০৬-১০. তোয়ালেটা নাকের কাছে তুলে

তোয়ালেটা নাকের কাছে তুলে ধরতেই এতক্ষণ যে গন্ধটা অস্পষ্ট আমাদের সকলের নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করছিল—তার একটা ঝাপ্টা যেন সকলেরই নাসারন্ধ্রে এসে লাগল।

কিরীটী দেখি ততক্ষণে আলোর সামনে তোয়ালেটা ধরে পরীক্ষা করছে এবং পরীক্ষা করতে করতেই মৃদুকণ্ঠে বললে, দেখছি একেবারে নতুন তোয়ালেটা, সামান্য একটু ভিজেও আছে—বোঝা যাচ্ছে কিছুক্ষণ পূর্বেই তোয়ালেটা ব্যবহৃত হয়েছিল।

শেষের কথাগুলো কতকটা যেন আপনমনেই বলে কিরীটী। এবং আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝতে পারি, কিরীটীর মনের মধ্যে একটা চিন্তাধারা চলেছে, যদিচ চিন্তার ধারাটা সুসংবদ্ধ নয়, এলোমেলো তখনো।

এলোমেলো অসংবদ্ধ চিন্তার ধারাটা তার বিশেষ একটি কেন্দ্রে পৌঁছবার চেষ্টা করছে কিন্তু হাতের কাছে এমন কোন নির্ভরযোগ্য সূত্র পাচ্ছে না যার সাহায্যে বা যার ওপর নির্ভর করে সে সেই কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছতে পারে।

আমিও যে মনে মনে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করছিলাম না তা নয়, কিন্তু বিশেষ কোন নির্ভযোগ্য সূত্র আমিও যেন হাতের কাছে পাচ্ছিলাম না।

একটু বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, এমন সময় কিরীটীর কণ্ঠস্বর কানে এল, চলুন ডাক্তার ঘোষ, ঘরে যাওয়া যাক!

সকলে আমরা পুনরায় ফিরে এলাম পূর্বের ঘরে।

ডাক্তার ঘোষ বললেন, আর একটা জরুরী কল আছে—তাকে ছেড়ে দিলে ভাল হয়।

শিবেন সোম কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।

কিরীটী বললে, হা ডাক্তার ঘোষ, আপাততঃ আপনি যেতে পারেন, তবে আপনাকে পরে হয়ত শিবেনবাবুর প্রয়োজন হতে পারে।

বেশ তো, আমার দ্বারা যতটুকু সম্ভব আমি আপনাদের নিশ্চয়ই সাহায্য করব মিঃ রায়।

বলা বাহুল্য, ইতিমধ্যে একসময় শিবেন সোমই কিরীটী এবং আমার পরিচয় দিয়েছিলেন ডাক্তার ঘোষকে।

ডাক্তার ঘোষ নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিলেন।

ডাক্তার ঘোষ ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পরই কিরীটী শিবেন সোমের দিকে তাকিয়ে বললে, এঁদের এখানকার সকলের জবানবন্দি নিশ্চয়ই এখনো তোমার নেওয়া হয় নি সোম?

না।

তাহলে সেটাই এবারে শুরু কর।

.

প্রথমেই ঘরে ডাকা হল শকুন্তলা চৌধুরীকে।

পাশের ঘরে এসে ইতিমধ্যে আমরা সকলে বসেছিলাম। এ ঘরটা মৃত অধ্যাপকের শয়নসংলগ্ন ঘর। জানা গেল পূর্বে ঘরটা খালিই পড়েছিল, ইদানীং মাসখানেক হবে বিমলবাবুর ভাগ্নে রঞ্জন বোস এসে ঘরটা অধিকার করেছেন।

ঘরটার মধ্যে বিশেষ কোন আসবাবপত্র ছিল না। একধারে একটি খাটে শয্যা বিছানো, একটি দেরাজ, একটি দেওয়াল-আলনা ও একটি আলমারি। ঘরের এক কোণে একটি টেবিল ও চেয়ার ছিল। গোটাচারেক চেয়ার ঐ ঘরে আনিয়ে ঐ টেবিলটা টেনে নিয়ে শিবেন সোম বসলেন, কিছুদূরে আমরা বসলাম।

শকুন্তলা চৌধুরী ঘরে এসে ঢুকল এবং প্রথমেই সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালো।

কিরীটী তখন বললে, বসুন মিস্ চৌধুরী, শিবেনবাবু আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চান। উনি যা জানতে চান—আশা করি আপনার বলতে আপত্তি হবে না!

না। বলুন উনি কি জানতে চান?

দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন?

শকুন্তলা নিঃশব্দে কিরীটী কর্তৃক নির্দিষ্ট চেয়ারটায় উপবেশন করল।

শিবেন সোম বললেন, মিস্ চৌধুরী, যদিও ব্যাপারটা আমি মোটামুটি শুনেছি—আপনার মুখ থেকে আর একবার শুনতে চাই।

.

মিস্ শকুন্তলা চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত বিবৃতি হচ্ছে।

বিমল চৌধুরী প্রথম যৌবনে বিবাহ করেছিলেন এম-এ পাস করবার পর, কিন্তু বৎসরখানেকের মধ্যেই তার স্ত্রী-বিয়োগ হয় এবং আর দ্বিতীয়বার তিনি বিবাহ করেন নি।

এম-এ পাস করবার পরই তিনি কোন একটি বেসরকারী কলেজে কলকাতায় অধ্যাপনার কাজ নেন। এবং অদ্যাবধি সেই অধ্যাপনার কাজেই নিযুক্ত ছিলেন। বর্তমানে তার বয়স হয়েছিল বাহান্ন বছর।

অধ্যাপনা করে মাইনে যে একটা খুব বেশী পেতেন তা নয়, তাহলেও তার মাসিক উপার্জনটা বেশ যাকে বলে ভালই ছিল, এবং সেই বাড়তি টাকাটা তিনি উপার্জন করতেন তার লেখা কলেজের পাঠ্যপুস্তকগুলো ও অন্যান্য বিষয়ে গবেষণামূলক পুস্তকগুলো থেকে, কাজেই আর্থিক সচ্ছলতা তার বরাবরই ছিল, বেসরকারী কলেজের একজন অধ্যাপক হলেও।

প্রত্যেক মানুষেরই নানা ধরনের কর্মব্যস্ততা ও নেশা বা হবি থাকে।

বিমল চৌধুরীরও ছিল অমনি একটি হবি বা নেশা—নানা ধরনের ব্যবসা করা। জীবনে বহুরকম ব্যবসাই তিনি করেছেন এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তাকে ঐসব ব্যাপারে লোকসান দিতে হয়েছে—একটার পর একটা অকৃতকার্যতায়, কিন্তু তবু তিনি নিরাশ বা নিরুৎসাহ হন নি।

সংসারে তার আপনার জন বলতে ঐ একটিমাত্র ভাইঝি শকুন্তলাই।

শকুন্তলার, বিমলবাবুর মুখেই শোনা, বাবা প্রসাদ চৌধুরী বিমল চৌধুরীর একমাত্র সহোদর ছিলেন। শকুন্তলার যখন তিন বছর বয়স সেই সময় তার মার মৃত্যু হয়। প্রসাদ চৌধুরীও আর দ্বিতীয়বার দ্বারপরিগ্রহ করেন নি। যদিচ শোনা যায়, সি. পি.-তে কেন্দ্রীয় সরকারের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে মোটা মাইনের চাকরি করতেন প্রসাদ চৌধুরী—তথাপি মৃত্যুকালে একটি টাকাও নাকি মেয়ের জন্য রেখে যেতে পারেন নি, বরং কলকাতার কোন নামকরা মদের দোকানে কিছু ধারই রেখে গিয়েছিলেন।

চাকরিতে ঢোকার পর থেকেই মদ্যপান-দোষ প্রসাদ চৌধুরীর মধ্যে দেখা দেয় এবং স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে সেটা ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবং মৃত্যুও হয়েছিল তার অতিরিক্ত মদ্যপান করে মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালাতে চালাতে, ভয়াবহ একটা দুর্ঘটনার ফলে স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েক মাসের মধ্যেই।

কর্মজীবনে দুই ভাই বিমল ও প্রসাদ চৌধুরী পরস্পর থেকে দূরে অবস্থান করলেও পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কটা ছিন্ন হয়ে যায় নি। উভয়েই উভয়ের দেখাসাক্ষাৎ বড় একটা না হলেও খোঁজখবর নিতেন, পরস্পরের মধ্যে পত্রের আদান-প্রদানও ছিল।

সহোদরের আকস্মিক মৃত্যুসংবাদটা তারযোগে পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে সি. পি.-তে চলে গিয়েছিলেন এবং সেখানে গিয়ে বিমল চৌধুরী সঙ্গে করে সাড়ে তিন বছরের বাচ্চা ভাইঝি শকুন্তলাকে নিজের কাছে কলকাতায় নিয়ে এলেন। এবং সেই থেকেই শকুন্তলা তার কাকা বিমল চৌধুরীর কাছে আছে।

কিরীটী ঐ সময় বাধা দিল, অবিশ্যি আপনার মনে থাকবার কথা নয়, তবু শুনেও থাকেন কখনো যদি—আপনি যখন এখানে আসেন মিস্ চৌধুরী সে সময় কি ঐ সরমা ঝি এখানে ছিল?

