৪. কিরীটীর আহ্বানে কুনাল

০৪.

বসুন কুনালবাবু!

কিরীটীর আহ্বানে কুনাল সামনাসামনি সোফাটার উপর বসল। মামুলী কয়েকটা প্রশ্নের পর তাকেও কিরীটী ঐ একই প্রশ্ন করে।

চিড় ধরেছিল কিনা জানি না, কুনাল বলে, তবে প্রতুলের সঙ্গে যে আড়ালেআবডালে একটা ব্যাপার ওর চলেছে আমি বুঝতে পেরেছিলাম সেটা। আর তাই নিয়ে। দুজনের মধ্যে আমাদের কথা-কাটাকাটিও হয়ে গিয়েছিল কিছুদিন আগে। আমি সবটাই গীতাকে বলেছিলাম। তার মনের মধ্যে যদি অন্য কিছু থাকে সে আমাকে যেন স্পষ্টই বলে দেয়। আমি একটি বোকা বনতে চাই না।

কি বলেছিল তাতে গীতা?

বলছিল, আমার পছন্দমত কাউকে বিয়ে করারও কি আমার অধিকার নেই, তুমি বলতে চাও কুনাল!

কেন থাকবে না? কিন্তু বিট্রে করবার নিশ্চয়ই তোমার কোন যুক্তি নেই!

তাতে কি জবাব দিয়েছিল গীতা?

মৃদু হেসেছিল কেবল।

কুনালবাবু, আর একটা কথা, গীতার মৃত্যুর ব্যাপারে আপনার ঐ দুই বন্ধুকে কোন রকম সন্দেহ করেন?

কুনাল চুপ করে থাকে।

কি, জবাব দিচ্ছেন না যে।

জানি না। তবে প্রতুল-ওকে আমি বিশ্বাস করি না, রাগলে ওর আসাধ্য কিছু নেই।

.

সর্বশেষ এল সুভাষ।

কিরীটীর সেই একই প্রশ্ন।

প্রথম প্রশ্নের জবাবে বলে, রাত ঠিক বারোটা পনেরো।

আপনার গাড়ি করেই তো সকলকে আপনি পৌঁছে দেন?

হ্যাঁ। রাত কটায় আপনি বাড়ি ফিরে যান?

তা একটা হবে।

কি রকম speed-এ আপনি গাড়ি চালান?

বেশ একটু speed-এ চালাই।

আচ্ছা সুভাষবাবু, আপনি কি জানতেন যে আপনার বন্ধু প্রতুলবাবুর সঙ্গে গীতা দেবীর বিয়ের ব্যাপারটা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল।

জানব না কেন?

জানতেন। তারাই বুঝি আপনাকে জানিয়েছিল—গীতা ও প্রতুলবাবু?

হ্যাঁ-না they were coward; সোজা কথা স্পষ্ট করে যারা বলতে পারে না, বলবার courage রাখে না—তাদের আমি ঘৃণা করি। সুভাষের কণ্ঠস্বরে যেন একটা বিরক্তি, ঘৃণা ঝরে পড়ল। অথচ ব্যাপারটা নিয়ে লুকোচুরি করবার কিছুই ছিল না, আর জানালেও যে আমরা কেউ ভেঙে পড়তাম হতাশায় তা নয়।

আপনি কি করে কবে প্রথম জানতে পারলেন ব্যাপারটা? কিরীটী এবারে প্রশ্ন করে।

কি করে জানলাম সেটা বলব না, তবে মাসখানেক আগে জানতে পারি প্রথম।

আপনি যে জানতে পেরেছেন সেটা ওদের জানিয়েছিলেন?

না।

কেন? ওসব নোংরা ব্যাপার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করাটা আমার রুচি ও শিক্ষায় বেধেছিল বলে।

নোংরা ব্যাপার।

তাছাড়া কি? যারা ভালবাসার নাম করে শেষ পর্যন্ত পরস্পরের দেহ নিয়ে টানাটানি করে তাদের সবটাই নোংরামি। যাদের রুচি আছে, শিক্ষা আছে-তাদের অতখানি বিকৃতি কখনও হয় না।

কিরীটী একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে, মনে হচ্ছে আপনি গীতাকে ভালবাসতেন—if I am not wrong!

ক্ষেপেছেন? ভালবাসতে যাব আমি ঐ মনোবৃত্তির একটা তুচ্ছ মেয়েছেলেকে? গীতা জানত না যে তাকে আমি কতখানি ঘৃণা করতাম, তার চরিত্রের ওই দুর্বলতা আর হ্যাংলামির জন্য!

তাহালেও বুঝতে পারছি, কখনও সে কথা গীতাকে আপনি জানতে দেননি নচেৎ সব কিছু জানবার পরও আপনি তার সঙ্গে মিশতেন না বা হেসে কথা বলতেন না।

বরং বলুন অতখানি নিচে কখনও আমি নামতে পারিনি!

আপনি বোধ হয় শুনেছন, গীতার মৃত্যুর কারণ বিষ নয়?

বিষ নয়!

না, কেউ তাকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করছে সে-রাত্রে।

না, না,-তা কেন হবে—

তাই। ময়নাতদন্তেও তাই বলেছে। আচ্ছা কাউকে আপনি সন্দেহ করেন?

না।

অতঃপর সেদিনকার মত কিরীটী সকলকে বিদায় দিল।

.

দিন-দুই পরে।

সন্ধ্যারাত্রি তখন! কিরীটী হঠাৎ গিয়ে হাজির হয় সুভাষের গৃহে। সুভাষ তখন গৃহে। ছিল না।

সীতারাম বললে, দাদাবাবু তো বাড়িতে নেই!

কোথায় গিয়েছেন জান?

না।

কখন ফিরবেন, তা জান না?

না।

তোমার নাম কি?

আজ্ঞে সীতারাম।

কতদিন এ বাড়িতে আছ?

তা দশ-বারো বছর হবে।

তুমি শুনেছ বোধ হয় গীতা দিদিমণি মারা গিয়েছেন?

শুনেছি বৈকি বাবু। আহা, দিদিমণি বড় ভাল ছিল। হাসি ছাড়া কখনও দেখিনি।

এখানে আসত না?

হ্যাঁ, প্রায়ই আসত।

তোমার দাদাবাবুর সঙ্গে খুব ভাব ছিল, তাই না?

আজ্ঞে। আমি তো ভেবেছিলাম দাদাবাবু গীতা দিদিমণিকেই বিয়ে করবে।

আচ্ছা সেদিন রাত্রে কখন তোমার দাদাবাবু ফিরেছিল মনে আছে?

রাত তখন একটা হবে। না—ঠিক তা নয় বোধ হয়, রাত প্রায় দেড়টা হবে।

একবার বলছ রাত একটা, আবার বলছ রাত দেড়টা—

হ্যাঁ  বাবু, ঘড়িটা আধ ঘণ্টা স্লো হয়ে গিয়েছিল, মনে পড়ছে আমার—

ঘড়িটা আধ ঘণ্টা স্লো হয় গিয়েছিল কি রকম?

হ্যাঁ, পরের দিন দেখি—দাদাবাবু গীতা দিদিমণির বাড়ি থেকে ফিরে এসে ঘড়িটা ঠিক করছে। আধ ঘণ্টা এগিয়ে দিলে দেখলাম।

কোন্ ঘড়িটা?

সীতারাম ঘড়িটা দেখিয়ে বলে, ঐ ঘড়িটা।

ওটা স্লো-ফাস্ট থাকে নাকি?

কখনও না। একেবারে ঠিক ঠিক টাইম দেয়। কখনও আগে-পিছে হতে গত দশ বছর দেখিনি।

আচ্ছা সীতারাম, আমি চলি।

কিন্তু আপনি কোথা থেকে আসছেন, কি নাম আপনার—বললেন না তো?

আমি আবার আসব। কথাটা বলে বের হয়ে এল কিরীটী।

সেখান থেকে বের হয়ে কিরীটী সোজা গেল নিরালায়।

শান্তনু গৃহেই ছিল।

শান্তনু!

বল?

তুমি সেদিন বলেছিলে না, তোমার মাসী গীতার পাশের ঘরেই শোন।

হ্যাঁ, কেন বল তো?

তাকে একটিবার ডাকবে? তার সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে।

শান্তনু তখনি গিয়ে সৌদামিনীকে ডেকে নিয়ে এল।

বসুন মাসীমা। কয়েকটা কথা আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করব।

কি বাবা?

রাত্রে আপনার ঘুম হয় কেমন?

ঘুম কি আর চোখে আছে—

সে-রাত্রে তো আবার বাতের ব্যথাটা আপনার বেড়েছিল, তাই না?

হ্যাঁ।

আচ্ছা, সাড়ে বারোটা পৌনে একটার সময় কোনরকম শব্দ বা চেঁচামেচি শুনেছিলেন পাশের ঘরে?

চেঁচমেচি নয়, তবে—

বলুন—থামলেন কেন?

দেখ বাবা—সেদিন আমি দারোগাবাবুকে বলিনি, তবে আমার বেশ স্পষ্ট মনে আছে। সে-রাত্রে গীতা যেন কার সঙ্গে কথা বলছিল—

আর কিছু শোনেননি?

না।

ঠিক আছে, আপনি যেতে পারেন।

মাসী চলে যাবার পর কিরীটী বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলে, ব্যাপারটা আমার কাছে। স্পষ্ট হয়েছে শান্তনু।

কি? কিছু জানতে পেরেছ?

হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি কে তোমার বোনকে হত্যা করেছে।

কে? শম্ভু?

না। ভাল কথা, শম্ভুকে পাওয়া গেছে, জান না?

না তো! কোথায়? কখন?

মেদিনীপুর এক গাঁয়ে তার আত্মীয়-বাড়িতে।

সে পালিয়েছিল কেন?

ভয়ে।

ভয়ে!

হ্যাঁ। কিন্তু একটা কথা তুমি কি জানতে, গীতা প্রতুলকে বিয়ে করবে বলে স্থির করেছিল?

