৩. শম্ভুচরণ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে

০৩.

শম্ভুচরণ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। দুদিন ধরে সারা কলকাতা শহরে তোলপাড় করেও তার কোন সন্ধান করা গেল না। পুলিস হন্যে হয়ে যেন শম্ভুচরণকে সর্বত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার গ্রামের বাড়িতেও ধাওয়া করেছিল পুলিস, কিন্তু সেখানেও তার কোন সন্ধান পায়নি।

পুলিসের একপ্রকার ধারণাই হয়ে গিয়েছে, ওই শম্ভুচরণই দোষী। সে-ই গীতাকে হত্যা করছে।

শান্তনু কিন্তু এখন বলছে, শম্ভু গীতাকে হত্যা করতে পারে, কিছুতেই সে বিশ্বাস করতে পারে না। তবে শম্ভুচরণ গীতাকে না হত্যা করলেও, কেউ-না-কেউ হত্যা করেছে। তাকে ঠিকই কিন্তু সে কে? কে হত্যা করতে পারে গীতাকে? আর কেনই বা হত্যা করল? গীতার মৃত্যু হয়েছে, কথাটা যেন এখন কিছুতেই ভাবতে পারছে না শান্তনু।

হঠাৎ মনে পড়ে শান্তনুর একজনের কথা। প্রেসিডেন্সিতে একসঙ্গে বছর-দুই পড়েছিল। তারপর দুজন দুদিকে চলে যায়। তাহলেও মধ্যে মধ্যে দেখা হয়েছে।

তার কথা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আর দেরি করে না শান্তনু, সেইদিনই সন্ধ্যার দিকে সোজা তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়।

বাইরের ঘরেই ছিল সে, একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছিল। শান্তনুকে দেখে বলে, এস শান্তনু, বস।

শান্তনু বসল। একটু পরে ভদ্রলোককে বিদায় করে দিয়ে সে তাকাল শান্তনুর মুখের দিকে। বললে, অনেক দিন পরে দেখা তোমার সঙ্গে। কিন্তু কি ব্যাপার? মুখ দেখে যেন মনে হচ্ছে, you are very much worried—খুব চিন্তিত!

কিরীটী!

শান্তনুর ডাকে কিরীটী ওর মুখের দিকে তাকাল, বস, একটু চায়ের কথা বলে আসি।

ওসব এখন থাক ভাই। তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই আমার এক বোন ছিল—ওই একটি মাত্রই বোন গীতা, তাকে গলা টিপে গত শনিবার রাত্রে কে যেন হত্যা করেছে।

হত্যা করেছে।

হ্যাঁ। প্রথমে সবার ধারণা হয় ব্যাপারটা বুঝি সুইসাইড, কিন্তু পরে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে, না গলা টিপে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

কোথায়?

তার শোবার ঘরে।

কিরীটীর অনুরোধে তখন শান্তনু সমস্ত ব্যাপারটা আগাগোড়া বলে যায়, তারপর বলে, কিন্তু কে-কে হত্যা করতে পারে গীতাকে? কেনই বা হত্যা করল? পুলিসের ধারণা বাড়িরই কেউআর ঐ শম্ভুচরণই, কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না।

কিরীটী জবাবে কিছু বলে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর একসময় বলে, ওই যে তিনটি ছেলের নাম করলে, গীতার সহকর্মী ও বিশেষ পরিচিত-কুণাল, প্রতুল ও সুভাষ—ওরা কি বলছে?

ওরা তো রীতিমত shocked!

ওদের তো তুমি সকলকেই চেন?

হ্যাঁ, খুব চিনি।

কি রকম মনে হয় ওদের?

কালচার্ড, সভ্য—আর যতদূর মনে হয় ওরা গীতাকে সত্যিই ভালবাসত।

They are all bachelors? কেউই বিয়ে করেনি?

না।

কে কি করে?

সুভাষের অবস্থাই ওদের মধ্যে সবচাইতে ভাল। কোন রকম চাকরিবাকরি করে, পার্টি নিয়েই সর্বদা ব্যস্ত। লেখাপড়া বোধহয়—বি. এ. পর্যন্ত পড়েছিল। কুনাল প্রফেসারি করে, তাছাড়া একজন কবি। অবস্থা মোটামুটি। প্রতুল একটা সংবাদপত্রের অ্যাসিসটেন্ট এডিটর। ওদের পার্টির একজন প্রচণ্ড উৎসাহী পাণ্ডা। সুভাষকে মনে হয়েছে আমার একটু অহংকারী ও উদ্ধত প্রকৃতির, কুনাল খুব শান্ত ও নিরীহ, প্রতুল ভীষণ বদরাগী ও অস্থির প্রকৃতির; একসময় কলেজজীবনে নামকরা একজন অ্যাথলেট ছিল।

কাল সন্ধ্যার দিকে ওদের একটিবার তোমার বাড়িতে ডাকতে পার? ওদের সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলতে চাই আমি।

বেশ তো।

.

পরের দিন সন্ধ্যায়—নিরালায়। এক এক করে প্রশ্ন করছিল ওদের কিরীটী।

প্রথমেই প্রতুল। দু-চারটে কথাবার্তার পর কিরীটী প্রতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে, এবারে একটা কথার শুধু স্পষ্ট জবাব চাই প্রতুলবাবু, আপনি গীতাকে ভালবাসতেন এবং গীতাও আপনাকে ভালবাসত জানি। আপনাদের পরস্পরের ওই ভালবাসার মধ্যে কি কোন কারণে চিড় ধরেছিল?

চিড়।

হ্যাঁ, কারণ ওই ধরনের ভালবাসা যেমন selfish তেমনি blind—অন্ধ। কখনও কখনও তাই সামান্যতম কারণে ও সামান্য সন্দেহে–

না, সেরকম কিছু ঘটেনি। কারণ সামনেই জানুয়ারিতেই আমরা বিয়ে করব স্থির ছিল–

এ কথাটা কুনাল ও সুভাষবাবু জানতেন?

স্পষ্ট করে আমরা না বললেও, ওরা বোধ হয় সন্দেহ করেছিল।

কীসে বুঝলেন?

মধ্যে মধ্যে ওদের কথাবার্তায় ইদানীং মনে হত।

আপনারা তিনজন সহকর্মী ও বন্ধু জানি, দীর্ঘদিনের পরিচিতও-ওদের দুজনার মধ্যে কাকে আপনি বেশি পছন্দ করেন?

সুভাষ অত্যন্ত selfish—আত্মসর্বস্ব, আর একটু অহংকারীও। I like কুনাল more than সুভাষ।

আচ্ছা সে-রাত্রে কখন ঠিক—মানে কত রাত্রে আপনারা বের হয়ে যান এই নিরালা থেকে মনে আছে?

হুঁ, মনে আছে-রাত বারোটা বেজে পনেরো মিনিট।

সে-সময় গীতাকে আপনার কি রকম মনে হয়েছিল?

অত্যন্ত স্বাভাবিক, হাসিখুশি।

আর একটা কথা প্রতুলবাবু, গীতার মৃত্যুর ব্যাপারে আপনার ঐ দুই বন্ধুর মধ্যে কাউকে আপনি সন্দেহ করেন?

না, না। এ আপনি কি বলছেন মিঃ রায়!

প্রেম মানুষকে যেমন দুর্বল অসহায় ভীরু করতে পারে, তেমনি অন্ধ অবিবেচক হিংস্রও করে তুলতে পারে। কথাটা আরও একটু স্পষ্ট করে বলি, এই প্রেম-যার অন্য সংজ্ঞা পুরুষ বা নারীর একের প্রতি অন্যের আকর্ষণ, যেটাকে মানুষের আদিম রিপুও বলতে পারেন।..আচ্ছা ঠিক আছে, আপাতত আর আপনার সঙ্গে আমার কোন কথা নেই। আপনি যেতে পারেন।