সঙ্গে সঙ্গে শকুন্তলা কিরীটীর মুখের দিকে তাকালো এবং শান্ত মৃদু কণ্ঠে বললে, ছিল কিন্তু সরমা তো ঝি নয় কিরীটীবাবু!

শকুন্তলার কথায় একটু যেন বিস্ময়ের সঙ্গে কিরীটী ওর মুখের দিকে তাকালো।

ঝি নয়! মৃদু কণ্ঠে শুধাল।

না।

তবে যে শুনলাম সে এ বাড়ির পুরাতন ঝি?

না, যা শুনেছেন ভুল শুনেছেন—সে ঝি নয়।

তবে কে সে?

এ বাড়ির সঙ্গে তার কোন আত্মীয়তা বা কোন সম্পর্কই নেই সত্যি মিঃ রায়, তবু সে ঝি নয়। তারপর যেন একটু থেমে বলতে লাগল শকুন্তলা, সরমা এক কৈবর্ত পরিবারের মেয়ে, বারো বছর বয়সের সময় সে বিধবা হয় এবং কাকা তাকে নিজগৃহে আশ্রয় দেন। তার পূর্বইতিহাস এর বেশী কিছু আমার জানা নেই—জানবার চেষ্টাও আজ পর্যন্ত করি নি। এখানে এসে ওকে আমি দেখেছিলাম, মায়ের মতই সে আমাকে মানুষ করেছে—ও ঝি নয়।

ও। আমি ভেবেছিলাম–

শুধু আপনি কেন, বাইরে থেকে কেউ এলে বা কথা শুনলে ঐ রকমই একটা কিছু ভাববে—কিন্তু সে ঝি নয়। এবং কাকা তাকে সেভাবে কোন দিনই দেখতেন না, এ বাড়িতে তার একটি বিশেষ স্থান বরাবরই দেখেছি

ঠিক আছে। আপনি যা বলছিলেন বলুন।

শকুন্তলা চৌধুরী আবার বলতে শুরু করল।

গত পাঁচ বছর ধরে শকুন্তলারই ইচ্ছায় তার কাকা বিমল চৌধুরীর জন্মতিথি উৎসব পালন করা হচ্ছে। আজ সেই জন্মতিথি উৎসবই ছিল।

প্রত্যেকবারই ঐ দিনটিতে বিমল চৌধুরীর কিছু পরিচিত বন্ধুবান্ধব ও সতীর্থকে নিমন্ত্রণ করা হয়। এবারেও জন-পঞ্চাশেককে করা হয়েছিল। উৎসবের সঙ্গে জলযোগের আয়োজন ছিল।

বেলা চারটে থেকেই নিমন্ত্রিতরা সব আসতে শুরু করে ও এক এক করে আবার সন্ধ্যার পর থেকেই চলে যেতে শুরু করে। রাত্রি তখন বোধ করি সওয়া সাতটা হবে। একে একে নিমন্ত্রিতরা সবাই তখন প্রায় চলে গিয়েছে।

সামনের দোতলার ছাদেই সামিয়ানা খাটিয়ে প্যাণ্ডেল বেঁধে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল।

বিমল চৌধুরী সেখানেই একটা চেয়ারে বসে দীর্ঘদিনের সতীর্থ অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তীর সঙ্গে গল্প করছিলেন, এমন সময় রঞ্জন বোস এসে বলে তার মামাকে কে ফোনে ডাকছে।

বিমল চৌধুরী ভিতরে চলে যান সেই সংবাদ পেয়ে

বাধা দিল ঐ সময় আবার কিরীটী, এক্সকিউজ মি মিস্ চৌধুরী, একটা কথা–

বলুন।

বলছিলাম ঐ রঞ্জনবাবুর কথা। কে যেন বলছিলেন উনি মাসখানেক হলো মাত্র এখানে এসেছেন।

হ্যাঁ, মাসখানেকই হবে।

আচ্ছা রঞ্জনবাবু কি বিমলবাবুর আপন বোনের ছেলে?

হ্যাঁ। ওঁদের একমাত্র বোন সরলা দেবীর ছেলে।

মাসখানেক তাহলে রঞ্জনবাবু এখানে আছেন! কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ।

তার আগে উনি কোথায় ছিলেন?

মালয়ে। সেখানে পিসেমশাইয়ের কিসের যেন ব্যবসা ছিল।

ছিল কেন বলছেন, এখন কি নেই?

না, বছর তিনেক আগে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর রঞ্জনদাই ব্যবসাটা দেখছিল কিন্তু চালাতে পারল না, শেষ পর্যন্ত সেই ব্যবসা অন্যের হাতে চলে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই গত মাসে তাকে এখানে চলে আসতে হয়।

আর আপনার পিসিমা?

পিসিমা বছর দশক আগেই মারা গিয়েছেন।

আর ওঁর কোন ভাই-বোন নেই?

না।

এখানে উনি কি করছিলেন?

কিছুই না।

তবে কি বসেছিলেন নাকি?

না, ঠিক তাও নয়—প্রেস ও বইয়ের দোকান করবে বলে কাকার সঙ্গে কিছুদিন ধরে কথাবার্তা চলছিল।

কোন কিছু স্থির হয় নি?

না। কাকা রাজী হচ্ছিলেন না কিছুতেই।

কেন?

বলতে পারি না। তবে—

তবে?

আমার মনে হয়, কাকা যেন রঞ্জনদাকে ঠিক পছন্দ করছিলেন না। দিন দশেক আগে—

কি?

দুজনের মধ্যে খানিকটা কথা-কাটাকাটি হয়ে গিয়েছিল সরমাদির মুখে শুনি।

কি বিষয় নিয়ে হয়েছিল কথা-কাটাকাটি কিছু জানেন?

না।

আপনার কাকা কেন রঞ্জনবাবুকে পছন্দ করতেন না, সে সম্পর্কে কিছু আপনার ধারণা আছে?

না।

রঞ্জনবাবুর স্বভাবচরিত্র কেমন?

ভালই। তাছাড়া রঞ্জনদা অত্যন্ত ভদ্র ও বিনয়ী—

বয়স কত হবে তার?

আমার চাইতে বছর চারেকের বড়।

লেখপড়া?

ম্যাট্রিক পাস।

.

০৭.

শকুন্তলা আবার তার কাহিনী শুরু করল।

বিমল চৌধুরী ফোন ধরবার জন্য আধঘণ্টা চলে যাবার পর রিটায়ার্ড জজ মহেন্দ্র সান্যাল মশাই প্রথম বললেন, চৌধুরী এখনো ফিরছে না কেন? তিনি এবারে বিদায় নেবেন।

ভৃত্যকে ডেকে বিনয়েন্দ্র সেন বিমলবাবুর এক বাল্যবন্ধু, বিমলবাবুকে ডেকে দেবার জন্য বলেন ঐ সময়।

ভৃত্য ডাকতে যাবার কিছুক্ষণ পরেই ভিতর থেকে একটা গোলমালের শব্দ শোনা যায়।

ওঁরা সকলে সেই গোলমাল শুনে এগুতে যাবেন, ভৃত্য ছুটতে ছুটতে এমন সময় এসে হাজির হলো এবং হাউমাউ করে বলে, তার বাবু মারা গিয়েছে–

বিনয়েন্দ্র সেন যেন থমকে যান, সে কি রে!

হ্যাঁ, বাবু! ভৃত্য কাঁদতে কাঁদতে বলে, বাবু নেই—

সকলে একসঙ্গে প্রশ্ন করে, কোথায় কোথায় তোর বাবু?

