১৬-২০. সুদর্শন একটু থেমে বললে

১৬.

সুদর্শন একটু থেমে বললে, তা সংসারে তো আপনাদের লোক কম নয়! একা একা চালাতে পারবেন?

যেমন করে তোক চালাব—চালাতেই তো হবে।

আচ্ছা শুনেছি সাবিত্রী দেবীর পড়ার খরচ মাধবী দেবীই দিতেন?

হ্যাঁ।

এখন আপনার বোন সাবিত্রীর পড়ার কি হবে?

ও বলছিল ছেড়ে দেবে। পরীক্ষা আর দেবে না। তা আমি বলে দিয়েছি, পরীক্ষা শালা দিতেই হবে। বি. এ. পাস তাকে করতেই হবে। বাবার খুব দুঃখ, তার একটা ছেলেমেয়েও বি. এ. পাস করল না।

কেন, মাধবী দেবী?

মাধবীটা কোনমতে থার্ড ডিভিসনে আই. এ. পাস করেছিল। তারপরই তো ঢুকে গেল চাকরিতে—আর সঙ্গে সঙ্গে অভিনয় করতে শুরু করে দিল।

আপনার বাবা মাধবী দেবীর অভিনয় করার ব্যাপারটা জানাতেন?

না। তিনি কোনদিনই জানতে পারেন নি। তারপর একটু থেমে অমলেন্দু বললে, বাবার ইচ্ছা ছিল ও চাকরি করতে করতেই বি. এ. পরীক্ষাটা দেয়, কিন্তু ওই বয়সে কাচা পয়সা হাতে এলে যা হয়—গেল মাথাটা বিগড়ে।

কেন, বিগড়ে গেল বলছেন কেন?

তাছাড়া কি! যা খুশি তাই তো করে বেড়াচ্ছিল।

যা খুশি তাই করছিলেন মাধবী দেবী? প্রশ্নটা করে তাকাল সুদর্শন অমলেন্দুর মুখের দিকে।

নয় তো কি! সেই কোন সকালে বের হয়ে যেত, তারপর রাত বারোটা সাড়ে বারোটার আগে কোনদিনই তো বাড়িতে ফিরত না।

থিয়েটার করত তো-হয়তো থিয়েটারের রিহার্সালে আটকা পড়ত।

হ্যাঁ, রিহার্সালই বটে। যাক গে, ওসব কথায় আর কাজ কি! কতদিন বলেছি, মাধু, এত রাত করে ফিরিস না, বয়সের মেয়েছেলে তুই, কখন একটা বিপদ-আপদ ঘটাবি। শেষ পর্যন্ত তাই ঘটল। বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যায় অমলেন্দু, কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যায়।

তারপর কতকটা যেন আত্মগত ভাবেই বলে, কি যে হল—

সুদর্শন দেখতে পায়, অমলেন্দুর চোখের কোল দুটো যেন ছলছল করছে।

অমলেন্দুবাবু!

বলুন স্যার?

আপনার বোনের হত্যার ব্যাপারে কাউকে আপনার সন্দেহ হয়?

সন্দেহ।

হ্যাঁ। মানে পল্লীর কাউকে—বাইরের কাউকে?

না না, পল্লীর কেউ তা করতে যাবে কেন? কত ছোট থেকে ওকে সবাই দেখে এসেছে–

কিন্তু আমি খবর পেয়েছি–

কি খবর পেয়েছেন?

অনেকেরই ওর ওপরে দৃষ্টি ছিল। এমন কি বিয়েও করতে চেয়েছিল মাধবীকে কেউ কেউ। প্রত্যাখ্যানের সেই আক্রোশে হয়ত–

এসব কথা আপনি কার কাছে শুনলেন?

শুনেছি। বিশেষ করে ওই হীরু সাহা—

মনে হচ্ছে, বড়বাবুই আপনাকে হয়ত ওই সব বলেছে!

তিনি তো বলেছেনই, আপনাদের পল্লীরই আরও দু-একজনের মুখেও শুনেছি।

অমলেন্দুকে যেন সহসা কেমন একটু বিব্রত বোধ হয়। একটু চুপ করে থেকে বললে, কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। কিন্তু তাই বলে সেই আক্রোশে–না না—

তাহলে আপনার কারও ওপর সন্দেহ হয় না?

না।

আরও কিছুক্ষণ এটা-ওটা কথাবার্তার পর অমলেন্দুকে ছেড়ে দিল সুদর্শন।

নাঃ, সমস্ত ব্যাপারটা যেন ক্রমশ বেশ জটিল হয়ে উঠছে!

সুদর্শন যেন কোন কূল-কিনারাই দেখতে পাচ্ছে না।

.

আরও দশ-বারো দিন কেটে গেল ঐ ঘটনার পরে।

মাধবীর আকস্মিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দশের পল্লী ও তার আশপাশে যে কৌতূহলের চাঞ্চল্য জেগেছিল, ধীরে ধীরে ক্রমশ সেটা যেন কেমন থিতিয়ে আসে।

পল্লীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা আবার পূর্বের মতই চলতে শুরু করল, কিন্তু সুদর্শন মল্লিকের মনে যেন শান্তি নাই।

মাধবীর মৃত্যুটা যেন তাকে রীতিমত বোকা বানিয়ে দিয়েছে।

নানাজনকে সন্দেহ করেছে, নানা দিক দিয়ে ব্যাপারটা চিন্তা করবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কোথায়ও কিছু যেন দানা বেঁধে ওঠেনি। অথচ তার দৃঢ় বিশ্বাস মাধবীর হত্যাকারী বাইরের কেউই নয়—ঐ পল্লীরই কেউ। কিন্তু কে?

ঠিক এমনি সময় একদিন বিকেলের দিকে একটা কালো রঙের ফিয়াট গাড়ি থানার সামনে এসে দাঁড়াল। গাড়ি চালাচ্ছিল লম্বা রোগা এক শ্বেতশুভ্র দাড়ি ও মাথায় পাগড়ি পাঞ্জাবী ড্রাইভার।

গাড়িটা থানার সামনে এসে দাঁড়াবার পর ড্রাইভার হীরা সিং গাড়ির দরজা খুলে দিল।

পরনে পায়জামা ও গরমের পাঞ্জাবি ও তার উপরে দামী একটা শাল জড়ানো, চোখে মোটা কালো সেলুলয়েডের চশমা, মুখে চুরুট, প্রায় ছফুটের কাছাকাছি লম্বা সৌম্যদর্শন প্রৌঢ় ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নামল।

থানার প্রহরাধীন সেপাইকে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করে, ও. সি. সাহেব আছেন?

জী হাঁ। যাইয়ে না, অফিস-কামরামেই সাব বৈঠা হ্যায়।

আগন্তুক এগিয়ে গেল অফিস কামরার দিকে। দরজা খোলাই ছিল।

আগন্তুকের খোলা দরজাপথে নজরে পড়ল, ও. সি. সুদর্শন মল্লিক গভীর মনোযোগের সঙ্গে সামনে টেবিলের ওপরে একটা মোটা ফাইল নিয়ে কি সব দেখছে।

আগন্তুক ভিতরে পা দিল, সুদর্শন!

চমকে মুখ তুলল সুদর্শন মল্লিক। তারপরই আগন্তুকের দিকে তাকিয়েই সোল্লাসে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, দাদা, আপনি! আসুন আসুন, বসুন-বসুন এই চেয়ারটায়।

সুদর্শন নিজের চেয়ারটাতেই আগন্তুককে বসবার জন্য অনুরোধ জানায়।

পাগল নাকি! ওটা হচ্ছে ও. সি.-র চেয়ার। আমি এই যে বসছি।

আগন্তুক বসল।

সুদর্শন যে কি করবে ভেবে পায় না। উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে, উঃ, সত্যি দাদা, আমি ভাবতেই পারছি না আপনি আমার এখানে আসবেন! দাদা, কি খাবেন বলুন? চা, না কফি?

কফি-চা করবেটা কে? আগন্তক মৃদু হেসে বলে, এখন তো বিয়েই করলে না—

একটা ভাল কমবাইন্ড হ্যান্ড পেয়েছি, জানেন দাদা!

তাই নাকি?

হ্যাঁ, শ্রীমান গোবর্ধন। বলতে বলতে হাসে সুদর্শন।

নামটি তো বেশ। তা পেলে কোথায় আজকালকার এই ভৃত্যসঙ্কটের দিনে?

পেয়ে গিয়েছি গুরুকৃপায়।

বল কি? গুরুও একটা পাকড়াও করেছ নাকি ইতিমধ্যেই?

গুরু লাভ তো আমার বহু পূর্বেই হয়ে গিয়েছে দাদা!

তাই বুঝি?,তা সে মহাশয় ব্যক্তিটি কে যে তোমার মত ঘোর নাস্তিক ও অবিশ্বাসীকে কৃপা করল?

কিরীটী রায়।

অ্যাঁ!

হ্যাঁ দাদা, আপনি। মনে মনে একলব্যের মত সেই কিশোরকাল থেকেই গুরু পদে বরণ করেছিলাম আপনাকে।

কিরীটী মৃদু হাস্যে বলে, কিন্তু কেন? হঠাৎ ও দুর্মতি হল কেন?

জানেন দাদা, প্রথমে ছিলেন হিরো-হিরো-ওয়ারশিপ, তারপর হলেন গুরু, পথপ্রদর্শক—বসুন দাদা, গোবর্ধনকে চায়ের কথা বলে আসি।

সুদর্শন ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

.

১৭.

বছর সাতেক আগে এক ট্রেনের কামরায় কিরীটীর সঙ্গে সুদর্শনের আকস্মিক ভাবে প্রথম আলাপ হয়।

কিরীটী ও কৃষ্ণা মুসৌরী যাচ্ছিল ট্রেনে।

সেই ট্রেনেই যাত্রী ছিল সুদর্শন। সে তখন সবে বি.এস-সি পাস করে যা হোক। কিছু একটা চাকরির ধান্দায় ঘুরছে।

কাগজে বহুবার কিরীটীর ফটো ইতিপূর্বে দেখেছিল সুদর্শন এবং তাহার রহস্য উদ্ধারের অনেক অত্যাশ্চর্য কীর্তি-কাহিনী পড়ে পড়ে তার এক অন্ধ ভক্ত হয়ে উঠেছিল।

একটা বড় জংশন স্টেশনে গাড়ি তখন থেমেছে। সবে ভোর হয়েছে। প্ল্যাটফর্মে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ ফার্স্ট ক্লাস কামরার জানলার ধারে উপবিষ্ট কিরীটীকে দেখতে পায় সুদর্শন।

চমকে ওঠে সুদর্শন। কি আশ্চর্য, কিরীটী রায়!

গাড়ি চলতেই সুদর্শন লাফিয়ে সেই ফার্স্ট ক্লাস কামরাতে উঠে পড়ে। তারপর বলে, আমার কিন্তু স্যার ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট নয়–থার্ড ক্লাসের–

তবে এ গাড়িতে উঠলে কেন? কিরীটী শুধিয়েছিল।

আপনাকে এই জায়গায় দেখে আপনার সঙ্গে আলাপ করবার লোভটা সামলাতে পারলাম না। তাতে যদি ফাইন দিতে হয় তো দেব।

তুমি আমাকে চেনো?

না চিনলে উঠেছি?

সুদর্শনের গন্তব্যস্থল ছিল হরিদ্বার—তার পিসেমশাইয়ের ওখানে। কিন্তু যে-যাত্রায় সে কিরীটীর সঙ্গে আলাপ হবার পর বেমালুম হরিদ্বারের কথা ভুলে গিয়ে সোজা তাদের সঙ্গে মুসৌরী চলে গিয়েছিল। তারপরই ঘনিষ্ঠতা।

কিরীটীই তার পরিচিত পুলিস-কমিশনারকে ধরে পরে সুদর্শনের চাকরি করে দিয়েছিল।

.

একটু পরে সুদর্শনের পিছনে-পিছনে চা নিয়ে এল গোবর্ধন ট্রেতে করে।

চা পান করতে করতে সুদর্শন একসময় বলে, ভগবান বোধহয় আপনাকে আজ হঠাৎ এভাবে আমার মুশকিল-আসানের জন্যেই পাঠিয়েছেন দাদা।

তোমার আবার মুশকিলটা কি হল সুদর্শন। কিরীটী মৃদু হেসে শুধায়।

বিশ্রী একটা হত্যা-মামলা—

হত্যা মামলা?

হ্যাঁ, দাদা। কদিন ধরে যত ভাবছি ততই যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, দাদা। মনে মনে বোধ হয় তাই আপনাকেই খুঁজছিলাম-ডাকছিলাম—

তোমার রহস্যের কথা শুনব, তার আগে আমার কিছু সংবাদ চাই।

কীসের সংবাদ দাদা?

