকাঠি পৌঁছান শুধু ঐ আফতাবের সাথে দেখা করতে। পৌঁছে দেখা হয় বিশালদেহী, পরনে লুঙ্গি, গায়ে ডোরাকাটা স্পোটর্স। গেঞ্জি, মাথায় বার্মিজদের মতো রুমাল বাঁধা সুবেদার আফতাবের সঙ্গে। তার আগে পিছে রাইফেলধারী দেহরক্ষী। আফতাব একজন অফিসারকে দেশের মাটির ভেতরে তার ঐ যুদ্ধ ক্যাম্পে দেখে অবাক।

সারারাত সুবেদার আফতাবের সাথে কথা হয় তাহেরের। অফিতাব বলেন : আমি স্যার কিছুতেই ভারতের মাটিতে কোনো ক্যাম্প তৈরি করব না, যুদ্ধ করব দেশের ভিতরে বসেই।

আফতাবের দেশপ্রেম, সাহস আর দৃঢ়তা মুগ্ধ করে তাহেরকে। সুবেদার আফতাবকে তাহের বলেন : রৌমারীকে আমাদের মুক্ত রাখতেই হবে, আমরা বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগর থেকে সরিয়ে আনব রৌমারীতে।

চওড়া কাঁধ, লম্বা কোকড়ানো চুলের নির্ভীক আফতাব তাহেরকে বলেন : স্যার পাকিস্তানিরা শুধু সুবেদার আফতাবের লাশের উপর দিয়াই রৌমারিতে ঢুকতে পারবে।

তাহের : তোমার তো অস্ত্র কম। দেখি তোমার জন্য অস্ত্র যোগার করতে পারি কিনা।

আফতাব বলেন : আমি স্যার ইন্ডিয়ার অস্ত্র চাই না। পাকিস্তানিদের অস্ত্র কেড়ে নিয়াই দেখি কতক্ষণ যুদ্ধ চালাইতে পারি।

তাহের : তোমার জন্য সেই ব্যবস্থাই করব।

টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকীর সাথেও যোগাযোগ হয় তাহেরের। কাদের সিদ্দিকী সীমান্ত পেরিয়ে প্রায়ই মহেন্দ্রগঞ্জ চলে আসেন তাহেরের সঙ্গে দেখা করতে। তাকে অস্ত্রসহ সবরকম সহযোগীতা দেন তাহের। একবার বিবিসির সাংবাদিকরা আসেন ১১ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধের নানা ফুটেজ সংগ্রহ করতে। তখন সেখানে ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। তাহের বিবিসির সাংবাদিককে বলেন : আমার না বরং এই ছেলেটির সাক্ষাৎকার আর কাজকর্মের ছবি আপনারা তোলেন।

শ্মশ্রুমণ্ডিত কাদের তখন বাঘা কাদের নামে পরিচিত। মাথায় কাউবয়দের মতো টুপি পড়ে থাকেন কাদের সিদ্দিকী। থাকেন খালি পায়ে। কাদের প্রতিজ্ঞা করেছেন দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত পায়ে জুতা, সেলে কিছুই পরবেন না। বিবিসি কাদের সিদ্দিকীর ছবি তোলে এবং তা প্রচারিত হওয়ার পর কাদের সিদ্দিকীর নাম ছড়িয়ে যায় দেশে, বিদেশে।

এমনি আরেক স্থানীয় যুদ্ধসম্রাট ময়মনসিংহের ভালুকার সৈনিক আফসার। তিনি নিজেকে মেজর ঘোষণা করে দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হিসেবে রক্ষা করে যাচ্ছেন ভালুকাকে। তাহের তার সাথেও যোগাযোগ করেন এবং সব রকম সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেন।

দেশের সীমানার ভেতরই স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠা এইসব চারণ বীরদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাহের নিজেও জারিত হতে থাকেন নানা মাত্রায়। আকৈশোর তাহের করোটিতে বয়ে বেড়িয়েছেন যুদ্ধনেশা। সেই স্বপ্নে দেখা যুদ্ধের ভেতর স্বপ্নে পাওয়া মানুষের মতো ছুটে বেড়ান তাহের।

২৯. রণাঙ্গনের রাত, দিন

কোনো কোনো দিন রাতে হ্যাজাক জ্বালিয়ে মহেন্দ্রগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধরা বসায় গানের আসর। দল বেধে গায়-তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবরে …। তাহেরও যোগ দেন তাদের সঙ্গে। কোনোদিন যোদ্ধারা তাকে বলে, স্যার আপনার পাকিস্তান পালানোর গল্পটা বলেন। চারপাশে ঘিরে থাকা উদ্দীপ্ত গেরিলাদের মধ্যে বসে তাহের শোনান তার এবোটাবাদ থেকে দেবীগড় আসবার গল্প। আবু তাহের অচিরেই হয়ে ওঠেন সাধারণ যোদ্ধা, সিপাইদের প্রিয় নাম।

