হরিবাবুর অন্তর্ধান

০৬. হরিবাবুর অন্তর্ধান

ভবানীপুরের অবসরপ্রাপ্ত আইনজীবী শচীন্দ্রলাল মুখার্জি আজ একেবারে উল্টো মানুষ হয়ে গেছেন দেখে অবাক লাগছিল। প্রথমে কর্নেলের হাত ধরে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে আদর করে পাশে বসালেন। তারপর চোখ মুছে বললেন, আমি পাপী! মহাপাপী! তাই আমার এই অথর্ব অবস্থা হয়েছে। হাজারটা অসুখে। ভুগছি। ওদিকে গিন্নিও পক্ষাগাতে শয্যাশায়িনী হয়ে আছেন। আমার মনের অবস্থা বলার মতো নয় কর্নেল সায়েব!

কর্নেল বললেন, বুঝতে পেরেছি। পেরেছি বলেই আবার আপনার কাছে। আসতে দ্বিধা করিনি।

শচীনবাবু এবার চাপা গলায় বললেন, আপনি যে বিচক্ষণ মানুষ, তা আমি প্রথমদিনই টের পেয়েছিলাম। আপনি কাল ঠিকই বলেছিলেন। কার্যত আমি নিজেই বিগ্রহ চুরি করেছিলাম। কিন্তু সেটা যে অমন একটা সাংঘাতিক রিস্কের ব্যাপার, তা আমার মাথায় আসেনি। কারণ ক্রোধ মানুষকে অন্ধ করে। আমি ভাবতেই পারিনি হারামজাদা হরি বোকামি করে বসবে। আমার প্ল্যানটা ছিল সোজা। আফটার অল, তরুণের দেহে আমার বাবার রক্ত আছে। তার বাড়িতে একটা রাত্তির গৃহদেবতাকে রাখা যেত। তারপর পুলিশ সকালে ওটা উদ্ধার করে দিত। তরুণও ফেঁসে যেত। কিন্তু হতচ্ছাড়া হরিটা–

শচীনবাবু কপালে করাঘাত করলেন। কর্নেল বললেন, আসলে রিস্কটা আপনি যত তুচ্ছ ভেবেছিলেন, ততটা ছিল না।

হ্যাঁ। কিন্তু তা তো পরে বুঝেছিলাম। তখন ক্রোধান্ধ হয়ে একটা প্ল্যান ছকেছি। তখন মনে হয়েছিল, গৃহদেবতা একই পরিবারের এক গৃহ থেকে আর। এক গৃহে যাচ্ছেন। সক্কালে আবার ফেরত পাব।

হরিবাবুর ওপর আপনার বিশ্বাস গভীর ছিল বোঝা যাচ্ছে?

হ্যাঁ। তা তো ছিলই। যদি বলেন এখনও কি নেই? আছে। কারণ আমি মানুষ চিনি। সারাজীবন আদালতে আসামি জেরা করে কাটিয়েছি। ক্রিমিন্যাল দেখলেই ধরতে পারি। তাছাড়া হরি একটু সাদাসিধে ধরনের গোবেচারা টাইলস লোক। খুব পরিশ্রমীও বটে। সকাল আটটায় কাজে আসত। রাত দশটা কোনও-কোনও রাতে এগারোটা পর্যন্ত থেকে যেত। কোনওরকম তঞ্চকতাম কাজ করেনি আমার সঙ্গে। আমি মানুষ চিনি কর্নেলসায়েব।

মনে মনে বললাম, ঘোড়ার ডিম চেনেন! তরুণবাবুর চর ছিলেন হরিবার। বিরক্ত হয়ে কর্নেলের দিকে তাকালাম। ভাবলাম, হরিবাবুর চরিত্র ফাস করে দেবেন শচীনবাবুকে। কিন্তু কর্নেল ক্রমাগত দাড়ি নেড়ে সায় দিচ্ছিলেন। এবার বললেন, হরিবাবু আপনার মতোই সব্রাহ্মণ। ওঁর ঘরে আপনার গৃহদেবতার ফোটো বাঁধানো আছে দেখেছি!

আইনজীবী আবেগে বললেন, আমার সব কর্মচারীকে এককপি করে গৃহদেবতার ফোটো আমিই বাঁধিয়ে দিয়েছিলাম।

হরিবাবুর ঘর থেকে ওঁর মামাতো ভাই শ্যামসুন্দরবাবু বিগ্রহ চুরি করে। পালিয়েছিলেন।

হ্যাঁ। হরি বলেছিল। ওর মুখ দেখে মনে হয়েছিল, সত্যি কথা বলেছে। তাহলে ওঁকে বরখাস্ত করেছিলেন কেন?

