কর্নেলের হেঁয়ালি

০৭. কর্নেলের হেঁয়ালি

হাড়কাঁপানো শীতের সকালে বরমডিহি রেলস্টেশনে যখন ট্রেন থেকে নামলাম, তখনও চারদিকে গাঢ় কুয়াশা। কয়েক হাত দূরে কিছু দেখা যায় না। কর্নেল হনুমানটুপি পরেছেন। তাই ওঁর দাড়ি ঢেকে গেছে এবং মুখের খানিকটা মাত্র দেখা যাচ্ছিল। সম্ভবত এখন এটাই ওঁর ছদ্মবেশ! একটা ওভারকোটও চাপিয়েছেন। গায়ে। প্রকাণ্ড শরীর আরও প্রকাণ্ড দেখাচ্ছে। পিঠে আটকানো বোঁচকা এবং হাতে সুটকেস। গলায় ঝুলন্ত বাইনোকুলার ওভারকোটের ভেতর লুকিয়ে আছে।

আমার মাথায় টুপি এবং আষ্টেপিষ্টে জড়ানো মাফলার। পুরু জ্যাকেটের ভেতরও শীতের ঠাণ্ডা হিম থাবা টের পাচ্ছি। কর্নেলের পরামর্শে পশমের দস্তানা পরেছি। হাতে একটা হাল্কা সুটকেস।

বরমডিহি একটা হিলস্টেশন। পাহাড় দুভাগ করে রেললাইন চলে গেছে। পাড়ের গায়ে জঙ্গল কুয়াশায় ঢাকা। অক্টোবরে আমরা এখানকার নিসর্গের অন্যরূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ডিসেম্বরের সকালে এখানকার নিসর্গের অন্য রূপ দেখে আমি ভড়কে গেলাম। এর চেয়ে দার্জিলিং-কালিম্পং অনেক আরামদায়ক, যদিও সেখানে বরফ পড়ে। এখানে বরফ পড়ে না। কিন্তু এ কী বিচ্ছিরি ঠাণ্ডা!

কিন্তু এই সাংঘাতিক ঠাণ্ডার মধ্যেও কী ভিড়! কর্নেল হনুমানটুপির আড়াল থেকে বললেন, শীতে মুনলেক ট্যুরিস্টদের বড় আকর্ষণ। এ সময় কালো দৈত্যের উপদ্রব হয় না। তবে বেশিরভাগই বাঙালি। পিকনিক করতে আসে আশেপাশের শিল্পাঞ্চল থেকে। সব হোটেল, ট্যুরিস্ট লজ, সরকারি বাংলো গিজগিজ করে। কলকাতার বাবুদের বাড়িগুলো ভাড়া দিয়ে কেয়ারটেকাররা এ সময় প্রচুর কামিয়ে নেয়।

উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, তা হলে এবার আমরা উঠব কোথায়?

তরুণবাবুর বাংলোবাড়িতে।

তরুণবাবু? কোন তরুণবাবু?

তোমাকে যখন তরুণবাবু বলছি, তখন তোমার বোঝা উচিত এখন একজন তরুণবাবুই আছেন, যাঁকে তুমিও চেনো।

অবাক হয়ে বললাম, শচীনবাবুর ভাই তরুণবাবু? ওঁর এখানে বাংলোবাড়ি আছে নাকি?

থাকা স্বাভাবিক। বৈমাত্রেয় দাদা ওঁকে পৈতৃক বাড়িতে ঢুকতে দেননি। কাজেই বিত্তবান ছোটভাই ক্ষোভে দুঃখে এবং জিদ করেই এখানে সুদৃশ্য বাংলোবাড়ি তৈরি করেছেন।

কিন্তু তরুণবাবুর সঙ্গে আপনার এ ব্যাপারে কখন কথা হল?

কাল দুপুরে তুমি যখন ঘুমোচ্ছিলে, তখন টেলিফোনে কথা হয়েছে। কর্নেল হনুমানটুপির আড়ালে হাসলেন এবং চোখে সেই কৌতুকের হাসি জ্বলজ্বল করে উঠল। দাদাকে চিট করার জন্য তরুণবাবু সব সময় তৈরি। কাজেই আমি সেই সুযোগটা নিয়েছি আর কী! এবার দেখা যাক, ঝুলির ভেতর থেকে কার বেড়াল বের হয়।

আপনি ওঁকেও কি বলেছেন শ্যামবাবুরই রক্তাক্ত লাশ দেখেছিলেন?

বলেছি। তাই শুনেই উনি–যাক্। এখন এসব কথা নয়। যা অবস্থা দেখছি, যানবাহন পাব না। পায়ে হেঁটে যেতে হবে।

বাংলোবাড়িটা কোথায়? কত দূরে?

এখান থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার হবে। শচীনবাবুর সেই বাড়ির উল্টোদিকে কিছুটা দূরে একটা টিলার মাথায়। বাড়িটার নাম হিলটপ। তরুণবাবু জিদ করে আস্ত একটা পাহাড় কিনে ফেলেছিলেন।

সেই কনকনে ঠাণ্ডা এবং কুয়াশায় বাঁদিকে নতুন টাউনশিপ এবং বাজার এলাকা ছাড়িয়ে আমরা যে রাস্তায় মোড় নিলাম, সেটাই বরমডিহি-জাহানাবাদ রোড। সৌভাগ্যক্রমে একটা খালি ট্রাক পাওয়া গেল। ট্রাকটা একটা কাঠগোলা থেকে সবে স্টার্ট দিয়ে রাস্তায় উঠেছিল। ট্রাক ড্রাইভাররাও যে এই মরশুমে বেশ কামিয়ে নেয়, তা বুঝলাম। পঞ্চাশ টাকা হেঁকেছিল। তিরিশে রফা হল। তখন তিরিশ টাকা অনেক টাকা!

কিন্তু কী আর করা যাবে? কর্নেল যা পারেন, আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। মিলিটারির লোক। তার ওপর এই বয়সেও গায়ে সাংঘাতিক জোর। এদিকে ওইটুকু হেঁটেই আমি ভিজে বেড়ালছানা হয়ে গেছি।

কুয়াশার মধ্যে হেডলাইট জ্বেলে ট্রাকটা সাবধানে যাচ্ছিল। প্রায় আধঘণ্টা পরে ড্রাইভার বলল, হিলটপ বাংলো বোলা? উতারিয়ে।

টাকা মিটিয়ে দুজনে নামলাম। ততক্ষণে কুয়াশা কিছুটা কমেছে। সূর্যের চেহারা বিবর্ণ হলুদ থালার মতো এবং মাঝে মাঝে কুয়াশার প্রবাহ চলেছে। ট্রাকটা চলে গেল। কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন জয়ন্ত! তোমার দুর্ভাগ্য! হাঁটতেই হবে।

কেন?

মনে হচ্ছে, আধ কিলোমিটার এগিয়ে এসেছি। হু! ওই তো মুনলেক যাওয়ার রাস্তা!

খাপ্পা হয়ে বললাম, ট্রাক ড্রাইভারটা তো মহা পাজি!

নাহ। ওর দোষ নেই। আমিও তো কুয়াশায় কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। চলো, মুনলেক রোড দিয়ে ঘুরে শর্টকাট করি। ওই রাস্তার উত্তরে হিলটপ বাংলো। সেবার বাইনোকুলারে দূর থেকে দেখেছিলাম। কর্নেল হাঁটতে হাঁটতে বললেন, এস। জগিং করা যাক্। তা হলে ঠাণ্ডাটা কেটে যাবে। কাম অন!

বলে সত্যিই উনি জগিং শুরু করলেন। অগত্যা আমিও শুরু করলাম। কিন্তু সুটকেস হাতে জগিং বা দৌড়ব্যায়াম সহজ নয়। তাতে পাথর, ঝোপঝাড়, উঁচুউঁচু গাছের জঙ্গল। একবার হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিলাম। দ্বিতীয়বার হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। কর্নেল আমাকে টেনে ওঠালেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই কুয়াশা মোটামুটি কেটে গেল। হিলটপ বাংলো কর্নেলের বাইনোকুলারে ধরা পড়ল। তারপর কী করে যে চড়াই বেয়ে বাংলোর গেটে পৌঁছুলাম কে জানে! কর্নেল হয়তো একটা আস্ত চুম্বক।

কেয়ারটেকার আমাদের দেখে দৌড়ে এলেন। আপনি কি কর্নেল সায়েব? নমস্কার স্যার। সায়েব ট্রাঙ্কল করেছিলেন ওঁর লোকাল ব্রাঞ্চ অফিসে। সেখান থেকে কাল সন্ধ্যায় আমাকে খবর দিয়ে গেছে। কিন্তু ওখান থেকে স্টেশনে গাড়ি পাঠানোর কথা। যায়নি গাডি? কী আশচর্য! বৈজু! বৈজু! ইধার আও।

একজন লোক দৌড়ে এল। কেয়ারটেকারের নির্দেশে সে আমাদের সুটকেস দুটো নিয়ে গেল। কর্নেল সহাস্যে বললেন, গাড়ি নিশ্চয় গিয়েছিল। তবে গাড়ি সম্ভবত সাদা দাড়ি খুঁজছিল এবং দাড়ির দর্শন পায়নি। কারণ তা ঢাকা ছিল।

কেয়ারটেকার হেসে ফেললেন।

সুন্দর সাজানো একটা ঘরে আমাদের নিয়ে গিয়ে তিনি রুম হিটার চালিয়ে ঘর গরমের ব্যবস্থা করলেন। কর্নেল বললেন, আপনিই নন্দবাবু?

আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার নাম নন্দকুমার রায়। সায়েব কিংবা তাঁর গেস্ট এলে আমি আগাম চলে আসি। নৈলে বৈজই সব দেখাশোনা করে। বেজু জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবেতেই এক্সপার্ট। চায়ের ব্যবস্থা করে আসি।

কফি পেলে ভাল হয়। আমি কিন্তু কফিরই ভক্ত।

নন্দবাবু হাসলেন। কফিও আছে। কোনও অসুবিধা নেই স্যার! সায়েবও আসবেন বলেছেন। তাই সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।

নন্দবাবু চলে গেলে বললাম, আপনি ভবিষ্যতে আর দাড়ি ঢাকবেন না। ওঃ! আপনি দাড়ি না ঢাকলে এই কষ্টটা পেতাম না।

ডার্লিং! কথায় আছে না কেষ্ট পেতে হলে কষ্ট করতে হয়?

কী কেষ্ট পেলেন শুনি?

কর্নেল চোখে হেসে বললেন, শুধু কেষ্ট নয়, তার সঙ্গিনী রাধাকেও।

অ্যাঁ?

চেপে যাও, ডার্লিং! স্পিকটি নট। বলে ওভারকোট এবং হনুমানটুপি খুলে ফেললেন কর্নেল। চাপা স্বরে ফের বললেন, ট্রাক ড্রাইভারকে বখশিস দেওয়া উচিত। আমাকে ঠিক জায়গায় সে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।

নন্দবাবু এলেন। কফি এসে যাচ্ছে। ব্রেকফাস্ট কখন খাবেন স্যার?

ঘড়ি দেখে কর্নেল বললেন, এখন সাড়ে আটটা। ন-টায় খাব বরং।

বৈজু আছে। কোনও অসুবিধে হবে না। আমি একবার বাড়ি ঘুরে বাজার টাজার করে আসছি।

আপনি কি বরমডিহির বাসিন্দা?

আজ্ঞে তিনপুরুষের বাসিন্দা। বলে নন্দবাবু ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেলেন। আমি বাথরুমে যাচ্ছিলাম। লক্ষ্য করলাম, নন্দবাবু সাইকেল নিয়ে লনে হাঁটছেন। বোঝা গেল, ভদ্রলোক যদিও কেয়ারটেকার, এই বাংলোয় আসেন কদাচিৎ। সম্ভবত বৈজুই কার্যত কেয়ারটেকারের সব দায়িত্ব পালন করে।

বাথরুম থেকে ফিরে দেখি, টেবিলে কাপ, ট্রেতে কফির পট, দুধ, চিনি এবং দুটো মস্ত পেয়ালা। প্লেট ভর্তি নানারকম স্ন্যাক্সও আছে। রুম হিটারের কাছাকাছি বসে আরামে কফি খেতে খেতে বললাম, দা হলে দৈবাৎ বিগ সন্ধান পেয়ে গেছেন?

কর্নেল চোখ কটমট করে তাকালেন।

বললাম, সরি! স্পিকটি নট।

কিছুক্ষণ পর বৈজু ট্রে নিতে এল। কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, আচ্ছা বৈজু! দেখো তো ইধার। ইয়ে আদমিকো পহচানতা তুম?

কর্নেল পকেট থেকে শ্যামবাবুর ছবি বের করে তাকে দেখালেন। বৈজু ঝুঁকে ছবিটা দেখল। গম্ভীর মুখে বলল, মালুম, কোহি জগাহ্ পর দেখা। লেকিন য়্যাদ নেহি আতা।

খ্যালসে দেখো, বৈজু!

সে মাথা চুলকে বলল য়্যাদ নেহি আতা হজুর!

আচ্ছা! ইয়ে চার পিকচার দেখো!

কর্নেল পকেট থেকে শ্যামসুন্দরের চারটে রিটাচ করা ছবি টেবিলে সাজালেন। এইসব ছবিতে বয়সের ছাপ দেওয়া হয়েছে এবং কোনও ছবিতে গোঁফ, কয়েকরকম ছাঁটের দাড়ি আঁকা।

বৈজু ঝুঁকে ছবিগুলো দেখছিল। চিবুকে দাড়িওয়ালা ছবিটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে একটু হাসল। ইয়ে তো ওহি আদমি।

কৌন?

দেড়-দো মাহিনা আগে সাব কা সাথ মুলাকাত করনে আয়া।

উসটাইম তুমকা সাব হেঁয়া থা?

সাব দো-দিনকে লিয়ে আয়া, হজুর! ফির চলা গেয়া কলকাত্তা।

ইয়ে আদমি উনহিকা সাথ চলা গেয়া?

নেহি হুজুর! সাব একেলা চলা গেয়া। ইয়ে আদমিকা সাথ সাবকা বহত বাতচিত করার হুয়া। সাব ইসকো নিকাল দিয়া ঘরসে।

দো মাহিনা নেহি! দেড় মাহিনা আগে।

বৈজু একটু হাসল। হোগা দেড় মাহিনা। তো কাহে হামকো ইয়ে সব বাত পুছতা হুজুর?

কর্নেল পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট ওর হাতে দিয়ে বললেন, বখশিস্ বৈজু। কিসিকো মাত বোলো হাম তুমকো পিকচার দেখায়, কী ইস্ তরাহ কোই বাত কিয়া। সমঝা?

হাঁ হুজুর!

সে সেলাম ঠুকে সন্দিগ্ধ ভঙ্গিতে ট্রে নিয়ে বেরিয়ে গেল। বললাম, তা হলে দেখা যাচ্ছে, তরুণবাবুও আপনাকে অনেক কথা গোপন করছেন! অক্টোবরে শ্যামবাবুর সঙ্গে তরুণবাবুর এখানে দেখা করার কথা ছিল এবং দেখা হয়েছিল। সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সম্ভবত বিগ্রহের দরদাম নিয়ে তর্ক হয়েছিল। বেশি দাম চাওয়ায় চটে গিয়ে তরুণবাবু তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন। কিও আমার অবাক লাগছে, তরুণবাবু বিগ্রহচোরকে তক্ষুনি পুলিশে দেননি। কেন? তারও পূর্বপুরুষে অমূল্য সম্পদ ওই বিগ্রহ। চোরকে হাতে পেয়ে ছেড়ে দিলেন কেন?

কর্নেল চোখ বুজে চরুট টানছিলেন। আমার কথাগুলো যেন ওর কানে ঢুকল না। হঠাৎ চোখ খুলে বেমক্কা হাঁক দিলেন, বৈজু! ইধার আও! বৈজু কিচেনের দিক থেকে সাড়া দিল। তারপর তেমনই সন্দিগ্ধ ভঙ্গিতে আড়ষ্টভাবে ঘরে ঢুকে সেলাম দিল।

কর্নেল বললেন, ঔর এক পিকচার দেখো বৈজু!

উনি এবার পকেট থেকে জাল ভোলা ওরফে হারাধনের ছবি বের করে দেখালেন। বৈজু কঁচুমাচু হেসে বলল, হুজুর। ইয়ে তো সাবকা সাথ কলকাত্তাসে আয়া। সাবকা সাথ চলাভি গেয়া। ইস্‌কা নাম–

হারাধন।

হাঁ হুজুর! সাবকা নোকর-উকর হোগা। লেকিন বলে সে হাত জোড় করল। হুজুর! মুঝে মালুম নেহি পড়ে, কাহে আপ ইয়ে সব বাত পুছতা! হাম গরিব আদমি হুজুর! নোকরি চলা যায় তো ভুখসে মর যায়েগা।

কর্নেল আর একটা দশ টাকার নোট ওর হাতে গুঁজে দিয়ে ওকে আশ্বস্ত করলেন। বৈজু আড়ষ্টভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কর্নেল হিন্দিতে বললেন, তোমার সায়েব থাকার সময় কি এখানে কালো দৈত্যের উপদ্রব হয়েছিল?

বৈজু বলল, হ্যাঁ হুজুর! তার পরদিন সায়েব কলকাতা ফিরে গিয়েছিলেন।

কর্নেল আপন মনে বললেন, ২৬শে অক্টোবর তরুণবাবু কলকাতা ফিরে যান।

হুজুর?

কিছু না তুমি এস বৈজু। চিন্তা কোরো না। এসব কথা কেউ জানবে না।

বৈজু চলে গেল। কর্নেলকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। বাইনোকুলার হাতে বাইরের বারান্দায় গেলেন উনি। বাইরে ততক্ষণে রোদ ফুটেছে।

একটু পরে বারান্দায় গেলাম। দেখলাম লনে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ বাইনোকুলারে কিছু দেখছেন। জায়গাটা উঁচু বলে চারদিকে বহু দূর দেখা যাচ্ছে। পূর্বদিকে গাছপালার ফাঁকে একটা চওড়া পিচের পথ দেখতে পেলাম। তারপরই চোখে পড়ল–হ্যাঁ, ওই তো সেই পোড় দোতলা বাড়িটা! অত দূর থে যেন হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছে। কঙ্কালের মতো ভয়ঙ্কর একটা বাড়ি।

কর্নেল হঠাৎ ঘুরে একটু হেসে বললেন, বাইনোকুলারে ভুতুড়ে বাড়িটা দেখবে নাকি জয়ন্ত?

নাহ্! আপনি দেখুন!

ব্রেকফাস্টের সময় হয়ে এল। খেয়ে নিয়ে বেরুব। তুমি—

ঝটপট বললাম, নাহ্। ঘুমোব।

কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। তোমার মনে যে প্রশ্নগুলো এসেছে, আমার মনেও এসেছে। তবে এখন এ নিয়ে মাথা ঘামানোর অর্থ হয় না। তরুণবাব। আসুন। তারপর আশা করি, ব্যাখ্যা পেয়ে যাব। ওঁর এখানে আসার উদ্দেশ্য আমাকে ব্যাখ্যা দেওয়া এবং বৈমাত্রেয় দাদাকে চিট করা। এক ঢিলে দুই পাখি বধ। ওয়েট অ্যান্ড সি।

আপনি বলেছিলেন বিগ্রহের খোঁজ পেয়ে গেছে। কোথায় কীভাবে পেলেন?

সমস্যা হল, জয়ন্ত! কখন আমার মুখ দিয়ে একটা কথা বেরিয়ে যায় এবং তুমি তা নিয়ে বড় বেশি চিন্তাভাবনা করে ফেলো! ওটা একটা আইডিয়া।

আহা, খুলে বলতে অসুবিধা কী?

কর্নেল বারান্দায় এসে বেতের চেয়ারে বসলেন। আমিও বসলাম। কর্নেল বললেন, বনজঙ্গল, পাথর, তার ফের চড়াই ভেঙে ওঠার সময় বাংলা প্রবচনটা আমার মাথায় এসেছিল : কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না। হ্যাঁ, কষ্ট কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একবার হোঁচট খেতে দেখলাম তোমাকে। দ্বিতীয়বার হোঁচট খেয়ে তুমি পড়ে গেলে। তোমাকে টেনে ওঠালাম। ওঠাতে গয়ে আইডিয়াটা মাথায় এল।

উনি থেমে গেলেন হঠাৎ। হাঁক দিলেন, বৈজু ব্রেকফাস্ট লাও!

মাঝে মাঝে কর্নেলের এইসব হেঁয়ালি ন্যাকামি মনে হয়। বিরক্ত হয়ে চুপ করে থাকলাম।

কর্নেল বললেন, যা বলছিলাম। কষ্ট করে আরোহণের সময় পদঙ্খলন হতেই পারে। একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে কষ্ট করে মানুষ এগোচ্ছে। হঠাৎ পা পিছলে পতন। দা আইডিয়া!

বৈজু বারান্দার টেবিলে ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল।

মাখনটোস্টে কামড় দিয়ে কর্নেল বললেন, তো যেখানেই কেষ্ট সেখানেই রাধা।

ওঃ কর্নেল! আপনি বিগ্রহ পেয়ে গেছেন বলছিলেন?

দা আইডিয়া! আইডিয়া যদি সঠিক হয়, তা বাস্তবে কাজে লাগালেই সঠিক প্রাপ্তি। যা চাইছি, তা পেয়ে যাবই। তোমার পতনের সময় যে আইডিয়া মাথায় এসেছিল তা সঠিক বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কাজেই বিগ্রহ পেয়ে গেছি, এটা নিশ্চিত। শুধু উদ্ধারের অপেক্ষা মাত্র।

নাহ্। আর মুখ খুললে আবার ক্রমাগত হেঁয়ালি শুনতে হবে। কাজেই চুপচাপ ব্রেকফাস্টে মন দেওয়াই উচিত।……

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *