ন’ নম্বর গলি

ন’ নম্বর গলি

রাজধানীর উত্তর প্রান্ত থেকে যে সড়কটা সোজা বেরিয়ে এসে দুভাগ হয়ে গেছে তারই একটার নাম হয়েছে বারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড। বাংলাদেশে ইংরেজের বিরাট শিল্প এলাকা গড়ে উঠেছিল এককালে এই রোডের ধারে ধারে।

এ রোডের প্রায় মাঝামাঝি অঞ্চলে, তার বুকে চিরে যে অসংখ্য গলি পথ আচমকা চোখে পড়ে তারই একটার নাম ন নম্বর গলি। সেই মাঠের ধারে রেল লাইনে গিয়ে মিশেছে গলিটা। বড় গলি। সেই গলিরও আছে আবার শাখা-প্রশাখা। সেগুলোর নাম নেই, দরকারও নেই তার।

ভোরবেলা থেকে শুরু করে বিকাল পাঁচটা অবধি এ গলির অধিবাসীদের কাউকে বড় একটা চোখে পড়ে না। কারণ সকলেই থাকে কারখানায়। নেহাত রুগ্ন, বুড়ো, ছেলেমানুষ আর পোয়াতি মেয়েমানুষ ছাড়া ঘরের আগল কারও খোলা থাকে না। দোকান ঘরগুলোর দরজা মাপে পোয়াটাক খোলা থাকে, এ-সময়ে খদ্দেরের ভিড় থাকে না বলে। কেবল খোলা থাকে রাস্তার মোড়ের বড় চা-খানাটা আর ধোঁয়াটে হোটেল ঘর দুটো। রাত্রিচর চোর পকেটমার গুণ্ডারা আর এক আধটা সেপাই আড্ডা জমায় চা-খানায় আর হোটেলগুলোতে চাপে ভাতের হাঁড়ি।

সন্ধ্যা যখন ঘনিয়ে আসে, বিদঘুটে গরম কেটে গিয়ে খানিক হাওয়া বয় তখন ধীরে ধীরে। সারাদিনের নিঝুম ঝিমুনো ন নম্বর গলি চাঙ্গা হয়ে ওঠে।

এসময়ে কারখানার খাটিয়েরা ঘরে ফেরে সবাই। প্রত্যেকটা ঘরেই প্রায় জ্বলে উনুন। তা ছাড়া পথের ধারে জ্বলে তেলেভাজাওয়ালাদের উনুনগুলো। ফুলুরি, পেঁয়াজি, ফুচকা, দই বড়ার ঝাল টোকো বিষাক্ত তেলের গন্ধে ভরে ওঠে বাতাস। ধোঁয়ার দম আটকানো ধূসরতায় ছেয়ে ফেলে ন নম্বর গলির আকাশ।

এ সময়ে হাসি, গান, ঝগড়া-বিবাদ, বাচ্চাদের কান্না, ফেরিওয়ালাদের চিৎকারে এক বিচিত্র কলরবে মুখর থাকে ন নম্বর গলি। মাতালের ভিড় বাড়ে, ভিড় বাড়ে শৌখিন রিকশাওয়ালা, আর জোয়ান তাঁতি স্পিনারদের। চটকলের মধ্যে শ্রমিক হিসাবে যাদের চোখে পড়ে বেশি। অল্পবয়সীরা এসে সব আড্ডা জমায় ন নম্বর গলির শেষের দিকটায়, যেখানে বেশ্যা বস্তিটা মৌচাকের মতো জমাট বেঁধে উঠেছে, আলোর ঝলকে হাসি উপচে পড়ে যেখানে মদের বোতলগুলোর রঙিন মসৃণ গা বেয়ে।

ধাঙ্গরেরা তাদের পোষা শুয়োরগুলোর আস্তানার জন্য মাঝে মাঝে ভাবে। কিন্তু এ ন নম্বর গলির মতো অসংখ্য গলিগুলোর জন্য কেউ ভাবে না। এখানকার মানুষরাও বোধ হয়—এখানকার জীবন সম্বন্ধে অচৈতন্য। এর কোনও বৈচিত্র্য নেই। তবু ন নম্বর গলিকে আজ অচেনা মনে হবে। তার দৈনন্দিন চলার পথে কোথায় যেন মস্ত একটা হোঁচট খেয়েছে। এ গলির মধ্যে যারা ভাল, যাদের সকলে সমীহ করে, যারা সাহসী—তাদের ছোঁয়াচ যেন গলিটার সকলের মধ্যেই লেগেছে। ন নম্বর গলি আজ তাই শান্ত, কিন্তু এত উদ্ধত দেখা যায় না তাকে।

ইলিয়াসের চা-খানা থেকে উঠে পড়ল মতিলাল তার বিরাট চেহারাটা নিয়ে।

শের মতিলাল, ন নম্বর গলির শের। খলিফা। ন নম্বর গলির মধ্যে সবচেয়ে সম্মানের পদবী খলিফাগিরি যে দখল করেছে, আদায় করেছে প্রভুত্ব—সে হল খলিফা মতিলাল।

হাঁ, এককালে সে ছিল ওই রুস্তম, রঘুনন্দন, সব ভিন এলাকা আর এ এলাকার খলিফাদের একজন ছোকরা সাকরেদ মাত্র। বহু চড়-চাপড়, লাথঘুষা খেয়েছে ওস্তাদদের, তামিল করেছে বহুত কড়া হুকুম। বহু দুখ তখলিফের পর মহারাজা হনুমানজির কৃপা হল তার উপর। একদিন রঘুনন্দনকে ডেকে বসল পাঞ্জা লড়বার ফিকিরে। এসপার নয় ওসপার। বিগড়ে গিয়েছিল মতির মন। বুকটার মধ্যে ক্রোধ আর আফসোস জমে জমে বারুদ হয়ে উঠেছিল। হাঁ, একজন থাক। হয় রঘু, নয় মতি।

হনুমানজির কৃপা। আগুনের তাত লাগা লোহার রডের মতো বেঁকে দুমড়ে পড়ে গিয়েছিল রঘুনন্দনের চওড়া লোমশ হাতটা।

এক বোঝা বেলফুলের মালা দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিল তাকে ন নম্বর গলি। হাঁ, শের বটে। জোয়ান খলিফা। এলাকার রাজা। পঞ্চায়েত নয়, পুলিশ দারোগা নয়, জেল কাচারি নয়, যা করতে হয় সবকিছুর মালিক খলিফা। মহল্লার সরকার।

জেল খাটতে হয়, মামলা লড়তে হয়, সব ঝামেলা মাথায় আসবে খলিফার। খলিফা কিনা। আর এই হল এইসব মজুর এলাকার চলতি নিয়ম।

মতি উঠল ইলিয়াসের চাখানা থেকে। সারাদিন কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে চোখ দুটো হয়েছে ভাটার মতো লাল। তা ছাড়া রাতের শরাবির আমেজটাও নিঃশেষ হয়নি এখনও। কানের সোনার মাকড়ি দুটো চকচকিয়ে উঠল আলোয়।

এই হল নিয়ম। খলিফা হতে হলে, লোহা দিয়ে কান পিটিয়ে থেঁতো করে সোনার মাকড়ি পরতে হয়।

সালাম খলিফা! রাস্তার আশে পাশে মেয়ে পুরুষ, বালক বৃদ্ধদের অভিনন্দন শোনা যায়। মতি দাঁড়ায় না। এক অদ্ভুত দৃপ্ত ভঙ্গিতে, নির্লিপ্ত হাসিতে এগিয়ে যায়। সঙ্গে যায় দুচারজন-জঙ্গী জোয়ান সাকরেদ।

অ্যাই ওপ শালা! থমপকে দাঁড়িয়ে পড়ে, ঠাস্ করে একটা চড় কষালো সে রামধনির গালে। কেতনা দিন শালা তোকে মানা করেছি—

একটা লাথি দিয়ে রামধনির তেলসুদ্ধ চড়ানো কড়াটা আর উনুনটা ফেলে দিল সে মাটিতে। খলিফার বিচার। রামধনিকে সে মানা করেছিল তেলে ভাজা বিক্রি করতে এ মহল্লায়। কেননা, লোকটা বারো নম্বর গলির মানুষ।

ঠিক হ্যায়। একজন সাকরেদ শাসায় : দুসরা দিন দেখব, শালা তোর শির চড়িয়ে দেব উনুনে।

হায় রাম! রামধনি মার খাওয়া কুকুরের মতো সামনের বস্তিটার গায়ে লেপটে যায়। 

বৈজুর ছেলে লালু একটু দেমাকি কায়দায় আসছিল। ছোকরাটা আজকাল একটু ভাব ধরেছে উড়ু উড়ু। খলিফা চালে কথাবার্তা বলে, বুকটা চিতিয়ে দেয় সামনের দিকে। মহল্লার ছুকরিগুলোর উপর নজর তার বড় বেশি। খলিফার কাছে দু চারটে নালিশও হয়ে গেছে তার নামে।

মতিকে আসতে দেখে, টুক করে মুদিখানার ঝাঁপের পাশে সরে পড়ে সে।

সালাম হো খলিফা! কী একটা ওজন করতে করতেই বলে মুদিয়াইন। পরমুহূর্তেই ঝাঁপের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলে, ওখানে কি রে? কুত্তা না, বিল্লি?

হাঁ, ভারী খাপসুরত আছে মুদিয়াইন এখনও। দু চারটে ছেলের মা বলে কিছুতেই মনে হয় না ওকে। ওর দিকেও নজর আছে লালুর।

কিন্তু গালাগাল শুনে চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল তার। রাস্তায় খলিফা, চেঁচানো সম্ভব নয়। চাপা গলায় খিস্তি করল সে।

কী বললি? কপট রাগে ঝেঁজে উঠল মুদিয়াইন। বুদ্ধু কাঁহাকে, দেখবি–বোলাব খলিফাকে?

যেন মন্ত্রোচ্চারণ করল মুদিয়াইন। বোকার মতো শান্ত হয়ে গেল লালুর মুখটা। বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখল—মতির চেহারাটা মিলিয়ে গেছে কি না।

মিলিয়ে গেছে। এবার সে বেশ খানিকটা বুক টান করে ঝাঁপের পাশ থেকে বেরিয়ে প্রায় মুদিয়াইনের গা ঘেঁষে বসে।

কী বলছ? মুদিয়াইনের সারা দেহটা সে চোখ দিয়ে চাটে।

বলছি, তোর উমর কত হল রে ছোকরা? পান খাওয়া পাতলা ঠোঁট দুটো ধনুকের ছিলার মতো বেঁকে ওঠে মুদিয়াইনের। কাঁচা প্রাণ ভরে ওঠে লালুর রূপ রসে। কিন্তু কথার ঘায়ে ভেঙে যায় সে রসের ভাণ্ড।

তোর এ গরব একরোজ টুটিয়ে দেব। উঠতে উঠতে বলে লালু : হপ্তা হরতালটা ঢুকে যাক, তোদের ওই বুঢ়া খলিফাকে তারপর পাঞ্জায় ডাকব। সেদিন

থোড়া কেড়ুয়া তেল লিয়ে যা, কবজিতে মালিশ করবি।

লালু তখন চলতে শুরু করেছে।

মুদিয়াইন ডাকল : এ রামু, ভোলা, এ নরেশ ভাইয়া–লালুর বাত শুনে যাও তোমরা।

কিন্তু আজ কেউ আসবে না, তা সে জানে। অন্যান্য দিন এতক্ষণ তার দোকানে আর দোকানের ধারে খাটিয়ায় জোয়ান বুড়োদের ভিড় লেগে যায়। মরদগুলির সঙ্গে ঢলে ঢলে গল্প করে। হেসে গড়িয়ে মুদিয়াইন পাড়ার মেয়ে বউদের বুকে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। মরদগুলি যে তাদেরই মরদ, বাপ, ভাই। কেউ কেউ চুপ করে থাকতে না পেরে এতক্ষণে তুবড়ি ছুটিয়ে দেয় গালাগালির। কিন্তু মুদিয়াইনের তাতে যায় আসে না কিছুই।

কিন্তু আজ কেউ আসবে না। মুদিয়াইন ভাবে মিনমিনে বোকা বোকা দেখতে এই শয়তানগুলো–কারখানায় নাকি কি একটা গোলমাল বাধিয়ে এসেছে। হপ্তা ওঠায়নি কেউ আজ। মুদিয়াইনের ধার তো শোধ হলই না। এর উপর আবার হারামজাদাগুলো নাকি কাল বিলকুল কারখানা বন্ধ করে দেবে।

মহল্লা খলিফার কানে এখনও যায়নি কথাটা। সে বহাল তবিয়তে হাতির মতো ঢুলতে ঢুলতে চলেছে শরাবির দোকানের দিকে রোজকার মতো। দুনিয়া কেঁপে উঠুক, এই সময়ে পয়লা শরাব, তারপর সব বাত পুছ হবে।

কিন্তু তারও মনে খটকা লেগেছে। গলিটা যেন এখনও ঝিমিয়ে আছে বলে মনে হচ্ছে। নেহাত ফাঁকা আওয়াজ—সালাম খলিফা, তার বেশি কিছু নয়। গান নেই, হল্লা নেই, নেই মাতোয়ালের চিৎকার—। মনে মনে বলে,কেয়া বাত?

বাতের নিকুচি করেছে, এখন চাই শাব। হাঁ শরাব।

মোড়ে মোড়ে জটলার বহর বাড়ছে। তর্কের ঝড় বইছে। বাজে মাথা-গরম করা তর্ক। নাঙ্গা ফকির খালি-পট মাথা গরমের দল। মায়া লাগে মতির, সকরুণ হাসে সে। আদমি নয়, জানবার আছে। জানবার। জানোয়ারের খলিফা সে। কমতি মহব্বত, জাস্তি মার যাদের দাওয়াই।

চোপ! লাগাব দো ঝাপর। বলতে বলতে রামচন্দর কষিয়ে দিল দুটো চড় তার বন্ধুর গালে।

অ্যাই—ওপ। হেঁকে উঠল মতি।

আরে বাপ রে! খলিফা!

সালাম খলিফা।

শালা, মারতা কাঁহে?

শালী খালি খানে মাংতা। খানা কাঁহা? রূপেয়া নেহি

বাস্ বাস্। ঝগড়া করবি না। গোলমাল চায় না মতি। শান্তি চায়, শান্তিরক্ষক খলিফা সে।

কিন্তু মনে পড়ল না তার আজ হপ্তার দিন রুপেয়া কেন নেই ওর হাতে।

চায়ের দোকানগুলোতে মাঝারি ভিড়। রোজকার মতো গানে গল্পে উচ্ছ্বসিত ভিড় নয়, স্তব্ধ চিন্তিত হাত পা গুটিয়ে বসা ভিড়।

সালাম খলিফা। বেয়াকুবগুলোর হাত পর্যন্ত ওঠে না কপালে। অনিচ্ছার অভিনন্দন, থোড়াই কেয়ার করা ভাব। নিজেদের নিয়েই সব মশগুল। কেয়া বাত? খলিফা না মতি?

হতাশ পেশোয়ারি আর কাবুলিওগালারা বিচিত্র ভাষায় ফিসফিস্ করে গালাগাল দিতে দিতে ফিরে চলেছে। না সুদ, না আসলি। কোনও ব্যাটা একটা আধেলাও ছোঁয়াল না। বলে, হপ্তা হরতাল কিয়া হ্যায়…

আরে এ শালে। রাজিন্দর ওর ছেলেকে হাঁকল। চুল্লী জ্বালাতা ক্যায়া, হামারা শির পাকায়েগা?

ছোট ছেলে। মা নেই। বাপকে কারখানা থেক ফেরে চুপচাপ থম্ ধরে বসে থাকতে দেখে নিজেই উনুনে আগুন দেবার চেষ্টা করছিল। পেটের জ্বালা। বাপের খামখেয়ালিতে বেশি রাত করতে সে রাজি নয়। কিন্তু কথা শুনে থমকে গেল। ভুখ লাগতা হ্যায়।

হাত ধরে ছেলেটাকে ধরে বুকের কাছে নিয়ে আসে রাজিন্দর। চল, থোরা চা উ পি কে আয়ি। ক্যায়া করেগা, হপ্তা হরতাল হুয়া হ্যায় না?

সালাম খলিফা! ছেলেকে নিয়ে রাজিন্দর রাস্তায় বেরোয়।

সালাম। ছেলেটাও মতিকে অভিনন্দন জানায়।

জিতা রহো বেটা।

খলিফার চাল, খলিফার ইজ্জত। দুধ পিনেবালা লেড়কাও সেলাম দেবে।

তেলেভাজাওয়ালি অবলা এর মধ্যেই পাততাড়ি গুটাচ্ছে দেখে তাজ্জব মানল মতিলাল।

আভি চললি যে?

তা কী করব? অবলা ঠোঁট বাঁকায়। বিকিকিনি নেই, ভাজা মাল ঠাণ্ডা হয়ে জমে যেতে লাগছে। এতক্ষণ নাইনে দাঁড়ালে রোজগার হত।

হাঁ? ক্যায়া, শালা ভিখারি বনে গেল ন নম্বর গলি?

দে, হামকো আঠ আনার মাল দে।

মিশি দেওয়া দাঁত বেরিয়ে পড়লো অবলার। ফুলুরি আর পেঁয়াজি দিতে দিতে বলে, তা, খলিফার আর আমাদের নাইনে যাওয়া হয় না কেন?

মতি হাসল। তোদের লাইনটা বিলকুল বুড্ডিদের লাইন আছে।

তা একদিন না হয় মুফতেই মহব্বত দিয়ে এসো।

সাকরেদের হাত থেকে পয়সা নিয়ে অবলা সরে পড়ে।

মোড়ে মোড়ে জটলা। বহু জেনানার দল মুরগির ডিমে তা দেওয়ার মতো ঘরে বসে আছে। ঘরে ঘরে গালি খিস্তি ঝগড়া গোলমাল নেই। নেই হাসি গান হল্লার কান ঝালাপালা করা শব্দ।

খলিফা মতিলাল একেবারে অনভ্যস্ত সাঁঝবেলায় মহল্লার এ ঝিমুনিতে। অনভ্যস্ত ন নম্বর গলির পুরনো নোংরা জীবন।

কী ব্যাপার? খালি বাচ্চা লেড়কাগুলোর ঘ্যানঘ্যানে কান্না। কান্নার মধ্যে খালি ভুখা শব্দের ছড়াছড়ি। আর মোড়ে মোড়ে জটলা।

হাঁ, একটা খটকা লাগে।

যা-নে দেও। শরাব না টানলে কিছু দিমাকে ঢুকবে না।

ন নম্বর গলির বাঙালি পাড়া।

দু একটি কেরানিবাবু আছে বাবুসাহাব বাড়িওয়ালাদের দু-একটা আব্রুওয়ালা পাকা বাড়ি নিয়ে। আর সবই মিস্তির মজুর কুলির দল।

একই দৃশ্য এখানে।

মোড়ে মোড়ে জটলা। মাথা গরম করা হাঁক ডাক বাজে কথা।

সম্প্রতি এখানে আরও ভিড় বেড়েছে। পাকিস্তানি হিন্দু বাঙালিদের ভিড়। মুরগির বাচ্চার পালের মতো আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে মুলুক-ছাড়া মানুষেরা। যে বিচারে এসব হয়েছে সেই বিচারে থুক দেয় মতিলাল।

সেলাম খলিফা!

এই পরেশোয়া! পরেশকে হাঁকল মতিলাল।

লালুর দোস্ত পরেশ। পকেট মারে এ ছোকরা। কিন্তু আজ বড় ঝিমিয়ে পড়েছে। আজ সারা এলাকাটার পকেট খালি হয়ে গেছে। বরাত! নিজের বাপটার ওপরও রাগ হয় তার। শালারা হপ্তা হরতাল করেছে। খেতেই জোটে না, তার আবার—। আজ তো নিশ্চয়ই ভাত বন্ধ। হপ্তা যখন হয়নি।

কিন্তু হিম হয়ে গেছে তার বুক, খলিফার ডাক শুনে।

কী বে শালা, গরিব বেচারা কার্তিকের দুঠো রূপেয়া মেরে দিয়েছিস তুই ওর লেড়কার দাবাই এনে দিবি বলে?

ঠাস্ করে একটা চড় পড়ে পরেশের গালে। কামিনা কাঁহাকে। আর শালা কেতনা দিন হামি মানা করেছি কি ই এলাকায় পাকিট মারবি না।

আর একটা চড় পড়ে অন্য গালে। সঙ্গে সঙ্গে দুটো টাকাও দেয়। লে, আভি দিয়ে দে কার্তিককে। মারের পরই টাকা। বাপের কাছে মার খাওয়া শান্ত ছেলের মতো নীরবে চোখের জল মোছে পরেশ। যাক্, উপোস থাকতে হবে না বাপের হপ্তা হরতালের জন্য। এ টাকা দিয়েই আজ…। ঘরের দিকে গেল সে।

রাস্তার আলো আঁধারিতে দেখল একটা কাবলে তার বাপকে টাকপড়া মাথাটায় চাপড়ে চাপড়ে বলছে, টুমলোক বুঢঢু আছে। হপ্তা উঠাও, আপনি খাও, হামার ছুডটা মিটাও। মালুম?

হাঁ। কেঠো হাসি হেসে মাথা নাড়ে পরেশের বাপ। কিন্তু খাঁসাহেব, এটা আমাদের রুজির লড়াই হ্যায়, কাল তো তামাম কারখানা বন্ধ রহেগা।

কুচ শুনবে না। ঝেঁজে ওঠে কাবুলিওয়ালা। কাল হামার ছুড চাই, বেগর-ছুডকে ভি ছুড হোবে।

সালোয়ারের ঝাপটা দিয়ে চলে গেল সে।

এবার চোখ তুলতেই পরেশকে চোখে পড়ে তার বাপের।–কুত্তার বাচ্চা! ঝেঁঝে উঠল বাপ, আমার মরা মুখ দেখতে এসেছ শালা? এসো, আজ পিণ্ডি গেলাচ্ছি তোমাকে।

পরেশ কিছু না বলে, একটু ইতস্তত করে খলিফার দেওয়া টাকা ছুড়ে দেয় বাপের দিকে।

নেই মাংতা। রগের চোটে হিন্দি বেরিয়ে পড়ে বাপের। টাকাটা ছুড়ে ফেলে পরেশের পায়ের কাছে। রোজগার করবে না, হারামজাদা পকেট মারবে আর গিলবে। বেরো, হট যা।

পরেশ নির্বিকার ভাবে সরে পড়ে। খানিকটা গিয়ে একটা লাইটপোস্টের আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখে বুড়ো কী করে।

বুড়ো মাটিতে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজছে টাকাটা, আর গালি দিচ্ছে। …

বেশ্যাপল্লী।

ফাঁকা, চুপচাপ। বসে দাঁড়িয়ে এধার ওধার ছিটকে আছে মেয়েগুলো। নতুন মুখের আশায় তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে চারিদিকে। বাবু ভদ্রলোকদের আশায়।

আজ ভিড় নেই শৌখিন রিকশওগালা, মজুর, তাঁতিদের। গান নেই, হল্লা নেই মাতোয়ালের। গন্ধ নেই ছড়িয়ে—চামেলির তেল আর বেলী ফুলের।

কেয়া বাত?

খটকা লাগছে খলিফা মতিলালের।

আইয়ে, খলিফাজি আইয়ে, সর্দারজি আইয়ে!

দুহাত তুলে অভিনন্দন জানাল মদের দোকানের মালিক কুণ্ডু বাবু।

কেয়া বাত? তাজ্জবে ভ্রূ কুঁচকে গেল মতির। শরাবখানাটাও খালি! কেয়া, মর গয়া নও নম্বর গল্লি? কুলি কামিন তাঁতি রিকশওয়ালা, ছোকরা ফিটার স্পিনার কোথায় গেল সব? কাঁহা গেল বিলাসপুরী দিলদরিয়া মেহেরারুর দল, নাঙ্গা মাতায়ালে, শরাবপিনেওয়ালীদের হাসি গান হল্লা? কাঁহা সুখন, সাবীর, যারা মদখাওয়া বিলাসপুরী মেয়েদের গা থেকে কাপড় খুলে দিয়ে বহুত বঢ়িয়া বাহারে ফুর্তি শোরগোল মচায়?

তাজ্জব।

কেয়া বাত কুণ্ডু বাবু, এ শরাবখানা, না শ্মশান ঘাট আছে?

আর বোলো না খলিফাজি। আফসোসে মুখ বিটকেল হয়ে ওঠে কুণ্ডবাবুর। বলে, কুলি কামিন শালারা আজ হপ্তা হরতাল করেছে। তাই কারওর টিকিটি নেই আজ।

হাঁ? খানে বিনা মরে এগুলো, আবার হপ্তা হরতালের রমজানি? রাম রাম! উল্লুক ন নম্বর গলি।

শুধু তাই? কাল পুরা হরতাল মানাবে আবার।

আরে বাব্বা! শালাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। দিমাক ঠিক নেই। খালি ফালতু শোরগোল মচাতা।

ছোড়ো ইয়ার। শরাব লাও। ও-সব বাজে ব্যাপারে খলিফা বাত করে না।

হঠাৎ চমকে উঠলো খলিফা মতিলাল। কপালে হাত ঠেকিয়ে সেলাম জানাল সে–সালাম বাবুলোক।

চমকে উঠেছে সে শাবখানায় কয়েকজন বাবুলোককে দেখে। চেনে সে, মুখার্জিবাবু, বোসবাবু, বাবুসাহেব রাম শর্মা, শঙ্কর সিং। এরা নিজেদের সমাজপতি বলে, মহল্লার বিচারক হতে চায়। মুদি কারবার করে, মেয়েপট্টি চালায়। কারখানার সাহেবদের দোস্ত। এখানকার মজুরগুলির সঙ্গে, মতিলালকেও ওরা ঘৃণা করে। খলিফাকে চায় ওরা হটিয়ে দিতে। এরা এলাকার কারবারি মহলের কর্তা।

কিন্তু, হাঁ, তাজ্জব! এরা কেন শরাবখানায়? সঙ্গে আরও দু চারজন ছিল। ভিন এলাকার ছোটখাটো ছিঁচকে গুণ্ডা। শরাব টানছে ওরা।

যানে দেও। লাও, শরাব চালাও। বেশি তাজ্জব হওয়া ভাল নয়। খলিফা তো সে।

মদ টানতে টানতে বিড় বিড় করে সে। মরবে খাটিয়েগুলো জরুর মরবে। খানা নেই, পিনা নেই, হপ্তা হরতাল! আরে বাপরে! যত বাজে ফালতু কাজ। কুলি কামিন্ কা লড়াই।

কিন্তু খটকা লাগছে বড়, দিমাক চটে যাচ্ছে বাবু শরীফ আদমিগুলোর সঙ্গে ছিঁচকে গুণ্ডাগুলোর গুনগুন ফুসফুস কানাকানি ভাবভঙ্গি দেখে। কী চায় এরা, কী বলছে এরা? হাঁ, খলিফা ওদের সালাম ঠোকে, বাবু বলে মানে, কিন্তু লিখাপঢ়াবালা টোপিওয়ালা এ-সব আদমিদের সে বিশ্বাস করে না। বাবুলোক সব মতলববাজ আছে।

বেরিয়ে গেল সব বাবুলোকেরা। পিছে গুণ্ডা আদমিগুলো।

থুক ফেলল মতিলাল ছিঁচকে গুণ্ডাগুলোর দিকে চেয়ে। গুণ্ডা নয়, কুত্তা। বাবুদের পিছে পিছে ঘোরে। হাঁ, খাঁটি গুণ্ডাবাজির দাম দিতে রাজি আছে খলিফা, রাজি আছে নিজের পাশে বসতে দিতে। কিন্তু এরকম নয়। ওদের মতো হুকুম তামিল করনেওয়ালাদের নয়।

কুণ্ডুবাবু কেশো গলায় ভুঁড়ি কাঁপিয়ে নমস্কার ঠুকল বাবুদের দিকে চেয়ে। খলিফাকে বলল চোখ মেরে, হরতালের দাওয়াই দেবে শালাদের ভাল করে। মাল চেনেনি এখনও। দিনটাই আজ মাটি করে দিয়েছে।

হরতালের দাওয়াই? সে আবার কী চিজ?

হটাও ফালতু কথা। শরাব খেতে খেতে নেশাটা জমে উঠেছে খলিফার।

হঠাৎ একটা শোরগোলে তার নেশা যেন চড় খেয়ে কেটে গেল।

কেয়া বাত? মার দাঙ্গা? ন নম্বর গল্লিমে? মতি খলিফার এলাকায়? শের খলিফা। এক ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়াল সে। হাঁ, খলিফা হ্যায় না মতি ন নম্বর গলির। এ পরেশ না হয় লালু হারামজাদার কাজ হবে জরুর। নয় তো, মাথা গরম, হরতাল শোরগোল মচানেওয়ালা রাজিন্দর, জগু, শিবুর ফালতু গোলমাল। শালাদের হাড্ডিগুলো গুঁড়িয়ে দিতে হবে আজ।

ছুটে এল সাকরেদদের নিয়ে।

রাম রাম। তাজ্জব মানল মতি ঘটনাস্থলে এসে।

ঝগড়া লাগিয়েছে বোসবাবু আর মুখার্জিবাবু, বাবু সাহাব রাম শর্মা আর শংকর সিং-এর সঙ্গে। আর ওদের পিছে পিছে ঘোরা গুণ্ডাগুলো হিন্দি বাংলায় ঝগড়া লাগিয়েছে নিজেদের মধ্যে।

কেয়া বাত? একই দলের লোক, দোস্ত আদমি সব, বঢ়ে বঢ়ে লিডর লোক সব নিজেদের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দিল! মাতোয়ালে হয়ে গেল লোকগুলো?

আরে এ বাবু লোক, এ শালালোক, তুমলোক না অভি শরাব পিতা রহা এক সাথ?

হট যাও! কে যেন ধমকে উঠল মতিলালকে।

রাগে গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল খলিফার। শের খলিফা।

এঃ, ইমান ভুলে গেছে শালা বাবুসাহাব আদমিগুলো। বোসবাবু আর শংকর সিং, নাংগা ফকিরগুলোকে সাক্ষী মানছে, জঘন্য গালাগালির সমর্থন চাইছে, চাইছে প্রতিকার।

হট যাও, শালা দেখ লেংগে বাঙালি লোককো। ছিঁচকে গুণ্ডাটার সঙ্গে শংকর সিংও সায় দিল।

আয়রে শালা মেড়োর ডিম, ঢ্যামনার বাচ্চারা। মুখার্জি বাবুর তড়পানির ফাঁকে তার সাকরেদ হাঁকল।

হাঁ, ন নম্বর গলি জেগেছে, কেটেছে ঝিমুনি, ভেঙেছে আড়মোড়া। ন নম্বর গলির সবাই বাইরে এসেছে, ভাগ হয়ে গেছে দুটো।

আরে কেয়া কর রহে তুমলোক? চিৎকার করে উঠল খলিফা–ই লোক দোন্ত হ্যায়, মাতোয়ালে বন্ গিয়া হ্যায়। দারুণ গর্জনে ড়ুবে গেল শের খলিফার গলা। শালা লোক গালি কাঁহে দেতা?

তোরা শালারা কেন গালি দিচ্ছিস? জবাব আসে।

রহমতের তন্দুরি রুটি বানাবার উঁচু উনুনটার উপর লাফিয়ে ওঠে রাজিন্দর। ভাই লোক!…

হাঁক দিল সে, এ দাঙ্গামে ফাঁসো মত।

হঠাৎ একটা ধস্তাধস্তির মধ্যে জান্তব গর্জন ওঠে। মার মার…

বেয়াকুবের মতো খলিফা দেখল, বাবু সাহাবদের গুণ্ডাটার লাঠি সজোরে গিয়ে পড়ল রাজিন্দরের মাথায়।

তাজ্জব! বে-ইজ্জত শের খলিফার! কেউ মানল না। একই এলাকার দোস্ত আদমি বাঙালি হিন্দুস্থানী লড়াই শুরু করে দিল। সারা ন নম্বর গলি খুন খারাবিতে মেতে গেল।

থুক। সব জানবার হ্যায়, বিলকুল।

কিন্তু শের খলিফা হ্যায় না মতি?—খবরদা–র!

হাঁক দিল মতি।

খ্যাপা কুকুরের মতো হাঁকল রাম শর্মাজি, ঠার যাও মতি।

মতি ঠার যাবে? কেন, এ কার ইলাকা!–ঝাঁপ দিল সে ভিড়ের মাঝে, উজবুকদের ডাণ্ডাবাজির মাঝখানে। খবরদা–র!

ধাক্কা খেল খলিফা, ঝাঁ করে একটা ডাণ্ডা এসে পড়ল একটা চোখের উপর। ভিড়ের পেষণে ছিটকে পড়ল সে মাটিতে। শের খলিফা!…

আর্ত চিৎকার নারী পুরুষ শিশুর, কুকুরের আর গরুর। ক্রুদ্ধ গর্জন আর ডাণ্ডার ঠোকাঠুকিতে ন নম্বর গলিকে আর চেনা যায় না।

শোন, শোন, রাজিন্দরের জায়গায় পরেশের বুড়ো বাপ অনেক কসরত করে উঠে হাঁকল। এ-লড়াই শয়তানদের…

মার! জন্তুর চিৎকার ওঠে। নিষ্ঠুর শব্দ ওঠে আঘাতের।

তাজা গরম রক্ত খানিকটা ছিটকে এসে লাগল খলিফার গালে।

এঃ। থুক দেয় আবার মতি। একটা রক্তাক্ত চোখ হাত দিয়ে চেপে ধরে মাটি হিঁচড়ে হিঁচড়ে মার খাওয়া জানোয়ারের মতো সরে যায় খলিফা! শের খলিফা!…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *