০৭. ল্যান্সডাউন মার্কেটের কাছাকাছি

০৭.

ল্যান্সডাউন মার্কেটের কাছাকাছি-বাঁয়ে একটা রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়ে ঢুকে একটা গলির মধ্যে দোতলা একটা বাড়ি।

নিচের ঘরে আলো জ্বলছিল। কলিংবেল টিপতেই একটু পরে ঘরের দরজাটা খুলে গেল, কে?

ওরা দুজনে দরজার গোড়াতেই তখনও দাঁড়িয়ে আছে।

তাদের সামনেই দাঁড়িয়ে একটি তেইশ-চব্বিশ বছরের তরুণী। পাতলা দোহারা চেহারা। পরনে একটা সিল্কের শাড়ি। চোখ-মুখ খুব সুশ্রী না হলেও উচ্ছল যৌবনরসে ও প্রসাধনে সুন্দরই দেখাচ্ছিল তরুণীকে। দুহাতে চারগাছা করে সোনার চুড়ি।

কাকে চান?

সুব্রতই কথা বললে, হীরেন বাড়ি আছে?

আছেন তরুণী বললে।

কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তখন তরুণীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

সুব্রত বললে, বলুন গিয়ে তাকে, সুব্রত এসেছে—সঙ্গে কিরীটী।

নিচের ঘরে ওদের বসিয়ে তরুণী ওপরে চলে গেল এবং একটু পরেই ফিরে এসে ওদের বললে, কিন্তু এখন তো দেখা হবে না।

হবে না? কেন?

তিনি ঘুমোচ্ছেন।

ঘুমোচ্ছে! এত তাড়াতাড়ি? সুব্রতই আবার প্রশ্ন করে।

রোজ এই সময়টা ঘুমের ওষুধ খান রাত্রে ঘুম হয় না বলে। ইঞ্জেকশান দেবার পর ঘুমোচ্ছেন।

ওঃ। তাহলে আর কি হবে! কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে সুব্রত।

কিরীটী বললে, হুঁ। চল, ফেরা যাক।

আচ্ছা, নমস্কার। আসি।

তরুণীও প্রতিনমস্কার জানালো দুটি হাত তুলে, নমস্কার।

ফিরে এসে ওরা গাড়িতে উঠে বসল।

কিধার জায়গা সাব? হীরা সিং শুধায়।

একবার শ্যামবাজার চল হীরা সিং-নাট্যমঞ্চ থিয়েটারে।

হীরা সিং গাড়ি ছেড়ে দিল।

সুব্রত একটু যেন বিস্মিত হয়েই বলে, আজ তো বুধবার, থিয়েটার নেই!

জানি। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী বলে।

তবে?

সজনীবাবু নিশ্চয়ই আছেন, তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করব।

সজনী গুপ্ত নামকরা একজন নাট্যকার ও নাট্য-পরিচালক এবং দীর্ঘদিন ধরে নাট্যশালার সঙ্গে জড়িত।

গাড়ি চলেছে শ্যামবাজারের দিকে। কিরীটী চুপচাপ বসে সিগার টানছে।

ব্যাপার কি বল তো কিরীটী, হঠাৎ নাট্যমঞ্চে কেন?

সন্দেহের একটা নিরসন করব মাত্র। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয়।

কীসের সন্দেহ?

চল্ না!

থিয়েটারের সামনে যখন ওরা এসে নামল, তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা। কাউন্টার বন্ধ, তবে লবিতে আলো ছিল।

লবিতে দেওয়ালের শো-কেশে বর্তমান নাটকের সব স্টীল টাঙানো। কিরীটী গেটে উপবিষ্ট দারোয়ানকেই শুধাল, সজনীবাবু হ্যায় দারোয়ান?

জী। উপরমে।

ওরা ওপরে উঠে গেল দোতলার সিঁড়ি দিয়ে। সরু প্যাসেজটার শেষপ্রান্তে সজনী গুপ্তর ঘর।

কিরীটী আর সুব্রত ঘরে ঢুকতেই সজনী বললেন, আসুন, আসুন—কি সৌভাগ্য আমার। বসুন, বসুন।

চেয়ারটা টেনে নিয়ে মুখোমুখি বসতে বসতে কিরীটী বলল, সজনীবাবু, আপনার নতুন নাটকের স্টীল দিয়ে নিশ্চয়ই একটা অ্যালবাম তৈরি করেছেন?

হ্যাঁ, কেন বলুন তো?

আছে সেটা এখানে?

আছে।

একবার দেখতে পারি?

দাঁড়ান, আগে চায়ের কথা বলি। সজনী বেল বাজালেন।

বেয়ারা রামলাল এসে ঘরে ঢুকতেই তিনি আবার বললেন, তিন কাপ ভাল চা নিয়ে আয় রামলাল।

রামলাল চলে গেল।

সজনী ঘরের আলমারি খুলে একটা ফটোর অ্যালবাম বের করে কিরীটীর সামনে। এগিয়ে দিলেন।

সুব্রত তখনও বুঝে উঠতে পারছে না, ব্যাপারটা কি! কেন কিরীটী এখানে এল আর কেনই বা তার চলতি নাটকের নির্বাচিত দৃশ্যগুলোর অ্যালবামের প্রয়োজন হল।

কিরীটী অ্যালবামটা টেবিলের উপরে রেখে পাতা উলটোতে উলটোতে চতুর্থ পৃষ্ঠায় একটা ফটোর প্রতি সজনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললে, এই মেয়েটি কে সজনীবাবু?

ও তো সঞ্চারিণী বিশ্বাস!

সুব্রতও ততক্ষণে ফটোটার ওপর ঝুঁকে পড়েছে এবং ঝুঁকে পড়েই চমকে উঠেছে। কোথায় যেন মেয়েটিকে সে দেখেছ! কিন্তু কোথায় দেখেছে, সেই মুহূর্তে কিছুতে মনে করতে পারল না।

মেয়েটি কতদিন আপনার থিয়েটারে আছে?

তা প্রায় বছর পাঁচেক হল। কিছু বেশিও হতে পারে। Talent আছে মেয়েটির। পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু ঘরের মেয়ে, কেন বলুন তো?

হীরেন সরকারকে আপনি জানেন?

জানব না কেন—একসময় তো এখানে অভিনয় করত, এখানকারই আর্টিস্ট ছিল!

অভিনয়-ক্ষমতা কেমন ছিল?

খুব ভাল অভিনয় করত। বেচারী হঠাৎ মাস আষ্টেক আগে কি হয়ে যেন পঙ্গু হয়ে গেছে—একেবার শয্যাশায়ী।

থিয়েটার ছেড়ে দিয়েছেন?

হ্যাঁ।

সঞ্চারিণী বিশ্বাসের সঙ্গে হীরেন সরকারের যথেষ্ট দহরম-মহরম ছিল, তাই না?

সজনী হাসলেন।—ঠিক। এখনও বোধ হয় তার keepingয়েই আছে সঞ্চারিণী।

হীরেন সরকারের তো আর্থিক অবস্থা এখন তেমন সুবিধার নয়, তবে?

তবু কেন সঞ্চারিণী তার সঙ্গে আছে, তাই না?

হ্যাঁ।

ওসব মশাই ভালবাসাবাসির ব্যাপার–দুর্জ্ঞেয়!

কিরীটী হেসে বললে, তাই দেখছি।

ইতিমধ্যে চা এসে গিয়েছিল।

চা-পান করতে করতে একসময় কিরীটী বললেন, অসুখ হবার পর হীরেন সরকারের সঙ্গে আপনার আর কখনও দেখা হয়েছে সজনীবাবু?

না। ওই সঞ্চারিণীর কাছেই মধ্যে মধ্যে তার খবর পাই।

রাত নটা নাগাদ অতঃপর কিরীটী উঠে দাঁড়াল।-আজ চলি সজনীবাবু।

কিন্তু কি ব্যাপার বলুন তো, হঠাৎ সঞ্চারিণী ও হীরেন সরকারের খোঁজখবরে আপনার কি প্রয়োজন হল রায়সাহেব? সজনী প্রশ্ন করলেন।

একটা কবিতার শেষ পঙক্তি মিলছিল না, সেটা মেলাবার জন্য এসেছিলাম আপনার কাছে।

কবিতার শেষ পংক্তি! কথাটা বলে সজনী কেমন যেন বিস্ময়ের সঙ্গে তাকান কিরীটীর মুখের দিকে।

কিরীটী মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ। আচ্ছা চলি। Good night.

সুব্রতর কাছে ব্যাপারটা তখন স্পষ্ট হয়ে গেছে।

দুজনে এসে আবার গাড়িতে উঠে বসল।

কিরীটী বললে, কোঠি চল হীরা সিং।

হীরা সিং গাড়ি ছেড়ে দিল।

.

গৃহে প্রত্যাবর্তন করে আহারাদির পর কিরীটী, সুব্রত ও কৃষ্ণা তিনজনে বসবার ঘরে এসে বসল। জংলী ওদের কফি দিয়ে গেল।

এতক্ষণ কিরীটী একটা কথা বলেনি, সুব্রতও তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তবে কিছু জিজ্ঞাসা না করলেও, সুব্রত কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বেশ বুঝতে পারছিল, কোন কিছুর একটা সমাধানের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে সে পৌঁছেছে।

ভ্রূ-যুগল সরল। চোখে একটা আনন্দের দীপ্তি ঝকঝক করছে।

কিরীটী?

উঁ।

মনে হচ্ছে যেন—

কীসের কি মনে হচ্ছে?

নীল রুমালের রহস্য যেন তোর কাছে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে এসেছে!

তা এসেছে। চারের অঙ্ক প্রায় মিলের মুখে। এখন কেবল শেষ পর্বের শেষ অধ্যায়ের পূর্ববর্তী অধ্যায়টি বাকি।

মানে?

শিবানন্দ-কাহিনী শিবানন্দ!

হ্যাঁ। প্রথমে শ্ৰীমন্ত, তারপর হারাধন, তারপর শশধর, এইবার শ্রীমান শিবানন্দের পালা। আর তাহলেই গ্রন্থ সমাপ্ত। কিন্তু ওই সঙ্গে একটা কথা কি মনে হচ্ছে জানিস?

কি?

ওরা প্রত্যেকেই deserved it! তাহলেও একটা কথা থেকে যাচ্ছে–

কৃষ্ণা শুধায়, কি গো?

কিরীটী বললে, আইন যদি সবাই যে যার খুশিমত হাতে তুলে নেয়, তাহলে আইন বলে আর কোন কিছু থাকে না। আইন-আদালত সব প্রহসন হয়ে যায়। তাই বলছিলাম—

কি? স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণা প্রশ্নটা করে।

আইন ভাঙার দণ্ড আইনভঙ্গকারীকে মাথা পেতে নিতেই হবে। শান্ত গলায় কিরীটী জবাব দেয়।

সুব্রত বললে, শিবানন্দকে তুই বাঁচাতে পারবি?

পারব কিনা জানি না, তবে চেষ্টা করব। তার বাড়ির চারপাশে পাহারাও রাখা হয়েছে।

বাইরে শীতের রাত তখন নিঝুম হয়ে এসেছে।

সুব্রত হঠাৎ উঠে পড়ে বলে, এবারে তাহলে উঠি রে—

কিরীটী বলে, মাথা খারাপ নাকি!

কৃষ্ণা বলে, আরে, তোমার বিছানা আমি করে রেখেছি।