১. ইস্পাতের তৈরী ছোরাটা

কৃষ্ণা কাবেরী

ইস্পাতের তৈরী ছোরাটা।

ছোরার ফলাটা ক্রমে সরু হয়ে অগ্রভাগটা তীক্ষ্ণ, অত্যন্ত ধারালো; ছোরার বাঁটটা সুদৃশ্য কারুকার্যখচিত চন্দনকাঠের তৈরী! সুমিগ্ধ পাতলা একটা চন্দনের গন্ধ ঘরের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে!

দুটি চেয়ারে মুখোমুখি বসে সি. আই. ডি-র ইন্সপেক্টার মজিবুর রহমান ও কিরীটী রায়। সামনেই একটা ছোট শ্বেতপাথরের টেবিলের উপরে অয়েল পেপারের উপরে রক্ষিত ছোরাটা।

কিরীটী প্রশ্ন করে, তারপর?

তারপর সকালে ভৃত্য মধুই নরেন মল্লিকের শয়নকক্ষে ঢুকে প্রথম দেখতে পায়, নরেন মল্লিকের অসাড় প্রাণহীন দেহটা ডেক-চেয়ারটার ঠিক সামনেই, মেঝের কার্পেটের উপরে চিৎ হয়ে পড়ে আছে এবং বাম দিককার বুকে ঐ ছোরাটা সমূলে বিদ্ধ হয়ে আছে। গায়ে তখনও তার স্লিপিং গাউনটা পরা! The dagger pierced through and through the heart!

হুঁ! যে-ই নরেন মল্লিককে ছোরা দিয়ে হত্যা করে থাকুক আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে লোকটা হাতে প্রচুর শক্তি রাখে! আচ্ছা স্লিপিং গাউনটা তখনও নরেন মল্লিকের গায়েই ছিল বলছিলেন ইনসপেক্টার, ঘরের শয্যাটা পরীক্ষা করা হয়েছিল কি?

হাঁ। আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি শয্যাটা, রাত্রে ব্যবহৃত হয় নি। এমন কি প্রতি রাত্রে নাকি শয়নের পূর্বে নরেন মল্লিকের এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল পান করা অভ্যাস ছিল, মধুর সে রাত্রে রাখা শিয়রের সামনে ত্রিপয়ের উপরে রক্ষিত জলভর্তি গ্লাসটা পর্যন্ত ঠিক তেমনই ছিল। রাত্রি দশটায় নিজে সে গ্লাসটা জলভর্তি করে রেখে এসেছিল। ময়না তদন্তের রিপোর্টেও তাহলে মৃত্যুর কারণ ছুরিকাঘাতই—

অন্য কোন নিদর্শনই পাওয়া যায় নি?

না।

কিরীটী সম্মুখের টেবিলের ওপরে রক্ষিত অয়েল পেপারের উপর থেকে ছোরাটা তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। ইস্পাতের তৈরী মজবুত ছোরা। ওজনেও মন্দ হবে না। অগ্রভাগটা ধারালো ও তীক্ষ্ণ।

হঠাৎ মজিবুর রহমান বলে, কিন্তু আশ্চর্য কি জানেন মিঃ রায়, ছোরার বাঁটে কোন আঙ্গুলের ছাপই পাওয়া যায় নি।

কিরীটী তখনও ছোরাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল, মৃদু কণ্ঠে বলে, স্বাভাবিক।

স্বাভাবিক!–বিস্মিত রহমান কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ, তা বই কি! প্রথমতঃ ছোরার বাঁটে কোন আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া গেলে সর্বাগ্রে নিশ্চয়ই সে কথা আপনি আমাকে বলতেন। দ্বিতীয়তঃ অমন কৌশলের সঙ্গে যে খুন করতে পারে, ছোরার বাঁটে সে তার আঙ্গুলের ছাপ রেখে যাবে এমন ভাবাই তো অন্যায়! আর এসব ক্ষেত্রে by chance আঙ্গুলের কোন ছাপ পাওয়া গেলেও সেটা হত্যাকারীর কখনো হয় না, বরং যে নিহত হয় অনেক সময় তারই আঙ্গুলের ছাপ বা হাতের ছাপ পাওয়া যায়। কিন্তু সে কথা যাক। মৃতের কক্ষে হত্যার সূত্র বা প্রমাণ হিসেবে তার বক্ষে বিদ্ধ এই ছোরাখানি ছাড়া আর কিছুই তাহলে পাওয়া যায় নি বা নজরে পড়ে নি আপনাদের? যেমন ধরুন, কোন struggleয়ের চিহ্ন বা—

না। So far সবই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখা হয়েছে, but nothing more could be detected.

হুঁ।

এর পর কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে থাকে।

হঠাৎ আবার কিরীটীই ডাকে, মিঃ রহমান?

বলুন?

সেই ঘরটা, মানে পার্ক সার্কাসে মৃত নরেন মল্লিকের বাড়িতে যে কক্ষে তাকে নিহত অবস্থায় পাওয়া যায়, সেই ঘরটা কি এখনো আপনাদের disposalয়েই আছে?

হাঁ নিশ্চয়ই! তদন্ত এখনো চলছে, করোনার্স কোর্টে বিচার এখনও শেষ হয় নি। নরেন মল্লিক নিহত হয়েছে গত ২৭শে পৌষ সোমবার—আর আজ বৃহস্পতিবার, মাত্র তিন দিন আগে।

বেশ। তাহলে আজ এখুনি যদি আপনার অসুবিধা না হয় চলুন না, আর একটিবার সেই ঘরটা দুজনে ভাল করে দেখে আসা যাক। আর সেই সঙ্গে বাড়ির লোকদেরও দু-চারটে কথা জিজ্ঞাসা করে আসা যাবে।

বেশ তো! আপত্তি কি, চলুন!

তবে আর দেরি নয়—শুভস্য শীঘ্র—চলুন ওঠা যাক।

ইন্সপেক্টার মিঃ রহমানের গাড়িতে চেপেই কিরীটী ও রহমান সাহেব রওনা হলো পার্ক সার্কাসে নরেন মল্লিকের বাড়ির দিকে অতঃপর। এবং গাড়িতে বসেই একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করে ধূমপান করতে করতে হঠাৎ এক সময় কিরীটী আবার প্রশ্ন করে, আচ্ছা রহমান সাহেব, আপনি বলছিলেন নরেন মল্লিক বহুদিন বর্মা মুন্নকে ব্যবসা করেছেন। এবং মাত্র এক বৎসর আগে যদি তিনি হঠাৎ ব্যবসা গুটিয়ে দিয়ে এসে থাকেন, কেন এলেন? আর শুধু তাই নয়, এক বৎসরের মধ্যেই খুনও হলেন নৃশংস ভাবে। কিন্তু কেন, কেন

আপনার কথাটা ঠিক আমি বুঝতে পারছি না মিঃ রায়!

মানে, বলছিলাম তার অর্থাৎ মল্লিকের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে একটা details পেলে আমাদের তদন্তের সুবিধা হতো না কি?-অনেক সময় দেখা গিয়েছে এ সব ঘটনার পিছনে থাকে অনেক ব্যক্তিগত ব্যাপার জড়িত হয়ে।

সৌভাগ্যক্রমে খুনের পরের দিন সকালে তদন্তের সময়ই নরেন মল্লিকের এক পুরাতন বন্ধু, অ্যাড়ভোকেট সমীর রায় এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনিই বলেছিলেন, নরেন মল্লিক তার বহুকালের বন্ধু এবং নরেন মল্লিক হঠাৎ চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে এসে তারই বাড়িতে নাকি সর্বপ্রথম ওঠেন।

.

এক দিন সকালে ঠিক আজ থেকে এক বছর আগে।

সমীর রায় সকালে তার বাইরের ঘরে বসে ঐ দিনকার সংবাদপত্রটার ওপরে চোখ বুলোচ্ছে, বাইরে গেটের সামনে একটা গাড়ি থামবার শব্দ শোনা গেল। সমীর একটু কৌতূহলী হয়েই জানালার সামনে উঠে এসে দাঁড়াল। বাড়ির গেটের সামনে একটা মালবোঝাই ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে, ট্যাক্সির সামনে নরেন মল্লিক ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলছে।

নরেন! এ সময়ে হঠাৎ! কোন চিঠিপত্র না দিয়ে!

একটু পরেই নরেন এসে কক্ষে প্রবেশ করল।

নরেন তুই! হঠাৎ–

হঠাৎই। বর্মার ব্যবসা গুটিয়ে দিয়ে এলাম।

গুটিয়ে দিয়ে এলি? হঠাৎ

চলে এলাম আর ভাল লাগল না। কিন্তু তার আগে তোর চারককে বল, আমার চাকর মধু ট্যাক্সিতে আছে, মালপত্রগুলো নামিয়ে আপাতত কোথাও গুছিয়ে রাখবার জন্য হাত দিতে।

তা না হয় বলছি—কিন্তু—

ব্যস্ত হোস নে। সব বোলবো–

সমীর ভৃত্যকে ডেকে ট্যাক্সি থেকে সব মালপত্র নামিয়ে নিচের ভিজিটার্স রুমে আপাতত গুছিয়ে রেখে দিতে আদেশ দিল।

নরেন মল্লিকের চেহারাটা সত্যই দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে। বাঙালীর মধ্যে সচরাচর এমন চমৎকার সুগঠিত, উঁচু, লম্বা, সুশ্রী দৈহিক গঠন বড় একটা দেখা যায় না। নরেন মল্লিকের বয়েস বর্তমানে উনপঞ্চাশ এবং বয়সের অনুপাতে দেহের কোথাও এতটুকু ভাঙনও ধরে নি। সমস্ত দেহ জুড়ে এখনো যৌবন যেন স্থির হয়ে আছে।

কেবল কপালের দুপাশের চুলে সামান্য পাক ধরেছে। গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল গৌর। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। চঞ্চল, ক্রীড়াশীল ও কৌতুকপ্রিয় স্বভাব। নরেন মল্লিককে দেখলেই মনে হয়, সত্যিই যেন সে বেঁচে আছে। এবং পৃথিবীতে বাঁচবার সমস্ত রহস্যটুকুই যেন ওর করায়ত্ত।

.

দ্বিপ্রহরে আহারাদির পর নরেন ও সমীর মুখোমুখি বসে দুই বন্ধুতে সকালের কথারই জের চালাচ্ছিল। আজ রবিবার, আদালতও বন্ধ। ছুটি।

নরেন বলছিল, মোদ্দা কথা বন্ধু, I want to live the rest of my life, যদিও শাস্ত্রে বলেছে পঞ্চাশের পরেই বনং ব্রজেৎ, আমি স্বীকার করি না সে কথা। আমার ideal পুরুষ হচ্ছে বিখ্যাত ডাক্তার ও বৈজ্ঞানিক ভরেনহ। অর্থ না থাকলে বাঁচা যায় না। এতকাল সেই অর্থের ধান্ধায় ঘুরেছি, সময় পাই নি জীবনের দিকে তাকাবার, আজ অর্থ আমার করায়ত্ত, এবারে eat, drink and be merry! এবারে বাঁচতে চাই! So–

So? হাস্যোফুল ভাবে সমীর বন্ধুর দিকে তাকায়।

So একটা বাড়ি ও একটা গাড়ি সর্বাগ্রে প্রয়োজন; তারপর শুরু করবো আমার জীবন।

বাড়ি আর গাড়ি?

হাঁ। বর্তমান দুনিয়ায় বাড়ি, গাড়ি ও ব্যাঙ্ক-ব্যালান্সই আধুনিক কালে বাঁচবার প্রচেষ্টায় প্রথম তিনটি সোপান; শেষটি আমি সঙ্গে করেই এনেছি এবার, প্রথম দুটি তুমি সংগ্রহ করে দাও, শুরু করি আমি আমার জীবনের নতুন অধ্যায়।

বেশ!

বেশ নয়—একটি মুহূর্তও আর নষ্ট করবার মত হাতে নেই বন্ধু! জীবনের অনেকটা সময় চলে গিয়েছে অতএব আর অপেক্ষা নয়—বাড়ি তৈরী করবার ধৈর্য বা সময় আমার নেই। ৬০।৭০ হাজারের মধ্যে একটা বাড়ি ক্রয় করতে চাই আমি—আর a nice-looking carFord fluid-drive, ওলডমবিল বা স্টুডিবেকার—নিদেনপক্ষে হাম্বার বা রোভার-১২।

বেশ নয়—একটি মুহূর্তও আর নষ্ট করবার মত সময় হাতে নেই বন্ধু। জীবনের অনেকটা সময় একটা গাড়ি!

তারপর একটু থেমে বলে, দাঁড়াও, পার্ক সার্কাস অঞ্চলে একটা চমৎকার নব্যকেতার বাড়ি আমার এক ক্লায়েন্টের ডিসপোজালেই আছে, বাড়িটা ভালই—দোতলা, উপরে নীচে খান আষ্টেক ঘর, সামনে লন, পের্টিকো, পিছনেও ছোটখাটো একটা বাগান, গ্যারাজ, গেটের পাশে দারোয়ানদের থাকবার ঘর।

চমৎকার! দাম?

সেলামী নিয়ে বোধহয় হাজার ষাটেক পড়বে—মানে যার বাড়ি তিনি একটু বেকায়দায় পড়েই বাড়িটা বিক্রী করে দিতে চান, নইলে ও বাড়ি ধরে রাখলে হাজার আশি পর্যন্ত—

ডোন্ট ওরি, এখুনি ফোন কর কিন্তু ঐ সেলামীর কথা কি বলছিলে?

থাকতে মগের দেশে, অধুনা কলকাতার সংবাদ তো রাখ না! বাড়ির problem বর্তমানে এ শহরে যা হয়েছে! ঐ সেলামী হচ্ছে বাড়ি ভাড়া ও ক্রয়ের প্রথম সোপান। তা সেলামীও বলতে পার—আক্কেল সেলামীও বলতে পার কারণ প্রয়োজনটা যখন ক্রেতা বা ভাড়াপ্রার্থীর–

ঠিক আছে, ফোন কর।

বাড়ি দেখে নরেনের পছন্দ হয়ে গেল। সত্যি চমৎকার বাড়িটা। পরের দিনই বায়না করা হলো। এবং নির্দিষ্ট দিনে নতুন বাড়ি ও ফ্লুইড় ড্রাইভ একটা ফোর্ড গাড়ি কিনে নরেন মল্লিক গৃহপ্রবেশ করল। বাড়ির ফটকে নেমপ্লেট বসলো : শ্রীনরেন মল্লিক।

গেটের দারোয়ান বহাল হলো, খোট্টাই রামখেল সিং। আরো দুজন চাকর এলো, হরি আর যদু, পনের বছরের পুরাতন ভৃত্য মধু তো রইলই। ড্রাইভার নন্দুয়া এলো, পাচক উৎকলবাসী শ্রীমান জগন্নাথ। দামী দামী সাজসজ্জায় বাড়িঘরদোর ভরে উঠলো।

নিরহঙ্কার, সদালাপী স্বভাবের দরুন শীঘ্রই পাড়ায়, অভিজাত মহলে নরেন মল্লিকের নামটা এ-কান ও-কান হতে হতে দশ কানে ছড়িয়ে গেল। লম্বাচওড়া সুশ্রী চেহারা এখনো বিবাহাদি করে নি। বয়স যদিচ পঞ্চাশের কোঠায় চলেছে, এখনো অটুট স্বাস্থ্য ও যৌবনের প্রাচুর্যে ঢল ঢল, তার উপরে কাল্পনিক ব্যাঙ্ক-ব্যালান্সের গুজব, বাড়ি, গাড়ি এবং সর্বোপরি মিষ্টি সদালাপী অমায়িক ব্যবহার।

কলকাতার আধুনিক অভিজাত মহলে শীঘ্রই মুখে মুখে নরেন মল্লিক প্রসিদ্ধ হয়ে গেল। জাগিয়ে তুললো একটা রীতিমত সাড়া। অনেক অবিবাহিতা মেয়েদের মায়েরা নরেন মল্লিকের গৃহে প্রায়ই আনাগোনা করতে শুরু করলেন। আর এক শ্রেণীর মেয়ের মায়েরা আছেন, যাঁরা অল্পবয়সী ছেলে—জীবনে এখনো সুপ্রতিষ্ঠিত নয়, সেই সব পাত্রের চাইতে মধ্যবয়সী প্রতিষ্ঠিত ও অর্থবান পাত্রদের ঢের বেশী পছন্দ করেন, তাঁরাও অনেকে সেজেগুজে মেয়েদের নিয়ে নিয়মিত হাজিরা দিতে শুরু করলেন মল্লিক পারলারে।

আজ পার্টি, কাল উৎসব—একটা না একটা লেগেই থাকত নরেন মল্লিকের গৃহে; মোট কথা নরেন মল্লিক যা চেয়েছিল তা দিনেই হাতের মুঠোয় এসে গেল। ঐ সঙ্গে এলো প্রতিষ্ঠা।

আত্মীয়স্বজন বলতে গৃহে নরেন মল্লিকের এক ভাগ্নে, নাম সুবিমল এবং বয়স তার ৩০৩২য়ের মধ্যে। সুবিমলও বিবাহাদি করে নি, বি. এ. পাস। ইনসিওরেন্সের মাহিনা করা দালাল। দেখতে সুশ্রী না হলেও মোটামুটি শরীরে একটা আলগা শ্ৰী আছে। বলিষ্ঠ দোহারা দেহের গঠন, বেশ একটু সৌখীন প্রকৃতির।

সুবিমল ছাড়া বাড়িতে পুরাতন বৃদ্ধ ভৃত্য মধু; হরি ও যদু দুটি ভৃত্য, ঠাকুর জগন্নাথ, দারোয়ান রামভজন সিং ও রামখেল সিং, ড্রাইভার নন্দুয়া এবং বিনতা। আর বাড়িতে ঐ বিনতাই ছিল একমাত্র স্ত্রীলোক। বিনতা ভদ্রঘরের ব্রাহ্মণের বিধবা, মধ্যবয়সী। প্রকৃতপক্ষে নারীহীন সংসার নরেন মল্লিকের বিনতাই সব দেখাশুনা করতো। এবং ভদ্রমহিলা সব দেখাশুনা করলেও কখনও নরেনের সামনে বড় একটা বের হতো না। আর সর্বদাই মুখের ওপর টানা থাকত একটি দীর্ঘ অবগুণ্ঠন।

নিরবচ্ছিন্ন আনন্দের মধ্যে দিয়েই দিন কেটে যাচ্ছিল নরেন মল্লিকের। কোন একটি নবলব্ধ বান্ধবীর জন্মতিথি উৎসব অত্যাসন্ন—সুন্দরী, তরুণী বান্ধবী, একটা ভাল রকম প্রেজেন্টেশন দিতে হবে।

সন্ধ্যার কিছু পরে নরেন মল্লিক হীরালাল শেঠের প্রকাণ্ড জুয়েলারীর দোকানের সামনে এসে গাড়ি থেকে নামল।

আধুনিক ডিজাইন ও প্যাটার্ণের স্বর্ণালঙ্কার বিক্রেতা হিসাবে হীরালাল শেঠের দোকানে অভিজাত মহলের সুন্দরীদের যাতায়াতটা খুব বেশী। উজ্জ্বল আলোয় শো কেসের জড়োয়ার গহনাগুলো বর্ণদ্যুতি বিকিরণ করছে।

নরেন মল্লিক দোকানের মধ্যে এসে প্রবেশ করল। দোকানের ম্যানেজার যমুনাদাস শেঠ নরেন মল্লিকের পরিচিত। শাঁসালো খরিদ্দার হিসাবে মল্লিক এ দোকানে বহুবার পদার্পণ করেছে ইতিপূর্বে, সেই কারণেই ম্যানেজার শেঠজী তাকে যথেষ্ট খাতিরও করেন।

আইয়ে আইয়ে মল্লিক সাব!

যমুনাদাস নরেন মল্লিককে দোকানে প্রবেশ করতে দেখেই সাদর আহ্বান জানায়।

মল্লিক ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি নিয়ে এগিয়ে আসে, নমস্তে যমুনাদাসজী। তবিয়ৎ আচ্ছা তো?

আপকি মেহেরবানি। ফরমাইয়ে সাব কেয়া দেখাউঁ—

আসলি মুক্তাকা কৌই হার হ্যায় তো জেরা মেহেরবানি করকে দেখাইয়ে শেঠজী—

আসলি মুক্তা! চলিয়ে সাব উধার, ও কাউন্টারকে পাশ–

দোকানের পশ্চিম কোণে একটু নিরিবিলি কাউন্টারের ছোট একটি অংশ, স্বল্প আলোআঁধারিতে ঘেরা। একপাশে স্ট্যাণ্ডের উপরে সবুজ ডোমে ঢাকা উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলছে—আলোর নিচে আট-দশটা মুক্তার হার বের করে এনে ছড়িয়ে দিল যমুনাদাস, মল্লিকের সামনে।

 লিজিয়ে মল্লিক সাব! সব আসলি মুক্তা!

নরেন মল্লিক হারগুলি পরীক্ষা করতে থাকে আলোয়।

হঠাৎ সামান্য দূরে কাউন্টারের অপর পার্শ্ব হতে একটা ঈষৎ চাপা ভারী গলা শোনা যায়, কোই দামী নেকলেস দেখাইয়ে সাব। হীরাকা নেকলেস। বহুৎ আচ্ছা হীরা হোনা চাইয়ে—

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতই যেন চম্‌কে ফিরে তাকায় ঐকণ্ঠস্বরে নরেন মল্লিক। হাতপাঁচেক ব্যবধান মাত্র। লম্বাচওড়া দীর্ঘকায় এক পাঠান। পরিধানে দামী নেভী-রু সার্জের স্যুট, মাথায় কালো ফেজ। মুখের একাংশ মাত্র দেখা যাচ্ছে। উজ্জ্বল আলোর খানিকটা তির্যক ভাবে মুখের দক্ষিণ অংশে এসে পড়েছে।

দীর্ঘ একটা ক্ষতচিহ্ন দক্ষিণ অক্ষিকোণ হতে গালের অর্ধাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত।

নরেন মল্লিক তাড়াতাড়ি মুক্তার হারগুলো এক পাশে ঠেলে দিয়ে বলে ওঠে, ফির দোসরা কোই টাইমমে কাল আয়েঙ্গে শেঠজী। আচ্ছা নমস্তে।কতকটা যেন হন্তদন্ত হয়েই নরেন মল্লিক দোকান থেকে বের হয়ে আসে।

হঠাৎ পাঠান এমন সময় বলে ওঠে, এ কেয়া হীরা হায়! হীরা—ম্যায় আসলি হীরা চাহাতে হুঁ!

নরেন মল্লিক গাড়ির দরজা খুলে ঝুপ করে গাড়ির পিছনের গদীতে বসে পড়েই বলে, নন্দুয়া, বাড়ি!

সে রাত্রে নরেন মল্লিকের ভাল ঘুম হয় না। তার মনে হয় দীর্ঘকায় একটা ছায়ামূর্তি যেন তার শয্যার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখে একটা কালো মুখোশ। ভীতিবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নরেন মল্লিক। মুখখাশের দুটি গোলাকার ছিদ্রপথে, দুটি চক্ষু তো নয় যেন দুটি অগ্নিগোলক জ্বলজ্বল করছে। ধীরে ধীরে মুখোশধারী এগিয়ে আসছে শয্যার দিকে, পায়ে পায়ে নিঃশব্দে। এসে দাঁড়াল একেবারে শয্যার গা ঘেঁষে।

তারপর একটু একটু করে মুখখাশটা যেন উন্মোচন করে ছায়ামূর্তি।

কে! কে! ঘুমের ঘোরেই চিৎকার করে ওঠে নরেন মল্লিক। ঘুম ভেঙে যায় নরেন মল্লিকের। অন্ধকার ঘরে সামান্য একটুখানি চাঁদের আলো খোলা জানালাপথে এসে কক্ষমধ্যে লুটিয়ে পড়েছে। সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে গিয়েছে। হাত বাড়িয়ে আলোটা জ্বালিয়ে দেয় নরেন মল্লিক বেড় সুইটা টিপে। শূন্য ঘর। বাকী রাতটুকু চোখের পাতায় আর ঘুম আসে না।

আবার একদিন রাত্রি প্রায় সাড়ে এগারটায় গাড়িতে করে বেড়িয়ে ফিরছে নরেন মল্লিক, গাড়ি গেটের মধ্য দিয়ে ঢুকছে, হঠাৎ নরেনের দৃষ্টি যেন স্থির হয়ে যায়। রাস্তার গ্যাসপোস্টের আলো গেটের ওধারে এসে পড়ছে—সেই অস্পষ্ট আলোয় দেখে দীর্ঘ এক ছায়ামূর্তি, পরিধানে কালো স্যুট, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক গেটেরই কাছে।

মূর্তিটা যেন একটু নত হয়ে কুর্নিশ জানাবার ভঙ্গী করে এবং পরক্ষণেই একপাশে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।

প্রায়ই এর পর থেকে ছায়ামূর্তি চোখে পড়তে লাগল নরেন মল্লিকের। কখনো পাশ দিয়ে হেঁটে যায়, কখনো গাড়িতে করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কখনো দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। কখনো ছায়ার মত দীর্ঘ পা ফেলে ফেলে হেঁটে অথবা গাড়িতে চড়ে অনুসরণ করে।

একদিন গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে শয়নকক্ষের খোলা জানালার সামনে এসে দাঁড়াতেই নজরে পড়লো–বাড়ির অল্পদূরে গ্যাসপোস্টটার নিচে দাঁড়িয়ে সেই দীর্ঘ ছায়ামূর্তি–মুখ তুলে অপলকে যেন তারই ঘরের দিকে তাকিয়ে আছে।

শুধু নরেন মল্লিকেরই না, ড্রাইভার নন্দুয়ার দৃষ্টিতেও পড়ে। সেও দেখে কালো রংয়ের। একটা সেলুনগাড়ি যেন প্রায়ই নিঃশব্দে ওদের গাড়িকে অনুসরণ করছে। কখনো অনুসরণ করে একটা চকিত প্রহেলিকার মত, কখনো সোঁ করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কখনো বা শোনা যায় একটা অস্পষ্ট শব্দ।

নন্দুয়া অবশেষে একদিন বলে, একটা কথা বলবো বাবু—

কি নন্দুয়া?

মাঝে মাঝে কিছুদিন থেকে মনে হচ্ছে যেন একটা কালো রংয়ের গাড়ি আমাদের গাড়ির পিছু আসছে—

হেসে ওঠে নরেন মল্লিক, যাঃ! কে আবার follow করবে? ও তোর দেখবার ভুল নন্দুয়া

না বাবু—

যা যা–ওসব কিছু না।

উড়িয়ে দিতে চাইলেও একটা বোবা আশঙ্কা নরেনের মনকে যেন আচ্ছন্ন করে রাখে সর্বদা। ক্লেদাক্ত একটা অক্টোপাশের অষ্টবাহু যেন নরেনের সর্বাঙ্গ বেষ্টন করতে চাইছে। শয়নে, স্বপনে, জাগরণে একটা অনিশ্চিত আশঙ্কা, বিশ্রী একটা দুঃস্বপ্নের মতই ওকে যেন। তাড়া করে ফেরে সর্বদা। অবাধ হাসি ও আনন্দের মধ্যে ঐ দুঃস্বপ্ন যেন নরেন মল্লিককে চঞ্চল, আনমনা করে তোলে। চোখেমুখে একটা দুশ্চিন্তার কালো রেখা যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বন্ধু সমীরের দৃষ্টিকেও এড়াতে পারে না নরেন মল্লিক। কথা বলতে বলতে হঠাৎ কেমন চমকে চমকে ওঠে। ভীত, শঙ্কিত দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকায়।

সমীর একদিন প্রশ্ন করে, ব্যাপার কি বল্ তো নরেন? আজকাল কিছুদিন হতে তোকে যেন কেমন চঞ্চল অন্যমনস্ক মনে হয়! হঠাৎ কেমন চম্‌কে চমকে উঠিস, কি ব্যাপার বল্ তো?

না না–ও কিছু নয়।

উঁহু, আমার কাছে গোপন করছিস তুই! Keeping some secret-no no my dear friend—আমার চোখে তুই ধুলো দিতে পারবি না। Be frank!

এবারেও কিন্তু নরেন মল্লিক চুপ করেই থাকে।

আমার কাছেও গোপন করবি নরেন?

আজ নয় সমীর, অন্য এক সময় বলবো-অন্য এক সময় বলবো। বলতে বলতে হঠাৎ যেন নরেন মল্লিক কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল।

নরেন?

Its a long story সমীর! তারপর একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ আবার মৃদু চাপাকণ্ঠে বলে, রাজার ঐশ্বর্য! বহু রাজার রত্নভাণ্ডারেও নেই! বলতে বলতে আবার চুপ করে গেল। নরেন মল্লিক।

সমীর বুঝতে পারে। একটা রহস্য যা নরেন গোপন করতে চাইছে, কিন্তু কি এ রহস্য! নরেন বলে, তোকে বলবো সমীর, হ্যাঁ, একদিন তোকে সব বলবো। সাজাহানের ময়ূরসিংহাসন আলো করেছিল। এক হাত থেকে আর এক হাত-হস্তান্তর হতে হতে বাকীটুকু আর শেষ করলে না নরেন মল্লিক। সমীরের বাড়িতেই রাত্রে তারই ওখানে আহারাদির পর দুটো সোফার ওপরে মুখোমুখি বসে গল্প করছিল দুই বন্ধুতে।

আচমকা হঠাৎ একসময় সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল নরেন মল্লিক। ওয়ালক্লকটায় ঢং ঢং করে রাত্রি এগারটা ঘোষণা করলে।

উঃ, রাত অনেক হলো, চলি ভাই! Good Night।

.

এর দুদিন পর নরেন মল্লিকের বাড়িতে রাত্রে চোরের উপদ্রব হলো। আশ্চর্য, চোরের উপদ্রব হলো বটে কিন্তু কোন জিনিসই চুরি যায় নি শেষ পর্যন্ত দেখা গেল। নরেন ওই ডিস্ট্রিকটের পুলিস কমিশনার মিঃ চট্টরাজকে চোরের উপদ্রবের কথা সব বললে। চট্টরাজ নরেনের বন্ধু। দিবারাত্রির জন্য নরেনের গৃহে পুলিস প্রহরী মোতায়েন হলো। এবং আশ্চর্য, সঙ্গে সঙ্গে ছায়ামূর্তিও যেন মিলিয়ে গেল ছায়ার মতই।

তারপর দুমাস নির্বিঘ্নে কেটে গেল। আর কোন উৎপাত নেই—নরেনও ভুলে গেল বোধ হয় সব কথা। পুলিস প্রহরী উঠিয়ে নেওয়া হলো।

ঐ সময় সমীর স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ায় মাস তিনেকের জন্য কলকাতার বাইরে যায়। নরেনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হবার সুযোগও হয় নি। যেদিন সমীর কলকাতায় ফিরে এলো তারই দিনতিনেক বাদে-নরেনের জন্মতিথি উৎসবে এলো সমীর নরেনের বাড়িতে। নরেনের আগের স্ফুর্তি যেন আবার ফিরে এসেছে, নরেন যেন অত্যন্ত খুশী!

সেই রাত্রেই অদৃশ্য আততায়ীর হাতে নৃশংসভাবে ছুরিকাঘাতে নিহত হলো নরেন মল্লিক।

চলন্ত গাড়ির মধ্যে রহমানের পার্শ্বে উপবিষ্ট কিরীটী মুখের পাইপটা হাতে নিয়ে একসময় প্রশ্ন করলে, নরেন মল্লিকের তাহলে একটা পূর্ব-ইতিহাস আছে বলুন-and quite interesting too! তারপর হঠাৎ আবার দ্বিতীয় প্রশ্ন করে, বাড়ির সমস্ত লোকেদের জবানবন্দীই তো নেওয়া হয়েছে, না মিঃ রহমান?

হ্যাঁ। এই যে দেখুন না, জবানবন্দীর ফাইলটা এই তো আমার সঙ্গেই আছে।

দেখি? হাত বাড়িয়ে কিরীটী রহমানের হাত থেকে জবানবন্দীর ফাইলটা নিল।

.

জবানবন্দী নেওয়া হচ্ছিল সেই দিন প্রাতে নরেন মল্লিকের শয়নকক্ষেই বসে। পার্ক সার্কাস থানা ইনচার্জ খোদাবক্স এক একজন করে ঘরের মধ্যে ডেকে এনে জবানবন্দী নিচ্ছেন। টেবিলের ওপরে ফাইলটা খোলা, হাতে পেনসিল, থানা ইনচার্জ খোদাবক্স জবানবন্দী লিখে নিচ্ছেন একের পর একের।

সামনে দাঁড়িয়ে নরেন মল্লিকের পুরাতন ভৃত্য মধু ঘোষ। মধুর জবানবন্দীই প্রথমে নেওয়া হয়, কারণ সে-ই ঘরের মধ্যে ঢুকে সর্বপ্রথম এ বাড়িতে মৃতদেহটা দেখতে পায়।

মধু ঘোষ : বেঁটেখাটো লোকটি, দড়ির মত পাকানো দেহের পেশীগুলো অত্যন্ত সজাগ।

মাথার চুলে ইতিমধ্যেই পাক ধরেছে। পরিষ্কার একটা ধুতি ও হাতকাটা একটা পিরান গায়ে। চোখ দুটো ছোট ছোট বর্তুলাকার। এক জোড়া ভারী গোঁফ। সামনের দুটো দাঁত বেশ উঁচু—নিচে ঠোঁটের ওপরে চেপে বসেছে।

তোমার নাম মধু ঘোষ?

আজ্ঞে।

কোথায় বাড়ি?

কাটোয়াতে।

জাত?

গোয়ালা, বাবু!

কতদিন এ বাড়িতে আছো?

আজ্ঞে বাবুর কাছে আজ প্রায় আট বছর আমি কাজ করছি।

আট বছর! তাহলে তো খুব পুরাতন লোক হে তুমি!

আজ্ঞে—

তাহলে বাবুর সঙ্গে তুমি বর্মাতেও ছিলে?

হাঁ। আট বছর আগে বাবু একবার এক মাসের জন্যে কলকাতায় আসেন। বাবুর যে উকীল বন্ধু সমীরবাবু তারই বাড়িতে আমার কাকা কাজ করতো। আমি তখন কাজের খোঁজে নতুন শহরে এসেছি, কাকার কাছেই আছি; বাবুর একজন দেশী লোকের প্রয়োজন হওয়ায়, উকিল বাবুই কাকাকে বলে আমাকে বাবুর কাজে বহাল করে দেন। আমার বয়স তখন বছর পঁচিশেক, সেই হতে এ পর্যন্ত বাবুর কাছেই আছি!

বেশ। আচ্ছা মধু, গতকাল রাত্রে বাবুর সঙ্গে শেষ তোমার কখন দেখা হয়েছিল?

আজ্ঞে রাত সাড়ে দশটায়। দশটা নাগাদ রাতে বাবু বেড়িয়ে ফিরে আসেন। এসে বললেন আমায় ডেকে, ক্ষিধে নেই, কিছুই খাবেন না রাত্রে, কেবল এক কাপ দুধ খাবেন। আমি বিনতা দিদিকে তাই আর তুললাম না ডেকে। দুপুর থেকেই তিনি জ্বর হয়েছিল বলে শুয়ে ছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, বাবুর খাবার সময় হলে তাকে ডাকতে কিন্তু বাবু রাত্রে খাবেন না জেনে আর তাকে তুলি নি। অনেক দিন থেকেই রোজ রাত্রে ঘুমোবার আগে বাবুর এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল খাওয়ার অভ্যাস ছিল। দুধ খাইয়ে রাত সাড়ে দশটায় ঘরে জলের গ্লাসটা রেখে যাই।

জলের গ্লাসটা রেখে যাবার সময় বাবু কি করছিলেন তোমার মনে আছে মধু?

হ্যাঁ, ঐ ডেক-চেয়ারটার ওপরে বসে একটা বই পড়ছিলেন। আমায় বললেন, যাবার সময় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যেতে। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে আমি নিচে চলে এলাম।

তারপর?

তারপর বিকালের দিকে কাল বাবুর জন্মতিথি উৎসবের জন্য বিশেষ খাটাখাটনি হওয়ায় সোজা নিজের ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়ি। রোজ খুব ভোরে আবার বাবু এক গ্লাস গরম জল নুন দিয়ে খেতেন। গ্লাসে করে গরম নুনজল নিয়ে আজ সকালে ঘরে এসে ঢুকলাম, তখনও কিছুই জানি না–

একটা কথা মধু, তোমার বাবুর শোবার ঘরের দরজাটা কি বরাবর খোলাই থাকত?

আজ্ঞে হাঁ। খুব ভোরে গরম নুনজল গ্লাসে করে এনে আমিই তার ঘুম ভাঙ্গাতাম। এটা বাবুর ২১/২২ বছরের অভ্যাস। চাকরিতে ঢোকার পর আমিই ঐ কাজটা করতাম।

হাঁ–বল তারপর?

ঘরে ঢুকে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলাম বাবু ঐভাবে মেঝের ওপরে–বলতে বলতে মধু থেমে গেল। সকলের দৃষ্টি মধুর কথা অনুসরণ করে যুগপৎ গিয়ে মেঝেতে কার্পেটের ওপরে যেখানে নরেন মল্লিকের অসাড় প্রাণহীন, ছোরাবিদ্ধ দেহটা পড়ে ছিল, সেই দিকে গিয়ে স্থিরনিবদ্ধ হলো।

দামী কার্পেটের ওপরে ঠিক ডেক-চেয়ারটার সামনেই চিৎ হয়ে পড়ে আছে নরেন মল্লিকের প্রাণহীন দেহটা তখনও।

বামদিককার বক্ষে প্রায় আমূল বিদ্ধ হয়ে আছে সুদৃশ্য কারুকার্যখচিত বাঁটওয়ালা একটা ছোরা। চোখ দুটো যেন ঠেলে বের হয়ে আসতে চায়। অসহায় একটা ভীতি যেন চোখের মণি দুটোয় তখনও স্পষ্ট হয়ে আছে।

ঐভাবে বাবু পড়ে আছেন–রুদ্ধ কান্নাঝরা সুরে কথা কটি যেন কোনমতে শেষ করার জন্যই উচ্চারণ করে মধু। প্রভুর আকস্মিক নিষ্ঠুর মৃত্যুতে মধু যে মনে বিশেষ আঘাত পেয়েছে বুঝতে কারও কষ্ট হয় না।

এতক্ষণে যেন সত্যসত্যই শোকের একটা বিষণ্ণতা নরেন মল্লিকের হত্যাকে কেন্দ্র করে কক্ষের মধ্যে নেমে এলো। থানা-ইনচার্জ খোদাবক্সও ক্ষণেকের জন্য তাঁর লেখা থামিয়ে মৃতের মুখের দিকে চেয়ে থাকেন।

প্রসারিত দেহটা। ডান ও বাম হাতের মুষ্টি দুটো বদ্ধ। মাথাটা এক পাশে ঈষৎ হেলে পড়েছে।

মধুর দুচোখের কোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।

খোদাবক্স আবার তার পেনসিলটা তুলে নিয়ে সম্মুখে টেবিলের ওপরে রক্ষিত খাতার উপরে খস্ খস্ করে লিখে চলেন –

মধু ভয়ে চিৎকার করতে করতে হাউমাউ করে নিচে এসে যদু ও হরিকে সব বলে। সুবিমল তখনও নাকি নিজের কক্ষে ঘুমাচ্ছিল, গিয়ে ডাকাডাকি করে তাকে তোলে। সুবিমলের চোখ থেকে তখনও ঘুমের ঘোর ভাল করে কাটে নি, হতভম্বের মত চেয়ে থাকে ওদের মুখের দিকে কিছুক্ষণ। শেষ পর্যন্ত সুবিমলই ফোন করে পার্ক সার্কাস থানায় সংবাদ পাঠায়।

রবিবার সন্ধ্যায় নরেন মল্লিকের বাড়িতে তার জন্মতিথিকে কেন্দ্র করে যে উৎসবের আয়োজন হয়েছিল অনেকেই তাতে নাকি যোগ দিয়েছিল। উৎসব শুরু হয় বিকাল পাঁচটায় এবং শেষ হয় রাত্রি আটটায়। রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটার সময় নরেন মল্লিক গাড়ি নিয়ে বেড়াতে যান। এবং ফিরে আসেন রাত্রি প্রায় দশটায়। ক্ষিদে না থাকায় রাত্রে বিশেষ কিছু খাওয়াদাওয়া করেন নি, কেবল এক গ্লাস গরম দুধ পান করেছিলেন মাত্র।

পরের দিন প্রাতে তাকে বুকে ছোরাবিদ্ধ অবস্থায় মৃত দেখতে পাওয়া গেল শয়নকক্ষের মেঝের উপরে লম্বমান। এবং আশ্চর্য, ছোরাটা নাকি নরেন মল্লিকের নিজেরই ছোরা!

তাঁরই শয়নকক্ষে বুক-শেলয়ের উপরে একটা সুদৃশ্য জয়পুরী পিতলের প্লেটে ছোরাটা থাকত এবং অনেকেই সে কথা জানত। ছোরাটা তাকে উপহার দিয়েছিল তারই এক বন্ধু, মহীশূরে বেড়াতে গিয়ে কিনে এনে তারই কোন এক জন্মতিথি উৎসব উপলক্ষে।

মধু ঘোষ, গোয়ালার ছেলে, বাড়ি কাটোয়ায়। বছর আষ্টেক হবে নরেন মল্লিকের সঙ্গে আছে। নরেনের বেশীর ভাগ কাজ ও-ই করত। নরেনের জামা কাপড় ইত্যাদির ভারও মধুর উপরেই ছিল। নরেন ওকে অত্যন্ত ভালবাসতেন : লিখে চলেন খোদাবক্স।

মধু তার জবানবন্দীতে আরো বলে :

ইদানীং একটি মেয়ে বাবুর সঙ্গে একটু যেন বেশী ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। বয়স তার বছর ২৪/২৫ হবে। দেখতে খুব সুন্দরী না, তার বাড়ির ঠিকানা আমি জানি না, ড্রাইভার নন্দুয়া হয়ত জানে। দেখলে হ্যাঁ, তাকে দেখলে নিশ্চয়ই আমি চিনতে পারবো, অনেক দিন তো তাকে। দেখেছি। আজ্ঞে মেয়েটি খুব ভাল বলেই তো মনে হয়। বাবুর ভাগ্নে ঐ সুবিমলবাবুকে বাবু খুব ভালবাসতেন। সুবিমলবাবুও তার মামাবাবুকে খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করতেন। না, মামা-ভাগ্নের মধ্যে কোন মন-কষাকষি বা রাগারাগিই ছিল না। কাল সুবিমলবাবু অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরেছেন, নিচের দালানের দরজা রাত্রে আমিই তাকে খুলে দিয়েছিলাম। না, বাবুর শত্রু থাকলেও সে খবর আমি রাখি না বাবু। অমন লোকের কোন শত্রু থাকতে পারে বিশ্বাস করি না। না, কাউকেই আমার সন্দেহ হয় না। না, কোন শব্দ বা চিৎকার আমি শুনি নি গতরাত্রে।

যদুনাথ পোল : আজ্ঞে–জাতিতে আমি সদ্‌গোপ। বাড়ি পাবনা জেলায়। মাস ছয়েক হলো বাবুর এখানে কাজে বহাল হয়েছি। সেদিন উৎসব শেষে সকলে চলে গেলে কিছুক্ষণ পরেই জামা কাপড় বদলিয়ে বাবু গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলেন। রাত্রি দশটায় আবার ফিরে আসেন। আজ্ঞে না, কোন শব্দই ঐ রাত্রে আমি শুনতে পাই নি। খাটাখাটনিতে বড্ড পরিশ্রান্ত ছিলাম, শুতে শুতেই ঘুমিয়ে পড়েছি। পরের দিন মধুদার ডাকেই ঘুম ভেঙ্গে সব শুনতে পাই।

হরি সাধুঃ আমি বাবু জাতিতে তিলি, বাড়ি বগুড়া জেলায়। মাস তিনেক হলো বাবুর এখানে কাজ করছি। বাবু বেশ ঠাণ্ডামেজাজী লোক ছিলেন, কখনো কাউকেই গালমন্দ করতেন না। সন্ধ্যার ঝামেলা মিটে গেলে বাবুর কাছ থেকে ছুটি নিয়ে, আমার এক খুড়ো থাকে পার্ক সার্কাস বাজারের ওপরে, তার পানবিড়ির দোকান, তারই সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসেছি রাত যখন সাড়ে বারোটা হবে, দারোয়ানের ঘরের ঘড়িতেই সময় দেখেছি। আমার স্পষ্ট মনে আছে বাবুর শোবার ঘরের আলো তখনও জ্বলছিল। আজ্ঞে না, কোন চিৎকার বা শব্দ কিছুই শুনতে পাই নি। সকালে মধুদার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গে, তার মুখেই প্রথমে শুনলাম বাবু খুন হয়েছেন।

রামখেল সিং : বাড়ি ছাপড়া জিলায়, এ বাড়িতে শুরু থেকেই আমি দারোয়ানের কাজ করছি। আজ্ঞে হ্যাঁ, রাত্রি সাড়ে দশটার পরই সাধারণত গেট বন্ধ করে দিই। রাত যখন সাড়ে এগারোটা, নন্দুয়া এসে বিড়ি চাওয়ায় তাকে বিড়ি দিই, ঐ সময়ই বাবুর ঘরের আলো নিবে যেতে দেখি। আজ্ঞে হ্যাঁ, ঘরে আমার একটা ঘড়ি আছে, বাবুই কিনে দিয়েছিলেন। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, রাত সাড়ে বারোটায় হরি ফিরে এলে আবার তাকে গেট খুলে দিই, আবার রাত সোয়া একটায় সুবিমলবাবুও ফিরে এলে গেট খুলে দিয়েছিলাম। না, শেষের দুবারের একবারও তখন বাবুর ঘরের আলো জ্বলছিল কিনা লক্ষ্য করি নি, তবে যতদূর মনে পড়ে জ্বলছিল না।

রামভজন সিং ও সন্ধ্যার পরই ছুটি নিয়ে টালায় তার এক দেশওয়ালী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যায়, ফিরেছে আজ সকাল বেলা সাড়ে নটায়। এখানে মাস পাঁচেক মাত্র চাকরি করছে।

ঠাকুর জগন্নাথ : বাড়ি উড়িষ্যায়। রান্নাঘরের পাশেই ছোট একটা ঘরে আমি শুই। উৎসবের ঝামেলা মিটে গেলে এবং বাবু রাত্রে কিছু আর খাবেন না শুনে শুয়ে পড়ি, বড্ড মাথা ধরেছিল বলে, কিছু জানি না, কোন চিৎকার বা শব্দও শুনি নি। পরদিন মধুদার ডাকে ঘুম ভাঙ্গে এবং তার মুখেই প্রথমে শুনি বাবু খুন হয়েছেন।

নন্দুয়া : বাড়ি মজঃফরপুর। মাস আষ্টেক হবে বাবুর গাড়ির ড্রাইভারি করছি আমি। বাবু বেশীর ভাগই দেশপ্রিয় পার্কে বা লেকেই সন্ধ্যার দিকে বেড়াতে যেতেন। ইদানীং মাস কয়েক আমীর আলী য়্যাভিনুতে ছোট একটা পার্কেও মাঝে মাঝে সন্ধ্যার দিকে গিয়ে তিনি বসতেন। সেখানে একটি খুব সুন্দরী মেয়ে, বয়স ২৫/২৬ হবে, বাবুর সঙ্গে বসে গল্প করতো দেখেছি, মাঝে মাঝে সেই দিদিমণিকে নিয়ে বাবু লেকে, বোটানিক্যাল গার্ডেনে হগ মার্কেটে এবং মাঝে মাঝে রাত্রের শোতে সিনেমাতেও যেতেন। গতকাল রাত্রে দেশপ্রিয় পার্কে যান—ফিরে আসবার সময় সেই দিদিমণিকে পার্কের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখেছি। বাবুকে তারপর সোজা একাই গাড়িতে করে বাড়ি নিয়ে আসি। না, দেখিনি দিদিমণি কোন্ দিকে গেলেন। হ্যাঁ, দিদিমণির বাড়ি চিনি। দু-একবার তাকে চিঠিও দিয়ে এসেছি। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তাকে দেখলেই চিনতে পারবো। হ্যাঁ, রাত সাড়ে এগারোটায় বিড়ি ফুরিয়ে যেতে দারোয়ানের কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে এনেছিলাম। হ্যাঁ, আমিও দেখেছি ঐসময় বাবুর ঘরের আলো নিবে যায়। না, রাত্রে কোন চিৎকার বা শব্দ শুনি নি। না, কোন রকম সন্দেহজনক কিছু দেখি নি, তবে আগে, মানে মাসখানেক আগে পর্যন্তও প্রায়ই দেখতাম একটা কালো রংয়ের সিডনবডি গাড়ি যেন আমাদের গাড়ির পিছু পিছু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে গেটের সামনে এগিয়ে যেতে দেখেই গাড়িটা ছেড়ে চলে যায়। না, গাড়ির নম্বরটা কখনো দেখতে পাই নি। হ্যাঁ, বাবুকে বলেছিলাম—বাবু বলেছিলেন, ও কিছু না। কে আবার আমাদের গাড়িকে follow করবে?

সুবিমল রানা : গত রাত্রে প্রায় সোয়া একটার সময় বাড়ি ফিরেছি। দারোয়ান গেট খুলে দিয়েছিল, মধু ভিতরের দরজা খুলে দেয়। হ্যাঁ, লক্ষ্য করেছি মামাবাবুর ঘরের আলো তখনও জ্বলছিল, আমার বেশ স্পষ্টই মনে আছে। গতকাল সকাল নটায় অফিসের জরুরী কাজে ডায়মণ্ডহারবার যখন যাচ্ছি, মামার সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ হয়। না, মামার হাবভাবে বা কথাবার্তায় এমন কিছুই বুঝিনি যাতে করে কোন বিপদ আসছে বলে সন্দেহ মনে জাগতে পারে। না, তাঁর বন্ধু-বান্ধবীদের সম্পর্কে আমি কিছুই তেমন জানি না। মাস আষ্টেক হবে মামার একান্ত অনুরোধেই এখানে এসে আছি। আমার সংসারে আপনার বলতে একমাত্র বিধবা মা, এখনো তিনি বেঁচে আছেন, কুড়িগ্রামে দেশের বাড়িতেই আছেন। মা ও মামাবাবু বৈমাত্রেয় ভাই বোন। না, মামার কোন উইল আছে কিনা সে সম্পর্কে কিছুই আমি জানি না। না, আজ পর্যন্ত উইল সম্পর্কে কোন কৌতূহলও আমার মনে দেখা দেয়নি। ভারত বন্ধু বীমা কোম্পানীতে বছর দুই হলো চাকরি করছি। ফিক্সড তিনশত টাকা মাইনেতে আমি সেখানে এজেন্সী করি। আজ্ঞে না, বিবাহ করিনি, কারণ তেমন যে বিশেষ কিছু আছে তা নয়। প্রথম। কথা, যোগাযোগ তেমন কিছু ঘটেনি, আর আমার মতে আজকালকার দিনে ঐ সামান্য আয়ে বিবাহ করাটা খুব সুবিবেচকের কাজও নয়!

হঠাৎ ইল্সপেক্টার প্রশ্ন করলেন, সুবিমলবাবু, একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো—ইদানীং শোনা যাচ্ছে আপনার মামা নরেন মল্লিক নাকি একটি সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন, ও সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন বা কোনরকম—

জানি বললে ভুল হবে। তবে হ্যাঁ, দু-একবার একটি সুন্দরী তরুণীকে মামাবাবুর সঙ্গে দেখেছি। একবার নটার শোতে রক্সি সিনেমায় আর বার দুই হ মার্কেটে–

তার নাম শুনেছেন কখনো?

না।

আচ্ছা আপনার মামা বিবাহ করবেন বা করবার কোন মনস্থ করেছেন এ সম্পর্কে কোন কিছু আপনি আপনার মামার মুখে শুনেছেন বা—

না, তেমন কোন আভাসই পাইনি। তাছাড়া মামার এখানে আমি একান্ত অনুরোধেই এসে থাকি বটে, তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ কচিৎ কখনো হতো। আমি সর্বদাই আমার কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকি।

হুঁ। আচ্ছা যে সুন্দরী মেয়েটির কথা বললেন, তাকে কখনো রাত্রে এ বাড়িতে দেখেছেন?

না। কথাটা যেন একটু ইতস্তত করেই উচ্চারণ করে সুবিমল।

মেয়েটিকে দেখলে চিনতে পারবেন নিশ্চয়ই!

আশা তো করি।

বিনতা দেবী : নরেন মল্লিক নতুন বাড়িতে আসবার মাসখানেক বাদেই বিনতা দেবী এখানে এসে চাকরিতে ঢোকেন। একজন স্ত্রীলোক না হলে সংসারের কাজ ভালভাবে চলে না বলে ভদ্রঘরের একজন দুঃস্থ মহিলার জন্য নরেন মল্লিক সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। সেই বিজ্ঞাপন অনুযায়ী বিনতা দরখাস্ত করায় বিনতাকে নরেন মল্লিক কাজে বহাল করেন। বিনতা বিধবা, বর্ষীয়সী, ভদ্রঘরের। বিনতা এসে কাজে ঢোকবার পর ধীরে ধীরে একটু একটু করে সংসারের আভ্যন্তরিক ব্যবস্থাটা তারই হাতের মধ্যে চলে যায়। অত্যন্ত শান্ত ও মৃদুভাষী। কথা একটা প্রয়োজন ছাড়া কারো সঙ্গে তাকে বলতেই কখনো দেখা যায়নি। সংসারের আভ্যন্তরীণ খরচাদির টাকাকড়িও মাসের প্রথমেই মধুর হাত দিয়ে বরাবর নরেন মল্লিক বিনতার হাতেই পাঠিয়ে দিতেন। নিচের তলায় একটা ঘরে একাকিনী থাকতেন বিনতা, মাথার উপরে সর্বদা দীর্ঘ গুণ্ঠন থাকতো টানা। এ বাড়িতেও কেউ কখনো তার মুখ দেখেছে বলে মনে পড়ে না। নরেন মল্লিকের সকল ব্যাপারে সর্বদা বিনতার দুটি চক্ষু সজাগ থাকলেও গত ৮৯ মাসের মধ্যে কখনো তাকে কেউ নরেন মল্লিকের ঘরে বা তার সঙ্গে কথা বলতে সামনাসামনি দেখেনি। উভয়ের যাবতীয় কথাবার্তা মধুর মারফতই হতো। সেই বিনতাকে যখন ডাকা হলো, তিনি বললেন, ঘটনার দিন দ্বিপ্রহর থেকেই মাথায় যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিলেন বলে বিকাল থেকে তার নিজের ঘরের মধ্যেই ছিলেন। রাত্রে নরেন মল্লিক গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর মাত্র দুই মিনিটের জন্য ঘর থেকে বের হয়ে মধুকে জিজ্ঞাসা করতে বলেছিলেন নরেন মল্লিক রাত্রে কি আহার করবেন সেটা জানার জন্য। এবং মধুর মুখে রাত্রে তিনি আহার করবেন না জেনে আবার ঘরে গিয়ে ঢোকেন। পরের দিন সকালে ভৃত্যদের গোলমালে ঘুম ভেঙ্গে বাইরে এসে মধুর মুখেই সব ব্যাপারটা শোনেন। নরেন মল্লিক সম্পর্কে কোন কথাই বলতে পারলেন না তিনি। যে সুন্দরী তরুণীটি ইদানীং কিছুদিন ধরে নরেন মল্লিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল এবং মধ্যে মধ্যে এ বাড়িতে আসততা তার গলাই এক-আধবার বিনতা শুনেছেন কিন্তু কখনো তাকে চাক্ষুষ দেখেননি বা তাকে দেখলেও চিনতে পারবেন না।

সেই সুন্দরী মেয়েটি!

প্রায় প্রত্যেকেরই জবানবন্দী থেকে মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে যে সুন্দরী তরুণীর ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে শোনা গেল, সেই মেয়েটিরই খোঁজে পরের দিন পার্ক সার্কাস থানার ইনচার্জ খোদাবক্স। নরেনের ড্রাইভার নন্দুয়াকে সঙ্গে করে আমীর আলী য়্যাভিনুর ত্রিতল একটি ফ্ল্যাট বাড়ির তিনতলার ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হলেন। দরজা ভিতর হতে বন্ধ। দরজার গায়ে কলিং বেলের ব্যবস্থা আছে দেখা গেল।

নন্দুয়া, তুমি একটু আড়ালে দাঁড়াও, মেয়েটিই যদি এসে দরজা খুলে দেয় তো আমাকে চোখ-ইশারায় কেবল তুমি জানিয়ে দেবে।

বুঝেছি। নন্দুয়া একটু দূরে সরে দাঁড়ায়।

কলিং বেল টিপতেই একটু পরে দরজা খুলে গেল।

খোলা দরজাপথে এসে দাঁড়াল একটি ২৩।২৪ বৎসরের তরুণী। তরুণীর রূপের সত্যিই যেন অবধি নেই। চাপা ফুলের মত উজ্জ্বল গায়ের বর্ণ। ক্ষীণাঙ্গী নয়, সুডৌল স্বাস্থ্যে দেহযমুনায় যেন বান ডেকেছে। অপরূপ মুখশ্রী। টানা টানা গভীর কৃষ্ণ দুটি আঁখি। ভারী আঁখিপল্লব। নাকের পাশ দিয়ে বামদিককার গালে একটি ছোট্ট কালো তিল। তিলটি সৌন্দর্যকে যেন তিলাঞ্জলি দিচ্ছে। দাঁড়াবার ভঙ্গীটিও অপূর্ব, পুরাকালে রাজসভায় করঙ্ক বাহিনীর কথাই মনে করিয়ে দেয়। অপর্যাপ্ত কুঞ্চিত কেশরাশি পৃষ্ঠব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। কবির ভাষায় বলতে সাধ যায়, বিকীর্ণ কুন্তলা।

চকিতে অদূরে দণ্ডায়মান নন্দুয়ার দিকে তাকাতেই, নিঃশব্দে ঘাড় হেলিয়ে সে জানাল, হাঁ ঐ মেয়েটিই।

ইশারা করলেন খোদাবক্স নন্দুয়াকে সরে যেতে। নন্দুয়া সরে গেল।

কাকে চান? তরুণীই কথা বললে প্রথমে খোদাবক্সকে সম্বোধন করে।

নমস্কার।

নমস্কার।-তরুণীও প্রতিনমস্কার দেয়।

আমি পার্ক সার্কাস থানার O.C., বিশেষ একটি জরুরী ব্যাপারে আপনাকে একটু বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে বিশেষ দুঃখিত। ঘরে আসতে পারি কি?

তরুণী ভ্রূকুঞ্চিত করে মৃদু কণ্ঠে বলে, আসুন।

তরুণী রাস্তা ছেড়ে দাঁড়ায়, খোদাবক্স কক্ষে প্রবেশ করেন।

শৌখীন পরিচ্ছন্ন ভাবে সাজানো-গোছানো ছোট একখানি ঘর। আসবাবপত্র ও ব্যবস্থা দেখে মনে হয় ড্রয়িংরুম হিসাবেই ঘরটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে সাধারণত। গোটা দুই সোফা। ঘরের মেঝেতে কার্পেট বিস্তৃত, মাঝখানে একটি গোল পিতলের স্ট্যাণ্ডে একটি জয়পুরী কারুকার্যখচিত পাত্রে একগোছা প্রস্ফুটিত পদ্মফুল। ঘরের দেওয়ালে দু-তিনটি ফটোগ্রাফ, দুটি ল্যাণ্ডস্কেপ, কোন একটি বিলাতী কোম্পানীর সুদৃশ্য একখানা দেয়ালপঞ্জী।

ঘরের তিনটি জানলার প্রত্যেকটিতেই সুদৃশ্য জারাণী রঙের পর্দা খাটানো। দ্বিতীয় দরজাটিতে একটা ভারী সবুজবর্ণের পর্দা ঝুলছে। সেই দরজারই ঠিক বিপরীত দেওয়ালে একটি প্রমাণ সাইজের দর্পণ প্রলম্বিত।

সোফাটা দেখিয়ে তরুণী বললে, বসুন।

হঠাৎ এমন সময় কানে ভেসে এলো অন্তরাল হতে অতি শুদ্ধ, সুস্পষ্ট সু-উচ্চারিত ইংরাজীতে আবৃত্তির সুর—

The mind is its own place, and in itself
Can make a Heaven of Hell, a Hell of Heaven.

অন্তরাল হতে যেন সুললিত আবৃত্তির সেই সুর সহসা খোদাবক্সকে আকর্ষণ করে।

বাঃ চমৎকার!

আবার শোনা গেল : এবারে ইংরাজী নয়, বাংলায় আবৃত্তি, কবিগুরুর বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি পংক্তি–

তবু একদিন এই আশাহীন পন্থ রে
অতি দূরে দূরে ঘুরে ঘুরে শেষে ফুরাবে
দীর্ঘ ভ্রমণ একদিন হবে অন্ত রে
শান্তি সমীর শ্রান্ত শরীর জুড়াবে।

 আবৃত্তি করছেন মনে হচ্ছে এই ফ্ল্যাটেরই যেন কেউ?

হ্যাঁ, আমার বাবা।

আপনার বাবার নামটা জানতে পারি কি?

শ্ৰীসঞ্জীব চৌধুরী। একটা পা ওঁর paralytic হয়ে যাওয়ায় ঘর থেকে বের হতে পারেন না, তাই সর্বদা লেখাপড়া ও আবৃত্তি নিয়েই থাকেন।

একেবারেই হাঁটা-চলা করতে পারেন না বুঝি?

সেই রকমই প্রায়, অতি কষ্টে ক্রাচে ভর দিয়ে সামান্য একটু-আধটু হাঁটা-চলা যা করেন। তরুণী বলে।

দেখেছেন মিস চৌধুরী, আমরা পুলিসের লোকেরা এত unsocial, এতক্ষণ আপনার নামটা পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করিনি!

আমার নাম কৃষ্ণা চৌধুরী।

সহসা এমন সময় খোদাবক্সের নজরে পড়ল, অদূরে সোফার উপরে ঐদিনকারই প্রাত্যহিক সুপ্রভাতখানা। এবং মাঝের পৃষ্ঠা—যেটিতে মৃত নরেন মল্লিকের ছবি দিয়ে তার হত্যাসংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, সেটিই খোলা। সংবাদপত্রটার প্রতি কৃষ্ণার দৃষ্টি আকর্ষণ করে খোদাবক্স বলে ওঠেন, পড়েছেন নরেন মল্লিকের হত্যার সংবাদ?

ঈষৎ বিরক্তিমিশ্রিত কণ্ঠে কৃষ্ণা যেন জবাব দেয়, অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত একটি শব্দে, হুঁ।

ওঁকে তো আপনি চিনতেন কৃষ্ণা দেবী, তাই না?

ভ্রূকুঞ্চিত করে তাকায় কৃষ্ণা খোদাবক্সের মুখের দিকে, কে বলেছে একথা?

বুঝতেই পারছেন জানতে পেরেছি, নইলে—মৃদু হাসি ওষ্ঠপ্রান্তে জেগে ওঠে খোদবক্সের অতঃপর।

কৃষ্ণা চুপ করে থাকে, মনে হয় সে যেন একটু অন্যমনস্ক।

শুধু যে চিনতেনই আপনি নরেন মল্লিককে তা নয়, বিশেষ ভাবে জানা গিয়েছে আপনি ওঁর সঙ্গে নাকি বেশ ঘনিষ্ঠ ভাবেই পরিচিত ছিলেন—অবিশ্যি—খোদাবক্স কথাটা শেষ না করে কৃষ্ণার মুখের দিকে তাকালেন।

অস্বীকার করবো না যে তার সঙ্গে সামান্য আলাপ ছিল, তবে আপনি যেরকম ঘনিষ্ঠতার কথা বলছেন—

দেখুন মিস চৌধুরী, পুলিসের লোক আমরা, ভাল ভাবে কোন সংবাদ না নিয়ে

দারোগা সাহেব, ভদ্রতার সীমাটা কি লঙ্ঘন করে যাচ্ছেন না? এখন মনে হচ্ছে, বোধ হয় ঐ কারণেই এখানে আপনার পদার্পণ হয়েছে। সত্যিই যদি তাই হয়ে থাকে, I must say you would be rather disapointed.

খোদবক্সের বুঝতে কষ্ট হয় না, শক্ত মাটিতে পা ফেলেছেন। তাই এবার নিজেকে বেশ প্রস্তুত করেই খোদাবক্স তার বক্তব্য শুরু করেন, কথাটা মানে আপনি যে বিশেষ ভাবেই মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন, মিথ্যে বলেই কি একেবারে উড়িয়ে দিতে চান মিস্ চৌধুরী?

নিশ্চয়। কারণ যেটা সত্যিই মিথ্যা তাকে আইনের দোহাই পেড়ে বা গলাবাজীর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যে করা যায় না কোন দিনই, আপনার মত একজন আইনজ্ঞকে সেটা নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে হবে না আশা করি দারোগা সাহেব। তাছাড়া আপনার এ ধরনের প্রশ্ন—not only objectionable, damaging too.

শেষের দিকে কৃষ্ণার কণ্ঠস্বরে সুস্পষ্ট উম্মার ভাব একটা যেন জেগে ওঠে।

কৃষ্ণা যে রীতিমত চঞ্চল ও উত্তেজিত হয়ে উঠেছে বুঝতে কষ্ট হয় না।

মুহূর্তে সমগ্র পরিস্থিতিটাই বুঝে নেন খোদাবক্স এবং এবারে কতকটা যেন কর্তৃত্বভরা কণ্ঠেই বলে ওঠেন, দেখুন মিস্ চৌধুরী, আমি পুলিসের লোক–

খোদবক্সের কথাটা শেষ হলো না।

দিদি! হঠাৎ ঠিক অনুরূপ একটি মেয়েলী কণ্ঠস্বরে খোদাবক্স চমকে মুখ তুলে তাকাতেই সম্মুখে দেওয়ালে প্রলম্বিত দর্পণে দেখতে পেলেন, প্রতিবিম্বিত হয়েছে বর্তমানে তার সম্মুখে উপবিষ্ট অনুরূপ একটি তরুণীরই যেন প্রতিচ্ছায়া।

খোদাবক্স যেন সহসা নিশুপ হয়ে গিয়েছেন। আর্শির বক্ষে দৃষ্টি তখনও তার স্থিরনিবন্ধ।

আশ্চর্য! আশ্চর্য! হুবহু এক! তিলমাত্র প্রভেদ বা পার্থক্যও যেন জীবিত ও আর্শিতে প্রতিফলিত ছায়াতরুণীর মধ্যে কোথাও নেই! অবিকল প্রতিচ্ছবি যেন একে অন্যের!

চক্ষু, নাসিকা, ভূ, কপাল, চিবুক, ওষ্ঠ—এমন কি বাম গালের উপরে ছোট্ট কালো তিলটি পর্যন্ত। দাঁড়াবার বিশেষ ভঙ্গীটি যেন হুবহু এক দুজনারই। এবং সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর কণ্ঠস্বরের মিলটুকুও উভয় তরুণীর একই যেন। কথা বলার ও উচ্চারণ ভঙ্গীটি পর্যন্ত এক।

কে উনি? বিস্মিত হতভম্ব খোদাবক্স এতক্ষণে সম্মুখে সোফার উপরে উপবিষ্ট কৃষ্ণাকে প্রশ্নটা করেন।

দর্পণে প্রতিবিম্বিতা নারী ধীরপদে ততক্ষণ কক্ষে প্রবেশ করে একই সোফার উপরে কৃষ্ণার পার্শ্বে এসে উপবেশন করল।

আমার বোন কাবেরী। কৃষ্ণা জবাব দেয়।

আপনার বোন! আপনারা—

আমরা যমজ বোন, মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের ছোট বড়।

কৃষ্ণা ও কাবেরী যমজ বোন!

পাশাপাশি দুটি বোন কৃষ্ণা কাবেরী সোফার উপরে বসে। পরিধানে শাড়ির রঙ, পাড় এবং পরবার স্টাইলটির মধ্যেও যেন বিন্দুমাত্র পার্থক্য নেই। দুজনেরই মাথার চুল ভোলা। সাধ্য নেই কারো একটি ভগ্নীকে অন্যের থেকে পৃথক করে বুঝবার।

ক্রমে বিস্ময়ের ধাক্কাটা কেটে গেলে ধীর সংযত কণ্ঠে খোদাবক্স এবারে কাবেরীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনার নাম কাবেরী চৌধুরী?

হ্যাঁ। কিন্তু আপনি–

আমি পার্ক সার্কাস থানা থেকে আসছি। আমার নাম খোদাবক্স। আচ্ছা কাবেরী দেবী, আজকের সংবাদপত্রে—বলতে বলতে সংবাদপত্রটি তুলে নরেন মল্লিকের মৃত্যুসংবাদটির প্রতি অঙ্গুলী নির্দেশ করে বললেন, এঁকে আপনি চিনতেন?

কথাটা কাবেরীকে জিজ্ঞাসা করা হলেও জবাবটা দিল কৃষ্ণা অনুচ্চ বিরক্তির সুরে, ওর বেলাতেও ঐ কথাই প্রযোজ্য মিঃ খোদাবক্স। বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ওরও তাঁর সঙ্গে ছিল না। আমারই মত সামান্য পরিচয় ছিল মাত্র।

দেখুন কৃষ্ণা দেবী, এবারে সুস্পষ্ট একটা আদেশের কাঠিন্য যেন প্রকাশ পায় খোদাবক্সের কণ্ঠস্বরে, কথাটা আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি, হয়েছে আপনার বোন কাবেরী দেবীকে। উনি শিশু নন—ওঁর যা বলবার ওঁর মুখে শুনতে পেলেই আমি খুশী হবো।

কাবেরী কৃষ্ণার মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল, এবার খোদবক্সের মুখের দিকে তাকাল।

বলুন কাবেরী দেবী, আমার প্রশ্নের জবাব দিন।

সামান্য পরিচয় ছিল মিঃ মল্লিকের সঙ্গে। দু-একবার পার্টিতে, উৎসবে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে মাত্র এই হ্যাঁ। জবাব দিল কাবেরী।

আপনি নরেন মল্লিকের ওখানে মাঝে মাঝে যেতেন?

না। কৃষ্ণার মুখের দিকেই তাকিয়ে কাবেরী এবারে জবাব দিল।

ব্যাপারটা খোদবক্সের দৃষ্টিতে কিন্তু এড়ায় না।

আপনি, কৃষ্ণা দেবী?

কস্মিনকালেও যাইনি।

হুঁ। সত্যিই খোদাবক্স এবার নিজেকে যেন যথেষ্ট বিব্রত বোধ করেন।

বুঝতে তার কষ্ট হয় না, যমজ দুটি বোন কৃষ্ণা ও কাবেরীর মধ্যে নিশ্চয়ই একজন মিথ্যা বলছে এবং দ্বিতীয়জন ইচ্ছা করেই অন্যজনের কথায় সায় দিচ্ছে। এবং এও ঠিক, অবিকল একই রকম দুজনে দেখতে, এদের মধ্যে কে যে মিথ্যা বলছে, নিজে হতে স্বেচ্ছায় এরা স্বীকৃতি না দিলে সেই আসল সত্যটুকু জানা কারো পক্ষে শুধু দুঃসাধ্যই নয়, অসম্ভবও। কিন্তু উপায়ই বা কি? যারা এদের মধ্যে একজনকে মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে দেখেছে তারাও হয়ত এখন দুজনকে পাশাপাশি দেখলে আসলটিকে নির্দিষ্ট করতে পারবে না।

আচ্ছা কৃষ্ণা দেবী, গত রবিবার রাত্রে অর্থাৎ পরশু রাত্রে আপনি সন্ধ্যা হতে রাত্রিতে শয্যায় শয়ন করতে যাবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কোথায় ছিলেন বা কোথায় কোথায় গিয়েছেন, কার কার সঙ্গে দেখা হয়েছে, I mean all your movements and whereabouts in details, একটা বিবৃতি চাই।

এটা কি আপনার জুলুম নয় দারোগা সাহেব?

দেখুন কৃষ্ণা দেবী, আমি যদি তার উত্তরে বলি, নরেন মল্লিকের হত্যার ব্যাপারে আপনারা যমজ ভগ্নী দুজন যথেষ্ট সন্দেহের কারণ ঘটিয়েছেন, মানে—কথাটা খোদবক্সের শেষ হলো না, যুগপৎকৃষ্ণা ও কাবেরী অস্ফুটকণ্ঠে আর্তনাদ করে ওঠে।

অতএব বুঝতেই পারছেন-I want a detail report of the movements of both of you. আপনাদের দুই ভগ্নীরই একটা পূর্ণ জবানবন্দী আমার চাই। এটা আমি দাবী জানাচ্ছি আইনের দিক হতে

এরপর উভয়েই কিছুক্ষণ ঝিম্ দিয়ে থাকে, তারপর কৃষ্ণাই প্রথমে কথা বলে, সেদিন আমাদের দু বোনেরই off duty ছিল।

Off duty ছিল—আপনাদের? মানে, আপনারা কি—

আমরা দু বোনেই টেলিফোন অফিসে চাকরি করি।

ওঃ! আচ্ছা বলুন।

কৃষ্ণা তখন বলতে শুরু করে, গত রবিবার-শরীর আমার বিশেষ রকম ক্লান্ত থাকায় সারাটা দিন ঘরেই বই পড়ে ও ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। তারপর রাত্রি দশটায় খেয়েদেয়ে একেবারে শুয়ে পড়ি।

আপনি কাবেরী দেবী?

সারাটা দিন আমিও বাড়িতেই ছিলাম। রাত্রি সাড়ে সাতটায় একটু গঙ্গার ধারে বেড়াতে যাই।

কতক্ষণ পর্যন্ত সেখানে ছিলেন?

রাত্রি দশটা পর্যন্ত।

কি করে বুঝলেন ঠিক সময়টা?

হাতে ঘড়ি ছিল, ফিরবার মুখে দেখেছি রাত তখন দশটা ঠিক।

বাড়িতে ফিরে আসেন কখন?

এই সাড়ে দশটা নাগাদ হবে।

এসে দেখলেন আপনার দিদি তখন ঘুমিয়ে বোধ হয়?

হ্যাঁ।

আচ্ছা গঙ্গার ধারে যতক্ষণ ছিলেন, কারো সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি?

হয়েছিল—দুজনের সঙ্গে।

তাদের নাম পরিচয়টা জানতে পারি কি?

একজনের পরিচয় দিতে পারবো না—অবশ্য আপনি আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেন, তিনি আপনার নরেন মল্লিক নন—

হুঁ। আর দ্বিতীয় জন?

আমার এক পরিচিত অ্যাডভোকেট বন্ধু–রবীন সেন, তিনিও ঐ সময় গাড়িতে গঙ্গার ধারে বেড়াতে এসেছিলেন।

আপনাদের কোন previous engagement ছিল ঐ সময় meet করবার?

না। বলতে পারেন নেহাৎ আকস্মিক ভাবেই তার সঙ্গে সেখানে দেখা হয়েছিল আমার।

তার ঠিকানাটা?

৩।১ রিজেন্ট পার্ক–টালিগঞ্জ।

মিঃ সেন ওখানে কখন পৌঁছেছিলেন?

রাত্রি সাড়ে আটটা বোধ হয়।

একসঙ্গেই বোধ হয় আপনারা ফিরে আসেন?

হ্যাঁ। তিনিই তার গাড়িতে করে আমাকে পার্ক সার্কাস মার্কেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যান।

এরপর খোদাবক্স বিনীত ভাবে উভয়কেই সম্বোধন করে বলেন, আবার হয়ত দেখা হতে পারে। আচ্ছা আজ আসি, নমস্কার।

কৃষ্ণা কিন্তু চুপ করেই থাকে। চোখেমুখে বিরক্তির চিহ্নটা তখনও কৃষ্ণার নিঃশেষে মুছে যায়নি যেন।

.

গাড়ি চলেছে নরেন মল্লিকের গৃহের দিকে। ফাইলটা রহমানের হাতে ফিরিয়ে দিতে দিতে কিরীটী বলে, দুটি যমজ বোন সম্পর্কে আপনার মতামতটা কি রহমান সাহেব?

One of them must be telling deliberate lies—

আমারও তাই মনে হয়, রহমান সাহেব।

শুধু তাই নয়—আমার স্থির ধারণা মিঃ রায়, যমজ ওই দুই বোনের মধ্যেই একজন খুনী।

হতে পারে আবার নাও হতে পারে।

গাড়ি ইতিমধ্যে নরেন মল্লিকের বাড়ির সামনে এসে গিয়েছিল।

We have reached our destination মিঃ রায়।

গাড়ি গেটের মধ্যে প্রবেশ করল। গাড়ি হতে নামতে নামতে, কিরীটী তার অর্ধসমাপ্ত কথার জের টেনে বলে, একটা কথা কি জানেন রহমান সাহেব, স্রেফ probabilityর উপরেই basis করে এসব ক্ষেত্রে সবসময় conclusionয়ে পৌঁছানো যায় না, আর investigationয়ের ব্যাপারে সে proceedure-ও ভুল। হত্যা-রহস্যের মীমাংসার ব্যাপারে আরও ব্যাপক ও সূক্ষ্ম তদন্তের প্রয়োজন।

নরেন মল্লিক যে ঘরে নিহত হয়েছিল সে ঘরে তেমনি তালা দেওয়াই ছিল। রহমান সাহেব পকেট হতে চাবি বের করে তালাটা খুলে ফেললেন, দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল।

ঘরটা অন্ধকার দিনের বেলাতেও। কারণ জানালা-দরজাগুলো সব বন্ধই ছিল। রহমান একে একে ঘরের জানালা-দরজাগুলো খুলে দিলেন। সকালের আলোয় ঘরটা ঝলমল করে ওঠে। ঘরের মেঝেতে সুদৃশ্য গালিচা বিস্তৃত, একটি সুদৃশ্য পালঙ্কে ধবধবে শয্যা বিছানো।

একটি আলমারি, গোটা দুই কাউছ, একটি রকিং আর্ম-চেয়ার। দেওয়ালে সুদৃশ্য সব পেনটিং। হঠাৎ কিরীটীর অনুসন্ধানী দৃষ্টি দেওয়ালে টাঙ্গানো একটি প্রমাণ আয়নার উপরে গিয়ে স্থিরনিবদ্ধ হলো।

আয়নার কঁচটা ভাঙ্গা, মনে হয় কোন ভারী বস্তুর আঘাতে ভেঙ্গে গিয়েছে চৌচির হয়ে যেন।

আশ্চর্য! অস্ফুট কণ্ঠে কতকটা স্বগতোক্তির মতই কথাটা উচ্চারণ করে কিরীটী।

কি? রহমান কিরীটীর কণ্ঠস্বরে ফিরে তাকালেন।

ওই বড় আয়নাটা-ওটা কি সেদিন ভাঙ্গাই দেখেছিলেন?

লক্ষ্য করিনি, কিন্তু কেন বলুন তো?

এই ঘরের অন্যান্য জিনিসপত্র সব লক্ষ্য করে দেখলেই বুঝবেন, এ ঘরে যে ব্যক্তি থাকতেন, তাঁর রুচিতে ঘরের মধ্যে এমন একটি ভাঙ্গা আয়না ঝুলিয়ে রাখা উঁহু, সম্ভব নয়।

কিন্তু—

ডাকুন আপনার সেই মধু চাকরকে, সে-ই হয়ত প্রমাণ দিতে পারবে।

তক্ষুনি মধুকে ডাকা হলো এবং সবিস্ময়ে সে বললে, আয়নাটা আগে ভাঙ্গা ছিল না।

মধু চলে গেলে কিরীটী আবার ঘরের ভিতরটা ভাল করে চারিদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল।

আয়নাটা ঘরের মধ্যে এমনি ভাবে ঝুলানো, যাতে করে শয়নকক্ষ-সংলগ্ন স্নানঘর থেকে বের হলে প্রথমেই আয়নার উপরে ছায়া পড়ে। বাথরুমটা পরীক্ষা করে দেখা গেল, বাথরুমের বাইরে দিয়ে মেথর যাতায়াতের জন্য একটি ঘোরানো লোহার সিঁড়িও আছে। তবে বাথরুমের দরজাটি তখন বন্ধই ছিল।

রহমান সাহেবও বললেন, সেদিনও মানে তদন্তের দিনও নাকি দরজাটি বন্ধই ছিল তিনি দেখেছিলেন। এবং সেদিন খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছিল, দিনে একবার মাত্র দরজাটি নাকি খোলা হত এবং মেথরের কাজ শেষ হলেই আবার বন্ধ করে রাখা হত।

রবিবার মধুই মেথর কাজ সেরে চলে যাবার পর নিজহাতে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল।

কিরীটী একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করে ধূমোদ্গীরণ করতে করতে বলে, ভাঙ্গা আয়না অথচ কেউ সে-রাত্রে কোনরকম শব্দই শোনেনি!

কি বলছেন মিঃ রায়? মজিবুর রহমান প্রশ্ন করেন।

কিরীটী মজিবুরের প্রশ্নটা আপাতত এড়িয়ে গিয়ে প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়ে বলে, আচ্ছা মিঃ রহমান, এই নরেন মল্লিকের হত্যার ব্যাপারে আপাতত ছটা পয়েন্ট অত্যন্ত এলোমেলো বা জট পাকানো বলে কি মনে হচ্ছে না আপনার?

বিস্মিত রহমান কিরীটীর মুখের দিকে তাকান, ব্যাপারটা তিনি যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। বুঝে উঠতে পারছেন না যেন কিরীটী ঠিক কি বলতে চায়!

কি কি পয়েন্টস্ বলুন তো মিঃ রায়? তবু প্রশ্ন করেন।

প্রথমতঃ ধরুন, আপনার ঐ যমজ বোন কৃষ্ণা ও কাবেরী, circumstantial evidence থেকে মনে হয়, ওদের মধ্যে একজন বা দুজনই মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে বিশেষ এবং ঘনিষ্ঠ ভাবেই পরিচিত ছিল; অথচ মিঃ মল্লিকের জন্মতিথি বা জন্মদিন উৎসবে ওদের মধ্যে কেউই কেন নিমন্ত্রিতা হলো না কেন? এবং ওরা দুই বোনই যে অস্বীকার করেছে তাদের নিজ নিজ জবানবন্দীতে যে, ওদের কেউই কখনো নরেন মল্লিকের গৃহে আসেনি সেও মিথ্যা। কারণ। মল্লিক-বাড়ির অন্যান্য দু-একজনের জবানবন্দী থেকেই সেটা প্রমাণিত হয়, কিন্তু এখন কথা হচ্ছে কৃষ্ণা কাবেরী মিথ্যা কথা বললে কেন? মিথ্যা তারা বলেছে নিঃসন্দেহে এবং তারা যে বুদ্ধিমতী যথেষ্ট সে বিষয়েও সন্দেহের কোন অবকাশ মাত্র নেই। তারপর দ্বিতীয়তঃ, যে রাত্রে নরেন মল্লিক নিহত হন, সে রাত্রে এগারোটার পরে দারোয়ান দেখেছে তার ঘরের আলো নিবে গিয়েছে, অথচ সুবিমলের জবানবন্দী থেকে আমরা জানতে পারছি যে, রাত্রি এগারটার পরে মিঃ মল্লিকের ঘরে আলো জ্বলছিল। এর দ্বারা এই প্রমাণ হয়, রাত্রি এগারোটায় আলো নিবে গেলেও যে কোন কারণেই হোক, রাত্রি একটায় আবার ঘরের আলো জ্বলেছিল সুনিশ্চিত, কিন্তু কেন? তৃতীয়তঃ মিঃ মল্লিকের শয়নকক্ষের সংলগ্ন বাথরুমে মেথর যাতায়াতের দরজাটা পরের দিন সকালে ছিল ভিতর হতে বন্ধ-কেন? চতুর্থতঃ এবং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে, ঘরের ঐ আয়নার কঁচটা ভাঙ্গল অথচ সেরাত্রে এ বাড়ির কেউ কোন শব্দ পেল না, কেন? পঞ্চম, আয়নার কঁচটা ভাঙ্গল অথচ মিঃ মল্লিক খুন হয়েছেন ছোরার আঘাতে—কেন? ষষ্ঠ : নরেন মল্লিক যে ছোরাটার দ্বারা নিহত হয়েছেন সে ছোরাটা তারই ঘরে ছিল এবং খুনী অন্য কোন ছোরা ব্যবহার না করে, বিশেষ করে ঐ ছোরাটাই বা ব্যবহার করতে গেল কেন?

মিঃ রহমান ভাবেন লোকটা পাগল নাকি, খুনের তদন্ত করতে এসে এসব কি অদ্ভুত আবোল-তাবোল প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন!

মধ্যে যাতায়াতের জন্য যাতায়াতের দরজাটা বন্ধ ছিল কেন, ঘরের আলো দুবার জ্বলেছে কেন, ঘরের আয়নাটার কাচ ভাঙ্গল কেন, শব্দ কেউ শুনতে পেল না কেন?

মনে মনে রহমান সাহেব একটু বিরক্তই হন। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারেন না।

আমার কি মনে হয় জানেন মিঃ রহমান—কিরীটী আবার বলে।

কি?

ঐ আয়নার কঁচটা ভাঙ্গার ব্যাপার ও শব্দটা যে কারো না কারো অন্ততঃ এ বাড়িতে শুনতে পাওয়া উচিত ছিল অথচ শোনা যায়নি—এ দুয়ের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে।

যে শব্দটা কারো না কারো অন্ততঃ শুনতে পাওয়া উচিত ছিল অথচ শোনা যায়নি!

হাঁ। যে শব্দটা হারিয়ে গিয়েছে মিস্টিরিয়ালি অথচ যার অতীত অস্তিত্ব সম্পর্কে মনে আমার বিন্দুমাত্রও দ্বিধা বা সন্দেহ নেই। তারপর ধরুন আপনার ওই যমজ বোন কৃষ্ণা ও কাবেরী, তা যাক গে সেকথা, পরেও ভাবা চলতে পারে তাদের কথা, আপাতত আপনার মধু ও সুবিমলবাবু যদি বাড়িতে থেকে থাকেন তাদের এবং বিনতা দেবী ও দারোয়ান রামখেল সিং এই চারজনকে গোটাকতক কথা আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল চারজনই তখন বাড়িতেই আছে।

প্রথমে ডাকা হলো দারোয়ানকে।

তোমারই নাম রামখেল? কিরীটীই প্রশ্ন করে।

জি।

আচ্ছা যে রাত্রে তোমার বাবু মারা যান সে রাত্রে তুমি দেখেছিলে সাড়ে এগারটায় বাবুর শোবার ঘরের আলো নিবে যায়, তাই না?

জি।

কেমন করে জানলে যে ঠিক তখন রাত সাড়ে এগারটা?

হরি ফিরে এলে আমাদের ঘরে একটা ঘড়ি আছে সেটায় ঢং ঢং করে এগারটা বাজল। তারপর আবার ঠিক ঢং করে সাড়ে এগারটার ঘণ্টা বাজতেই আমি শুতে যাবো বলে গেটের তালাটা আর একবার দেখতে যাই, ঠিক সেই সময় দেখলাম বাবুর ঘরের আলোটা নিবে গেল।

তারপর সুবিমলবাবু যখন ফিরে আসেন রাত্রে তুমি গেট খুলে দাও, কেমন তো?

হাঁ।

তখন বাবুর ঘরের আলো জ্বলছিল কিনা লক্ষ্য করেছিলে?

জি না। ঘুম-চোখে এসে গেট খুলেছি অতটা লক্ষ্য করিনি।

রাত্রি সাড়ে বারোটার মধ্যে কোন শব্দ শুনেছিলে? যেমন ধর কোন কঁচটাচ ভাঙ্গার শব্দ?

না। ঘুমিয়েছিলাম।

সুবিমলবাবু ডাকতেই তোমার ঘুম ভেঙ্গে যায়, তাই না?

জি না, আমার ঘরে কলিং বেল আছে, সেই বেলের শব্দে ঘুম ভেঙ্গেছিল।

আচ্ছা তুমি যেতে পারো।

রামখেল অতঃপর চলে গেল।

এরপর এলো মধু।

কিরীটী এবার তাকে প্রশ্ন শুরু করে।

আচ্ছা মধু, তোমার বাবুর শোবার ঘরের দরজাটা সাধারণত রাত্রে খুলেই কি বাবু ঘুমোতেন?

হ্যাঁ। রাত্রে তিনি কখনো দরজা বন্ধ করতেন না। রোজ সকালে আমিই এসে তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে গরম নুন-জল দিতাম কিনা, তাই দরজা খোলাই থাকত।

আচ্ছা সে রাত্রে তুমি যখন গরম দুধ নিয়ে এলে, বাবু তখনি দুধটা খেয়েছিলেন কি?

হ্যাঁ, দুধটা খাবার পর আমি যখন খালি গ্লাসটা নিয়ে যাচ্ছি, তিনি আমাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল ঘরে রেখে যেতে বললেন। শোবার আগে বাবু এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল খেতেন।

তাহলে গ্লাস হাতে তুমি যখন ঘর হতে বের হয়ে যাও বাবু তখনও শোন নি, তাই না?

হ্যাঁ।

কি করছিলেন তখন তিনি মনে আছে তোমার?

ঐ আরাম-চেয়ারটার ওপরে বসে একটা কি বই পড়ছিলেন যেন।

তোমার সঙ্গে আর কোন কথা হয়েছিল তোমার বাবুর সে রাত্রে?

হ্যাঁ, বলেছিলেন দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যেতে।

আর একটা কথা মধু, সেদিন সকালে মেথর এসে বাথরুম পরিষ্কার করে যাবার পর তুমি দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলে?

তা মনে আছে বৈকি।

আচ্ছা তুমি যেতে পার মধু।

মধু ঘর ছেড়ে প্রায় চলে যেতে উদ্যত হতেই হঠাৎ কিরীটী আবার তাকে ডাকে, মধু?

আজ্ঞে! ফিরে দাঁড়াল মধু যেতে যেতে।

আচ্ছা মধু, তোমার বাবুর সঙ্গে তো তুমি অনেক দিন যাবৎ ছিলে, একটা কথা বলতে পারো, সাধারণত তোমার বাবুর ঘুম কেমন ছিল, রাত্রে কখনো উঠতেন কিনা?

তা ঠিক বলতে পারি না বাবু—তবে একবার-আধবার উঠতেন বোধ হয় মাঝরাত্রে।

মধু, বলতে পারো তোমার বাবুর স্বভাবচরিত্র কেমন ছিল?

এবারে মধু মাথা নিচু করে।

বল, এতে লজ্জার কিছু নেই। শোন মধু, তোমার বাবুর হত্যার মীমাংসা করতে হলে তার সব কথাই যে আমাদের জানা দরকার—

আজ্ঞে—মেয়েছেলে ইদানীং, বিশেষ করে সেই সুন্দর দিদিমণি এখানে যাতায়াত করতেন। বটে, তবে কখনো কোন খারাপ কিছু বা নষ্টামি আমার চোখে পড়েনি।

আচ্ছা যাও।

এরপর এলো সুবিমল, নিহত নরেন মল্লিকের ভাগ্নে।

আপনার নাম সুবিমল রানা?

হাঁ।

বসুন, বসুন-দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? আমাদের কর্তব্যটাই বড় বিশ্রী।

সুবিমল নির্দিষ্ট চেয়ারটার উপরে উপবেশন করে।

তারপর হঠাৎ ইন্সপেক্টারের দিকে চেয়ে সুবিমল বলে, ইপেক্টার, সেদিন আপনি মামার উইল সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি কিছুই বলতে পারিনি তখন, কারণ সে সম্পর্কে তখনও আমি কিছুই জানতাম না। কাল সন্ধ্যার দিকে মামার সলিসিটার বোস এণ্ড চৌধুরীর মিঃ রাধেশ চৌধুরী এসেছিলেন। মামা উইল কিছুই যদিও লিখিতভাবে করে যাননি-তবে he had definite instructions–

বটে! কি instructions ছিল? রহমান প্রশ্ন করেন।

আমিই তার অবর্তমানে সমস্ত সম্পত্তির মালিক হব।

হুঁ, Good news no doubt! রহমান সানন্দে বলেন।

হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করে, মিঃ মল্লিকের সলিসিটারের কাছে তার সম্পত্তির পরিমাণ সম্পর্কে কোন কিছু শোনেননি সুবিমলবাবু? মানে কোন definite idea?

চোখ তুলে তাকাল সুবিমল কিরীটীর দিকে, তারপর মৃদু কণ্ঠে বললে, হাঁ বলেছেন। ব্যাংকে তার নগদ হাজার পঞ্চাশেক টাকা, কলকাতায় পার্ক সার্কাসের এই বাড়ি, যার valuation প্রায় সত্তর হাজার টাকা দাঁড়িয়েছে, তাছাড়া কিছু কোম্পানীর কাগজ।

A good fortune! স্মিতভাবে কিরীটী বলে।

Really lucky আপনি মিঃ রানা। রহমান বলেন।

কিন্তু একা মানুষ আমি, এক বুড়ী বিধবা মা মাত্র সংসারে, কি হবে আমার এই বিরাট সম্পত্তি দিয়ে ইন্সপেক্টার! এর চাইতে তিনি—মামা যদি বেঁচে থাকতেন—বলতে বলতে সহসা সুবিমলের চোখের কোণ দুটো অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে যায়। ট ট করে কয়েক ফোঁটা অশ্রুও গাল বেয়ে ঝরে পড়ে।

আর একটা কথা সুবিমলবাবু! কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

বলুন?

আপনি বলেছেন, সে রাত্রে আপনি প্রায় সোয়া একটার সময় বাড়ি ফিরেছিলেন, রানাঘাট কোথায় যেন গিয়েছিলেন–

হ্যাঁ, রানাঘাটেই insuranceয়ের একটা জরুরী কাজে যেতে হয়েছিল।

কোন্ ট্রেনে রানাঘাট হতে ফেরেন?

শেষ ট্রেনে, রাত সাড়ে এগারটায়।

সাড়ে এগারটায়?

হ্যাঁ, ট্রেনটা একটু লেট ছিল।

 ওঃ, সাড়ে এগারটায় শিয়ালদহে পৌঁছালেন তো বাড়িতে পৌঁছাতে এত দেরি হলো যে?

ট্রাম, বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, একটা ট্যাক্সিও ছিল না। কোনমতে একটা রিক্সা করে এসেছিলাম।

.

এরপর ডাক পড়ল বিনতা দেবীর। সুবিমল ঘর থেকে চলে যাবার মিনিট দশেক বাদেই এলেন বিনতা দেবী। দীর্ঘ অবগুণ্ঠন টানা, সাদা থান পরিহিতা, নিরাভরণা, ধীর সংযত চলুন।

কিরীটীই কথা বলে, বসুন বিনতা দেবী।

বিনতা দেবী বসলেনও না, কোন সাড়াও দিলেন না। যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন তেমনিই দাঁড়িয়ে রইলেন।

।কিরীটী লক্ষ্য করছিল বিনতা দেবী শুধু যে মুখখানাই তার অবগুণ্ঠনের আড়ালে সযতনে রেখেছিলেন তাই নয়, সর্ব অবয়বই যেন পরিধেয় বস্ত্র দ্বারা অন্যের দৃষ্টির সামনে থেকে আড়াল করবার একটা সুস্পষ্ট সযত্ন প্রয়াস প্রকাশ পাচ্ছিল।

কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করবার জন্য আপনাকে ডেকেছি বিনতা দেবী। কিরীটী বলে।

এবারও কোন জবাব পাওয়া গেল না।

আপনার বাড়ি কোথায়?

বর্ধমানে। মৃদুকণ্ঠে জবাব এল।

আপনার আত্মীয়স্বজন কেউ আছেন?

না।

কেউ নেই?

না।

আপনার স্বামী কতদিন আগে মারা গেছেন?

দশ-বারো বছরের বেশি হবে।

সুবিমলবাবু যদি আপনাকে চাকরিতে রাখেন তাহলে তো আপনি এখানেই থাকবেন?

না। আমি আর চাকরি করবো না, সুবিমলবাবুকে পরশুই বলে দিয়েছি।

চাকরি আর করবেন না?

না।

দেশে ফিরে যাবেন বুঝি?

বলতে পারি না।

আচ্ছা নরেন মল্লিকের সঙ্গে কি এখানে আপনার চাকরির এই কয় মাসে কখনো কথা বলেননি?

না।

নরেনবাবু লোক কেমন ছিলেন আপনার ধারণা?

ভালই।

কৃষ্ণা কাবেরীকে আপনি চেনেন?

বিনতা চুপ করে থাকেন শেষের প্রশ্নে।

কই, আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না?

কি জবাব দেবো?

কৃষ্ণা কাবেরীকে আপনি চেনেন?

না।

ঐ নাম দুটি কখনো শোনেননি?

না।

নরেনবাবুর সঙ্গে যে একটি সুন্দরী তরুণীর আলাপ ছিল, মধ্যে মধ্যে যিনি এ বাড়িতে আসতেন, তাকে কখনো দেখেন নি?

দেখেছি।

তার নাম শোনেন নি কখনও?

না।

তার নাম হয় কৃষ্ণা না হয় কাবেরী!

হবে।

অতঃপর কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, আচ্ছা আপনি যেতে পারেন।

বিনতা যেমন নিঃশব্দে ধীরে এসেছিলেন তেমনি নিঃশব্দেই চলে গেলেন।

কিরীটী রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, এবারে চলুন ওঠা যাক রহমান সাহেব।

চলুন।

এরপর কিরীটী ও রহমান সুবিমল রানার কাছ হতে বিদায় নিয়ে চলে আসে।

সুবিমল নিজের ঘরে এসে একটা বই নিয়ে বসল। মনের মধ্যে অসংখ্য চিন্তা যেন জাল বুনে চলেছে একটা কালো মাকড়সার মত।

.

সন্ধ্যার অন্ধকার চারিদিকে নামছে ধূসর অঞ্চলখানি বিছিয়ে।

কিরীটী তার বসবার ঘরে একটা সোফার ওপরে অর্ধশায়িত অবস্থায় চক্ষু বুজে, একটা পা আর একটা পায়ের ওপর তুলে অভ্যাসমত মৃদু মৃদু নাচাচ্ছিল। নরেন মল্লিকের হত্যার রহস্যটা ঠিক যে কোথা হতে শুরু করা যেতে পারে, গতকাল ইস্পেক্টারের সঙ্গে অকুস্থান হতে ঘুরে আসা অবধি সেই চিন্তাটাই কিরীটীর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল।

কতকগুলো বেখাপ্পা রকমের সূত্র বিশ্রী ভাবে জট পাকিয়েছে, সেগুলো সর্বাগ্রে ভোলার প্রয়োজন কিন্তু তারও আগে প্রয়োজন যমজ বোন কৃষ্ণা ও কাবেরীর মধ্যে আসল কোন্ জন মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল সেইটাই জানা। ইপেক্টার মজিবুর রহমানের কথাই ঠিক, ওদের মধ্যে একজন স্পষ্টই মিথ্যা কথা বলছে।

কিন্তু কে বলছে মিথ্যা কথা?

এবং এও ঠিক, একজন মিথ্যা কথা বললেও দ্বিতীয়জন তাতে সায় দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন?

আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে দুজনেই মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে বেশ ভালভাবেই পরিচিত ছিল। আচ্ছা পরিচিতাই যদি ছিল দুটি বোনই তবে ওদের মধ্যে একজনও সেদিন নরেন মল্লিকের জন্মতিথি উৎসবে, নরেন মল্লিকের বাড়িতে গেল না কেন?

চিন্তাস্রোত পাক খেয়ে ফিরতে থাকে।

আচ্ছা ঐ ধরনের যমজ বোন, তাদের একজনকে অন্যজন থেকে কি ভাবে পৃথক করা যেতে পারে? এবং সত্যিই সেটা সম্ভব কিনা?

এমন কোন লোক যে ছোটবেলা হতে ওদের চেনে না বা জানে না এবং ওদের ঠিক পরস্পরের পরস্পর হতে পার্থক্য কোথায় জানে না, সে যদি ওদের দুজনের মধ্যে একজনকে পৃথক করে নিতে চায়, কি ভাবে করতে পারে? এবং প্রকৃতপক্ষে সেটা আদপেই সম্ভবপর কিনা?

জংলী এসে অন্ধকার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল, বাবু?

কিরে জংলী?

রহমান সাহেব এসেছেন—আপনাকে—

নিয়ে আয়, এই উপরের ঘরেই নিয়ে আয়। যা।

একটু পরে রহমান সাহেব কক্ষে এসে প্রবেশ করলেন, এ কি! ঘর অন্ধকার কেন হে সত্যাশ্রয়ী?

কিরীটী তাড়াতাড়ি উঠে আলোটা জ্বেলে দেয়, আসুন, আসুন রহমান সাহেব। একটু পরেই আপনার কাছে যেতাম। আমার এক বন্ধু আছেন ডাঃ সুকুমার গুপ্ত, সাইকো অ্যানালিস্ট, চলুন তাঁর কাছে একবার যাবো, সে হয়ত কৃষ্ণা কাবেরীর ব্যাপারে আমাদের help করতে পারে–

.

থিয়েটার রোডে সুন্দর প্যাটার্নের একখানি দোতলা বাংলো বাড়ি। গেটের মাথায় নিওন সাইনে লেখা : Dr. Guptas Clinic; গেটের গায়ে নেমপ্লেটে লেখা?

Dr. Sukumar Gupta, D. Sc, M. R. c. P. (Lond) Neurologist.

কিরীটীর গাড়িটা এসে নিঃশব্দে বাংলোবাড়ির গেটের মধ্যে ঢুকলো।

ডাঃ গুপ্তের কনসালটিং চেম্বার। ভিতরের কক্ষটি চমৎকারভাবে সাজানোগোছানো। একটি সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনে ঘূর্ণায়মান একটি চেয়ারের উপরে বসে ডাঃ গুপ্ত।

বেশ লম্বা, বলিষ্ঠ চেহারা, গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম। পরিধানে দামী গরম সুট, তার উপরে সাদা অ্যাপ্রন। চোখে রিমলেস্ চশমা। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। চশমার কাচের অন্তরালে তীক্ষ্ণ একজোড়া চক্ষু। চোখে-মুখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির একটি পরিচয় অত্যন্ত সুস্পষ্ট।

এদিককার চেয়ারে একজন চ্যাঙ্গা, রোগা, বৃদ্ধ ভাঃ গুপ্তর সঙ্গে বসে কথা বলছেন। বৃদ্ধটির পরিধানে দামী শান্তিপুরী ধুতি, গায়ে সার্জের গলাবন্ধ গরম কোট, কাধে দামী শাল একখানা পাট করা সযতনে। একমুখ দাড়িগোঁফ।

বৃদ্ধ বলছিলেন, বুঝলেন ডাঃ গুপ্ত, লভ—আমার ছেলে ন্যাপলার মস্তিষ্কে একালের ঐ লভ ব্যাধি ঢুকেছে। বৌমাটি আমার সতীলক্ষ্মী। এগার বছর বয়সের সময় ঘরে নিয়ে আসি মা-জননীকে আমার। বুঝলেন কিনা-ন্যাপলা কুম্মাণ্ডের বয়স তখন বাইশ। হারামজাদা ছয়ছয়টি কন্যের পিতা, বড় নাতনীটির বয়সই এখন তেরো। তা হতভাগা বুঝলেন কিনা—

ডাঃ গুপ্ত : দেখুন মিঃ চ্যাটার্জী, direct patient-য়ের সঙ্গেই কথা বলা দরকার কারণ এও এক ধরনের যৌন মনোবিকার, sexual insanity!

বৃদ্ধ ও কি বললেন?

ডাঃ গুপ্ত : sexual insanity মানে যৌন বিকৃতি, অর্থাৎ যৌন সংক্রান্ত মস্তিষ্ক বিকৃতি, তা-

বৃদ্ধ ও তা বেশ। হতভাগা কুণ্ডটাকে নিয়ে কবে আসতে হবে বলুন?

বেয়ারা এসে একখানা কার্ড দিল ডাঃ গুপ্তর হাতে।

কার্ডের দিকে তাকিয়েই ডাঃ গুপ্তর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আসতে বল। আচ্ছা মিঃ চ্যাটার্জী-তাহলে ঐ কথাই রইলো, আপনার ছেলেকে সঙ্গে করে একদিন নিয়েই আসবেন, তারপর যা করবার–

বৃদ্ধ ও আপনার ফিস্‌টা—

ডাক্তার : সোল।

বৃদ্ধ দেখুন ডাক্তার সাহেব, টাকার জন্য আপনি ভাববেন না। বুঝলেন কিনা—আপনার ন্যায্য ফিস ছাড়াও হতভাগাটির যদি মতিগতি ফিরিয়ে দিতে পারেন, আপনাকে খুশী করে দেবো, বুঝলেন কিনা—

.

কিরীটী আর রহমান সাহেব চেম্বারের সুইংডোর ঠেলে কমধ্যে এসে প্রবেশ করল; সুকুমার মৃদু হেসে বৃদ্ধকে সম্বোধন করে বলে, হবে হবে, আপনি আপনার ছেলেকে একদিন নিয়ে আসুন তো! তারপর কিরীটীর দিকে তাকিয়ে আনন্দোৎফুল্ল কণ্ঠে আহ্বান জানায়, এসো এসো রহস্যভেদী, তারপর?

বৃদ্ধ কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।

তারপর পথ ভুলে নাকি?

না হে না। কিরীটী জবাব দেয়।

বসুন—কিরীটী এবার রহমানের দিকে তাকিয়ে বলে। ওঁর নাম মজিবুর রহমান, লালবাজার ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টার।

নমস্কার।

তারপর কি ব্যাপার বল তো ভাই, হঠাৎ এই অধীনের গৃহে–

তুই তো মানসিক চিকিৎসা করিস—সাইকোঅ্যানালিস্ট, একটা ডায়লেমার সলুশন করে দে তো ভাই–

কি ব্যাপার!

একটু সময় নেবো ভাই। তুই এখন ফ্রি তো?

হ্যাঁ, দাঁড়া চা আনতে বলি, আপত্তি নেই তো?

না, মৃদু হাসি দেখা দেয় কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে, অমৃতে অরুচি কিরীটী রায়ের নেই।

সুকুমার টেবিলের উপরে রক্ষিত কলিং বেল বাজাতেই বেয়ারা এসে সেলাম জানাল। জগদেও—একটু চায়ের ব্যবস্থা কর। জগদেও সম্মতি জানিয়ে চলে গেল।

তারপর এখন বাসা নিলি কোথায়? সুকুমারকে প্রশ্ন করে কিরীটী।

কোথায় আবার, এইখানে! সমস্ত বাড়িটাই ভাড়া নিয়েছি, ভিতরের দিকে ব্যাচিলার্স ডেন, বাইরে চেম্বার।

সুকুমারের কথায় কিরীটী ও রহমান দুজনেই হেসে ওঠে।

পসার কেমন জমলো?

কিরীটীর কথায় আড়চোখে রহমান সাহেবের দিকে একবার তাকিয়ে মৃদু হাসির সঙ্গে বলে, Confidential; হাঁড়ির খবর আজকালকার দিনে কেউ কাউকে দেয় রে!

চেম্বার তো বেশ জাঁকিয়ে বসেছিস।

হ্যাঁ, তা বসতে হবে বৈকি। এ দেশটাকে তো চিনলি না এখনও, আমাদের মত বাপের টাকা বা শ্বশুরের টাকার জোরে বিলেত-প্রত্যাগত আনকোরা বিশেষজ্ঞদের কেউ পোঁছে না ভাই, কেউ পোঁছে না। দাঁড়া, আগে না খেয়ে খেয়ে, দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় প্যান্টে তালি পড়ক, মাথার চুল সাদা হয়ে যাক, বাপের দেওয়া ব্যাংক ব্যালেন্সটা শেষ হয়ে আসুক, তবে তো।

কিন্তু এতগুলো institution, হাসপাতাল-visitingয়ের postও একটা জোটাতে পারলি না?

না ভাই। বাবা, মামা, শ্বশুর, মেসো কারোই তো জোর নেই, কোন হাসপাতালে অনাহারী বহির্বিভাগীয় পরিদর্শনকারী হওয়া কি এতই সহজ রে! তা আমিও বাবা শত হস্তেন দুর্জনদের পরিত্যাগ করেছি। My own Nursing Home & chamber, এতে করে কিন্তু মন্দ হয় নি, সুফলই পেয়েছি। একা মানুষ বেশ আনন্দেই আছি।

ট্রেতে করে ভৃত্য চা নিয়ে এলো। চা পান করতে করতেই কিরীটী সংক্ষেপে কৃষ্ণা ও কাবেরীর ব্যাপারটা বলে গেল।

এই হলো story, তুই তো একজন মনস্তাত্ত্বিক, এই ডায়লেমাটার সলুশন করে দে তো! ঐ দুই যমজ বোন কৃষ্ণা ও কাবেরী ওদের পরীক্ষান্তে দৈহিক কোন চিহ্ন, যেমন বার্থ মার্ক, স্কার মার্ক বা ডিফিসিয়েন্সি ইত্যাদি ছাড়া, ওদের মনের বা চরিত্রগত গঠন বা প্রবৃত্তিগত ভাবধারার অনুশীলন দ্বারা কি এক থেকে অন্যকে পৃথক করা যেতে পারে না?

How interesting! Its marvellous idea! ঐভাবে ঠিক ইতিপূর্বে কখনো আমি ভেবে দেখি নি। হ্যাঁ, হয়ত কিছুদিন ধরে আলাদা আলাদা ভাবে ঐ যমজ বোনদুটিকে study করতে পারলে, হয়তো—হয়তো yes, একটা conclusion-এ পৌঁছানো যেতে পারে। কিন্তু–

কিন্তু কি?

ভাবছি তা সম্ভবই বা হতে পারে কি করে? ভদ্রঘরের অবিবাহিতা সুন্দরী তরুণী, বাপ বর্তমান, রাজীই বা হবেন কেন? না ভাই, এদেশে এখনও এ সব সম্ভব নয়–

শোন ডাক্তার, আমি ইতিমধ্যেই একটা মতলব ঠাউরেছি, how do you like the idea কাগজে কাগজে তোর নাম দিয়ে সাইকোঅ্যানালিস্ট হিসাবে বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে।

বিজ্ঞাপন?

হ্যাঁ, বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে : যমজ ভাই বোন, যমজ ভাই বা যমজ বোন এদের মনোগত বা চরিত্রগত প্রবৃত্তি বা ভাবকে স্টাডি করে এদের মানসিক ও প্রবৃত্তিগত গঠন থেকে একজনকে অন্যজন হতে identify করা যায় কিনা, ঐ সম্পর্কে তুই গবেষণা করছিস এবং ঐ গবেষণার জন্য তুই যমজ ভাই, বোন ও ভাইবোনদের আহ্বান জানাচ্ছিস; নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তারা তোর চেম্বারে এসে sitting দেবে–

দূর পাগল! এদেশে ও ধরনের বিজ্ঞাপনে কেউ সাড়া দেবে না।

উঁহু, তুই আমার পরিকল্পনাটা ঠিক এখনও ধরতে পারিস নি। তাদের বেগার দিতে হবে, রীতিমত প্রতি sittingয়ের জন্য তাদের pay করা হবে—হ্যাঁ, handsomely pay করা হবে—বলতে থাকে কিরীটী, ধর এক বা দু ঘণ্টার জন্য যেমন প্রয়োজন, প্রতি sittingয়ে ৫০ হতে ৬০, ৮০ টাকা পর্যন্ত দেওয়া হবে।

বলিস কি!

হ্যাঁ, আর সে টাকা দেব আমি।

তুই দিবি?

হ্যাঁ, আমি দেবো কারণ দায়টা এক্ষেত্রে আমারই—

কিন্তু–

না, আর কিন্তু নয় বন্ধু। শুভস্য শীঘ্রম্। কালই আমি কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন দেবার সব ব্যবস্থা করছি।

বেশ। কিন্তু যাদের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে, যদি শেষ পর্যন্ত তারাই না সাড়া দেয়?

সাড়া তাদের দিতেই হবে এবং যতদিন না সাড়া দেবে বিজ্ঞাপন চলবে কিন্তু অতটা বোধ হয় করতেই হবে না। কারণ খোঁজ নিয়ে ইতিমধ্যেই আমি জেনেছি, আর্থিক অবস্থা তাদের এমন বিশেষ কিছু একটা নয়। এ ফাঁদে তাদের ধরা দিতেই হবে। আর শেষ পর্যন্ত ধরা যদি নাই দেয়, তখন অন্য উপায় না হয় একটা কিছু ভেবে দেখা যাবে।

বেশ, দে বিজ্ঞাপন।

তবে আজকের মত উঠি?

আয়—

.

কৃষ্ণা ও কাবেরীর ফ্ল্যাটবাড়ি।

অন্তরাল হতে সঞ্জীবের আবৃত্তি শোনা যাচ্ছে।

Our sincerest laughter
With some pain is fraught
Our sweetest songs are those
That tell of saddest thought.

ত্রিলোকের হৃদিরক্তে আঁকা তব চরণ শোণিমা,
স্বর্গ, মর্ত্য, আরাধ্যা, তুমি হে চিরবরেণ্যা।

কৃষ্ণা একটা সোফার উপরে বসে কাঁটা দিয়ে উলের একটা স্কার্ফ বুনছে। কাবেরী হাতে ঐদিনকার ইংরাজী একটা সংবাদপত্র নিয়ে কক্ষে এসে প্রবেশ করল, দিদি!

উঁ।

আজ কদিন থেকে খবরের কাগজে যে বিজ্ঞাপনটা বেরুচ্ছে—একজন সাইকোঅ্যানালিস্ট যমজ ভাই ও বোনদের study করে তাদের মানসিক ও চরিত্রগত প্রবৃত্তি থেকে তাদের এক হতে অন্যকে পৃথক করে নেওয়া যায় কিনা সে সম্পর্কে–

পড়েছি।

আয় না কেন, আমরা দুজনে দরখাস্ত করে দিই!

কৃষ্ণা কাবেরীর দিকে মুখ তুলে তাকাল, কুঞ্চিত ভ্রূযুগল।

বিনা পরিশ্রমে কেবল কথাবার্তা বলবার জন্য প্রত্যেক সিটিংয়ে টাকা দেবে–

না।

না কেন? এত সহজে অর্থোপার্জন! তাছাড়া টাকার তো আমাদের যথেষ্টই প্রয়োজন। এক্ষেত্রে–

তুই কি ক্ষেপে গেলি কাবি?

বাঃ রে! এতে ক্ষেপে যাবার মত কি দেখলি তুই?

তাছাড়া কি! সামান্য কয়েকটা টাকার জন্য ভদ্রঘরের মেয়ে হয়ে আমরা একজন পরপুরুষের সামনে বসে বসে তার খুশিমত যত সব আবোল-তাবোল প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাবো! মান-সম্রম নেই আমাদের–

But really this is too much দিদি। তাছাড়া ভদ্র শিক্ষিত বিলাতফেরত ডাক্তার, তার রুচি ও ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চয়ই আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি।

বাবা! বাবার কথা ভুলে যাস না কাবি। হ্যাঁ, তুই তো জানিস কোন পুরুষের সংস্পর্শে আমরা আসি—এ তিনি একেবারে চান না। একটু থেমে আবার কৃষ্ণা বলে, তা ছাড়া বাবা মনে যাতে দুঃখ পান আমাদের তা করারই বা কি প্রয়োজন? কোন এক পরপুরুষ ডাক্তারের চেম্বারে একা একা তার সঙ্গে বসে বসে এভাবে sitting দেওয়ায় তিনি কিছুতেই মত দেবেন না।

নেপথ্য হতে ঠিক এমনি সময় ওদের পিতা সঞ্জীবের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, কৃষ্ণা কাবেরী!

কৃষ্ণা? যাই বাবা। চল, বাবা ডাকছেন।

দুই বোন ভিতরের ঘরের দিকে গেল।

.

ভিতরের একটি কক্ষ।

আসবাবপত্রের কোন বাহুল্যই নেই। একটি সিংগল খাট একপাশে, উপরে তার শুভ্র শয্যা বিছানো। একপাশে নানাজাতীয় ইংরাজী বাংলা বইতে ঠাসা একটা আলমারী। ছোট একটি বেতের টেবিলের উপরে মদের গেলাস ও মদের বোতল। একটি হেলান দেওয়া বেতের চেয়ারের ওপরে বসে, কোলে একটি মোটা বই, পাঠনিরত সঞ্জীব চৌধুরী।

অদূরে দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করানো আছে একজোড়া ক্রাচ ও দেওয়ালে টাঙ্গানো একটি বেহালার বাক্স।

ক্রাচের সাহায্যেই সঞ্জীব চৌধুরী ঘরের মধ্যে সামান্য প্রয়োজনমত হাঁটা-চলা করেন।

সঞ্জীবের বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। সরু ছুঁচালো মুখ—মাথার চুল ঝাকড়া আঁকড়া। বহুকাল চিরুনির সংস্পর্শ নেই বলেই মনে হবে। কোটরপ্রবিষ্ট দুটি চক্ষু। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, অন্তর্ভেদী। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। পরিধানে পায়জামা ও গায়ে কিমোনো।

কৃষ্ণা ও কাবেরী এসে কক্ষে প্রবেশ করল।

বই হতে চোখ না তুলেই সঞ্জীব মৃদু কণ্ঠে বলেন, তোমাদের বোনদের কথা কিছু কিছু আমার কানে এসেছে। I agree with কাবেরী

পিতার প্রকৃতিবিরুদ্ধ কথা শুনে দু বোনই যুগপৎ চমকে যেন পিতার মুখের দিকে তাকায়। কারো সঙ্গে মেলামেশা করা, বিশেষ করে কোন পরপুরুষের সঙ্গে, সঞ্জীব একেবারেই পছন্দ করেন না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাঁর সর্বদাই সজাগ ওদের প্রতি।

এমন কি এ কথাও তিনি বহুবার মেয়েদের বলেছেন, মেয়েদের স্বাধীনতার তিনি আদপেই পক্ষপাতী নন। মেয়েদের স্থান ঘরে-অন্দরের সীমানায়, আর লজ্জা ও সংযমের মধ্যে। শিক্ষার তাদের প্রয়োজন আছে, কিন্তু সে শিক্ষা স্কুল কলেজের ডিগ্রী শিক্ষা নয়। বাড়িতে বসেই তারা অধ্যয়ন করবে, শিক্ষালাভ করবে আত্মোন্নতির জন্য। বাইরের জগতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক যতটা কম হয় ততই ভাল ও মঙ্গল। সেই জন্যই ম্যাট্রিক পাসের পর ঘরে বসেই আই-এর পাঠ পড়তে পড়তে তাদের পড়া বন্ধ হয়ে যায়। মোট কথা অতিমাত্রায় রক্ষণশীল পিতার প্রকৃতির সঙ্গে তাদের বেশ ভালভাবেই পরিচয় আছে।

সেই পিতার মুখে আজ এ কি কথা!

বিস্ময়ে দুই বোনই চেয়ে থাকে পিতার মুখের দিকে।

আবার সঞ্জীব বলে ওঠেন, বুঝতে পারছি তোমরা কি ভাবছো। মত আমার আজও বদলায় নি। তবু এ ব্যাপারে আমার মত আছে দুটি কারণে–

একটু থেমে আবার সঞ্জীব বলতে শুরু করেন, হ্যাঁ, দুটি কারণে, ১নং আমাদের কিছু টাকার প্রয়োজন। এযাবৎকাল তোমাদের দুজনের মাইনে হতে যা আমি বাঁচিয়েছি, তার উপরে আরো কিছু টাকা হলে আমরা কলকাতা ছেড়ে কোন গ্রামে গিয়ে কিছু জমি-জায়গা করে সাধারণভাবে নিরুপদ্রবে ও শানিতে জীবন কাটাতে পারবো। তোমরতা দু বোন প্রত্যেক sittingয়ের জন্য ১০০ টাকা করে চার্জ করবে, যদি এতে তারা রাজী হয় ভালো নচেৎ sitting দেবে না। আর ২নং কারণ—আমি দেখতে চাই এতদিন ধরে যে শিক্ষা তোমরা আমার কাছ হতে পেয়েছে, কতটুকু তার তোমরা গ্রহণ করেছে। সত্যিকারের মনের জোর যদি তোমাদের থাকে, তোমরা যে কোন situationয়েই উত্তীর্ণ হয়ে আসতে পারবে।

কাবেরী বেশী উৎসাহিত হয়ে ওঠে পিতার কথায়, বলে, তাহলে একটা দরখাস্ত করে দিই বাবা?

দাও—তবে হ্যাঁ, ঐ একশ টাকা করে তোমরা প্রত্যেক sittingয়ের জন্য চাও, এ কথাটা mention করতে ভুল হয় না যেন। •

কাবেরী বলে, কিন্তু বাবা, একশ টাকাটা খুব বেশী নয় কি?

সঞ্জীব জবাব দেন, না। যে লোক সামান্য একটা অদ্ভুত খেয়ালের জন্য টাকা খরচ করতে রাজী থাকে, তার কাছে অর্থের মূল্যটা খুব বেশী নয় কাবেরী। তাছাড়া দিয়েই দেখ না দরখাস্ত, রাজীও তো হতে পারে। তাছাড়া লোকটা রাজী হয়ে যায় ভালইনচেৎ আমাদের ক্ষতিই বা কি?

কিন্তু বাবা—এতক্ষণে কৃষ্ণা কথা বলে।

আর কথা নয় কৃষ্ণা। তোমরা এখন যেতে পারো—সঞ্জীব কতকটা যেন মেয়েকে বাধা দিয়েই প্রসঙ্গটা থামিয়ে দিলেন।

বাপের প্রকৃতির সঙ্গে কৃষ্ণা কাবেরী যথেষ্ট পরিচিত, আর দ্বিরুক্তি না করে দুজনে কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

***

মেয়েরা কক্ষ হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলে সঞ্জীব চেয়ার হতে উঠে ক্রাচে ভর দিয়ে দিয়ে কক্ষের আলমারীটার সামনে এসে দাঁড়ালেন।

একটা ড্রয়ার খুলে বের করলেন একটা ফাইল—সেই ফাইলটা খুলতেই বের হলো ৩০/৩২ বৎসরের অপরূপ রূপলাবণ্যময়ী এক নারীর ফটো। ফটোটা চোখের সামনে তুলে ধরে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সঞ্জীব চৌধুরী চাপা স্বরে বলতে থাকেন, করুণা করুণা করুণা! চোখের কোণে দুফোঁটা জল বুঝি এসে জমা হয় বৃদ্ধ সঞ্জীবের। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেন সঞ্জীব চৌধুরী, তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফটোটার দিকে তাকিয়ে চাপা কণ্ঠে বলে ওঠেন, You-You cruel heartless woman, you ruined my life! কিন্তু আজ? কেমন জব্দ, কেমন জব্দ করেছি তোমায়! আমার বুকভরা অফুরন্ত ভালবাসাকে একদিন দুপায়ে তুমি থেঁতলে দিয়েছিলে। নিষ্ঠুর পাষাণ হৃদয়ে তোমার তিলমাত্রও সাড়া জাগাতে পারি নি। কিন্তু আজ! কেমন জব্দ, কেমন জব্দ?…World is too big, নয়?

হঠাৎ পাগলের মতই হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠেন সঞ্জীব চৌধুরী।

.

দীর্ঘ সতের বছর আগে—স্মৃতির পর্দায় আলোকপাত হলো।

হাঃ হাঃ করে একটি সুবেশধারী যুবক হাসছে। সুসজ্জিত একটি ড্রইংরুম। যুবকটির নাম অরুণ মল্লিক। অদূরে সোফার উপরে বসে সুন্দরী, সুবেশা সঞ্জীব চৌধুরীর তরুণী স্ত্রী করুণা।

না–না—হাসি নয়, সত্যি বলছি অরুণ, সে ভীষণ রেগে গিয়েছে। লিখেছে, শীঘ্রই নাকি আমাদের সে চা-বাগানে নিয়ে যাবে

After all the good old Sanjib is really a devoted husband. মিথ্যে তুমি ভয় পাচ্ছ রুণা। চা-বাগানে নিয়ে যাবে তোমার মত একজন সোসাইটি লেডিকে, চা-বাগানের সেই অন্ধকার জীবনে সে কখনই টেনে নিয়ে যেতে পারে না। সকলে মিলে আমরা তীব্র প্রতিবাদ করবো। Vehemently protest করবো।

কিন্তু এ কথাটা তোমরা ভোল কেন অরুণ, আমি তার বিবাহিতা স্ত্রী! তারই অধিকার সর্বাগ্রে–

বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা!

Dont be naughty অরু। সে আমার স্বামী।

অস্বীকার করি না, তাই বলে সীমা লঙ্ন করা কি উচিত?

এমন সময় ছয় বছরের শিশুকন্যা কৃষ্ণা ঘরে এসে প্রবেশ করল।

কৃষ্ণি! কাবি কোথায়?

কাবি ওঘরে খেলছে মা!

মা মেয়েকে কাছে টেনে এনে কুঞ্চিত কেশরাশিতে সস্নেহে হাত বুলাতে থাকেন।

অরুণ বলে, তাছাড়া তোমার এই যমজ মেয়ে কৃষ্ণা কাবেরী, ওদের কথা একবারও কি ভাবছো রুণা? চা-বাগানের বনজঙ্গলে গেলে ওদের লেখাপড়া, মানুষ করা সম্ভব হবে বলে মনে করো? তোমার স্বামী মিঃ চৌধুরী তাঁর নিজ সন্তানের ভবিষ্যৎকে নিশ্চয়ই অবহেলা করবেন না।

মুশকিল তো আমার মেয়ে দুটিকে নিয়েই আরো হয়েছে অরুণ।

এমন সময় বাইরে কাবেরীর উল্লসিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ওমা! দেখবে এসো বাবা এসেছে–

এ কি! উনি আজই এসে গেলেন নাকি! সবিস্ময়ে বলে ওঠে করুণা।

আমি তাহলে এখন চলি রুণা! আজকের পার্টির কথা ভোল নি তো?

না।

আসছো নিশ্চয়ই?

নিশ্চয়ই।

তা হলে চলি। পার্টিতে আবার দেখা হবে।

অরুণ যে দ্বারপথে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল তার ঠিক বিপরীত দ্বারপথে কাবেরীকে কোলে নিয়ে করুণার স্বামী মিঃ সঞ্জীব চৌধুরী এসে কক্ষে প্রবেশ করলেন।

একটু বেশী বয়সেই সঞ্জীব সোসাইটির অন্যতম রত্ন তরুণী করুণাকে বিবাহ করেছিলেন। এবং করুণার অনুপাতে তার স্বামী সঞ্জীবকে বৃদ্ধ বলেই মনে হয়। অতিরিক্ত খাটুনি ও পরিশ্রমে শরীর ভেঙ্গে গিয়েছে, মুখটা লম্বাটে হয়ে গিয়েছে। রগের দুপাশে চুলে পাক ধরেছে।

সঞ্জীব আসাম অঞ্চলের কোন এক চা-বাগানের ম্যানেজার। বেশ মোটা মাইনেই যে কেবল পান তা নয়, পিতৃসম্পত্তি এই বাড়িখানা ছাড়াও আরো খান-দুই বাড়ি কলকাতা শহরে ছিল। কিন্তু আজ আর একখানা বাড়িও তাঁর নিজস্ব বলতে নেই। যে বাড়িখানায় তাঁর স্ত্রী করুণা বর্তমানে আছে সেটাও দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে গিয়েছে, এখন ক্রেতার কাছ হতেই মাসিক দুশ টাকা ভাড়া দিয়ে ওরা আছে।

করুণা ও সঞ্জীবের পরিচয় হয় কোন এক পার্টিতে।

সঞ্জীব চমৎকার আবৃত্তি করতে পারতেন ও বেহালা বাজানোর হাত ছিল তার সত্যিই মিষ্টি। কিন্তু অত্যন্ত চপল, বিলাসী ও অন্তঃসারশূন্য প্রকৃতির মেয়ে করুণা সঞ্জীবের গুণে নয়, তার মোটা মাইনের চাকরি, ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স ও কলকাতা শহরের উপরে তিনখানা বাড়ির লোভেই এবং একান্ত বুদ্ধিমতী, বিধবা, স্কুল-মিসট্রেস মায়ের সৎপরামর্শেই এ বিবাহে অগ্রসর হয়েছিল। সঞ্জীবের বয়স তখন চুয়াল্লিশ পার হয়ে গেছে, করুণা পঞ্চবিংশতিবর্ষীয়া মাত্র।

করুণার কৃপাদৃষ্টি লাভের জন্য অনেক বেকার বড়লোকের সন্তানও স্বল্প আয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠা খুঁজে বেড়াচ্ছে এমন তরুণের দল সর্বদা করুণার পিছনে পিছনে মধুলোভী ভ্রমরের মত গুনগুন রব তুলে ফিরছে তখন।

কিন্তু করুণার জননী মুখে কাউকে কিছু না বললেও মনে মনে কাউকেই ভবিষ্যৎ জামাতা হিসাবে পছন্দ করতেন না।

সঞ্জীব মাসখানেকের ছুটি নিয়ে সেবার কলকাতায় এসে নতুন একটা গাড়ি কিনে এক

অবিবাহিত ব্যারিস্টার বন্ধুর পাল্লায় পড়ে ক্লাবে ও নানা পার্টিতে যাতায়াত করছে।

ঐরকম এক পার্টিতেই সঞ্জীব আবৃত্তি করলে ও বাজিয়ে শোনালে বেহালা। করুণা যেচে এসে সঞ্জীবের সঙ্গে আলাপ করলে।

ক্রমে আলাপ-পরিচয়টা আরো ঘনিষ্ঠ হলো, পরস্পর পরস্পরের বাড়িতে যাতায়াত শুরু করলে। সঞ্জীব আরও এক মাসের ছুটি নিল। অবশেষে করুণার মা-ই একদিন সঞ্জীবের কাছে। বিবাহের প্রস্তাব করলেন কন্যার হয়ে।

সঞ্জীব মনে মনে যে কামনাটা ইদানীং ভীরু সঙ্কোচের সঙ্গে লালন করছিল, করুণার মায়ের প্রস্তাব শুনে অন্তরের সেই ভীরু বাসনা মুক্তির আনন্দে যেন দুকূল ছাপিয়ে গেল।

মৃদু সঙ্কোচের সঙ্গে সঞ্জীব বললে, কিন্তু মা, করুণা কি—

মৃদু হেসে করুণার মা বললেন, রুণার মন না জেনেই কি এ প্রস্তাব আমি তোমার কাছে করছি বাবা! তাছাড়া মেয়ে আমার এদিকে যতই সোসাইটির মধ্যে ঘুরে বেড়াক, ভীষণ লাজুক। আমি তো জানি রুণাকে।

***

যা হোক ঐ মাসেরই শেষে সঞ্জীব ও করুণার বিবাহ হয়ে গেল। এবং বিবাহের পরেই সঞ্জীব করুণাকে নিয়ে চা-বাগানে চলে গেল। দশ-পনের দিন যেতে-না-যেতেই কিন্তু করুণা বলতে শুরু করলে, এ কি ছাইয়ের জায়গা! মনের কথা বলবার একটা লোক নেই। না আছে ক্লাব, একটা হোটেল বা সিনেমা!

সঞ্জীব ভাবলেন, সত্যিই তো, অল্প বয়স করুণার, চিরদিন কলকাতার মত শহরে মানুষ। পাণ্ডব-বর্জিত এই বনজঙ্গলে তার মন টিকবেই বা কেন?

নিজে সঙ্গে করে সঞ্জীব রেখে এলেন করুণাকে কলকাতার বাড়িতে। ভৃত্য, চাকরানী, ড্রাইভার, বামুন নিযুক্ত হলো। করুণা মনের আনন্দে দিন কাটাতে লাগলো। হাতে অজস্র টাকা, বাড়ি, গাড়ি, সোসাইটিতে পজিশন করুণা তার নিজের খেয়ালখুশিতে মশগুল হয়ে উঠলো।

সঞ্জীব মধ্যে মধ্যে আসেন, ছয় সাত দিন থেকে যান। স্ত্রীকে যখনই নিজের কর্মস্থলে যাওয়ার কথা বলেন, করুণা মুখখানি ভার করে। সঞ্জীবের কেমন মায়া হয়, কিছু বলতে পারেন না।

বৎসর দেড়েক বাদে কৃষ্ণা ও কাবেরী যমজ দুটি মেয়ে হলো করুণার।

এবারে আবার সঞ্জীব করুণাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেন নিজের কর্মস্থলে, কিন্তু করুণা রাজী হলো না।

স্ত্রীর ব্যবহারে সঞ্জীব মনে বিশেষ আঘাত পেলেন এবারে, মুখে কিছু বললেন না—কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, জীবনে আর কখনো স্ত্রীকে নিজের কাছে যেতে বলবেন না। থাক সে এখানে, যদি কখনো সে স্বেচ্ছায় যেতে চায় তাঁর কাছে, তবেই নিয়ে যাবেন নইলে নয়।

শাপে বর হল করুণার। আয়ার হাতে মেয়ে দুটির রক্ষণাবেক্ষণের ভার সঁপে দিয়ে করুণা তার পার্টি, ক্লাব নিয়েই হৈ হৈ করে সারাদিন বেড়াতে লাগল।

.

ব্যাঙ্কের জমানো টাকার সংবাদ বিবাহের পর থেকেই সঞ্জীব আর রাখতেন না, স্ত্রীর নামে ব্যাঙ্ক হতে টাকা তুলবার ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছিলেন। বিবাহের বছর চারেক বাদে হঠাৎ একদিন সঞ্জীব আবিষ্কার করলেন ব্যাঙ্ক প্রায় শূন্য।

তাড়াতাড়ি ছুটে এলেন সঞ্জীব কলকাতায়। শুধু যে ব্যাঙ্ক শূন্য তা নয়, বহু জায়গায় ধারও হয়েছে করুণার প্রচুর। সেই ঠেলা সামলাতে গিয়ে একখানা বাড়ি বিক্রয় হয়ে গেল। তথাপি সঞ্জীব করুণাকে কিছু বললেন না।

দুটো বছরও তারপর গেল না—বাকী দুখানা বাড়িও দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে গেল, সময় থাকতে করুণাকে কিছু না বলবার জন্যই। কিন্তু এবারে আর সঞ্জীব চুপ করে থাকতে পারলেন না।

একদিন স্ত্রীকে বললেন, করুণা, এতদিন তোমায় আমি কোন কথা বলি নি, কিন্তু আর বলে পারছি না, এবার থেকে যদি তুমি সাবধানে না চল, ভবিষ্যতে তোমায়ই অসুবিধায় পড়তে হবে।

করুণা স্বামীর দিকে বিলোল কটাক্ষ হেনে বললে, সোনার হরিণের দাম কি কখনো কমে?

তারপর স্বামীর দেহের উপরে এলিয়ে পড়ে হাসতে হাসতে বললে, তাই বলে কঞ্জুস নাম কিনতে পারবো না। তোমার স্ত্রীর societyতে একটা position আছে তো!

সমস্ত আঘাতই সঞ্জীব সহ্য করেছিলেন করুণার দিক থেকে কিন্তু শেষ ও চরম আঘাত এলো যখন তিনি একটা উড়ো চিঠি থেকে জানতে পারলেন, করুণা অরুণ নামে কোন এক তরুণ ব্যারিস্টারের সঙ্গে কুৎসিত জীবনযাপন করছে, তারই স্বোপার্জিত অর্থে।

গোপনে সংবাদ নিয়ে সঞ্জীব জানলেন চিঠির একটি বর্ণও মিথ্যা নয়। তথাপি করুণার প্রতি তার হৃদয়ভরা ভালবাসা তাঁকে রূঢ় হতে দিল না।

কেবল একখানা চিঠি লিখলেন, তিনি আসছেন—করুণা যেন প্রস্তুত থাকে, এবারে তাকে তিনি সঙ্গে নিয়েই আসবেন।

করুণা স্বামীর চিঠি পেয়েও এতটুকু বিচলিত হলো না, কারণ স্বামীর তার প্রতি যে কি প্রগাঢ় ভালবাসা সেটা তার অবিদিত ছিল না।

সেদিন সঞ্জীব আসবার একটু আগে সেই সম্পর্কেই করুণা ও অরুণের মধ্যে কথাবার্তা চলছিল।

কাবেরীকে কোলে নিয়ে স্বামীকে হঠাৎ কক্ষে প্রবেশ করতে দেখে করুণা চিৎকার করে আয়াকে ডাকল, আয়া—আয়া—

আয়া ঘরে এসে ঢুকলো হন্তদন্ত হয়ে, জি মেমসাব–

বেবীকো লে যাও। দেখতা নেই—সা আভি আয়া, কেতনা পরেশান হুয়া—

সঞ্জীব বাধা দিলেন, না না, থাক।

No No, you look so tired darling! কাবি—যাও খেলগে যাও—

মাকে মেয়েরা যমের মতই ভয় করে, কাবেরী তাড়াতাড়ি বাপের কোল থেকে নেমে চলে গেল।

তারপর কেমন আছো?–করুণা প্রশ্ন করে।

ভাল—সব ready করে রেখেছে তো? পরশুই রওনা হবো আমরা।

এত তাড়া কেন? রহস্যপ্রিয় কণ্ঠে করুণা বলে।

কেন—তুমি আমার চিঠি পাওনি?

পেয়েছি গো পেয়েছি—

ঐদিন সন্ধ্যার মুখে সঞ্জীব তার কক্ষমধ্যে বসে কি একটা ইংরাজী বই পড়ছেন।

অপরূপ সাজসজ্জায় করুণা এসে স্বামীর সামনে দাঁড়াল।

ব্যাপার কি, হঠাৎ এত সেজেছো যে?

একটা পার্টি আছে মিঃ চাকলাদারের ওখানে—

পার্টি?

হাঁ-ফিরতে একটু রাত হবে।

আজ পার্টিতে না গেলেই নয় করুণা?

ওঃ ডিয়ার! কি বলছো তুমি? আমার জন্য সবাই হা-পিত্যেশ করে বসে থাকবে—

সত্যিই I am serious, রুণা। আজ পার্টিতে তোমার যাওয়া হবে না। ফোন করে দাও—

 Dont be so jealous। আচ্ছা চলি–

রঙীন প্রজাপতির মতই যেন রূপের একটা ঢেউ তুলে করুণা স্বামীকে আর দ্বিতীয় বাক্য পর্যন্ত উচ্চারণ করার অবকাশ মাত্র না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

একটু পরেই গাড়ির শব্দে জানা গেল করুণা চলে গেল।

স্তম্ভিত হয়ে সঞ্জীব ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলেন।

অনেক রাত্রি। কৃষ্ণা কাবেরী ঘুমিয়েছে।

শয়নকক্ষে একাকী বসে বসে সঞ্জীব বহুদিন বাদে বেহালাটা বাজাচ্ছিলেন। অনেকক্ষণ ধীরে ধীরে বেহালা বাজিয়ে থামবার পর হঠাৎ ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনিতে তাঁর চমক ভাঙল।

রাত্রি একটা। আশ্চর্য, এখনো করুণা ফিরল না! মুখে বিরক্তির ছায়া নেমে এলো সঞ্জীবের।

ঘরের মধ্যে পায়চারি সুরু করলেন সঞ্জীব আর বেহালাটা একপাশে রেখে ঘন ঘন দেওয়াল-ঘড়ির দিকে তাকাতে লাগলেন। এমন সময় নিচে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। এগিয়ে এলেন সঞ্জীব জানালাটার ধারে।

নিচের গেটের সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, আর তার স্ত্রী করুণা ও অরুণ পরস্পর পরস্পরের কাছ থেকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানাচ্ছে।

মুহূর্তে দাবাগ্নির মতই সমস্ত অন্তর জ্বলে ওঠে সঞ্জীবের।

অপেক্ষা করতে লাগলেন ঘরের মধ্যেই দাঁড়িয়ে।

একটু পরেই সিঁড়িতে চঞ্চল পদশব্দ ও সেই সঙ্গে জড়িত কণ্ঠে গানের একটি কলি শোনা গেল,–

কাছে যবে ছিল তারে হলো না চাওয়া—

করুণা কমধ্যে এসে প্রবেশ করল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই বজ্রকঠিন কণ্ঠ সঞ্জীবের শোনা গেল, করুণা!

করুণার তখন দাঁড়াবার মতও অবস্থা নয়, রীতিমত টলছে, চোখ দুটো নেশার ঘোরে বুজে আসছে, ঢুলু ঢুলু।

করুণা!

Oh dear! Please—not now! Im feeling so sleepy!

জড়িত, ক্লান্ত কণ্ঠে কথা কয়টি বলে করুণা যেমন শয়নকক্ষের দিকে পা বাড়াতে যাবে, তীক্ষ্ণ কণ্ঠ আবার শোনা গেল সঞ্জীবের, শোনা করুণা, দাঁড়াও। তোমার সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে—

করুণা আবার যাবার জন্য পা বাড়িয়ে জড়িত কণ্ঠে বলে ওঠে, Oh sweety, dont be so cruel! কাল-কাল সকালে সব-সব শুনবো–

করুণা! করুণা এবারে একটা চেয়ারে বসে পড়ে।

ছিঃ! এত দূর তোমার অধঃপতন হয়েছে! পরপুরুষকে নিয়ে শুধু যে ঢলাঢলি করছো তা নয়, ইতর মেয়েমানুষের মত মদও খেতে শুরু করেছ!

মদ! No No-শ্যাম্পেন—শেরী—that is not liquor!

Shut up! বাঘের মতই গর্জন করে ওঠেন সঞ্জীব, স্বৈরিণী!

হঠাৎ যেন করুণার নেশাটা টুটে গেল, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠলো সে, সঞ্জীব, how dare you insult me!

Insult! অপমানের কোন জ্ঞান আজ আর তোমার আছে? ভদ্রঘরের বৌ, ভদ্রলোকের স্ত্রী-সন্তানের জননী হয়ে যে জঘন্য কুৎসিত জীবন তুমি যাপন করছে তোমার লজ্জা নেই কিন্তু আমার গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হচ্ছে।

সঞ্জীব! ভুলে যেও না আমি তোমার বিবাহিত স্ত্রী হলেও নিজস্ব আমার একটা মতামত, একটা স্বাধীনতা আছে—

এর নাম স্বাধীনতা! You shameless filthy woman!

সঞ্জীব!

তুমি না শিক্ষিতা? স্বামী বর্তমানে যে জঘন্য রুচিত পরিচয় তুমি আজ দীর্ঘ সাত বছর ধরে দিয়েছে—কি বলবো, তুমি আমার সন্তানের জননী, নইলে–

নইলে কি করতে? বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে?

তাড়িয়ে দিতাম? না। অত বড় বোকা সঞ্জীব চৌধুরী নয়। তোমাকে আজ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবো আর তুমি আমার পরিচয়ের শেষ চিহ্নটুকু বহন করে নিয়ে সর্বত্র কাদা ঘেঁটে বেড়াবে, নিজের সর্বাঙ্গে কালি মাখবে—সেই সঙ্গে আমার সর্বাঙ্গে কালি ছিটাবে!

একটু থেমে সঞ্জীব আবার বলেন, না করুণা, সে সুযোগ এ জীবনে আর তোমায় আমি দেবো না। আমার অফুরন্ত বুকভরা ভালবাসা, বিশ্বাস ও ধৈর্যের শেষ পাওনাগণ্ডাটুকুও পর্যন্ত তুমি মিটিয়ে দিয়েছে। অনেক দিয়েছো তুমি আমায় এই জীবনের সুদীর্ঘ সাত বছর ধরে হাঁ অনেক দিয়েছে।

করুণা এবারে বাধা দিয়ে উঠলো, থাক। তোমার লেকচার শোনবার মত আমার এখন ধৈর্য নেই, তুমি মনে করো না, তোমার এই ঘর ছাড়া এত বড় দুনিয়ায় আর জায়গা নেই—World is too big! এরপর আমারও এখানে থাকা সম্ভব নয়। এখুনি আমি চলে যাচ্ছি–

করুণা পাশের কক্ষে, যেখানে ছোট মেয়ে দুটি কৃষ্ণা কাবেরী ঘুমাচ্ছে সেই ঘরের দরজার দিকে অগ্রসর হতেই গম্ভীর বজ্রকঠিন কণ্ঠে সঞ্জীব বলে ওঠেন, ওদিকে কোথায় যাচ্ছ? দাঁড়াও!

স্তম্ভিত, হতচকিত হয়ে করুণা তার চলমান পা দুটো সহসা যেন থামিয়ে, কুঞ্চিত করে তাকায় সঞ্জীবের মুখের দিকে, I want to give a parting kiss to my kiddies।

না। ও ঘরের দরজা তোমার কাছে চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তোমার ও অপবিত্র দেহের স্পর্শও আমার সন্তানদের গায়ে তোমায় আজ আর আমি লাগাতে দেবো না

ওঃ এতদূর! কিন্তু ভুলে যাচ্ছো ওরা আমারও সন্তান। I have got legal rights!

Legal rights! তোমার সন্তান সেটাই আজ ওদের জীবনের সবচাইতে বড় অভিশাপ, সবচাইতে বড় ক্লঙ্ক; সন্তানই বটে—যে মা সন্তানের জন্ম মাত্র দিয়ে পশারিণীর বৃত্তি নিয়ে–-

সঞ্জীব! বাঘিনীর মত গর্জন করে ওঠে করুণা, এবং মুহূর্তে করুণার সর্বাঙ্গ যেন জ্বলে ওঠে, ও পরক্ষণেই হাতের কাছে স্ট্যাণ্ডের ওপরে রক্ষিত ফুলসমেত পিতলের ফুলদানীটা চোখের। নিমেষে তুলে নিয়ে সজোরে নিক্ষেপ করে সঞ্জীবকে লক্ষ্য করে। ঠং করে সঞ্জীবের কপালের উপরে গিয়ে ফুলদানীটা আঘাত করে, ঝরঝর করে রক্ত পড়ে কপালটা কেটে গিয়ে; একটা আর্তনাদ করে সঞ্জীব বসে পড়েন। কয়েকটি মুহূর্ত, তারপর উঠে কোনমতে এগিয়ে গিয়ে ড্রয়ার থেকে লোডেড রিভলভারটা হাতে নিয়ে করুণার দিকে এগিয়ে এল সঞ্জীব। রাগের মাথায় অকস্মাৎ ফুলদানী স্বামীর কপালে ছুঁড়ে মেরেই কতকটা যেন বোকা বনে গিয়ে স্থাণুর মত দাঁড়িয়েছিল, এখন রিভলভার হাতে স্বামীকে এগিয়ে আসতে দেখে ভয়ে, আতঙ্কে আর্ত চিৎকার করে ওঠে, না, না—খুন করো না, আমায় খুন করো না। আমি, আমি

মরতে এত ভয়! বলেই সঞ্জীব পাগলের মত অট্টহাসি হেসে ওঠে, তারপর বলে, ভেবেছিলাম তোমায় খুনই করবো, কিন্তু না, খুন তোমায় আমি করবো না করুণা। তোমার মত একটা নরকের কীটকে খুন করে হাত আমার কলঙ্কিত করবো না। এখুনি এক বস্ত্রে, রিক্ত দেহে, এ গৃহ এই মুহূর্তে তোমায় ত্যাগ করে যেতে হবে। বলতে বলতে গিয়ে আলনা হতে সাধারণ একটা শাড়ি টেনে করুণার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে কঠোর কণ্ঠে সঞ্জীব বললে, আমারই অর্থে ক্রয় করা তোমার ঐ মূল্যবান জড়োয়ার চোখ-ঝলসান গহনাগুলো তোমায় ত্যাগ করতে হবে, এমন কি পরিধানের ঐ শাড়িটি পর্যন্ত। ঐ সাধারণ শাড়িখানা পরে একবস্ত্রে একেবারে রিক্ত হয়ে এই মুহূর্তে এ গৃহ তোমাকে ত্যাগ করতে হবে। যাও—তাড়াতাড়ি করো, যত তাড়াতাড়ি এ গৃহ ছেড়ে তুমি যাও ততই মঙ্গল। তোমার পাপে এ গৃহের বাতাস পর্যন্ত বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। যাও—

বেশ।

একে একে গহনাগুলো গা হতে করুণা খুলে দিল, তারপর স্বামীর দেওয়া শাড়িখানা পরে নিল।

দাঁড়াও—এখনও একটা জিনিস বাকী আছে, তোমার সিঁথির ঐ সিঁদুর, আমার সামনে ওটা মুছে ফেলতে হবে। নিশ্চিহ্ন করে ঘষে মুছে ফেলতে হবে।

করুণা বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

মোছ! মোছ সিঁথির সিঁদুর! বলতে বলতে সঞ্জীব নিজেই এগিয়ে এসে পাগলের মত মুছে দেয় ঘষে করুণার মাথার সিঁদুর।

হ্যাঁ, এবারে যাও। পৃথিবী অনেক বড়, কিন্তু একটা কথা, আমার শেষ কথা, তোমার সিঁথির সিঁদুর মুছে দিলেও সমাজের চোখের দৃষ্টি তো মুছে দিতে পারবো না, তারা আঙুল তুলে টিটকারী দেবে। কিন্তু সেদিন আর আমাকে তারা খুঁজে পাবে না—সে টিটকারী তোমার গায়েই ফিরে আসবে। যাও–

হঠাৎ এমন সময় চমকে উঠলেন সঞ্জীব, ইতিমধ্যে একসময় কৃষ্ণা ঘুম ভেঙে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।

কৃষ্ণা ডেকে ওঠে, মা!

হঠাৎ যেন সঞ্জীব পাগলের মত ছুটে গিয়ে করুণাকে প্রাণপণে ধাক্কা দিতে দিতে ঘর হতে ঠেলে বের করে দেন, যাও–যাও!

কৃষ্ণা কেঁদে ওঠে চিৎকার করে, মা–মা!

ঠেলতে ঠেলতে করুণাকে ঘর হতে বের করে দিতে গিয়ে চৌকাঠে পা বেধে সঞ্জীব হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন।

করুণা ছুটতে ছুটতে নিচে চলে গিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

তারপর আর কেউ করুণার সংবাদ কোন দিনও পায় নি।

***

সেই রাত্রেই কৃষ্ণা কাবেরীকে নিয়ে সঞ্জীব বাড়িতে তালা দিয়ে বের হয়ে পড়লেন। চাকুরিস্থলে আর ফিরে গেলেন না, দেশ হতে দেশান্তরে কৃষ্ণা কাবেরীকে নিয়ে ঘুরতে লাগলেন।

এদিকে সেরাত্রে চৌকাঠে পা বেধে পড়ে গিয়ে পায়ের হাড়ে প্রচণ্ড আঘাত লাগে সঞ্জীবের। ক্রমে সেই পা নিয়ে সঞ্জীবকে অনেক ভুগতে হলো এবং শেষটায় পা-টা অকর্মণ্য হয়ে গেল।

ঘুরতে ঘুরতে আবার সুদীর্ঘ দশ বছর পরে সঞ্জীব কলকাতায় ফিরে এলেন এবং ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করলেন অতীতকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে।

ইতিমধ্যে কৃষ্ণা কাবেরী প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাস করেছিল। প্রাইভেটে তারা আই. এও পাস করল। কিন্তু এদিকে সঞ্জীবের সমস্ত সঞ্চিত অর্থ গেল ফুরিয়ে।

নিজে অথর্ব হয়ে পড়েছেন, অগত্যা মেয়েদের টেলিফোনে চাকরি নিতে দেওয়া ছাড়া আর উপায়ান্তর রইলো না।

মেয়েদের চাকরি করতে দিলেও সঞ্জীব মেয়েদের প্রতি সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। এবং ছোটবেলা হতেই এমন কঠোর শাসনের মধ্যে মেয়েদের গড়ে তুলেছিলেন যে, মেয়েরা বাপকে বাঘের মতই ভয় করতো। বাপের অমতে এক পাও এগুবার সাহস ছিল না।

আসলে সঞ্জীব করুণার ব্যাপারে সমস্ত নারীজাতির উপরেই বিতৃষ্ণ ও সন্দিহান হয়ে উঠেছিলেন। এবং তাদের তিলমাত্র স্বাধীনতা দেবারও ইচ্ছা তার হত না। সর্বদা ভয় ছিল, কখন মেয়েরা তার অধিকারের বাইরে চলে যায়-দশ চক্ষু মেলে তাই যেন তিনি সর্বদা মেয়েদের পাহারা দিতেন। এমন কি যতদিন বেঁচে থাকবেন, মেয়েদের বিবাহ পর্যন্ত দেবেন না, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে রেখেছিলেন।

.

ডাঃ সুকুমার গুপ্তের চেম্বার।

সকালের ডাকে আজ অনেকগুলো চিঠি এসেছে। ডাক্তার চিঠিগুলো একটার পর একটা খুলে পড়ছে। হঠাৎ একখানা চিঠি পড়তে পড়তে ডাক্তারের মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

ডাক্তার তাড়াতাড়ি পাশ থেকে ফোনটা তুলে নেয়, Please put me to south…. একটু পরে ওপাশ হতে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, হ্যালো!

কে, কিরীটী নাকি?

কে, ডাক্তার? কি খবর ভাই?

সুখবর। তোর কৃষ্ণা কাবেরী দরখাস্ত করেছে—

সুখবর। দিয়ে দাও—জবাব দিয়ে দাও এখুনি। শুভস্য শীঘ্রম্।

কিন্তু—

কিন্তু আবার কি? না না—appointment দিয়ে দাও।