০৩. ঘণ্টাখানেক বাদে কিরীটীও বের হচ্ছে

ঘণ্টাখানেক বাদে কিরীটীও বের হচ্ছে দেখে কৃষ্ণা শুধোয়, বেরোচ্ছ নাকি?

হ্যাঁ, একটু ডালহাউসি যাব।

সংবাদপত্র প্রত্যহের অফিসে বোধ হয়?

ঠিক।

তোমার কি সত্যিই মনে হয়–

কি?

ওই বিজ্ঞাপনটার সঙ্গে—

নীল রুমাল হত্যা-রহস্যের কোন যোগাযোগ আছে কিনা?

হ্যাঁ, মানে—

কিন্তু কৃষ্ণার কথা শেষ হল না, নিচের কলিংবেলটা বেজে উঠল। কৃষ্ণা বললে, ওই দেখ, আবার যেন কে এল! সুব্রত ঠাকুরপো বোধ হয়—

মনে হচ্ছে, না। তার বেল বাজানো ঠিক ওই রকম নয়।

ওই সময় জংলী এসে ঘরে ঢুকল, বাবুজী!

কি রে?

একজন ভদ্রলোক দেখা করতে চান।

ভদ্রলোক! কোথা থেকে আসছেন?

তা তো কিছু বললেন না, বললেন আপনার সঙ্গে কি বিশেষ দরকার আছে।

যা, ডেকে নিয়ে আয়।

জংলী নিচে চলে গেল। কৃষ্ণাও ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল, কিরীটী তাকে সম্বোধন করে বললে, এখন আর বেরোব না।

সেই ভাল, ফুলকপির সিঙাড়া ভাজছিলাম–

সুব্রতকে খবর দিয়েছ?

কালই ফোনে বলেছি, এখুনি হয়ত এসে পড়বে।

ঠিক আছে, তুমি যাও।

কৃষ্ণা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা যায়। কিরীটী কান পেতে শোনে। দুজোড়া শব্দ। প্রথম শব্দটা জংলীর, তার সঙ্গে যে শব্দটা কানে আসে, সেটা থেমে থেমে-হাতে বোধ হয় একটা লাঠি আছে, লাঠির শব্দও কানে আসে।

সত্যিই তাই। পরমুহূর্তে জংলীর পেছনে পেছনে যে লোকটি ঘরে এসে প্রবেশ করে, তার বয়স খুব বেশি না হলেও দেখলে মনে হয় যেন অকালে বুড়ো হয়ে গেছে। রসকষহীন শুকনো পাকানো চেহারা, মুখটা লম্বাটে ধরনের, মুখে চাপদাড়ি, কণ্ঠার হাড় দুটো প্রকট, কপালে একটা জড়ল চিহ্ন। দুটি চোখে যেন শৃগালের মত অস্থির সতর্ক দৃষ্টি। ডান পা-টা মনে হয় পঙ্গু, হাতে একটা মোটা লাঠি। পরনে দামী শান্তিপুরী ধুতি, গ্রে কলারের গরম সার্জের পাঞ্জাবির ওপর একটা দামী কাশ্মিরী সাল জড়ানো।

নমস্কার।

কিরীটী প্রতিনমস্কার জানায় হাত তুলে, নমস্কার বসুন।

হ্যাঁ, এই যে বসি। ভাঙা ভাঙা একটু যেন মোটা কর্কশ স্বর।

কোনমতে আগন্তুক কিরীটীর মুখোমুখি সোফাটার ওপরে বসে পাশে তার লাঠিটা রাখলেন। তারপর বললেন, আপনিই নিশ্চয় রায়মশাই?

হ্যাঁ।

আগন্তুক পকেট থেকে একটা দামী সোনার সিগারেট কেস বের করেন, কেস থেকে একটা দামী বিলাতী সিগারেট নিয়ে কেসটা কিরীটীর দিকে এগিয়ে ধরে বললেন, সিগারেট!

না ধন্যবাদ।

সিগারেট চলে না বুঝি? ধূমপানে বুঝি অভ্যস্ত নন? তা ভাল, বড় বদ অভ্যাস–

চলে, তবে সিগারেট নয়—সিগার আর পাইপ।

সুদৃশ্য দামী একটা ম্যাচবক্স-হোলডার থেকে কাঠি বের করে সিগারটে অগ্নিসংযোগ করতে তৎপর হন আগন্তুক।

কিরীটী লক্ষ্য করে, আগন্তুকের দুহাতের তিন আঙুলে আংটি, তার মধ্যে ডান হাতের অনামিকায় যে আংটিটা রয়েছে সেটায় একটা বেশ বড় সাইজের হীরে বসানো রয়েছে এবং অন্য আংটি দুটো মীনে করা।

হীরেটার দাম খুব কম করেও হাজার দশেক তো হবেই। দামী হীরে। জ্বলজ্বল করছে। বেশভূষা, সোনার সিগারেট কেস, হাতের হীরের আংটি—সব কিছুই যেন নির্দেশ করছে যে আগন্তুক একজন ধনী ব্যক্তি।

সিঁড়িতে ওই সময় দ্রুত জুতো-পরা পায়ের শব্দ শোনা গেল।

কিরীটী বুঝতে পারে সুব্রত আসছে।

পরমুহূর্তই সুব্রত ঝড়ের মত ঘরে ঢুকে চেঁচিয়ে ওঠে, বৌদি–

কিন্তু বাকি কথা সে শেষ করতে পারে না। ঘরের মধ্যে কিরীটীর সামনে একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তিকে দেখে থেমে গেল এবং সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকাল।

আয় সুব্রত, বস্।

বৌদি—

বস, এখনও দেরি আছে।

সুব্রত বুঝতে পারে, কিরীটী তাকে বসতে বলছে। আর কোন কথা না বলে সে কিরীটীর পাশেই বসে পড়ল।

হ্যাঁ  এবারে বলুন তো আমার কাছে আপনার কি প্রয়োজন? প্রশ্নটা করে কিরীটী আগন্তুকের দিকে দৃষ্টিপাত করল।

আমার নাম শিবানন্দ বসু। বালিগঞ্জে বোস অ্যান্ড কোং নামে যে জুয়েলারি শপটা আছে তার প্রোপ্রাইটার—মানে মালিক আমি।

তা আমার কাছে কি প্রয়োজন বলুন তো বোস মশাই?

ভদ্রলোক কেমন যেন একটু ইতস্তত করতে থাকেন। আড়চোখে সুব্রতর দিকে তাকান।

ও, সুব্রত আমার অন্তরঙ্গ ও সহকারী। আমাকে যা বলার, ওর সামনে আপনি তা নিঃসঙ্কোচে বলতে পারেন শিবানন্দবাবু। তারপর একটু থেমে কিরীটী বললে, মনে হচ্ছে। বিশেষ কোন কারণে আপনি একটু চিন্তিত?

সত্যিই তাই রায় মশায়। ব্যাপরটা হচ্ছে—

বলুন?

আপনার নজরে পড়েছে কিনা জানি না, গত দুমাসের মধ্যে এই শহরে–

আপনি কি সেই নীল রুমালের ফাঁস লাগিয়ে যে সব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, সেই কথাই

ঠিক তাই। কিন্তু আশ্চর্য, বুঝলেন কি করে?

আপনি একজন নামকরা জুয়েলার বললেন না? যাঁদের হত্যা করা হয়েছে, তারাও সবাই জুয়েলার ছিলেন কিনা—

ঠিক। সেই কারণেই আমি এসেছি আপনার কাছে একটা পরামর্শের জন্য।

কীসের পরামর্শ বলুন তো?

আমার কেমন একটা ভয় ঢুকেছে মনে। কে জানে এবার আমারই পালা কিনা!

কিরীটী হেসে ফেলে।

হাসছেন যে রায় মশাই?

হাসছি এই কারণে, কলকাতা শহরে তো অনেক জুয়েলার আছেন, বলতে বলতে হঠাৎ কিরীটী শিবানন্দের বাঁ-হাতের মধ্যমায় মীনাকরা আংটিটার দিকে তাকিয়ে থেমে যায়।

শিবানন্দর দৃষ্টি এড়ায় না বোধ হয় ব্যাপারটা। বলেন, কি দেখছেন?

না, কিছু না। কি বলছিলেন বলুন?

বুঝতেই পারছেন রায় মশাই, ব্যাপার স্যাপার দেখে আমি বড় নার্ভাস হয়ে পড়েছি–

কেন বলুন তো?

বলেন কি! বেটাদের যত আক্রোশ তো দেখছি সব আমাদের জুয়েলার্সদের ওপরেই। বেটারা যেন আমাদের সব খতম করবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তাই ভয়ে ভয়ে আছি সর্বক্ষণ। রাতে ঘুম নেই, আহারে রুচি নেই—জেগে জেগে যেন কেবলই ওই নীল রুমালের আতঙ্ক দেখছি, ভয়াবহ এক বিভীষিকা।

তা শিবানন্দবাবু, সেজন্য আমার কাছে এসেছেন কেন? আমি তো আর আপনাকে কোন প্রোটেকশান দিতে পারব না! তা যদি কেউ পারে তো পুলিসই পারবে।

তা কি আর জানি না রায় মশাই—

তবে?

পুলিস হয়ত আমার কথায় কানই দেবে না।

তা কেন? বলেন তো টালিগঞ্জ থানার ও. সি.-কে আমি বলে দিতে পারি—

না না, মশাই, বরং আপনি যদি কোন পথ বাতলাতে পারেন—

না, ক্ষমা করবেন। তাছাড়া—

আহা, সাহায্য না করতে পারেন, উপদেশ তো কিছু দিতে পারেন।

বাড়িতে গোটা দুই দারোয়ান রাখুন।

তা কি আর বাকি রেখেছি রায় মশাই-তিন-তিনজন দারোয়ান বহাল করেছি। তবু নিশ্চিন্ত হতে পারছি না, স্বস্তিতে বাইর ঘোরা-ফেরা পর্যন্ত করতে পারছি না।

সুব্রত কিরীটীর পাশে বসে শিঃশব্দে এতক্ষণ শিবানন্দ বোসের কথাবার্তা শুনছিল। এবারে বললে, আপনি বরং এক কাজ করুন শিবানন্দবাবু–

কি বলুন তো?

মাসখানেকের জন্য কাউকে কোথায় যাচ্ছেন না জানিয়ে বাইরে কোথাও গিয়ে কাটিয়ে আসুন।

সেই পরামর্শ দিচ্ছেন!

হ্যাঁ। নীল রুমালের ব্যক্তিটির সত্যিই যদি আপনার উপরে কোন আক্রোশ থাকে তো মাসখানেক অন্তত তো আপনার খোঁজ পাবে না—

কিন্তু তারপর? সব কিছু ফেলে দিয়ে তো আমি অজ্ঞাতবাসে বাকি জীবনটা কাটাতে পারি না। তাছাড়া শেষ পর্যন্ত যদি তারা আমাকে খুঁজে বের করে ফেলে।

শিবানন্দবাবু? কিরীটী আবার কথা বলে।

আজ্ঞে।

আপনার ছেলেমেয়ে কটি?

নেই।

নেই মানে? আপনার কোন সন্তানাদি নেই?

না। আমার স্ত্রীর কোন সন্তান হয়নি। দুঃখের কথা আর বলেন কেন?

তবে আপনার বিষয়-আশয়ের ওয়ারিশন কে?

কে আর–ওই নানু, বোম্বেটে ভাগ্নেটারই শেষ পর্যন্ত হবে পোয়া বারো!

ভাগ্নে!

হ্যাঁ, ভাগ্নে নয়—বলতে পারেন কুলাঙ্গার। লেখাপড়া করল না, মানুষ হল না, কাজকর্মও শিখল না। সর্বক্ষণ পার্টি করে বেড়ায়।

কোন পার্টির লোক তিনি?

কে জানে মশাই, এদেশে তো হাজারটা পার্টি। নামও জানি কি ছাই তার যে বলব কোন্ পার্টি শ্রীমানের। বুঝলেন, দিতাম গলা-ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে বাড়ি থেকে, কিন্তু ওই যে–

কি?

তার মামী–মামার অর্ধাঙ্গিনীটি, সে যে নানু বলতে অজ্ঞান। বলেছিলাম একবার তাড়িয়ে দেব, তা ঘন ঘন ফিট হতে শুরু করল গিন্নীর। শেষে সাপের ছুঁচো গেলার মত চুপ করে রামবুদ্ধ হয়ে বসে আছি। মরুক গে—যা খুশি ওরা করুক গে। অথচ মশাই, ছেলেটা লেখাপড়ায় ভালই ছিল—

তাই বুঝি?

হ্যাঁ। স্কুল-ফাইন্যাল পাস করে বিদ্যাসাগরে বি. এসি. পড়ছিল, তারপরই মাথায় ঢুকল পোকা। ব্যাস, সব কিছু শিকেই উঠল। এখন দিবা-রাত্র পাটি করছেন আর আমার অন্নধ্বংস, ধনক্ষয় করছেন।

কিরীটী মনে মনে বলে, ঠিকই করছে-বর্বরস্য ধনক্ষয়! কিন্তু মুখ দিয়ে তার সে কথাটা বের হল না, কেবল মিটিমিটি হাসে।

শিবানন্দ এবারে বললেন, আমি অবিশ্যি আপনার পরামর্শ এমনি চাই না, তার জন্যে পারিশ্রমিক দিতে আমি কার্পণ্য করব না—

ঠিক আছে শিবানন্দবাবু, আপনার কথাটা আমি ভেবে দেখব।

দেখবেন?

হ্যাঁ, দেখব।

ব্যস, ব্যস—তাহলেই আমি খুশি। বড় বিপদে পড়েছি রায় মশাই, এ বিপদ থেকে আপনি আমাকে উদ্ধার করুন—আমিও আপনাকে খুশি করে দেব। আচ্ছা, তাহলে আমি উঠি। নমস্কার।

নমস্কার।

শিবানন্দ অতঃপর উঠে পড়লেন এবং লাঠির সাহায্যে পঙ্গু ডান পা-টা সামান্য টেনে টেনে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

কিরীটী একদৃষ্টে শিবানন্দর ক্রমঅপস্রিয়মাণ দেহটা ও চলার ভঙ্গির দিকে তাকিয়ে ছিল।

সুব্রতর সেদিকে নজর পড়ায় বললে, কি দেখছিস রে কিরীটী?

কিরীটী সে কথায় জবাব না দিয়ে বলল, কেমন বুঝলি সুব্রত।

কীসের কি বুঝলাম?

বলছিলাম, ভদ্রলোকের আগমন ও প্রত্যাগমন থেকে কি তোর মনে হল!

বেশ ভয় পেয়ে গেছেন মনে হল।

তা ঠিক, তবে ওই যে একটা কথা আছে না আমাদের দেশে–

কি?

ভেক না নিলে ভিক্ষে মেলে না!

সুব্রতর কথার জবাব দেওয়া হল না, কৃষ্ণা এসে ঘরে প্রবেশ করল। হাতে তার প্লেটে গরম গরম সিঙাড়া।

সুব্রতও সব কিছু ভুলে গিয়ে হাত বাড়িয়ে কৃষ্ণার হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে নিল এবং বিনা বাক্যব্যয়ে সিঙাড়ার সদ্ব্যবহার শুরু করে দিল।

কৃষ্ণা মুখোমুখি বসতে বসতে বললে, কে এসেছিল গো?

কিরীটী মৃদু কণ্ঠে হেসে বললে, নীল রুমাল।

মানে!

ওই আর কি, নীল রুমালের আতঙ্কে আতঙ্কিত এক ভদ্রলোক। সুব্রত বললে।

তাই নাকি? কি রকম?

সুব্রতই সংক্ষেপে ব্যাপারটা বিবৃত করে গেল সিঙাড়ার স্বাদ নিতে নিতে।

কিরীটী হঠাৎ ওই সময় বলে উঠে, ব্যাপারটা নিয়ে আজ সকাল থেকে চিন্তা করতে করতে একটা ব্যাপার আমার কাছে যেন এখন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে সুব্রত–

কি বল তো?

নীল রুমালের ব্যাপারটায় পূর্বপরিকল্পিত দৃঢ় সঙ্কল্প কারও-না-কারও আছে। কিরীটী তার সামনের নিচু টেবিল থেকে সুদৃশ্য চন্দনকাঠের সিগারের বাক্সের ডালাটা খুলে একটা সিগার তুলে নিয়ে সেটায় অগ্নিসংযোগ করতে করতে বললে।

পূর্বপরিকল্পিত দৃঢ় সঙ্কল্প!

হ্যাঁ। এই দুই দিন—তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে, এবারে চতুর্থ ব্যক্তির পালা, চারের অঙ্ক আর কি–

বলিস কি!

কিন্তু ভাবছি, সেই চতুর্থ কে? কার জন্য হত্যাকারীর নীল রুমাল অপেক্ষা করেছে?