চলুন দেখবেন, তাঁর শোবার ঘরে চেয়ারের ওপর মরে পড়ে রয়েছেন।

তাড়াতাড়ি সকলে গিয়ে বিমলবাবুর শোবার ঘরে হাজির হয়, এবং ঘরে ঢুকে এখন যে অবস্থায় মৃতদেহ চেয়ারে পড়ে আছে—ঠিক সেই অবস্থায় দেখতে পায়, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সরমা।

সরমার দেহে যেন এতটুকু প্রাণের স্পন্দন নেই। একেবারে পাথরের মূর্তি। মাথার ঘোমটা খসে পড়েছে, দুচোখের কোল বেয়ে নিঃশব্দে দুটি অশ্রুর ধারা গড়িয়ে পড়ছে।

ওঁরা সকলেই স্তম্ভিত বিস্ময়ে যেন কিছুক্ষণ ঐ দৃশ্যের দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কারো মুখে কোন কথা ফোটে না, কারো ওষ্ঠে কোন প্রশ্ন আসে না, সবাই যেন বোবা, সবাই যেন স্তব্ধ।

কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ যেন সরমার মধ্যে সম্বিৎ ফিরে আসে। সে মাথার কাপড়টা তুলে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় একটি কথাও না বলে।

মানুষটা যে মারা গিয়েছে কারোরই বুঝতে দেরি হয় না। তবু রিটায়ার্ড জজ মহেন্দ্র সান্যাল বিমলবাবুকে পরীক্ষা করে দেখেন।

দেহটা যদিও তখনো গরম রয়েছে—শ্বাস-প্রশ্বাসের কোন চিহ্নই নেই।

সকলে তবু মহেন্দ্র সান্যালের মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো।

ক্ষীণকণ্ঠে মহেন্দ্রবাবু বললেন, ডেড!

তারপর? শিবেন সোম শকুন্তলার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।

তারপর সরমাদিকেই প্রশ্ন করে জানা যায়, বিমলবাবুকে কি একটা কথা বলতে নাকি সরমা ঐ সময় তার শোবার ঘরে এসে তাকে ঐ মৃত অবস্থায় দেখে হঠাৎ পাথর হয়ে গিয়েছিল।

এবারে কিরীটীই প্রশ্ন করল, তাহলে সরমা দেবীই প্রথম ব্যাপারটা জানতে পারেন?

হ্যাঁ।

আপনি ঐ সময় কোথায় ছিলেন মিস্ চৌধুরী?

সন্ধ্যা থেকেই মাথার মধ্যে বড় যন্ত্রণা হচ্ছিল, আমি সাতটা নাগাদ গিয়ে আমার ঘরে আলো নিভিয়ে অন্ধকারে শুয়েছিলাম, গোলমাল শুনে ছুটে যাই।

কোন্ ঘরে আপনি থাকেন?

রঞ্জনদার পাশের ঘরটাই আমার ঘর।

আপনি তারপরই বোধ হয় আমাকে টেলিফোন করেন?

হ্যাঁ।

কেন বলুন তো, হঠাৎ আমাকে ফোন করতে গেলেন কেন মিস্ চৌধুরী? প্রশ্নটা করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় কিরীটী শকুন্তলার মুখের দিকে।

কারণ আমার—আমার এ ব্যাপারটা দেখেই মনে হয়েছিল—

কি? কি মনে হয়েছিল মিস্ চৌধুরী?

স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। সামথিং হ্যাপেণ্ড!

কেন?

তা আমি ঠিক বলতে পারব না মিঃ রায়, তবে—তবে আমার যেন তাই মনে হয়েছিল, আর তাই আপনাকে আমি ফোন করি।

ফোনটা কোথায় এ-বাড়ির?

ঘরের সামনে বারান্দাতেই আছে।

মিস্ চৌধুরী।

বলুন?

ফোনে আপনার কাকাকে কেউ ডাকছে এ খবরটা তাকে কে দিয়েছিল বলতে পারেন?

বোধ হয় ভোলা।

ভোলা বুঝি চাকরটার নাম?

হ্যাঁ।

কতদিন কাজ করছে এ বাড়িতে ভোলা?

নতুন এসেছে ও, এক মাসও হবে না, বোধ করি দিন-কুড়ি।

আর চাকর নেই?

আছে, রামচরণ—অনেকদিন সে এ বাড়িতে আছে কিন্তু বুড়ো হয়ে গিয়েছে—তাছাড়া হাঁপানির টান, কাজকর্মের বড় অসুবিধা হয় বলে ঐ ভোলাকে রাখা হয়েছিল। অবিশ্যি আরো একজন ঝি আছে—বুনী!

আচ্ছা মিস্ চৌধুরী, আপনাদের ফ্যামিলি-ফিজিসিয়ান ডাঃ ঘোষ বলছিলেন, কিছুদিন থেকে ইদানীং নাকি বিমলবাবুর মনটা বিক্ষিপ্ত ছিল, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিল—আপনি জানেন কিছু সে সম্পর্কে?

হ্যাঁ, কাকাকে যেন কিছুদিন ধরে বড্ড বেশী চিন্তিত মনে হতো। ফলে মাথার যন্ত্রণাও হচ্ছিল—আর তাই ডাঃ ঘোষকে তিনি কয়েক দিন আগে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাও জানি।

কারণ কিছু জানেন না?

না।

আচ্ছা, ব্যাপারটা রঞ্জনবাবু সম্পর্কে কোন কিছু বলে আপনার মনে হয় নি?

না, তবে—

তবে?

ইদানীং কিছুদিন ধরে একটা ব্যাপার আমার চোখে পড়ছে–

না।

কি? রাঘব সরকার প্রায়ই কাকার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন।

রাঘব সুরকার!

হ্যাঁ  এবং প্রতি রাত্রেই তিনি এলে, কাকার শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দুজনের মধ্যে কি সব কথাবার্তা হতো ঘণ্টাখানেক ঘণ্টাদেড়েক ধরে।

কি ব্যাপারে আলোচনা হতো আপনি জানেন না কিছু?

না।

আর একটা কথা মিস্ চৌধুরী—

বলুন?

আপনার যখন ধারণা ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়, কাউকে আপনি কোন রকম সন্দেহ করেন?

সন্দেহ।

হ্যাঁ।

না, সন্দেহ কাকেই বা সন্দেহ করব!

কাকে করবেন তা জিজ্ঞাসা করি নি, জিজ্ঞাসা করছি কাউকে করেন কিনা?

না।

আচ্ছা আপনি যেতে পারেন—বিনয়েন্দ্রবাবুকে পাঠিয়ে দিন—শিবেন সোম বললেন।

শকুন্তলা ঘর থেকে চলে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিল, হঠাৎ ঐ সময় কিরীটী আবার বাধা দিল, ওয়ান মিনিট মিস চৌধুরী—আর একটা কথা!

শকুন্তলা ঘুরে তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।

আপনার কাকার কোন উইল ছিল, আপনি জানেন?

না।

আচ্ছা আপনি যান।

শকুন্তলা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

.

বিনয়েন্দ্র সেন।

বিমল চৌধুরীর দীর্ঘদিনের বন্ধু। বেশ হৃষ্টপুষ্ট গোলগাল চেহারা। মাথার কাঁচা-পাকা চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। দুচোখে বুদ্ধির দীপ্তি। দাড়ি-গোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। পরিধানে দামী অ্যাশকালারের ট্রপিক্যাল সুট।

নমস্কার মিঃ সেন, বসুন।

বিনয়েন্দ্র সেন শিবেন সোমের নির্দেশে ওঁর মুখোমুখি চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলেন।

শুনছিলাম বিমলবাবুর সঙ্গে আপনার দীর্ঘদিনের পরিচয় মিঃ সেন! শিবেন সোম প্রশ্ন শুরু করেন।

হ্যাঁ, হিন্দু স্কুলে একসঙ্গে আমরা চার বছর পড়েছি, তারপর বিদ্যাসাগর কলেজেও চার বছর একসঙ্গে পড়েছি। সেন বললেন।

কি করেন আপনি?

আমার ছবির ডিস্ট্রিবিউসন অফিস আছে বেন্টিঙ্ক স্ট্রীটে—স্বাগতা পিকৰ্চাস অ্যাণ্ড ডিস্ট্রিবিউটার্স।

কলকাতায় কোথায় আপনি থাকেন?

শ্যামবাজারে।

কাছেই থাকেন তাহলে বলুন?

হ্যাঁ।

প্রায়ই তাহলে আপনাদের উভয়ের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ হতো নিশ্চয়ই?

না, প্রায়ই হতো না, তবে মাসে এক-আধবার হতো।

এবারে কিরীটী প্রশ্ন করল, আজকের আগে শেষ আপনার ওঁর সঙ্গে কবে সাক্ষাৎ হয়েছিল মনে আছে?

বোধ করি দিন দশেক আগে। এই পথ দিয়েই এবোডড্রাম থেকে ফিরছিলাম, দেখা করে গিয়েছিলাম ফিরতি পথে। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক এখানে ছিলাম সেদিন।

কি ধরনের কথাবার্তা সেদিন আপনাদের মধ্যে হয়েছিল?

বিশেষ সেদিন কোন কথাবার্তা হয় নি, বিমল তার ডাইরী থেকে আমাকে পড়ে শোনাচ্ছিল অতীতের সব কথা।

ডাইরী রাখতেন নাকি তিনি?

রাখতে যে সেদিনই প্রথম জানতে পারি, আগে কখনো শুনি নি।

তা হঠাৎ সেদিন ডাইরী পড়ে শোনালেন কেন?

বলছিল হিসেব-নিকেশের সময় ঘনিয়ে এসেছে, তাই একটা জমাখরচের খসড়া নাকি সে তৈরী করেছে।

মিঃ সেন?

বলুন।

সেদিন আপনার সেই বন্ধুর ডাইরী পাঠ থেকে তার জীবনের এমন কোন বিশেষ গোপন কথা কিছু কি জানতে পেরেছিলেন যা পূর্বে কখনো আপনি শোনেন নি তার মুখ থেকে?

তা কিছু জেনেছিলাম।

কি? যদি আপত্তি না থাকে আপনার–

ক্ষমা করবেন, তার জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত কথা সে-সব। ইউ মে বী রেস্ট অ্যাসিওরড় কিরীটীবাবু, আজকের দুর্ঘটনার সঙ্গে সে-সবের কোন সম্পর্ক আছে বলে আমার মনে হয় না। তাছাড়া আমার পক্ষে সে-সব কথা বলা সম্ভবও নয়।

বেশ, বলতে আপনার অনিচ্ছা থাকে আপনাকে আমি পীড়াপীড়ি করব না সে সম্পর্কে। কিন্তু একটা কথা, সেদিন আপনার বন্ধুর কথাবার্তায় বা হাবভাবে এমন কিছু কি আপনি লক্ষ্য করেছিলেন যাতে মনে হয় তিনি বিচলিত বা চিন্তিত?

হ্যাঁ, তাকে যেন একটু বিচলিতই মনে হয়েছিল সেদিন।

আর একটা কথা, আপনার বন্ধুর আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল জানেন কিছু?

ভালই। ব্যাঙ্কে তার বেশ কিছু নগদ টাকা ফিকস ডিপোজিটে এবং কিছু ক্যাশ সার্টিফিকেটে আছে আমি জানি।

তার পরিমাণ আন্দাজ কত হবে বলে আপনার ধারণা?

তা হাজার পঞ্চাশেক হবে। তাছাড়া—

বলুন? হাজার পঁচিশেক টাকার জীবন-বীমাও তার আছে।

হুঁ। আচ্ছা বলতে পারেন—তার কোন উইল বা ঐ টাকাকড়ি সম্পর্কে কোন ফিউচার প্ল্যান ছিল কিনা?

উইল ছিল কিনা জানি না তবে ইদানীং কিছুদিন ধরে একটা বাড়ি করবে বলে জায়গা দেখছিল বিমল আমি জানি।

আচ্ছা, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ—আপনি যেতে পারেন।

শিবেন সোম বললেন, অধ্যাপক চক্রবর্তীকে দয়া করে একবার পাঠিয়ে দেবেন এ-ঘরে মিঃ সেন।

মিঃ সেন চলে গেলেন।

.

০৮.

অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী এসে ঘরে ঢুকলেন।

রোগা লম্বা চেহারা। মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা। খাঁড়ার মত উঁচু নাক। চোখে মোটা কালো সেলুলয়েডের ফ্রেমে পুরু লেন্সের চশমা। কালো কুচকুচে গায়ের বর্ণ। পরিধানে খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি।

অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী ঘরের মধ্যে পা দিয়েই যেন একেবারে যাকে বলে ফেটে পড়লেন। কটা রাত হয়েছে আপনার কিছু খেয়াল আছে দারোগাবাবু? বেশ চড়া সুরেই কথাগুলো বললেন অধ্যাপক চক্রবর্তী।

শিবেন সোম বললেন, তা একটু হয়ে গিয়েছে—

একটু হয়ে গিয়েছে! ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখুন তো, সোয়া এগারোটা রাত এখন–তাছাড়া আমাদের সকলকে এভাবে আটকে রাখার মানেটাই বা কি? আপনার কি ধারণা আমরা কেউ এর সঙ্গে জড়িত আছি?

কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন মিঃ চক্রবর্তী, আকস্মিকভাবে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে বলেই। আপনাদের এভাবে কষ্ট দিতে হল আমাদের–

দুর্ঘটনা! দুর্ঘটনা কিসের? লোকটা হাইপারটেনশনে ভুগছিল—সাডেন স্ট্রোকে হার্টফেল করেছে—এর মধ্যে দুর্ঘটনার কি আপনারা দেখলেন?

হ্যাঁ  মিঃ চক্রবর্তী, কথা বললে এবারে কিরীটী, হার্টফেল করেই উনি মারা গিয়েছেন সত্য, কিন্তু স্বাভাবিক হার্টফেল নয়—ইটস্ এ মার্ডার অ্যাণ্ড ডেলিবারেট মার্ডার!

কি—কি বললেন?

নিষ্ঠুরভাবে কেউ আপনার বন্ধু বিমলবাবুকে হত্যা করেছে।

হত্যা? বিস্ময়ে যেন অধ্যাপক চক্রবর্তীর কণ্ঠরোধ হয়ে আসে, হত্যা-ইউ মীন—

হ্যাঁ–খুন!

না না—হাউ অ্যাবসার্ড—

অ্যাবসার্ড নয়—নিষ্ঠুর সত্যি সত্যিই হত্যা করা হয়েছে বিমলবাবুকে। কিরীটী আবার বলল শান্ত দৃঢ়কণ্ঠে।

হঠাৎ যেন একটা নির্মম আঘাতে মনে হল অধ্যাপক চক্রবর্তী একেবারে বোবা হয়ে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন কিরীটীর মুখের দিকে।

তারপরই চেয়ারটার উপর থ করে যেন বসে পড়লেন।

সত্যি বিমল নিহত হয়েছে! কিন্তু কে কে করল এ কাজ? কতকটা যেন আত্মগতভাবেই নিম্নকণ্ঠে কথাগুলো উচ্চারণ করলেন চক্রবর্তী।

মিঃ চক্রবর্তী।

বোবা দৃষ্টিতে চক্রবর্তী কিরীটীর দিকে মুখ তুলে তাকালেন।

বুঝতে পারছি ব্যাপারটা সত্যিই আপনার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে, আমাদেরও তাই মনে হয়েছিল প্রথমে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে—

কি–কি মনে হচ্ছে আপনাদের?

আপনাদের সকলের সাহায্য পেলে হয়ত এই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা কি করে ঘটল আমরা তার একটা কিনারা করতে পারব।

আমাদের সাহায্যে?

হ্যাঁ।

কিন্তু কি—কি সাহায্য আমি আপনাদের করতে পারি?

আপনার বন্ধুর আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কেউ এ কাজ করতে পারে বলে আপনার মনে হয়? বলছিলাম এমন কোন ঘটনা আপনি কিছু কি জানেন আপনার বন্ধুর-সতীর্থের জীবনের, যার মূলে এই নৃশংস হত্যার বীজ লুকিয়ে থাকতে পারে!

না না—বিমলের কেউ শত্রু থাকতে পারে বলে অন্ততঃ আমার জানা নেই।

শত্রুই যে এ কাজ করতে পারে মনে করছেন কেন? কোন বিশেষ মিত্রস্থানীয় লোকও স্বার্থের জন্য তো এ কাজ করতে পারে।

স্বার্থ?

হ্যাঁ।

কি স্বার্থ?

তা অবিশ্যি বলতে পারছি না, তবে এটা তো ঠিকই হত্যাকারী বিনা উদ্দেশ্যে ঐ গর্হিত কাজটা করে নি! দেয়ার মাস্ট বী সাম কজ! আচ্ছা একটা কথা কি আপনি জানেন মিঃ চক্রবর্তী, ইদানীং কিছুদিন ধরে আপনার সতীর্থের মনটা বিক্ষিপ্ত ছিল?

হ্যাঁ, সেটা আমি লক্ষ্য করেছিলাম—

লক্ষ্য করেছিলেন?

করেছি বৈকি—

কারণ কিছু জানতে পারেন নি?

না। মানুষটা বরাবর এমন চাপা-প্রকৃতির ছিল, কাউকে কিছু বলতো না—কাউকে নিজের চিন্তার ভাগটা দেওয়াকেও সে দুর্বলতা মনে করত।

তাহলে আপনি কিছু জানেন না, তিনিও আপনাকে কিছু বলেন নি!

.

অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তীর পরে ঘরে ডাক পড়ল রিটায়ার্ড জজ-বিমল চৌধুরীর প্রতিবেশী মহেন্দ্র সান্যালের।

কিন্তু মহেন্দ্র সান্যালও ব্যাপারটার উপরে এতটুকু আলোকসম্পাত করতে পারলেন না।

তিনি বললেন, অধ্যাপকের সঙ্গে প্রতিবেশী হিসাবে যতটুকু ঘনিষ্ঠতা থাকা সম্ভব তার চাইতে কিছুই বেশী ছিল না। তিনিও কখনো তাঁর বাড়ির বা নিজের খবর যেমন জিজ্ঞাসা করেন নি, তেমনি অধ্যাপকও গায়ে-পড়া হয়ে কোনদিন কিছু বলেন নি। অতএব তিনি পুলিসকে কোনরূপ সাহায্য ঐ ব্যাপারে করতে পারছেন না বলে দুঃখিত।

অগত্যা মহেন্দ্র সান্যালকে বিদায় দিতেই হল।

মহেন্দ্র সান্যাল ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

নিমন্ত্রিত হিসাবে সেদিন বাইরের লোক যারা ছিল তাদের সকলকেই অতঃপর বিদায় দেওয়ার জন্য শিবেন সোম বললেন। তারপর বললেন, ওদের বাকী দুজন—ঐ রাঘব সরকার আর দুষ্মন্ত রায়কেই বা আটকে রেখে আর কি হবে কিরীটী, ওদেরও ছেড়ে দিই, কি বল?

না না–রাঘব সরকার আর দুষ্মন্ত রায়কে যে আমার অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করবার আছে! কিরীটী বলে।

জিজ্ঞাসা করছ করো, তবে বিশেষ কিছু ওদের কাছ থেকেও জানা যাবে বলে তো আমার মনে হয় না কিরীটী। শিবেন সোম বললেন।

কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বলে, কিছু কি বলা যায়! তাছাড়া তোমাকে তখন বললাম না, মিস্ চৌধুরী চাইছিলেন দুষ্মন্ত রায়কে বিয়ে করতে আর বিমলবাবু চাইছিলেন রাঘব সরকারের সঙ্গে ভাইঝির বিয়ে দিতে!

হ্যাঁ, তা বলেছিলে বটে, কিন্তু—

ডাকো, ডাকো—আগে তোমার ঐ রাঘব সরকারকেই ডাকো!

রাঘব সরকার এসে ঘরে ঢুকলেন।

শিবেন সোমই কয়েকটা মামুলী প্রশ্ন করবার পর কিরীটী মাঝখানে বাধা দিল।

মিঃ সরকার, এ কথা কি সত্যি যে অদূর ভবিষ্যতে একদিন বিমলবাবুর একমাত্র ভাইঝি শকুন্তলা দেবীর সঙ্গে আপনার বিবাহ দেবেন বলে তিনি আপনাকে কথা দিয়েছিলেন?

কথার মাঝখানে কিরীটীর কথাটা এমন অতর্কিতে উচ্চারিত হয়েছিল যে রাঘব সরকার যেন হঠাৎ চমকে উঠে কিরীটীর মুখের দিকে না তাকিয়ে পারলেন না।

কিরীটী আবার প্রশ্ন করল, কথাটা কি সত্যি?

হ্যাঁ।

কথাটা তাহলে সত্যি?

হ্যাঁ। কিন্তু হঠাৎ এ কথাটা আপনি জানলেনই বা কি করে আর জিজ্ঞাসাই বা করছেন। কেন?

জানলাম কি করে নাই বা শুনলেন, আর জিজ্ঞাসা করছি কেন যদি প্রশ্ন করেন তো বলব, ব্যাপারটা কেমন যেন একটু অস্বাভাবিক তাই জানতে চাইছিলাম—

অস্বাভাবিক কেন?

দেখুন মিঃ সরকার, আজকের দিনে অসবর্ণ বিবাহের কথাটা আমি তুলব না, কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই জানেন শকুন্তলা দেবী মনে মনে বিমলবাবুর ছাত্র দুষ্মন্ত রায়কে ভালবাসেন!

না, জানি না।

জানেন না?

না।

কিন্তু–

আর যদি বাসেই, তাতে আমার কি?

কিন্তু একজন নারী মনে মনে অন্য এক পুরুষকে কামনা করে জেনেও সেই নারীকে আপনি বিবাহ করতে চলেছেন!

দেখুন আপনারা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে এনক্রোচ করবেন না।

অবশ্যই করতাম না, যদি আজকের এই দুর্ঘটনাটা না ঘটতে!

মানে কি বলতে চান আপনি?

বলতে যা চাই সেটা কি খুব অস্পষ্ট মনে হচ্ছে আপনার মিঃ সরকার?

অবশ্যই! কারণ সে কথা আসছেই বা কি করে?

আচ্ছা ছেড়ে দিন সে কথা, অন্য একটা কথার জবাব দিন!

বলুন?

অধ্যাপকের সঙ্গে আপনার কি সূত্রে আলাপ হয় প্রথমে?

প্রথমে আলাপ হয়েছিল আমার দোকানের একজন কাস্টোমার হিসাবে।

তারপর?

তারপর আবার কি! সেই আলাপই ক্রমে ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়।

এমন ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হল যে একেবারে বিবাহ-সম্পর্ক! একটু বেশী হল না কি মিঃ সরকার?

কথাটা কিরীটী বেশ শান্ত ও নির্বিকার কণ্ঠে বললেও, মনে হল যেন ব্যঙ্গের একটু সুর লেগে আছে তার বলার ভঙ্গীতে, তার কণ্ঠের স্বরে।

এই সব অবান্তর প্রশ্ন আপনারা কেন করছেন আমি বুঝতে পারছি না! রাঘব সরকার বিশেষ বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠেই যেন কথাটা বলে উঠলেন।

আচ্ছা রাঘববাবু, আপনি নিশ্চয়ই জানতেন আপনার ক্লায়েন্ট ও ভাবী শ্বশুরমশাই রক্তচাপাধিক্যে ভুগছেন! কিরীটী আবার কথা বললে।

না। তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ।

জানতেন না?

না।

আশ্চর্য! অমন একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আপনাদের মধ্যে হতে চলেছিল, অথচ ঐ কথাটাই আপনি জানতেন না?

বিরক্তি ও ক্রোধপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন রাঘব সরকার কিরীটীর মুখের দিকে এবং তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললেন, মশাই আপনি কে জানতে পারি কি?

উনি পুলিসেরই লোক মিঃ সরকার। জবাব দিলেন শিবেন সোম, উনি যা জিজ্ঞাসা করছেন তার জবাব দিন।

মিঃ সরকার! আবার কিরীটী ডাকল।

মুখে কোন জবাব না দিয়ে পূর্ববৎ বিরক্তিপূর্ণ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে পুনরায় তাকালেন রাঘব সরকার কিরীটীর মুখের দিকে।

আপনার কি এটাই প্রথম সংসার করবার অভিলাষ নাকি?

মানে?

মানে জিজ্ঞাসা করছিলাম, ইতিপূর্বে কি আপনি বিবাহাদি করেন নি?

করেছি।

কি বললেন আপনি? বিবাহ—

হ্যাঁ করেছিলাম—সে স্ত্রী আজ পাঁচ বছর হল গত হয়েছেন।

ছেলেপুলে?

না, নেই।

তাহলে পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা বলুন!

কটমট করে আবার রাঘব সরকার তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে এবং রূঢ়কণ্ঠে বললেন, আপনি বিমলবাবুর মৃত্যুব তদন্ত করছেন, না আমার ঠিকুজিনক্ষত্র সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছেন—কোন্টা করছেন বলতে পারেন?

এক ঢিলে দুই পাখিই মারছি! তবে আপনি একটু ভুল করছেন মিঃ সরকার, বিমলবাবুর মৃত্যুর নয়—হত্যার তদন্ত করছি আমরা!

কি বললেন?

বললাম তো হত্যা!

ও, আপনাদের ধারণা বুঝি বিমলবাবুকে হত্যা করা হয়েছে?

ধারণা নয়, সেটাই সত্য। যাক সে কথা—আচ্ছা আপনি বলেছেন অবিশ্যি একজন খরিদ্দার হিসাবেই বিমলবাবুর সঙ্গে আপনার প্রথম পরিচয় ও পরে ঘনিষ্ঠতা, কিন্তু আমি যেন শুনেছিলাম আপনার সঙ্গে বিমলবাবুর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল রেসের ময়দানে—কথাটা কি সত্যি?

কি বললেন?

জিজ্ঞাসা করছি রেসের ময়দানেই কি আপনাদের উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল?

হঠাৎ যেন মনে হল রাঘব সরকারের সমস্ত আক্রোশ ও বিরক্তি দপ করে নিভে গিয়েছে। মুখখানা তার যেন একেবারে হঠাৎ চুপসে গিয়েছে।

কি, জবাব দিচ্ছেন না যে?

কিসের জবাব চান?

যে প্রশ্নটা করলাম!

জবাব দেবার কিছু নেই।

কেন?

কারণ কিছু নেই বলে!

I see! আচ্ছা মিঃ সরকার, আপনি যেতে পারেন।

রাঘব সরকার মাথা নিচু করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। এবং রাঘব সরকার ঘর থেকে বের হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই শিবেন সোম কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ব্যাপারটা ঠিক কি হল মিঃ রায়?

কিসের ব্যাপার?

লোকটা যে রেস খেলে, জানলেন কি করে?

সামান্য একটা সূত্রের উপর নির্ভর করে—স্রেফ অনুমানের ওপরেই ঢিল ছুঁড়েছিলাম। সামান্য সূত্র!

হ্যাঁ, গতকাল ইসমাইল খানের ছদ্মবেশে ওঁর বৌবাজারের ইকনমিক জুয়েলার্সের দোকানে গিয়েছিলাম—

হঠাৎ?

হঠাৎ ঠিক নয়—

তবে?

লোকটা চোরাই জুয়েলস্ ও সিথেটিক জুয়েলস্ অর্থাৎ নকল জহরতের কারবার করে, পূর্বে সেই রকম একটা কথা আমার কানে এসেছিল। তারপর গতকাল ঐ লোকটির কথাই শকুন্তলা দেবীর মুখে শুনে বিশেষ যেন সন্দিগ্ধ হয়ে উঠি। সোজা ইকনমিক জুয়েলার্সে চলে যাই। সেখানে ওর ঘরে বসবার টেবিলে একটা রেসকোর্সের বই দেখতে পাই, তারই ওপরে নির্ভর করে ঢিলটা ছুঁড়েছিলাম অন্ধকারে। কিন্তু যাই হোক, অনুমানটা যে আমার মিথ্যা নয় সে তো আপনিও কিছুক্ষণ আগে দেখলেন!

কিন্তু–

শিবেনবাবু, রাঘব সরকারের মত একজন লোকের সঙ্গে বিমলবাবুর মত একজন লোকের এতদূর ঘনিষ্ঠতা—ব্যাপারটা যেন কিছুতেই আমার মন মেনে নিতে পারছিল না! এবং সত্যি কথা বলতে কি, সহজভাবে যে ব্যাপারটা সম্ভব নয়—এবং তাই সেই গোলকধাঁধা থেকে বেরুবার জন্যই ঐভাবে ঢিলটি আমি ছুঁড়েছিলাম! যাক, এখন আমি নিশ্চিন্ত—অনেক জটিলতাই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।

জটিলতা?

হ্যাঁ। কিন্তু রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গিয়েছে, আপনার তদন্ত-পর্ব এবারে সত্যি সত্যিই শেষ না করলে যে রাত পুইয়ে যাবে!

.

০৯.

এবারে রঞ্জন বোসকে ডাকা হল।

বয়েস ভদ্রলোকের চব্বিশ থেকে পঁচিশের মধ্যেই বলে মনে হয়। দোহারা চেহারা, গায়ের রঙটা একটু চাপা। চোখে মুখে বেশ একটা বুদ্ধির দীপ্তি রয়েছে। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা। হাতে সোনার রিস্টওয়াচ। পরিধানে দামী গ্রে কলারের গ্যাবার্ডিনের লংস ও সাদা সার্কস্কিনের হাওয়াই সার্ট।

ভদ্রলোক যে শৌখীন প্রথম দৃষ্টিতেই বোঝা যায়।

শুনেছেন বোধহয় রঞ্জনবাবু, কিরীটীই প্রশ্ন শুরু করে, আপনার মামার মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়—কেউ তাঁকে হত্যা করেছে।

শুনেছি—আপনাদের তাই ধারণা, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না।

বিশ্বাস করেন না?

না।

কেন বলুন তো?

কেন আবার কি? মামার মত নিরীহ একজন ভদ্রলোককে কার আবার হত্যা করবার প্রয়োজন হতে পারে?

ওকথা বলবেন না রঞ্জনবাবু, প্রয়োজন যে কার কখন কিসের হয় কেউ কি বলতে পারে! কিন্তু যাক সে কথা, আপনি তাহলে কথাটা শুনেছেন?

হ্যাঁ।

কিন্তু কার মুখে শুনলেন কথাটা?

কার মুখে!

হ্যাঁ।

তা—তা ঠিক মনে নেই, তবে কানাঘুষা শুনছিলাম ভিতরে—

হুঁ। আচ্ছা রঞ্জনবাবু, মালয় থেকে হঠাৎ আপনি চলে এলেন কেন?

মালয়ের কথাটা যখন শুনেছেন, তখন নিশ্চয় এও শুনেছেন কেন সেখান থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি!

হ্যাঁ শুনেছি—তবু আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।

কি ঠিক শুনতে চান বলুন?

আপনার বাবার ব্যবসাটা হঠাৎ ফেল করল কি করে?

বাবার নিজের গাফিলতির জন্য!

কি গাফিলতি?

সে-সব শুনে কি করবেন?

টাকার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনে অনেক রকম সমস্যা এসে দেখা দেয়—সেই সব আর কি!

ওঃ, আচ্ছা রঞ্জনবাবু, মালয়ে থাকতে আপনার মামা বিমলবাবুর সঙ্গে নিশ্চয়ই আপনাদের নিয়মিত চিঠিপত্র চলতো?

চলতো বৈকি। যাকে বলে–বাবার মামার সঙ্গে রেগুলার চিঠিপত্র চলতো।

তাহলে আপনাদের পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ ছিল?

 নিশ্চয়ই।

রঞ্জনবাবু, আপনার মামাকে হত্যা করার ব্যাপারটা কি মনে হয়? কাউকে সন্দেহ করেন কি?

না মশাই, সন্দেহ করব কি, শোনা অবধি তো যাকে বলে একেবারে তাজ্জব বনে গিয়েছি!

ভাল কথা রঞ্জনবাবু, রাঘব সরকারের সঙ্গে তাণনার বোন শকুন্তলা দেবীর বিয়ের কথা কিছু শুনেছিলেন?

এখানে এসেই তো শুনেছি—

আপনার সমর্থন ছিল ব্যাপারটায়?

আদপেই না। মামাকে সে কথা বলেছিও, কিন্তু মামা অ্যাডামেন্ট-কারো কথাই শুনবেন না!

বলতে পারেন, তা আপনার মামাই বা এ ধরনের বিয়েতে কেন জিদ করছিলেন?

কে জানে মশাই কেন—তাছাড়া মামা যদি বিয়ে দিতে পারেন আর শকুন্তলা যদি বিয়ে করতে পারে তো আমার কি বলুন!

দুষ্মন্ত রায়কে শকুন্তলা দেবী মনে মনে ভালবাসেন, আপনি জানেন?

তা জানতাম।

জানতেন?

হুঁ। শকুন্তলাই তো আমাকে কথাটা বলেছিল।

তাই বুঝি! তা দুষ্মন্ত রায়কে আপনার কেমন লোক বলে মনে হয় রঞ্জনবাবু?

এমনি মন্দ লোক নয়, তবে এক নম্বরের কাওয়ার্ড! ভীতু—

ভীতু?

নয় তো কি—ভালবাসতে পারিস, আর জোর করে যাকে ভালবাসিস তাকে বিয়ে করতে পারিস না!

তা সত্যি। আচ্ছা রঞ্জনবাবু, আপনি তো আপনার মামা যে ঘরে থাকতেন তার পাশের ঘরেই থাকেন!

হ্যাঁ।

ইদানীং রাঘব সরকার রাত্রে এলে আপনার মামার ঘরে দরজা বন্ধ করে তাদের মধ্যে কি সব কথাবার্তা হতো কখনো শুনেছেন কিছু?

না মশাই। তবে—

তবে?

একটা ব্যাপার ইদানীং লক্ষ্য করে কেমন যেন আশ্চর্যই লাগছিল।

কি?

মামা যেন রাঘব সরকারের কাছে কেমন কেঁচোটি হয়ে থাকতেন।

হুঁ। আচ্ছা রাঘব সরকার লোকটিকে আপনার কি রকম মনে হয় রঞ্জনবাবু?

একটি বাস্তুঘুঘু।

বাঃ, বেশ বলেছেন! সত্যি আশ্চর্য, জন্মাবধি আপনি মালয়ে থেকেও এমন চমৎকার বাংলা দেশের প্রবচনগুলো আয়ত্ত করেছেন! সত্যিই আপনার তারিফ না করে পারছি না।

অ্যাঁ, কি বললেন? যেন একটু থতমত খেয়েই কথাটা বলেন রঞ্জনবাবু।

না, কিছু না। আচ্ছা রঞ্জনবাবু, সরমা দেবী তো এ বাড়িতে অনেক দিন আছেন, তাই?

সেই রকমই তো শুনেছি।

আচ্ছা তার সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?

ওসব স্ক্যাণ্ডেলাস অ্যাফেয়ার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি নাই বা করলেন মশাই—

স্ক্যাণ্ডেলাস অ্যাফেয়ার!

নয় তো কি–ওসব হচ্ছে ড়ুবে ড়ুবে জল খেয়ে একাদশী করা! ও ঢাক-ঢাক গুড-গুড করলে কি হবে—ব্যাপারটা তো আর জানতে কারো বাকী নেই!

কথাটা খুলেই বলুন না।

না মশাই, মরে গেলেও গুরুজন ব্যক্তি তোপাপ-কথা আর এ-মুখে না-ই উচ্চারণ করলাম!

হুঁ, আচ্ছা থাক থাক।

.

১০.

রঞ্জন বোসকে বিদায় দেবার পর কিরীটীর ইচ্ছাক্রমেই ডাকা হল এবারে দুষ্মন্ত রায়কে।

গত সন্ধ্যায় দুষ্মন্ত রায়ের চেহারার বর্ণনাপ্রসঙ্গে শকুন্তলা বলেছিল রাঘব সরকারের চেহারার সঙ্গে তুলনায় নাকি দুষ্মন্ত রায় আদৌ আকর্ষণীয় নয়। কথাটা যে মিথ্যে নয় প্রথম দৃষ্টিতে তাই মনে হবে সত্যিই।

কিন্তু কিছুক্ষণ দুষ্মন্ত রায়ের দিকে চেয়ে থাকলে মনে হবে ঠিক উল্টোটিই।

দুষ্মন্ত রায়ের চেহারার মধ্যে কোন একটা সহজগ্রাহ্য রূপ বা সৌন্দর্যের আকর্ষণ নেই সত্যি, কিন্তু এমন একটা বিশেষ অথচ চাপা আকর্ষণ আছে যা একবার নজরে পড়লে নজর ফিরিয়ে নেওয়া কষ্টসাধ্য। যেহেতু একবার সেই বিশেষত্ব কারো চোখে পড়লে সেটা মনের মধ্যে দাগ কেটে বসবেই—এবং সে রূপের বর্ণনাও দেওয়া যেমন দুঃসাধ্য, বোঝানোও বুঝি তেমনি কষ্টকর।

লোকটি লম্বা, কিন্তু দেহে ঠিক পরিমিত পেশী ও মেদ থাকার দরুন লম্বা মনে হয় না। দেহের রঙ কালো—যাকে বলে রীতিমত কালো। কিন্তু সেই কালো রঙের মধ্যেও যেন অদ্ভুত একটা দ্যুতি আছে। গাল দুটো ভাঙা। নাকটা খাড়া। প্রশস্ত ললাট। রেশমের মত একমাথা অযত্নবিন্যস্ত তৈলহীন লালচে চুল। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো।

পরিধানে ধুতি ও গেরুয়া রঙের খদ্দরের পাঞ্জাবি।

আপনার নাম দুষ্মন্ত রায়? শিবেন সোমই প্রশ্ন শুরু করলেন।

হ্যাঁ। মৃদুকণ্ঠে জবাব এল। এবং কণ্ঠস্বরে একটা আত্মপ্রত্যয় বা আত্মদৃঢ়তা যেন স্পষ্ট। সেই হেতুই বোধ হয় আবার দুষ্মন্ত রায়ের মুখের দিকে তাকালাম।

বসুন। শিবেন সোম বললেন।

দুষ্মন্ত রায় একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন।

কি করেন আপনি?

বিমলবাবুর কাছে ডক্টরেটের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম।

এ বাড়ির সকলের সঙ্গেই আপনার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা আছে দুষ্মন্তবাবু, তাই না? প্রশ্নটা করল কিরীটীই এবারে।

এ বাড়ির সকলকেই আমি চিনি। জবাব দিলেন দুষ্মন্ত রায়।

দুষ্মন্তবাবু! আবার কিরীটী প্রশ্ন করে।

বলুন?

কথাটা কি সত্যি যে, শকুন্তলা দেবীকে আপনি বিশেষ দৃষ্টিতে দেখেন এবং তিনিও আপনাকে দেখেন?

ঠিকই শুনেছেন। পরস্পর আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি।

আপনার অধ্যাপক নিশ্চয়ই ব্যাপারটা জানতেন! কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

বলেছিলাম তাকে।

কি বলেছিলেন?

কুন্তলাকে আমি বিয়ে করতে চাই—

আপনার সে কথার কি জবাব দিয়েছিলেন তিনি? সম্মত হয়েছিলেন কি?

রাজী হন নি। প্রথমদিকে তার নীরব সম্মতিই ছিল, কিন্তু পরে কথাটা তুলতে কেন জানি না–

রাজী হন নি?

না। তবে রাজী তিনি না হলেও আমাদের কি এসে যাচ্ছে সে সাবালিকা, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়াতে পারেন না আইনত!

তাকে এ কথা বলেছিলেন নাকি?

না, প্রয়োজন বোধ করি নি।

আচ্ছা আপনি কি জানতেন, আপনার অধ্যাপকের ইচ্ছা ছিল শকুন্তলা দেবীকে তিনি রাঘব সরকারের সঙ্গে বিয়ে দেবেন?

শুনেছিলাম কথাটা। শকুন্তলাই আমাকে বলেছিল। কিন্তু তাতেই বা কি এসে গেল!

আচ্ছা শকুন্তলা দেবী কি আপনার সঙ্গে একমত?

না।

মানে–তার মত–

না, তার মত ছিল না। কাকা যতদিন বেঁচে আছেন তাঁর বিরুদ্ধে শকুন্তলার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয় এই কথাই সে বলেছিল।

তা হলে বলুন আপনার পরিকল্পনাটা ভেঙে গিয়েছিল?

না, ভেঙে যাবে কেন? এইটুকুই শুধু বুঝেছিলাম, কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে—মানে বিমলবাবুর মৃত্যু পর্যন্ত

কিন্তু দুষ্মন্তবাবু, আপনার অধ্যাপক হঠাৎ রাঘব সরকারের সঙ্গেই বা শকুন্তলা দেবীর বিয়ে দেবার জন্য স্থিরপ্রতিজ্ঞ হয়েছিলেন কেন? কিছু শুনেছিলেন সে-সম্পর্কে কখনো কারো

কাছে?

না।

শকুন্তলা দেবীও আপনাকে কিছু বলেন নি?

না।

আচ্ছা রাঘব সরকারের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে নিশ্চয়ই?

না।

কিন্তু এ বাড়িতে তো আপনাদের দুজনেরই যাতায়াত ছিল, সেক্ষেত্রে তো পরস্পর আপনাদের দেখা-সাক্ষাৎ হওয়াটা–

দেখা হবে না কেন—বহুবার হয়েছে!

তবে?

কেন যেন লোকটাকে আমার ভাল লাগে না—

লোকটাকে আপনার ভাল লাগত না?

না।

কিন্তু একটু আগে তার সঙ্গে, সামান্যক্ষণের জন্য হলেও, আলাপ করে তো আমাদের ভালই লাগল। তবে আপনার

তবে আমার কেন ভাল লাগে না লোকটাকে, এই তো আপনার প্রশ্ন? দেখুন কাউকে কারো ভালো লাগালাগির ব্যাপারটা একান্তই ব্যক্তিগত নয় কি? এবং তার জন্য কি সর্বক্ষেত্রেই কোন কারণ থাকে বা থাকতেই হবে-এমন কোন কথা আছে?

দুষ্মন্ত রায়ের কথা বলার ভঙ্গির মধ্যে এমন একটা বিশেষত্ব ছিল যে পুনরায় তার মুখের দিকে আপনা হতেই যেন দৃষ্টি আমার আকর্ষণ করে।

মনে হল মুখের কোথাও হাসি না থাকলেও, তার দুই চোখের দৃষ্টিতে একটা চাপা হাসির বিদ্যুৎ যেন খেলছে। এবং বলাই বাহুল্য, ব্যাপারটা যে কিরীটীর প্রখর দৃষ্টিকে এড়িয়ে যায় নি—তার পরবর্তী কথাতেই সেটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়।

কথাটা সত্যিই আপনি মিথ্যা বলেন নি দুষ্মন্তবাবু! নইলে দেখুন না, ভাগ্যে মনের অগোচরে পাপ নেইনচেৎ পাশাপাশি দিনের পর দিন আমাদের কত বন্ধু, সুহৃদ ও পরিচিত জনের পক্ষেই বাস করাটা অসম্ভব হয়ে উঠত, তাই নয় কি?

