০৪. সুব্রত বললে, তাহলে তুই বলতে চাস

০৪.

সুব্রত বললে, তাহলে তুই বলতে চাস কিরীটী, নীল রুমালের ফাঁস আরও একজনকে গলায় নিতে হবে!

তাই তো মনে হচ্ছে। তবে—

তবে কি? এবারে ওই শিবানন্দরই পালা নাকি?

কিরীটী মৃদু হাসল।

হাসছিস যে! আমারও মনে হয়—

কি মনে হয় রে?

ভদ্রলোক যেভাবে ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে তোর কাছ ছুটে এসেছিলেন—

কিন্তু ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বিপরীতও তো হতে পারে?

মানে?

অতি সতর্কতায় মতিভ্রম! যাগগে সে কথা। তারপরই হঠাৎ যেন কি মনে পড়েছে এমনি ভাবে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললে, হ্যাঁ রে সুব্রত–

কি?

হীরেন সরকারের সঙ্গে তোর জানশোনা ছিল না?

কোন্ হীরেন সরকারের কথা বলছিস?

আরে ওই যে সরকার জুয়েলার্সদের বাড়ির ছেলে—

হ্যাঁ, ছিল তো। তা কি হয়েছে তাতে?

তাকে একবার ডাকতে পারিস?

পারব না কেন? দীর্ঘকাল দেখা-সাক্ষাৎ নেই অবিশ্যি, তাহলেও দেখা করে তোের কথা বললে আসবেই। কিন্তু কেন?

কেন আবার কি—একটু আলাপ-সালাপ করতাম ভদ্রলোকের সঙ্গে আর কি।

কি হবে আলাপ করে?

কোথা থেকে কি হয়, কেউ কি কিছু বলতে পারেনা তাই কিছু বলা যায়?

বেশ, কালই যাব তার ওখানে একবার।

তাই যাস। আচ্ছা তোরা বস, আমি বিকাশকে একটা ফোন করে আসি। বলতে বলতে কিরীটী উঠে পড়ল সোফা থেকে।

কিন্তু ফোনে বিকাশ সেনকে থানায় পাওয়া গেল না, তখনও সে থানায় ফিরে যায় নি। এ. এস. আই. বললেন, কখন ফিরবেন তিনি বলতে পারেন না।

কিরীটী ফিরে এসে সোফায় বসতে বসতে বললে, খুব করিৎকর্মা ব্যক্তি আমাদের এই বিকাশ সেন। হয়ত সকালে আজ যা বলেছি, সেই সব নিয়েই সে মেতে উঠেছে। যাক গে, মরুক গে—তারপর তোর ব্যাপার কি বল্ তো সুব্রত!

কেন? ব্যাপার আবার কি?

এদিকে যে ভুলেও পা মাড়াস না!

কে বললে? প্রায়ই তো আসি, কৃষ্ণাকে জিজ্ঞাসা কর।

সুব্রত কখনও কৃষ্ণাকে নাম ধরে ডাকে, কখনও বৌদি বলে ডাকে।

কি করিস বাড়িতে বসে বসে?

কি আর করব, বই পড়ি।

তা ভাল। শেষ পর্যন্ত দেখবি ওই শুকনো বইয়ের পাতাগুলো ক্রমশ আরও নীরস হয়ে উঠছে। বুঝলি না তো সময়ে! অত করে বললাম তখন, চোখ কান নাক মুখ বুজে ঝুলে পড়।

সুব্রত হাসতে হাসতে বলে, দুঃখ হচ্ছে?

আমার নয়, তোর—তোর কথা ভেবে সত্যিই দুঃখ হচ্ছে। কুন্তলার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করিস?

না।

কেন?

কেন আবার কি, প্রয়োজন হয় না বলে!

মেয়েটাও হয়েছে তেমনি কৃষ্ণা, সুব্রতটা বুড়বাক বলে সেও গো ধরে বসে আছে।

কৃষ্ণা চুপ করে থাকতে পারে না, বলে, দায় পড়েছে তার! হ্যাংলামি করতে যাবে কেন—তার নিজস্ব একটা প্রেসটিজ নেই!

প্রেসটিজ! একে তুমি প্রেসটিজ বল কৃষ্ণা।

তা নয় তো কি?

বাইরে প্রেসটিজের মিথ্যে একটা মুখোশ মুখে এঁটে, ভেতরে ভেতরে সর্বক্ষণ চোখ মোছা–

থাম তো-মেয়েদের তুমি ভাব কি!

ঠিক যা ভাবা উচিত তাই ভাবি।

সুব্রত ওদের কথা শোনে বসে বসে, আর মৃদু হাসতে থাকে।

তরল হাসি-গল্পের মধ্যে দিয়ে আরও অনেকক্ষণ কাটিয়ে একসময় সুব্রত যাবার জন্য যেমন উঠে দাঁড়িয়েছে, কৃষ্ণা বললে, এ কি, উঠছ কোথায়?

বাঃ, যেতে হবে না!

হবে। তবে বিকেলে-দুপুরের খাওয়া এখানে।

সুব্রত বসে পড়ে বলল, তথাস্তু দেবী।

.

হাতে কিছু কাজ ছিল বিকাশের। কাজগুলো সারতে সারতে বেলা দুপুর গড়িয়ে যায়। প্রায় দেড়টা নাগাদ সে থানায় ফিরে এল।

অতক্ষণ ধরে কাজ করলেও তার মাথার মধ্যে কিন্তু সর্বক্ষণ কিরীটীর সকালের কথাগুলোই ঘোরাফেরা করছিল।

কিরীটী যা বললে, তা কি সত্যি! তিন-তিনটি হত্যার মধ্যে সত্যিই একটা সুস্পষ্ট যোগাযোগ আছে! অবিশ্যি তিনটি হত্যার মধ্যে দুটি ব্যাপারে অদ্ভুতমিল আছে—প্রথম, প্রত্যেকেই শহরের জুয়েলার্স, অবস্থা ভাল;দ্বিতীয়, প্রত্যেকেরই গলায় নীল রুমাল পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। আর সেই কারণেই কি কিরীটীর ধারণা, একই ব্যক্তি তিন-তিনটি নিষ্ঠুর হত্যার পেছনে রয়েছে? একজনেরই অদৃশ্য হাতের কারসাজি তিনটি হত্যাই?

আশ্চর্য নয়!

কিন্তু কথা হচ্ছে উদ্দেশ্য কি থাকতে পারে ওই ধরনের নৃশংস হত্যার?

কি উদ্দেশ্যে একটা লোক অমন নৃশংস ভাবে একটার পর একটা জুয়েলারকে হত্যা করে চলেছ এ শহরে?

ব্যক্তিগত কোন আক্রোশ কি?

কিন্তু কীসের আক্রোশ? কি ধরনের আক্রোশ?

ঝনঝন করে পাশে টেলিফোনটা টেবিলের উপরে বেজে উঠল। আঃ, শালারা একটু নিশ্চিন্তে বসে বিশ্রামও করত দেবে না। ঘণ্টাচারেক হন্তদন্ত হয়ে রোদে ছোটাছুটি করে এসে একটু বসেছি-একান্ত বিরক্ত ভাবেই ফোনটা তুলে নিল : ও- সি. বৌবাজার স্পিকিং!

ও প্রান্ত থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কে, বিকাশ—আমি কিরীটী।

সঙ্গে সঙ্গে বিকাশ সেনের মুখের ওপর থেকে বিরক্তির মেঘটা যেন কেটে যায়। সে উগ্রীব হয়ে ওঠে, সোজা হয়ে বসে।

বলুন, বলুন রায় সাহেব—

তুমি এখান থেকে যাবার পর সকালে একবার ফোন করেছিলাম।

আমি এই ফিরছি। কি ব্যাপার বলুন তো? ফোন করেছিলেন কেন?

সকালে তখন কয়েকটা কথা তোমাকে বলতে পারিনি—

কি কথা?

এর আগে যে দুজন জুয়েলার এ শহরে নীল রুমালের ফঁসে নিহত হয়েছে, তারা কোথায় কি ভাবে কখন নিহত হয়েছে এবং তাদের সম্পর্কে ডিটেলস্ খবরাখবর একটা যোগাড় করতে পার?

কিছুটা সংগ্রহ করেছি রায় সাহেব—

করেছ? খুব ভাল সংবাদ–

হ্যাঁ। আর সেই খবরের জন্যই এতক্ষণ বাইরে ঘুরে এলাম।

কি জানতে পারলে বল? টেলিফোনেই বলব, না

না, শোন, আমি আগামী কাল সকালেই দিন-কয়েকের জন্য দিল্লী যাচ্ছি প্লেনে—

হঠাৎ দিল্লী?

ওখানে এক মন্ত্রী মশাইয়ের দপ্তর থেকে একটা গোপন কনফিডেনসিয়াল দলিল বেপাত্তা হয়ে গেছে, তাই মন্ত্রী মশাই কিছুক্ষণ আগে এক জরুরী ট্রাঙ্ককল করেছিলেন আমায়–

তাহলে?

কি তাহলে?

এদিককার কি হবে?

কীসের—তোমার নীল রুমাল রহস্যের?

হ্যাঁ।

ভয় নেই, আমার ধারণা বা অনুমান যদি মিথ্যা না হয়, তাহলে আমাদের নীল রুমালের ভদ্রলোকটি এখুনি আবার তার হাত প্রসারিত করবেন না, কিছুটা অন্তত সময় নেবেন।

কিন্তু যদি না নেয়—

নেবে। অন্তত দিন পনেরো-কুড়ি তো নেবেই—সাধারণ যুক্তিতে। কারণ—

কি?

পুলিসকে যে তৃতীয়বার বোকা বানাল, সেই আত্মশ্লাঘা বা আত্মতৃপ্তিটা অন্তত কিছুদিন তো একটু যাকে বলে চেখে চেখে উপভোগ করবেই, মনে মনে হাসবে। ভয় নেই ভায়া, তার ওই আত্ম-অহমিকাই তার রথচক্র গ্রাস করবে ঠিক সময়ে। গতি রুদ্ধ হবে।

বলছেন!

হ্যাঁ, বলছি। যাক, যা বলছিলাম, ওই খবরগুলো কীভাবে সংগ্রহ করলে?

ফোনেই বলি–

না, থাক। বরং তুমি এখন আছ তো?

হ্যাঁ।

আমিই কিছুক্ষণের মধ্যে যাচ্ছি। সংবাদটা ফোন মারফত আদান-প্রদান না হওয়াই ভাল।

অন্য প্রান্তে কিরীটী ফোন রেখে দিল।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই কিরীটী থানায় এসে হাজির হল।

বিকাশ তখন স্নান সেরে চাট্টি মুখে দিয়ে কোনমতে সবেমাত্র নিচের অফিসে এসে বসেছে।

আসুন মিস্টার রায়!

তারপর, বল। কিরীটী বসতে বসতে বললে, কতটুকু কি সংবাদ সংগ্রহ করলে?

প্রথম ব্যক্তি নিহত হয় নীল রুমালের ফাসে, ঠিক আজ থেকে দুমাস আগে এক শনিবার রাত্রি আটটা-নটার মধ্যে কোন এক সময়। কারণ—

কারণ? কিরীটী বিকাশের মুখের দিকে তাকাল।

রাত সোয়া আটটা নাগাদ শ্যামবাজার অঞ্চলে তার জুয়েলারির দোকান বন্ধ করে বেরুতে যাবেন শ্ৰীমন্ত পোদ্দার, ঠিক তখন একটা ট্যাকশি এসে থামে তার দোকানের সামনে–

বলে যাও।

লোকটির যে বর্ণনা দোকানের কর্মচারীদের একজনের কাছে পাওয়া গেছে তা হচ্ছে, লোকটি মধ্যবয়সী, রোগা। পাকানো চেহারা। পরনে দামী স্যুট ছিল।

আর কিছু? আর কোন বিশেষত্ব?

না, তেমন কিছু রিপোর্ট নেই আর।

হুঁ, বলে যাও।