২. কাজ হয়ে গেল

কাজ হয়ে গেল। সুকুমারও মনে মনে যেন একটা নতুন উৎসাহ অনুভব করে। ব্যাপারটার মধ্যে সত্যিই একটা নতুনত্ব আছে। আছে একটা বৈচিত্র্য ও উত্তেজনা।

পৃথক পৃথক ভাবে sitting শুরু হলো। এক-একটা sittingয়ের জন্য ১০০ টাকা করে পারিশ্রমিকই দেওয়া হতে লাগল, যেমন কৃষ্ণা কাবেরী চেয়েছিল।

.

ডাঃ সুকুমার গুপ্তের চেম্বার।

রাত্রি আটটা হবে। প্রশস্ত একটি হলঘরের মধ্যে নানাজাতীয় বিচিত্র আসবাবপত্রে সুসজ্জিত। ঘরের মধ্যে জ্বলছে একটি ডোমে-ঢাকা নীলাভ আলো। কৃষ্ণার sitting।

একটি আরামকেদারার উপরে কৃষ্ণা অর্ধশায়িতভাবে বসে, পাশেই একটি স্ট্যাণ্ডের উপরে ভাসে রক্ষিত এক থোকা রক্তগোলাপ। ঘরের মধ্যে বায়ুস্তরে গোলাপের উগ্র একটি মিষ্টি গন্ধ ভেসে বেড়ায়। জানালার উপরে লাল রক্তবর্ণের সব ভারী পর্দা টাঙানো, বাইরের জনতার গোলমাল বা শব্দ ঘরে প্রবেশ করে না।

সুকুমার বলছিল–

আচ্ছা কৃষ্ণা দেবী, মনে করুন আপনাকে একটা particular situation বলবো এবং আপনাকে যদি সেই বিশেষ situationটিতে পড়তে হয় আপনি কি করতেন? চটপট জবাব দেবেন না—ভেবে বলুন। মনে করুন আপনি যেন কোন একটা অচেনা পথ ধরে এগিয়ে চলেছেন দিক ভুল করে। রাত্রির অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, আশেপাশে সব নির্জন, জনপ্রাণীর চিহ্ন পর্যন্ত নেই।

সুকুমার গল্প বলে যায় কিন্তু তার স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে সামনের বড় আর্শিটার উপরে—যার উপরে উপবিষ্ট কৃষ্ণার সম্পূর্ণ ছায়াটা প্রতিফলিত হয়েছে। কৃষ্ণার অজান্তে তার মুখের সমস্ত ভাব-বৈলক্ষণ্যই সুকুমারের দৃষ্টিতে ধরা দিচ্ছে।

সুকুমার বলতে থাকে—

আপনি চলেছেন—চলেছেন। হঠাৎ দেখলেন পথের মধ্যে একটা বিষধর সাপ ফণা তুলে দুলছে। এবং পথও সেখানে সংকীর্ণ। সাপটাকে এড়িয়ে পথ অতিক্রম করা দুঃসাধ্য। পিছনপানে ফিরে তাকালেন। একটি ছোট্ট শিশু টলতে টলতে এগিয়ে আসছে। এ অবস্থায় পড়লে আপনি কি করতেন?

কি আর করব—ছুটে পালাব! জবাব দেয় কৃষ্ণা।

আর সেই ছোট্ট শিশুটি! অসহায়—তাকে–

আপনি বাঁচলে বাপের নাম, আপনি কি করতেন? প্রাণ নিয়ে পালাতেন না?

কি জানি, হয়ত—হয়ত পালাতামই।

***

একই প্রশ্নের জবাবে দিন দুই পরে কাবেরী কিন্তু সাপের কথা শুনেই চিৎকার করে ওঠে অর্ধস্ফুটভাবে।

তারপর শিশুটির কথায় বলে, কি বিশ্রী নিষ্ঠুর গল্প আপনার ডাঃ গুপ্ত!

ডাঃ গুপ্ত হেসে ফেলে।

হাসলেন যে ডাঃ গুপ্ত? আমি কি মিথ্যা বলেছি?

ডাঃ গুপ্ত জবাব দেয় না।

.

আবার আর একদিন, ডাঃ গুপ্ত কৃষ্ণাকে প্রশ্ন করে, আচ্ছা কৃষ্ণা দেবী, প্রত্যেকেরই জীবন সম্পর্কে আমরা একটা কল্পনা বা আশা পোষণ করি মনে মনে, কেমন না?

কৃষ্ণা মৃদু কণ্ঠে জবাব দেয়, তা করি।

ডাঃ গুপ্ত বলে, বেশ। বলুন তো আপনি ভবিষ্যতের জীবন সম্পর্কে আপনি মনে মনে কি আশা পোষণ করেন? লজ্জা করবেন না কিন্তু, be frank & straightforward!

অনেক টাকাকড়ি থাকবে ব্যাঙ্কে, সচ্ছল জীবন, গাড়ি, বাড়ি, শিক্ষিত, রূপবান, স্বাস্থ্যবান স্বামী–

বলতে বলতে হঠাৎ মৃদু হেসে বলে, societyতে position না চায় কে বলুন ডাঃ গুপ্ত? স্বপ্ন আমরা সকলেই তো দেখি এবং শতকরা ৯৯টি ক্ষেত্রেই তা বাস্তবে পরিণত হয় না এই যা দুঃখ!

একটা নোটবুকে কৃষ্ণার মন্তব্যগুলো টুকে নিতে নিতে স্মিতভাবে সুকুমার বলে, অত pessimistic হচ্ছেন কেন? হয়ও তো!

কৃষ্ণা মৃদু হাসে।

পরের দিন ডাক্তারের একই প্রশ্নের জবাবে কাবেরী বলে, আকাঙ্ক্ষা বা কল্পনা বলতে আপনি কি ঠিক mean করছেন বলতে পারি না ডাঃ গুপ্ত। তবে এভাবে চাকরি করে জীবিকা উপার্জন করতে সত্যিই ভাল লাগে না। এর চাইতে–

বলুন-বলুন, dont be shy!

ছোটখাটো শান্ত সচ্ছল একটি পরিবার, সুখে দুঃখে দিন চলে যাবে, অশান্তি বা মনের গরমিল থাকবে না—তাছাড়া অভাব-অভিযোগ তো মানুষের কতকটা নিজেরই মনে সৃষ্টি করা ডাঃ গুপ্ত। শান্তি অর্থে ক্রয় করা যায় না, সেও মানুষের মনে।

ডাক্তার কাবেরীর মন্তব্যটা কৃষ্ণার মন্তব্যের পাশেই ঠিক টুকে নিতে নিতে বলে, যা বলেছেন। তবে মনকে সব সময় ঠিকভাবে যাচাই করতে গেলে দুঃখটা আমাদের বেশীর ভাগ মানসিকই বইকি।

***

দিনের পর দিন এই ধরনের আলাপ আলোচনা, দুটি সুন্দরী তরুণীর নিকটত্ব, একক সাহচর্য, তরুণ ডাক্তারের মনে রঙের ছোঁয়া লাগে বোধ হয়, অদৃশ্য মীনকেতুর ফুলশ্বর কখন বুঝি মনের একটি কোমল তারে মৃদু আঘাতে সুর জাগিয়ে যায়।

মনের আকাশে পঞ্চশরের ফুলবাণে কিসের স্পর্শ লাগে—ফুটে ওঠে কুসুমের কলি। মনের ঘরে অকারণে ভ্রমর যায় গুনগুনিয়ে। ভাল লাগে সুন্দর মুখখানি, ভাল লাগে কোন একটি কণ্ঠস্বর, চোখের চাউনি, একটি তনুর ভঙ্গিমা। মন পড়ে থাকে পায়ের সাড়ার সঙ্গীতে।

কিন্তু কে? কৃষ্ণা না কাবেরী?

কিরীটী হঠাৎ একদিন রাতে এলো। তারপর মনস্তাত্ত্বিক, সংবাদ কি তোমার clientদের?

এগুচ্ছে। ডাঃ গুপ্ত বলে।

হঠাৎ কিরীটীর টেবিলের উপরে নজর পড়ে। একটা ব্লটারের উপরে কত ভাবেই যে লেখা, কৃষ্ণা কাবেরী—কাবেরী কৃষ্ণা দুটি নাম।

মৃদু হাসি দেখা দেয় কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে, হুঁ! একটা কবিতা মনে পড়ে গেল ডাক্তার।

কবিতা? বিস্মিত সুকুমার বন্ধুর মুখের দিকে তাকায়।

হাঁ। একটু হেসে সুর করে কিরীটী বলে।

ভাল লাগে মোর দুটি নাম!
ভাল লাগে কানে কানে বলা–
আর মনে মনে জানা,
তটিনীর কলতান
ভাল লাগে খালি দুটি নাম।

লজ্জায় ডাক্তারের চোখে মুখে যেন রক্ত আবির ছড়িয়ে দেয়, যাঃ, কি যে বল!

কিরীটী বলে, বলি ভালই বন্ধু। তবে সত্য এই যা, সুন্দরী তরুণী, নির্জন একক সাহচর্য, দিনের পর দিন experiment বা studyটা তো মনের কথারও হতে পারে কি বল?

আঃ, কি আরম্ভ করলি বল্ তো! কাবেরী দেবীর আসবার সময় হয়েছে, এখুনি হয়ত এসে পড়বেন, যদি শুনতে পান–

আনন্দই পাবেন, তাছাড়া এসে পড়বেন নয়—পড়েছেন। ঐ শোন তাঁর লঘু পদধ্বনি পাষাণ সোপানবক্ষে। শোন—কান পেতে শোন—নহে, নহে মিথ্যা বা মনের কল্পনা।

সত্যি সিঁড়িতে লঘু পদশব্দ শোনা গেল। কেউ উপরে উঠে আসছে।

চলি বন্ধু—দেখা হবে পুনঃমৃদু হেসে কিরীটী ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যায়।

কাবেরীর কণ্ঠস্বর সুইং-ড্ডারের ওপাশ হতে ভেসে এলো, ভিতরে আসতে পারি কি?

আসুন, আসুন কাবেরী দেবী।

সানন্দ আহ্বান শোনা গেল ডাক্তারের কণ্ঠে।

.

টেলিফোন অফিসের অপারেটিং রুম। কানে হেড়পিস লাগিয়ে দুবোন কাজ করছে। পাশাপাশি। মধ্যে মধ্যে একথা সেকথা আলোচনা হচ্ছে। দুই বোনের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল, বাইরে সন্ধ্যার তরল অন্ধকার ডানা মেলেছে।

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করে হঠাৎ একসময় আলোচনার মধ্যে, ডাক্তার গুপ্তকে তোর কি রকম মনে হয় কাবি?

কাবেরী : তা মন্দ কি! বেশ ভাল লোক বলেই তো মনে হয়। একটু যা মিস্টিরিয়াস—সব সময় যেন ঠিক বোঝা যায় না।

কৃষ্ণা : একদিন আমাদের বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণ করলে মন্দ হতো না—

কাবেরী? বাবাকে কি ভুলে গেলি দিদি!

হঠাৎ কৃষ্ণা হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, মিস রেহানা এখনো তো এলো না। সোয়া সাতটা বেজে গেল।

কাবেরী বলে, আমারও তো রিলিফ মিস্ বোস এখনো এলো না।

এমন সময় দেখা গেল মিস্ রেহানা ও মিস্ বোস দুজনেই প্রায় আগে পিছে ঘরে এসে ঢুকছে।

কৃষ্ণা কাবেরী তাদের পরস্পরের ডিউটি মিস্ রেহানা ও মিস্ বোসের হাতে তুলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

বাইরে সন্ধ্যার কলকাতা শহর আলোকসজ্জায় হাস্য ও লাস্যময়ী হয়ে উঠেছে তখন।

টেলিফোন অফিসের ঠিক গেটের সামনেই লাইটপোস্টের নিচে স্যুট পরিহিত একটি ভদ্রলোক, মাথায় ফেল্ট ক্যাপ বাঁ দিককার মুখের উপরে একটু টেনে গেটের দিকে দৃষ্টি দিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছিল। ওদের দুবোনকে অফিস থেকে বের হতে দেখে যেন লোকটা সজাগ হয়ে ওঠে। কাবেরীর দৃষ্টি হঠাৎ স্যুট-পরিহিত লোকটার উপরে গিয়ে পড়ে। সে অলক্ষ্যে কৃষ্ণার গায়ে হাত দিয়ে চাপা কণ্ঠে ডাকে, দিদি

কি হলো আবার, থামলি কেন?

ওই যে লাইটপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে স্যুটপরা লোকটা, কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি ও আমাদের প্রায়ই follow করে—

কি যে বলিস?

স্যুটপরিহিত লোকটি ততক্ষণে এক পা এক পা করে হাঁটতে শুরু করেছে।

হাঁ—I am sure about it. সেদিন রাত্রে ডিউটি সেরে ফিরছি—লোকটা ঠিক ঐ জায়গায় দাঁড়িয়েছিল। প্রথমটা তত মন দিই নি, পরে ট্রাম থেকে বাড়ির কাছে গিয়ে নেমেছি, রাত্রি তখন প্রায় এগারোটা। রাস্তা ও তার আশপাশ বেশ নির্জন। মনে হলো হঠাৎ, তখনও যেন লোকটা আমার পিছু পিছু আসছে। পিছন ফিরে থমকে দাঁড়ালাম। তাকিয়ে দেখতে পেলাম, কেবল ঐ লোকটা দূরে দাঁড়িয়ে। গাটার মধ্যে কেমন ছছ করে উঠলো।

নে নে চল, যত সব আজগুবী চিন্তা! আমার আবার ডাক্তার গুপ্তের ওখানে রাত আটটায় sitting আছে—তুই বাড়ি হ্যাঁ, আমি একেবারে sitting শেষ করে যাবো–

আজই রাত আটটায় sitting?

হ্যাঁ, রাত আটটায়।

আমারও তো sitting আছে আজ রাত নটায়–কাবেরী বলে।

ঢং ঢং করে ডাঃ গুপ্তর চেম্বারের সুদৃশ্য ওয়ালকটায় রাত্রি ঠিক আটটা ঘোষণা করলো। ডাঃ গুপ্ত একাকী চেম্বারের মধ্যে নিঃশব্দে কার্পেট-মোড়া মেঝের ওপরে পায়চারি করছে। এক-একবার ঘড়ির দিকে তাকায়।

তারপর এগিয়ে গিয়ে অদূরে স্ট্যাণ্ডের উপরে রক্ষিত রেডিও সেক্টা চালিয়ে দিল। গান শোনা যায় কলকাতা কেন্দ্রের।

আটটা বেজে ঠিক পাঁচ মিনিট। সুইং-ডোরের ওপাশ হতে নারীকণ্ঠ ভেসে এলো, আসতে পারি?

চট করে রেডিওটা বন্ধ করে দাঁড়ায় ডাক্তার, আসুন আসুন, কৃষ্ণা দেবী।

কৃষ্ণা কক্ষে এসে প্রবেশ করলো। বড় সুন্দর আজ মানিয়েছে সাধারণ একটি কালো রঙের শাড়ি ও টকে লাল রঙের একটা ব্লাউজ গায়ে কৃষ্ণাকে।

রেডিও বন্ধ করলেন কেন? বেশ সুন্দর গানটা হচ্ছিল—

Duty first—স্মিতভাবে ডাঃ সুকুমার জবাব দেয়।

তারপর তখনও কৃষ্ণাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে ওঠে, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন।

আমি আপনার কথা কিন্তু ঠিক মেনে নিতে পারলাম না ডাঃ গুপ্তহঠাৎ কৃষ্ণা বলে ওঠে।

বুঝতে পারলাম না আপনার কথা কৃষ্ণা দেবী।

ঐ যে একটু আগে বললেন-duty first! জীবনে সর্বক্ষণ যদি কেবল dutyকেই first preference দিতে হয়, আপনি কি মনে করেন না তাতে অনেক ক্ষেত্রেই জীবনের অনেক বড় আনন্দকে বাদ দিতে হয়?

কেন? তা হবে কেন?

তা ছাড়া কি? মানুষের জীবনটা কি কেবল bundle of duties-ই? কেবল কর্তব্য আর কাজ করেই যাবো?

তা তো ঠিক আমি বলি নি মিস্ চৌধুরী। বলেছি আগে কর্তব্য। তার মানে এ নয়, জীবনের আনন্দটুকু বাদ দিয়ে কেবল কর্তব্যই করে যাবো—কেবল কাজই করে যাবো।

তাহলে অমন সুন্দর গানটা শোনা যাচ্ছিল, আপনি বন্ধ করে দিলেন কেন? কতক্ষণই বা সময় লাগত গানটা শেষ হতে!

তা নয় মিস্ চৌধুরী, আপনাকে আমি একটা কাজের জন্য আসতে বলেছি, আপনার সময়ের দাম আছে, তাই–

কৃষ্ণা হাসতে থাকে।

হাসছেন যে? সুকুমার প্রশ্ন করে।

আপনি ঠিক আমার বাবার মত। Duty সম্পর্কে he is so sincere—একটি মুহূর্তও তিনি কখনো অলসভাবে কাটান না।

আপনার বাবার সঙ্গে একদিন পরিচয় করবো।

না না—না–কতকটা যেন নিজের অজ্ঞাতেই আর্তস্বরে বলে ওঠে কৃষ্ণা। ডাক্তার একটু। বিস্মিত হয়।

তিনি—

না, তিনি বাইরের কারোর সঙ্গে কখনো কথাবার্তা তো দূরে থাক, দেখাশুনা পর্যন্ত করেন। এমনকি আমাদের দু বোনের সঙ্গেও দিনান্তে একটি দুটির বেশী কথা বলেন না।

কেন? বিস্মিত ডাক্তার প্রশ্ন করে।

কৃষ্ণা প্রসঙ্গটা তাড়াতাড়ি চাপা দিয়ে বলে ওঠে, সে কথা থাক। আজ কি করতে হবে বলুন।

ডাক্তার বুঝতে পারে, যে কোন কারণেই হোক কৃষ্ণা তার পিতার সম্পর্কে কোন আলোচনাই করতে ইচ্ছুক নয়।

অগত্যা ডাক্তার এগিয়ে গিয়ে অদূরে দেওয়াল-আলমারিটার ড্রয়ার খুলে, একটা খামের মধ্যে ভরা খানকয়েক হাতে আঁকা বিচিত্র ছবি বের করে আনে।

কৃষ্ণা প্রশ্ন করে, কি ওগুলো?

ডাক্তার বলে, ছবি। এবারে আপনি ঐ চেয়ারটার উপরে উঠে গিয়ে বসুন। এবার কাজ শুরু করা যাক।

ডাক্তারের হাতে খানকয়েক হাতে আঁকা ব্ল্যাক এণ্ড হোয়াইটের ছবি।

কৃষ্ণার চোখে-মুখে একটা কৌতুক ও আগ্রহ যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ছবিগুলো হাতের মধ্যে ধরে সুকুমার বলে, আজকের আমাদের sittingয়ের বিষয়বস্তু হচ্ছে এই ছবিগুলো। এই ছবিগুলো এক এক করে আপনাকে দেখতে বলবো এবং ছবিগুলো দেখে ছবিগুলোর বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রথম দৃষ্টিপাতেই যেমন যেমন আপনার মনে হবে বলে যাবেন—আমার বক্তব্যটা বুঝতে পারছেন তো?

কৃষ্ণা মৃদু হেসে ঘাড় নেড়ে জানায়, হাঁ।

কৃষ্ণা যে চেয়ারটার উপরে উপবেশন করেছে ঠিক তার সামনে, প্রলম্বিত একখানা প্রমাণ দর্পণে প্রতিবিম্বিত হয়েছে তার সর্বাঙ্গীণ ছায়া।

কৃষ্ণা সুন্দরী নয় শুধু, রূপে তিলোত্তমা যেন।

কৃষ্ণার অল্প দূরে টেবিলটার উপরে ছবিগুলো রেখে, একখানা ছবি হাতে নিয়ে টেবিলটার উপরে অর্ধদণ্ডায়মান ও অর্ধউপবিষ্ট ভাবে ডাক্তার ছবিখানা এগিয়ে ধরলো কৃষ্ণার দিকে, বলুন এই ছবিটা দেখে, কি দেখছেন এই ছবিতে?

কৃষ্ণা ছবিখানা দেখতে দেখতে বললে, এ আবার একটা ছবি নাকি? থুড়থুড়ে বুড়ো মানুষের মত যেন মনে হচ্ছে কি দুটো বসে!

বলুন তারপর? বলতে বলতে ডাক্তার একটা নোটখাতায় কি সব লিখে যায় পেনসিল দিয়ে।

হাড়পাঁজরাগুলো জিরজির করছে, হাত-পাগুলো সরু সরু প্যাঁকাটির মত, বড় বড় চোখ,  হাতের নখগুলো বাঁকানো বড় বিশ্রী–

আর কিছু?

আবার কি! বুড়োমানুষ না বলে ও দুটোকে—দুটো বাঁদরও তো বলতে পারেন। দুটো সাপও বলতে পারেন-গোলকধাঁধাও একটা বলতে পারেন।

ছবিখানা কৃষ্ণার হাত হতে নিয়ে দ্বিতীয় ছবিটা কৃষ্ণার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে সুকুমার বললে, বেশ, এই নিন দ্বিতীয় ছবিখানা, বলুন এ ছবিটায় কি দেখছেন?

ছবিখানা দেখতে দেখতে কৃষ্ণা বলে, চমৎকার! এগুলো আবার কি? একটা বাদুড় না চামচিকে-মুখে একটা পোকা ধরেছে বোধ হয়, নিচে ঘাস, বুনো আগাছা না কতকগুলো কেঁচো কিলবিল করছে!

খাতায় নোট করতে করতে সুকুমার বলে, আর কিছু?

সত্যি বলুন না—চামচিকে না বাদুর ওটা?

ডাক্তার মৃদু হেসে কৃষ্ণার হস্তধৃত ছবিখানা নিয়ে টেবিলের উপর রেখে তৃতীয় ছবিখানা এগিয়ে দিয়ে বললে, বেশ, এখন বলুন তো কি দেখছেন?

তৃতীয় ছবিখানা হাতে নিয়ে কৃষ্ণা ছবিটা দেখতে দেখতে বললে, Rare collections তো আপনার ছবিগুলো ডাঃ গুপ্ত!

কি দেখছেন বলুন?

একটা ঘাসের চাবড়া-না একটা মাটির ঢেলা—হ্যাঁ, তাই বলেই মনে হয়। উপরে কি একটা যেন বসে, একটা বোলতা না গুবরে পোকা! নিচে ওগুলো কি—আগাছা জন্মেছে অনেকগুলো, না?

বেশ। এই ছবিটায় কি দেখছেন এবারে বলুন? তৃতীয় ছবিখানা কৃষ্ণার হাত হতে নিয়ে চতুর্থ ছবিখানা এবারে ডাক্তার কৃষ্ণার হাতে তুলে দেয়।

কতকগুলো গোল সার্কেল (circle)—সার্কেলগুলোকে pierce করেছে একটা ধারালো ছোরা–

0. K.–আজ এই পর্যন্ত।

ছবিগুলো গোছাতে গোছাতে সুকুমার বলে, সোজা টেলিফোন অফিস থেকেই তো আসছেন, না?

হাঁ।

এক কাপ চায়ে আশা করি আপত্তি হবে না, কি বলেন মিস্ চৌধুরী?

না—না। এখন আবার চা-কৃষ্ণা আপত্তি জানায়।

টেবিলের উপরে রক্ষিত কলিং বেলটা বাজিয়ে ডাক্তার বলে, আমাদের হিন্দুশাস্ত্রে বলে দশ পা একত্র গেলেই নাকি বন্ধুত্ব হয়। দশ পা একত্রে আমরা না গেলেও অনেকদিন একত্রে বসে অনেক আলাপ আলোচনাই তো আমাদের পরস্পরের হয়েছে মিস্ চৌধুরী।

ভৃত্য জগদেও এসে কক্ষে প্রবেশ করল।

দুকাপ চা, জলদি।

ভৃত্য জগদেও আদেশ পালনের সম্মতি জানিয়ে চলে গেল।

অবশ্য কাজের জন্যই আপনারা এখানে আসেন, কিন্তু কাজের মধ্য দিয়ে যে আলাপপরিচয়টা আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে, তাকেও তো আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। পারেন কি, বলুন?

না। মৃদু হাস্যে কৃষ্ণা জবাব দেয়।

তাহলেই দেখ, সামাজিক জীবনটাকে অস্বীকার করতে আমরা কেউই পারি না। তার অবশ্য আরো একটা কারণ আছে, আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনের অনেকখানি জ্ঞাতেই হোক বা অজ্ঞাতেই হোক, ঐ সহজ সামাজিকতাটাই জুড়ে আছে।

হয়ত আপনার কথাই ঠিক ডাঃ গুপ্ত।

হয়ত কেন বলছো কৃষ্ণা, তোমার টেলিফোন অফিস ও সেখানকার ডিউটি দেওয়া ছাড়া তোমার কি একটা বাইরের সামাজিক জীবন নেই? কোথাও বেড়াতে যাও না, বন্ধু বান্ধবীদের বাড়ি, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি, পার্টি, উৎসব বা সিনেমা থিয়েটার।

একমাত্র অফিসের কাজ ছাড়া বাইরে বড় একটা আমরা বেরই হই না। কচিৎ কখনও ন-মাসে ছ-মাসে হয়ত এক-আধদিন সিনেমায় যাই—আর বন্ধু বা বান্ধবী নেই বললেই চলে।

বল কি! কখনো কি ইচ্ছা হয় না কারও সঙ্গে দুদণ্ড বসে আলাপ করতে, লেক বা গঙ্গার ধারে বা অন্য কোথাও বেড়াতে যেতে?

হয়, নির্জন গঙ্গার উপকূলে অথবা কোন নিরালা জায়গায় চুপটি করে একা একা এক এক সময় বসে থাকতে ইচ্ছা করে।

আচ্ছা কোন বন্ধু বা বান্ধবীই কি তোমার নেই?

বন্ধু বা বান্ধবীর কথা বলতে যেমন বইয়ে পড়ে থাকি বা শুনে থাকি তেমন কারও সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ পরিচয় তো আমার নেই—

বর্তমানে নেই, না পূর্বেও কোনদিন ছিল না?

এখনও নেই—আগেও ছিল না।

সে রকম ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব না হয় কোনদিন কারও সঙ্গে ছিল না, কিন্তু পরিচয়?

একটু যেন ইতস্তত করে কৃষ্ণা এবারে জবাব দেয়, না।

জগদেও ট্রেতে করে চা নিয়ে এল।

চায়ের একটা কাপ নিজে তুলে নিয়ে অন্যটা কৃষ্ণার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে সুকুমার বলে, চা নাও—

তারপর হঠাৎ মৃদু হেসে সুকুমার বলে ওঠে, দেখেছ ইতিমধ্যে কখন এক সময় আপনাকে তুমি বলতে শুরু করেছি–

তাতে কি হয়েছে, বয়সে তো আপনার থেকে কত ছোেট, এবার থেকে আপনি আমাকে তুমিই বলবেন–

এ অধিকারটুকু যখন দিলে, আর একটা ছোট্ট অনুরোধ জানাই—

অনুরোধ বলছেন কেন, বলুন না কি বলবেন?

পরশু শনিবার প্রাচীতে খুব ভাল একটা বই আছে, যাবে?

একটু ইতস্তত করে কৃষ্ণা।

অবশ্য আপত্তি যদি থাকে—

না—না। পরশু তো আমার off-dutyই আছে, বেলা ৫টার পর থেকে অসুবিধা হবে না।

বেশ, তবে সেই কথাই রইলো, তুমি এখানেই এসো–ছটায় শো। চন্দ্রিমা কাফেতে we will have our tea—তারপর সেখান হতে যাব সিনেমায়।

সুইংডোরের ওপাশ হতে কাবেরীর কণ্ঠস্বর সহসা ভেসে এল, আসতে পারি কি?

যুগপৎ দুজনই চমকে ওঠে।

ঠিক এমনি সময় চেম্বারের দেওয়াল-ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত্রি নয়টা ঘোষণা করলে।

কৃষ্ণা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়, উঃ! রাত নটা বাজে, আমি যাই।

আসুন, আসুন কাবেরী দেবী।

ডাঃ সুকুমার সাদর আহ্বান জানায়।

কৃষ্ণা সুইংডোর ঠেলে বের হয়ে যায়, কাবেরী এক পাশে সরে দাঁড়ায়, ক্ষণেকের জন্য উভয়েরই চোখাচোখি হয়।

 কাবেরী দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।

কৃষ্ণা হন্ হন্ করে বের হয়ে যায়।

কাবেরী কমধ্যে প্রবেশ করলো।

কাবেরীর পরিধানে আজ অতি সাধারণ সাজসজ্জা। গেরুয়া রংয়ের খদ্দরের শাড়ি, লাল শাড়ির পাড়, গায়ে লাল রক্তবর্ণ ভয়েলের জামা। মাথার চুল বর্মিজ প্যাটার্নে বাঁধা। হাতে একগাছি করে সরু সোনার চুড়ি। দুই ভূর মাঝখানে বড় একটি কাজলের টিপ ও চোখের কোণে সূক্ষ্ম সুর্মার টান।

বসুন কাবেরী দেবী—

বসতে বসতে কাবেরী বলে, আজ প্রথমেই একটা প্রতিবাদ জানাবো ডাঃ গুপ্ত–

প্রতিবাদ? স্মিতহাস্যে তাকায় সুকুমার কাবেরীর হাস্যোচ্ছল মুখের দিকে।

হাঁ প্রতিবাদ। আপনার চাইতে বয়সে আমি অনেক ছোট, আপনি আমাকে এবার থেকে তুমি বলবেন, আপনি বলে আর কথা বলতে পারবেন না।

বেশ তো। কিন্তু আধুনিক সমাজে আজ ঐটাই প্রচলিত যে—

তা হোক। তাছাড়া আমাদের পরস্পরের এতদিনকার পরিচয়েও কি অপরিচিতের দূরত্ব বা সঙ্কোচটা কেটে যায় নি?

অন্তত আমি তো কেটে গিয়েছে বলে মনে করি।

একটু পরে সুকুমার আবার বলে, কৃষ্ণা দেবীও আজ আমাকে সেই অনুরোধই জানিয়েছেন।

তাই নাকি!

হ্যাঁ।

তাহলেই দেখুন আমরা দুজনেই কেউ আপনার ঐ আপনি সম্বোধনটা সহজভাবে নিতে পারছিলাম না। Businessয়ের ব্যাপারে টাকাটা না নিলে চলবে না যখন নিতেই হবে, কিন্তু এটা নিশ্চয়ই businessয়ের বাইরে পড়বে, কি বলেন? আমাদের সামাজিক সম্পর্কটা

বেশ তাই হবে।

আজ আমার sittingয়ের বিষয়বস্তু কি বলুন?

বিশেষ কিছু না, কয়েকটা ছবি সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই আজ, it wont take much time!

ছবি! কিসের?

ঐ চেয়ারটার উপরে বসুন আগে—

কাবেরী উঠে গিয়ে নির্দিষ্ট চেয়ারটায় উপবেশন করে।

আচ্ছা এবারে আপনাকে আমি পর পর চারখানা ছবি দেখতে দেবো। ছবিগুলো দেখে প্রথম দৃষ্টিতেই আপনার যেমন মনে হবে বলে যাবেন, কেমন?

বেশ।

দেখুন এই ছবিটা–কি দেখছেন?

ছবিটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে কাবেরী বলে, দুটি বৃদ্ধ—একেবারে থুড়থুড়ে বুড়ো, পরস্পরের পিঠের সঙ্গে পিঠ লাগিয়ে বসে আছে। কি রোগা বুড়ো দুজন! মনে হয় যেন দুর্ভিক্ষের দেশ থেকে উঠে এসেছে। ভাসা ভাসা উদাস চোখের দৃষ্টি।

বেশ। ধরুন এই ছবিটা-what do you find in this picture?

বাঃ, কি সুন্দর একটা পাখী! ডানা দুটি মেলে নীল আকাশে উড়ে চলেছে, ঠোঁটের মধ্যে রেখেছে বোধ হয় নীড় বাঁধবার জন্য একটি খড় বা কাঠি। নীড়ের মায়ায় পৃথিবীর যাবতীয় পশু, পাখী, প্রাণীই বোধ হয় এমনি ঘুরে মরছে!

আর কিছু দেখছেন ছবিটায়?

হুঁ। নীচে বোধ হয় ওগুলো ঘাস জন্মেছে, ঘাসের বুকে ছড়িয়ে আছে কতকগুলো শুকনো ঝরা পাতা।

নোটবইয়ে কাবেরীর কথাগুলো টুকতে ঢুকতে আর একখানা ছবি কাবেরীর দিকে এগিয়ে দিয়ে ডাক্তার বলে, দিন ও ছবিখানা, এইখানা দেখুন এবারে। বলুন এ ছবিটায় কি আছে?

চমৎকার একটি ফুল, দলগুলো মেলে ফুটে উঠেছে। ফোঁটা ফুলটির উপরে বসে আছে মধুলোভী একটি কৃষ্ণ ভ্রমর, নিচে ছড়িয়ে আছে দেখছি একরাশ ঝরা ফুলের পাপড়ি। তাই না ডাঃ গুপ্ত?

Good! দিন ছবিটা—now have this one! বলুন কি দেখছেন এইটায়?