চেয়ে ছিলাম তখন আমি একদৃষ্টে দুষ্মন্ত রায়েরই মুখের দিকে।

মনে হল কিরীটীর ঐ কথায় মুহূর্তের জন্য যেন দুষ্মন্তর দুই চোখের তারায় বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে গেল, অথচ সমস্ত মুখখানা মনে হল ভাবলেশহীন, একান্ত নিস্পৃহ।

দুষ্মন্তবাবু! আবার প্রশ্ন করে কিরীটী, আজ নিশ্চয়ই এখানে আপনিও নিমন্ত্রিতদের মধ্যেই একজন ছিলেন?

হ্যাঁ।

দেরিতে এসেছেন একটু শুনলাম?

হ্যাঁ, একটা কাজে আটকা পড়েছিলাম—

তা হলে আর আপনাকে কি জিজ্ঞাসা করব আজকের ব্যাপারে! কথাটা বলেই একটু যেন থেমে আবার প্রশ্ন করে, আচ্ছা দুষ্মন্তবাবু, আজকের এই দুর্ঘটনাটা আপনার ঠিক কি বলে মনে হয়? মানে বলছিলাম, আপনার অধ্যাপকের হত্যার ব্যাপারটা

ব্যাপারটা আদৌ হত্যা বলে মনে হয় না।

কেন?

আপনারা চেনেন না, কিন্তু আমার অধ্যাপককে দীর্ঘদিন ধরে আমি চিনতাম—তাকে কেউ হত্যা করবে তা যে কারণেই হোক আমার চিন্তা, বুদ্ধি, বিবেচনা বা যুক্তির বাইরে।

কিন্তু তবু তাকে হত্যা করাই যে হয়েছে আমরা জানি! দৃঢ়কণ্ঠে কিরীটী কথাটা বলে।

শুনেছি। তবু ঐ কথাই আমি বলব।

আচ্ছা দুষ্মন্তবাবু, আপনি যেতে পারেন। শিবেন সোম বললেন।

ধন্যবাদ।

দুষ্মন্ত রায় উঠে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে উদ্যত হতেই কিরীটী তাকে কতকটা বাধা দিয়েই যেন পিছন থেকে ডেকে ওঠে, এক্সকিউজ মি, জাস্ট এ মিনিট দুষ্মন্তবাবু!

ঘুরে দাঁড়ায় দুষ্মন্ত রায় কিরীটীর দিকে তাকিয়ে।

আপনি নিশ্চয়ই জানেন দুষ্মন্তবাবু, শকুন্তলা দেবীকে মনোনীতা স্ত্রী হিসাবে রাঘব সরকার একটি আংটি দিয়েছেন এবং সে আংটিটি শকুন্তলা দেবীর আঙুলেই এখনো আছে!

না।

সে কি! জানেন না আপনি?

না।

দেখেনও নি?

না।

ওঃ। আচ্ছা আপনি যেতে পারেন।

দুষ্মন্ত রায় অতঃপর ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

কিরীটী দুষ্মন্ত রায়ের গমনপথের দিকেই তাকিয়েছিল, দুষ্মন্ত রায়ের দেহটা দরজার ওপাশে অদৃশ্য হয়ে যাবার পর কিরীটী শিবেন সোমের দিকে ফিরে তাকাল, শিবেনবাবু!

কিছু বলছিলেন মিঃ রায়?

না, কিছু না বলছিলাম কেবল রাত অনেক হল, এবারে সরমা দেবীকে ডেকে যা জিজ্ঞাসা করবার করে আজকের পর্বটা তা হলে চুকিয়ে ফেলুন! ক্ষিদেটা তো থিতিয়েই গেল—ঘুমটাও না আজকের রাতের মত থিতিয়ে যায়!

মৃদু হেসে কথাটা বলতে বলতে কিরীটী এতক্ষণে পকেট থেকে একটা সিগার বের করে সেটায় অগ্নিসংযোগ করল।

শিবেন সোম সরমা দেবীকে ডাকবার জন্যই বোধ হয় ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

.

সরমা দেবীকে সঙ্গে নিয়েই মিনিট পাঁচেক পরে শিবেন সোম ঘরে এসে পুনঃপ্রবেশ করলেন।

বসুন সরমা দেবী, আপনাকে এ সময় বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে আমরা দুঃখিত, কিন্তু উপায় নেই—

সরমা নিঃশব্দে খালি চেয়ারটার উপরে উপবেশন করল।

তাকালাম আমি মহিলাটির দিকে। এবং তার মুখের দিকে চেয়ে প্রথম দৃষ্টিতেই মনে হয়েছিল সেরাত্রে বিমলবাবুর গৃহে সরমার পরিচয় যাই হোক না কেন, সে যে এ-বাড়ির দাসী নয়—কথাটার মধ্যে এতটুকুও শকুন্তলার অত্যুক্তি ছিল না।

মাথার উপরে পরিধেয় সরু কালোপাড় ধুতির গুণ্ঠনটা আধাআধি টানা সাদা সিঁথি। অনবগুণ্ঠনটি বলা উচিত।

লম্বা দোহারা গড়ন দেহের। গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম। চোখেমুখে কোন তীক্ষ্ণতা বা বুদ্ধির দীপ্তি নেই বটে তবে কোমলতা আছে। আর আছে যেন আত্মসমাহিতের একটি নিবিড়তা। সুডৌল দুটি হাতে একগাছা করে ক্ষয়ে যাওয়া সোনার রুলি আর গলায় সোনার সরু একটি বিচেহার। হাত দুটি কোলের উপরে রেখে বসেছিল সরমা নিঃশব্দে।

সরমা দেবী!

কিরীটীর ডাকে চোখ তুলে তাকাল সরমা। চোখের দৃষ্টিতে যেন একটু বিস্ময়।

দেবী বলে সম্বোধন করাতেই সে অমনি করে তাকিয়েছিল কিনা কে জানে!

এ বাড়িতে—মানে বিমলবাবুর এখানে আপনি অনেকদিন আছেন শুনলাম—

দৃষ্টি নত করল সরমা। কোন জবাব দিল না।

কত বছর হবে আন্দাজ?

অনেক দিন আছি আমি এখানে—

এতক্ষণে শান্ত মৃদু কণ্ঠে কথাগুলো উচ্চারিত হল।

আপনি এ বাড়িতে যখন অনেকদিন আছেন—এঁদের একপ্রকার পরম আত্মীয়ার মতই হয়ে গিয়েছিলেন ধরে নিতে পারি নিশ্চয়ই সরমা দেবী!

অনাত্মীয় হলেও এবং এঁদের সঙ্গে কোনপ্রকার সম্পর্কই আমার না থাকলেও, এঁরা বরাবর আমাকে স্নেহ ও ভালবাসা দিয়ে এসেছেন।

এঁরা মানে আপনি নিশ্চয়ই বলছেন অধ্যাপক বিমলবাবুর কথা ও তার ভাইঝি শকুন্তলা দেবীর কথা।

হ্যাঁ।

অবশ্যই সেটা তো স্বাভাবিক, কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করছিলাম—এঁদের সংসারের একজনের মত থেকে নিশ্চয়ই আপনি এঁদের পারিবারিক অনেক কথাই জানবার সুযোগ পেয়েছেন সরমা দেবী!

আপনাকে তো একটু আগেই বললাম, এঁদের পরিবারের মধ্যে থাকলেও আমি তো এঁদের কোন আপনজন নই—

এতক্ষণে বুঝতে পারি, চোখেমুখে সরমার বুদ্ধির দীপ্তি না থাকলেও ভদ্রমহিলা বুদ্ধিমতী। এবং শুধু বুদ্ধিমতীই নয়—নিরতিশয় সতর্ক।

কিরীটীও বোধ হয় উপলব্ধি করতে পেরেছিল ব্যাপারটা। তাই এবারে সোজাসুজিই প্রশ্ন করল, সরমা দেবী, এঁদের আপনি একজন আত্মীয় না হলেও নিশ্চয়ই জানেন দুষ্মন্তবাবুর সঙ্গে শকুন্তলা দেবীর একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল উভয়ের মেলামেশার ফলে?

অনুমান করেছি।

হুঁ। আচ্ছা বিমলবাবু নিশ্চয়ই সে কথা জানতেন?

অনুমান হয় জানতেন।

অনুমানের চাইতে বেশী কিছুই নয় আপনি বলতে চান কি?

যতটুকু আমি জানি তাই বলেছি। শান্ত কণ্ঠে জবাব এল।