০২. চা-জলখাবার নিয়ে আসি

০২.

যাই, চা-জলখাবার নিয়ে আসি।

কৃষ্ণা সোফা ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

কিরীটীর অনুমান মিথ্যা নয়, একটু পরেই সিঁড়িতে একটা ভারী জুতোর মচমচ শব্দ শোনা গেল।

মোটা মানুষ বিকাশ সেন, বৌবাজার থানার ও. সি.সিঁড়ি ভাঙার পরিশ্রমে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে এসে ঢুকল।

এস বিকাশ!

বিকাশ ধপ করে একটা সোফার উপরে বসতে বসতে বললে, বাপস! বলুনএবারে রায় সাহেব, ঊর্ধ্বশ্বাসে একেবারে ছুটে আসছি জীপ নিয়ে!

কিরীটী হাসল।

হাসছেন আপনি! আর এদিকে—

দেহের ওজনটা একটু কমাতে পার না? তাহলে আর হাঁপাতে হয় না!

আপনিও ওই কথা বলবেন রায় সাহেব! ঘরে-বাইরে যদি ওই একই কথা শুনতে হয়—

কেন হে, ঘরে আবার তাগিদ দিচ্ছে কে?

কে আবার! সখেদে বলল বিকাশ, তাগিদ দেবার যার ক্ষমতা বা অধিকার আছে।

বল কি, ভদ্রমহিলাও তোমার পেছনে লেগেছেন?

অথচ জানেন, গত আট মাসে আমার বিশ সের ওয়েট কমে গেছে! এভাবে ওয়েট কমতে থাকলে

তাই নাকি? তা আট মাস পূর্বে কত ছিল—কত?

আড়াই মণও নয়—ছ’মাসের কম।

কিরীটী গম্ভীর হবার চেষ্টা করে কোনমতে হাসি চেপে বলে, তাহলে তো সত্যিই যথেষ্ট কমে গেছে!

বলুন তাহলে—আরও কমলে হাঁপ ধরবে না? স্রেফ ব্যাঙাচিতে—

নির্ঘাত পরিণত হবে।

আমার পরিবারটিকে একটু বুঝিয়ে বলতে পারেন, মোটা না হয় একটু আমি সামান্যই, তাহলেও আমার মত অ্যাকটিভ অফিসার কজন আছে উপরিওয়ালারা, বলুন তো!

তা কথাটা মিথ্যা নয়, মোটাসোটা হলে কি হবে, বিকাশ সেন সত্যিই খুব কর্মঠ অফিসার, সরকারী মহলে যথেষ্ট নামও আছে, কিরীটীর সেটা অজানা নয়।

যাগগে ওসব কথা, বলুন এখন-হঠাৎ আসতে বললেন কেন ফোন করে—

বসো বসো, আগে চা-জলখাবার খেয়ে সুস্থ হও।

কৃষ্ণা ওই সময় একপ্লেট সন্দেশ ও চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।

কেমন আছেন বিকাশবাবু? কৃষ্ণা প্রশ্ন করে।

নমস্কার বৌদি। ভাল, চমৎকার। কেবল চারদিকে বদমাশ শয়তানগুলো জ্বালাতন করে মারছে। এই দেখুন না, গত পরশু একজন আবার নীল রুমালের ফাসে খতম হয়েছেন—আর হবি তো হ আমারই চৌহদ্দির মধ্যে।

ভাল কথা বিকাশ, সেই নীল রুমালটা এনেছ? কিরীটী প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ, এই যে—বলতে বলতে পকেট থেকে ছোট একটা কাগজের প্যাকেট বের করল বিকাশ সেন।

কিরীটী হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিল। নাও শুরু কর বিকাশ।

বিকাশকে বলবার আগেই সে প্লেটটা টেনে নিয়েছিল।

কিরীটী কাগজের মোড়কটা খুলতেই একটা দামী বিলাতী সেন্টের গন্ধের ঝাপটা ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলের নাকে এসে লাগল। নীল রঙের—আকাশ-নীল রঙের একটা বড় সাইজের রেশমী রুমাল।

কিরীটী রুমালটা মেলে ধরে দেখতে দেখতে বললে, হুঁ, হত্যাকারী মহাশয় দেখছি। রীতিমত সৌখীন ব্যক্তি! বন্দুক, রিভলবার, ছোরাছুরি নয়—একেবারে একটি সেন্টনিষিক্ত আকাশ-নীল রঙের রেশমী রুমালকেই হাতিয়ার করেছেন! জেনুইনিটি আছে বলতে হবে, কি বল বিকাশ?

একটা বড় আমসন্দেশ গালে পুরে চিবুতে চিবুতে বিকাশ বললে, তা যা বলেছেন। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা, যে রেটে এ শহরে নীল রুমালের আবির্ভাব ঘটতে শুরু করছে, শেষ পর্যন্ত না আমাদের পুলিশ মহলের কণ্ঠদেশেই তা চেপে বসে!

কিরীটী হো-হো করে হেসে ওঠে বিকাশের কথায়।

বিকাশ আর একটা সন্দেশ মুখে পুরতে পুরতে বলে, অতি উপাদেয়, কোথাকার সন্দেশ বৌদি? কোন্ দোকানের?

কৃষ্ণা জবাব দেয়,–দোকানের নয়।

তবে?

আমার হাতে তৈরি।

আঃ! কি ইচ্ছা করছে জানেন বৌদি?

কি? সহাস্য মুখে তাকাল কৃষ্ণা বিকাশ সেনের দিকে।

হাত দুটো আপনার সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিই।

কিরীটী আর কৃষ্ণা দুজনেই হাসে।

সন্দেশের রেকাবিটা নিঃশেষ করে চায়ের পেয়ালাটা তুলে নিতে নিতে বিকাশ বললে, কি কিরীটীবাবু, রুমালটা থেকে কিছু হদিস পেলেন?

আপাতত যা মনে হচ্ছে, তা হচ্ছে রুমালের সাধারণত যা সাইজ হয়ে থাকে তার থেকে কিছু বড়। সাধারণ সিল্কের রুমাল আর এক কোণে রুমালটার সাঙ্কেতিক ইংরাজী অক্ষর 3 লেখা ছাড়া বিশেষ কোন হদিস মিলছে না, তবে–

তবে?

ওই 3 সাঙ্কেতিক অক্ষরটিকে যদি বিশেষ একটা ইঙ্গিত বলে ধরে নেওয়া যায় তো বলতে হবে

বিকাশ সাগ্রহে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে শুধাল, কি মিস্টার রায়?

পরশুর হত্যাটি নিয়ে যে তিনটি হত্যাকাণ্ড এই দু মাসে এই শহরে সংঘটিত হয়েছে। এই ধরনেরই নীল রুমালের সাহায্যে, সেগুলির মধ্যে অর্থাৎ সেই হত্যাকাণ্ডগুলির মধ্যে একটা বিশেষ যোগাযোগ বা যোগসূত্র হয়ত আছে।

ঠিক। আমারও তাই মনে হয়েছিল। একই ব্যক্তির দ্বারা সব কটি হত্যাকাণ্ডই সংঘটিত হয়েছে মনে হচ্ছে।

হ্যাঁ।

অর্থাৎ হত্যাকারী একই ব্যক্তি, এই তো বলতে চান আপনি? বিকাশ বললে।

কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বললে, মনে হচ্ছে তো সেই রকমই।

কিন্তু একটা কথা–, বিকাশ বলে।

কি বল তো? কিরীটী বিকাশের মুখের দিকে তাকাল।

ওটা যদি ইংরাজি ‘3’ না হয়ে বাংলার ‘ও’ হয়।

না।

কি না?

ওটা ইংরাজির 3 ই।

কি করে স্থিরনিশ্চয় হলেন?

একটা বিজ্ঞাপন সংবাদপত্রে তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কিনা জানি না। বিকাশ–

বিজ্ঞাপন।

হ্যাঁ, বিজ্ঞাপনটা কিছুদিন থেকে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে—

কি বিজ্ঞাপন বলুন তো?

কিরীটী তখন দৈনিক প্রত্যহে প্রকাশিত বিজ্ঞাপন—যেটা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এবং যে বিজ্ঞাপন সম্পর্কে কিছুক্ষণ পূর্বে তার কৃষ্ণার সঙ্গে আলোচনা চলছিল সেটা সম্পর্কে বললে।

সত্যি? দেখি বিজ্ঞাপনটা।

কিরীটী কাগজটা এগিয়ে দিল।

বিকাশ বিজ্ঞাপনটা বারকয়েক পড়ল। তারপর বললে, হুঁ। বিজ্ঞাপনটা সত্যিই বিচিত্র তো! তাহলে–

ঠিক তাই বিকাশ, পর পর তিনটি হত্যাকাণ্ডই বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং এক বা একাধিক ব্যক্তির দ্বারা যদি সংঘটিত হয়েও থাকে, তাহলেও pre-planned premeditated, পূর্বপরিকল্পিত বলেই মনে হয়–

তা তো বুঝলাম, কিন্তু—

কি বল?

উদ্দেশ্য একটা নিশ্চয়ই আছে!

তা আছে বৈকি। হত্যাকারী কিছুটা maniac হলেও, হত্যাগুলোর পেছনে তার একটা উদ্দেশ্য সুনিশ্চিত আছে। হয়ত প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধ—কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পূর্বে তোমাকে কতকগুলো ব্যাপারে ভাল করে অনুসন্ধান নিতে হবে।

কিন্তু কি অনুসন্ধান করি বলুন তো? ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে আর কেউ ছিল বলেই তো এখনও জানা যায়নি। পেছনের গ্যারাজে যে ব্যাটা দারোয়ান ছিল, সে ব্যাটা তো সিদ্ধির নেশায় সে রাত্রে ঝুঁদ হয়েছিল।

আচ্ছা সংবাদপত্রে যে নিউজ বের হয়েছে–সেদিন রাত আটটা নাগাদ কার কাছ থেকে একটা ফোন-কল পেয়ে শশধর সরকার বার হয়ে যান বাড়ি থেকে–

হ্যাঁ, তার স্ত্রী তো বলতে পারলেন না, ফোন-কলটা কোথা থেকে এসেছিল! কেবল বললেন, তাঁর স্বামী নাকি তাকে বলেছিলেন ফোন-কলটা জরুরী।

জরুরী তো বটেই—একেবারে মৃত্যু-পরোয়ানা। তাই বলছিলাম, সেটার কোন ট্রেস করা যায় কিনা দেখ।

কেমন করে সম্ভব তা? অটোমেটিক ফোন–

তবু দেখ, চেষ্টা করলে হয়ত জানতেও পার। তারপর ওই বিনয়ভূষণ—

সেখানেও একটা ধোঁয়া।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ। ওই বিনয়ভূষণকে শশধরবাবুর স্ত্রী জানতেন না। তবে একটা সংবাদ পেয়েছি, দিন পনেরো আগে দোকানের চাকরি থেকে নাকিবিনয়কে বরখাস্ত করেছিলেন শশধর সরকার।

কি করে জানলে?

দোকানের একজন কর্মচারী যতীন সমাদ্দারই বললে এনকোয়ারির সময়। যে ফোন করেছিল শশধরের স্ত্রী সুনয়না দেবীকে সে বিনয়ভূষণের নাম করে ওই সব বলে। তাছাড়া আরও একটা কথা আছে, সে-রাত্রে তো নাকি বিনয়ভূষণ কলকাতাতেই ছিল না।

তবে কোথায় ছিল?

অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, বিকাশ বললে, বিনয়ভূষণ দিন দশেক আগে। থাকতেই তার বৌবাজারের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে শ্রীরামপুর চলে গিয়েছিল সেখানে একটা দোকানে চাকরি পেয়ে। সে-রাত্রে শ্রীরামপুরেই ছিল। ওই দিন সকালে কলকাতায় আসে কি একটা কাজে।

কিরীটী বললে, তা বিনয়ভূষণের চাকরি গিয়েছিল কেন, জানতে পেরেছ কিছু?

হ্যাঁ, চুরির ব্যাপারে—

চুরি?

হ্যাঁ। কিছু দামী জুয়েল্স্ চুরির ব্যাপারের সন্দেহে তার চাকরি যায়।

আচ্ছা শশধর সরকারের ফ্যামিলি মেম্বারস কজন? কে কে আছে বাড়িতে?

নিঃসন্তান ছিলেন উনি। স্ত্রী এবং একটি পোয্য ভাইপো রাজীব সরকার—আর চাকরবাকর, দারোয়ান, ড্রাইভার।

রাজীব সরকার কি করে?

সেও তার কাকার সঙ্গে দোকানেই বসত। এখন বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা যেমন ধোঁয়াটে তেমনি রীতিমত রহস্যজনক। আমি তো মিঃ রায়, কোন আলোর বিন্দুও কোথাও দেখতে পাচ্ছি না।

সুনয়না দেবী ও রাজীব সরকারকে ভাল ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলে?

করেছি।

তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেও কিছু জানতে পারা গেল না?

না। তারা বললেন, শশধরবাবু নাকি অত্যন্ত অমায়িক ও সৎ চরিত্রের লোক ছিলেন। কখনও কারও সাতে বা পাঁচে থাকতেন না। তার কোন শত্রু ছিল না। ওই ভাবে তার মৃত্যুটা তাদের কাছে কল্পনাতীত।

আচ্ছা দোকানটা কত দিনের? কিরীটী প্রশ্ন করে।

শুনলাম দোকানটা নাকি উনিই করেছিলেন—বছর পাঁচেক হল। ছোট দোকন থেকে পাঁচ বছরে বিরাট কারবার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ওটা পৈতৃক সম্পত্তি নয় তাহলে? পাঁচ বছরের ঐশ্বর্য?

হ্যাঁ। ওঁর বাপ রামজীবন সরকার সামান্য একজন কারিগর ছিলেন। শশধরও তাই ছিলেন। বাপ বছর আষ্টেক আগে মারা যান। বছর পাঁচেক আগে কাজ ছেড়ে দিয়ে কিছুদিন বসেছিলেন, তারপর ছোট্ট একটা দোকান খোলেন। তারপর ধীরে ধীরে

নিজের চেষ্টা, অধ্যবসায় ও পরিশ্রমে সরকার জুয়েলারির আবির্ভাব—তাই তো?

হ্যাঁ।

তা শশধর কোথায় চাকরি করত, কোন্ দোকানে-কিছু জানা গেছে—

সে খবরও নিয়েছি, বিরাট জুয়েলার্স বি. কে. সরকার অ্যান্ড সন্সের নামটা আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে

মনে থাকবে না কেন? সে তো প্রায় বছর পাঁচেক আগে কি সব আভ্যন্তরীণ কারণে প্রতিষ্ঠানটা বন্ধ হয়ে যায়।

হ্যাঁ, সেখানেই চাকরি করতেন শশধর সরকার এক সময়।

কিরীটী কিছুক্ষণ যেন কি ভাবল। তারপর বিকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, একটা খোঁজ নিতে পার বিকাশ–

কি বলুন তো?

বি. কে. সরকার অ্যান্ড সন্সের মালিক বা মালিকদের মধ্যে কেউ আছেন কিনা এবং যদি থাকেন তো বর্তমানে কে কোথায় আছেন, কি করছেন—

তা পারব না কেন?

হ্যাঁ, খবরটা সংগ্রহ কর তো। ভাল করে সন্ধান নাও। আলোর বিন্দু হয়ত দেখতে পাব এক-আধটা, আর–

আর কি?

সংবাদপত্রের ওই বিজ্ঞাপনের কথাটাও যেন ভুলে যেয়ো না।

একটা কথা বলব মিস্টার রায়?

বল।

সংবাপত্রে প্রকাশিত ওই বিজ্ঞাপনটার সঙ্গে নীল রুমাল হত্যা-রহস্যগুলোর সত্যি কোন যোগাযোগ আছে বলে কি আপনি মনে করেন মিস্টার রায়?

নাও থাকতে পারে। হয়ত কোনটার সঙ্গেই কারও কোন সম্পর্ক নেই। কিরীটী মৃদু হেসে বললে।

তবে?

সেই যে একটা কবিতা আছে না—যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, মিলিলে মিলিতে পারে—কিন্তু আর না বিকাশ, এবার আমি একটু বেরোব।

বিকাশ বুঝতে পারে, কিরীটী আপাতত বর্তমান প্রসঙ্গের ওপরে যবনিকাপাত করতে চায়। কিরীটী রায়কে বিকাশ ভাল করেই চেনে। যতটুকু সে বলেছে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তার বেশি একটি কথা তার মুখ থেকে আর এখন বের করা যাবে না।

তাহলে আমিও উঠি।

এস।

বিকাশ সেন উঠে পড়ল।