যুদ্ধক্ষেত্রে তাহেরের পরিচয় হয় সাংবাদিক যোদ্ধা হারুন হাবীবের সঙ্গে। হারুন হাবীব রণাঙ্গনের বিভিন্ন খবর পাঠিয়ে সরবরাহ করেন জয় বাংলা পত্রিকা কিংবা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অফিসে। তাহের তাকে ডেকে বলেন : শুধু খবর পাঠালে তো হবে না, ছবিও পাঠাতে হবে।

তাহের তার নিজের ইয়াসিকা ক্যামেরাটি একদিন হারুন হাবীবের হাতে তুলে দিয়ে বলেন : ক্যামেরাটা আমার খুব প্রিয়, মুক্তিযুদ্ধের ছবি তোলার জন্য তোমাকে দিচ্ছি, রিপোর্টের সঙ্গে ছবিও পাঠাবে।

হারুন বলেনঃ এখানে তো ছবি প্রিন্ট করা একটা বড় সমস্যা। এত দূর থেকে তুরা যাওয়া ছাড়া আর তো কোনো পথ নেই। সে তো অনেক দূর।

তাহের বললেন : কাছে কোনো স্টুডিও নেই?

হারুন : কাছাকাছি যেটা আছে সেটা বাংলাদেশের বর্ডারের ভেতরে।

তাহের : একটা প্লাটুন নিয়ে দেশের ভেতরে চলে যাও না কেন, গেরিলা কায়দায় স্টুডিও দখল করে নেগেটিভ প্রিন্ট করে নিয়ে আস। আরে গেরিলা জার্নালিস্টের কাজই তো হবে এই।

যতক্ষণ জেগে থাকছেন, নানা মানুষকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন তাহের। অল্প কয়ঘন্টা শুধু ঘুমান তাহের, জেগে থাকেন অনেক রাত। তাঁবুর ভেতর হাতল ঘোরানো টেলিফোনের পাশে উদ্বিগ্ন বসে তাহের অপেক্ষা করেন জগন্নাথ কিংবা বাহদুরাবাদ ঘাটে পাঠানো কোম্পানির অপারেশানের খবর শুনবার জন্য। রাত জেগে গল্প করেন হারুন হাবীব, আবু ইউসুফ, আনোয়ারসহ অন্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে। তাবুর খুটিতে ঝোলে হারিকেন। সেখানে অসংখ্য পতঙ্গের ভিড়। অবিরাম ডাকে ঝি ঝি পোকা। দূরে শোনা যায় গোলাগুলির শব্দ।

হারুন হাবীবকে জিজ্ঞাসা করেন তাহের : জার্নালিস্ট বলে খবরাখবর কি? যুদ্ধের অবস্থা কি বুঝতে পারছো?

হারুন : পাকিস্তানিরা তো নানা জায়গায় মার খাচ্ছে। তবে ইন্টারন্যাশনাল রিঅ্যাকশনটা শেষ পর্যন্ত কি হবে বুঝতে পারছি না।

তাহের : ক্যাপিটালিস্ট আর ইসলামিস্টরা আমাদের সাহায্য করবে না সেটা স্পষ্ট। ইন্ডিয়া ডেফিনিটলি আমাদের পাশে থাকবে, হয়তো অল আউট ওয়ারে যাবে। কিন্তু আমি মনে করি সেটা ঠিক হবে না। গত সেক্টর কমা গারদের মিটিং এ আমি বলে এসেছি ইন্ডিয়া আমাদের টোটাল সাপোর্ট দিচ্ছে ফাইন, উই আর রিয়েলি গ্রেটফুল। ওরা সরাসরি লড়লে অবশ্যই আমরা দ্রুত স্বাধীনতা পাব, পাকিস্তানিরা পালাতে বাধ্য হবে কিন্তু আই এম সিওর আমাদের জাতীয় মুক্তি বাধাগ্রস্ত হবে। এই যুদ্ধটাকে আমরা একটা সোসালিস্ট বিপ্লবের দিকে নিয়ে যেতে পারি। সেজন্য আমাদের মানুষ, পলিটিক্যাল লিডারশিপ, ফি কমান্ডার সবারই আরও সময় দরকার। অন্তত কয়েক বছর। পাকিস্তানিরা এখনই পালিয়ে গেলে একটা অসমাপ্ত বিপ্লব হবে মাত্র। আমরা স্বাধীনতা পাব কিন্তু জাতীয় বিপ্লব শেষ হবে না।

এক সহযোদ্ধা বলেন : কিন্তু যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে আরও কত লক্ষ মানুষ মারা। যাবে সেটা কি আমরা ভাবব না? আমাদের স্বাধীনতার জন্য এ যুদ্ধ দরকার ছিল কি যত তাড়াতড়ি এই যুদ্ধ শেষ হয় সেটাই কি ভালো না?

তাহের বলেন : আপাতভাবে ভালো মনে হতে পারে কিন্তু এটাও মনে রাখবে এই যুদ্ধে আমাদের ঘরবাড়ি, দালান কোঠা, ব্রিজ কালভার্ট, স্কুল-কলেজ এগুলোই শুধু পুড়ছে না। পুড়ছে আমাদের বিশ্বাস, চেতনা। পুড়ে পুড়ে আমরা খাঁটি হচ্ছি। আমরা নিশ্চয় অনেক অনেক হারাচ্ছি। কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য অর্জন করে যাচ্ছি আরও অনেক বেশি। এই অর্জনটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সাধারণ মানুষ, বেরাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যত এই যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যাবেন তত খাঁটি বিপ্লবী হয়ে উঠবেন। দেখছে না ভিয়েতনামে, কত বছর ধরে যুদ্ধ করতে করতে পুরো জাতিটাই একটা বিপ্লবী শক্তিতে পরিণত হয়েছে? আমেরিকার মতো এত বিশাল ক্ষমতাবানরাও হিমসিম খাচ্ছে সেখানে।

ইউসুফ : আমিও মনে করি বাংলাদেশের যুদ্ধটা ভিয়েতনামের যুদ্ধের মতো হয়ে উঠতে পারে। এ যুদ্ধ ব্যাপক একটা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে এই সাবকন্টিনেন্টে। কিন্তু নানা কন্সপিরেসি হচ্ছে, একটা হাফ হর্টেট রেভুলেশনই হবে বলে মনে হচ্ছে।

আরেক সহযোদ্ধা বলেন : শেখ মুজিব থাকলে হয়তো অনেক ভালো হতো।

তাহের : তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে থাকলে হয়তো ভালো হতো। যদিও তার কথা স্মরণ করেই মানুষ যুদ্ধ করছে। শেখ মুজিব তো এখন সাধারণ মানুষের কাছে এক পৌরাণিক চরিত্রের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছেন। হো চি মিনের মতে, ক্যাস্ট্রোর মতো যুদ্ধের অভিজ্ঞতাটা থাকলে হয়তো তার নিজের জন্যও ভালো হতো।

তোমরা তো লক্ষ করেছো আমি খুব প্ল্যান ওয়াইজ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে পলিটিক্যাল ওরিয়েন্টেশনটা আনবার চেষ্টা করছি। তাদের লেফট পলিটিক্সে টিচিং দিচ্ছি। এজনাই তো সময় দরকার আমাদের। আমাদের বামপন্থীরা তো যুদ্ধ নিয়ে নানা ধোয়াটে অবস্থায় আছে। মস্কোপন্থীরা অবশ্য যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। আমার সেক্টরেই অনেক ছেলে আছে। কিন্তু চীনাপন্থীরা তো শুনি মুক্তিযুদ্ধটাকেই রিজেক্ট করেছে।

আনোয়ার : বিশেষ করে আবদুল হকের দলের লোকেরা বলছেন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যেমন পাকিস্তানি বুড়ুয়াদের প্রতিনিধি, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধার বাঙালি উঠতি বুর্জুয়াদের প্রতিনিধি। তারা নাকি বলছে এই যুদ্ধ আসেল দুই কুকুরের লড়াই। তারা অনেক জায়গায় পাকবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী দু দলের সাথেই যুদ্ধ করছে।

তাহের : এসব সিলি বুকিস এনালাইসিস! আমার মনে হয় না এরা পিপলের পালস বিন্দুমাত্র বুঝতে পারে কি বুঝলেও তার কোনো মূলা দেয়।

ইউসুফ : অবস্থা আরও ঘোলাটে হচ্ছে কারণ পাক আর্মি বাঙালিদের দিয়েই তাদের সাপোর্টে রাজাকার, আল বদর বাহিনী তৈরি করেছে। ঐ জামায়াত ইসলামের ছেলেরা মিলে এসব বাহিনী তৈরিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। পাশাপাশি সামান্য কিছু টাকা পয়সা পাবার আশায় অনেক গরিব কৃষকও রাজাকারে নাম লেখাচ্ছে। আবার পাকিস্তান সাপোর্ট করে এমন সব ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মেম্বারদের নিয়ে ওরা তৈরি করছে শান্তি কমিটি। এই স্টুপিডগুলো নাকি শান্তি আনতে চায়। এই দালালগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছে আরেক ডিসটার্বং এলিমেন্ট।

তাহের; আসলে মুক্তিযোদ্ধা গেরিলারা যেভাবে ওদের চোরাগোপ্তা আক্রমণ করছে তাতে ওরা ঠিকই টের পেয়েছে যে ওদের রেগুলার আর্মি দিয়ে এই যুদ্ধে ওরা বেশিদিন টিকবে না। বাঙালিদের ভেতরেই ওদের দোসর দরকার।

আরেক সহযোদ্ধা : ওদিকে তো ইন্ডিয়ান ইন্টিলিজেন্সের তত্ত্বাবধায়নে দেরাদুনে মুজিববাহিনীর ট্রেনিং হচ্ছে। ওটাও একটা বিভক্তি তৈরি করছে। ইন্ডিয়ানরা কেন যে ওদের আলাদা করে এভাবে টেনিং দিচ্ছে বুঝতে পাছি না।

ইউসুফ : ঐযে ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, ওয়ান ব্যুড নট পুট অল ওয়ানস এগস ইন ওয়ান বাস্কেট, ইন্ডিয়ানরা সেটাই ফলো করছে। দেশ স্বাধীন হলে, শেখ মুজিব ফিরে এলে, হাওয়া কোনো দিকে যায় সেটা তো বলা মুস্কিল। সুতরাং ওরা শেখ মুজিবের ক্লোজ এই সব ছাত্রনেতাদেরও হাতে রাখছে।

তাহের : আমাদের কেয়ারফুলি এসব নজর রাখতে হবে। আচ্ছা তোমরা কেউ কি সিরাজ শিকদারের খবর জানো?

আনোয়ার : শুনেছি তিনি বরিশালের পেয়ারাবাগানে যুদ্ধ করছেন। কোনো সেক্টরের আন্ডারে তিনি নেই। নিজের দল নিয়েই পেয়ারাবাগানকে মুক্ত করে রেখেছেন। তার দলের নাম রেখেছেন সর্বহারা পার্টি।

তাহের : সে তো দেশের আরেক প্রান্তে তা না হলে যোগাযোগ করতাম তার সঙ্গে।

হারিকেনের জ্বালায় তারা যখন গল্প করছেন দূর থেকে তখনও থেমে থেমে আসছে ভারী বিস্ফোরণ আর গুলির শব্দ। ভয় পেয়ে পাশের পাহাড় থেকে ডাকছে অনেকগুলো কুকুর। হঠাৎ বেজে ওঠে হাতল ঘোরানো টেলিফোন? তাহের উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন ধরেন। মুখে হাসি ফুটে ওঠে তার। খোঁজ পান বাহাদুরাবাদ ঘাট অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। রাতেই সে রিপোর্ট লিখে পাঠিয়ে দেন হারুন হাবীব। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে লোকে শোনে মুক্তিযোদ্ধাদের আর একটি বিজয়ের গল্প।

৩০. অপারেশন চিলমারী

রৌমারীর সুবেদার আফতাবকে অস্ত্র যোগার করে দেবেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তাহের। ভারতীয় অস্ত্র নয়, শক্তদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অস্ত্র দিয়েই যুদ্ধ করতে চান আফতাব। তাহেরও তার সঙ্গে একমত। রৌমারী তারই সেক্টরের অধীনে একটি এলাকা। রৌমারীর যোদ্ধাদের অস্ত্র যোগান দিতে পাকিস্তানিদের দখলে থাকা চিলমারী আক্রমণের পরিকল্পনা করেন তাহের। চিলমারির কয়েক মাইল দক্ষিণেই মিলেছে তিস্তা আর ব্রহ্মপুত্র। পাকিস্তানিরা রৌমারীর খুব কাছে চিলমারী বন্দর থেকে গানবোটে প্রায়ই আক্রমণ করে রৌমারীর মুক্ত অঞ্চল। চিলমারী একাধারে নৌ এবং স্থল বন্দর। জমজমাট বন্দর চিলমারী তখন গুলি আর মেশিনগানের আওয়াজে প্রকম্পিত। কোনো বিরহীর কন্ঠে তার প্রেমিকের জন্য তখন আর গান নেই-হাঁকাও গাড়ি বন্ধু চিলমারীর বন্দরে …

ঠিক হয় চিলমারী হবে ১১ নম্বর সেক্টরের প্রথম বড় অভিযান। চিলমারীকে দখল করতে পারলে রৌমারীর প্রতিরক্ষার ব্যাপারে আর কোনো ঝুঁকি থাকে না। তাহের এও খোঁজ পেয়েছেন চিলমারীতে এক বিশাল রাজাকার বাহিনী গড়ে তুলেছে মুসলিম লীগের কুখ্যাত নেতা আবুল কাশেম। ধ্বংস করতে হবে এই রাজাকারদেরও।

তাহেরের নির্দেশে ওয়ারেন্ট অফিসার সফিক উল্লাহ স্থানীয় গ্রামের লোকজন নিয়ে দ্রুত তৈরি করে ফেলেন চিলমারীর একটি ম্যাপ চিহ্নিত করেন পাকিস্তানিদের অবস্থান এবং তাদের শক্তি। তারা খোঁজ পান পাকিস্তানিরা চিলমারীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পয়েন্টে ছড়িয়ে পজিশন নিয়ে আছে। তারা আছে ওয়াপদা ভবন, জোড়গাছ, রাজভিটা, থানাহাটপুর স্টেশন, কলবাড়ি রেলওয়ে স্টেশন এবং পুল স্টেশন রেলওয়ে ব্রিজে। এসব জায়গায় পাকিস্তানিদের সহযোগী আছে আবুল কাশেমের রাজাকার বাহিনী। প্রধান প্রধান রাজাকার নেতাদের নামও তারা খুঁজে বের করেন। জানতে পায় আবুল কাশেম ছাড়াও নেতৃত্বে আছে ওয়ালী আহমদ আর পাছু মিয়া।

তাহের তার সেক্টরের বেশ কয়েকজন কোম্পানি কমান্ডারদের নিয়ে অপারেশন পরিকল্পনায় বসেন। তাহের বলেন। পাক আর্মিরা যেসব জায়গায় পজিশন নিয়েছে সেসব জায়গায় একসাথে এটাক করতে হবে; ওদের এমনভাবে ব্যস্ত রাখতে হবে যেন এক পজিশনের পাক সেনা অন্য পজিশনের পাক সেনাকে সাহায্য করতে না পারে। পাশাপাশি চিলমারীর বোথ রেল এবং রোড কানেকশনকে ডেস্ট্রয় করে দিতে হবে। আর এই পুরো অপারেশনটা করতে হবে শত্রুদের অজ্ঞাতে এবং অতর্কিতে।

বেশ কয়েকদিন ধরে এলাকাগুলো রেকি করেন তারা। তারপর চূড়ান্ত আক্ৰমণ। সড়ক এবং রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করবার দায়িত্ব দেওয়া হয় মাহাবুব এলাহি রঞ্জু এবং খায়রুল আলম নজরুলের কোম্পানিকে আক্রমণের একদিন আগে গোপনে অতি সন্তর্পণে তারা দিয়ে পৌঁছান ডলিপুর এবং চিলমারীর মাঝামাঝি ঘুঘুমারীর চরে।

তাহের বলেন : তোমরা ওখানে গিয়ে জাস্ট ওয়েট করবে। মূল অ্যাটাক শুরু হবার আগে কিছু করবে না। মেইন অ্যাটাক ওপেন হলেই শুধু তোমারা তোমাদের অপারেশনে যাবে।

মূল আক্রমণকারী দলের কামান্ডার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল কাশেম চঁদ আর তার সঙ্গে আছেন নায়েক সুবেদার মান্নান। তারা গিয়ে অবস্থান নেন চিলমারী বন্দরের মাত্র দুই মাইল দক্ষিণে গাজির চরে। গাজির চরকেইআক্রমণকারী বাহিনীর মূল ঘাঁটি হিসাবে বেছে নেওয়া হয়। তেমন উন্নত অস্ত্র নেই তাদের হাতে। থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, কিছু পুরনো স্টেনগান আর হ্যান্ড গ্রেনেড। সুবেদার মান্নানের উপর দায়িত্ব চিলমারীর ওয়াপদা ভবনকে ধ্বংস করার আর কমান্ডার চাঁদের দায়িত্ব ছোট ছোট দল দিয়ে জোরগাছা, রাজভিটা, থানাহাট পুলিশ স্টেশন, ব্রিজ এই সব জায়গা গুলোকে সরাসরি আক্রমণ করা।

রাতের অন্ধকারে অনেকগুলো নৌকা নিয়ে ধীরে প্রায় তিন মাইল প্রশস্ত ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দেন আবুল কাশেম চাঁদ আর নায়েক সুবেদার মান্নানের দল। পুরো দলটি চিলমারী বন্দরের খুব কাছে গাজির চরে গিয়ে মূল আক্রমণের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকেন। চিলমারী বন্দর থেকে বেশ কিছুটা ভেতরে গাজির চরের পেছনে জালিয়ার চর। সেখানে গিয়ে পজিশন নেন তাহের। জালিয়ার চর হয় তার কমান্ডিং হেডকোয়ার্টার। ব্যাক আপ সাপোর্ট হিসেবে তাহের সঙ্গে নেন তার সেক্টরের সবেধন নিলমণি চারটি দূরপাল্লার কামান। গভীর রাতে কামানগুলো নিয়ে তাহের তার সঙ্গের দলটিসহ গিয়ে উঠেন সেই চরে। নৌকা থেকে কামানগুলো হনামানো হয়। চারপাশে ধু ধু বালুচর। অন্ধকারে ঐ বালুর ওপর দিয়ে গলদঘর্ম হয়ে ভারী কামানগুলো টেনে টেনে তারা নিয়ে যান চরের অন্যপ্রান্তে।

অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি। মাঝরাত। জালিয়ার চরে গ্রাউন্ড সিট বিছিয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে নেন তাহের। ওয়ারলেসে খবর আসে, গাজির চর, মুঘুমারির চরসহ সবদিকে তার দলের লোকেরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তারা পজিশন নিয়ে বসে আছেন চূড়ান্ত আক্রমণের মুহূর্তের জন্যে। রাত সাড়ে তিনটার দিকে ওয়ারলেসে তাহেরকে জানানো হয় আর কিছুক্ষণ পরেই তার বাহিনী শত্রুসেনার। ওপর আক্রমণ চালাবে। চরের বালিতে পায়চারী করেন তাহের। দূর আকাশে আজ অনেক তারা। নানা ভাবনায় আচ্ছন্ন তাহের। ১১ নম্বর সেক্টরের পক্ষ থেকে প্রথম বড় একটি অপারেশন শুরু হতে যাচ্ছে। অস্ত্রশস্ত্র বিশেষ নেই, নেহাতই অল্পবয়স্ক ছেলে সবাই, এদের কেউই প্রায় নিয়মিত বাহিনীর নয়, সামান্য কয়েক দিনের প্রশিক্ষণ সবার। তবু সবার মধ্যে দুর্দম সাহস আর যুদ্ধ করবার আকাক্ষা।

ওয়ারেন্ট অফিসার সফিক উল্লাহ তখন ঘুঘুমারির চরে। তাদের দলে আছে বছর তেরোর এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। মূল আক্রমণের জন্য তারা চরের এক সুবিধাজনক জায়গায় রওনা দেবার সময় বয়স কম বলে সেই কিশোরকে রেখে যান পেছনে। সফিক উল্লাহ এবং তার সঙ্গীরা নৌকায় উঠলে রাতের অন্ধকার ভেদ করে নাটকীয়ভাবে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেয় সে কিশোর : আমারে নিবেন না ক্যান, আমারে যুদ্ধ করতে দিবেন না ক্যান? দ্যাশ কি আপনার একার?

কিন্তু তাকে ফেলে সফিক উল্লাহ নৌকা এগিয়ে যেতে নিলে কিশোরটি দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্রহ্মপুত্রে। সাঁতার কাটতে থাকে নৌকার পাশে পাশে। যুদ্ধে সে যাবেই। কিশোরের প্রবল উদ্দীপনায় পরাজিত হয় সবাই, নৌকায় তুলে নেন তাকে।

ভোর চারটার দিকে সুবেদার মান্নান তার কাছে সরবরাহ করা রকেট লাঞ্চার নিয়ে প্রথম আঘাত করেন ওয়াপদা ভবনের উপর। সঙ্গে সঙ্গে গাজির চর থেকে আবুল কাশেম চাঁদের দলও মুহুর্মুহু গুলি বর্ষণ, গ্রেনেড হামলা শুরু করেন পাকবাহিনীর ছাউনিতে, ঘাঁটিগুলোতে। তাহেরও তখন জালিয়ার চর থেকে ছুঁড়ে দেন দূরপাল্লার কামানের গোলা। সেগুল গিয়ে পড়ে শত্রু সেনার গানবোটে। কামানের গোলা, মেশিনগান, গ্রেনেড আর ছোট অস্ত্রের আওয়াজে চিলমারীর রাতের নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে ভাঙে। ভয় ছিল তাহেরের এই অনভিজ্ঞ তরুণ যোদ্ধাদের কেউ যদি অতি উত্তেজনায় একবার সময়ের আগে অস্ত্র চালিয়ে ফেলে তাহলে পুরো পরিকল্পনটাই ভেস্তে যাবে। কিন্তু তেমন কিছু ঘটে না।

ঠিক যেভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল অপারেশন এগোয় সেভাবেই। মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত চতুর্মুখী আক্রমণে মুহূর্তে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে পাকবাহিনী। সকাল ছয়টার মধ্যেই গোরগাছা, রাজভিটা পুলিশ স্টেশন এবং ব্রিজের অবস্থানগুলো থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা সরে যায়। নিহত হয় প্রচুর পাক সৈন্য। মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নেন সেসব জায়গা। মূল আক্রমণ হবার পর নির্দেশ মাফিক অন্য দলটি সাফল্যের সঙ্গে মাইন দিয়ে উড়িয়ে দেয় রেল লাইন, ভোঙ্গে দেয় সড়ক। রাস্তা উড়িয়ে দেবার সময় পাক সৈন্য বোঝাই একটি ট্রাককেও উড়িয়ে দেয় তারা। রেল এবং সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াতে আশে পাশের কোনো পাক ঘাঁটি থেকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা তাদের জন্য হয়ে পড়ে অসম্ভব।

শক্রদের অনেকগুলো ঘাঁটি দখল হলেও তাদের প্রধান ঘাঁটি ওয়াপদা ভবনটি মুক্তিযযাদ্ধারা তখনও দখল করতে পারে না। ওয়াপদা ভবনের আশপাশে রয়েছে কংক্রিটের বাঙ্কার। বাঙ্কারগুলোতে আশ্রয় নেয় সব পাক সেনারা। শক্ররা আত্মসমর্পণ না করাতে এবং পুরোপুরি সব জায়গা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে না আসাতে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়। তারা পিছু না হটে যার যার অবস্থান থেকে ঐ ওয়াপদা ভবন এলাকাটিকে আঘাত করতে থাকেন। ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা অন্যান্য এলাকায় পাকবাহিনীদের ফেলে যাওয়া বেশ কিছু অস্ত্রও উদ্ধার করে ফেলে।

গাজির চর থেকে আবুল কাশেম চাঁদ তাহেরকে জানান তার আরও কিছু অস্ত্র দরকার। খবর পেয়েই তাহের তার ছোট স্পিডবোডটি নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদী পার হয়ে জালিয়ার চর থেকে চলে যান গাজির চরে। পথে স্কোয়াডন লিঙার হামিদউল্লার দলটির কাছে জানতে পারেন যে আবুল কাশেম চাপকে দেবার মতো বাড়তি কোনো অস্ত্র মজুদ নেই। তাহের তাৎক্ষণিক সিন্ধান্ত নেন তার ছোট্ট নিজস্ব ডিফেন্স বাহিনী নিয়ে চিলমারী থানা আক্রমণ করে অস্ত্র সগ্রহ করবেন। থানার দিকে এগোতে গিয়ে তাহের লক্ষ করে সারারাতের যুদ্ধের তাণ্ডবে গ্রামের মানুষ তখনও দ্বিগবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ছুটে পালাচ্ছে ভয়ে। ছুটতে ছুটতে কেউ কেউ চিৎকার করে বলছে জয় বাংলা।

তাহের থানার খুব কাছাকাছি যখন পৌঁছে গেছেন তখন রাস্তার উপর ফেলে যাওয়া গরুর গাড়িতে শুয়ে আছে একটি মেয়ে। পাকিস্তানি মর্টার শেলের আঘাতে ভেঙ্গে গেছে তার হাত, বুকের স্তন উড়ে গেছে। একটা ছোট বাচ্চা মায়ের রক্ত মাখামাখি করে বসে কাঁদছে শাড়ি ধরে। তাহের দ্রুত মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে যখন পৌঁছান, তখনও গোলাগুলি হচ্ছে প্রচণ্ড। ঝাঁকে ঝাঁকে মেশিনগানের গুলি হাসপাতালের দেওয়াল ফুটো করে দিচ্ছে। হাসপাতালের মধ্যে একজন সন্ত্রস্ত ডাক্তারকে পাওয়া যায়। তাহের মেয়েটিকে ঐ ডাক্তারের হাতে তুলে দিয়ে আবার এগিয়ে যান থানার দিকে। বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে আড়ালে এগিয়ে গিয়ে শত্রুর খুব কাছে সঙ্গের এলএমজিটি স্থাপন করেন। তারপর অতর্কিতে শত্রুর উপর এক নাগাড়ে গুলি শুরু করলে মুহূর্তে প্রচুর পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। বাকিরা পালিয়ে যায় ভয়ে। তাহেরের দখলে চলে আসে খানা। দ্রুত থানার গোলা বারুদ, অস্ত্র তারা নিয়ে নেন নিজেদের দখলে।

ওদিকে আবুল কাশেম চাঁদ কোম্পানির যোদ্ধারা চিলমারীর কুখ্যাত রাজাকার পছি, মিয়াকে ধরে ফেলেন। পাদু মিয়াকে নিয়ে তারা রওনা হন রৌমারীর দিকে। পথে বক পাহার করে পৌঁছালে এক বিশাল বেদে বহর তাদের রাস্তা আগলে দাঁড়ায়। তারা বলে পাছু মিয়াকে তাদের কাছে সর্পদ্দ করতে হবে।

কেন? জানতে চান চাঁদ।

তারা বলেন : আমরা তারে শাস্তি দিতে চাই।

জানা যায় এই পাছু মিয়াই বেদেদের ঘরের মেয়েদের ধরে নিয়ে দিয়ে, এসেছে পাক আর্মিদের ক্যাম্পে। সফিক উল্লাহ বেদেদের বলেন পাছ মিয়াকে নেওয়া হবে সেক্টর কমান্ডারের কাছে এবং সেখানে তার বিচার হবে। কিন্তু বেদেরা নাছড়বান্দা, ক্ষুদ্ধ। তারা বলেন : আপনারা যাই করেন, আমাদের মনের ঝালটা মিটাইতে দেন।

পরে তাদের কথামতো পাছু মিয়াকে হাত বেঁধে একজায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয় এবং বেদে দলের সবাই সারিবদ্ধভাবে এক এক করে এসে তার মুখে থুথু ছিটিয়ে দেয়।

পাছু মিয়াকে নিয়ে যাওয়া হয় রৌমারী। অন্যদিকে সুবেদার মান্নান চিলমারীর আরেক রাজাকার নেতা ওয়ালী আহমদকেও রৌমারীতে নিয়ে আসেন। উপস্থিত জনতা এবং সেক্টর কমান্ডার তাহেরের সামনে পাছু মিয়া আর ওয়ালী আহমদকে হাজির করা হয়। তাহের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন : আপনারাই বলেন এদের কি বিচার হওয়া উচিত?

উপস্থিত জনতা তাদের যাবতীয় অপরাধের বিবরণ দিয়ে বলেন, এদের দুজনের একমাত্র শাস্তি হতে পারে মৃত্যুদণ্ড। তাহের তা অনুমোদন করেন। সবার সামনে পাছুমিয়া এবং ওয়ালি আহমেদকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

প্রথম গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনটি সফল হওয়াতে তাহেরের আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে যায়।

অপারেশনে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে গিয়ে তার গলফ স্টিক নিয়ে দাঁড়ান তাহের। বলেনঃ একটা সফল অপরেশন চালানোর জন্য তোমাদের জানাই অভিনন্দন। আমরা চিলমারী বন্দর আক্রমণ করেছিলাম হঠাৎ আঘাত করে যতবেশি সম্ভব শত্রু সেনা শেষ করা, তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়া এবং অস্ত্র আর গোলাবারুদ দখল করার উদ্দেশ্য নিয়ে। আমি মনে করি সবকটি দিক দিয়েই সফল হয়েছে চিলমারীর অপারেশন। আর্মি ট্রেনিংএর সময় অনেক যুদ্ধের ইতিহাস আমাকে পড়তে হয়েছিল। আমার মনে হচ্ছিল চিলমারীর এই অপারেশনের সাথে হয়তো তুলনা করা যেতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর ইংলিশ চ্যানেল দখলের ঘটনার। তবে সেখানে ছিল সুশিক্ষিত কয়েক ডিভিশন সৈন্য আর স্পেশাল ফোর্স। আর চিলমারীতে আমরা যুদ্ধ করেছি তোমাদের মতো সপ্তাহ দুয়েকের ট্রেনিং নেওয়া গ্রামের কৃষক আর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রদের নিয়ে। এ আমাদের এক বিরাট অর্জন। এভাবেই এক এক করে আমরা ঘায়েল করব শত্রুসেনার প্রতিটা ঘাঁটি। দখল করা অস্ত্র তাহের পৌঁছে দেন সুবেদার আফতাবের কাছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *