স্বস্তিকা রহস্য

স্বস্তিকা রহস্য

পোস্টমাস্টার এবং ধাঁধা

ঝিরঝিরে বৃষ্টিঝরা সন্ধ্যায় হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার বৃদ্ধ বন্ধু প্রকৃতিবিজ্ঞানী কর্নেল নীলাদ্রি সরকার পাশেই হুইলার স্টলে পত্রিকা ঘাঁটছিলেন। সেই সময় আবার ভদ্রলোককে কাছাকাছি ঘুরঘুর করতে দেখলাম। ওঁর দৃষ্টি একবার কর্নেলের দিকে, একবার আমার দিকে। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর।

একটু আগে উনি আসতে আসতে হঠাৎ যেন আমাদের দেখেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। তারপর ভিড়ে মিশে গিয়েছিলেন। রোগাটে বেঁটে গড়নের মানুষ। বয়স আমার ধারণায় চল্লিশের উপরে। চাঁছাছোলা মুখ। বসা গাল। ছুঁচলো চিবুক। চোখদুটো ছোট এবং যাকে বলে কুতকুতে চাউনি। কিন্তু দেখার মতো লম্বা এবং তীক্ষ্ণ নাক। গায়ে ফুলহাতা ঘিয়ে রঙের শার্ট এবং পরনে ফিকে খয়েরি প্যান্ট। এক হাতে একটা চটাওঠা ব্রিফকেস। অন্যহাতে ভাজকরা ভিজে ছাতি। কাজেই তেমন কোনও হোমরা-চোমরা বলে মনে হয় না।

এই যে বর্ণনাটা দিলাম, সেটা কর্নেলের শিক্ষা সহবত। নৈলে কালেও এত খুঁটিয়ে দেখা আমার স্বভাব নয়। তবে এ-ও সত্যি, ভদ্রলোকের আচরণ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।

এবার আমি তার চোখে চোখ রাখলাম এবং আমার দৃষ্টিতে যথাসম্ভব তীব্রতা ছিল। তখনই ওঁর মুখে একটু কাচুমাচু হাসি ফুটে উঠল। কয়েক পা এগিয়ে এসে চাপা স্বরে বললেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? কিছু মনে করবেন না তো?

না। বলুন। ভারিক্কি চালে বললাম।

আচ্ছা, ওই যে সাদা দাড়ি, মাথায় টুপি, গলায় বাইনোকুলার ঝুলছে, উনিই কি বিখ্যাত রহস্যভেদী সেই কর্নেল সাহেব?

অস্বস্তিটা কেটে গেল। হাসি চেপে বললাম, হ্যাঁ। তা আপনার কি কোনও রহস্যটহস্য–

না, না। ভদ্রলোক জিভ কেটে ঝটপট বললেন, তাহলে আপনি নিশ্চয় জয়ন্তবাবু?

একটু অবাক হয়ে উঠলাম, হ্যাঁ। জয়ন্ত চৌধুরী। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার রিপোর্টার। আপনি আমাদের কি করে চিনলেন?

ভদ্রলোকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ওরে বাবা! আপনাদের চিনব না? আমি সত্যসেবক পত্রিকার ফ্যান। আপনাদের দুজনকারও ভীষণ ফ্যান। আপনার লেখা কত রোমাঞ্চকর ক্রাইমস্টোরি পড়েছি। কর্নেল সায়েবের ছবি না দেখলেও চেহারার ডেসক্রিপশন পড়েছি। তো যেখানে উনি সেখানেই আপনি।

বলে উনি চাপা অদ্ভুত শব্দে হেসে উঠলেন। বললাম, আপনি কোথায় থাকেন?

ভদ্রলোক আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চোখে রহস্য ফুটিয়ে বললেন, কর্নেল সায়েব নিশ্চয় কোথাও রহস্য ফাঁস করতে যাচ্ছেন। তাই না?

কপট গাম্ভীর্যে বললাম, হ্যাঁ। উনি এবার এক সাংঘাতিক রহস্যের পিছনে ছুটেছেন।

তা-ই বটে! উনি খুব চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায়, তা বলতে আপত্তি আছে?

আছে, তবে…।

বলুন না প্লিজ। বুঝলেন না? আপনাদের কীর্তিকলাপ পড়ে পড়ে আমারও ওই এক বাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন কি, আপনারা যদি আমাকে কো ওপারেট করতে ডাকেন, আমি আপনাদের দলে ভিড়ে যাব। আর কর্নেল সায়েব থাকলে ভয়টা কিসের?

রহস্যটা যদি খুনোখুনি সংক্রান্ত হয়?

হোক না। তা ঘটনাটা কোথায় ঘটেছে?

ভীমগড়ে।

ভদ্রলোক চমকে উঠলেন। অ্যাঁ? ভীমগড়ে? কবে?

 দুদিন আগে। আমি অবশ্য তিনদিন কি এক সপ্তাহ আগেও বলতে পারতাম। কিন্তু কেন কে জানে দুদিন আগে বলে ফেললাম। আসলে বেশ মজা পাচ্ছিলাম ওঁর কথাবার্তা শুনে। এদিকে সময়ও দিব্যি কেটে যাচ্ছিল। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে পৌঁছাতে দেরি করছে। সাতটায় ছাড়ার কথা। পৌনে সাতটা বেজে এল।

তো উনি আমার কথা শুনে আরও চমকে গিয়ে বললেন, সে কী? ভীমগড়ে মার্ডার হল। আর আমি জানতে পারলাম না? আমি ভীমগড়ে থাকি। সেখানকার নাড়ীর খবর রাখি। গতরাতে ট্রেনে চেপে আজ সকালে কলকাতা এসেছি। এখন ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু আশ্চর্য তো!

আপনি ভীমগড়ে থাকেন বুঝি?

হ্যাঁ। আমি সেখানকার পোস্টমাস্টার। এসেছিলাম পি. এম. জি. অফিসে জরুরি কাজে।

আপনার নাম?

অনিল কুমার সাঁতরা। তিন পুরুষের বাসিন্দা ভীমগড়ে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, মার্ডারটা–

বেগতিক দেখে বললাম, আসলে মার্ডারটা পুলিশ গোপন রেখেছে। খুব রহস্যময় মার্ডার কিনা?

অনিলবাবু আমার আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করলেন, কাদের বাড়িতে মাৰ্ডর? কে মার্ডার হয়েছে? আমি ভীমগড়ের সব্বাইকে চিনি। ক্ল দিতে পারব।

সময় কাটাতে গিয়ে কি উটকো ঝামেলায় পড়া গেল দেখছি। কর্নেল স্টলে কী একটা পত্রিকার পাতায় দৃষ্টি রেখে মগ্ন। যা মাথায় এল, বলে দিলাম। নাম কর্নেল জানেন। ব্যাপারটা টপ সিক্রেট। নামী লোক কিনা?

অনিলবাবু ভুরু কুঁচকে একটু চিন্তাভাবনার ভঙ্গি করে বললেন, ছ। বুঝেছি। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? ভারি অদ্ভুত তো?

ঠিক এইসময় ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে এসে ভিড়ল। হইহল্লা শুরু হয়ে গেল। পোস্টমাস্টার ভদ্রলোক আবার ভিড়ে হারিয়ে গেলেন।

এতক্ষণে কর্নেল পত্রিকাটির দাম মিটিয়ে ট্রেনের দিকে ঘুরলেন। হাল্কা বোঁচকাকুঁচকি হাতে নিয়ে আস্তে সুস্থে শেষ প্রান্তে কুপের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, কিন্তু তা কি করে সম্ভব? ভারি অদ্ভুত তো!

তার মানে?

ভদ্রলোকের শেষ সংলাপটা।

 হেসে ফেললাম। আপনি শুনছিলেন নাকি?

 কানে আসছিল। তুমি তো জানো জয়ন্ত আমার শ্রবণেন্দ্রিয় বিচ্ছিরি রকমের প্রখর। শুনতে না চাইলেও শোনা হয়ে যায়।

বাইরে কোথাও ট্রেনে গেলে কর্নেল কুপে পছন্দ করেন। এবারকার যাত্রা ভীমগড়ে এবং সেখানে নাকি এক দুর্লভ প্রজাতির অর্কিড এই বর্ষাকালে অবিশ্বাস্য রকমের ফুল ফোঁটায়, যা নাকি ময়ূরের পেখমের মতো। কর্নেল তার কি একটা লাতিন নামও বলেছিলেন, ভুলে গেছি। তবে এবার দেশের সর্বত্র বর্ষার যা বিক্রম শুনছি, ভ্রমণ আমার কাছে কতখানি আনন্দদায়ক হবে সংশয় ছিল।

ট্রেন ছাড়ার পর হাসতে হাসতে বললাম, ভদ্রলোক আপনার চেয়ে বাতিকগ্রস্ত। ওঁকে ভীষণ ভড়কে দিয়েছি। ভীমগড়ে দুদিন আগে গোপন হত্যাকাণ্ড এবং আপনি চলেছেন সেই রহস্য ফাঁস করতে।

প্রকৃতিবিজ্ঞানী টুপি খুলে রেখে টাকে হাত বুলোচ্ছিলেন। চুরুট ধরিয়ে বললেন,। রহস্য তো বটেই।

কি রহস্য?

অনিল কুমার সাঁতরার শেষ সংলাপটা। বলে কর্নেল আবার আওড়ালেন, কিন্তু তা কি করে সম্ভব? ভারি অদ্ভুত তো।

আশ্চর্য! আপনি দেখছি আপনার এক গুণমুগ্ধ ফ্যানের কথাতেও রহস্য আবিষ্কার করে ফেললেন! কর্নেল, এরপর আপনি আমার কথাতেও

ডার্লিং! ভদ্রলোকের ওই কথাটা আমার কানে বিধছে।

হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম, ঠিক আছে বস্। ভীমগড়ে গিয়ে পোস্টমাস্টার ভদ্রলোকের সঙ্গে নিরিবিলি কথা বললেন। তবে আমি এসবে নেই। না আপনার কোন দুর্লভ প্রজাতি অর্কিডে, না অনিলকুমার সাঁতরার ব্যাপারে। আপনি বলেছেন, কোন টিলার ওপরে বাংলোয় বসে বৃষ্টির রূপ দর্শন নাকি অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হবে। ব্যস্!

টিলাটাকে স্থানীয় লোকেরা বলে ভীমের গদা।

সে কি! পাথরের ন্যাড়া টিলার ওপর বাংলো?

কর্নেল হাসলেন। না। দ্বাপর যুগের গদার এই কলিযুগে কি অবস্থা হবে চিন্তা করো। তাতে বনদফতরের মালীদের হাত পড়েছে। তাছাড়া এখন বর্ষাকাল। বলে কর্নেল সেই পত্রিকাটি খুললেন এবং ফের পোস্টমাস্টারের শেষ সংলাপ আওড়ালেন, কিন্তু তা কি করে সম্ভব? ভারি আশ্চর্য তো!

বিরক্ত হয়ে কিটব্যাগ খুলে একটা গোয়েন্দা উপন্যাস বের করলাম।

একটু পরে শুনি, কর্নেল বলছেন, নাঃ। এর আগে একটা কথা ছিল। কী যেন কথাটা?

বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে বললাম, ব্যাপারটা কি খুলে বলুন তো?

মনে পড়েছে। শব্দ জুড়ে বাক্য, বাক্য জুড়ে সন্দর্ভ। ইংরেজিতে বলে ডিসকোর্স। কর্নেল আপনমনে বললেন, প্রায় একটা সন্দর্ভের সূচনা। প্রথম বাক্যটি ছিল, হুঁ। বুঝেছি। পরের দুটি বাক্য কিন্তু তা কি করে সম্ভব? আশ্চর্য তো! তার মানে, ভীমগড়ের পোস্টমাস্টার অনিলকুমার সাঁতরা, যিনি সেখানে তিনপুরুষ ধরে বাসিন্দা, তিনি একটি কল্পিত গোপন হত্যাকাণ্ডের কথা শুনে তিনটি বাক্য উচ্চারণ করলেন। মাই গুডনেস!

কর্নেলকে নড়ে বসতে দেখে বললাম, কি?

স্বস্তিকা।

তার মানে?

নাগমিথুন।

ওঃ!

জয়ন্ত। গুপ্তযুগে নাগমিথুনের প্রতীক ছিল স্বস্তিকা চিহ্ন, সে যুগের মন্দির স্থাপত্যের শৈলীতে স্বতিকা চিহ্ন ছিল একটি আবশ্যিক অংশ।

হঠাৎ গুপ্তযুগের স্থাপত্য এবং স্বস্তিকা নিয়ে পড়লেন কেন?

কর্নেল বৃষ্টিরোধী নেভি ব্লু রঙের জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে একটা ভাজকরা কাগজ খুলে আমার হাতে দিলেন। মুখে মিটমিটে হাসি। দেখি, কাগজটার মাথায় স্বস্তিকা এবং নিচে একটা শব্দছক আঁকা আছে। যেদিক থেকে পড়া যাক, শব্দগুলো একই থাকে। শব্দছকটা–

ম—-ক—-র
ক—-চ্ছ—-প
র—-প—-ট

বললাম, এ আবার কি?

কর্নেল কাগজটা আমার হাত থেকে নিয়ে ভাঁজ করে ভেতর পকেটে ঢুকিয়ে শুধু বললেন, রহস্য। তবে শব্দরহস্য। যাকে বলে ধাঁধা।

.

ভূতের চেয়ে অদ্ভুত

একটা মজার শব্দছককে কেনই বা কর্নেল ধাঁধা বললেন এবং গুপ্তযুগের মন্দির স্থাপত্যের স্বস্তিকা চিহ্নকে তার সঙ্গে জুড়ে দিলেন, উপরন্তু অনিলকুমার সাঁতরার কথাগুলি নিয়ে মাথা ঘামালেন, উনিই জানেন। তবে ব্যাপারটা আমাকে চিন্তিত করেছিল। তার কারণ এই বর্ষা-বাদলার মরশুমে কোনও রহস্যটহস্যের পেছনে ছোটাছুটি করে বেড়াবেন কর্নেল এবং আমাকেও বেশ ভোগাবেন মনে হচ্ছিল।

তাহলে কি ময়ূরের পেখমের মতো ফুলফোঁটানো অর্কিড দেখতে যাওয়া ওঁর নেহাত একটা ছুতো? ভীমের গদা নামক টিলার সুদৃশ্য বন বাংলোয় পৌঁছে অবশ্য উদ্বেগটা কেটে গিয়েছিল। সেখানে থেকে একটা সুবিস্তীর্ণ সংরক্ষিত জঙ্গল শুরু। সমৃদ্ধ পুরনো জনপদ ভীমগড় মোটামুটি সমতল একটা পাহাড়ি উপত্যকায় অবস্থিত। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটা ছোট্ট নদী। কিন্তু এই বর্ষায় সত্যিই যে ভীমা ভয়ঙ্করী। ফরেস্ট বাংলোর দূরত্ব ভীমগড় থেকে প্রায় এক কিমি। তবে কর্নেলের স্নেহভাজন বন দফতরের অফিসার হরদেব সিংহের একটি জিপ আমাদের সেবার জন্য তৈরি থাকায় কোনও অসুবিধে হয়নি। জিপচালক রহমতের গোঁফ এবং তাগড়াই চেহারা আপাতদৃষ্টি ভীতিপ্রদ হলেও, সে খুব অমায়িক এবং সজ্জন লোক। একসময় প্রতিরক্ষা দফতরে চাকরি করত। কাশ্মীরের লাদাখ অঞ্চলে দুর্গম তুষারঢাকা পথে সামরিক যানবাহন চালানোর অভিজ্ঞতা তার আছে। কর্নেলকে! সে বেজায় সমীহ করে এবং দেখামাত্র সামরিক সেলাম ঠোকে।

বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ রহমত কর্নেলের নির্দেশে জঙ্গলের পথে জিপ ছুটিয়েছিল। সে সাংঘাতিক পথের বর্ণনা দিচ্ছি না। দেওয়া যায় না বলেই। তাছাড়া সেটাকে পথও বলা যায় না। টুকরো টুকরো পাথরের চাই এবং হঠাৎ হঠাৎ বাঁক। কখনও বর্ষার ধস্ ছেড়ে পড়া গাছপালা ঝোপঝাড় জিপের গতি রোধ করছিল। রহমত জিপ থামিয়ে সেগুলো সরিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু কর্নেলের বা আমার একাজে সাহায্য নেওয়ার পাত্র নয় সে। তার কথা, আরামসে বৈঠিয়ে সাব! ইয়ে তো মামুলি কাম হ্যায়। সেইসঙ্গে লাদাখে বড় বড় তুষারঢাকা পাথর সরিয়ে তার জিপ চালানোর অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছিল সে।

অবশেষে একটা মাঝারি গড়নের প্রপাতের কাছে জিপ থেমেছিল এবং কর্নেল উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। বুঝেছিলাম সেই অর্কিডের খোঁজেই গেলেন। আকাশ কখনও নিজেকে ঘন মেঘে ঢাকছে। কখনও মেঘ সরিয়ে ঝলমলে রোদ্দুর ছড়াচ্ছে। বৃষ্টি ছিল না। রহমত খৈনি ডলতে ডলতে তার সামরিক জীবনের গল্প শোনাচ্ছিল। তাতে রঙ চড়ানো স্বাভাবিক। আমি কখনও শুনছিলাম, কখনও অন্যমনস্ক। শব্দছকের তিনটি শব্দ মকর, কচ্ছপ এবং রপট, গুপ্তযুগের মন্দির স্থাপত্যে স্বস্তিকা চিহ্ন এবং পোস্টমাস্টার অনিল কুমার সাঁতরা আমার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল। শেষে ভাবলাম, ব্যাপারটা আমাকে নিয়ে কর্নেলের একটা কৌতুক ছাড়া কিছু নয়।

প্রপাতের গর্জনে রহমতের কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল না। তাতে আমি হিন্দি, উর্দু তত বুঝি না। সে কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছিল। একসময় সে ঈষৎ উদ্বেগে বলল, এই জঙ্গলে জন্তু জানোয়ার আছে। তবে তার ভয় বুনো হাতির পাল সম্পর্কে। হাতিদের সর্দার নাকি খামখেয়ালি হয়। কার্নিলসাব কি কোথাও তার পাল্লায় পড়ে আটকে গেছেন? না-কর্নিলসাব মিলিটারির লোক। তিনি হাতির সর্দারকে ফাঁকি দিতে পারবেন। লেকিন বহত দের হো জায়েগা। বৃষ্টি এসে গেলে ধস্ ছাড়ারও ভয় আছে।

প্রায় দেড়টা নাগাদ কর্নেল ফিরলেন। হাতে কয়েকটা অর্কিডের চারা। বললেন, ফুল দেখলে তুমি অবাক হতে জয়ন্ত। কিন্তু তুমি তো জানো, আমি কখনও ফুল ছিড়ি না। সেটা পাপ গণ্য করি। হুঁ, তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারতাম। নিয়ে যাইনি তার কারণ জায়গাটা ভীষণ দুর্গম। তোমাকে নিয়ে সমস্যা হত।

আমাদের ভাগ্য ভাল। বৃষ্টি নামল বাংলোয় ফেরার পর। রহমত বৃষ্টির মধ্যে জিপ নিয়ে ভীমগড়ে ফিরে গেল। বলে গেল, সে খেয়েদেয়েই ফিরবে। বাংলোর প্রবীণ চৌকিদার কামরাঁধুনি কিরপানাথ– কৃপানাথ চমৎকার রাঁধে। দেরিতে হলেও বৃষ্টির পরিবেশে এবং খিদের দরুন খাওয়াটা ছিল তৃপ্তিদায়ক। খেতে খেতে কর্নেল হিন্দিতে কৃপানাথকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো ভীমগড়ের পুরনো লোক। তুমি পোস্টমাস্টার অনিলবাবুকে চেনো?

কৃপানাথ বলল, হ্যাঁ স্যার। চিনব না কেন? ওঁকে সবাই চেনে। আজকাল চিঠি লেখার খুব রেওয়াজ হয়েছে। আগের দিনে এত বেশি ছিল না। যে লেখাপড়া জানে না, সে-ও নানা জায়গায় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধবকে চিঠি পাঠায়। চিঠি লিখে দেওয়ার লোকও পোস্টাপিসে আছে। মানিঅর্ডার ফরম লেখা, ইংরেজিতে টাইপ করে দরখাস্ত পাঠানোর জন্যও লোক আছে। তবে পোস্টমাস্টারের কথা বলেছেন। ওঁরা ভীমগড়ের বড় ব্যবসায়ী পরিবার। বাঙালি বাজারের একচেটিয়া কারবারি। অনিলবাবু ব্যবসা ছেড়ে কেন যে চাকরিতে ঢুকলেন বুঝি না।

জিজ্ঞেস করলাম, বাঙালিবাজার নামে আলাদা বাজার আছে নাকি?

আছে স্যার। আমার ছোটবেলায় বাঙালি জমিদার ছিলেন। তিনিই ভীমগড়ে বাজার, হাইস্কুল, লাইব্রেরি, দেব-দেবীর মন্দির কত কি করেছিলেন। এখন ওঁরা কলকাতা চলে গেছেন। একটু দ্বিধার সঙ্গে কৃপানাথ ফের বলল, সাঁতরাবাবুদের অত্যাচারেই চলে গিয়েছিলেন জমিদার রায়বাবুরা। কি নিয়ে মামলা-মোকর্দমা হয়েছিল শুনেছি।

কর্নেল বললেন, তুমি তাহলে প্রসন্নকুমার রায়কে দেখেছ নিশ্চয়?

দেখেছি। তা বছর বিশেক আগে। উনি জমিদারবাড়ির ছোটহুজুর ছিলেন। বড় হুজুর নাকি সাধু হয়ে হিমালয়ে চলে গিয়েছিলেন।

জমিদারবাড়িটা তো এখনও আছে?

জঙ্গল আর খণ্ডহর হয়ে গেছে। এমন জঙ্গলে জায়গা যে, কেউ কিনতে রাজি হয় না। ছোটবেলায় শুনেছি লোকে বলত কেল্লাবাড়ি। তিনদিক গড়খাই, একদিক নদী। গড়খাইয়ের ওপর একটা কাঠের সাঁকো ছিল। কবে ভেঙে গেছে। গড়খাইয়ের একখানে কারা পাথর ফেলেছিল। সেই পাথরের ওপর দিয়ে খণ্ডহরে যাওয়া যায়। কিন্তু যাবেই বা কে? কেনই বা যাবে? যদি যায় কেউ, সে মুসহরবস্তির লোকেরা। ওরা শিকারি।

কর্নেল নিজেই বলেন, খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই। কিন্তু খেতে খেতে এইসব কথাবার্তা দিব্যি চালিয়ে গেলেন। খাওয়া শেষ হতে হতে বৃষ্টিটা থেমে গেল। মেঘ সরে রোদ্দুর ফুটল। রহমত জিপ নিয়ে এসে গেল। আমার ভাতঘুমের অভ্যাস আছে। কিন্তু কর্নেল বাধ সাধলেন। প্রায় চারটে বাজে। ওঁর সঙ্গে বেরুতে হবে এবং চোখে হেসে বললেন, এবার অর্কিড নয় ডার্লিং। রহস্য।

জিপ ভীমগড়ের দিকে উত্রাইয়ের চিকন বৃষ্টিধোয়া পথে ছুটে চলল। কর্নেল বসতির কাছে পৌঁছে বললেন, রহমত, পোস্টঅফিসে যাব।

কৌতূহল চেপে রাখলাম। অফিস আদালত এলাকায় বড় রাস্তার ধারে ছিমছাম একতলা সাব পোস্ট অফিস। ইংরেজি এল প্যাটার্ন নতুন বাড়ি। বারান্দার এক কোণে একজন পেশাদার টাইপিস্ট আপন মনে টাইপ করে চলেছেন। ভিড় নেই। থাকারও কথা নয় এখন। কর্নেল কাউন্টারে এক কর্মচারীকে নিচু গলায় কিছু বললেন, সে মুখ ঘুরিয়ে ইশারায় কিছু দেখাল। কর্নেল ঢুকে গেলেন। আমিও ওঁকে অনুসরণ করলাম।

ভেতরে কোনার দিকে দেয়াল ঘেঁষে একটা চেয়ার টেবিল। চেয়ারে আন্দাজ পঁচিশ বছর বয়সী গাঁট্টাগোট্টা চেহারার এক যুবক বসে ফাইলে কিছু লিখছিলেন। কর্নেলকে দেখে ইংরেজিতে বললেন, দয়া করে বসুন মহাশয়। আপনাকে সাহায্য করতে পারি কি?

বাংলা অনুবাদে এই বাক্যদুটি দাঁড়ায়। তো বুঝলাম, কর্নেলকে উনি সায়েব ভেবেছেন। কর্নেল বাংলায় বললেন, আপনিই কি পোস্টমাস্টার?

উনি একটু অবাক হয়ে বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনারা কোথা থেকে আসছেন?

কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছি। আপনার নাম কি অনিলকুমার সাঁতরা?

হ্যাঁ। আপনি

এখন আমিই অবাক এবং হতবাক। হাওড়া স্টেশনের সেই ভদ্রলোক ইনি, নন।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, মিসেস দয়াময়ী সাঁতরা আপনার আত্মীয়া?

অনিবাবু ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, জেঠিমা তাহলে তলে তলে পুলিশকে অ্যাপোচ করেছেন। কোনও মানে হয়?

কর্নেল পকেট থেকে তাঁর নেমকার্ড বের করে দিয়ে বললেন, না অনিলবাবু। আমরা পুলিশের লোক নই। আপনার জেঠিমার সঙ্গে কলকাতায় এক ভদ্রলোকের বাড়িতে আলাপ হয়েছিল। তো আপনার পদবি সাঁতরা বলেই কথাটা মাথায় এল। আপনার নাম অবশ্য এখানে বেড়াতে এসে জানতে পেরেছি। দৈবাৎ একটা যোগাযোগ আর কি!

অনিলবাবু কার্ডটা দেখছিলেন। নার্ভাস মুখে হেসে বললেন, ভীমগড়ে সাঁতরা ফ্যামিলি একটাই। জ্যাঠামশাই মারা যাওয়ার পর জেঠিমা কলকাতার বাড়িতে গিয়ে আছে। খুলেই বলি। জেঠিমার একটু সন্দেহবাতিক আছে। সব সময় ওঁর সন্দেহ, আমরা ওঁকে প্রপার্টির ন্যায্য শেয়ার থেকে বঞ্চিত করেছি। সন্তানাদি না থাকায় পোষ্যপুত্র নিয়েছেন। যত অশান্তির মূলে এই গুণ্ডাটা। তা চা-ফা বলি কর্নেলসায়েব?

ধন্যবাদ। কর্নেল অমায়িক কণ্ঠস্বরে বললেন, আপনার জেঠিমার পোষ্যপুত্রের নাম কি?

 অচিন্ত্য। ভীমগড়েই ওদের বাড়ি ছিল। ওর বাবা ছিলেন জমিদারবাবুদের কর্মচারী। বলে অনিলবাবু আবার সেইরকম ভুরু কুঁচকে তাকালেন। অচিন্ত্যকে চেনেন নাকি?

না। সে কোথায় থাকে?

কলকাতায় জেঠিমার কাছেই থাকে। কালেভদ্রে জেঠিমা এখানে এলে সঙ্গে আসে। জ্যাঠামশাইয়ের জীবদ্দশায় বাড়ির একটা অংশ পার্টিশন করা হয়েছিল। এলে সেখানেই ওঠেন। অনিলবাবু হাসবার চেষ্টা করে বিকৃত মুখে ফের বললেন, গত মাসে এসে হঠাৎ হইচই বাধিয়েছিলেন। তালা ভেঙে কি কি সব চুরি গিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার দেখুন–চুরি যদি হবে, পুলিশকে জানাক। তা নয়, খামোকা চ্যাঁচামেচি। শাসানি। আসলে অচিন্ত্য ওঁকে সামনে রেখে আমাদের সঙ্গে ঝামেলা বাধাতে চায়। তা বাধাক। উই আর রেডি টু ফেস–

উঠি অনিলবাবু। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তারপর পা বাড়িয়ে হঠাৎ ঘুরে বললেন, কাল সন্ধ্যায় হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। রোগা, বেঁটে মতো। লম্বা নাক। বলছিলেন, তাঁর নাম নাকি অনিলকুমার সাঁতরা। ভীমগড়ের পোস্টমাস্টার। তো দেখছি, উনি মিথ্যা বলছিলেন।

অনিলবাবু উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন, অ্যাঁ? সে কি কথা?

কর্নেল হাসলেন। কত লোক কত ধান্দায় থাকে।

অনিলবাবুকে উত্তেজিত মনে হল। ডাকলেন, শচীন। ও শচীন। আবার সেই কেলোর কীর্তি। বটকেষ্ট এঁদের কাছেও আমার নাম ভাড়িয়ে কি সব বলেছে।

এক তরুণ কর্মী চিঠির তাড়া বাঁধছিলেন। ফিক করে হেসে বললেন, কত টাকা ধার নিয়েছে বটোদা?

পোস্টমাস্টার কিছু বলার আগেই কর্নেল বললেন, নাহ। টাকা ধার নেননি। নেহাত নিজের পরিচয় দিয়েছেন। ধার চাইলেই বা দেব কেন? কিন্তু কে এই ভদ্রলোক?

অনিলবাবু খাপ্পা হয়ে বললেন, ওকে ভদ্রলোক বলছেন? নাম্বার ওয়ান ঠক। আমার নাম ভাড়িয়ে কত লোককে ঠকিয়েছে জানেন? এই অফিসেই একসময় পোস্টম্যান ছিল বটকেষ্ট। এর চিঠি তাকে, তার চিঠি ওকে করে গণ্ডগোল বাধাত। শেষে মানিঅর্ডারের টাকা মেরে ধরা পড়ল। ছমাস জেল হয়েছিল জানেন?

এখন কোথায় থাকেন উনি?

অনিলবাবু খ্যাঁক শব্দ হাসলেন, ও শচীন। বটকেষ্ট কোথায় থাকে জানো?

শচীনবাবু বললেন, পাটোয়ারিজির গদিতে খাতা লেখে। গদির লাগোয়া একটা ঘরে থাকে। পাটোয়ারিজি ঘুঘু লোক।

 বলো কি! জেনেশুনেও পাটোয়ারিজি ওকে কাজ দিয়েছেন?

রতনে রতন চেনে। বলে শচীনবাবু খি খি করে হেসে উঠলেন।

কর্নেল পোস্টমাস্টারকে নমস্কার করে বেরিয়ে এলেন। জিপের কাছে গিয়ে বললাম, বাস্! কত কি বেরিয়ে এল ঝুলি থেকে। মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। কিন্তু দয়াময়ী সাঁতরা কি আপনার মক্কেল?

নাহ্। মক্কেল-টলে নন। আমারই নেহাত কৌতূহল। অনুসন্ধিৎসা বলতে পারে।

শব্দছক ও স্বস্তিকা–

কর্নেল হাসলেন। এতদিনে বুঝলাম তকালীন পোস্টম্যান বটকৃষ্ণবাবু ইচ্ছে করেই রং ডেলিভারি দিয়েছিলেন দয়াময়ীকে। খামের মধ্যে একটা কাগজে স্বস্তিকা চিহ্নের তলায় ওই মকর, কচ্ছপ এবং রপট শব্দছক আঁকা ছিল।

বুঝলাম। কিন্তু খামের ওপর নাম-ঠিকানা ছিল তো?

ছিল। প্রসন্নকুমার রায়। অথচ বাংলোর চৌকিদার কৃপানাথ যা বলল, তাতে মনে হয়, প্রসন্নবাবু বহুবছর আগে ভীমগড় ছেড়ে কলকাতাবাসী হয়েছিলেন।

 জিপে উঠে কর্নেল রহমতকে বললেন, পাটোয়ারিজির গদি চেনো রহমত?

রহমত স্টার্ট দিয়ে বলল, জরুর কর্নিলসাব। সুন্দর সিং পাটোয়ারিজিকে এ মুলুকে সবাই চেনে। এখন নয়া টাউনশিপে কারবারি অফিস খুলেছেন। লেকিন তার গদি পুরানা বাজারে।

গদিতেই চলো আগে।

রহমত বিনীতভাবে বলল, পুরানা বাজারে ঘিঞ্জি গলি। গাড়ি ঢুকবে না। কর্নিলসাবকে একটু কষ্ট করে কয়েককদম হাঁটতে হবে।

ঠিক আছে।

জিপ সংকীর্ণ আঁকাবাঁকা রাস্তায় মিনিট পনের চলার পর ভিড়ভাট্টায় ভরা জরাজীর্ণ চেহারার একটা বাজার এলাকায় গিয়ে থামল। রহমত গদির হদিস দিল। কর্নেলকে অনুসরণ করলাম। সত্যিই ঘিঞ্জি গলি এবং খানাখন্দে ভরা পথ। জলকাদায় পাথরের ইট পিচ্ছিল হয়ে আছে। কিছুটা চলার পর একটা ফাঁকা চত্বর দেখা গেল। তার চারদিকে একতলা-দোতলা বাড়ি।–দোকানপাটে ভিড় গিজ গিজ করছে। চত্বরে একদঙ্গল গরু-মোষ এবং ঘোড়া এখনই রাতের খাওয়া। সেরে নিচ্ছে। যে গাড়িগুলো তারা টেনে এনেছে, সেগুলো কোন্ পথে ঢুকেছে খুঁজে পেলাম না। সবে বিদ্যুতের আলো জ্বলে উঠেছে। কারণ আকাশে ঘন মেঘ : নীচের নৈসর্গিক আলো শুষে নিয়েছে।

পাটোয়ারিজির গদি খুঁজে পাওয়া গেল। গদিতে যে অবাঙালি ভদ্রলোক দোপদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বসেছিলেন, তিনি পাটোয়ারিজির এক ভাতিজা। তার কাছে জানা গেল, বটকৃষ্ণবাবু কারবারি কাজে কলকাতা গেছেন। এখনও ফেরেননি।

পাটোয়ারিজির ভাতিজা ভদ্রলোক কেমন যেন নির্লিপ্ত উদাসীন প্রকৃতির মানুষ। কর্নেলকে পাত্তা দিলেন না, জিজ্ঞেসও করলেন না কিছু।

ফিরে আসতে আসতে বললাম, লোকটা বড় অভদ্র তো!

কর্নেল আনমনে বললেন, কেন?

কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। গ্রাহ্যও করলেন না।

কর্নেল হাসলেন। টিপিক্যাল ঝানু ব্যবসায়ীরা তোক চেনেন। দেখেই আঁচ করেছেন, আমরা কারবারি কাজে আসিনি। সন্দেহও হয়ে থাকবে সরকারি লোক কি না। পাত্তা দেওয়া মানে পয়সা খরচ। যদি আমরা কিছু চার্জ করি, তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে। এই হল এখানকার কারবারিদের বাঁধা ছক।

বটকৃষ্ণবাবুর কীর্তিকলাপ সত্যিই রহস্যজনক। তবে আপনার আচরণও কম রহস্যজনক নয়! আমাকে খুলে বললেই পারেন, কলকাতার দয়াময়ী দেবী আপনাকে একটা কেস দিয়েছেন।

না জয়ন্ত। কেস উনি দেননি। আমিই নিয়েছি। নিছক অনুসন্ধিৎসা। তবে বটকৃষ্ণবাবুর কথা দয়াময়ী আমাকে বলেননি। লেটারবক্সে বছর তিনেক আগে খামটা পেয়েছিলেন। কৌতূহলবশত খুলে দেখে অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারেননি। তবে বুদ্ধিমতী মহিলা। জমিদার রায়বাবুদের সঙ্গে ওঁর স্বামীর ফ্যামিলির বিবাদ ছিল জমি-জায়গা নিয়ে। তাই খামটা লুকিয়ে রেখেছিলেন, কোনও দিন কাজে লাগবে ভেবেই।

ওঁর পোষ্যপুত্রকে জানাননি?

পোষ্যপুত্রের কথা আমাকে দয়াময়ী বলেননি। তবে ওঁর কথায় আঁচ করেছি, এই খামের কথা উনি ঘুণাক্ষরে কাকেও বলেননি। কদিন আগে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে ওঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তো আমার পরিচয় পেয়ে

ভিড়ে ঠাসা ঘিঞ্জি গলিতে পিচ্ছিল পাথুরে ইটের ওপর হাঁটতে হাঁটতে বাক্যালাপের বিপদ আছে। বার দুই পা হড়কে পড়তে পড়তে টাল খেয়েছিলাম। তৃতীয়বার পড়েই পেলাম। নোংরায় প্যান্টের অবস্থা শোচনীয় হল। দুটো হাতে কাদা মেখে গেল। কিন্তু ভাগ্যিস আঘাত পেলাম না। ভিড়ের কেউ আমাকে সাহায্য করার আগেই উঠে দাঁড়ালাম। কেউ কেউ জলের কল দেখিয়ে দিল সমবেদনায়।

কিন্তু কর্নেল কোথায়?

একটু পরে তাঁকে আবিষ্কার করলাম। গলির বাঁকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে চুরুট ধরাচ্ছেন। কাছে গেলে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ফলপট্টির ভেতর হাঁটার সময় সতর্ক থাকা উচিত। বিশেষ করে যদি দুধারে পাকা কলার কাঁদি দেখা যায়। যাই হোক, তোমার জন্য এই ট্যাপের কাছে অপেক্ষা করাই উচিত মনে করেছিলাম। ধুয়ে নাও। বাংলোয় ফিরে পোশাক বদলাবে।

অগত্যা ট্যাপের জলে যতটা পারা যায় ধুয়ে পেলে বললাম, যত বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি জায়গায় আপনার যাতায়াত। এই নোংরা কাদার দুর্গন্ধ ছ্যাঃ।

কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, তোমার চেয়ে বটকৃষ্ণবাবুর অবস্থা শোচনীয়। বেচারা ভিড় ঠেলে পালাতে গিয়ে একবারে ড্রেনে পড়লেন। আমি ওঁকেই ওঠাতে গেলাম। কিন্তু উনি কাদায় ভূত হয়ে ভূতের মতোই অদৃশ্য হয়ে গেলেন। একেই বলে ভূতের চেয়ে অদ্ভুত।

 বলেন কি! বটকৃষ্ণবাবুকে দেখেছেন? চোখের ভুল নয় তো?

নাহ্। আপন মনে উনি আসছিলেন। হাতে অবশ্য ব্রিফকেস ছিল না। আমাকে দেখামাত্র গা ঢাকা দিতে গিয়ে কেলেঙ্কারি। কর্নেল স্বভাবসিদ্ধ অট্টহাসি হাসলেন। তারপর জিপের কাছাকাছি পৌঁছে আপনমনে বললেন, বটকৃষ্ণবাবু একটা ভাইট্যাল পয়েন্ট। ওঁকে না পেলে খড়ের গাদায় সুচ খুঁজে হন্যে হব।

.

বটকৃষ্ণবাবুর চিঠি

 কর্নেল জিপে উঠেই রহমতকে বললেন, নিউ টাউনশিপে পাটোয়ারিজির কোম্পানির অফিসে যাব। তুমি কি অফিসটা চেনো রহমত?

রহমত হাসল। চিনি কর্নিয়ালসাব। এখানে সুন্দর সিং পাটোয়ারিজিকে চেনে না এমন লোক নেই। বহৎ কড়া আদমি। মিনিস্টাররাও ওঁকে খুব খাতির করেন। সে জিপ স্টার্ট দিয়ে ফের বলল, পুরানা বাজারে ওঁর ভাতিজা মোহন সিং পাটোয়ারিজিকেও চিনি। খুব দেমাগি লোক। সুন্দর সিং পাটোয়ারি তাকে বিশ্বাস করেন বটে, কিন্তু আমার মনে হয়, একদিন ওই ভাতিজাই ওঁকে পথে বসাবে।

কেন একথা তোমার মনে হয়?

মোহনজির হাতে অনেক গুণ্ডা-বদমাইস আছে। সুন্দরজিও ওকে ভয় করে চলেন। ভাতিজা মোহনজির বেনামে দুসরা কারবার আছে, সুন্দরজি তা জেনেও চুপ করে আছেন।

তুমি বটকৃষ্ণবাবুকে চেনো? আগে পোস্টম্যান ছিলেন। এখন মোহনজির গদিতে কাজ করেন!

রহমত বাঁকামুখে বলল, চোট্টামি করে বেড়ায়। নেশাখোর। মোহনজির লোক বলে তাকে কেউ কিছু বলতে পারে না। জেলখাটা লোক।

কর্নেল সারা পথ রহমতের সঙ্গে এইসব কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন। নিউ টাউনশিপ এলাকায় তখন আলো ঝলমল করছে। ছিমছাম সুদৃশ্য পরিবেশ। রহমত একখানে জিপ থামিয়ে বলল, সুন্দরজির অফিস বন্ধ দেখছি। তবে পাশেই ওঁর বাড়ি। আমি দেখে আসি উনি আছেন কি না।

সে জিপ থেকে নেমে বাঁদিকে একটু বিরাট দোতলা বাড়ির গেটে গেল। গেটে দারোয়ান ছিল। তার সঙ্গে কথা বলে ফিরে এল রহমত। বলল, সুন্দরজি আছে। আমি দারোয়ানকে বলে এলাম, কলকাতা থেকে কর্নিয়ালসাব দেখা করতে এসেছেন।

কর্নেল জিপ থেকে নামলেন। ওঁকে অনুসরণ করলাম। বুঝতে পারছিলাম না কে কর্নেল এই ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন।

দারোয়ান কর্নেলকে দেখে সেলাম ঠুকে গেটের একটা অংশ খুলে দিল। সাজানোলন এবং ফুলবাগিচা দেখে বুঝলাম সুন্দরজি সেকেলে ব্যবসায়ী নন। পোর্টিকোর সামনে স্মার্ট চেহারা এবং প্যান্ট-শার্ট পরা একজন মধ্যবয়সী লোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। ইংরেজিতে বললেন, আপনারা কলকাতা থেকে আসছেন?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। তারপর পকেট থেকে একটা নেমকার্ড দিলেন। সুন্দরজির সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। আপনিই কি–

ভদ্রলোক কার্ডটা দেখছিলেন। বললেন, আমি সুন্দরজির কোম্পানির ম্যানেজার। আমার নাম রাকেশ শর্মা। আপনারা ভেতরে এসে বসুন। আমি ওঁকে খবর দিচ্ছি।

বসার ঘরটা সুন্দরভাবে সাজানো। মেঝেয় দামি কার্পেট। একদিকের দেয়াল ঘেঁষে সার সার গদিআটা চেয়ার। অন্যদিকে সোফাসেট। আলমারিতে দেশ বিদেশের পুতুল, ইতস্তত সাজিয়ে রাখা ভাস্কর্য, শেফে কিছু ঝকঝকে মলাটের বই। দেয়ালে কয়েকটা চিত্রকলা। দেবদেবীর মূর্তিও চোখে পড়ল এবং সেগুলি উৎকৃষ্ট শিল্প নিদর্শন। সুন্দরজি আধুনিক রুচির মানুষ, তাতে সন্দেহ নেই।

রাকেশ শর্মা আমাদের বসিয়ে পর্দা তুলে ভেতরে গিয়েছিলেন, একটু পরে ফিরে এসে বললেন, সুন্দরজি আসছেন, আপনারা বসুন।

বলে উনি বাইরে চলে গেলেন। মিনিট কয়েক পরে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক শক্তসমর্থ গড়নের বৃদ্ধ ঘরে ঢুকে নমস্কার করে অমায়িক কণ্ঠস্বরে ইংরেজিতে বললেন, বলুন কর্নেল সরকার। আপনার জন্য কি করতে পারি?

তার হাতে কর্নেলের কার্ড এবং একটা ছড়ি ছিল। তিনি কর্নেলের দিকে তাকিয়ে কথা বললেন, একটু অবাক হলাম, তা ঠিকই। তবে আমাদের দুজনের মধ্যে কার কর্নেল হওয়া সম্ভব, সেটা হয়তো চেহারা ও ব্যক্তিত্ব দেখেই জানা সম্ভব।

কর্নেল বললেন, আলাপ করিয়ে দিই। কলকাতার বিখ্যাত দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী।

সুন্দরজি আমাকে দেখি নিয়ে সহাস্যে বললেন, আমি কি সংবাদ হওয়ার মতো কিছু কাজ করেছি?

কর্নেল হাসলেন। নাহ সুন্দরজি। জয়ন্ত আমার সঙ্গে এখানে বেড়াতে এসেছে।

আপনি রিটায়ার্ড সামরিক অফিসার। সরকারের পক্ষ থেকে কোনও কাজে এসেছেন কি? ঠিক আছে। বলুন কি কাজ?

সরকারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই সুন্দরজি। আমি এখানে বেড়াতেই এসেছি। তো শুনলাম, আপনি এখানকার পুরনো বাসিন্দা। তাই একটা কথা জানতে এলাম।

বলুন কি জানতে চান?

এখানে একটা কেল্লাবাড়ির মালিক ছিলেন বাঙালি জমিদার। তারা দুই ভাই। প্রশান্ত রায় এবং প্রসন্ন রায়। তাদের নিশ্চয় চিনতেন?

সুন্দরজি ভুরু কুঁচকে বললেন, চিনতাম। প্রশান্ত বছর পঁচিশ আগে সন্ন্যাসী হয়ে চলে যায়। আমার বন্ধু ছিল সে। ছোটবেলা থেকেই ধর্মকর্ম নিয়ে থাকত। প্রসন্ন উল্টো স্বভাবের লোক। ভীমগড়ের বাঙালিবাজারে আমার মতোই এক কারবারি বাঙালি পরিবার আছে। তাদের সঙ্গে প্রসন্নের জমিজায়গা নিয়ে মামলা বেধেছিল। প্রসন্নও এখান থেকে চলে যায়। সে-ও প্রায় বিশ বছর আগের কথা।

কোন জমি নিয়ে মামলা হয়েছিল জানেন নিশ্চয়?

কেল্লাবাড়ির একটা জমি নিয়ে। জমিটা একর তিনেক হবে। প্রশান্ত নাকি সন্ন্যাসী হওয়ার আগে জমিটা ওই কারবারি ফ্যামিলির বড়কর্তা সত্যকুমার সাঁতরাকে বেচেছিল। সত্যবাবু মারা গেছেন। তার ছোট ভাই নবকুমার ঝানু লোক। আমি তাকে পছন্দ করি না। না, কারবারি প্রতিযোগিতার প্রশ্ন নয়। লোকটা কুচুটে স্বভাবের। নিজের ছেলের সঙ্গেই বনিবনা হয় না। ছেলে অনিল তাই চাকরি করছে। পোস্টমাস্টার হয়েছে।

বটকৃষ্ণবাবু নামে এক ভদ্রলোক আপনার গদিতে কাজ করেন শুনলাম। তিনি নাকি পোস্টম্যান ছিলেন?

সুন্দরজির মুখে সন্দিগ্ধ ভাব ফুটে উঠল। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকার পর বললেন, আপনার এসব কথাবার্তা বলতে আসার উদ্দেশ্য কি? কে। আপনি?

কর্নেল হাসলেন, কার্ডেই আমার পরিচয় লেখা আছে। তবে বটকৃষ্ণবাবু আমাকে–

সুন্দরজি ওঁর কথার উপর বললেন, চিট করেছে? কিভাবে ওর পাল্লায় পড়লেন?

যেভাবে আপনি ওর পাল্লায় পড়েছেন।

 তার মানে? কি বলতে চান আপনি?

কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে ভাজকরা সেই শব্দছক আঁকা পুরনো কাগজটা বের করে খুললেন। বললেন, দেখুন তো, এটা চিনতে পারেন কি না?

সুন্দরজির মুখের ভাব মুহূর্তে বদলে গেল। প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন, কে আপনি?

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার পরামর্শ সুন্দরজি, আপনি যেন এই ফাঁদে পা দেবেন না। আপনার এই ঘরে সাজানো ভাস্কর্যগুলো দেখেই বুঝতে পেরেছি, আপনি প্রাচীন ভারতীয় শিল্পনিদর্শনের সমঝদার। কিন্তু আপনাকে সাবধান করে দেওয়া উচিত, বটকৃষ্ণবাবুর নির্বুদ্ধিতায় আপনার বিপদ ঘটতে পারে। তিনি আপনাকে লোভ দেখিয়ে চাকরি আদায় করেছেন। আমি বলছি না বেচারাকে বরখাস্ত করুন। শুধু বলছি বটকৃষ্ণবাবুর কথায় চলবেন না।

বলে কর্নেল দ্রুত ঘর থেকে বেরুলেন। সুন্দরজি রুষ্ট মুখে বসে রইলেন।

জিপে উঠে বললাম, আপনি যেন সুন্দরজিকে হুমকি দিতেই গিয়েছিলেন। ব্যাপারটা কি?

কর্নেল আমার কথার উত্তর না দিয়ে রহমতকে বললেন, রহমত। তুমি নবকুমার সাঁতরার বাড়ি চেনো?

রহমত বলল, ওঁর বাড়ি নদীর ধারে বাঙালি বাজারের শেষ দিকে। পাশেই একটা খণ্ডহর আছে কর্নিলসাব। জমিদারবাবুদের কেল্লাবাড়ি। ওঁরাও বাঙালি ছিলেন।

জানি। নবকুমারবাবুর বাড়ি পর্যন্ত জিপ যাবে তো?

যাবে কর্নিলসাব। বাবুজি নতুন বাড়ি বানিয়েছেন পুরনো বাড়ির পাশে। পুরনো বাড়িতে ওঁর ছেলে থাকে। পোস্টমাস্টার অনিলবাবু।

অনিলবাবুর ভাই নেই?

আছে। সুনীলবাবু বড়। অনিলবাবু ছোট। ওঁর বোনেদের বিয়ে হয়ে গেছে। সুনীলবাবু বাবার সঙ্গে কারবার দেখাশোনা করেন।

প্রায় কুড়ি মিনিট পর আলো-আঁধারি পরিবেশে জনহীন নিঝুম একটা এলাকায় পৌঁছলাম। রহমত একটা সংকীর্ণ পিচের রাস্তায় জিপ ঘোরালো। রাস্তার দুধারে ঘন গাছপালা এবং অসমতল মাটিতে পুরনো নতুন একটা করে বাড়ি জিপের আলোয় দেখা যাচ্ছিল। রাস্তার ধারে কিছুদূর অন্তর একটা করে কাঠের ল্যাম্পপোস্ট আছে বটে, কিন্তু বাতিগুলো ম্লান এবং কোনও কোনও বাতি গাছের পাতার আড়ালে ঢাকা পড়েছে। এই সন্ধ্যারাত্রে রাস্তাটা এমন জনহীন যে একা পায়ে হেঁটে গেলে গা ছমছম করতেই পারে। বৃষ্টি বন্ধ এবং বাতাস বইছে না। তাই গুমোট গরম। একখানে জিপ আবার ঘুরল এবং কিছুটা এগিয়ে থামল। রহমত জিপ থেকে নেমে বলল, এই বাড়ি কর্নিলসাব। আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি খবর দিয়ে আসি।

ডানদিকে একটা নতুন দোতলা বাড়ি। তবে পাটোয়ারিজির বাড়ির মতো ছিমছাম নয়। বাড়িটা সদ্য তৈরি হয়েছে মনে হচ্ছিল। একটু পরে কুকুরের হাঁকডাক শোনা গেল। তারপর হেঁড়ে গলায় দোতলা থেকে কেউ বললেন, কে? কি চাই?

রহমত বলল, বাবুজি। কলকাতা থেকে কর্নিলসাব এসেছেন। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।

কর্নেলের সঙ্গে আমি নামলাম জিপ থেকে। গেটের ভেতর থেকে একঝলক টর্চের আলো এসে আমাদের মুখে পড়ল। সেই সঙ্গে কুকুরের হাঁকডাক। দেখলাম, বন্ধ গেটের ভেতরে একজন পাজামা-পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর একহাতে প্রকাণ্ড অ্যালসেশিয়ানের গলার চেন। কুকুরটা গেটের গরাদে দুই ঠ্যাং তুলে গর্জন করছে।

কর্নেল বললেন, আমি নবকুমারবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।

বাবা তো নেই। দুদিন আগে কলকাতা গেছেন। আজ ফেরার কথা ছিল। রাতের ট্রেনে ফিরতেও পারেন।

আপনি কি সুনীলবাবু?

হ্যাঁ। তো অনিল–আমার ভাই জানিয়ে গেছে, জেঠিমা আমাদের পেছনে পুলিশ লাগিয়েছেন। দেখুন স্যার, আমরা জেঠিমার কোনও সাতেপাঁচে নেই।

সুনীলবাবু। আমরা পুলিশ নই। অনিলবাবুকে বলেছি–

অনিল একটা গবেট। সুনীলবাবু খাপ্পা মেজাজে বললেন, ওর বোকামির জন্যই বাবা ওকে পছন্দ করেন না। ঘরের শত্রু বিভীষণ। আজ আবার ভালমানুষি করে বলতে এসেছিল, জেঠিমা কলকাতা থেকে সি আই ডি অফিসার পাঠিয়েছেন।

কর্নেল বললেন, উনি বটকৃষ্ণবাবুর কথা বলেননি?

সুনীলবাবু অ্যালসেশিয়ানটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গর্জন করলেন, বটোকেষ্টকে গুলি করে মারা উচিত। ঠগ। জোচ্চোর। ধান্দাবাজ। সেই আমাদের বিরুদ্ধে জেঠিমার কান ভারি করত। এখনও কলকাতা গিয়ে তাই করছে। করুক না। ভেবেছে, পাটোয়ারির গুণ্ডারা ওর পিঠ বাঁচাবে? চামড়া খুলে নেব।

নিশ্চয় নেবেন। তা সুনীলবাবু, জমিদার রায়বাবুদের সঙ্গে আপনাদের মামলার কি অবস্থা?

সুনীলবাবু একটু দমে গেলেন যেন। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললেন, দেখুন স্যার, এসব ব্যাপারে যা বলার বাবা বলবেন। তবে জেঠিমা যখন আপনাদের হেল্প নিয়েছেন, তখন জেঠিমার কাছেই জানতে পারতেন মামলার কি অবস্থা। প্লিজ, আপনারা পরে খোঁজ নেবেন। বাবা ফিরে আসুন।

এই সময় টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হল। আমরা জিপে উঠলাম। কর্নেল রহমতকে বললেন, সোজা ফরেস্ট বাংলো৷

ফরেস্ট বাংলোয় পৌঁছনোর আগেই তুমুল বৃষ্টি নামল। জিপের সামনে কর্নেলের বাঁদিকে এবং রহমতের ডানদিকে ঠাসবন্দি অবস্থায় বসার ফলে আমি তত ভিজলাম না। কিন্তু বৃষ্টিরোধী জ্যাকেট পরা সত্ত্বেও কর্নেল যথেষ্ট ভিজলেন। পর্দাটা ছেঁড়া। আটকাতে পারলেন না। ওঁর সাদা দাড়ি থেকে ঝরনা ঝরতে থাকল। টুপিতে অবশ্য টাক বাঁচল।

বাংলোয় আমাদের পৌঁছে দিয়ে রহমত চলে গেল জিপ নিয়ে। কৃপানাথ দৌড়ে এল। কর্নেল তাকে কড়া কফির হুকুম দিলেন। সেইসময় কৃপানাথ পকেট থেকে একটা ভাঁজকরা কাগজ কর্নেলকে দিয়ে বলল, এক বাঙালিবাবু কিছুক্ষণ আগে চিঠিটা দিয়ে গেলেন। চেনা-চেনা মনে হচ্ছিল।

তাকে থামিয়ে কর্নেল বললেন, জলদি কফি।

কৃপানাথ চলে গেলে চিঠিটা খুলে কর্নেল পড়লেন। তারপর নির্বিকার মুখে আমার হাতে দিলেন। পড়ে দেখি, লেখা আছে–

মহামান্য কর্নেল নীলাদ্রি সরকার মহাশয়
সমীপেষু,
যাহা ভাবিয়াছিলাম, তাহাই ঘটিয়াছে। পুরানা বাজারে যখন আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, তখন পাটোয়ারিজির গুণ্ডারা আশেপাশে ছিল। আপনার সহিত কথাবার্তা বলিলে তাহাদের সন্দেহ হইবে ভাবিয়া শীঘ্রই সরিয়া পড়ি। এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী। তবে বিশেষ ঘটনা, অদ্য বৈকালে কেল্লাবাড়ির একটি ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপ-চাপ রক্ত এবং একটি পামসু জুতা আবিষ্কার করিয়াছি। পামসু পাটি চিনিতে পারিয়াছি। উহা শ্রীনবকুমার সাঁতরার। আপনি অনুগ্রহপূর্বক তদন্ত করুন, সাঁতরাবাবুকে কে হত্যা করিয়াছে। আমি আড়ালে থাকিয়া এইরূপে আপনাকে সহযোগিতা করিব।
প্রণাম জানিবেন।
ইতি শ্রীবটকৃষ্ণ গুঁই…

.

জল্পনা এবং জুতো

 অবিশ্রান্ত বৃষ্টির রাতে বনবাংলোর বারান্দায় বসে কফি পানের এই অভিজ্ঞতা তুলনাহীন। বৃদ্ধ প্রকৃতি প্রেমিক মুগ্ধভাবে কথাগুলি উচ্চারণ করলেন। তারপর চুরুট জ্বেলে আমার দিকে তাকালেন। তোমাকে বলেছিলাম জয়ন্ত, ভীমগড়ের বৃষ্টি ভীমের মতোই দুর্ধর্ষ।

আমার মনে বটকৃষ্ণবাবুর চিঠিটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। বৃষ্টির দিকে মন যাচ্ছিল না। ভদ্রলোক একবার না হয় কোনও কারণে মিথ্যা বলেছেন, দ্বিতীয়বারও কি মিথ্যা বলবেন? বিশেষ করে নবকুমারবাবুর এক পাটি পামসু এবং রক্ত আবিষ্কারের মতো সাংঘাতিক ধোঁকাবাজি করবেন কর্নেলের সঙ্গে?

আমাকে চুপচাপ দেখে কর্নেল বললেন, তুমি দেখতে পাচ্ছ কেল্লাবাড়ির ধ্বংসস্তূপের ঘাসে নবকুমারের চাপ-চাপ রক্ত বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে। একপাটি পামসুও ভিজতে পারে, যদি না বটকৃষ্ণবাবু তা হাতিয়ে থাকেন। বলে বটকৃষ্ণবাবুর সেই কথা তিনটি আওড়ালেন। হুঁ, বুঝেছি। কিন্তু তা কেমন করে সম্ভব? ভারি অদ্ভুত তে।

ক্ষুব্ধভাবে বললাম, আপনার এই হেঁয়ালিপনা এক বিচ্ছিরি অভ্যাস কিন্তু। এক ভদ্রমহিলা এজন্যই আমাকে বলেছিলেন, আপনার ওই কর্নেল ভদ্রলোক বড্ড ন্যাকা।

হ্যাঁ, ন্যাকা। কর্নেল হাসলেন। আর তুমি হেঁয়ালিপনা বললে! সত্যিকার হেঁয়ালিতে নিজেই যখন হাবুডুবু খাই, তখন হেঁয়ালির লেজ ধরে টেনে তোমাকে দেখাই–যদি তুমি এমন কোনও সূত্র দিতে পারো, যাতে উদ্ধার পাই। অর্লিং। আমাকে বাধ্য হয়েই ন্যাকা সাজতে হয়। কেন জানো? যে ঘটনার কিছুটা জানি, বাকিটা জানি না, তখন ন্যাকামি আমাকে উদ্দীপ্ত রাখে। অর্থাৎ অন্যের প্রতিক্রিয়া বুঝতে চাই। তো দেখা যাচ্ছে, বটকৃষ্ণবাবুর সেই শেষ সংলাপ তোমার মধ্যে কোনও প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার করতে পারেনি।

আপনার পেরেছে?

পেরেছে। সেটাই সমস্য। কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, প্রথমত বটকৃষ্ণবাবুর আচরণের কথাই ধরো। কেন উনি নিজেকে ভীমগড়ের পোস্টমাস্টার বলে পরিচয় দিলেন?

শুনলাম তো। এটা ওঁর স্বভাব। এই করে উনি লোককে ঠকান। 

কিন্তু আমাদের কাছে কিসের আশায় উনি মিথ্যা পরিচয় দিলেন? এর একটাই জবাব হয়। উনি সাঁতরা পরিবারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ঘটাতে চেয়েছিলেন। আমি রহস্যভেদী এবং তুমি আমার ছায়াসঙ্গী, তা উনি সত্যসেবক পত্রিকা পড়ে জেনেছেন। এদিকে দেখ, সত্যিই সাঁতরা পরিবারে একটা রহস্য আছে এবং দয়াময়ী দেবী আমাকে ওই অদ্ভুত শব্দছক আঁকা কাগজটা দিয়েছেন। বটকৃষ্ণবাবু কিন্তু আমাকে কাগজ দেওয়ার কথা জানেন না। তবু উনি নিজেকে অনিলবাবু বলে পরিচয় দিয়েছিলেন স্টেশনে। এবার চিন্তা করো, বটকৃষ্ণবাবুর উদ্দেশ্য কি ছিল।

বুঝলাম। আপনার কীর্তিকলাপ পড়ে ওঁর মাথাতেও রহস্যভেদের বাতিক চাড়া দিয়েছে।

ঠিক তা-ই। এবার দেখ, উনি ছিলেন পোস্টম্যান। প্রসন্ন রায়ের ঠিকানায় আসা একটি চিঠি–যার মধ্যে ওই স্বস্তিকা এবং শব্দছক আঁকা ছিল, সেটা উনি দয়াময়ী সাঁতরার লেটারবক্সে ফেলেছিলেন কেন?

বটকৃষ্ণবাবুর অন্যের চিঠি খুলে পড়ার অভ্যাস ছিল নিশ্চয়?

নাহ্। খামে প্রেরকের নাম ছিল না। কিন্তু ডাকঘরের সিল ছিল। পোস্টম্যানরা অস্পষ্ট সিল পড়তে পারে। ওটা অভ্যাস। যেমন ছাপাখানার কম্পোজিটাররা খারাপ হাতের লেখাও কম্পোজ করতে পারেন। পোস্টিং অফিসের সিল আমিও আতসকাঁচে পড়েছি। ওটা পোস্ট করা হয়েছিল কেদারনাথ থেকে।

নড়ে বসলাম। মাই গুডনেস। তাহলে কি খামটা প্রসন্নবাবুর দাদা সেই সন্ন্যাসী

আমার কথার উপর কর্নেল বললেন, বাহ্। বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেছ। সংসারত্যাগী প্রশান্ত রায়ই ওটা ভাইকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু বটকৃষ্ণবাবুর ওই বদ অভ্যাসটাও সত্যি। শব্দছকটা টুকে নিয়ে কেল্লবাড়ির তলায় গুপ্ত কোন ভাস্কর্যের লোভ দেখিয়ে পাটোয়ারিজির কাছে অন্নের সংস্থান করে নিয়েছেন। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। কারণ আজ সুন্দর সিং পাটোয়ারির বাড়িতে কিছু প্রত্নভাস্কর্যের নকল দেখেছি। তাছাড়া উনি বড় ব্যবসায়ী। একটা সত্যিকার প্রত্নভাস্কর্য হাতাতে পারলে বিদেশে বহু টাকায় পাচার করতেও পারবেন। ক্লিয়ার?

কিন্তু প্রত্নভাস্কর্য আসছে কোথা থেকে

স্বস্তিকা নাগমিথুনের প্রতীক, তা তোমাকে বলেছি। গুপ্তযুগের মন্দিরে ওই প্রতীক সর্বত্র ব্যবহার করা হত।

বুঝলাম। কেল্লাবাড়িতে কোথাও গুপ্তযুগের কোন প্রত্নভাস্কর্য গুপ্তধনের মতো লুকোনো আছে। এই তো?

তাই তো মনে হচ্ছে। শব্দছকটা হয়তো তা খুঁজে বের করার সূত্র।

বটকৃষ্ণবাবু কেমন করে সেই রহস্য টের পেলেন?

এর উত্তর উনিই দিতে পারেন।

আরও প্রশ্ন আছে কর্নেল। উনি দয়াময়ী দেবীর লেটারবক্সেই বা কেন তা ফেলেছিলেন?

এর উত্তরও বটকৃষ্ণবাবু দিতে পারেন।

দয়াময়ী দেবীই বা প্রসন্নবাবুর ঠিকানা লেখা খাম খুলেছিলেন কেন?

কর্নেল হাসলেন। প্রসন্নবাবু ওঁর স্বামীর শত্রু। জমিজায়গা নিয়ে মামলা। কাজেই দয়াময়ী দেবীর কৌতূহল স্বাভাবিক ছিল। বিশেষ করে ওই হেঁয়ালি আঁকা ব্যাপারটা–হ্যাঁ, তোমাকে আগেই বলেছি, ভবিষ্যতে কোনও কাজে লাগতে পারে ভেবে গোপন রেখে দিয়েছিলেন।

দয়াময়ী আপনাকে মামলার কি অবস্থা এখন, তা বলেননি?

উনি জানেন না। কারণ ওঁর দেবর নবকুমারবাবু মামলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাছাড়া পারিবারিক কলহ বা শরিকি ঝামেলা তো থাকেই এসব ক্ষেত্রে।

একটু ভেবে নিয়ে বললাম, বটকৃষ্ণবাবুর এই চিঠিটি আমাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। আমার ভয় হচ্ছে, যদি সত্যি নবকুমারবাবু খুন হয়ে থাকেন

কর্নেল বললেন, ডিনার সেরে নেওয়া যাক। বেচারা কৃপানাথ ঢুলছে। কেউ কোথাও রক্ত এবং জুতো পড়ে থাকতে দেখে খবর দিলেও রাতের বৃষ্টির মধ্যে আমি দৌডুচ্ছি না।

বাংলোর ছোট্ট ডাইনিং রুমে আমরা খেতে গেলাম। কৃপানাথ উৎকৃষ্ট বাঁধে। কিন্তু খেতে খেতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলাম। এক সময় বললাম, বটকৃষ্ণবাবুর শেষ সংলাপ নিয়ে আপনি মাথা ঘামাচ্ছেন কেন?

কর্নেল মুরগির ঠ্যাং কামড়ে ধরে বললেন, উনি তোমাকে মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিলেন এবং তুমিও মিথ্যা খুন-খারাপির কথা বলেছিলে তাকে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, মিথ্যাগুলোর আড়ালে একটা কঠিন সত্য আছে। উনি তোমার কথা শুনে খুব অবাক হয়েছিলেন। তাই না?

ভীষণ অবাক।

তার মানে, উনি জানতেন কাউকে খুনের চেষ্টা হতে পারে। কিন্তু ওঁর। ধারণা ছিল, তাকে খুন করা সম্ভব নয় এবং কোনও ভাবেই নয়। যাই হোক, বটকৃষ্ণবাবুকে মুখোমুখি না পেলে কিছু জানা যাবে না।

খাওয়া শেষ করে আমরা ঘরে ফিরলাম। ততক্ষণে বৃষ্টি কমে এসেছে। কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে চুরুট ধরালেন। সেই সময় হঠাৎ পিছনের খোলা জানালার নিচে ভিজে কাগজের একটা মোড়ক দেখতে পেলাম। সেটা তুলে নিয়ে দেখি, একপাটি পামসু। চমকে ওঠে বললাম, কর্নেল! কর্নেল! একপাটি জুতো। পামসু।

কর্নেল একবার দেখে নিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন, রেখে দাও–

.

খণ্ডহরে জোড়া লাশ

 জুতোটা যে বটকৃষ্ণবাবুই কখন চুপি চুপি এসে জানালা গলিয়ে ফেলে গিয়েছিলেন তাতে ভুল নেই। কিন্তু ভদ্রলোক কেন আর আমাদের মুখোমুখি হচ্ছেন না, এটাই অদ্ভুত। কর্নেল কিন্তু তেমনই নির্বিকার। শুয়ে শুয়ে দেখছিলাম, টেবিলবাতির আলোয় একটা গাদা বই পড়ছেন। বাইরে বেড়াতে এলেও এই বইপত্র সঙ্গে আনেন। নিশ্চয় প্রজাপতি-অর্কিড-পাখি কিংবা প্রকৃতি সংক্রান্ত বই ওটা।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম এবং সেই ঘুম ভাঙল কর্নেলের ডাকে। ঘরে দিনের আলল। আজ আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার। বারান্দায় রোদ্দুর ঝলমল করছে।

সুপ্রভাত ডার্লিং। বলে কর্নেল টেবিলের উপর কিটব্যগ রাখলেন। লক্ষ্য করলাম, অভ্যাসমতো প্রাতঃভ্রমণে গিয়েছিলেন। ক্যামেরা এবং বাইনোকুলার রেখে পা থেকে হান্টিং বুট খুললেন। রেন-জ্যাকেট তো বটেই, টুপি এবং দাড়িতে মাকড়সার জাল, পাতার কুচি ইত্যাদির নৈসর্গিক আবর্জনা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হলেন।

প্রায় আটটা বাজে। চুপচাপ বাথরুমে গেলাম। ফিরে এসে দেখলাম, কর্নেল পোশাক বদলেছেন। কৃপানাথ টেবিলে কফির পট, পেয়ালা, কিছু স্ন্যাক্স রেখে গেছে। বললাম, কেল্লাবাড়িতে গিয়েছিলেন নাকি?

যাওয়া উচিত। যাব।

 আপনি বটকৃষ্ণবাবুর চিঠিটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।

দিচ্ছি। তবে প্রথম গুরুত্ব ওঁর রেখে যাওয়া একপাটি জুতত। কর্নেল হাসলেন। কিন্তু মজার কথা, এই একপাটি জুতো বাঁ পায়ের। ডান পায়ের জুতোটা বাংলোর নিচেই ঝোপের ভেতর কুড়িয়ে পেয়েছি। সস্তা রবারের পামসু। নবকুমারবাবুর মতো ধনী ব্যবসায়ীর পায়ে এমন জুতো শোভা পায় না। হুঁ, সেকেলে স্বভাবের হাড়কিপটে ব্যবসায়ীরা এমন সাদাসিধে জুতো পরতেই পারেন। কিন্তু জয়ন্ত, জুতো জোড়া ৬ নম্বরী। তার মানে খর্বকায় শীর্ণদেহী লোকের জুতো। এবং নতুন জুতো। কর্নেল টেবিলের তলায় রাখা জুতোজোড়া দেখিয়ে দিলেন।

আপনি যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছেন দেখছি।

হ্যাঁ বটকৃষ্ণবাবুকে ফেরত দেব। কারণ এ জুতো কলকাতা থেকে সদ্য কেনা। হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ওঁর পায়ে এই জুতো পরশু সন্ধ্যায় দেখেছিলাম।

হেসে ফেললাম। আপনি লক্ষ্য করেছিলেন তা হলে?

কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, কিন্তু প্রশ্ন হল, বটকৃষ্ণবাবু এভাবে আমাকে কার সঙ্গে লড়িয়ে দিতে চাইছেন? শুধু বুঝতে পারছি, এবার উনি কেল্লাবাড়ির ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ঘটাতে তৎপর হয়েছেন। দেখা যাক।

লোকটা অদ্ভুত।

কর্নেল আমার মন্তব্যে কান করলেন না। ঘড়ি দেখে বললেন, রহমত জিপ নিয়ে আসতে দেরি করছে কেন? তার আটটা নাগাদ এসে যাওয়ার কথা।

উনি বারান্দায় গিয়ে বাইনোকুলারে সম্ভবত রহমতের ধাবমান জিপ খুঁজতে থাকলেন। আমি রাতের পোশাক বদলে নিলাম।

রহমতের জিপ এল প্রায় পৌনে নটায়। সে সামরিক সেলাম ঠুকে উদ্বিগ্ন মুখে বলল, বড়া খতরনাক কর্নিলসাব। সেইজন্য আসতে দেরি হল। কেল্লা বাড়ির খণ্ডহরে একজন বাঙালিবাব খুন হয়েছে। পাটোয়ারিজির পুরানা গদিতে কাজ করতেন উনি। খুব ভিড় হয়েছে। পুলিশ গেছে। তো–

কর্নেল কিছু বলার আগেই আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম, বটকৃষ্ণবাবু!

রহমত বলল, জি সাব। ওহি বাবু। লাশ পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে।

কর্নেল চুপচাপ জিপের কাছে গেলেন। আমাকে উঠতে ইশারা করলেন। তারপর রহমত স্টিয়ারিঙে বসলে বললেন, কেল্লাবাড়ি।

বাঙালি এলাকা ছাড়িয়ে সদর রাস্তা থেকে জিপ সংকীর্ণ এবড়ো-খেবড়ো একটা রাস্তায় বাঁক নিল। এদিকটায় অসমতল মাটি ঘন জঙ্গলে ঢাকা। কিছু লোক সেই রাস্তায় ফিরে আসছিল। তারা আমাদের জিপ দেখে একবার থমকে দাঁড়াল। উত্তেজিতভাবে কিছু বলাবলি করল। তারপর চলে গেল। বুঝলাম তারা অত্যুৎসাহী প্রকৃতির লোক এবং অকুস্থল থেকে ফিরে আসছে।

জিপ যেখানে থামল, সেখানেই এই রাস্তার শেষ। সামনে গভীর গড়খাই জলে ভরা। একখানে বড় বড় পাথর পড়ে আছে সেই গড়খাইয়ে। তার ওধারে। পাথুরে পাঁচিল ভেঙে পড়েছে। ভেতরে উঁচু-নিচু গাছ ঝোপঝাড় এবং ধ্বংসস্তূপ। তার ফাঁকে জরাজীর্ণ একটা বিশাল ইটের বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। রহমতের সঙ্গে পাথরের উপর দিয়ে আমরা কেল্লাবাড়িতে ঢুকলাম। পায়ে চলা পথ দেখে বোঝা গেল কৃপানাথের কথা ঠিক নয়। কেল্লাবাড়িতে লোক চলাচল করে। সম্ভবত গরিব লোকেরা জ্বালানি কাঠ, ফলমূল সংগ্রহের জন্য এবং পাখি বা। ছোট জন্তু শিকারেও আসে। একটু পরে দুধারে দুটো পুকুর দেখা গেল। ঘন জলজ গাছে ঢাকা। দুটোতেই পাথরের ভাঙাচোরা ঘাট আছে এবং ঘাটের দুদিকে বিধ্বস্ত কোনও ভাস্কর্যের চিহ্নও আছে। মধ্যিখানে পাথরের ইটে বাঁধানো পথ। সেই পথের অবস্থা শোচনীয়। ফাটলে ঘাস আর ঝোপ গজিয়েছে। পথের দুধারে প্রাচীন পামগাছের সারি ঢাকা পড়েছে বিশাল সব গাছের তলায়। প্রকাণ্ড লতা ঝুলছে। ইটের বাড়িটা মুখ থুবড়ে পড়েছে। দরজা-জানালার কাঠ লুঠ হয়ে গেছে কবে। বাড়ির সামনে প্রশস্ত সোপানের চিহ্ন টিকে আছে। রহমত সেই সোপানের কাছে গিয়ে বলল, এইখানে লাশ পড়েছিল। এই দেখুন কর্নিলসাব। এখনও রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে। ভোরে আবার খুব বৃষ্টি হয়েছিল। তাই রক্ত ধুয়ে গেছে।

কর্নেল বললেন, লাশ প্রথমে কে দেখতে পেয়েছিল?

মুসহর বস্তির একটা লোক স্যার। সে একটা খরগোশ তাড়া করে এসেছিল। লাশ দেখে সে বাঙালিটোলায় খবর দেয়। তারপর পুলিশের কাছে খবর যায়।

কি দিয়ে খুন করা হয়েছে জানো?

 মাথার পিছনে শাবলের ঘা মেরেছিল খুনি। শাবলটা পাশেই পড়ে ছিল। পুলিশ নিয়ে গেছে।

পাটোয়ারিজি বা তার কোন লোক এসেছিল দেখেছ?

জি হাঁ। ওঁর ভাতিজা, আরও অনেকে এসেছিল।  

লাশ কি অবস্থায় পড়েছিল?

 উপুড় হয়ে।

হুঁ, খুনি পিছন থেকে মাথায় ঘা মেরেছিল। বলে কর্নেল ধাপ বেয়ে উঠলেন। বারান্দার দুটো মোটা থামের অর্ধেক ভাঙা এবং বারান্দা ধ্বংসস্তূপে ঢাকা পড়েছে।

রহমতের নিষেধ গ্রাহ্য না করে কর্নেল বারান্দার ধ্বংসস্তূপের উপর দিয়ে চলে গেলেন। আমি কৌতূহলী হয়ে ওঁকে অনুসরণ করলাম। রহমত পিছন থেকে বলল, আমি জিপের কাছে যাচ্ছি স্যার।

কর্নেল একটি দরজার ফাঁকে ঝোপ সরিয়ে উঁকি দিচ্ছিলেন। সেইসময় লক্ষ্য করলাম, ঝোপের একপাশটা কাত হয়ে আছে এবং ছোট কয়েকটা ডাল ভেঙে পড়েছে। টাটকা ভাঙা বলে মনে হল। সেদিকে কর্নেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। উনি শুধু বললেন, দেখেছি।

তারপর উনি মেঝের ধ্বংসস্তূপে উঠে থমকে দাঁড়ালেন। ওঁর মুখে বিস্ময় লক্ষ্য করে বললাম, কি?

কর্নেল মৃদুস্বরে বললেন, পুলিশের এটা চোখে পড়া উচিত ছিল। তবে আমি প্রকৃতিচর বলেই প্রকৃতির কোথাও যেটুকু অস্বাভাবিকতা আবিষ্কার করতে পারি, পুলিশ তা পারে না। বিশেষ করে বর্ষাকাল এবং গত তিনদিন ধরে বৃষ্টি হয়েছে। তার ফলে অস্বাভাবিকতা অনেকটা ঘুচে গেছে।

এবার আমিও সাবধানে পা ফেলে পটায় উঠলাম। একপাশে বিপজ্জনকভাবে দুটো লোহার বর্গার কিছুটা নেমে এসে স্কুপে ঢুকেছে। তার উপর ছাদের খানিকটা অংশ এবং তলায় ঘন ছায়া। মেঝের বাকি অংশে বোদ্র পড়েছে। বললাম, খোঁড়াখুঁড়ির চিহ্ন নাকি?

নাহ। কেউ খুঁড়তেই এসেছিল। খোঁড়া হয়নি। উল্টোদিক থেকে কেউ এসে পড়েছিল। ওই যে দেখছ, উল্টোদিকের দরজার ঝোপেরও একই অবস্থা।

বলে কর্নেল কিটব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট খুন্তির মতো জিনিস বের করলেন। বিরল প্রজাতির উদ্ভিদের চারা সংগ্রহে ওটা ওঁকে ব্যবহার করতে দেখেছি। এবার উনি দুহাতে রবারের দস্তানা পরে বিপজ্জনকভাবে ঝুলে থেকে ছাদটুকুর তলায় ঢুকে গেলেন। সাবধান করতে গিয়ে থেমে গেলাম। জানি, উনি আমার কথায় কান দেবেন না।

প্রায় মিনিট দুই খোঁড়ার পর কর্নেল বেরিয়ে এলেন। একটু হেসে বললাম, গুপ্তযুগের প্রত্নভাস্কর্য খুঁজেতে বড্ড বেশি রিস্ক নিচ্ছেন কিন্তু। এখানে সাপের আচ্ছা।

কর্নেল বললেন, অত্যুৎসাহী বটকৃষ্ণবাবু নিজের বুদ্ধির দোষেই প্রাণটা খুইয়েছেন। বেচারার জন্য দুঃখ হচ্ছে।

উনি বেরিয়ে গেলেন। সোপানে পৌঁছে বললাম, বটকৃষ্ণবাবু কি প্রভাস্কর্যের খোঁজে এসেছিলেন?

নাহ্। একটা লাশের খোঁজে!

 চমকে উঠলাম। তার মানে?

একটা লাশের খোঁজে এসে বেচারা নিজেই লাশ হয়ে গেছেন।

কার লাশ?

নবকুমারবাবুর বলেই ধরে নেওয়া যায়। কারণ চিঠিতে বটকৃষ্ণবাবু আমাদের একথা জানিয়েছিলেন। পাছে আমি ওঁর কথা গ্রাহ্য না করি, তাই নিজের জুতো ফেলে দিয়ে এসেছিলেন বাংলায়। তার পরও যখন উনি দেখলেন আমি গ্রাহ্য করছি না, তখন ভোরবেলায় উনি নিজেই ওই পুঁতে রাখা লাশ খুঁড়ে বের করতে এসেছিলেন। সেই সময় আততায়ী ওঁকে অনুসরণ করে এসেছিল। তারপর ওঁর শাবল কেড়ে নিয়ে ওঁকেই লাশ বানিয়ে গেছে।

আপনি এমনভাবে বলছেন যেন নিজের চোখে সব দেখেছেন।

চিহ্নগুলি এক একটি তথ্য। তথ্যগুলি থেকে আমার কাছে এই ঘটনা এসে দাঁড়াচ্ছে।

কার পুঁতে রাখা লাশ খুঁড়ে বের করতে গেলেন কেন বটকৃষ্ণবাবু?

লাশের খবর হলে আমি গিয়ে পড়ব, উনি জানতেন। কর্নেল হাঁটতে হাঁটতে বললেন, আমার ভুলে নয়, নিজের ভুল এবং হঠকারিতায় বটকৃষ্ণবাবু মারা পড়লেন। একটু ধৈর্য ধরা ওঁর উচিত ছিল। বড় অদ্ভুত চরিত্রের লোক ছিলেন বটকৃষ্ণ গুই। কিংবা

কিংবা?

ওঁর মনে কোনও অভিসন্ধি ছিল। এমনও হতে পারে, আমার হাত দিয়ে হুঁকো খেতে চেয়েছিলেন।

হুঁকো খেতে? সে আবার কি?

কর্নেল বিষণ্ণভাবে হাসলেন। পুরনো বাংলা প্রবচন আছে, পরের হাতে হুঁকো খাওয়া।

তা হলে বলুন, গুপ্তযুগের সেই প্রত্নভাস্কর্য উদ্ধারের সূত্র আপনার সাহায্যে

কর্নেল থমকে দাঁড়ালে চুপ করলাম। উনি পাথুরে পথটার দুধারে পুকুর দুটি দেখতে থাকলেন।

একটু পরে বললেন, আশ্চর্য তো!

 আমাদের বাঁদিকের পুকুরটা উঁচুতে এবং ডানদিকেরটা নিচুতে। বলে আবার হাঁটতে শুরু করলেন। এখনই থানায় যেতে হবে। দেরি করা ঠিক হচ্ছে না

এই নিরিবিলি জায়গায় তার আগেই যদি নবকুমারবাবুর লাশ খুনি সরিয়ে ফেলে?

 দিনদুপুরে তা পারবে না। ওদিকে মুসহর বস্তি আছে নদীর ধারে। তাছাড়া কৌতূহলী লোকেরা ঘটনাস্থল দেখতে আসতে পারে। তাদের চোখে পড়বে। বলে কর্নেল আঙুল তুললেন। ওই দেখ, একদল লোক আবার আসছে। খবর ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ।

নানা বয়সী একদল লোক কর্নেলের দিকে কেমনচোখে তাকাতে তাকাতে পাশ কাটিয়ে গেল। পাদ্রিবাবা ভাবল কি না কে জানে!

রহমত জিপের কাছে অপেক্ষা করছিল। গড়খাই পেরিয়ে গিয়ে আমরা জিপে চাপলাম। কর্নেল বললেন, এবার পুলিশ স্টেশন চলো রহমত।

পুলিশ স্টেশন নিউ টাউনশিপ এলাকায়। পৌঁছুতে সাড়ে নটা বেজে গেল। কর্নেল বললেন, তোমার মুখ দেখে বুঝতে পারছি, খিদে পেয়েছে। তুমি বসে থাকো। আমি এখনই আসছি।

উনি নেমে গেলেন। গেটে সেন্ট্রি দাঁড়িয়ে ছিল। কর্নেল তার পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন।

রহমত দুঃখিত মুখে বলল, আজকাল খুনখারাপি লেগেই আছে। কেউ আইনকানুন মেনে চলছে না। পুলিশ কিছু করবে ভাবছেন? কিছু না। তবে স্যার, ওই বাবু পাটোয়ারিজির গদিতে কাজ করতেন। দেখা যাক, ওঁরা পুলিশকে চাপ। দিয়ে কিছু করাতে পারেন কি না। সুন্দরজি খুব বড়া আদমি। মিনিস্টার, এম এল এর সঙ্গে ওঁর চেনাজানা আছে। কিন্তু ওই বাবুজিরও দোষ আছে স্যার।

কি দোষ?

জেলখাটা লোক। পোস্ট অফিসের পিয়ন ছিলেন। তারপর চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন। লোককে ঠকিয়ে পয়সা কামাতেন। তো আমি বুঝতে পারছি না উনি খণ্ডহরে কেন গিয়েছিলেন? আর শাবলই বা ওখানে কে নিয়ে গেল? রহমত মুখে রহস্য ফুটিয়ে বলল, শুনেছি, কেল্লাবাড়িতে খাজানা (গুপ্তধন) পোঁতা আছে। থাকতেই পারে। পুরনো আমলের রাজবাড়ি। কলকাতার বাঙালি জমিদারবাবুরা কোন আমলে খরিদ করেছিলেন। আমি বছর তিনেক আগে এখানে বদলি হয়েছি। কত গল্প শুনি।

সে গল্প শোনাতে থাকল। আজগুবি সব গল্প। তারপর কর্নেল ফিরে এসে বললেন, সোজা ফরেস্ট বাংলো, রহমত। তারপর আমার দিকে ঘুরে আস্তে করে বললেন একটা লাশ পোঁতা আছে বলেছি পুলিশকে। তবে কার লাশ তা বলিনি। কারণ যদি অন্য কারও লাশ হয়?

.

অচিন্ত্যনীয় ঘটনা

 কৃপানাথ ব্রেকফাস্ট রেডি রেখেছিল। বারান্দায় বসে ব্রেকফাস্টের সময় ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি এল। রহমত কৃপানাথের সঙ্গে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বটকৃষ্ণবাবুর খুনখারাপি নিয়ে আলোচনা করছিল।

বললাম, পুলিশ আপনাকে পাত্তা দিল?

কর্নেল বললেন, তুমি তো বরাবর দেখে আসছ, এসব ক্ষেত্রে কলকাতা থেকে থু প্রপার চ্যানেলে আমি যোগাযোগের ব্যবস্থা রাখি। এস পি ভীমগড় থানাকে রেডিও মেসেজে আমার কথা জানিয়ে রেখেছিলেন। তবে আমি কোথায় উঠব, তা বলিনি। যাই হোক এস পি ভদ্রলোক রসিক। থানাকে জানিয়েছিলেন, অসময়ে কলকাতা থেকে এক সান্তা ক্লজ আসছেন। তার সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে। থানার অফিসাররা অবশ্য বুঝতে পারেননি কেন কোন সান্তা ক্লজ বুড়ো এই বর্ষায় এখানে আসছে এবং তাকে কী ভাবে সহযোগিতা করতে হবে। এখন তারা আমাকে চর্মচক্ষে দেখে এবং এই হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার ফলে আমার সেবায় তৎপর হয়ে উঠলেন। নাহ্। আমি দয়াময়ী সাঁতরার নাম করিনি, কিংবা স্বস্তিকা আঁকা শব্দছকের কথাও ওঁদের জানাইনি। শুধু বলেছি, এটা সাধারণ খুনখারাপি নয়। এর সঙ্গে একটা জটিল রহস্য জড়িয়ে আছে। আপনারা কেল্লাবাড়িতে পুলিশক্যাম্প বসান। কেল্লাবাড়িতে যেন জনপ্রাণীটি না যায় আর। যদি কাউকে সেখানে দেখা যায়, তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। কি উদ্দেশ্যে সে গিয়েছিল, জেরা করে জেনে নিতে হবে।

বৃষ্টি জোরালো না হলেও সমানে ঝিরঝিরি ধারায় ঝরছিল। সেই সঙ্গে এলোমেলো হাওয়া। বাংলোটা টিলার মাথায় বলে হাওয়ার দৌরাত্ম্য বেশি। ব্রেকফাস্টের পর ঘরে গিয়ে জানালার ধারে বসলাম। ওদিকটায় ঢেউ খেলানো ঘনসবুজ অরণ্য–যতদূর চোখ যায়। মাঝে মাঝে বেখাঁচা একটা করে কালো নগ্ন পাথরের পাহাড় অতিকায় হাতির মতো দাঁড়িয়ে আছে।

কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে চুরুট টানছিলেন। পাশের টেবিল থেকে সেই গাব্দা বইটা হঠাৎ তুলে নিলেন। তারপর পাতা ওল্টাতে থাকলেন। দেখলাম, একগুচ্ছ মন্দিরের ফটোয় পৌঁছে ওঁর হাত থামল। এবার আতস কাঁচ দিয়ে ফটোগুলোতে কিছু দেখতে মন দিলেন। কিছুক্ষণ পরে সশব্দে বইটা বুজিয়ে রেখে বললেন, ওঠ। বেরুনো যাক।

অর্কিডের খোঁজে বেরুলে আমি যাচ্ছি না।

নাহ। কেল্লাবাড়িতে পুঁতে রাখা লাশটা সত্যিই নবকুমারবাবুর কি না জানা দরকার। গত রাতে ওঁর বড় ছেলের মুখে শুনেছি, উনি দুদিন আগে কলকাতা গেছেন। এদিকে বটকৃষ্ণবাবুর চিঠিতে বলে থেকে গেলেন কর্নেল। স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে ফের বললেন, , বুঝেছি। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? ভারি অদ্ভুত তো।

ওঃ কর্নেল। আবার বটকৃষ্ণবাবুর সেই শেষ সংলাপ।

 সংলাপটা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে জয়ন্ত। তোমার সংলাপের শেষাংশ স্মরণ করো। তুমি বলেছিলে, ব্যাপারটা টপ সিক্রেট কি না। নামী লোক।

আপনার মুখস্থ আছে দেখছি।

 হ্যাঁ, কর্নেল দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বললেন, তার উত্তরেই বটকৃষ্ণবাবুর ওই তিনটি কথা। তুমি বলেছিলে নামী লোক। তাই তাঁর হত্যাকাণ্ড পুলিশ চেপে রেখে তদন্ত চালাচ্ছে টপ সিক্রেট। এগুলোর জবাবে বটকৃষ্ণবাবুর উক্তি, স্থ। বুঝেছি! কিন্তু পরের বাক্যে তাঁর উক্তি–তা কি করে সম্ভব? জয়ন্ত। এখন মনে হচ্ছে, সেই নামী লোক, যাঁর খুন হওয়ার সম্ভারনা আঁচ করেছিলেন বটকৃষ্ণবাবু, কি করে খুন হতে পারেন, এটাই ভারি অদ্ভুত মনে হয়েছিল বটকৃষ্ণবাবুর কাছে। কেন মনে হয়েছিল? না, না। তখন আমি ওই তিনটি কথার মানে খুঁজতে ভুল দিকে ছুটেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে ঠিক দিকেই চলেছি।

ঠিক দিকটা কি?

যার খুন হওয়ার সম্ভাবনা বলে ধারণা ছিল বটকৃষ্ণবাবুর, তিনি নিশ্চয় বটকৃষ্ণবাবুর সঙ্গে একই ট্রেনে কলকাতা গিয়েছিলেন, কিংবা বটকৃষ্ণবাবু তাকে একই ট্রেনে কলকাতা যেতে দেখেছিলেন। জয়ন্ত, বটকৃষ্ণবাবু আসলে নবকুমারবাবুর কথা ভেবেই ওই উক্তি করেছিলেন। সিওর। হানড্রেড পারসেন্ট সিওর।

বলে কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে টুপি পরলেন। বাংলোর পোর্টিকোর তলায় জিপের দিকে এগিয়ে গেলেন। রহমত ছুটে এল। বৃষ্টি এখন কমে গেছে। টিপ টিপ করে পড়ছে। সমতলে বড় রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল বললেন, রহমত। আমরা নবকুমার সাঁতরার বাড়ি যাব।

জিজ্ঞেস করলাম; কেল্লাবাড়ি যাবেন না?

আগে ওঁর বাড়ি। তারপর কেল্লাবাড়ি।

গতরাতে এলাকাটা রহস্যময় মনে হয়েছিল। দিনের আলোয় দেখলাম মোটামুটি ভদ্র পরিবেশ। একটা করে পুরনো বাগানবাড়ি। তার পাশে একালীন ঝকমকে স্থাপত্য। প্রচুর গাছপালা, এমন কি আম বাগানও আছে। একটা সুন্দর মন্দির দেখতে পেলাম। কালীমন্দির না হয়ে যায় না। চোখে পড়ল পুরনো কিন্তু মেরামতে ভোলফোরানো একতলা একটা লাইব্রেরি এবং সাইনবোর্ডে বাংলায়। লেখা বান্ধব পাঠাগার। স্থাপিত ১৯৩১ খৃঃ। শুধু রাস্তাটাই যা বিচ্ছিরি।

সাঁতরাবাবুর নতুন বাড়ির পেছনে পুরনো বাড়িটা বেমানান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গেটে জিপ থামলে আবার কুকুরের হাঁকডাক শোনা গেল। রহমত নেমে গিয়ে ডাকছিল, বাবুজি। বাবুজি।

কর্নেল নামার পর আমি নামলাম। দোতলার বারান্দায় গ্রিলের ভেতর আবছা দেখা যাচ্ছিল এক প্রৌঢ়কে। প্রকাণ্ড ভূঁড়ি। গায়ে ফতুয়া এবং পরনে লুঙি। বললেন, কে-এ-এ?

রহমত বলল, সাবলোগ কালকাত্তাসে আয়া বাবুজি। আপকা মুলাকাত মাতা।

একটু পরে তিনি গেটের কাছে এলেন। কর্নেল নমস্কার করে বললেন, আমি কাল সন্ধ্যায় এসেছিলাম। নবকুমার সাঁতরা মশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

আমিই নবকুমার সাঁতরা। ভেতরে আসুন।

অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম বটে, কিন্তু একটা অস্বস্তি ঘুচে গিয়েছিল। এই ভদ্রলোকের লাশ কেল্লাবাড়িতে মাটির তলায় থাকা বরদাস্ত করতে পারছিলাম না। কেন পারছিলাম না কে জানে।

বসার ঘরে সোফা এবং আলমারিতে পুতুল আছে। একটা ডিভান আছে। কিন্তু শিক্ষা-সংস্কৃতির ছাপ নেই। বিত্তবান ব্যবসায়ীদের মতো ঐশ্বর্য প্রদর্শনেরও প্রবণতা চোখে পড়ল না। সোফায় বসে কর্নেল নিজের নেমকার্ড দিলেন। নবকুমার তা পড়ে দেখে কর্নেলকে ফেরত দিলেন। একটু আড়ষ্টভাবে হেসে বললেন, সুনীলের কাছে শুনেছি, বউদি আমার পেছনে সি আই ডি

কর্নেল বাধা দিলেন। না সাঁতরামশাই। আমি পুলিশ নই। এক সময় সামরিক অফিসার ছিলাম। এখন রিটায়ার্ড। আর আলাপ করিয়ে দিই। জয়ন্ত চৌধুরী। কলকাতার প্রখ্যাত দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক।

সাঁতরামশাই আমার দিকে মন দিলেন না। বললেন, কাল রাতে কলকাতা থেকে ফিরেছি। ট্রেন দুঘণ্টা লেট। সুনীল আপনাদের কথা বলল। এদিকে সক্কালবেলা বটো খুন হয়েছে শুনলাম। আমি স্যার কোনও ব্যাপারে নেই। বউদি খামোকা আমাকে ভুল বুঝেছে। তারই হেস্তনেস্ত করতে কলকাতা গিয়েছিলাম। বউদি তার প্রপার্টির শেয়ার বেচবে না। বেচবে পাটোয়ারিজিকে। বড্ড জেদী মেয়ে স্যার।

কর্নেল বললেন, রায়বাবুর সঙ্গে আপনাদের মামলার কি অবস্থা?

মামলা হাইকোর্টে ঝুলে আছে। তবে বউদি রাজি হলেই মিটে যাবে। রায়মশাইয়ের আশি বছর বয়স হয়েছে। ছেলে নেই। একটি মাত্র মেয়ে। সে বরের সঙ্গে আমেরিকায় থাকে। রায়মশাই গঙ্গা-যমুনা আমাদের দিয়ে কেল্লাবাড়ির বাকি অংশ

এক মিনিট। কি বললেন? গঙ্গা-যমুনা?

আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার। কেল্লাবাড়িতে দুটো পুকুর আছে। একটার নাম গঙ্গা, অন্যটার নাম যমুনা। পুকুর দুটো আর ওই অংশের জমি রায়মশাইয়ের দাদা আমাদের বিক্রি করেছিলেন। তারপর উনি সাধু হয়ে চলে গেলেন। তখন রায়মশাই মামলা ঠুকে দিলেন এজমালি সম্পত্তি। দাদা ভাইকে না জানিয়ে বেচতে পারে না। এই হল গিয়ে মামলা।

কর্নেলকে উত্তেজিত মনে হল। চুরুট ধরিয়ে বললেন, গঙ্গা-যমুনা।

আজ্ঞে স্যার। শুনেছি, ওঁর ঠাকুর্দার ঠাকুর্দা নাকি দুটো পুকুর খুঁড়ে একটাতে গঙ্গার জল, অন্যটাতে যমুনার জল এনে ভরেছিলেন। লাখ লাখ জালায় জল ভরে আনা হয়েছিল নাকি প্রয়াগ সঙ্গম থেকে। সত্যিমিথ্যা ভগবান জানেন। শুকনোনা হাসি হাসলেন সাঁতরামশাই। তবে সেকালে রাজা জমিদারদের খেয়াল ওইরকমই ছিল। সত্যি হতেও পারে। শুনেছি, পুকুর দুটোর মধ্যিখানে মাটির তলায় সুড়ঙ্গ আছে। যমুনার জল খরায় কমে গেলে গঙ্গার জল সুড়ঙ্গ দিয়ে যমুনায় ঢোকে। আমি স্যার অত কিছু দেখার সময় পাইনি কখনও। লোকের মুখে যা শুনেছি, তাই বলছি।

আপনারা গঙ্গা-যমুনা কিনেছিলেন কেন?

আসলে দাদার খেয়াল। দাদা মাছ চাষ করার জন্য কিনতে চেয়েছিল। তা দাদার ইচ্ছা আমার ইচ্ছা। বলে সাঁতরামশাই হাঁক দিলেন, বেচু। এঁদের চা-ফা নিয়ে আয়।

কর্নেল বললেন, না সাঁতরামশাই। আমরা চা খাই না। এবার একটা কথা জানতে চাই। বটকৃষ্ণবাবুর সঙ্গে কি আপনি একই ট্রেনে কলকাতা গিয়েছিলেন?

বটোর সঙ্গে? আমি? আমার মাথা খারাপ হয়েছে? বটো ছিল বউদির চর। তার ওপর মিথ্যা করে বউদির নামে আমাকে লাগাতে আসত। আবার আমার নামে বউদির কান ভারী করত। সাঁতরা মশাই খাপ্পা হয়ে উঠেছিলেন। আপনি। জানেন না স্যার। ওই বটোই রায়বাবুকে আমাদের নামে একইভাবে মিথ্যেমিথ্যি কি সব বলে আসত। বরাবর ওর এই স্বভাব ছিল। আমার ছোট ছেলে অনিল পোস্টমাস্টার। ওকে জিজ্ঞেস করলেই

কর্নেল বললেন, করেছি।

ও হ্যাঁ। সুনীল বলছিল বটে। আপনারা আগে অনিলের কাছে গিয়েছিলেন। সাঁতরামশাই কাচুমাচু মুখে হেসে চাপা স্বরে ফের বললেন, দয়া করে একটু খুলে বলুন না সার, কি ব্যাপার? আপনাদের সেবাযত্নের জন্য যতটা করা দরকার, আমি করব।

কর্নেল প্রায় অট্টহাসি হাসলেন। সেবাযত্ন? নাহ্ সাঁতরামশাই। এই যে আপনি সরল মনে কথা বলছেন, এটাই আমার কাছে যথেষ্ট সেবাযত্ন।

এবার সাঁতরামশাইয়ের মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, বটোর কোনও ব্যাপারে আমরা কিছু জানি না স্যার। মা কালীর দিব্যি। বিশ্বাস করুন।

না, না। আমি ও ব্যাপারে আসিনি। আপনি নিশ্চিন্ত হোন। বলে কর্নেল একটু বললেন, আপনার ছোটছেলে অনিলবাবু দুঃখ করে বলছিলেন, বাবা আমাকে মিথ্যেমিথ্যি ভুল বোঝেন।

সাঁতরামশাই নিমেষে আবার খাপ্পা হলেন। মিথ্যেমিথ্যি? ও এবাড়ি ইদানীং যাতায়াত করছে বা কথাবার্তা বলছে বটে, কিন্তু অন্য কোনও বাবা হলে ওকে লাঠিপেটা করত। ত্যজ্যপুত্র করে ছাড়ত। ঘরের শত্রু বিভীষণ।

আমার মনে পড়ল, গতকাল সন্ধ্যায় সুনীলবাবুও এই কথাটা বলেছিলেন ছোটভাই সম্পর্কে। তাই আমিই প্রশ্নটা করে ফেললাম, অনিলবাবু কেন ঘরের শত্রু বিভীষণ সাঁতরামশাই?

কর্নেল দ্রুত বললেন, ওসব পারিবারিক ব্যাপার ওঁদের। সব পরিবারেই এটা থাকে।

সাঁতরামশাই খাপ্পা হয়েই ছিলেন। বললেন, না স্যার। কোনও পরিবারে এমন শত্রু থাকে না। ওর মা বেঁচে থাকলে অ্যাদ্দিন–হুঁ। নেহাত আমি ভালমানুষ বলেই চুপচাপ আছি।

কর্নেল অমায়িক কণ্ঠস্বরে বললেন, ব্যাপারটা খুলে বললে আমি অনিলবাবুকে শায়েস্তা করে দিতে পারি সাঁতরামশাই।

সাঁতরামশাই চাপা স্বরে বললেন, বউদির সন্তানাদি নেই। পুষ্যি নিয়েছেন নরেনবাবুর ছেলে অচিন্ত্যকে। মহা ধড়িবাজ গুণ্ডা। বউদির শখের বেড়াল। কিন্তু বেড়ালের চেয়ে ধূর্ত স্যার। সেই হারামজাদার সঙ্গে অনিলের একসময় গলাগলি ভাব ছিল। বুঝলেন?

বুঝলাম। বলুন।

সেই বদমাসটি ওই গাধা–মানে অনিলকে দিয়ে আমার সিন্দুক থেকে একটা দলিল রেকর্ড-পরচা নকশার ফাইল হাতিয়ে বউদিকে দিয়েছিল। ফার্স্ট সেটলমেন্টের রেকর্ড-নকশা স্যার। সব বাবা আমার জিম্মায় রেখেছিলেন। কারণ আমার দাদা ছিল মনভোলা ধরনের লোক। খামখেয়ালি যাকে বলে।

তারপর?

তারপর আর কি? যেমনই সন্দেহ হল, অনিলকে পৃথগান্ন করে দিলাম। নাও। এবার ঠেলা বোঝ। হারামজাদা এমনই গোঁয়ার, এখনও বলে, বেশ করেছি। কিন্তু কি করব বলুন? নিজের ছেলে। ঘরের শত্রু বিভীষণ হলেও ওর মায়ের মুখ চেয়ে ক্ষমাঘেন্না করে–স্যার। ওকে শায়েস্তা করে দিন তো। আপনার সেবাযত্নের ত্রুটি হবে না।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। আসি সাঁতরামশাই।

সাঁতরামশাই গেট পর্যন্ত বিদায় দিতে এলেন। আবার চাপাস্বরে সেবাযত্নের কথা তুললেন। বুঝলাম, কথাটার মানে ঘুষ। গেটে দাঁড়িয়ে কর্নেল হঠাৎ বললেন, আর একটা কথা সাঁতরামশাই। বটকৃষ্ণবাবু কি কখনও আপনাকে বলেছিলেন কেল্লাবাড়ির গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছেন?

আচমকা এই প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সাঁতরামশাই বললেন, ধড়িবাজ ঠগ। ওইরকম কত মিথ্যা কথা বলত। ওর কথা আমি কানে নিতাম না।

তাহলে উনি বলেছিলেন আপনাকে?

সাঁতরামশাই বললেন, হ্যাঁ। মিথুকের শিরোমণি।

এইসময় এক ভদ্রলোক সাইকেল চালিয়ে আসছিলেন। সাইকেল থামিয়ে উত্তেজিতভাবে বললেন, নবদা। সর্বনেশে কাণ্ড। কেল্লাবাড়িতে পুলিশ আবার একটা ডেডবডি পেয়েছে। মাটির তলায় পোঁতা ছিল। কার বড়ি জানো? তোমার বউদির পুষ্যি সেই অচিত্যের বডি। বাপস্। আমার মাথা বন্ বন্ করে ঘুরছে।

.

 অনিলবাবুর আবির্ভাব

 কেল্লাবাড়ির গড়খাইয়ের সামনে পৌঁছনো পর্যন্ত আমি বিস্ময়ে হতবাক ছিলাম। কর্নেল নির্বিকার মুখে বসে ছিলেন। সবে অ্যাম্বুলেন্সে লাশ ঢোকানো হয়েছিল। কর্নেলকে দেখে একজন পুলিশ অফিসার এগিয়ে এলেন। বললেন, স্থানীয় লোকেরা লাশটা সনাক্ত করেছে, কর্নেল সরকার। এখানে একসময় থাকত সে। অচিন্ত্য দাস নাম। ডাকনাম ছিল বাচ্ছ। গুণ্ডা প্রকৃতির যুবক। পরে সাঁতরা ফ্যামিলির এক মহিলা তাকে পোষ্যপুত্র নিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে সে কলকাতা। চলে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে তার সঙ্গেই এখানে আসত।

জানি। কর্নেল আস্তে বললেন। বডি কি অবস্থায় ছিল–তার মানে, পচন ধরেছিল কি না?

হ্যাঁ, জায়গায় জায়গায় চামড়া খসে গেছে। কালো হয়ে গেছে। আমার ধারণা, অন্তত ৭২ ঘণ্টা আগে খুন হয়েছে। একই পদ্ধতিতে খুন। মাথার পেছনে শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করেছিল খুনি। খুলি ফাঁক হয়ে গেছে।

মিসেস দয়াময়ী সাঁতরাকে খবর দেওয়া দরকার। উনি কলকাতায় আছেন।

সাঁতরাবাড়িতে আমাদের অফিসার গেছেন। এখান থেকে হাঁটাপথে শর্টকাট করা যায়।

কর্নেল পকেট থেকে একটা নোটবই বের করে বললেন, আপনি বরং থানায় গিয়ে এই নম্বরে কলকাতায় ট্রাঙ্কল করুন মিঃ পাণ্ডে। মিসেস সাঁতরাকে আমাদের খুবই দরকার। ট্রাঙ্ককলে খবর পেলেই ছুটে আসবেন।

আপনি কি বড়ি দেখতে চান?

নাহ। তবে মর্গে বডির পোশাক সার্চ করা জরুরি। পরনে কি পোশাক আছে।

প্যান্ট আর গেঞ্জি। পায়ে চপ্পল আছে। আশ্চর্য কর্নেল সরকার, খুনটা ওখানেই করা হয়েছে বলে মনে হল। মানে, যেখানে বডি পোঁতা ছিল, সেখানেই। বুঝতে পারছি না, ওই বিপজ্জনকভাবে ঝুলে থাকা ভাঙা ছাদের তলায় সে কি করছিল?

কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, আমি কেল্লাবাড়িতে যাচ্ছি মিঃ পাণ্ডে। তো ভেতরে পুলিশ ক্যাম্প বসাতে বলেছিলাম–

ক্যাম্প করা হয়েছে। এ এস আই আমেদকে আপনার কথা বলা আছে। আমেদ ক্যাম্পের চার্জে আছে।

ধন্যবাদ। বলে কর্নেল গড়খাইয়ের সেই পাথরের দিকে এগিয়ে গেলেন।

কেল্লাবাড়ির ভেতরে আমাদের দেখে একজন সপ্রতিভ চেহারার তরুণ পুলিশ অফিসার ব্যক্তভাবে এগিয়ে এলেন। নমস্তে কর্নেলসাব। আমি আর আমেদ।

মিঃ আমেদ, কেল্লাবাড়ির চারদিকে আশা করি নজর রেখেছিলেন আপনারা।

অবশ্যই। গতরাত্রে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল, তবু কনস্টেবলরা সতর্ক ছিল। কিছুক্ষণ অন্তর টর্চের আলো ফেলে জানিয়ে দিচ্ছিলাম, আমরা আছি।

মিঃ আমেদ হেসে উঠলেন। ভেঙে পড়া বাড়ির কাছাকাছি বিশাল বটগাছের তলায় দুটো তেরপলের তাঁবু দেখা যাচ্ছিল। তাঁবুর সামনে খাটিয়ায় বসে ছিল বন্দুকধারী কয়েকজন কনস্টেবল। কয়লার উনুনে রান্নার আয়োজনও চোখে পড়ল।

কর্নেল ক্যাম্পের দিকে গেলেন না। ডানদিকের গঙ্গা নামে পুকুরটার পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালেন। ঘন জলজঘাসে ঢাকা পুকুরটার বাকি তিনদিক ঝোপঝাড়ে ঢাকা। আমেদ বললেন, এনিথিং রং স্যার?

নাহ! বলে কর্নেল উল্টো দিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করলেন। বাঁদিকের পুকুরটার পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালেন। এই পুকুরটার নামে শুনেছি যমুনা। এটা একটু নিচুতে। বর্ষায় যমুনাও ভরা এবং ঘন ঘাসে ঢাকা। একটা পানকৌড়ি হঠাৎ উড়ে আমাদের মাথার উপর দিয়ে গঙ্গায় অবতরণ করল। যমুনায় একজোড়া জলপিপি পাখি পি পি করে ডাকতে ডাকতে ঘাসের আড়ালে গা ঢাকা দিল। কর্নেল ঘুরে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমেদ আবার জিজ্ঞেস করলেন, এনিথিং রং স্যার?

 কর্নেল হসেলেন, নাহ। পুকুরদুটোর নাম জানেন কি মিঃ আমেদ?

জানি স্যার। ওটার নাম গঙ্গা, এটার নাম যমুনা। শুনেছি, দুটো পুকুরের মধ্যে নাকি একটা গোপন সুড়ঙ্গ আছে। সত্যমিথ্যা জানি না। আমি এখানে প্রায় একবছর এসেছি। অনেক গল্প শুনি। সবই আজগুবি গল্প।

কর্নেল বাইনাকুলারে কিছু দেখতে থাকলেন। তারপর বললেন, ওদিকে একটা মাউন্ড দেখছি। ওটা কি কোন ধ্বংসাবশেষ?

আমেদ বললেন, স্থানীয় লোকেরা বলে, ওখানে নাকি ভীমের মন্দির ছিল। আমার শোনা কথা স্যার।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, মহাভারতের ভীমের মন্দির নয়, রাজা ভীম রায়ের মন্দির। বাদশা আকবরের আমলের এক সামন্ত রাজা। তার নামেই ভীমগড় নাম। তো ওই ঢিবির পেছনেই কি নদী?

হ্যাঁ স্যার। ছোট্ট পাহাড়ি নদী। তবে প্রচণ্ড স্রোত এখন।

কর্নেল ঘুরে আবার গঙ্গার দিকে তাকালেন। তারপর হঠাৎ গঙ্গার দিকে হাঁটতে থাকলেন। এবার বললাম, ব্যাপারটা কি? গঙ্গা-যমুনা খেলতে শুরু করলেন কেন?

কর্নেল মাঝামাঝি সেই পাথরের ইট বিছানো প্রাচীন পথের ধারে একটা পামগাছের কাছে থমকে দাঁড়ালেন। বললেন, এখানে সম্প্রতি কেউ মাটি খুঁড়েছিল দেখছি। মাটিটা উঁচু। টাটকা ঘাস গজিয়ে আছে। নাহ, খুব বেশি দিন আগে খোঁড়া নয়। মিঃ আমেদ। আপনাদের ক্যাম্পে খোঁড়ার মতো কোনও শাবল বা কিছু আছে?

আমেদ অবাক হয়ে বললেন, স্যার।

আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, এখানেও আর একটা লাশ পোঁতা আছে নাকি?

কর্নেল কোনও উত্তর না দিয়ে পিঠের কিটব্যাগ থেকে সেই খুদে খননযন্ত্রটা বের করলেন। তারপর উঁচু ঘাসগজানো ছোট্ট স্কুপটা খুঁড়তে থাকলেন। আলগা মাটির চাবড়া বৃষ্টিতে নরম হয়ে আছে। সহজেই খোঁড়া যাচ্ছিল। একটু পরে বেরিয়ে পড়ল ভাঙা পাথরের মসৃণ একটা টুকরো। দেড়ফুট লম্বা প্রায় অর্ধচন্দ্রাকৃতি পাথরের টুকরোটা কর্নেল উপড়ে ফেললেন। ফাটলের ভেতর জল দেখা গেল। আমেদ উত্তেজিতভাবে বললেন, আশ্চর্য! তাহলে দেখা যাচ্ছে সত্যি একটা সুড়ঙ্গ আছে?

মিঃ আমেদ। প্লিজ, ওই ঝোপ থেকে একটা লম্বা ডাল ভেঙে আনুন।

আমেদ দ্রুত ডাল ভেঙে আনলেন। কর্নেল ডালটা সুড়ঙ্গে ভরে গভীরতা মেপে বললেন, প্রায় পৌনে এক মিটার গভীর। চওড়া আধ মিটার। কিন্তু এই গর্ত খুঁড়েছিল কে, এটাই প্রশ্ন।

আমেদ হাসলেন। কেউ দেখতে চেয়েছিল সুড়ঙ্গের গুজব সত্যি কি না।

কর্নেল সুড়ঙ্গের জলে তার খুন্তি ধুয়ে কিটব্যাগে ঢোকালেন। তারপর বললেন, চলি মিঃ আমেদ। আমি মিঃ পাণ্ডেকে বলব, আজই যেন ক্যাম্প সরিয়ে নেওয়া হয়। কারণ আর এখানে নজর রাখার দরকার নেই।

বলে উনি হন্তদন্ত গড়খাইয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন।

গড়খাইয়ের ওধারে পুলিশকে ভিড়ের উদ্দেশে ধমক দিতে এবং লাঠি তুলতে দেখছিলাম। অ্যামবুলেন্স চলে গেছে। মিঃ পাণ্ডেকেও দেখলাম না।

জিপে উঠে কর্নেল রহমতকে বললেন, পোস্ট অফিস।

রহমত জিপ চালিয়ে যেতে যেতে বলল, কিছু বুঝতে পারছি না কর্নিল সাব। কেল্লাবাড়ির জমি নিয়ে নাকি মামলা চলছে অনেক বছর ধরে। কিন্তু খুনখারাপি কখনও হয়নি। লোকেরা বলাবলি করছিল, খুনের বদলেই খুন। হয়েছে। এবার আরও খুনোখুনি হবে। সে কণ্ঠস্বর চাপা করল। পাটোয়ারিজি কেল্লাবাড়ি কিনতে চান এই মওকায়। তাই উনি নাক গলিয়েছেন স্যার। পাটোয়ারিজির ভাতিজার হাতে ভীমগড়ের সব গুণ্ডা বাঁধা। শুনলাম, বটবাবুকে খুনের জন্য পাটোরারিজি খাপ্পা হয়ে সাঁতরাবাবুদের আসামী করতে চাইছেন। বটবাবু পাটোয়ারিজির লোক ছিল কি না।

কর্নেল বললেন, আজ যে লাশটা পাওয়া গেল, সে সম্পর্কে স্থানীয় লোকেরা কি বলছে?

অনেকে অনেক কথা বলছে স্যার। এই লোকটাও নাকি একসময় পাটোয়ারিজির ভাতিজার দলের গুণ্ডা ছিল। বাচ্চুবাবু না কি যেন নাম। তো সে দল থেকে ভেগে সাঁতরাবাবুদের দলে ভিড়েছিল।

সাঁতরাবাবুদেরও গুণ্ডাদল আছে নাকি?

আছে বৈকি স্যার। গুণ্ডা না পুষলে আজকাল ব্যবসা চলে?

তা হলে স্থানীয় লোকের মতে খুনখারাপিটা দলাদলির ব্যাপার?

 জি স্যার। সাঁতরাবাবুদের অত্যাচারেই জমিদারবাবু কলকাতা চলে গিয়েছিলেন। জমিদারবাবু পাটোয়ারিজির দোস্ত ছিলেন।

লোকেরা বলছে?

 জি স্যার।

পোস্ট অফিসের সামনে রহমত জিপ থামাল। কর্নেল ধীরেসুস্থে নামলেন। বললেন, জয়ন্ত। তুমি বসে থাকো। আমি এখনই আসছি।

কৌতূহল চেপে বসে থাকতে বাধ্য হলাম। কর্নেল পোস্ট অফিসে ঢুকলেন এবং তারপরই বেরিয়ে এলেন। জিপে চেপে বললেন, অচিন্ত্যর লাশের খবর পেয়েই অনিলবাবু ছুটে গেছেন। এখনও ফেরেননি। দুজনের মধ্যে একসময় খুব বন্ধুত্ব ছিল। কাজেই এটা স্বাভাবিক। রহমত। আমরা বাংলায় ফিরব।

রহমত আমাদের ফরেস্ট বাংলোয় পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। কর্নেল তাকে চারটে নাগাদ জিপ নিয়ে আসতে বলেছেন।

স্নানাহারের পর কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে মিটিমিটি হেসে বললেন, তুমি এমন ভাবাচ্যাকা খেয়ে গেছ যে কোন প্রশ্ন তোমার মাথায় আসছে না। যাকে বলে হাল ছেড়ে দেওয়া।

ঠিক বলেছেন বস্। বড্ড গোলমেলে ব্যাপার।

খেই পাওয়া গেলে সব জটই ছাড়ানো যায়। কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন। খেইটা ধরিয়ে দিয়েছেন সাঁতরামশাই।

বলেন কি!

 হ্যাঁ। গঙ্গা এবং যমুনা। মধ্যিখানে সুড়ঙ্গ।

ওটাই কি সেই খেই?

কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, উডল্যান্ড সায়েবের লেখা দা লেটার গুপ্টা আর্কিটেকচার বইটা আমাকে গণ্ডগোলে ফেলে দিয়েছিল। গুপ্তযুগের শেষভাগে মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীতে তিনটে প্রতীক ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বস্তিকা, মকর এবং কচ্ছপ। মকর হল গঙ্গার বাহন এবং কচ্ছপ যমুনার বাহন কাজেই মকর গঙ্গার এবং কচ্ছপ যমুনার প্রতীক।

চমকে উঠলাম। কর্নেল। ওই শব্দছকে–

আমাকে থামিয়ে বৃদ্ধ রহস্যভেদী বলনেল, স্বস্তিকা আছে। তার তলায় মকর, কচ্ছপ এবং রপট আছে। রপট মানে প্রবাহ। কাজেই আমি ধাঁধায় পড়েছিলাম। গুপ্তযুগের কোনও মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের কথা ভেবেছিলাম এবং প্রবাহ বলতে ওই নদীটাকে বুঝেছিলাম। নদীর তীরে একটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের স্তূপও আছে। কিন্তু ওটা রাজা ভীম রায়ের তৈরি মন্দির। জেলা গেজেটিয়ারে মন্দিরটার যে বর্ণনা আছে, তা মিশ্র স্থাপত্যের। গুপ্তযুগের মন্দিরের মতো স্তম্ভ ছিল না। যাই হোক, সাঁতরামশাই গঙ্গা-যমুনা নামে দুটো পুকুর এবং মধ্যিখানে সুড়ঙ্গের কথা বলা মাত্র শব্দছকের জট খুলে গেল। রপট অর্থাৎ প্রবাহ বলতে এই সংযোগ সুড়ঙ্গই বোঝাচ্ছে। কারণ গ্রীষ্মে যমুনা পুকুরের জল কমে গেলে উঁচু জমিতে গঙ্গা পুকুরের জল সুড়ঙ্গ বেয়ে এসে যমুনাকে ভরিয়ে দেয়।

বললাম, সুড়ঙ্গ তো দেখলাম। কিন্তু ওটা খুঁড়ল কে? কেনই বা খুঁড়ল?

 বুঝতে চেষ্টা করো জয়ন্ত। কেদারনাথ থেকে সংসারত্যাগী প্রশান্তবাবু একটা শব্দছক ভাইকে পাঠিয়েছিলেন। রায় বংশের পবিত্র দেবসম্পদ কোথায় আছে, তার সূত্র ওই শব্দছক।

দেব সম্পদ কি?

নাগমিথুন। যার প্রতীক স্বস্তিকা চিহ্ন। বোঝা যাচ্ছে, দামী রত্ন দিয়ে তৈরি ওই নাগমিথুন রপটে–তার মানে প্রবাহপথে লুকোনো ছিল। সুড়ঙ্গের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় ওটা ছিল। নাগমিথুন অর্থাৎ স্বস্তিকা সুড়ঙ্গপথে জলপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি করত না। আবার জলের স্পর্শে তার কোনও রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটারও সম্ভাবনা ছিল না। সুড়ঙ্গের গভীরতা পৌনে এক মিটার মতো। সেই ভাঙা মসৃণ পাথরের তলায় চাপ দিয়ে স্বস্তিকা বসানো ছিল। চোর তার সন্ধান পেয়ে খুঁড়ে বের করেছিল। আমার অনুমান, এই প্রকাণ্ড স্বস্তিকা যদি সোনার হয়, তবে তার ওজন কমপক্ষে দু কিলোগ্রাম তো বটেই। কর্নেল চুপ করে গেলেন। কিছুক্ষণ চোখ বুজে দাড়িতে হাত বোলানোর পর ফের বললেন, স্বস্তিকায় গঙ্গা পুকুরের ঘাস ভেসে এসে আটকে যাওয়া সম্ভব কিন্তু তাতে রপটের গতি তত কিছু ব্যাহত হওয়ার কথা নয়। কারণ দুটো পুকুরের জলের যে স্তর দেখেছি, তাতে বুঝেছি গঙ্গাপুকুরের জলের স্তর যমুনাপুকুরের জলের স্তর থেকে প্রায় তিন মিটার উঁচু। রপট তীব্রই হত।

অচিন্ত্যবাবু বলেই থেমে গেলেন।

কর্নেল চোখ খুলে আমার দিকে তাকালেন। দয়াময়ী দেবী আমাকে বলেছেন, ওই খামটার কথা তাকে জানাননি। এদিকে দেখা যাচ্ছে, বটকৃষ্ণবাবু খামের ভেতরকার শব্দছকের কথা জানতেন। কিন্তু তিনি ধাঁধার অর্থভেদ করতে পারলে পাটোয়ারিজিকেই স্বস্তিকা বেচে দিয়ে চলে যেতেন ভীমগড় থেকে। আমি নিশ্চিত, তেনি গুপ্তধন আঁচ করছিলেন। কিন্তু সেই গুপ্তধন কি এবং কোথায় লুকানো আছে বুঝতে পারেননি।

কর্নেল, অচিন্ত্যবাবু জমিদার রায়বাবুদের কর্মচারীর ছেলে। তাঁর পক্ষে কেল্লাবাড়িতে লুকিয়ে রাখা স্বস্তিকার কথা জানা কি সম্ভব ছিল না?

ছিল। কিন্তু কোথায় ছিল, তা জানতে পারলে কবে তা হাতিয়ে নিত।

তাহলে খুব সম্প্রতি কেউ স্বস্তিকার সন্ধান পেয়ে ওটা হাতিয়েছে।

ঠিক বলেছ। কর্নেল হঠাৎ সোজা হয়ে বসলেন। সাইকেলে চেপে অনিলবাবু আসছেন। হ্যাঁ, আমি জানতাম উনি আসবেন। আসতেই হবে। এই আবির্ভাব অনিবার্য ছিল।

খোলা জানালা দিয়ে গেটের কাছে পোস্টমাস্টার অনিলবাবুকে সাইকেল। থেকে নামতে দেখলাম। কিন্তু বুঝলাম না, কেন ওঁর এই আগমনকে কর্নেল আবির্ভাব বলছেন।

.

অভিধান রহস্য

 কর্নেলের সঙ্গে বারান্দায় বেরিয়েছিলাম। অনিলবাবুর চেহারা ঝোড়ো কাকের মতো। পোর্টিকোর তলায় সাইকেল রেখে নমস্কার করে বললেন, শচীন বলল আমার খোঁজে গিয়েছিলেন।

বারান্দার বেতের চেয়ারে আমরা বসলাম। কর্নেল বললেন, বসুন অনিলবাবু।

অনিলবাবু আড়ষ্টভাবে বসলেন। ধরা গলায় বললেন, বাচ্চু–অচিন্ত্য আমার বাল্যবন্ধু ছিল। জেঠিমার সঙ্গে মন কষাকষি থাকলেও আমাদের বন্ধুত্ব বজায় ছিল। আমি বুঝতে পারছি না, কবে সে কলকাতা থেকে একা এল, কি করেই বা খুন হয়ে গেল? কে তাকে মারল? কেনই বা মারল? অবশ্য বাচ্চু একটু আধটু মস্তানি করে বেড়াত, তা ঠিক। কিন্তু

অনিলবাবু ফোঁস ফোঁস করে নাক ঝেড়ে কান্না দমন করলেন। রুমালে চোখ মুছলেন। কর্নেল বললেন, আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। আপনি মর্গে আপনার বন্ধুর ডেডবডি দেখতে গেছেন শুনে পোস্টঅফিস থেকে চলে এলাম। আমার শুধু দু-একটা কথা আপনার কাছে জিজ্ঞাস্য ছিল।

বলুন স্যার।

আপনার সন্তানাদি আছে?

আছে স্যার। এক ছেলে, দুই মেয়ে। আনিলবাবু অবাক হলেন। কেন এ কথা জিজ্ঞস করছেন?

তাদের মধ্যে কার বয়স কত?

অনিলবাবু হকচকিয়ে গেলেন, তা স্পষ্ট। বললেন, মেয়ে দুটির বয়স ৭ বছর ৫ বছর। ছেলের বয়স দেড় বছর। কিন্তু

আপনার স্ত্রীর পড়াশোনা কতদূর?

 মাধ্যমিক। কিন্তু এসব কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন স্যার?

 আপনার স্ত্রী কি প্রাইভেটে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন?

অনিলবাবুর মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল। ছেলেমেয়ে ঘরকন্না সামলাবে, না লেখাপড়া করবে? ছাপোষা গেরস্থ ফ্যামিলি। বাবা বড়লোক আছেন, আছেন। আমি স্যার বাবার হেল্প নেব না বলেই পৃথগন্ন হয়েছি।

বাহ। আপনি পৃথগন্ন বললেন। শুদ্ধ বাংলা। আপনার বাবা পৃথগান্ন বলছিলেন। বুঝতে পারছি আপনি বাংলা ভাষা নিয়ে চর্চা করেন। পৃথক এবং অন্ন সন্ধি করলে পৃথগন্ন হয়। আজকাল যা অবস্থা হয়েছে, শিক্ষিত বাঙালি শুদ্ধ বাংলা বলতে পারেন না। কিছু মনে করবেন না। আপনি কতদূর পড়াশোনা করছেন?

অনিলবাবু গলার ভেতর বললেন, আমি গ্রাজুয়েট।

আর্টস না কমার্স?

কমার্স।

কর্নেল মুখে প্রশংসা ফুটিয়ে বললেন, বাহ্। কমার্সের ছাত্র হয়েও আপনি। শুদ্ধ বাংলা বলতে পারেন। তার মানে, আপনি বাংলা ভাষার রীতিমতো চর্চা করেন। কাল আমার অবাক লেগেছিল, সরকার ডাকঘরে অভিধান সাপ্লাই করেন না। অথচ আপনার টেবিলে বৃহৎ বঙ্গীয় অভিধান। একেবারে নতুন সংস্করণের অভিধান। আজকাল বইয়ের যা দাম। নিশ্চয় অভিধানটা কিনতে একশো টাকার বেশি খরচ হয়েছে। বাংলার বাইরে বাংলা ভাষার চর্চা যারা করেন, তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা হয়।

অনিলবাবু নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ছিলেন। আমার মনে হচ্ছিল, উনি কর্নেলের কথার লক্ষ্য খুঁজছেন। ঢোক গিলে গম্ভীর মুখে বললেন, আমাদের একটা লাইব্রেরি আছে, বান্ধব পাঠাগার। তার একজিকিউটিভ কমিটির মেম্বার আমি। লাস্ট মিটিং-এ ঠিক হয়েছে, প্রত্যেককে অন্তত দুশো টাকা দামের বই কিনে দিতে হবে। লিস্ট করে দেওয়াও হয়েছে কাকে কি কি বই কিনে দিতে হবে। আমার একটা অভিধান কিনে দেওয়ার কথা। তাই ওটা কলকাতা থেকে ভি পি করেই আনিয়েছি। দিতে যাওয়ার সময় পাইনি।

কর্নেল হাসলেন। তাই বুঝি? বাহ। চমৎকার সিদ্ধান্ত। আপনাদের লাইব্রেরিটা দেখতে যাব। কিছু ডোনেশনও দেব বই কেনার জন্য।

য়ু আর ওয়েলকাম স্যার। বলে অনিলবাবু উঠে দাঁড়ালেন। নমস্কার করে তেমনই গম্ভীর মুখে নেমে গেলেন বারান্দা থেকে। তারপর সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে লন পেরিয়ে গেট খুলে বেরুলেন। উত্রাইয়ের পথে জোরে সাইকেলে চেপে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এই ভঙ্গিতে খাপ্পা মানুষের লক্ষণ প্রকট ছিল।

বললাম, ভদ্রলোকের সঙ্গে রসিকতা করার অর্থ কি?

আভিধানিক অর্থ নিষ্কাশন। কর্নেল ঘড়ি দেখলেন। তুমি কিছুক্ষণ গড়িয়ে নিতে পারো। মাত্র ৪৫ মিনিট। কারণ সওয়া তিনটে বাজে।

মিনিট পনের বিছানায় লম্বা হয়েছিলাম, আরামপ্রিয় বাঙালির চিরাচরিত ভাতঘুমের অভ্যাস। হঠাৎ বাইরে জিপের শব্দে ঘুমের রেশ ছিঁড়ে গেল। কর্নেল বারান্দায় ছিলেন। সম্ভাষণ করলেন, আসুন মিঃ পাণ্ডে।

সেই পুলিশ অফিসার পাণ্ডে। কান পাতলাম। পাণ্ডের পুলিশি জুতোর বিচ্ছিরি শব্দ কানে এল। বেতের চেয়ারটা মচমচ করে উঠল। যেন ধপাস করে বসলেন। চাপা স্বরে বললেন, বডির প্যান্টের হিপ পকেটে একটা ছোট্ট মানিব্যাগ পাওয়া গেছে। কিছু টাকাকড়ি আর দুটো ভাজকরা ইনল্যান্ড লেটার আছে। একটা সুন্দর সিং পাটোয়ারিজির পক্ষ থেকে ম্যানেজার রাকেশ শর্মার লেখা ইংরেজিতে টাইপ করা চিঠি। অন্যটা বটকৃষ্ণ গুইয়ের লেখা। এই দেখুন।

একটু পরে কর্নেল বললেন, হু। দুটো চিঠিতেই অচিন্ত্যকে ডেকে পাঠানো হয়েছে দেখছি।

বটকৃষ্ণবাবুর চিঠিটা ১ জুলাই লেখা। রাকেশ শর্মারটা ৮ জুলাই।

 আজ ১৮ জুলাই।

 কলকাতার এন্টালি পোস্ট অফিসের ডেটস্ট্যাম্প দেখুন। বটকৃষ্ণের চিঠি পৌঁছেছে ১৪ জুলাই। কিন্তু রাকেশ শর্মারটা পৌঁছেছে ১৩ জুলাই। লোকাল পোস্ট অফিসের ডেটস্ট্যাম্প পড়া যাচ্ছে না। অস্পষ্ট। আসলে টিকিটের ওপর ছাপ পড়লে তারিখ পড়া যায় না।

মিঃ পাণ্ডে। দুটো ইনল্যান্ডেই প্রেরকের নাম-ঠিকানা নেই দেখছি। যাই হোক, রাকেশ শর্মাকে জিজ্ঞেস করেছেন আশা করি?

অবশ্যই। অচিন্ত্যকে নাকি পাটোয়ারিজি তার কলকাতা অফিসে চাকরি দিতে চেয়েছিলেন। চিঠিটা আ সর্ট অব ইন্টারভিউ। তবে ইন্টারেস্টিং ঘটনা হল, আমাদের একজন ইনফরমার বলেছে, ১৪ জুলাই বিকেলে রাকেশের বাড়িতে বাচ্চু–মানে অচিন্ত্যকে দেখেছিল। রাকেশ অস্বীকার করছে। অথচ সেদিনই সন্ধ্যার একটু আগে কেল্লাবাড়ির উত্তর-পূর্ব কোণে নদীর ধারে ঢিবির ওপর রাকেশ এবং বাচ্চু বসে ছিল। মর্গের ডোম কানহাইয়ার বউ দেখেছে। সে জৈব প্রয়োজনে নদীর ধারে গিয়েছিল। এই দুটো মার্ডার কেসের তদন্তকারী অফিসার আই ও মিঃ রামলাল সিংহ ঢিবিতে একটা গাছের তলায় পাথরের স্ল্যাবের নিচে অনেকগুলো সিগারেটের ফিল্টারটিপস আবিষ্কার করেছেন। রাকেশ চেইন স্মোকার। কাজেই তাকে আমরা গ্রেফতার করেছি। তবে এখনই প্রচণ্ড প্রেসার আসছে। সুন্দরজি প্রভাবশালী লোক।

শাবলটা কার খোঁজ নিয়েছেন?

পাণ্ডের হাসি শোনা গেল। প্রব্লেম আছে। খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার ব্যাপার। কেউ কি স্বীকার করতে চাইবে শাবলটা তার?

মিঃ পাণ্ডে। কেল্লাবাড়ি থেকে পুলিশ ক্যাম্প তুলে নিন।

 ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের বিশেষ করে আমার কাছে এই খুনোখুনির মোটিভ এখনও অস্পষ্ট। আপনি কি অনুগ্রহ করে আপনার হাতের তাস দেখাবেন? দেখালে পুলিশের পক্ষে এগোনো সহজ হবে।

দেখাব মিঃ পাণ্ডে। মিসেস দয়াময়ী সাঁতরা এসে পৌঁছালেই দেখতে পাবেন।

 উনি রাত দশটার আগে পৌঁছতে পারবেন না।

 হ্যাঁ, ওঁকে ট্রাঙ্ককলে কি অচিন্ত্যের মৃত্যু সংবাদ জানিয়েছেন?

 অবশ্যই। আমিই কথা বলেছি।

 ওঁর রি-অ্যাকশান কেমন বুঝলেন?

খুব একটা বিচলিত মনে হয়নি। সম্ভবত স্ট্রং নার্ভের মহিলা। শোনা মাত্র বললেন, তাই নাকি? ঠিক আছে আমি যাচ্ছি। তারপর ফোন ছেড়ে দিলেন।

 এখনই গিয়ে কেল্লাবাড়ি থেকে পুলিশক্যাম্প সরিয়ে নিন মিঃ পাণ্ডে।

মিঃ পাণ্ডে কর্নেলকে নমস্তে বলে চলে গেলেন। ওঁর জিপের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার পর আমি বারান্দায় গেলাম। বললাম, ভাতঘুম বরবাদ। তাতে দুঃখ নেই। কিন্তু আপনাদের কথাবার্তা শুনে একটা ব্যাপার মাথায় এল। বটকৃষ্ণবাবু অচিত্যের সাড়া না পেয়ে তাকে ডেকে আনতেই কলকাতা গিয়েছিলেন।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললে, রহমতের আসার সময় হয়ে এল। কফি খেয়ে নিই। কৃপানাথ।

কৃপানাথ তার ঘর থেকে সাড়া দিল। আসছি স্যার।

কফি নিয়ে এস। একটু পরে কফি দিয়ে গেল কৃপানাথ। কফি খেতে খেতে বললাম, আপনি আমার কথাটাকে পাত্তা দিলেন না।

কর্নেল আস্তে বললেন, দয়াময়ীকে আসতে দাও।

রহমতের জিপ এসে গেল ঠিক চারটেয়। কর্নেল তাকে সাঁতরাবাবুদের বাড়ি নিয়ে যেতে বললেন। বিরক্ত হলাম। বললাম, আবার সেই সাঁতরাবাড়ি। খুনি তো ধরা পড়ে গেছে। মোটিভও স্পষ্ট। অচিন্ত্য সোনার স্বস্তিকার খোঁজ পেয়েছিল, যেভাবেই থোক। তাই নিয়ে

কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, বান্ধব পাঠাগারে যাব, ডার্লিং। বাংলার বাইরে বাঙালির বাংলা চর্চার এই চেষ্টাটা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।

বান্ধব পাঠাগারের সামনে জিপ দাঁড় করাতে বললেন কর্নেল। একতলা এই বাড়িটা আগেই দেখেছিলাম। এখন দরজা খোলা। আমাদের দেখে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। আপনিই কি কর্নেলসায়েব? আসুন, আসুন। কিছুক্ষণ আগে অনিল আপনার কথা বলে গেল। হা–আমার পরিচয় দিই। ইন্দুমাধব গাঙ্গুলি। সেক্রেটারি। উনি বিষণ্ণ হাসলেন। এই দেখুন না, একা বসে মাছি তাড়াচ্ছি। আজকাল লোকে বই পড়তে চায় না। খবরের কাগজ আর টিভির দিকে ঝোঁক। কয়েকটা কাগজ রাখি। একটা টিভি কেনার চেষ্টা চলেছে। তাকিয়ে দেখুন, কত বই। মূল্যবান সব কালেকশন। সব পোকায় কাটছে। জমিদার রায়বাবুদের দান করা জমি এবং তাঁদেরই তৈরি এই লাইব্রেরি। ওঁরা চলে যাওয়ার পর আমরা কজন বান্ধুবান্ধব মিলে অনেক চেষ্টায় নবজীবন দিয়েছিলাম। আপনারা বসুন স্যার। মেম্বাররা সন্ধ্যার আগেই এসে পড়বে।

কর্নেল বসলেন না। বললেন, বৃহৎ বঙ্গীয় অভিধান দেখছি আপনার টেবিলে।

হ্যাঁ। অনিল দিয়ে গেল। লাস্ট মিটিং-এ আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

অনিলবাবু বলছিলেন। তো, আমাকেও একটা লিস্ট দিতে পারেন। কলকাতা থেকে কিনে পাঠিয়ে দেব। বাংলার বাইরে বাঙালির নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি চর্চা,আমার ভাল লাগে। একসময় অনেক বিখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিককে বাংলার বাইরে থেকেই আমরা পেয়েছি। এমনকি কত উঁচুদরের বাংলা পত্রিকা বেরুত।

ইন্দুবাবু আবেগে চঞ্চল হয়ে বললেন, আপনার আমার জেনারেশনের লোকেরা এর খবর রাখি। আজকালকার ছেলেরা শুধু হুল্লোড়বাজি বোঝে। খেলা বলতে ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস। একসময় এই লাইব্রেরির পৃষ্ঠপোষকতায় পুজোপার্বণ, খেলাধুলা, আবার ধরুন শরীরচর্চা–সব কিছুই হত। এখন কথা তুললে বলে জুডো ক্যারাটে যৌগিক ব্যায়ামের কথা। তো তা-ও গজিয়ে উঠেছে। চলুন স্যার, আপনাদের এরিয়াটা দেখাই। প্রায় পনের কাঠা জমি। পেছনে জঙ্গল হয়ে পড়ে আছে।

পেছনে অনেকটা জায়গা পাঁচিল ঘেরা। সত্যিই জঙ্গল হয়ে আছে। পেছনকার বারান্দার কোনায় থিয়েটারের স্টেজের সরঞ্জাম দেখলাম। অবহেলায় পড়ে আছে আবর্জনার মতো। কর্নেল বললেন, মুগুর ডাম্বেলও আছে দেখছি।

হ্যাঁ স্যার। ব্যায়ামাগারও ছিল। ওই দেখুন আয়রন বারের অবস্থা। রায়মশাইদের আমলে কুস্তিচর্চাও হত।

বাঁশ আর কাঠের খুঁটি দেখছি।

থিয়েটারের স্টেজ কিংবা ফাংশান-টাংশানের জন্য রাখা হয়েছে। প্যান্ডেলের সব সরঞ্জাম আছে।

আজ নাকি ভীমগড়ে খুনোখুনি হয়েছে শুনলাম।

কর্নেলের আকস্মিক প্রশ্নে ইন্দুবাবুর উত্তেজনা বেড়ে গেল। হ্যাঁ। এখনকার কালচার করতে পারেন–এই খুনোখুনি আর দাঙ্গা হাঙ্গামা। রাজনীতি দেশটাকে উচ্ছন্নে পাঠাচ্ছে।

শুনলাম দুজন বাঙালি খুন হয়েছে?

ইন্দুবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, বাজে চরিত্রের লোক। একজন গুণ্ডামি করে বেড়াত। আর একজন ছিল নাম্বার ওয়ান চিট। জেলখাটা দাগী আসামি।

কি নাম যেন?

বটোকেষ্ট। ওর কথা আর বলবেন না স্যার।

অন্যজন

 বাচ্চু। ওর বাবা নরেনবাবু কিন্তু সজ্জন মানুষ ছিল। এই লাইব্রেরির পৃষ্ঠপোষক ছিল।

বাচ্চুবাবু নাকি অনিলবাবুর বন্ধু ছিলেন?

হ্যাঁ। অনিলের সঙ্গে আসত-টাসত। আমি ওকে পছন্দ করতাম না স্যার। তবে সাঁতরাবাড়ির বড়বাবুর স্ত্রী ওকে পোষ্যপুত্র নিয়েছিলেন। তিনিও এক দজ্জাল মহিলা স্যার। এখন কলকাতায় থাকেন। মাঝে মাঝে আসেন।

বাচ্চুবাবু গুণ্ডামি করে বেড়াতেন জেনেও তাকে পোষ্যপুত্র নিয়েছিলেন ভদ্রমহিলা?

ইন্দুবাবু চাপা স্বরে বললেন, ওঁর দেওর–মানে অনিলের বাবার অত্যাচারে। বাচ্চু না থাকলে অনিলের বাবা নব তার বউদিকে প্রপার্টির ন্যায্য শেয়ার দিত। না। পথে বসিয়ে ছাড়ত। নব স্যার হাড়ে হাড়ে বজ্জাত। টাকা ওর ধ্যানজ্ঞান। কিন্তু অনিল ওঁর ছেলে হয়েও উল্টো স্বভাবের। আবার দেখুন অনিলের দাদা সুনীল একেবারে বাবার মতো স্বভাব। অনিলকে বঞ্চিত করার তালে আছে। নব। মারা পড়লেই দুভাইয়ে ঝামেলা বাধবে। তবে অনিলকে জব্দ করা কঠিন আছে।

কেন?

অনিল বাইরে বাইরে ভদ্র। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ফেরোসাস টাইপ। বলেই ইন্দুবাবু প্রসঙ্গ বদলালেন। চলুন স্যার। লাইব্রেরির কালেকশান দেখাই।

কর্নেল পকেট থেকে নেমকার্ড বের করে ওঁকে দিয়ে বললেন, আমি চলি ইন্দুবাবু। এই ঠিকানায় বইয়ের লিস্ট পাঠাবেন। আমরা পক্ষে যতটা সম্ভব, তা কিনে পাঠিয়ে দেব। চলি। নমস্কার।

কর্নেল পা বাড়িয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। তারপর দাড়ি খামচে ধরে কি যেন ভাবলেন। ইন্দুবাবু নেমকার্ডটা খুঁটিয়ে পড়ছিলেন! কর্নেল ব্যস্তভাবে লাইব্রেরিতে ঢুকে টেবিলের ওপর রাখা সেই অভিধানটা তুলে নিলেন। তারপর শেষ দিককার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে কি একটা চিরকুট হাত সাফাই করলেন। ইন্দুবাবু আমার পিছনে। তাই ব্যাপারটা আমার চোখে পড়ল।

ইন্দুবাবু বললে, খুব ভাল ডিকশনারি স্যার।

কর্নেল টেবিলে বইটা রেখে বললেন, বৃহৎ বঙ্গীয় শব্দাভিধান। আমি ভেবেছিলাম নিছক অভিধান। উনিশ শতকের পণ্ডিত রামবিনোদ ভট্টাচার্যের এই শব্দাভিধান এতদিন আউট অব প্রিন্ট ছিল। প্রকাশককে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।

বলেই উনি ব্যস্তভাবে বেরিয়ে এলেন। জিপে আমাকে উঠতে ইশারা করলেন। তারপর উনি উঠে বললেন, রহমত। ফরেস্ট বাংলোয় ফিরব। আজ আর তোমাকে কষ্ট দেব না। কাল সকাল নটায় তুমি জিপ নিয়ে এসো যেন।

বাংলোয় আমাদের পৌঁছে দিয়ে রহমত চলে গেল। কর্নেল কৃপানাথকে কফি আনতে বলে বারান্দায় বসলেন। জিজ্ঞেস করলাম, অভিধান খুলে আপনার হাতসাফাই দেখে নিয়েছি।

কর্নেল পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে দিলেন। দেখলাম, কলকাতার এক নামী পুস্তক বিক্রেতার দোকানের ক্যাশমেমো। তারিখে ১৩ জুলাই। মেমোতে ক্রেতার নাম নেই। ১০ শতাংশ কমিশন বাদ দিয়ে ১৮০ টাকা দাম নেওয়া হয়েছে।

কর্নেল বললেন, কি বুঝলে বলো জয়ন্ত?

বইটা ভি পি পি-তে আসেনি। অনিলবাবু মিথ্যা বললেন কেন?

 মেমোটা যে পাতায় ছিল, সেই পাতায় রপট শব্দটা আছে। পাশে টিক দেওয়া।

তা হলে শব্দছকটা

হ্যাঁ। অনিলবাবু জানতেন। জানার কারণ ছিল প্রসন্ন রায়ের নামে ডাকে আসা চিঠি। প্রসন্নবাবু তখন কলকাতাবাসী। এদিকে তখন পোস্টম্যান ছিলেন। বটকৃষ্ণবাবু। তিনি পোস্ট মাস্টারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকবেন। আমার যুক্তিসঙ্গত অনুমান, চিঠিটা কৌতূহলী হয়ে খুলেছিলেন অনিলবাবুই। তারপর বটকৃষ্ণবাবুকে কলকাতায় প্রসন্নবাবুর ঠিকানায় রিডাইরেক্ট করতে বলেন। ঠিকানার ওপর লাল ডটপেনে কাটা দাগ আছে। দেখাচ্ছি। বটকৃষ্ণবাবু রিডাইরেক্ট না করে দয়াময়ী দেবীর লেটারবক্সে রেখে আসেন। বটকৃষ্ণবাবুর মাথায় রহস্য তৈরির বাতিক ছিল, তা আমরা জেনেছি। কর্নেল হাসলেন। ভদ্রলোক পেটের দায়ে লোককে হয়তো চিট করতেন। কিন্তু ওঁর রহস্যবাতিক চাগিয়ে তুলেছিল সত্যসেবক পত্রিকায় লেখা তোমারই রঙ চড়ানো ক্রাইমস্টোরি। তোমার কলম বড্ড বেয়াড়া।

বিব্রতভাবে বললাম, ভ্যাট। কি যে বলেন।

.

তৃতীয় চিঠি

 রাতের খাওয়ার পর বারান্দায় বসেছিলাম। কর্নেল পাহাড়ি অর্কিড নিয়ে বকবক করছিলেন। আমি বৃষ্টির আশা করছিলাম। রাতের বৃষ্টির সৌন্দর্য এমন করে কখনও বুঝিনি। কিন্তু আকাশে মেঘ নেই। নক্ষত্রমালায় এ রাত আজ অন্য সাজে সেজেছে।

শুয়ে পড়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু কর্নেল বললেন, আর একটু বসো জয়ন্ত। আশা করছি, আজ রাতেই রহস্যের শেষটুকু ফাঁস হয়ে যাবে।

অগত্যা বসতে হল। বললাম, ফাস হতে আর বাকি কি আছে? খুনি রাকেশ শর্মা, সেটা তো স্পষ্ট। অচিন্ত্য যেভাবে হোক, শব্দছকের ধাঁধা ছাড়িয়ে স্বস্তিকা উদ্ধার করেছিল। তাকে মেরে স্বস্তিকা হাতিয়ে রাকেশ তার লাশ পুঁতে রেখেছিল। অতি উৎসাহী বটকৃষ্ণবাবু কলকাতা থেকে আমাদের সঙ্গে ফিরে কেল্লাবাড়িতে গিয়ে নিশ্চয় লাশ পুঁতে রাখার চিহ্ন দেখেছিলেন। তাই ভোরবেলা লাশ খুঁড়ে বের করতে।

ওই দেখ। সম্ভবত মিঃ পাণ্ডের জিপ আসছে।

উত্রাই পথের নিচে আলোর ঝলক দেখতে পেলাম। জিপ গেটের কাছে। এসে হর্ন দিলে কৃপানাথ দৌড়ে গিয়ে তালা খুলে গেট ফাঁক করল। জিপটা এসে পোর্টিকোর তলায় থামল।

মিঃ পাণ্ডে এবং এক প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা নেমে এলেন জিপ থেকে। কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে সম্ভাষণ করলেন, আসুন মিসেস সাঁতরা।

ইনিই তা হলে দয়াময়ী সাঁতরা। উজ্জ্বল গৌরবর্ণা ব্যক্তিত্ববতী মহিলা। মুখে মানসিক শক্তির ছাপ স্পষ্ট। পরনে সাদা থান। কাঁধে একটা কিটব্যাগ ঝুলছে। সেটা টেবিলে রেখে শান্তভাবে বসলেন। মিঃ পাণ্ডে বললেন, সোজা স্টেশন থেকে এখানে আসছি। উনি বললেন, আগে আপনার সাথে দেখা করতে চান।

দয়াময়ী বললেন, আপনাকে আগে বলা উচিত, বাচ্চুর মৃত্যুতে আমি দুঃখিত হইনি। দুধ দিয়ে কালসাপ পুষেছিলাম। ও আমার জীবনে কাটার মতো বিধত। এবার আমি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি।

কর্নেল বললেন, আপনি আমাকে ওর সম্পর্কে কিছু জানাননি।

ইচ্ছে করেই জানাইনি। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে ওই খামটা সম্পর্কে আমার কৌতূহল ছিল তাই ভেবেছিলাম, আপনিই এই অদ্ভুত ধাঁধার জট ছাড়াতে পারবেন।

ছাড়িয়েছি। কিন্তু আগে প্রশ্নের উত্তর দিন। বাচ্চু কবে কলকাতা থেকে এখানে এসেছিল?

দয়াময়ী একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, ও মাঝে মাঝে কিছু না জানিয়ে উধাও হয়ে যেত। গত ১৩ জুলাই দুপুরে খেয়ে বেরিয়ে যায়। তারপর আর পাত্তা পাইনি। হঠাৎ আজ এখান থেকে পুলিশ ট্রাঙ্ককল করে জানাল–

আপনার দেবর নবকুমারবাবু আপনার কাছে গিয়েছিলেন?

 হ্যাঁ। রায়বাবুর সঙ্গে মামলা মিটমাটের জন্য বলছিল। আমি বলেছি, ভেবে দেখি।

বটকৃষ্ণবাবু কি আপনার কাছে গিয়েছিলেন?

 হ্যাঁ। বটো প্রায় যেত। বাচ্চুর সঙ্গে ওর ভাব ছিল। আমি বটোকে পাত্তা দিতাম না। বটোর দুমুখো স্বভাব ছিল।

নবকুমারবাবু আপনার ওখানে থাকার সময় কি বটকৃষ্ণবাবু গিয়েছিলেন?

না। নব বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরে বটো গিয়েছিল।

 তা হলে বটকৃষ্ণবাবু নবকুমারবাবুকে আপনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে থাকবেন। কিংবা নবকুমারবাবু আছেন জেনে বাইরে উনি অপেক্ষা করছিলেন। যাই হোক, বটকৃষ্ণবাবু আপনাকে কি বলেছিলেন?

বাচ্চুর কথা জিজ্ঞেস করল। বললাম, বাচ্চু নেই। বটো বেহায়া লোক ছিল। খেতে চাইল। খেতে দিলাম। খেয়েদেয়ে চলে গেল। দশটা টাকা চাইল। তাও দিলাম।

বাচ্চু যাওয়ার আগে টাকা চেয়েছিল আপনার কাছে?

পাঁচশো টাকা ধার চেয়েছিল। ধার চাওয়াতে আমার রাগ হয়েছিল। অনেক সাধাসাধির পর তিনশো টাকা দিয়েছিলাম।

অনিলবাবুর সঙ্গে তো আপনার সম্পর্ক ভাল?

অনিল ওর বাবা আর দাদার মতো কুচুটে নয়। আমাকে খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করে। আমি এলে অনিল আর ওর বউ খোঁজখবর নেয়। অনিল বাচ্চুর বন্ধু হলেও বাচ্চুর মতো খামখেয়ালি বা দুষ্টু প্রকৃতির ছেলে নয়। বাচ্চুকে নিয়ে আমার ঝামেলার শেষ ছিল না কর্নেলসায়েব।

কিন্তু গতমাস থেকে অনিলবাবুর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি আগের মতো আছে?

দয়াময়ীর চোখে চমক লক্ষ্য করলাম। অনিল কিছু বলছিল নাকি?

হ্যাঁ। গতমাসে এখানে এসে আপনি শাসিয়েছিলেন ওকে।

ওকে শাসাব কেন? ওর বাবাকে আর দাদাকে শাসিয়েছিলাম। শাসাব না? আমার ঘরের তালা ভেঙে জিনিসপত্র তছনছ করবে, আর আমি চুপ করে থাকব?

পুলিশকে জানাননি কেন?

দয়াময়ী আস্তে বললেন, কিছু চুরি যায়নি, তাই। কিন্তু ঘরের ভেতরটা লণ্ডভণ্ড করে রেখেছিল।

চোর কি কিছু খুঁজেছিল বলে আপনার মনে হয়?

পরে মনে হয়েছে।

 আপনার ঘরে এমন কি থাকতে পারে যে চোর তা খুঁজবে?

এবাড়িতে তেমন দামি কিছু রাখিনি। শুধু কিছু আসবাবপত্র, বিছানা আর রান্নাবান্নার জিনিস। পার্টিশন করা বাড়ি। অন্য পাশে অনিল থাকে। তাই অনিলের গায়ে লেগে থাকতে পারে। না–আমি অনিলের নাম ধরে শাসাইনি।

নবকুমারবাবু বলছিলেন, অনিল তার ঘর থেকে কিছু দলিলপত্রের ফাইল চুরি করে আপনাকে দিয়েছে। তাই অনিলকে তিনি পৃথগন্ন করে দিয়েছেন।

দয়াময়ী বাঁকা মুখে বললেন, আমার স্বামীর দলিলপত্রের ফাইল। নব তা লুকিয়ে রাখবে, চাইলে দেবে না–বাহ। কেল্লাবাড়ির বড় রায়বাবুর কাছে আমার স্বামী গঙ্গা-যমুনা নামে দুটো পুকুর আর মাঝখানের জমিটা পুরো কিনেছিলেন। ওতে নবর শেয়ার নেই। সেই দলিলপত্র নব লুকিয়ে রেখেছিল। কাজেই আমি কোনও অন্যায় করিনি। বাচ্চু অনিলের বন্ধু। বাচ্চু অনিলকে বলে-কয়ে ফাইলটা হাতাতে রাজি করিয়েছিল। তা অনিলকে বুঝি সেইজন্য টাকাকড়ি দিইনি? বলুক তো আমার সামনে।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, আপনি ট্রেনজার্নিতে ক্লান্ত। আর একটা প্রশ্ন করব।

যত খুশি প্রশ্ন করুন।

শব্দছকের কাগজটা কি আপনি কখনো বাচ্চুকে দেখিয়েছিলেন?

দয়াময়ী একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, বছর তিনেক আগের ব্যাপার। তখন আমি এখানেই থাকি। খামটা ভুল করে ছিড়িনি–তা আপনাকে কলকাতায় বলেছি, কৌতূহলী হয়েই ছিঁড়েছিলাম। কিছু বুঝতে না পেরে টেবিলের ড্রয়ারেই রেখেছিলাম। তারপর হঠাৎ মনে পড়েছিল, আমার স্বামী বলতেন গঙ্গা-যমুনার তলায় নাকি কোন আমলের যক্ষের ধন পোঁতা আছে শুনেছি। মনে পড়ার পরই খামটা আলমারির লকারে লুকিয়ে রাখি। এখন বাচ্চু ওটা তার মধ্যে দেখে ফেলতেও পারে। কেল্লাবাড়িতে যক্ষের ধনের গুজব ভীমগড়ে বরাবরই চালু। আছে।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। ঠিক আছে। আপনি বিশ্রাম করুন গিয়ে। দরকার হলে যোগাযোগ করব।

পাণ্ডে বললেন, মিসেস সাঁতরা। আপনি গাড়িতে বসুন। জাস্ট এ মিনিট।

বলে উনি কর্নেলকে বারান্দার শেষ প্রান্তে ডেকে নিয়ে গেলেন। চাপা স্বরে কিছু কথাবার্তা হল। তারপর উনি জিপে গিয়ে বসলেন। স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এতক্ষণে দেখতে পেলাম, জিপের পেছনের খোঁদলে কজন সশস্ত্র কনস্টেবল বসে আছে।

কর্নেল বললেন, সওয়া এগারোটা বাজে। চলো, শুয়ে পড়া যাক।

ঘরে ঢুকে বললাম, সত্যিই দজ্জাল মহিলা। বান্ধব পাঠাগারের ইন্দুবাবু ঠিকই বলছিলেন।

কর্নেল বাথরুমে গিয়ে রাতের পোশাক পরে এলেন। তারপর বিছানায় শুয়ে বললেন, সুখবর ডার্লিং। আশা করি তোমার সুনিদ্রা হবে। রাকেশ শর্মা জেরার মুখে কবুল করেছে, ১৪ জুলাই সন্ধ্যার একটু আগে সে এবং বাচ্চু কেল্লাবাড়ির সেই ঢিবিতে বসে কথা বলেছিল। কথা একটা চোরাই জিনিস নিয়ে। খুব দামি জিনিস। পাটোয়ারিজি দেখলেই নাকি কিনে নেবেন। তারপর রাকেশ গিয়ে মালিকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আসে। কিন্তু বাচ্চুর আর খোঁজ পায়নি। বাচ্চু রাকেশের বাড়িতে উঠেছিল, তাও সত্য। তো রাকেশ বরাবর দেখেছে, বাচ্চু ওইরকম খামখেয়ালি। তাই তার নিপাত্তা হয়ে যাওয়া নিয়ে মাথা ঘামায়নি। আর হ্যাঁ, রাকেশ বলেছে। যে, বাচ্চুকে কোনও চিঠি লেখেনি। ইনল্যান্ড লেটারটা তাকে দেখিয়েছে পুলিশ। ইংরেজিতে টাইপ করা চিঠি। তলার সইটা রাকেশের সইয়ের সঙ্গে মেলেনি।

অন্য কাউকে দিয়ে সই করিয়েছে। ধূর্ত লোক।

কর্নেল জড়ানো গলায় বললেন, এখন আমাদের দরকার আর একটা চিঠি। তা হলেই কেল্লা ফতে। সেই চিঠিটা নিশ্চয় লেখা হয়েছিল এবং ১৩ জুলাই রাকেশের চিঠির সঙ্গে কলকাতা পৌঁছেছিল। আর বটকৃষ্ণবাবুর চিঠি পয়লা জুলাই লেখা। অথচ পৌঁছুল ১৪ দিন পরে যখন বাচ্চু কলকাতা থেকে চলে এসেছে। ভীমগড় ডাকঘরের ডেটস্ট্যাম্পে তারিখ ধেবড়ে গেছে। সে যাই হোক, বটকৃষ্ণবাবু কেন বাচ্চুকে পত্রপাঠ আসতে লিখেছিলন? চিঠিটা কলকাতা পৌঁছুতেই বা এত বেশি সময় লাগল কেন? দেরিতে পোস্ট করেছিলেন?

জবাব দেবার জন্য বটকৃষ্ণবাবু আর ইহলোকে নেই। ছেড়ে দিন।

নাহ্। তার হয়ে জবাব দেবার লোক আছে। দেখা যাক।

কর্নেলের নাক ডাকা শুরু হল। এইরকম ওঁর ঘুম। সামরিক জীবনে নাকি গাছের ডালেও ঘুমিয়ে পড়তেন।

পরদিন যথারীতি কর্নেলের ডাকে ঘুম ভাঙল। প্রকৃতিবিজ্ঞানী প্রাতঃভ্রমণ সেরে এসেছেন। হাতে একগুচ্ছ অর্কিড। সুপ্রভাত বলে সম্ভাষণ করে জানালেন, কেল্লাবাড়ির জঙ্গলে পাথরের ফাঁকে এর খোঁজ পেয়েছেন।

হঠাৎ রাতের কথাটা মনে পড়ে গেল। বললাম, সেই তৃতীয় চিঠিটা খুজতেই কি কেল্লাবাড়ি গিয়েছিলেন?

কর্নেল হাসলেন। বাচ্চুকে মেরে তার লাশ যেখানে পোঁতা হয়েছিল, সেখানে মাটি নেই। লাইম কংক্রিটের চাবড়ার স্তূপ। কাজেই খুনিকে কষ্ট করে খুঁড়তে হয়নি। চাবড়াগুলো সরালেই ফুট তিনেক গর্তের তলায় ঘরের মেঝে। সেখানে লাশ ঠেলে ঢুকিয়ে চাবড়াগুলো চাপিয়ে দিলেই পাকা কবর তৈরি হয়ে গেল। মুসহর বস্তির লোকেরা জাত শিকারি। কাজেই শেয়াল আসার চান্স নেই। শকুনও টের পাবে না। কারণ সেই কবরের ওপর ভাঙা ছাদের অংশ ঝুলছে। হ্যাঁ, মুসহররা কুকুর পোষে। কিন্তু ওদিকে গড়খাইয়ে এখন গভীর জল। কাজেই লাশ কোনও দিনই আবিষ্কৃত হত না।

আহ। চিঠিটা—

 হ্যাঁ। দুটো চিঠি আস্ত রেখে নিজেরটা বুদ্ধিমান খুনি হাতিয়ে নিয়েছিল। যা শত্রু পরে পরে। কিন্তু তখন অন্ধকার রাত। হয়তো বৃষ্টিও পড়ছিল। চিঠিটা সাততাড়াতাড়ি ছিঁড়ে কুচি কুচি করে কবরের চাবড়ার তলায় গুঁজে রেখেছিল। ওখানে বৃষ্টি বাঁচানো ভাঙা ছাদ আছে। কাজেই ভেজেনি। কিন্তু আমার অবাক লাগছে, পুলিশ কবর খুঁড়ে লাশ বের করল। অথচ নীল রঙের কুচিগুলো চোখে পড়ল না কেন? পুলিশ রুটিন ওয়ার্কে পটু। তাই অত লক্ষ্য করেনি। বলে কর্নেল জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে রুমালে জড়ানো চিঠির কুচিগুলো বের করলেন। জয়ন্ত। বাথরুমে যাওয়ার আগে ফ্যান বন্ধ করে যাও। এগুলো উড়ে যাবে। দেখা যাক, কতটা মেলাতে পারি।

ফ্যান বন্ধ করে বাথরুমে গেলাম। এরপর ফিরে এসে দেখলাম, কর্নেল তখনও নীলচে কুচিগুলো মেলাচ্ছেন। কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম, একেকটা কুচিতে একটা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত হরফ পড়া যাচ্ছে। একটু পরে কৃপানাথ কফি দিয়ে গেল। কর্নেল কফির পেয়ালা তুলে বললেন, এনাফ। বরাবর দেখে আসছি, খুনি নিজের অজ্ঞাতসারে এমন কিছু চিহ্ন রেখে যায়, যা তাকে ধরিয়ে দিতে সাহায্য করে। হয়তো ব্যস্ততা কিংবা অতিবুদ্ধি, অথবা আতঙ্ক।

কার চিঠি বুঝতে পারছেন?

কর্নেল চারটে কুচির দিকে আঙুল রাখলেন। একটাতে বৃহ দ্বিতীয়টাতে ব তৃতীয়টাতে শব্দা এবং চতুর্থটাতে শুধু ন। কর্নেল হাসলেন। কিছু বুঝলে?

নড়ে বসলাম। মাই গুডনেস। বৃহৎ বঙ্গীয় শব্দাভিধান। তার মানে, এই চিঠি অনিলবাবু লিখেছিলেন। কর্নেল, আপনি কি বলতে চান অনিলবাবুই দু-দুটো খুন। করেছেন?

চুপ। রহমত আসবে জিপ নিয়ে। আমরা এখনই বেরুব।

.

উপসংহার

রহমতের জিপ সবে পোর্টিকোর তলায় ঢুকছে, এমন সময় মিঃ পাণ্ডের পুলিশ জিপও এসে হাজির। পাণ্ডেকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। বারান্দায় উঠে ব্যস্তভাবে বললেন, য়ু আর রাইট কর্নেল সরকার। ডাকঘরের বারান্দায় যে লোকটা টাইপ করে, তার নাম বদ্রিনাথ প্রসাদ। জেরার চোটে কবুল করেছে, রাকেশের নামে চিঠিটা সে অনিলবাবুর অনুরোধে টাইপ করেছিল। কাজেই অনিল সাঁতরাকে শেষরাতে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদিকে রাকেশ শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছে, বাচ্ছ তাকে বলেছিল অনিল চোরাই মালের জিম্মাদার। তারা দুজনে মিলে মালটা উদ্ধার করেছে। রাকেশ যেন পাটোয়ারিজির সঙ্গে কথা বলে রাখে। রাতেই তারা মাল নিয়ে যাবে। কিন্তু কথামতো বাচ্চু এবং অনিল সে রাতে যায়নি। পরদিন সকালে অনিল একা রাকেশকে সঙ্গে নিয়ে পাটোয়ারিজির কাছে কথা বলতে যায়। পাটোয়ারিজি বলেন, মাল না দেখে দরদাম হবে না। অনিল কিন্তু আর যায়নি। কেন যায়নি, তা ওকে জেরা করে জেনে নেওয়ার চেষ্টা চলেছে। দেখা যাক।

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ফেলে বললেন, সকালে মুসহর বস্তিতে গিয়েছিলাম। ভারুয়া নামে একটা লোক বলল, কিছুদিন থেকে অনিল সাঁতরাকে সে কেল্লাবাড়িতে ঘুরঘুর করতে দেখত। আর যখনই অনিল সেখানে যেত, বটোবাবু তাকে আড়াল থেকে ফলো করত। ভারুয়া জাত শিকারি। তার সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, তার দৃষ্টিশক্তি তীক্ষ্ণ। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, বটোবাবুর ফলো করে বেড়ানো অনিলের চোখে পড়ে থাকবে। তাই সে সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। কর্নেল আমার দিকে ঘুরলেন। হাওড়া স্টেশনে বটোবাবুর শেষ সংলাপে আরও একটি মাত্রা যোগ করা চলে। উনি বলেছিলেন, কিন্তু তা কি করে সম্ভব? ভারি অদ্ভুত তো। তার মানে, নবকুমারবাবু কলকাতা এসেছেন। কাজেই তার খুন হওয়া সম্ভব নয়। এরপর ভারি অদ্ভুত তো কথাটার মানে আরও অর্থবহ হচ্ছে, ছেলের বাবাকে খুন করা ভারি অদ্ভুত। যাই হোক, বটোবাবু কলকাতা ছুটেছিলেন। বাচ্চুকে জানাতে যে, অনিল কেল্লাবাড়িতে বড্ড বেশি ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে। কারণ বাচ্চু তার চিঠিতে সাড়া দেয়নি।

বললাম, কিন্তু নবকুমারবাবুই যে ভিকটিম হতে পারেন, বটোবাবুর মাথায় এ ধারণা কেন এল?

পাণ্ডে একটু হেসে বললেন, দ্যাটস্ অ্যানাদার স্টোরি। পাটোয়ারিদের সঙ্গে সাঁতরাদের রেষারেষি আছে। হয়তো পাটোয়ারির ভাতিজার মুখে তেমন কিছু শুনে থাকবেন বটোবাবু। মাঝেমাঝে দুদলে মারপিট বেধে যায়। এই কেসের সঙ্গে ওটার সম্পর্ক নেই। বেওসায়ি লোগোঁকা কাজিয়া।

কর্নেল বললেন, তো বটোবাবু সত্যি রক্ত দেখেছিলেন এবং লাশ উদ্ধারের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। অনিল তক্কেতক্কে ছিল। পাঠাগারের ইন্দুবাবু বলেছিলেন, আনিল ফেরোসাস। পেটাই শরীর দেখলেই বোঝা যায়, শরীর চর্চা করত। তার পক্ষে বটোবাবুর শাবল কেড়ে নিয়ে তাকে মারা খুব সহজ কাজ। দ্বিতীয় লাশটা পুঁতে ফেলার সুযোগ অনিল পায়নি। দিনের আলো ফুটেছিল।

পাণ্ডে বললেন, কিন্তু কর্নেলসায়েব, হোয়্যার ইজ দ্যাট সোয়াস্তিকা? অনিলের বাড়ি সার্চ করে পাইনি।

কর্নেল সে কথার জবাব না দিয়ে কৃপানাথকে কফি আনতে বললেন। তারপর বললেন, এই চিঠির কপিগুলো রাখুন। এতে একটা অভিধানের উল্লেখ আছে। পরে বুঝিয়ে বলব। আসলে মকর, কচ্ছপ এবং রপট শব্দের রহস্য ফাঁস করার মতো অভিধান ভীমগড়ে দুর্লভ। সাধারণ বাংলা অভিধানে মকর অর্থ কুমির এবং কচ্ছপ অর্থ কাছিম পাওয়া যাবে। রপট অর্থ যদি বা পাওয়া যায়, তাতে নদী বা স্রোত বোঝাবে। কিন্তু শব্দাভিধানে মকর যে গঙ্গার এবং কচ্ছপ যে যমুনার বাহন, তার উল্লেখ থাকবে। কাজেই এক ঢিলে দুই পাখি বধের মতো অনিল বাচ্চুর শরণাপন্ন হয়েছিল। আভিধানও এল এবং বাচ্চু পাশে থাকলে সে নির্ভয়ে কাজ করতে পারবে। বাচ্চু ছিল দুর্দান্ত প্রকৃতির যুবক।

পাণ্ডে চিঠির কুচিগুলো রুমালে বেঁধে বললেন, হ্যাঁ, ওর নামে পুলিশ রেকর্ডে অনেক সাংঘাতিক তথ্য আছে। এরিয়ার সব মাফিয়া দলই ওকে সমীহ করে চলত। মিসেস দয়াময়ী সাঁতরা ওকে জেনেশুনেই পোষ্যপুত্র নিয়েছিলেন। বাচ্চু না থাকলে ওঁর দেবর ওঁকে প্রপার্টি থেকে বিঞ্চিত করতেন।

কফি এল। কর্নেল বললেন, কফি খেয়ে নার্ভ চাঙ্গা করুন মিঃ পাণ্ডে। স্বস্তিকা একটি জায়গাতেই লুকিয়ে রাখা অনিলবাবুর পক্ষে সম্ভব। পোস্ট অফিসের পার্শেল রুমে। চট বা ওই জাতীয় কিছু–ধরুন পিচবার্ডের মোড়কে পেয়ে যাবেন। ভুয়া নামঠিকানাও লেখা থাকতে পারে।

কফি খেয়েই পাণ্ডে জিপ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, ডার্লিং। আমরা বরং ব্রেকফাস্ট করেই বেরুব। আর তাড়া দেখছি না। বলে সকৌতুকে ফিসফিস করে বললেন, অনিলবাবুর সঙ্গে দেখা করার দিন পাশের পার্শেল রুমে একটা বেখাপ্পা সাইজের পার্শেল দেখেছিলাম। খটকা লেগেছিল। ডাকে এই সাইজের পার্শেল পাঠানো যায় না…..।