চতুর্থ চিত্রখানা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে কাবেরী বলে, এটা কি! দাঁড়ান। হুঁ, মনে হচ্ছে কতকগুলো বৃত্ত। বৃত্তগুলোকে চিহ্নিত করছে আড়াআড়ি ভাবে একটি রেখা—সরল রেখা। কোন জিওমেট্রিক figure নিশ্চয়ই! জিওমেট্রি আমার ছিল বটে তবে ভাল বুঝতে পারতাম না কোন দিন। বরাবর তাই এড়িয়ে এসেছি ওটাকে—

ছবিখানা কাবেরীর হাত হতে ফেরত নিয়ে একটা খামের মধ্যে ছবিগুলো ভরে ফেলে সুকুমার।

আজকের sitting এইখানেই শেষ কাবেরী দেবী। হ্যাঁ, কৃষ্ণা দেবী চলে যাবার সময় তাড়াতাড়িতে তাঁর আজকের sittingয়ের পারিশ্রমিকটা নিয়ে যেতে ভুলে গেলেন। বলতে বলতে ডাক্তার ড্রয়ার খুলে ১০ টাকার কুড়িখানা নোট বের করে কাবেরীর হাতে দিতে দিতে বলে, একশ টাকা কৃষ্ণা দেবীর, বাকী একশ টাকা আপনার।

কাবেরী বিনম্ৰ কুণ্ঠার সঙ্গে ডাক্তারের হাত থেকে নোটগুলো নিতে নিতে সলজ্জ কণ্ঠে বলে, সত্যি এভাবে আপনার কাছ হতে টাকা নিতে কেমন যেন সঙ্কোচ অনুভব করি ডাঃ গুপ্ত

সঙ্কোচ! কেন? পারিশ্রমিকের মূল্য হিসাবে টাকা নিচ্ছেন, দান-খয়রা তো আর নয়—

তবু, সামান্য কথাবার্তা, আলোচনার জন্য এভাবে টাকা নেওয়া, সত্যি মনকে বড় পীড়া দেয়।

না, না–ও কথা ভাবেন কেন মিস্ চৌধুরী! সময়েরও মূল্য আছে একটা। বিশেষ করে আপনাদের ও আমাদের মত যাদের মানসিক ও শারীরিক পরিশ্রম দিয়ে জীবিকা উপার্জন করতে হয়। এতে সঙ্কোচ লজ্জা বা দ্বিধার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না—শুধু তো আপনারাই নন, আরো দুজনে sitting দিচ্ছেন।

টাকা নেবো বলেই যখন আপনার কাছে sitting দিতে এসেছি, তখন ও সম্পর্কে মনে আজ দ্বিধা বা সঙ্কোচ জাগলেও অন্তত আমাদের মুখ দিয়ে সেটা প্রকাশ করা নিশ্চয় শোভা পায় না।

আলাপ-আলোচনার মধ্যে হঠাৎ একসময় কাবেরীই প্রশ্ন করে বসে, আচ্ছা ডাক্তার, যখনই আমি এখানে এসেছি তখন দেখি আপনি চেম্বারে বসে বই-ই পড়েন, দিনরাত খালি বুঝি লেখাপড়া নিয়েই থাকেন? কখনো কোথাও বেড়াতে বা সিনেমা দেখতে যান না?

সিনেমায় মাঝে মাঝে যাই ভাল বই থাকলে। আপনি বুঝি বেড়াতে, সিনেমা দেখতে খুব ভালবাসেন?

বেড়াতে, সিনেমা দেখতে খুবই ভাল লাগে তবে কোনটাই হয়ে ওঠে না তেমন এই যাদুঃখ।

কেন?

বাবা! তিনি পছন্দ করেন না। কারো সঙ্গে মেলামেশা করা, থিয়েটার, সিনেমা বা ক্লাবে যাওয়া এসব তিনি আদপেই পছন্দ করেন না। তবু মাঝে মাঝে লুকিয়ে-চুরিয়ে যে যাই না তা নয়, তবে–

কেন? আপনার বাবা–

বাবা একজন অদ্ভুত typeয়ের লোক। এত স্নেহ করেন, এত ভালবাসেন আমাদের—তবু in some respects he is so queer! নিজে তো কখনো কোথাও বেরই হন না, আমরা যে কোথাও বের হবো, তাও পছন্দ করেন না একেবারে।

কেন বলুন তো?

তা ঠিক জানি না বলতে বলতে কাবেরী যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায়, তারপর হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস যেন কাবেরীর বুকখানা কাঁপিয়ে বের হয়ে যায়।

থাক ওসব কথা ডাঃ গুপ্ত। এক এক সময় এ জীবন এমন ক্লান্ত ও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে যে ইচ্ছা করে সব ভেঙেচুরে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই, কিন্তু বাবা—he is so affectionate, so tender—তাছাড়া বাবা কোন কারণে দুঃখ পাবেন, ভাবতেও পারি না-

কথার মোড়টা ফিরিয়ে দেবার জন্যে হঠাৎ সুকুমার প্রশ্ন করে, আচ্ছা মিস চৌধুরী, কি টী

আবার আপনি! জবাব দেবো না আপনার কথার—

Sorry! অনেক দিনের অভ্যাস কিনা—

Love picture আমার খুব ভাল লাগে—

রোমিও জুলিয়েট ছবিটা দেখেছেন?

দেখেছি, কিন্তু বড় বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়—

কিন্তু রোমিও জুলিয়েটের কাহিনী তো বিশ্বসাহিত্যের একটি প্রধান প্রেমের উপাখ্যান।

তা হোক। Effeminate love! তার চাইতে সিজার অ্যাণ্ড ক্লিওপেট্রা ঢের ভাল লেগেছে।

ঢং ঢং করে রাত্রি দশটা ঘোষণা করলে দেওয়াল-ঘড়িতে।

উঃ-রাত দশটা! তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায় কাবেরী।

চল তোমাকে খানিকটা এগিয়ে দিয়ে আসি

না না—তার প্রয়োজন নেই, আমি একাই যেতে পারবোকাবেরী কতকটা যেন ত্রস্ত পদেই ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল, শেষ বিদায়সম্ভাষণটুকুও জানাতে বোধ হয় ভুলে যায়।

কাবেরী ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যেতেই সুকুমার ঘরের রাস্তার দিকের জানালাটা খুলে দিয়ে সামনে দাঁড়াল।

খোলা জানালাপথে তাকিয়ে সুকুমার দেখলে, হন হন করে কাবেরী নির্জন রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে একাকী।

কাবেরী হন হন করে রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে। পিছনদিকে ফিরে তাকাবারও যেন কাবেরীর সময় নেই। কেবল মধ্যে মধ্যে রেডিয়াম দেওয়া ঘড়িটার উজ্জ্বল লেখাগুলোর দিকে তাকায়। কাবেরী পিছনপানে তাকালে দেখতে পেত বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে একটা কালো। রংয়ের গাড়ি নিঃশব্দে শ্লথগতিতে ওকে পিছু পিছু অনুসরণ করে চলেছে।

থিয়েটার রোড পার হয়ে সার্কুলার রোড ও পার্ক স্ট্রীট যেখানে এসে মিশেছে সেখানে চৌমাথার সামনে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই একটা সবুজ রংয়ের ফুইড় ড্রাইভ ফোর্ডগাড়ি কাবেরীর পাশটিতে এসে দাঁড়াল, গাড়ির চালক সুবিমল।

মৃদুকণ্ঠে সুবিমল আহ্বান জানায়, এসো।

দরজাটা খুলে যায় গাড়ির, কাবেরী গাড়ির মধ্যে উঠে বসে।

গাড়ি আবার চলতে শুরু করে।

পশ্চাতের গাড়িটা এতক্ষণ কিছুটা দূরত্ব বাঁচিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেটাও এবারে চলতে শুরু করে ওদের গাড়িটাকে অনুসরণ করে।

এত দেরি হল যে? ভাবছিলাম ভুলে গেলে বুঝি!

মৃদু হাসি জেগে ওঠে কাবেরীর ওষ্ঠপ্রান্তে, ভুলিনি, ডাক্তারের সঙ্গে কথায় কথায় দেরি হয়ে গেল।

ডাক্তার যে বড্ড ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে বলে মনে হচ্ছে।

ছিঃ, কি যে বল! লোকটা সত্যিই ভাল, I like him.

দেখো, বেশী ভাল লাগলে দেখা যায় ভালবাসায় পরিণত হয় কিন্তু—

তোমরা পুরুষরা ভারী jealous!

আর তোমরা মেয়েরা ভারী উদার, নয়?

আকাশে ইতিমধ্যে কখন কালো কালো মেঘ ঘন হয়ে উঠেছে। একটা ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। কালো মেঘের বুকে বিদ্যুতের চকিত আলোর ঝলকানিও লক্লকিয়ে গেল দুচারবার।

বৃষ্টি আসবে নাকি?

ক্ষতি কি আসুক না-সুবিমল জবাব দেয়।

কোথায় চলেছো?

যেদিকে দুচক্ষু যায়। সত্যি আর ভাল লাগে না, এই লুকোচুরি আর অন্তহীন এই প্রতীক্ষ্ণ। চল সোজা গাড়ি চালিয়ে চলে যাই পৃথিবীর কোন এক নির্জন প্রান্তে বা—

তারপর?

তারপর বেঁধে নেবো ছোট একখানি ঘর, নিরজনে তোমাতে আমাতে বাঁধিব বাসা—

বৃষ্টি শুরু হয়, উইণ্ড-স্ক্রীনের উপরে বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ছে।

হঠাৎ সুবিমল ডাকে, প্রিয়া?

ও কি!

বাধা দিও না প্রিয়া, বাধা দিও না, ডাকার নেশায় পেয়েছে আজ আমায়—

রাত অনেক হলো, এবারে ফিরে চল—

হোক, শেষ হয়ে যাবে আজকের এই রাত্রি, আবার আসবে রাত্রি, রাত্রির পর রাত্রি। এমনি কত রাত্রি পার হয়ে যাবে আর আমরা চলবো এগিয়ে বন্ধনহীন যাত্রী। সেই কবিতাটি জান—

পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি,
আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী

* * *
নাই আমাদের সঞ্চিত ধনরত্ন
নাইরে ঘরের লালন-ললিত যত্ন।
পথপাশে পাখি পুচ্ছ নাচায়,
বন্ধন তারে করি না খাঁচায়,
ডানা-মেলে-দেওয়া মুক্তি প্রিয়ের
কূজনে দুজনে তৃপ্ত
আমরা চকিত অভাবনীয়ের
ক্কচিৎ কিরণে দীপ্ত।

হঠাৎ সোঁ সোঁ শব্দে হাওয়া বইল, ঝমঝম্ বৃষ্টি হলো শুরু।

গাড়ির কাচটা তুলে দিতে দিতে কাবেরী বলে, জোরে বৃষ্টি নামল যে—

নামুক। নামুক–আকাশ ভেঙে নামুক–

বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে, সোঁ সোঁ করে বইছে ক্ষ্যাপা হাওয়া। নিজের ঘরের খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে সঞ্জীব চৌধুরী ক্রাচে ভর দিয়ে কবিতা আওড়াচ্ছেন। ঝোড়ো হাওয়ায় রুক্ষ এলোমেলো বড় বড় চুলগুলো উড়ছে। ঘরের কাগজপত্র, পর্দা উড়ে উড়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। সঞ্জীব চৌধুরী আবৃত্তি করছেন নিম্নস্বরে—

A dungeon horrible, on all sides round,
As one great furnace flamed; yet from those flames
No light, but rather darkness visible.
Served only to discover sights of woe,
Regions of sorrow, doleful shades, where peace
And rest can never dwell, hope never comes
That comes to all; but torture without end–

ঘুমাতে যায় নি অত রাত্রেও কৃষ্ণা, বাইরের ঘরে একাকী চুপটি করে বসে, একটা বাংলা উপন্যাস পড়ছিল কাবেরীর প্রতীক্ষ্ণয়।

এত রাত হয়ে গেল, এখনো কাবেরী ফিরে এলো না!

বইটা সোফার উপরে রেখে দিয়ে জানালাপথে গিয়ে দেখে এলো একবার, কাবেরী আসছে কিনা। সঞ্জীবের আবৃত্তি থেমে গিয়েছে, শোনা যাচ্ছে বেহালার সুর। সঞ্জীব বেহালা বাজাচ্ছেন।

দরজায় মৃদু করাঘাত শোনা গেল।

কে?

দিদি আমি কাবি, দরজাটা খোল।

কৃষ্ণা এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই কাবেরী এসে কক্ষে প্রবেশ করল।

কাবেরীর সর্বাঙ্গ ভিজা।

এত রাত করলি কেন?

হঠাৎ বৃষ্টি নামল দেখে ডাক্তার গুপ্ত আসতে দিলেন না। বলতে বলতে কাবেরী এগিয়ে যায় শয়নকক্ষের দিকে।

কাবি?

কি? কাবেরী ফিরে দাঁড়ায় কৃষ্ণার ডাকে।

কটা রাত হয়েছে খেয়াল আছে কি?

হাতে যখন ঘড়ি আছে এবং চোখের দৃষ্টিও যখন নষ্ট হয়ে যায় নি এখনো—

কাবেরী! কৃষ্ণা তীক্ষ্ণ চাপা কণ্ঠে ডেকে ওঠে।

দেখো দিদি—ফিরে দাঁড়ায় কাবেরী, আমার ব্যাপার নিয়ে তুমি একটু কম মাথা ঘামালেই সুখী হবো, mind your own business! বলে দৃঢ় পদবিক্ষেপে কাবেরী কক্ষান্তরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কাবেরীর গমনপথের দিকে কৃষ্ণা।

পাশের ঘরে সঞ্জীবের বেহালা সুরের ঝঙ্কা তুলেছে তখন। কড়কড়াৎ শব্দে মেঘের হুঙ্কার চারিদিক সচকিত করে গেল।

***

তাজ হোটেলে সেই রাত্রে।

দামী স্যুট পরিধানে এক দীর্ঘকায় পাঠান অধীর আগ্রহে একটি চেয়ারের উপরে বসে ঘন ঘন বন্ধ দরজাটির দিকে তাকাচ্ছে আর মণিবন্ধের ঘড়ি দেখছে।

এমন সময় পূর্ব-পরিচিত সেই পাঠানটি কক্ষে প্রবেশ করে উপবিষ্ট পাঠানকে দেখে সসম্রমে দাঁড়িয়ে পড়ে, আপ–

হাঁ, কুছ পাত্তা মিলা ফৈয়াজ?

আভিতক ঠিক ঠিক পাত্তা নেহি মিলা জনাব। কৌসি ত ম্যায় কর রাহা হুঁ।–

কর রাহা হুঁ–কর রাহা হুঁ! ও বাত ত বহুৎ দফে শুন চুকা। ফিরভি শুননা নেহি চাতা! জলদি হামে ও মিলনা চাহি, সমঝা—

লেকেন–

দেখো আউর দশ রোজ তুমহে time দিয়া যায় গা। দশ দিনকা অন্দর-অন্দর নেহি ও সামানকো ফায়সলা কর সেকে ত, হামেভি দোসরা কই নওজোয়ান কো এ কামকে লিয়ে ভেজনা পড়ে গা, সমঝা?

জি—

আচ্ছা ত ম্যায় চলতা। রূপেয়াকা কোই জরুরৎ হো ত—

নেহি—

পাঠান ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

ফৈয়াজ ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করে। নিম্নস্বরে আত্মগতভাবে বলে, ওহি—জরুর ওহি হোগি। খপসুরৎ লেড়কী—

***

ডাঃ গুপ্তর চেম্বার।

ডাক্তারের চেম্বারে আজ বিশেষ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। সমগ্র কক্ষটি, দেওয়াল হতে শুরু করে মেঝে আসবাবপত্র সব কিছু কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তারের টেবিলটির ওপরেও কালো টেবিলক্লথ বিস্তৃত এবং সেই টেবিলের উপরে সাদা হাড়ের তৈরী একটি অপূর্ব প্রতিমূর্তি : একটি পুরুষ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পশ্চাৎ হতে একটি নারীমূর্তি পুরুষটির পৃষ্ঠদেশ লক্ষ্য করে একটা তীক্ষ্ণ ছোরা তুলেছে।

ঘরের এক কোণায় জ্বলছে কেবল একটি লাল আলো স্বল্পশক্তির। রক্তাভ সেই আলোর দ্যুতি সমগ্ৰ কক্ষখানিকে যেন ভৌতিক এক বিভীষিকায় থমথমে করে তুলেছে। টেবিলের একধারে লাউডস্পীকার-সংযুক্ত একটা গ্রামোফোনে একটি রেকর্ড প্লেটের ওপরে বসানো। সাউণ্ড বক্সটাও রেডি করা আছে, মুহূর্তে ইচ্ছামত রেকর্ডটি বাজানো চলতে পারে।

ডাক্তার মধ্যে মধ্যে হাতঘড়িটা দেখছে।

ঢং ঢং করে রাত্রি নয়টা বাজল। সুইংডোরে মৃদু করাঘাত শোনা গেল, আসতে পারি?

আসুন।

কক্ষে এসে প্রবেশ করল কাবেরী।

সাদা জরির পাড় দেওয়া কালো সিল্কের একখানি শাড়ি পরিধানে, গায়ে কালো রংয়ের সাদা জরির বর্ডার দেওয়া টাইট-হাতা ব্লাউজ। মাথার চুল বেণীবদ্ধ, বক্ষের দুপাশে লম্বমান।

এ কি, ঘরে এমন আলো কেন?

বোস কাবেরী। ঐ চেয়ারটার ওপরে আরাম করে বোস।

কাবেরী নির্দিষ্ট চেয়ারটায় উপবেশন করে।

আবছা আলো-আঁধারিতে অস্পষ্ট ছায়ার মত ডাঃ সুকুমারকে দেখা যায়, গায়ে বোধ হয় একটা কালো অ্যাপ্রন। অ্যাপ্রনটার বুকের কাছে সোনালী জরি দিয়ে বীভৎস একটা ড্রাগনের মূর্তি তোলা।

ডাঃ গুপ্ত! ভীত একটা শঙ্কিত সুর যেন কাবেরীর কণ্ঠ হতে বের হয়।

Feeling nervous?

নার্ভাস! না–মানে–

We wont take much time কাবেরী। আজ কয়েকটা প্রশ্ন পর পর তোমাকে করে যাবো, তুমি প্রশ্নের পিঠে পিঠে যেমন মনে হবে জবাব দিয়ে যাবে, বুঝতে পেরেছো?

ক্ষীণকণ্ঠে জবাব দেয় কাবেরী, হুঁ।

বেশ। Ready?

Ready!

ফুল?

গন্ধ।

কীট?

পতঙ্গ।

নর?

নারী।

চাঁদ?

জ্যোৎস্না।

রাত্রি?

দিন।

পতঙ্গ?

পাখী।

দর্পণ?

প্রতিচ্ছায়া।

ড্যাগার?

সোর্ড।

প্রশ্নোত্তরের পর কাবেরীর সর্বশরীরকে যেন অসহ্য একটা ঘুমের ক্লান্তি ও শৈথিল্য আচ্ছন্ন করে ফেলে। যে চেয়ারটার ওপরে কাবেরী এতক্ষণ বসেছিল, সেই চেয়ারটারই গায়ে অবশভাবে শরীরটা এলিয়ে দেয় ধীরে ধীরে।

ডাঃ সুকুমার চেয়ারের ওপরে এলায়িত কাবেরীর সামনে আরো একটু এগিয়ে এসে দাঁড়ায়।

কাবেরীর চোখের পাতা দুটো নিমীলিত।

সুকুমার কিছুক্ষণ চেয়ারের ওপরে এলায়িত, মুদ্রিত চক্ষু কাবেরীর প্রতি চেয়ে থেকে ধীরে মৃদুকণ্ঠে ডাকে, মিস্ চৌধুরী! কাবেরী দেবী!

উঁ! ক্ষীণকণ্ঠে সাড়া দেয় কাবেরী।

খুব ক্লান্তি বোধ করছে, না?

হ্যাঁ, ঘুম আসছে—

ঘুমাও, ঘুমাবার চেষ্টা কর। হাঁ ঘুমাও–

একাগ্র তীক্ষ্ণদৃষ্টি ডাঃ সুকুমারের চোখে। অন্ধকারে জন্তুর চোখের মত জ্বল জ্বল করে ডাক্তারের চোখের মণি দুটো জ্বলছে যেন। গভীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, কিন্তু পাথরের মতো স্থির, অচঞ্চল।

Sleep-sleep Kaberi!

কাবেরীর মাথাটা আরো একটু ঝুলে পড়ে।

ডাক্তারের কণ্ঠস্বর আবার শোনা যায়, কাবেরী?

উঁ! বহুদূর হতে ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো আবার।

এই পৃথিবীতেই এমন একটা জায়গা আছে যেখানে ছয় মাস থাকে দিনের আলো আর ছয় মাস থাকে রাত্রির জমাট কালো অন্ধকার। চারিদিকে শুধু জমাটবাঁধা ঠাণ্ডা বরফ। হু-হু করে বইছে যেখানে অবিশ্রাম হিমতীক্ষ্ণ ক্ষ্যাপা এলোমেলো হাওয়া। কোথাও সেখানে ফুলের কোন সমারোহ নেই-বর্ণের সাত রঙের খেলা প্রজাপতির মন ভোলানো অস্তিত্ব নেই। নেই মধুপের মধুগুঞ্জন। শীল মাছ, শ্বেত ভল্লুক আর বড় বড় শিংওয়ালা হরিণ। জনহীন জমাটবাঁধা বরফের সেই নিঃশব্দ নির্জনতায় মাঝে মাঝে শোনা যায় শ্বেত ভল্লুকের ক্ষুধার্ত চিৎকার—

কথা বলতে বলতে ইতিমধ্যে একসময় ডাক্তার পার্শ্বেই রক্ষিত অ্যাপ্লিফায়ার সংযুক্ত গ্রামোফোনে, ইংরেজী শব্দময় বাজনার একটা রেকর্ড যেটা আগে বসানো ছিল, সেটা চালিয়ে দিয়ে আবার বলতে থাকে? আহারের কোন সংস্থান নেই নেই কোন খাদ্যবস্তু, একমাত্র ঐ শীল মাছ ছাড়া। তাই ওদেশের লোকেরা তীক্ষ্ণ ধারালো ছোরা চালিয়ে শীল শিকার করে, হরিণ শিকার করে—ছুরি দিয়ে ফালি ফালি করে রক্তাভ হাতে

সহসা রেকর্ড বেজে উঠলো মুহূর্তে যেন। ঝম্ ঝম্ করে তীব্র বাজনার শব্দ ঝঙ্কৃত, শায়িত করে তোলে সমগ্র কক্ষখানিকে মুহূর্তে।

সহসা একটা আর্ত চিৎকার করে উঠে দাঁড়ায় কাবেরী, না! না! না!

কি হলো? কি হলো কাবেরী? ব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে ডাঃ সুকুমার।

কাবেরী ততক্ষণে নিজের বিহ্বল, ভয়ার্ত ভাবটা সামলে উঠেছে। বড় রকমের একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে, কিছু না। আমি বড্ড ক্লান্ত—feeling extremely tired! আমি এবারে যেতে চাই ডাঃ গুপ্ত।

চল, আমার ড্রাইভার তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে—

না, না—তার কোন প্রয়োজন নেই, হঠাৎ কেমন মাথাটা ঘুরে উঠেছিল। আমি, আমি আমি একাই বাড়ি ফিরে যেতে পারবো।

না, তোমাকে সত্যিই অত্যন্ত পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে—তা ছাড়া ডাক্তার হিসাবে আমার একটা কর্তব্যও তো আছে—চল।

কাবেরী ডাক্তারের কথায় আর আপত্তি করে না।

আর আপত্তি করার মত শক্তিও তার ছিল না তখন।

নিচে এসে ড্রাইভারকে ডেকে ডাক্তার কাবেরীকে গাড়িতে তুলে দিল এবং ড্রাইভারকে ঠিকানা বলে দিল, মেমসাবকো সিধা কোঠি পৌঁছা দেনা লছমন্।

জি সাব্‌।

আপনার ফিস্‌টা মিস্ চৌধুরী–

ডাক্তার পকেট হতে দশ টাকার দশখানা নোট গাড়ির জানালাপথে এগিয়ে দিল কাবেরীর দিকে।

কাবেরী কুণ্ঠার সঙ্গে নোটগুলো হাতে নেয়।

আচ্ছা Good Night!

Good Night। মৃদুকণ্ঠে কাবেরী জবাব দিলে।

গাড়ি চলে গেল।

কাবেরীকে বিদায় দিয়ে সুকুমার চেম্বারে আবার যখন ফিরে এলো, দেখলে কিরীটী একটা সোফার ওপরে বসে পায়ের ওপরে পা তুলে দিয়ে চোখ বুজে একটা বর্মা সিগার নিঃশব্দে টানছে। সিগারের তীব্র কটু গন্ধ কক্ষের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। সুকুমারের পদশব্দে চোখ খুলেই এবং দাঁত দিয়ে সিগারটা চেপে ধরে কিরীটী বললে, কাবেরী দেবী চলে গেলেন?

সুকুমার সিগারেট কেসটা পকেট হতে বের করে, একটা সিগারেট নিয়ে ওষ্ঠের ফাঁকে চেপে ধরে অগ্নিসংযোগ করতে করতে বললে, হুঁ। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক কি হলো বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ কাবেরী অমন হিস্টিরিক ব্যবহার করলে কেন?

মনস্তাত্ত্বিক তুমি ডাক্তার, বোঝা উচিত ছিল। রোমান্টিক মাইণ্ড!

রোমান্টিক মাইণ্ড সে তো নিশ্চয়ই, কিন্তু—

আবার তবে কিন্তু কেন? ভাবুক মনের কল্পনাবিলাস বা স্বপ্ন—

কিন্তু একটা কথা–

কি?

So far তোমার কাজ excellent! চমৎকার। কিন্তু এবারে তোমাকে একটু ঘনিষ্ঠ হতে হবে।

মানে?

মানে–প্রেমের ব্যাপারে দুটির সঙ্গেই তোমার আরো একটু ঘনিষ্ঠ হতে হবে। যদিচ সেটা বিশেষ তোমার মত তরুণের পক্ষে জানি নিদারুণ risky খেলা—

কি বলছিস কি?

আহা অবোধ শিশুটি রে! কিছু যেন বুঝতে পারছেন না! শোন হে মনস্তাত্ত্বিক, অবশ্য মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি একটি ভগিনীর প্রেমে আপাততঃ তুমি যদিচ হাবুড়ুবু নদের নিমাই—দ্বিতীয়টির সঙ্গেও নদের নিমাইদের অভিনয় করতে হবে।

আঃ, কি হচ্ছে সব!

মধুর! মধুর! কিন্তু সত্য কথা বলতে ভাই, কে? কৃষা না কাবেরী? সুকুমার কিরীটীর প্রশ্নের জবাব দেবে কি, নিজেই এখনো মনের মধ্যে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারে নি, সত্যি কোন জন ওর হৃদয়কে আকর্ষণ করেছে!

কৃষ্ণা, না কাবেরী?

হৃদয় যেন দুলছে একবার এদিক, একবার ওদিক। এক বৃন্তে দুটি ফুল যেন দুটি বোন। মনকে কখনো আকর্ষণ করে কাবেরী, কখনো কৃষ্ণা। দ্বিধা-সংশয়ে দোলে মন।

কি? জবাব দিচ্ছিস না যে? নির্বাক-হতবাক যে!

কি বলবো তাই ভাবছি—

হুঁ। তা বন্ধু, বলি সাবধান! পূর্বকালে শাস্ত্রে বিষকন্যা বলে এক ধরনের কন্যার কথা শোনা যায়। পাতঞ্জলির শাস্ত্রে খুঁজলেই পাবে। এবং শোনা যায় ঐ অপূর্ব, মনোমোহিনী কন্যাদের স্পর্শেই নাকি মৃত্যু ঘটতো। কন্যার দেহ হতে বিষ সংক্রামিত হতো হতভাগ্য রূপমুগ্ধ প্রেমিকের দেহে। কৃষ্ণা ও কাবেরী তোমার ওই দুটি মানসপ্রিয়ার একটি কিন্তু কলির বিষকন্যা। অতএব সাবধান বন্ধু সাবধান

কি আবোল-তাবোল সব বকছিস? এখুনি হয়ত কৃষ্ণা আসবে—তারও আজ রাত্রেই sitting দেবার কথা—

অর্থাৎ বলতে চাও, তুমি যাও! কিন্তু বন্ধু, দ্বিতীয় সিটিংয়েও যে আমাকে উপস্থিত থাকতে হবে!

সত্যি এমন সময় সিঁড়িতে পদশব্দ শোনা গেল।

ঐ বোধ হয় আসছেন কৃষ্ণা দেবী—অতএব কিরীটী এবারে তুমি অন্তরালে আত্মগোপন করো—বলতে বলতে মৃদু হেসে কিরীটী উঠে পর্দার আড়ালে আত্মগোপন করে।

কৃষ্ণা এসে কক্ষে প্রবেশ করল।

কৃষ্ণার দেহসজ্জায়ও আজ নতুনত্ব পরিলক্ষিত হয়—তবে সহজ ও সরল। কৃষ্ণারও আজ সাধারণ গেরুয়া রংয়ের শাড়ি ও ব্লাউজ পরিধানে—মাথার পর্যাপ্ত চুল বেণীর আকারে পীনোন্নত বক্ষের দুটি পাশে লম্বমান।

এসো–এসো কৃষ্ণা! সাদর আহ্বান জানায় ডাক্তার।

আজকের sittingয়ের সময়টা এত রাত্রে করলেন কেন ডাঃ গুপ্ত?

উপায় ছিল না।

একই পরিবেশের মধ্যে একই প্রশ্ন করা হয় কৃষ্ণাকেও।

বোস–দাঁড়িয়ে কেন কৃষ্ণা!

কৃষ্ণা উপবেশন করে কক্ষের চতুর্দিকে একবার তাকায়।

কি দেখছো?

কিছু না।

Ready?

Yes!

ফুল?

কীট।

নর?

বানর।

চাদ?

সূর্য।

রাত্রি?

অন্ধকার।

পতঙ্গ?

আরশুলা।

দর্পণ?

ছায়া।

ড্যাগার?

ডেথ।

পূর্বের মতই দপ করে উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠলো ঘরে ও বাজনা বেজে ওঠে। ক্ষণপূর্বের আলোছায়ার রহস্য দূরীভূত হলো।

কৃষ্ণা শুনতে থাকে বাজনাটা, কি অদ্ভুত সব আবোল-তাবোল প্রশ্ন আজ আপনি করছিলেন বলুন তো ডাক্তার? জোরালো গলায় কৃষ্ণা প্রশ্ন করে।

সুকুমার মৃদু মৃদু হাসতে থাকে, কৃষার প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না।

আবার একসময় কৃষ্ণা প্রশ্ন করে, আমাদের নিয়ে যে গবেষণা আপনার চলছে, কতদূর successful হলো বলুন তো? এও কি কখনও সম্ভব নাকি, মানুষের মনের গতি বা সুপ্ত ও জাগ্রত প্রবৃত্তিকে অনুশীলন করে, এই প্রকারের বিভিন্ন দুজন মানুষ নর বা নারী একজন হতে অন্যজনের identityতে আসতে পারবেন?

কেন সম্ভব নয় বল? ডাক্তার মৃদু হেসে কৃষ্ণার মুখের দিকে তাকায়।

ধরুন আমি একবার যদি কৃষ্ণা, আবার একবার কাবেরী বলে নিজের পরিচয় দিই এবং আমরা দুটি বোন পরস্পর পরস্পরকে যতটা closely study করবার সুযোগ বা সুবিধা পেয়েছি সেই হতে আমরা পরস্পর পরস্পরকে যতটা ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ ভাবে চিনি ও জানি সেদিক থেকে আমরা একে অন্যের কথাবার্তা, হাবভাব, চালচলন একই ভাবে প্রকাশ করলে, সাধ্য কি কেউ তা জানতে পারে?

তোমার কথা যে কতকটা সত্য অস্বীকার করি না কৃষ্ণা, কিন্তু এও ঠিক, প্রত্যেক মানুষের। অবচেতন মনে যে প্রবৃত্তিগুলো জন্মগতভাবে সুপ্ত থাকে, অনেক সময় নিজের অজ্ঞাতে চিন্তায় ভাবে ও প্রবৃত্তিতে প্রকাশ হতে দেখা যায়। মানুষ তার পরিবেষ্টনী ও অবচেতন চিন্তার দ্বারা নিজের অজ্ঞাতেই অনেক ক্ষেত্রে চালিত হয়ে থাকে এ কথা কি অস্বীকার কর কৃষ্ণা! ডাক্তার তার বক্তব্য শেষ করে।

না।

তবে?

হঠাৎ ঢং ঢং করে রাত্রি বারোটা ঘোষণা করল দেওয়াল-ঘড়িতে।

কৃষ্ণা চমকে উঠে দাঁড়ায়, উঃ অনেক রাত হয়ে গেল!

আমার গাড়ি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে কৃষ্ণা।

না, প্রয়োজন নেই, রাস্তা থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে নেবোখন।

না। এত রাত্রে একাকী তোমার ট্যাক্সি করে যাওয়া উচিত হবে না, তা ছাড়া তোমার বাবা শুনলেও হয়ত অসন্তুষ্ট হবেন।

বাবা! হ্যাঁ, তা হবেন—কথাটা যেন অন্যমনস্কের মতই বলে কৃষ্ণা কতকটা আত্মগতভাবেই।

তারপর একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস যেন কৃষ্ণার বুকখানা কাঁপিয়ে বের হয়ে আসে।

একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো কৃষ্ণা, অবশ্য যদি মনে কিছু না করো—

কি?

তোমার বাবার সম্পর্কে যখনই কোন কথা উঠেছে তুমি যেন–

না, না—ওকথা থাক ডাঃ গুপ্ত, আমি এবারে যাবো—

বলতে বলতে সহসা যেন উঠে দাঁড়ায় কৃষ্ণা।

হ্যাঁ, চল—

কৃষ্ণাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে সুকুমার ড্রাইভারকে বলে, ওহি কোঠি পরই মেমসাবকো ভি পৌঁছা দেনা লছমন্।

জি।

গাড়ি চলে গেল। অন্ধকারে ক্রমবিলীয়মান গাড়ির লাল টেইল লাইটটার দিকে তাকিয়ে করিডোরেই দাঁড়িয়ে থাকে সুকুমার।

সহসা কিরীটীর ডাকে ও চমকে ওঠে, এবারে আমিও গুডনাইট জানাবো ডাক্তার।

যাবি?

হ্যাঁ, ধ্যানের সময় আর যাই হোক দ্বিতীয় ব্যক্তির উপস্থিতিও ভাল লাগবে না।

একটা কথা কিরীটী—

বল্।

আচ্ছা কৃষ্ণা কাবেরী বোন দুটি সম্পর্কে তোমার ধারণা মানে মতামত কি?

দেখ, তোর প্রতিদিনকার সিটিংয়ের রিপোর্ট পড়ে এবং ওদের সম্পর্কে তোর মতামত শুনে ও আজকের ব্যাপার দেখে আমরা একটা যাহোক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি।

কি?

কৃষ্ণা ও কাবেরী যমজ বোন দুটির মনোগত চিন্তা বা প্রবৃত্তির মধ্যে সুস্পষ্ট একটা পার্থক্য আছে স্বীকার করিস, না করিস না?

সে তো নিশ্চয়ই–কিন্তু–

হ্যাঁ, পরস্পরের মধ্যে তাদের যতই similarity থাকুক না কেন, চিন্তাধারা ও প্রবৃত্তির দিক হতে কতকগুলো জায়গায় they distinctly differ from each other—অর্থাৎ একে অন্য হতে বিশেষ ভাবেই পৃথক। কিন্তু সে কথার আগে একটা প্রশ্ন, এদের এতদিন ধরে study করে নিজস্ব নিশ্চয়ই তোর একটা মতামত গড়ে উঠেছে—সেটা কি বল তো?

একটু যেন চিন্তা করে সুকুমার বলে, আমার মনে হয় কৃষ্ণা ও কাবেরী দুটি বোনের মধ্যে একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, তীক্ষ্ণ ও চতুর—অথবা একেবারে নিরেট, আর তা না হলে একজন চতুর ও বুদ্ধিমতী হয়েও বোকার অভিনয় করে চলেছে এবং অন্যজন সত্যই হয়ত খুব নিরীহ, সরল, শান্তশিষ্ট ও একটু ভীতু প্রকৃতির।

তোমার কথা যে একেবারে মিথ্যা জোর গলায় বলতে পারি না ডাক্তার। অবশ্য আমার মনে হয় যাকে তুই অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও চতুরা বলছিস—তাকে আমি বুদ্ধিমতী ও চতুরা তো বলবোই সেই সঙ্গে অতিরিক্ত রোমান্টিক মনোভাবাপন্নও বলবো এবং মনের তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও রোমান্স দুটোতে মিলে কিছুটা মানসিক insanity develop করেছে বলবো।

Insanity—মানসিক বৈকল্য বা বিকৃতি?

হ্যাঁ, এখানে insanity বলতে ঠিক আমি যা বলতে চাই তা হচ্ছে, মন অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ও রোমান্টিক হওয়ার জন্য যে এক ধরনের মানসিক পরিবর্তন ঘটে তাই and nothing more কিন্তু সে কথা যাক, definite প্রমাণ বা প্র ছাড়া তো আজকের দিনে কাউকেই দোষী সাব্যস্ত করে কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করানো যেতে পারে না। আমরা দুটি বোনের মানসিক ও প্রকৃতির পরিচয় কিছুটা পেয়েছি মাত্র কিন্তু আসলে ঐ যমজ দুটি ভগ্নীর মধ্যে কোন্ জন সত্যি করে নিহত নরেন মল্লিকের সঙ্গে বিশেষভাবে ঘনিষ্ঠ ছিল সে সম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের বর্তমান সমস্যা এক পা-ও এগুচ্ছে না। যে জট ওদের দুটি বোনকে কেন্দ্র করে বর্তমান সমস্যাকে ঘোরালো করে রেখেছে সে জট এতটুকুও খুলছে না।

কোন উপায়ই কি খুঁজে পাচ্ছিস না?

পেতে হবেই কিন্তু তার আগে আরো একটা বিশেষ প্রয়োজনীয় কাজের ভার তোর ওপরে আমি দিয়ে যেতে চাই।

আবার কি কাজ?

That mysterious father of কৃষ্ণা কাবেরী—হ্যাঁ, কৃষ্ণা কাবেরীর বাপ ভদ্রলোকটি যেন নিজেকে একটা কুহেলীর আবরণে সযত্নে ঢেকে রেখেছেন; যতটুকু আজ পর্যন্ত ভদ্রলোকটি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, লোকটা ঘরের মধ্যে দিবারাত্র নিজেকে বন্দী করে রাখে, কারো সঙ্গে দেখা করে না, কথা বলে না, মেয়ে দুটির উপরে অসাধারণ একটা আধিপত্য ভদ্রলোকের, যার মধ্যে হয়তো আছে একটু হিংসা, একটু ভয়, একটু সন্দেহ ও একটু আশঙ্কা এবং সব কিছু মিলে রহস্যঘেরা বিকৃত ও অস্বাভাবিক একটা সংশয়।

এত সংবাদ তুই পেলি কোথা হতে?

পাওয়াটাই যে আমার কাজ—হাঁ বলছিলাম, শুধু তাই নয়, ভদ্রলোকের একটা পা paralytic, ক্রাচে ভর দিয়ে চলাফেরা করেন, রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন, সেক্সপীয়ার, মিল্টন, কীটস নিয়ে ও মদ্যপান করে সময় কাটান। সব কিছুতে মিলে একটা মিস্ত্রি, একটা কিউরিও। একটু থেমে আবার বলে, হয়ত ঐ পিতার রহস্যের সঙ্গেই কন্যা দুটিরও অনেক রহস্যের সন্ধান পাওয়া যাবে—অতএব তোকে ঐ বোন দুটির কাছ হতে যেমন করে হোক পিতা ও মেয়ে দুটির মধ্যে আসল ও সত্যিকারের সম্পর্কটুকু খুঁজে বের করে আনতে হবে, পারবি না?

আমি তো বুঝতে পারছি না–কি করে তা সম্ভব হবে?

কেন? প্রেম দিয়ে বন্ধু চিনিয়া লইও তোমার বঁধুর সে হৃদয়খানি।

.

ভিটোরিয়া মেমোরিয়াল-এর বাগানে নিরিবিলি একটা বৃক্ষতল। অদূরে গাছের নীচে দাঁড় করানো আছে ডাঃ সুকুমার গুপ্তর গাড়ি। পাশাপাশি বসে সুকুমার ও কৃষ্ণা।

একটা ঘাসের শীষ দাঁত দিয়ে কাটছে আনমনে কৃষ্ণা। সাধারণ পিঁয়াজী রংয়ের ব্লাউজ ও শাড়ি পরিধানে কৃষ্ণার, মাথার চুল এলো খোঁপার আকারে বাঁ কাঁধের উপর লুটিয়ে পড়েছে।

কি ভাবছেন ডাঃ গুপ্ত? কৃষ্ণা প্রশ্ন করে। টী করছো।

বেশ, তুমি বললে যদি আপনি সুখী হন তুমিই বলবো।

কথাটা বলতে বলতে কৃষ্ণা কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যায়।

কি ভাবছো? ডাক্তার প্রশ্ন করে।

ভাবছি এর চাইতে তোমার আমার পরিচয় না হলেই ভাল ছিল—

এ কথা কেন বলছো? এক-এক সময় তোমার হাবভাব দেখে মনে হয়, কি একটা গভীর সংশয় যেন দিবারাত্র তোমায় পীড়া দিচ্ছে। আমাকে সব কথা খুলে বল, এমনও তো হতে পারে তোমায় আমি সাহায্য করতে পারি।

না, না—তুমি জান না, তুমি তো জান না, কত বড় একটা দুঃস্বপ্ন দিবারাত্র ছায়ার মতোই আমাকে অনুসরণ করে ফেরে।

কৃষ্ণা আবার যেন অন্যমনস্ক, চিন্তিত হয়ে যায়।

শোন। সেদিনও তোমাকে বলেছি, আজও আবার বলছি আমি তোমার বাবার সঙ্গে একবার—

না, না—কতকটা আর্ত আকুল কণ্ঠেই যেন বলে ওঠে কৃষ্ণা, ও কাজও তুমি করো না, বাবাকে তুমি চেন না। মত তো তিনি দেবেনই না, আর এ জীবনে আমাদের পরস্পরের এই দেখাসাক্ষাৎ, এও তিনি চিরজীবনের মত বন্ধ করে দেবেন হয়ত।

কিন্তু চিরদিনই কি তাহলে আমাদের এমনি করেই লুকিয়ে-চুরিয়ে বেড়াতে হবে? প্রকাশ্যে তোমাকে কোনদিনই দাবী করতে পারবো না?

.

কলকাতা শহরের চৌরঙ্গী অঞ্চলে সুবিখ্যাত একটি ইংলিশ হোটেলের মধ্যে। আলোকিত হোটেলটি। বহু নরনারী একত্র বা জোড়া টেবিলে বসে পান ও আহার করছে। হোটেলের এক পাশে ইংরাজী বাজনা বাজছে নানা বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে। একটি কর্ণার সীটে মুখোমুখি বসে কাবেরী ও সুবিমল, সামনের টেবিলের উপরে রক্ষিত কেক চা ইত্যাদি। সুবিমলের পরিধানে সাহেবী পোশাক।

চা পান করতে করতে সুবিমল বলছিল, সত্যি বলতে পারো, এমনি করে কতকাল আর আমাদের লুকিয়ে-চুরিয়ে বেড়াতে হবে?

কি করব বল! তবু দেখাশুনাটাও তো হচ্ছে কাবেরী জবাব দেয়।

কিন্তু মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছো, বিবাহ তো একদিন মেয়ের দিতেই হবে—তবে তোমার বাবার তোমাদের বিবাহে এত আপত্তিই বা কিসের?

বুঝতে পারি না, কেন বাবা কোন পুরুষের সঙ্গেই আমাদের মিশতে দেন না। এমন কি সেদিন রাত্রের sittingয়ের পর বাড়িতে ফিরে গেলে ডাক্তারের চেম্বারে যেতেও সেদিন হতে নিষেধ করে দিয়েছেন। তোমার সঙ্গে মিশি একথা ঘুণাক্ষরে জানতে পারলেও আর রক্ষা রাখবেন না।

কিন্তু এ অত্যাচার! সত্যি, ক্রমেই যেন এ আমার অসহ্য ঠেকছে। চলো—তার চাইতে না হয় আমরা বিবাহ করে তারপর তোমার বাবার কাছে

না না, এত তাড়াতাড়ি বিবাহ আমাদের হতেই পারে না। বাবা আমাদের বাবাকে তুমি জান না, তিনি আমাকে কিছুতেই তা হলে ক্ষমা করবেন না। আর তার ক্রোধ! না না, সে আমি ভাবতেও পারি না। তুমি—তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

এমন সময় দীর্ঘকায় ফৈয়াজ, পরিধানে সাহেবী পোশাক আর চোখে কালো কাচের চশমা, এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হোটেলে এসে প্রবেশ করল। এবং সহসা কাবেরী ও সুবিমলের উপর নজর পড়তেই ওদের অল্প দূরে একটা চেয়ারে এসে উপবেশন করে ভারী গলায় ডাকল, বোয়!

বেয়ারা এসে সেলাম দিয়ে পাশে দাঁড়াল, টি অ্যাণ্ড স্যাণ্ডউইচ।

বেয়ারা সেলাম দিয়ে চলে গেল।

ফৈয়াজ একটা পাইপ ধরিয়ে ধূমোদগীরণ করতে থাকে।

তোমাদের দুই বোনেরই তোমাদের বাবা সম্পর্কে এমন একটা আতঙ্ক কেন বল তো? হাজার হলেও তিনি তো তোমাদেরই বাপ-তোমরা তার সন্তান—আবার এক সময় সুবিমল বলে।

হ্যাঁ, কিন্তু না—বাবার অমতে কোন কিছু করা অসম্ভব, তাছাড়া বাকী কথাগুলো আর কাবেরী শেষ করে না, সহসা অদূরে পাঠানটির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করে কাবেরী।

অধীর কণ্ঠে বলে ওঠে, চল—আমরা যাই।

এখনি উঠবে? আর একটু বসবে না?

না চল। ওঠ। কাবেরী উঠে দাঁড়ায়।

বয়—বিল লাও। সুবিমল বেয়ারাকে ডাকে।

.

পরের দিন প্রত্যুষে। কৃষ্ণা কাবেরীদের ফ্ল্যাটবাড়ির বাইরের কক্ষ।

কৃয়া বসে বসে ঐদিনকার সংবাদপত্রটা পড়ছে, কাবেরী এসে কক্ষে প্রবেশ করল, চোখে মুখে বেশভূষায় সদ্য নিদ্রাভঙ্গের সুস্পষ্ট চিহ্ন। আজকাল কিছুদিন থেকে দুই বোনের নিবিড় একাত্মবোধ ও অন্তরঙ্গতার মধ্যে যেন একটা চিড় খেয়েছে। স্পষ্টভাবেই আজকাল যেন পরস্পর পরস্পরকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলে।

কাল অত রাত করে ফিরলি যে কাবি! অফিস থেকে বের হয়ে কোথায় গিয়েছিলি?

একটা হাই তুলে সোফাটার উপর বসতে বসতে কাবেরী বলে, গিয়েছিলাম—

গিয়েছিলি তা তো জানিই, কিন্তু কোথায় অত রাত পর্যন্ত ছিলি তাই তো জিজ্ঞাসা করছি।

ডাঃ গুপ্তর ওখানে।

সংবাদপত্র হতে মুখ তুলে বিস্মিত দৃষ্টিতে কৃষ্ণা কাবেরীর মুখের দিকে তাকাল।

Sitting ছিল বুঝি?

না।

তবে?

তবে আবার কি? পরিচিত লোকদের সঙ্গে একমাত্র কাজ না থাকলে কি আর দেখাসাক্ষাৎ করা যেতে পারে না? এমনি একটা social call!

বাবা না নিষেধ করে দিয়েছিলেন সেখানে যেতে! আশা করি ভুলে যাস নি এত তাড়াতাড়ি–

না, ভুলবো কেন? স্মৃতিশক্তি আমার এখনো এত ক্ষীণ হয় নি যে—

সহসা এমন সময় কক্ষের আর্শিতে সঞ্জীবের ছায়াপাত হলো।

ক্রাচে ভর দিয়ে ইতিমধ্যে কখন একসময় নিঃশব্দে ওদের অলক্ষ্যে সঞ্জীব দরজার গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছেন ওরা দুজনার একজনও টের পায় নি।

স্মৃতিশক্তি তোমার অবশ্য তা হলে প্রশংসনীয়ই বলতে হবে কাবেরী—

যুগপৎ দুই বোনই চম্‌কে ফিরে তাকালো এবং সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল।

অস্ফুট শব্দ দুজনারই কণ্ঠ হতে নির্গত হলো, বাবা!

সঞ্জীব ক্রাচে ভর দিতে দিতে কক্ষে প্রবেশ করলেন।

তাহলে আবার তুমি ডাক্তারের ওখানে গিয়েছিলে কাবি! আশ্চর্য, আমার আদেশ অমান্য করতে সাহস করো! সঞ্জীবের চোখের মণি দুটোতে অদ্ভুত একটা আলো দেখা দেয়, হিংস্র কুটিল।

সভয়ে কৃষ্ণা বলে ওঠে, বাবা!

কি? জবাব দিচ্ছ না যে? আবার সঞ্জীবের কণ্ঠ শোনা গেল। কঠিন নির্মম।

আমি—

সহসা বোমার মতই ফেটে পড়েন সঞ্জীব—আমি! আমি কি? কেন–কেন আমার নিষেধ সত্ত্বেও ফের আবার ডাঃ সুকুমার গুপ্তের চেম্বারে গিয়েছিলে? বল—জবাব দাও!

কাবেরী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, কোন জবাব দিতেই বোধ হয় সাহস পায় না। সঞ্জীবের দুচক্ষুর তীক্ষ্ণ, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি যেন কাবেরীর সর্বাঙ্গে দ্রুত পরিক্রম করছে। স্তব্ধতা। নীরেট পাষাণের স্তব্ধতা সমগ্র কক্ষখানি জুড়ে।

সহসা আবার সঞ্জীবের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, বেশ, আজই ডাক্তারের কাছে কালকের দরুন ১০০ টাকার একটা বিল দেবে–

বাবা! আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে কাবেরী।

হ্যাঁ, আমার মেয়েরা বেকার নয় লোফার নয়, তাদের প্রতিটি মুহূর্তের দাম আছে।

বাবা–, আবার কাবেরী কি যেন বলবার চেষ্টা করে।

না, কোন কথাই আমি শুনতে চাই না। বিল তুমি দেবেই, হ্যাঁ, এই আমার আদেশ—আমার আদেশ। বাধা দিয়ে সঞ্জীব বলে ওঠেন।

না না, আমি পারবো না, আমি তা পারবো না! রুদ্ধ কণ্ঠে প্রতিবাদ জানায় কাবেরী।

পাষাণের মত দাঁড়িয়ে থাকে এক পাশে কৃষ্ণা।

পারবে না? গর্জন করে ওঠেন সঞ্জীব।

না, না-পারবো না। আমি পারবো না। বলতে বলতে স্খলিত পদে কাবেরী ঘর থেকে চলে যায়।

পারবে না? কাবেরী? কাবেরী? কাবেরী? বলতে বলতে সঞ্জীব মেয়েকে অনুসরণ করতে যেতেই এতক্ষণে কৃষ্ণা এসে বাপকে দুহাতে আগলে দাঁড়ায়।

বাবা! বাবা—

কৃষ্ণা! থমকে দাঁড়ান সঞ্জীব।

বাবা-কাবি ছেলেমানুষ, ওকে ক্ষমা করুন। ও—

ক্ষমা! হাঃ হাঃ—পাগলের মতই উচ্চৈঃস্বরে হেসে ওঠেন সঞ্জীব।

ক্ষমা-সঞ্জীব চৌধুরী ক্ষমা কাউকে করে না। কিন্তু আমি জানতাম, এ আমি জানতাম। রক্তের ঋণ তোমাদের শোধ করতেই যে হবে—করুণার দেহরক্তের বিষ। জানতাম, আমি জানতাম—বিষ একদিন ফেনিল হয়ে উঠবেই, তাকে কেউ রোধ করতে পারবে না। কেউ রোধ করতে পারবে না।

বাবা–তুমি হাঁপাচ্ছ। বসো, এই চেয়ারটার ওপরে বসো।

কৃষ্ণা সঞ্জীরকে টেনে এনে চেয়ারটার উপর বসিয়ে দেয়।

কৃষ্ণা, শোন। এ বাড়ি ছেড়ে এ শহর ছেড়ে–যত শীঘ্র সম্ভব আমাদের চলে যেতে হবে।

চলে যাবে? কোথায়?

জানি না। শুধু এইটুকু জানি দূরে—দূরে–বহুদূরে।

কিন্তু–

শোন, তোমাদের আমি এতদিন বলি নি–তোমাদের অনুপস্থিতিতে দুতিনদিন রাত্রে এ বাড়িতে নিশ্চয়ই চোর এসেছে–

চোর!

হ্যাঁ, খস খস শব্দ শুনে আমি পাশের ঘরে গিয়েছি—ঘর অন্ধকার। আলো জ্বেলে কাউকে দেখতে পাই নি। কিন্তু আমি নিশ্চিত, কোন অজানা লোক আমাদের ছায়ার মতই অলক্ষ্যে অনুসরণ করে বেড়াচ্ছে। তার পদশব্দ আমি শুনতে পেয়েছি।

কিন্তু বাবা, তেতলার ফ্ল্যাটে যে আমরা—

বিশ্বাস কর কৃষ্ণা, এসেছে, নিশ্চয়ই কেউ এসেছে—তার স্পষ্ট পদশব্দ আমি শুনেছি। বেশী দিন নয়, নরেন মল্লিকের মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকেই এ ব্যাপারটা চলেছে–

নরেন মল্লিকের মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকেই! আর্তকণ্ঠে যেন চিৎকার করে বলে ওঠে কৃষ্ণা।

হাঁ।

ফ্যালফ্যাল্ করে বোবাদৃষ্টিতে কৃষ্ণা তার বাবার মুখের দিকে চেয়ে থাকে।

.

হাঁ বাবু—কর্তাবাবু মারা যাবার পর থেকে প্রায়ই রাত্রে উপরের তলায় বাবুর ঘরটার মধ্যে কি সব শব্দ শোনা যায়। কখনো মনে হয় কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে, কখনো মনে হয় কেউ বা কারা যেন ঘরের সব জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করছে। শুধু আমিই নয় দাদাবাবু, হরি আর যদুও শুনেছে–

নরেন মল্লিকের বাড়িতে সকালবেলা সুবিমলের কক্ষে সুবিমল চেয়ারে বসে চা-পান করছে, সামনে দাঁড়িয়ে মধু।

মধুই কথাগুলো বলছিল।

কিন্তু এ কথা তোকই এতদিন তুমি আমাকে বল নি মধুদা!

এতদিন বলি নি দাদাবাবু, কিন্তু আর না বলে পারলাম না। হরি, যদু, ঠাকুর ওরা তো বেশ ভয় পেয়েই গেছে।

ভয় পেয়েছে?

হ্যাঁ, ওরা বলাবলি করছিল কর্তাবাবুর অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে–তাঁর প্রেতাত্মা–

Nonsense! সে যাক্, এক কাজ করো, আজ থেকে ওঘরে তালা দিয়ে রেখো।

বেশ।

.

কিরীটীর বাড়িতে। কিরীটী ও তালুকদারের মধ্যে কথোপকথন হচ্ছিল। সামনে ক্রিয়ের ওপরে কাপে চা। মধ্যে মধ্যে ওরা চা-পান করছে।

সেই লোকটার উপরে বেশ ভাল করে নজর রাখা হয়েছে তো তালুকদার?

হ্যাঁ, ভূপেন রথীন আর যতীন তিনজনকে নিযুক্ত করা হয়েছে। প্রায়ই লোকটাকে নরেন মল্লিকের বাড়ির আশেপাশে ও কাবেরীদের বাড়ির কাছে ঘোরাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে।

ও লোকটার রহস্য সব জানতেই হবে। লোকটার বাড়ি, জাতি, পেশা—সব।

কিছু কিছু জেনেছি—লোকটা জাতিতে পাঠান, পেশা দালালী, ব্রোকার। থাকে Taj Hotelয়ে, একটা কালো রংয়ের সিডনবডি গাড়ি আছে। গাড়ির নং BLA 6786.

আর একটা কথা, সঞ্জীব চৌধুরীর অতীত ইতিহাসটা জানা গেল?

সামান্য–লোকটা এককালে আসামের এক চা-বাগানে ম্যানেজার ছিল এবং প্রচুর নগদ পয়সা ও স্থাবর সম্পত্তি কলকাতার ওপরে তিনখানা বাড়ি ছিল। এককালের নামকরা আধুনিক সমাজের মেয়ে করুণা সেনকে বিবাহ করেছিল। বিবাহের পর স্ত্রী এখানেই থাকত। লোকটার মাঝখানের দীর্ঘ ১৫ বছরের ইতিহাসটা শুধু এখনো জানা যায় নি।

বেশ। আর সুবিমল? তার ওপরেও নজর রেখেছ তো?

হ্যাঁ, এইটুকু বোঝা গিয়েছে, দুটি বোনের একটির সঙ্গে তার যথেষ্ট হৃদ্যতা আছে। কিন্তু দুটি বোনকেই হুবহু একই রকম দেখতে হওয়ায় আমার লোকেরা এখনো স্থির করতে পারে নি কোন্ বোনটি আসলে সুবিমলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠা। ভাল কথা, তোমাদের ডাক্তার গুপ্ত কি বলেন?

আপাততঃ সে বেচারীও হর্নস অব এ ডায়লেমাতে পড়েছে হাসতে হাসতে জবাব দেয় কিরীটী।

কি রকম?

হ্যাঁ, বেচারী এখনও ঠিক করেই উঠতে পারে নি কার প্রেমে সত্যি সত্যি পড়লো!

ইনটারেস্টিং তো!

তা একটু বৈকি, কিন্তু সে যাক্‌-একটা কথা—

কি?

নিহত নরেন মল্লিকের শয়নকক্ষটা আরো একবার ভালো করে তন্ন তন্ন করে আমাদের সার্চ করতে হবে অর্থাৎ সেই ঘরের আলমারি, ডেস্ক, ড্রয়ার ইত্যাদিগুলো।

হঠাৎ ডেস্ক, ড্রয়ার ইত্যাদি—কোন কিছু পাওয়া যাবে আশা করো নাকি?

একেবারে করি না বললে সত্যের অপলাপই করা হবে বৈকি।

যদি কিছু না মনে কর তো আরো একটু যদি বিশদভাবে খুলে বল।

কত কি-ই তো পাওয়া যেতে পারে, যেমন ধরো চিঠিপত্র কিংবা কোন মূল্যবান কাগজপত্র বা অন্য ধরনের কিছু–

হুঁ, বুঝেছি।