জান তো, তোমার এই থানা এলাকাতেই অল্প দূরে রেলওয়ে ইয়ার্ডটা আছে—মানে হাওড়ার রেলওয়ে ইয়ার্ড–

হ্যাঁ, জানি তো–আমারই এলাকা।

গত কয়েক বছর ধরে ওয়াগন থেকে হাজার হাজার টাকার মাল চুরি যাচ্ছে। বিশেষ করে ধুতি-শাড়ির পেটি, কেরোসিন, সরষের তেলের ও ঘিয়ের টিন আর দামী দামী ওষুধপত্রের বড় বড় প্যাকিং। অথচ রেল পুলিস আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যাপারটার কোন কিনারা করতে পারেনি–

জানি, সব জানি। এখানে পোস্টিংয়ের সময় বড়কর্তা আমায় সব বলেছিলেন, যদিও আমি কিন্তু দাদা চেষ্টা করে আজ পর্যন্ত কিছু ধরতে পারিনি।

সেই ব্যাপারটারই একটা হদিস খুঁজে বের করবার ভার সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ থেকে আমার কাধে গত মাসে চাপানো হয়েছে।

সত্যি!

হ্যাঁ। তাই এই তল্লাটের একটা খোঁজখবর নিতে গিয়ে জানলাম, এই থানায় তুমি কিছুদিন হল এসেছ ইনচার্জ হয়ে। ভাবলাম তোমার সঙ্গেই তাহলে সর্বাগ্রে একবার দেখা করা প্রয়োজন।

তাই এসেছেন?

তাই।

ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে রীতিমত রহস্যজনক দাদা, কারণ আমার আগে চারজন থানা অফিসারকে এক বছর দেড় বছরের মধ্যেই বদলি করা হয়েছে তাদের অপটুতার জন্যে। যদিও আমার ধারণা–

কি?

আমার পূর্বতন অফিসারদের ওই ব্যাপারে কিছুটা ইচ্ছাকৃত অবহেলাছিল।

কেমন করে বুঝলে?

অবিশ্যি তারা হয়ত প্রাণের ভয়েই চুপচাপ থেকেছে বা এড়িয়ে গেছে। ব্যাপারটা–

প্রাণের ভয় ছিল কিনা জানি না, তবে একটা সংবাদ ওই চারজন অফিসার সম্পর্কেই আমি যোগাড় করেছি ইতিমধ্যে।

কি সংবাদ পেয়েছেন?

দুজন তাদের মধ্যে কলকাতার বাইরে জমিজমা কিনেছে, মেয়ের বিয়ে দিয়েছে খরচপাতি করে ভাল ঘরে, আর একজন জমি কিনেছে ও একজন বাড়ি করছে–

বলেন কি দাদা! তার মানে–

তার মানে ঠিক যা স্বাভাবিক তাই। তাদের পরোক্ষ প্রশ্রয় ছিল ওই ব্যাপারে। হয়ত প্রাণের ভয়টাও ছিল, একটু আগে তুমি যা বলছিলে—

.

১৮.

সুদর্শন অতঃপর কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। তারপর বলে, জানি না দাদা তারা কতটুকু জানতে পেরেছিল। তবে আমি এই চার মাসে নির্ভরযোগ্য তেমন কিছুই জানতে পারিনি। অবিশ্যি না জানতে পারলেও একটা কথা আমার মনে হয়—

কি?

কাছেই একটা জায়গা আছে, যাকে এ তল্লাটের লোকেরা দশ নম্বর পল্লী বলে থাকে–

আমিও জেনেছি সেটা।

ঐ পল্লীতে বহু লোকের বাস। অনেকদিন আগে থাকতে ঐ অঞ্চলে লোকের বসবাস ছিল, তারপর বহু ঘর রিফিউজি এসে আশপাশের পড়ো জমি জবরদস্তি দখল করে ঘরবাড়ি তুলে পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করে দেয়। ফলে একটা মিশ্র অথচ যৌথ বিরাট অঞ্চল গড়ে ওঠে ক্রমশ গত পনেরো-কুড়ি বছর ধরে। এবং সকলে মিলে নাম দিয়েছে তার দশ নম্বর পল্লী।

কেন, দশ নম্বর পল্লী নাম হল কেন?

এ তল্লাটে আশেপাশে ওই ধরনের ছোট ছোট আরও নটি পল্লী আছে। অবিশ্যি ভেতরে গেলে আপনার মনে হবে বিরাট একটা কলোনী যেন। বেশ কিছু পাকা বাড়ি, ইলেকট্রিক তো আছেই-রাস্তাঘাটও চলাচলের পক্ষে ভাল করা হয়েছে

আর পল্লীবাসীরা?

শিক্ষিত অশিক্ষিত নানা শ্রেণীর মানুষ আছে। অফিসের কেরানী থেকে শুরু করে প্রফেসার, স্কুলমাস্টার, মেকানিক, মোটর-ড্রাইভার, ইলেকট্রিক মিস্ত্রী, বহু ভদ্র গৃহস্থ পরিবার আছে। এবং আছে সামনের অন্নপূর্ণা জুট মিলের বহু কর্মী। আমার মনে হয়, সামনের ইয়ার্ডের ওয়াগন-ব্রেকের ব্যাপারে যারা জড়িয়ে আছে, তাদের বেশ কিছু ওই দশ নম্বর পল্লীরই বাসিন্দা।

তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে সুদর্শন, তোমার কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে।

ও-কথাটা ভাববার অবিশ্যি আমার আরও একটা কারণ আছে দাদা।

কি?

নিষিদ্ধ অনেক ব্যাপার ওই পল্লীতে চলে। যেমন চোরা কারবার, মদচোলাই—

মিল ওয়ার্কাররা থাকলে তা তো হবেই।

আরও আছে, সুদর্শন বলে, গত তিন বছরে পাঁচটা খুন হয়েছে ওই তল্লাটে।

তাও জানি।

এবং তারা সবই পুরুষ। গত ১৯শে শনিবার শেষ খুন হয়েছে—

তাও জানি-একটি মেয়ে–

হ্যাঁ। একটি মেয়ে, তাও আপনি জানেন দেখছি! তা ওই খুনের ব্যাপারটাই আপনাকে আমি বলব ভাবছিলাম। ব্যাপারটা যেন আগাগোড়াই একটা মিস্ত্রি-ধোঁয়াটে–

মেয়েটির বয়স কত? চব্বিশ-পঁচিশ ছিল না?

হ্যাঁ। পূর্ববঙ্গ থেকে আগত এক অন্ধ স্কুল-মাস্টারের মেয়ে। আই. এ. পাস করে শর্টহ্যান্ড শিখে একটা অফিসে চাকরি করছিল, আর সেই সঙ্গে—মেয়েটির চমৎকার অভিনয়-প্রতিভা ছিল, অ্যামেচার ক্লাবে অভিনয় করেও বেশ উপার্জন করত—

আর কিছু জানতে পারনি মেয়েটির সম্পর্কে?

না।

স্বভাব-চরিত্র কেমন ছিল?

বোধহয় খুব পরিষ্কার ছিল না।

প্রেমঘটিত ব্যাপার?

তাও তেমন শুনিনি, তবে—

কি?

ওর প্রতি সকলেরই নজর ছিল।

স্বাভাবিক। মেয়েটি বোধহয় দেখতে সুন্দর ছিল।

বলতে পারেন সত্যিকারেরই সুন্দরী।

অর্থাৎ সুন্দরী, যুবতী—

হ্যাঁ।

আলাপ হয়েছিল?

হয়েছিল। একটু যেন ফ্লার্টারিং টাইপের ছিল। সংক্ষেপে ব্যাপারটা আপনাকে বলি দাদা, সব শুনলে হয়ত আপনি মোটামুটি একটা কিছু আন্দাজ করতে পারবেন মেয়েটি সম্পর্কে।

ইতিমধ্যে শীতের বেলা ঝিমিয়ে এসেছিল। বিষণ্ণ আলোয় চারদিক ম্লান হয়ে উঠেছিল।

কিরীটী বললে, তোমার কাহিনী শুরু করবার আগে আর এক কাপ চায়ের ব্যবস্থা কর সুদর্শন।

নিশ্চয়ই দাদা, এখুনি ব্যবস্থা করছি।

সুদর্শন উঠে গেল।

খোলা দরজা-পথে বাইরের স্লান বিষণ্ণ আলোর দিকে চেয়ে চুপচাপ বসে একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে কিরীটী ধূমপান করতে থাকে।

বেশ শীত-শীত লাগে।

.

সুদর্শনের কাহিনী শেষ হতে ও সকলের জবানবন্দি পড়তে পড়তে রাত প্রায় নটা হয়ে গেল।

কিরীটী মধ্যে মধ্যে দু-একটা প্রশ্ন করেছে-যেমন, ওই পল্লীর যে সব লোকেদের তুমি ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছ সুদর্শন, তারা ছাড়াও তো অনেকে আছে?

তা আছে।

পল্লীর দু-চারজন বৃদ্ধ বা প্রৌঢ় ব্যক্তিকেও ডেকে তোমার জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত ছিল।

তা হয়ত ছিল, কিন্তু আমার মনে হয় দাদা–

বুঝতে পারছি সুদর্শন—ওই হীরু সাহা, খগেন পাঠক, কল্যাণ বসু, হরগোবিন্দ ঘোষ, নরহরি সরকার, অবিনাশ ও অমলেন্দু ব্যানার্জি-ওরাই তোমার মনে বিশেষভাবে রেখাপাত করায় তুমি তোমার অনুসন্ধানী দৃষ্টিটা ওদের ওপরেই ফেলেছ, তাই নয় কি!

কতকটা তাই–

.

১৯.

কিরীটী মৃদু হাসল, তারপর হাতের চুরুটে একটা টান দিয়ে বললে, সুদর্শন।

বলুন দাদা?

কথামালার একচক্ষু হরিণের গল্পটা তোমার মনে আছে? সেই যে—যে দিকটা সম্পর্কে সে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত ছিল, অবশেষে সেই দিক থেকেই এল মৃত্যুর আঘাত?

আপনি কি বলতে চান দাদা!

এসব ব্যাপারে পক্ষপাতিত্ব করেছ কি পদস্খলন অনিবার্য।

বুঝতে পারলাম না ঠিক দাদা আপনার কথা!

বলছি শ্রীমতী সাবিত্রী দেবীর কথা—

সহসা সুদর্শনের চোখ-মুখ যেন লাল হয়ে ওঠে।

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, মেয়েটি সত্যিই ভাল, আর মাধবীর আকস্মিক মৃত্যুতে এমন অসহায় হয়ে পড়েছে–

কিরীটী সুদর্শনের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু মদু হাসে।

ওকে দেখলে আপনারও সিমপ্যাথি হবে–

তা হয়ত হবে—যখন তোমার ইতিপূর্বেই হয়েছে। তবে কি জান—

কি?

ক্ষেত্রবিশেষে সিমপ্যাথি ব্যাপারটা যেমন প্রশংসনীয় ও একান্ত প্রয়োজনীয়, তেমনি ক্ষেত্রবিশেষেই আবার হয় মারাত্মক। যাক, আজ আমি এবার উঠব। রাত অনেক হল।

কিন্তু দাদা, আপনি তো কিছুই বললেন না?

বলব, বলব।

কখন?

দুটো দিন ব্যাপারটা আমায় একটু ধীরে-সুস্থে ভাবতে দাও।

কিন্তু–

কিরীটী ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। বললে, আজ বুধবার, সামনের শনিবার এই সময় আসব।

আসবেন আবার?

হ্যাঁ, ইয়ার্ডটা রাতের অন্ধকারে একবার ঘুরে দেখা প্রয়োজন।

কিরীটীকে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সুদর্শনও উঠে দাঁড়ায় সঙ্গে সঙ্গে।

গাড়িতে ওঠবার পর হীরা সিং গাড়িতে যখন স্টার্ট দিয়েছে, কিরীটী বললে, সুদর্শন, ছোটবেলায় যে যোগ অঙ্ক শিখেছিলে, দুয়ে দুয়ে যোগ করে চার হয়—সে অঙ্কটা ভুলে যেয়ো না!

সুদর্শন প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসে।

গাড়ি চলতে শুরু করে। কিরীটীর শেষ কথাটা সুদর্শনের কানে আসে, দুয়ে দুয়ে যোগফল চারই হয়—পাঁচও হয় না, তিনও হয় না। কম-বেশি হবার উপায় নেই।

গাড়িটা চোখের সামনে থেকে বের হয়ে গেল।

সুদর্শন ধীর পদক্ষেপে থানায় তার অফিস-ঘরে ফিরে আসে। কিরীটীর শেষের কথাগুলো তখনও তার মধ্যে আনাগোনা করছে।

কিরীটী যে ইঙ্গিতটা দিয়ে গেল, তার অর্থ কি? তবে কি সে আগাগোড়াই ভুলপথে চলেছে? হাতের সামনে সব থাকা সত্ত্বেও অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছে?

হয়ত তাই। দুটো ব্যাপারের সঙ্গে হয়ত সত্যিই একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। সেই দিক থেকে অগ্রসর হতে পারলেই মাধবীর হত্যা-রহস্যটা হয়ত পরিষ্কার হয়ে যাবে।

নাঃ, আর একবার দশ নম্বর পল্লীটা তাকে ভাল করে ঘুরে দেখতেই হবে।

সত্যিই হয়ত সে বিশেষ কয়েকটা মানুষ সম্পর্কেই কেবল চিন্তা করছে বলেই আসল কালপ্রিটের কোন সন্ধানই এখনও পর্যন্ত পায়নি।

মাধবীর হত্যা-রহস্যের সঙ্গে হয়ত ওই লোকগুলোর কোন সম্পর্কই সত্যিই নেই।

নতুন করে আবার সমস্ত ব্যাপারটা আগাগোড়া ভাববার চেষ্টা করে সুদর্শন।

শুতে শুতে অনেক রাত হয়ে যায় সুদর্শনের। এবং শুতে যখন যায় তখন সে ভাবতেও পারেনি, পরের দিন প্রত্যুষে জটিলতর আর একটি সংবাদ তার জন্য অপেক্ষা করছে।

একটু বেলাতেই সুদর্শনের ঘুম ভাঙে গোবর্ধনের ডাকাডাকিতে।

বাবু, বাবু—

কি রে? ভোরবেলা চেঁচামেচি শুরু করেছিস কেন?

আজ্ঞে সেপাই রামলোচন আপনাকে ডাকছে।

কেন, কি হয়েছে?

.

২০.

গরম আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে, চপ্পলের মধ্যে কোনমতে পা দুটো গলিয়ে ঘুমজড়ানো চোখে শোবার ঘর থেকে বের হয়ে এল সুদর্শন।

সামনেই দাঁড়িয়ে রামলোচন সিকদার। ছোকরা কনস্টেবল। বছর দুই চাকরিতে ঢুকেছে—যেমন চালাক, তেমনি চটপটে।

কি রামলোচন, কি খবর?

হুজুর, এ তল্লাটে আবার একটা খুন হয়েছে।

খুন! হঠাৎ যেন একটা ধাক্কা খায় সুদর্শন। ঘুমের শেষ রেশটুকু যেন সঙ্গে সঙ্গে চোখের পাতা থেকে মুছে যায়। বললে, কোথায়? কে খুন হল আবার? পল্লীর কেউ নাকি?

আজ্ঞে, লোকটা এক পাঞ্জাবী। দশ পল্লীর কেউ নয়।

পাঞ্জাবী?

হ্যাঁ। লোকটাকে একদিন আমি দিন-পনেরো আগে ওই যে—যে মেয়েটির বড় ভাইয়ের সঙ্গে বড় রাস্তায় যে কানন রেস্টুরেন্টটা আছে, সেই রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোতে দেখেছিলাম।

ডেড বডি কোথায়?

ওই মাঠটার মধ্যে।

সুদর্শন আর দেরি করে না, চটপট জামা-কাপড় পরে প্রস্তুত হয়ে জমাদার রামশরণ সিং, জনা-চারেক কনস্টেবল ও সঙ্গে রামলোচনকে নিয়ে বের হয়ে পড়ল।

মৃতদেহটা সেই মাঠের বট গাছটার সামনে পড়েছিল।

উপুড় হয়ে পড়ে আছে মৃতদেহটা। পরনে দামী ক্রিম কালারের ট্রপিক্যাল স্যুট, পায়ে দামী গ্লেসকিডের সু, মাথায় পাগড়ি, মুখে দাড়ি। পৃষ্ঠদেশের ঠিক মাঝামাঝি একটা ক্ষতস্থান। প্রচুর রক্তপাত হয়েছিল মনে হয় ক্ষতস্থান থেকে।

পিঠের জামার যে অংশটায় গুলি বিধেছিল তার চারপাশ রক্তে ভেজা। লাল হয়ে আছে। মৃতদেহের হাত দুটো ছড়ানো।

দশ নম্বর পল্লীর লোকেরা বোধ হয় ব্যাপারটা জানতেও পারেনি তখনও, কারণ আশপাশে কেউ ছিল না। কাউকেই সেখানে দেখতে পেল না সুদর্শন। আশপাশের ঘাস তখনও শিশিরসিক্ত।

সুদর্শনের বুঝতে কষ্ট হয় না লোকটা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে, এবং পেছন দিক থেকেই তাকে কেউ গুলি করেছিল।

হয়ত এমনও হতে পারে, সুদর্শনের মনে হয়, হত্যাকারী লোকটাকে অনুসরণ করেছে পিছন থেকে, তারপর সুযোগ বুঝে গুলি করেছে।

কিন্তু কথা হচ্ছে, লোকটা এই জায়গায় কেন এসেছিল?

আরও একটা কথা, হত্যাকারী কি জানত যে লোকটা এখানে আসবে কিংবা তাকে হত্যা করার জন্যই ফাঁদ পেতে এই নির্জন জায়গায় ডেকে আনা হয়েছিল, যাতে করে হত্যাকারীর সুবিধা হয় হত্যা করতে এবং গুলির শব্দটাও যাতে কেউ শুনতে না পায়।

নানা কথা ভাবতে ভাবতে নিচু হয়ে বসে মৃতদেহটা উলটে দিল সুদর্শন।

বেশ বলিষ্ঠ লম্বা-চওড়া গঠন লোকটার, যেমন সাধারণত পাঞ্জাবীরা হয়। বাঁ হাতে একটা লোহার বালা, ডান হাতে একটা দামী সোনার রিস্টওয়াচ।

পকেট হাতড়ে একটা দামী সেন্টের গন্ধসিক্ত সিল্কের রুমাল, কিছু চিউয়িংগাম ও একটা দামী চামড়ার পার্স পাওয়া গেল।

পার্সের মধ্যে লোকটার একটা ফটো ও নামধাম পাওয়া গেল।

গুলজার সিং। ১৪নং ক্যামাক স্ট্রীট। গগনচারী ম্যানসন, থার্ড ফ্লোর, রুম নাম্বার ৫৬।

আর পাওয়া গেল পার্সের মধ্যে খান-দুই একশো টাকার ও দশ পাঁচ ও এক টাকার খুচরো নোটে মোট দুইশত আটান্ন টাকা। এছাড়াও গোটা দুই পেট্রোলের ভাউচার ও ফ্রি স্কুল স্ট্রীটের একটা টেলারিং শপের ক্যাশমেমো দুশো সাতাত্তর টাকা এবং একটা চাবির রিং কোটের পকেটে।

মৃতদেহের ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ ছিল। রাইগার মর্টিস সেট-ইন করায় মুষ্টিটা শক্ত হয়ে গিয়েছিল।

আঙুলে বড় বড় নখ। নখের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটা বস্তু সুদর্শনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সাদা রঙের খানিকটা পশম।

আঙুলের নখ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পশমটা একটা কাগজের মোড়ক করে সুদর্শন তার পকেটে রেখে দিল।

আরও একটি বস্তু প্যান্টের হিপ পকেটে পাওয়া গেল—ছোট একটি আমেরিকান ছয় চেম্বারের অটোমেটিক পিস্তল। পিস্তলের ছয়টি চেম্বারই গুলি-ভর্তি।

গুলজার সিংয়ের চেহারা ও প্যান্টের হিপ পকেটে লোডেড পিস্তল দেখে মনে হয় সুদর্শনের, লোকটা আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে এলেও শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষার কোন সুযোগই পায়নি হয়ত।

আততায়ী পেছন থেকে তাকে গুলি করেছে এবং খুব ক্লোজ রেঞ্জ থেকে গুলি ছোঁড়া হয়েছে, লোকটা আত্মরক্ষার কোন সুযোগই পায়নি।

ক্ষতস্থানের চারপাশে জামার ওপরে কিছু কার্বন ডিপোজিট দেখা যায়।

পূর্বের সন্দেহটা তার মনে আরও দৃঢ় হয়, নিশ্চয় আততায়ী তার অলক্ষ্যে নিঃশব্দে তাকে ফলো করে পেছনে-পেছনেই আসছিল–প্রথম সুযোগেই পেছন দিক থেকে গুলি চালিয়েছে।

আশেপাশে কোন রক্তের চিহ্ন চোখে পড়ে না সুদর্শনের এবং কোন স্ট্রাগলের চিহ্নও। কোথাও নজরে পড়ে না তার।