২১-২২. কিরীটীর বাড়ি

২১.

কিরীটীর বাড়ি।

কিরীটী বলছিল, আপনারা হয়ত ভাবতেও পারেননি ইন্সপেক্টার যে ডাঃ সান্যালই ঐ দুজনের হত্যাকারী!–

না মৃণাল সেন বলে, নেভার ড্রেমট অফ ইট!

মনে আছে সুব্রত, যেদিন প্রথম তুই আমার কাছে কেসটা সম্পর্কে বলিস, আমি সব শুনে তোকে কয়েকটা কথা বলেছিলাম! এবং তার মধ্যে বলেছিলাম একটা কথা বিশেষ করে যা তা হচ্ছে ডাঃ চৌধুরীর ঐ দুই বন্ধুকে লেখা দুটো কাগজ-যার মধ্যে পর পর কতকগুলো লেখা রয়েছে এবং যে দুটো আমার কাছে রেখে যেতে বলেছিলাম!

হ্যাঁ, সে তো তোর কাছেই আছে। সুব্রত বলে।

হ্যাঁ, সেই কাগজই প্রথম আমাকে হত্যার মোটিভের ইঙ্গিত দেয়। কথাটা বলতে বলতে কিরীটী কাগজের টুকরো দুটো বের করে সামনের টেবিলের উপরে পাশাপাশি রাখল।

এই দেখ!

একটা কাগজের মাথায় লেখা ২৬ ইংলিশে, অন্যটার মাথায় লেখা অ্যালফাবেটসে অর্থাৎ ইংলিশ অ্যালফাবেটস, ইংরাজী বর্ণমালা—যার মধ্যে ২৬টি কথা আছে এ বি সি ডি করে। এখন ঐ অনুযায়ী ইংরাজী বর্ণমালা বসিয়ে দাও। তাহলে দেখ দাঁড়াচ্ছে কি–শ্রীরামপুর পর্ণকুটির গ্রাউন্ড ফ্লোর-সাউথ রুম। অর্থাৎ শ্রীরামপুরের পর্ণকুটিরের একতলার দক্ষিণের ঘর।

আশ্চর্য! মৃণাল সেন বলে, একবারও এসব মনে হয়নি তো আমাদের সুব্রতবাবু।

কিরীটী দুটো কাগজ জোড়া দিল।

মাঝখানে একটা রেকট্যাঙ্গল আঁকা আছে-তার দুমাথায় এস ও ই লেখা অর্থাৎ সাউথ ইস্ট কোণ।

তাহলে? সুব্রত বলে।

হ্যাঁ, সুব্রত, ডাঃ নলিনী চৌধুরীর দাদা যে ধনসম্পদ বর্মা থেকে নিয়ে এসেছিলেন সেটা তিনি তার শ্রীরামপুরের পর্ণকুটিরের নিচের দক্ষিণ দিককার ঘরের মেঝেতে দক্ষিণপূর্ব কোণে নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে রেখেছিলেন। এবং সেটা যে আছে সে সম্পর্কে স্থির নিশ্চিত হই আমি আর কেন জান?

কেন? সুব্রত জিজ্ঞাসা করে।

ডাঃ নলিনী চৌধুরীর দ্বিতীয় উইলের কথা জানবার সঙ্গে সঙ্গে।

ডাঃ নলিনী চৌধুরীর দ্বিতীয় উইল! মৃণাল সেন বলে।

হ্যাঁ, তার সেই দ্বিতীয় উইলের জন্যই তো এত কাণ্ড। এবং উইলের কথা আমি ডাঃ চৌধুরীর আইন-উপদেষ্টা কালীপদ চক্রবর্তীর কাছে জানতে পারি প্রথম।

কিন্তু কালীপদ চক্রবর্তী বা মিঃ গাঙ্গুলী তো সেরকম কোন উইলের কথা আমাকে বলেননি! সুব্রত বলে।

না বলেননি, তার কারণ উইলটা রেজিস্ট্রি করার আগেই ডাঃ চৌধুরীর মৃত্যু হয়। এবং তার মৃত্যুর পর সেই কাচা উইলটা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

কেন? উইলটা তার কাছে ছিল না?

না। কারণ যে রাত্রে ডাঃ চৌধুরীর অ্যাটাক হয় সেই রাত্রেই কালীপদ চক্রবর্তীকে ডেকে তিনি উইলটা লিখিয়ে সই করেন। কথা ছিল চক্রবর্তী এসে উইলটা নিয়ে গিয়ে টাইপ করে পাকাপাকি সব ব্যবস্থা করবেন আর তাই উইলটা ডাঃ চৌধুরীর বালিশের তলায় ছিল। কিন্তু সেই রাত্রেই গোটাপাঁচেক নাগাদ ডাঃ চৌধুরীর মৃত্যু হয়। তারপর মিঃ চক্রবর্তী এসে উইলটার খোঁজ করেন, কিন্তু পান না।

তারপর?

কাজে-কাজেই উইলটা না পাওয়া যাওয়ায় ডাঃ চৌধুরীর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায় এবং উইল যখন লেখা হয় তখনই ঐ কাগজটা মাঝামাঝি কেটে দুই বন্ধুর নামে খামে ভরে ব্যাঙ্কে জমা দেবার জন্য আগেই মিঃ চক্রবর্তীর হাতে দিয়ে দিয়েছিলেন ডাঃ চৌধুরী।

ঐ কাগজটা কি তারই তৈরি?

না, ওটা চৌধুরীর দাদার কীর্তি। ডাঃ চৌধুরী কাঁচি দিয়ে কেটে দুটুকরো করেছিলেন মাত্র জিনিসটা।

তারপর?

যা হোক, উইলের খসড়া চুরি গেলেও ঐ খাম-দুটো চুরি যায়নি। তাই চক্রবর্তী ঐ খাম-দুটো শেষে ডাঃ চৌধুরীর মৃত্যুর পর ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দেন ও তাদের ব্যাপারটা বলেন। কিন্তু চক্রবর্তী বলেননি রায় ও গাঙ্গুলীকে দ্বিতীয় উইলের খসড়ার কথা প্রথমে বা ঐ দ্বিতীয় উইলে কি ছিল! যদিও উইলে অর্থের কথা স্পষ্ট করে বলা ছিল। তবু সে অর্থ সঠিক কোথায় আছে ডাঃ চৌধুরীও না বুঝতে পারায় ঐ অঙ্ক থেকে কিছু বলে যেতে পারেননি স্পষ্ট করে তার উইলে।

কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না কিরীটী! সুব্রত বলে।

কি?

ডাঃ চৌধুরী তার ভাইকে সব কথা খুলে না বলে অমন একটা রহস্যের মধ্যে ব্যাপারটাকে চাপা দিয়ে রেখে গেলেন কেন?

সেটা বলতে পারব না। যা হোক, হঠাৎ তার সর্পদংশনে মৃত্যু হওয়ায় এবং আমার ধারণা সর্পদংশনে মৃত্যুর ব্যাপারটাও তার আসলে হত্যাই এবং সেটা ঐ নীরেনেরই কারসাজি। সে হয়ত কোনক্রমে ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল। যা হোক যা বলছিলাম, ডাক্তার ভাইয়ের কাগজপত্রের মধ্যে ওটা পেয়েছিলেন তার মৃত্যুর পর

তবে যে চিঠি একটা লিখে গিয়েছিলেন তার ছোট ভাইকে শুনেছিলাম। কথাটা ঠিক নয়। মানে চিঠি নয়-মুখে একদিন কথাটা ভাইকে বলেছিলেন মাত্র তিনি। কারণ তখনও তিনি অর্থের লোভটা সামলে উঠতে পারেননি বোধ হয়।

তাহলে উইলটা ডাঃ চৌধুরীর–

সুব্রতর কথায় বাধা দিয়ে কিরীটী বলে, অবশ্যই ডাঃ চৌধুরীর ভাগ্নে সকল রহস্যের মেঘনাদ ডাঃ নীরেন সান্যালই সরিয়েছিল। কিন্তু শুধু উইলে কি হবে! আসল তথ্য তো ছিল দুই বন্ধুর নামে ডাঃ চৌধুরীর ব্যাঙ্কে সেই দুই খণ্ড কাগজে। আর সেই কারণেই পর পর দুটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হল। এখন দেখা যাক, নীরেন ডাক্তারই যে মহেন্দ্র রায়ের হত্যাকারী—আমি তা জানতে পারলাম কি করে বা তাকে সন্দেহ করলাম কেন?

.

২২.

কিরীটী বলতে থাকে, যখন জানা গেল মহেন্দ্রনাথ নিহত হয়েছেন তখন স্বভাবতই তার আত্মীয়স্বজনদের উপরেই সন্দেহ জাগে প্রথমত, যেহেতু তিনি ছিলেন বিত্তবান এবং তার মৃত্যুতে তারা প্রত্যেকেই লাভবান হত।

তাহলেও সন্দেহের ব্যাপারটা মনে মনে বার বার বিশ্লেষণ করলাম। ছোট ভাই সুরেন্দ্র, দুই ছেলে সৌরীন্দ্র ও ভবেন্দ্র এবং মিঃ মুখার্জী ও তার বন্ধু মিঃ গাঙ্গুলী সকলের উপরই সন্দেহ জাগে।

বড় ছেলে ও ভাই সুরেন্দ্রকে অনায়াসেই বাদ দেওয়া যেতে পারে, কারণ তাদের পক্ষে ব্যাপারটা জানা সম্ভবপর ছিল না।

তারপই প্রথমে ধরা যাক, ছোট ছেলে ভবেন্দ্রর কথা, বিশেষ করে তার ঐ রিভলবারটির জন্য। আসলে কিন্তু রিভলবারটি হারায়নি!

তবে?

রিভলবারটা নীরেন সান্যাল বেরিলিতে গতমাস ভবেন্দ্রর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে নিয়ে আসে। বেশ কিছু টাকা দিয়ে কিছুদিনের জন্য চেয়ে নিয়ে আসে। টাকার। প্রয়োজন ছিল ভবেন্দ্রর, তাই সে দেয়। তাছাড়া সে ভেবেছিল, সেটা তো আবার ফিরে পাবেই!

ফিরে পাবে?

হ্যাঁ। সেইরকমই ভবেন্দ্রকে বুঝিয়েছিল নীরেন সান্যাল।

আপনি এ-কথা জানলেন কি করে? মৃণাল সেন শুধায়।

বেরিলিতে গিয়ে ভবেন্দ্রর সঙ্গে দেখা করে সব জেনেছি, আর সেই জন্যই-মানে রিভলবারটা ফিরে পাবার জন্যই ভবেন্দ্র কলকাতায় এসেছিল কিন্তু রিভলভার ফিরিয়ে দেয়নি নীরেন সান্যাল।

তাহলে–

হয়াঁ সুব্রত, এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিল নীরেন ডাক্তার। সে জানত বাপেছেলেতে বিরোধ—আর এও জানত ভবেন্দ্রর অনেক ধার। এই দুটোর সুযোগ নিয়ে সে বেশ কিছু মোটা টাকা দিয়ে ভবেন্দ্রর কাছ থেকে রিভলবারটা বাগিয়ে আনে। মহেন্দ্রনাথ ও মনীন্দ্র গাঙ্গুলীকে হত্যা করবার জন্য এবং সেই হত্যার অপরাধ বেচারি ভবেন্দ্রর ঘাড়ে চাপানোর জন্য। তাতে করে সে ভেবেছিল, কাজও হাসিল হবে আর তাকেও কেউ সন্দেহ করবে না।

কি সাংঘাতিক! সুব্রত বলে।

হ্যাঁ। চমৎকার প্ল্যান করেছিল নীরেন ডাক্তার। কিন্তু মারাত্মক দুটো ভুল করেছিল

সে–

দুটো ভুল! মৃণাল সেন প্রশ্ন করে।

একনম্বর—নিজের টাইপরাইটিং মেসিনে চিঠিটা টাইপ করে, সেই চিঠি মিঃ রায়কে পাঠিয়ে দিয়ে এবং দু নম্বর—তার মামার কাচা উইলটাকে সরিয়ে ফেলে।

কিরীটী একটু থেমে বলতে লাগল, যে মুহূর্তে ব্যাঙ্কের চিঠি দুটোর রহস্য আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় তখনই একটা কথা আমার মনে হয়। ঐ ডাঃ চৌধুরীর ভাইয়ের অর্থই হল হত্যার মূল এবং সে-কথা কে কে জানত! মহেন্দ্রনাথ ও মণীন্দ্র গাঙ্গুলী ছাড়া জানত নিশ্চয়ই ডাক্তার নীরেন। কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার উপরে আমার সন্দেহ হয়।

কিরীটীর কথা শেষ হল।

সকলেই নির্বাক।