জানতাম।

And that is the cause—

কি বলছ তুমি?

তাই। প্রতুল সুভাষ ও কুনাল তিনজনই গীতাকে ভালবাসত—সবাই মনে মনে গীতাকে চাইছিল, কিন্তু গীতা যখন প্রতুলকে বেছে নিল জীবনে, ব্যাপারটা জটিল হয়ে উঠল। যার ফলে শেষ পর্যন্ত তাকে ওই নিষ্ঠুর মৃত্যুবরণ করতে হয়।

সত্যি বলছ?

হ্যাঁ। প্রেম যেমন সর্বস্ব ত্যাগ করতে পারে, তেমনি প্রচণ্ডতম নিষ্ঠুর ও হিংস্রও হতে পারে। আর এক্ষেত্রেও হয়েছিল তাই–

কিন্তু কে?

গীতার তিন বন্ধুরই মধ্যে একজন।

কে?

কাল বলব। তুমি ওদের তিনজনকে কাল সন্ধ্যায় ডেকে পাঠাও।

.

পরের দিন সন্ধ্যায়।

ঘরের মধ্যে সকলেই উপস্থিত। শান্তনু, কিরীটী, দত্তরায়, সুভাষ, কুনাল ও প্রতুল।

কিরীটী বলছিল, আপনারা নিশ্চয়ই অবাক হবেন শুনলে, গীতাকে আপনাদের তিনজনের মধ্যে একজন খুন করেছেন।

প্রতুল বলে, কি আবোল-তাবোল বকছেন মশাই?

আবোল-তাবোল নয়, নিষ্ঠুর সত্য–

সুভাষ বলে, কিন্তু আমরা তো কেউ সে-রাত্রে ছিলামই না। একসঙ্গে তিনজন বের হয়ে যাই।

গিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু আবার সে-রাত্রে ফিরে আসা তো অসম্ভব কিছু ছিল না।

তার মানে? সুভাষ বলে।

তার মানে ভেবে দেখুন, কে এবং আপনাদের তিনজনের মধ্যে কার পক্ষে সে রাত্রে আবার ফিরে আসা সম্ভবপর ছিল!

কার?

কেন—আপনি সুভাষবাবু! আপনার গাড়ি ছিল, আপনি বন্ধুদের পৌঁছে দিয়ে এখানে সোজা আবার চলে আসতে অনায়াসেই পারতেন না। আর তাই হয়েছিল, আপনি সে-রাত্রে আবার ফিরে আসেন নিরালায়?

আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি!

মাথা যে আমার খারাপ হয়নি, আপনার চাইতে সে-কথা আর কেউ ভাল জানে সুভাষবাবু। আর আপনি যে ফিরে এসেছিলেন তার প্রমাণও আছে।

প্রমাণ! প্রশ্নটা প্রতুল করে এবার।

হ্যাঁ। এক নম্বর সে-রাত্রে গীতার ঘরে কথাবার্তা শুনেছিলেন মাসীমা, আপনারা তো কেউ সে-রাত্রে উপরে গীতার ঘরে আসেননি, নিচ থেকেই বিদায় নিয়েছিলেন। শান্তনুও বাড়ি ছিল না। তবে সে কে? দুই-নম্বর, সে-রাত্রে গীতা ওপরে আসবার পরও শম্ভুচরণ সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনেছিল। সে কার পায়ের শব্দ? তিন-নম্বর, আপনার বাড়ি ঘড়ির কাটা আধ ঘণ্টা পিছিয়ে দিয়েছিলেন, সময়ের ব্যবধানটা প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য। এর পরও অস্বীকার করত চান সে-রাত্রে আবার আপনি আসেননি?

হঠাৎ সুভাষ হো হো করে হেসে ওঠে—চমৎকার! যদি ধরুন আমিই–প্রমাণ কি তার?

হ্যাঁ, চার নম্বর, এই রুমালটা আপনার-কোণে আপনার নামের মনোগ্রাম করা আছে। দেখুন।

সুভাষ একেবারে বোবা। যেন পাথর।

এটা কোথায় পাওয়া গেছে জানেন? গীতার ঘরে। এটাই শম্ভুচরণ পাঠিয়েছে। আপনাকে–

শম্ভু!

হ্যাঁ, তাকে আপনি ভয় দেখিয়ে কলকাতা ছাড়া করবার চেষ্টা করেছিলেন, কারণ আপনার সন্দেহ হয়েছিল সে কিছু জানে। বেচারী ভয় পেয়ে পালিয়ে না গেলে হয়ত শেষ পর্যন্ত এই মোক্ষম প্রমাণটা তার কাছ থেকে পেতাম না—আপনি হয়ত তাকেও হত্যা করতেন। শুনুন সুভাষবাবু, সেদিন আপনার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যে প্রচণ্ড ঘৃণা ও আক্রোশ আপনার কথাবার্তায় প্রকাশ পেয়েছিল গীতা সম্পর্কে, সেটাই আমাকে সর্বপ্রথম অনুসরণের আলো দেখায়।

সুভাষ নির্বাক।