ওই যে তরুণের বাড়ি গিয়েছিল, সেইজন্য। ওর আত্মীয়ের চাকরির চেষ্টায় গিয়েছিল। সেটা বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু আমার রাগ হয়েছিল, তরুণকে সাধতে গেল কেন?

কর্নেল হাসলেন। আপনি কাল বলেছিলেন, বিগ্রহ চুরির জন্য যাকে-যাকে। সন্দেহ হয়েছিল, তাদের মধ্যে হরিও একজন।

শচীনবাবু কর্নেলের হাত চেপে ধরলেন। ভিজে গলায় বললেন, কালকের কথা ভুলে যান। আজ আমি কনফেস করার জন্য আপনাকে ডেকেছিলাম। তাছাড়া একটা কৌতূহলও হয়েছে।

বলুন মিঃ মুখার্জি।

আইনজীবী আবার চাপা গলায় বললেন, প্লিজ কর্নেলসাহেব! গোপন করবেন না। তরুণই কি আপনাকে বিগ্রহ উদ্ধারের জন্য ধরেছে? তার মানে, আপনার ক্লায়েন্ট কি তরুণ?

নাহ। আমি আপনাকে বলেছি, কোথাও রহস্য দেখলেই তা ফাঁস করা আমার হবি।

তা করুন। কিন্তু আপনার হাতে ধরে বলছি, আমার গৃহদেবতাকে উদ্ধার করে দিন।

চেষ্টা করব। তবে আপনার সহযোগিতা চাই।

পাবেন। সব রকমের সহযোগিতা পাবেন।

ট্রে ভর্তি স্ন্যাক্স, সন্দেশ এবং চায়ের কাপ-প্লেট এনে রাখল কালকের সেই পরিচারক। কর্নেল বললেন, কিছু মনে করবেন না। আমরা ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি। তবে শুধু চা খাব।

আপনার ইচ্ছে। বলে শচীনবাবু ছড়িয়ে রাখা বাঁ পা সোজা করলেন এবং এবার ডান পা ছড়িয়ে দিলেন। মুখে কষ্টের ছাপ।

কর্নেল চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, বরমডিহির সন্ধ্যানীড়ের চাবি কার কাছে আছে?

বরমডিহির জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে তাকে মামলার মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত বাড়ির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু খবর পাই, তিনি কিছুই দেখেন না। সরকারি ব্যাপার যা হয় আর কী। বাড়িটার নাকি পড়ো-পড়ো দশা। শুনে কষ্ট হয়। কিন্তু কী করব?

বাড়ির নিচের তলায় কখানা ঘর?

১০ খানা।

কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, দোতলায়?

দোতলাতেও ১০ খানা।

কর্নেল আমার দিকে তাকালেন। বললাম, পিওর ম্যাথ। বিশুদ্ধ গণিত মনে হচ্ছে।

শচীনবাবু বললেন, গণিত? গণিত মানে?

কর্নেল বললেন, জয়ন্ত ভাল অঙ্ক কষতে পারে তো! তাই ও বলতে চায়–

শচীনবাবু তার কথার ওপর বললেন, বাবা ছিলেন সে-আমলের নামকরা আর্কিটেক্ট। বরমডিহিতে যত কোর্ট কাছারি বা পুরনো সরকারি বাড়ি আছে, সব ওঁর নকশায় তৈরি। জয়ন্তবাবু ঠিক ধরেছেন। অঙ্ক কষে বাবা বাড়ির নকশা তৈরি করতেন। লক্ষ্য করে থাকবেন, বাড়িটা ইংরেজি এল প্যার্টেনের। ওপরে নিচে এল প্যাটার্ন বারান্দা। বাবা যে আমার জন্যই বাড়িটা করেছিলেন, তার প্রমাণ, তাঁর জীবদ্দশায় দেউড়িতে আমার নেমপ্লেট লাগানো হয়েছিল। এখনও তা অক্ষত আছে। তখন তরুণ কোথায়?

ভোলা নামে একজন লোককে সন্ধ্যানীড়ের কেয়ারটেকার রেখেছিলেন। তাই না?

হ্যাঁ। কিন্তু আপনি যে ভূতপ্রেত দেখেছিলেন–

সে ভোলা নয়। আপনি তা আমাকে বলেছিলেন। কর্নেল চায়ের কাপ। নামিয়ে রেখে বললেন, ভোলা কত বছর আগে মারা গেছে?

বছর দুই হয়ে এল প্রায়। সুপ্রিম কোর্টে গেল তরুণ, সেই বছর।

হাইকোর্টে আপনি মামলা জিতেছিলেন?

হ্যাঁ। তরুণ লোয়ার কোর্টে হেরে হাইকোর্ট করেছিল। হাইকোর্টে হেরে। এখন সুপ্রিম কোর্টে। পাজির পা ঝাড়া! বংশের কলঙ্ক!

তা হলে মামলা তরুণবাবুই করেছিলেন প্রথমে?

তাকে সন্ধ্যানীডে ঢুকতে চাবি দিইনি। এতেই বাবুর মেজাজ খাপ্পা। তো আমি হলাম নিজেই আইনজ্ঞ। আমাকে আইন দেখাচ্ছে!

আজ চলি মিঃ মুখার্জি। দরকার মতো যোগাযোগ করব। আপনিও করবেন। কর্নেলের একটা হাত দুহাতে চেপে ধরে শচীনবাবু বললেন, আমিই পাপ রেছিলাম কর্নেলসায়েব! এ তারই শাস্তি। আপনি আমার গৃহদেবতাকে উদ্ধার করে দিন।

বললাম তো! চেষ্টা করব।…

বড় রাস্তার মোড়ে গিয়ে কর্নেল বললেন, এবার আলিপুর কোর্টে যাব। ছেলেটিকে পুরস্কৃত করতে হবে।

আমার বৃদ্ধ বন্ধুর খেয়ালের ব্যাপারটা আমার জানা। তাই বাধা দিলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। কোর্টের দিকে ছুটে চলল।

ট্যাক্সি থেকে নেমে কর্নেল ট্যাক্সি চালককে বললেন, একমিনিট ভাই। এক্ষুনি আসছি। জয়ন্ত, তুমি বসে থাকো।

ট্যাক্সি থেকে ড্রেনের ওপারে গাছতলায় হরিবাবুর ডেরা দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু হরিবাবু নেই। হয়তো খেতে গেছেন ভাবছিলাম। পরক্ষণে দেখলাম টেবিলে টাইপরাইটার নেই এবং চেয়ারে সেই চৌকস ছোকরা বসে আছে।

কর্নেল তার কাছে গেলে সে উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম দিলো। তারপর কর্নেলের সঙ্গে তার কথাবার্তা চলতে থাকল। এতদূর থেকে শোনা যাচ্ছিল না। একটু পরে কর্নেলকে দেখলাম, তার হাতে একটা দশটাকার নোট গুঁজে দিচ্ছেন। ছোকরা রীতিমতো মিলিটারি কায়দায় সেলাম ঠুকল। কর্নেল ফিরে এলেন।

ট্যাক্সিতে বসে কর্নেল বললেন, পার্ক স্ট্রিট হয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট দিয়ে ইলিয়ট রোড।

ট্যাক্সি ঘুরল। জিজ্ঞেস করলাম, হরিবাবু আজ আসেননি নাকি?

নাহ্। অসুখবিসুখ হয়েছে হয়তো!

ছোকরাটির সঙ্গে—

ও জয়ন্ত! হি ইজ আ জিনিয়াস চ্যাপ।

হাসতে হাসতে বললাম, কী কথা হল জিনিয়াসের সঙ্গে?

নামঠিকানা জেনে নিলাম। ওকে একটা স্থায়ী কাজ জুটিয়ে দেওয়ার আশ্বাসও দিলাম।

এবং দশটা টাকা পুরস্কার দিলেন।

ওটা ওর পক্ষে নগণ্য। ওকে দশ-বিশ হাজার টাকা দেওয়া উচিত ছিল। আমার তো অত দেওয়ার মতো অবস্থা নয়। পেনসন আর বিদেশি কাগজে প্রজাপতি নিয়ে প্রবন্ধ লিখে রোজগার।

ব্যাপারটা কী খুলে বলুন তো?

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, আজও তোমার লাঞ্চের নেমন্তন্ন।

সর্বনাশ! আমাকে অফিস যেতে হবে না? এই সপ্তাহে বিকেলে ডিউটি। কাল কামাই করেছি।

তোমার চিফ অব দা নিউজ ব্যুরোকে টেলিফোনে জানিয়ে দাও একটা রোমহর্ষক স্টোরির পেছনে দৌডুচ্ছ। বলল, দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার জন্য এক্সকুসিভ স্টোরি। রাতারাতি প্রচার-সংখ্যা এক লক্ষ বেড়ে যাবে।

চুপ করে গেলাম। এই খামখেয়ালি রহস্যভেদীর পাল্লায় পড়েছি। রহস্য ফদাই না হওয়া পর্যন্ত ছাড়া পাব না। তবে এ-ও সত্যি, বরমডিহির পোড় বাড়ির ভুতুড়ে হত্যাকাণ্ড আমাকেও ধাঁধায় ফেলেছিল। ধাঁধার জট না খুললে ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করতে হবে। এটাই সমস্যা। ভূতের ভয় যতই পাই, ভূতে বিশ্বাস করাটা কেমন বিচ্ছিরি লাগে যেন। তাছাড়া আমার মতে, গল্পের ভূতে মজা আছে। সত্যিকারের ভূতে মজা কোথায়?…

এদিনও কর্নেলের বাড়ি লাঞ্চ খেয়ে ড্রয়িং রুমের ডিভানে লম্বা হয়েছিলাম। কর্নেল কোথায়-কোথায় টেলিফোন করছিলেন এবং চাপা গলায় কথা বলছিলেন, তারপর হঠাৎ ডাকলেন, উঠে পড়ো জয়ন্ত! বেরুনো যাক।

ভাতঘুমের রেশ ছিঁড়ে গেল। বিরক্ত হয়ে বললাম, ওঃ কর্নেল! খালি ছুটোছুটি আর কথাবার্তা!

কর্নেল হাসলেন। ছুটোছুটি না করে উপায় কী? আমরা ভুতুড়ে খুনখারাপি দেখে এসেছি। হরিবাবুও একই দৃশ্য দেখেছিলেন। ছুটোছুটি করে খুনী ভূতটাকে তো ধরতে হবে। আর কথাবার্তার কথা বলছ? কথা বলতে বলতে অনেক কথা বেরিয়ে আসে। আসলে আমরা জানি না যে কী জানি। তাই অনর্গল কথা বলতে হয়। জানা কথাটা এভাবেই মুখ দিয়ে নিজের অজান্তে চলে আসে। এই দুদিনে পুরো একটা ইতিহাস বেরিয়ে এল এবং একজোড়া বিগ্রহ!

কিন্তু এবার বেরুবেন কোথায়? নতুন কোনও সূত্র পেয়েছেন নাকি?

নাহ্। বেচারা হরিবাবুর খবর নেওয়া দরকার। কোর্টে যাননি। ওঁর পেছনে শত্রু লেগেছিল। নোটবইটা পেয়েও যদি সে খুশি না হয়? কিংবা যদি সে দেখে যে এটা সেই নোটবই নয়? হরিবাবুর কী দশা হবে ভাবো!

বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। সত্যিই তো! যদি ওটাই সেই কালো নোটবই না হয়?…

পাইকপাড়ার সেই ঠিকানায় কালকের চেয়ে আজ আগেই পৌঁছুলাম। ঝলমলে মিঠে রোদ্দুর খেলছে। মশা নেই। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে হরিবাবুর ঘরের সামনে কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন। দরজায় তালা ঝুলছে।

পাশের ঘরের এক ভদ্রমহিলা আমাদের দেখতে পেয়ে বললেন, হরিদার কাছে এসেছেন আপনারা? সে তো কাল সন্ধ্যায় দেশের বাড়িতে গেছে। বউদি নাকি খুব অসুখ। আমাকে বলে গেছে, কেউ তার খোঁজে এলে যেন জানিয়ে দিই।

কর্নেল বললেন, কবে ফিরবেন কিছু বলে গেছেন?

ঠিক নেই। অসুখবিসুখের ব্যাপার।

ওঁর দেশের ঠিকানা জানেন?

না তো! মেদিনীপুরে কোন গ্রামে যেন।

কর্নেল একটু কাচুমাচু মুখ করে বললেন, একটা জরুরি কাগজ টাইপ করতে দিয়েছিলাম। বড় সমস্যায় পড়া গেল দেখছি। আচ্ছা, হরিবাবুর কোনও অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকা উচিত। তার হাতেও আমার কাগজটা দিয়ে যেতে পারেন। তেমন কেউ কি এ ঘরে ওঁর সঙ্গে থাকেন না?

ভদ্রমহিলা মাথা নেড়ে বললেন, এ ঘরে হরিদা একা থাকে।

ওঁর মামাতো ভাই শ্যামসুন্দরবাবু ওঁর সঙ্গে থাকেন শুনেছিলাম। তিনি–বলে কর্নেল ভদ্রমহিলাকে হাঠৎ জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কতদিন এখানে আছেন?

অনেকদিন। আপনি শ্যামবাবুর কথা বলেছেন? শ্যাম নামে একজন হরিদার কাছে থাকত। সে তো অনেক বছর আগের কথা। হরিদার কাছে শুনেছিলাম, লোকটা ভাল না। মানে, হরিদার টাকাকড়ি চুরি করে পালিয়েছিল। আমার কিন্তু লোকটাকে একেবারে পছন্দ হত না।

আচ্ছা চলি! বলে কর্নেল সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন।

নিচে নেমে বললাম, জাল ভোলা ওরফে হারাধন কাল সন্ধ্যায় বউয়ের অসুখ বলে দেশে চলে গেছে। এদিকে হরিবাবুও কাল সন্ধ্যায় বউয়ের অসুখ বলে দেশে চলে গেছেন। টাইমিংটা লক্ষ্য করুন কর্নেল! ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হচ্ছে। দুজনেই হঠাৎ একই সঙ্গে গা-ঢাকা দিয়েছে যেন। কিন্তু কেন?

কর্নেল তুম্বো মুখে হাঁটছিলেন। আমার প্রশ্নের জবাবে কিছু বললেন না।

বললাম, অবশ্য নেহাত কাকতালীয় ঘটনাও হতে পারে। কারও বউয়ের অসুখ হতেই পারে। আবার অফিসের কর্মীরা বউয়ের অসুখের কথা না বললে ছুটি পায় না।…

ইলিয়ট রোডে তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে কর্নেল যথারীতি ষষ্ঠীকে কফির হুকুম দিয়েছিলেন। আজ সন্ধ্যায় শীতের ঈষৎ আমেজ পাওয়া যাচ্ছিল। কলকাতায় ডিসেম্বরের গোড়ায় শীতের চেহারা পুরো দেখা যায় না, যদিও বহু লোক গায়ে সোয়েটার-জ্যাকেট চড়ায়।

কফি খেতে খেতে কর্নেল হঠাৎ বললেন, দুই ভাইয়ের একভাই কোনও একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আমার কাছে গোপন করছেন। শচীনবাবু কিংবা তরুণবাবু যে কোনও একজন। সেই গোপন কথাটা আমি জানতে পারলে এ রহস্য ফাঁস করা সম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন হল, ওঁরা কি ইচ্ছে করেই গোপন করছেন, নাকি ওঁরা জানেন না ওটা আমার কাছে মূল্যবান সূত্র হতে পারে?

জিজ্ঞেস করলাম, গোপন কথাটা কী হতে পারে বলে আপনার ধারণা?

শ্যামবাবুর হত্যাকাণ্ড।

চমকে উঠে বললাম, শ্যামবাবুকে খুন করা হয়েছে বলতে চান?

তুমিও দেখেছ জয়ন্ত।

অ্যাঁ? আমি দেখেছি? কবে? কোথায়?

২৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় ঝড়বৃষ্টির সময় বরমডিহির সন্ধ্যানীড়ে।

কর্নেল! সেই রক্তাক্ত বডিটা শ্যামবাবুর নাকি?

হ্যাঁ। টর্চের আলোয় মুখটা দেখেছিলাম। তুমি তো জানো, যে মুখ একবার দেখি, তা আমি ভুলি না। তরুণবাবুর অফিসের গ্রুপ ফোটো থেকে শ্যামবাবুর যে ছবিটা তুলেছি, তা নিঃসন্দেহে সন্ধ্যানীড়ের দোতলার সেই ঘরে টর্চের আলোয় দেখা নিহত লোকটিরই ছবি।

শুকনো গলায় বললাম, হরিবাবুকে লেখা উড়ো চিঠিতে শ্যামবাবুকে খতম করে পুঁতে ফেলার করা ছিল বটে! সেখানে আমরা জাল ভোলা অর্থাৎ হারাধনকে দেখেছিলাম। তা হলে হারাধন…

আমার কথার উপর কর্নেল বললেন, হারাধন অন্যতম খুনী।

আর তক্তাপোসে নোংরা বিছানায় অসুস্থ শচীনবাবু সেজে যে লোকটা শুয়েছিল, সে-ও খুনী।

হ্যাঁ। আমি টর্চের আলো তার মুখে ফেলার আগেই হারাধন তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছিল।

কর্নেল চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। আমি দৃশ্যটা স্মরণ করছিলাম। একটু পরে বললাম, আপনার ফোন পেয়ে পুলিশ সেখানে গিয়ে কিছু দেখতে পায়নি। অন্তত রক্ত চোখে পড়া উচিত ছিল?

কর্নেল চোখ বুজেই বললেন, ডাকবাংলো পৌঁছুতে আমাদের সময় লেগেছিল। সেই সময়ের মধ্যে বডি সরানো এবং রক্ত ধুয়ে ফেলা সহজ ছিল। বিশেষ করে বৃষ্টি হচ্ছিল এবং ছাদ ছিল ফাটা। তাই জল দেখে পুলিসের সন্দেহ হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া তখন রাত্রিকাল।

পুলিশেরও লক্ষ্য ছিল একটা লাশ। তাই লাশ দেখতে না পেয়ে খাপ্পা হয়ে চলে যায়।

ঠিক বলেছ। পুলিশ আমাকে ফোনে বলছিল টালি এবং সুরকি ধোয়া জল দেখে আমি নাকি রক্ত ভেরেছি। ওই বাড়িটা নাকি ভুতুড়ে। বলে কর্নেল চোখ খুলে একটু হাসলেন। পুলিশের আইনে ভূত বলে কিছু নেই। কিন্তু পুলিশও তো মানুষ। মানুষের মনে ভূতপ্রেতে বিশ্বাস থাকা স্বাভাবিক। চিন্তা করো নির্জন এলাকায় একটা পোড়ো জরাজীর্ণ বাড়ি। এমন বাড়ি সম্পর্কে ভতে ছড়াতেই পারে।

কর্নেল! হরিবাবুও নাকি একই দৃশ্য দেখেছিলেন!

হুঁ। বলে কর্নেল টেলিফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। একটু পরে বললেন মিঃ এস. এল. মুখার্জির সঙ্গে কথা বলতে চাই।… বলুন, কর্নেল জীs. সরকার কথা বলবেন। জরুরি কথা। বলে কর্নেল কাঁধে টেলিফোন আটকে কে নিভে যাওয়া চুরুট ধরালেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন মিঃ মুখার্জি? আপনাকে একটু বিরক্ত করছি।… আপনি গৃহদেবতা ফেরত চান… না, না। এখনও আমি সন্ধান পাইনি। কিন্তু আপনার সহযোগিতা চাইছি। …হ্যাঁ। প্লিজ আমার প্রশ্নের জবাব দিন। আশা করি, সঠিক জবাব পাব। আচ্ছা, আপনি কি হরিবাবুকে বিগ্রহ উদ্ধার করে দিতে বলেছিলেন? বলেননি?.হ্যাঁ, হ্যাঁ। তা ঠিক। …অ্যাঁ? প্লিজ রিপিট। …অনুতপ্ত হতেই পারেন। স্বাভাবিক। কিন্তু এ কথাটা আপনি কি ইচ্ছে করেই আমাকে আমাকে জানানি? …হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনার কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ার কারণ ছিল না। …ঠিক। আচ্ছা মিঃ মুখার্জি, আর একটা প্রশ্ন। শ্যামবাবু– মানে হরিবাবুর সেই আত্মীয় খুন হওয়ার কথা আপনি জানেন? …জানেন না? হ্যাঁ। ওঁর রক্তাক্ত লাশই আমি দেখেছিলাম… জানেন না তাহলে? রাখছি।

বলে কর্নেল টেলিফোন রাখলেন। উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। বললাম কী বললেন?

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, বরমডিহি।

তার মানে?

আমরা আজ রাতের ট্রেনে বরমডিহি যাচ্ছি। শীতটা ওখানে বড্ড বেশি। গরম জামাকাপড় সঙ্গে নেবে। চিন্তা কোরো না! দুপুরে পূর্বরেলের পি. আর. ও. কে ফোন করে ফার্স্টক্লাসে দুটো বাৰ্থ রাখতে বলেছি। দশটা পঁয়ত্রিশে ট্রেন ছাড়ার কথা। তুমি এখনই গিয়ে রেডি হও। আমি তোমাকে ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে হাওড়া স্টেশনে যাব। কর্নেল মিটিমিটি হাসলেন। আবার ভূত দেখতে পাবে ডার্লিং! পোভড়া বাড়ির ভূত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *