ষষ্ঠ ঋতু

ষষ্ঠ ঋতু

মেয়েমানুষটি দাঁড়িয়েছিল দরজার কাছে।

সামনের রাস্তাটি উত্তর দক্ষিণে লম্বা। সরু রাস্তা দু-পাশে ঘিঞ্জি বাড়ি। রাস্তার ধারে পানবিড়ির দোকানপাট। দক্ষিণে জেলেপাড়া, উত্তরে মালীপাড়া। মালীপাড়ায় মালী আর নেই। এখন নামটি বেঁচে আছে। ভাল কথায় লোকে বলে খারাপ পাড়া। মফস্বলের ছোট শহর হলেও, বেচা কেনা, হাট বাজার—বেশ জমজমাট শহর।

মেয়েমানুষটি যে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়েছিল, ওইখান থেকে মালীপাড়ার শুরু বলা যায়।

পৌষের দুপুর। দেখতে দেখতে রোদ কাত হয়ে গেছে কখন। পাড়াটার পুবের বাড়ির চালাগুলি পেরিয়ে কোঠাবাড়ির মাথায় ঠেকেছে রোদ।

মেয়েমানুষটির দরজার মাথায় একটি ছোট সাইনবোর্ড টাঙানো রয়েছে। লেখা আছে, শ্রীমতী কৃষ্ণভামিনী দাসী কীর্তন গায়িকা। ভিতরে অনুসন্ধান করুন।

দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণভামিনী নিজেই। মাজা মাজা রং, দোহারা গড়ন। মধ্য-ঋতু আশ্বিনের নিস্তরঙ্গ ঢলে ঢলে শরীর। বয়সটা অবশ্য গিয়ে ঠেকেছে তলে তলে আর একটু দুরে। দিনের হিসেবে আশ্বিনের দিন কাবার হয়ে অগ্রহায়ণের একটু শীত ধরেছে সেখানে। একটু রাশভারী দলমলে কৃষ্ণভামিনী। কপালের সামনে পাতা পেড়ে চুল এগিয়ে দিয়েছে। সিঁথির সিঁদুর সামান্য। ডাগর চোখে এখনও সজাগ চাহনি, খরতাও আছে। কালো শাড়ি পরনে, গায়ে জামা নেই।

মুখে পান টিপে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে দক্ষিণে। চোখে ঠোঁটে রাগ রাগ ভাব। নাকছাবিটিও নড়েচড়ে উঠছে নাকের পাটায়।

পুব কোলের কোঠাবাড়ির বারান্দা থেকে একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করল, দাঁড়িয়ে আছ যে কেষ্টদিদি?

কৃষ্ণভামিনী, সেদিকে না তাকিয়ে বলল, দেখছি।

কাকে?

মরণকে।

মেয়েটি হেসে বলল, বুঝিছি। তোমার খোলঞ্চিকে তো? তা সে মিনসেকে তো দেখলাম, একটু আগে ভেঁপু ফুঁকতে ফুঁকতে, রিকশা চালিয়ে একটা লোক নিয়ে গেল পাড়ার মধ্যে।

কথা শেষ হতে না হতেই হর্ন বাজিয়ে একটা সাইকেল রিকশা এসে দাঁড়াল কৃষ্ণভামিনীর দরজায়। রিকশায় যাত্রী নেই। রিকশাওয়ালা নেমে একটু অপ্রতিভ মুখে হাসল কৃষ্ণভামিনীর দিকে চেয়ে।

কালো মানুষ। পেটা পেটা শক্ত চেহারা। বাবরি চুলও কালো। গোঁফ দাড়ি কামানো মুখ। এ-সব মানুষ একটু বয়স-চোরা হয়। ধরা যায় না কিছু। কালো মুখে ধুলো লেগে রুক্ষ দেখাচ্ছে। সদ্য রিকশা চালিয়ে ফুলে উঠেছে হাত পায়ের পেশি। অপ্রতিভ হয়ে হাসলে তাকে বোকা দেখায়।

ভ্রূ বাঁকিয়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল কৃষ্ণভামিনী, কটা বেজেছে?

সে বলল, এট্টুস দেরি হয়ে গেছে।

কৃষ্ণভামিনীর রাগ চড়ল তার কথা শুনে। বলল, রিকশা চালিয়ে খাবে, ওই চালিয়ে মরবে। ভগবান তোমার হাতে কেন শ্রীখোল দিয়েছিল, বলতে পারো?

অন্য মেয়েটির কথানুযায়ী বোঝা গেল, লোকটি কৃষ্ণভামিনীর খোলুঞ্চি অর্থাৎ খোল বাজিয়ে। নাম গগন। হেসে বলল, ভগবানের বিষয় বলে কথা? কী যে কে হয়, কেউ জানে? পয়সার কাজটা আমাকে করতে হবে তো। না, কি বলো গো।

বলে পুবের বারান্দার মেয়েটির দিকে তাকাল। কৃষ্ণভামিনীর কৃষ্ণচোখের তারা জ্বলে উঠল দপদপ করে। চতুর্থ ঋতু অগ্রহায়ণেও বৈশাখের বিদ্যুৎবহ্নি। তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠল, ও আবার কী বলবে? আমিই বলছি, না পোষায় ছেড়ে দিলেই পারো। আমার কি শ্রীখোলা-বাজিয়ের অভাব হবে, না তোমাকে পয়সা আমি দিতে চাইনি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাক্ষী মানছ লোককে, ন্যাকামো করে তবে মরতে আসা কেন এখানে?

বলতে বলতে ভিতরে ঢুকে গেল কৃষ্ণভামিনী। দাঁড়িয়েছিল রানীর মতো, ফিরে গেল ক্রুদ্ধা রাজেন্দ্রানীর মতো। দরজাটির পাল্লা নেই। নইলে বন্ধ করে দিয়ে যেত।

বিমর্ষ হেসে গগন ফিরে তাকাল পুবের বারান্দার দিকে। সে মেয়েটি, গগনকে নয়, কৃষ্ণভামিনীকে ভেংচে চলে গেল।

বাড়ির দরজাটি বড়। সেকেলে বড়লোকের বাড়ি ছিল এটা। বাড়িটা নেই। পাঁচিল আর দরজার মাথাটা রয়ে গেছে। রিকশাটা ঢুকিয়ে দিল গগন উঠোনে।

ভিতরে তখন কৃষ্ণভামিনী হাঁক দিয়েছে, রাধি, ও রাধা, কোথায় গেলি?

রাধা ছুটে এল ঘরে। ডাগর-সাগর রাধা, কটা রং। ছোট ছোট চোখে ডাগর চোখের ঢুলুনি। ঠোঁট দুটি বড় লাল, একটু স্থূল। কৃষ্ণভামিনী বলল, নে হারমনিয়াটা টেনে নে।

রাধা বুলল, খোলুঞ্চি খুড়ো এল না মাসি?

কৃষ্ণভামিনী দেওয়ালের পেরেক থেকে খঞ্জনি জোড়া পেড়ে ধমকে উঠল, তুই বোস্ দিকিনি। শ্রীখোল ছাড়াই হবে। পোষ মাসের আর কটা দিন মাত্তর বাকি। নবদ্বীপ থেকে বাবাজির চিঠি এসে পড়েছে। দোসরা মাঘ বেরুতেই হবে। আমার কাজ আছে। রাধা চোরা চোখে মাসির মুখ দেখে আর কথা বাড়াল না। ওই মুখের কাছে মুখ বাড়ানো যায় না।

প্রতি বছর মাঘ মাসেই কৃষ্ণভামিনী নবদ্বীপে যায়। মাঘ মাসে ভোর ভোর সকালে নবদ্বীপে আখড়ায়, আখড়ায়, মন্দিরে মন্দিরে কীর্তনের আসর বসে। নবদ্বীপের চেহারা বদলে যায়। স্বয়ং বিষ্ণু অবতরণ করেন। লোকে মাঘে যায় প্রয়াগে, বৃন্দাবনে, মথুরায়। ত্রিবেণীতে কল্পবাস করে। আর নবদ্বীপে আসেন নামকরা মহাজনেরা, মহাশয় বৈষ্ণবেরা। ত্রৈলোক্য আচার্য, কৃষ্ণনাথ ভট্টাচার্য, মোহিনীমোহন মল্লিক, এই সব বড় বড় লেখাপড়া জানা বৈষ্ণব গায়কেরা আসেন। পদ রচনা করেন, ভাঙেন গড়েন, পুঁথি নিয়ে বসেন বড় বড়। আসর হয়, এক একদিন এক এক আখড়ায়। সে আসরে স্কুল কলেজের ছাত্র মাস্টারমশাইরাও ভিড় করেন এসে। নবদ্বীপের ওই সব আসরে কৃষ্ণভামিনীর বড় আদর। মহাশয়েরা স্নেহ করেন মেয়ের মতো। বাবাজিরা তাকিয়ে থাকেন সতৃষ্ণ নয়নে। ভক্ত অভক্ত জনতার রক্তেও আখরের দোলা লাগে।

পানটি নেশার জিনিস। নবদ্বীপেও ভোরবেলা স্নান করে পানটি মুখে দেয় কৃষ্ণভামিনী। ঠোঁট রক্তরেখায় বেঁকে ওঠে। বোয়া নীলাম্বরী পরে, আঙুল তুলে গায়,

বঁধু, তোমার দেওয়া গরবে,
তোমার গরব টুটাব হে।

নবদ্বীপে না গিয়ে পারে না কৃষ্ণভামিনী। আজকাল, শহরে বাজারে আর তাদের বড় ডাক পড়ে না। বায়স্কোপ থিয়েটার, রেডিয়ো রেকর্ডে অনেক কীর্তন শোনে লোক। কত শত মিঠে গলায় বাহারে পদের গান। তা ছাড়া দিন গেছে বদলে। কৃষভামিনীর দেহ ও বয়সের ধারায়, যুগটা পাশ কাটিয়ে গেছে অন্যদিকে। পাড়াতে তাদের ডাকতেও নাকি অসম্মান। সাইনবোর্ডটা ঝুলানো আছে এক যুগ ধরে। ওইটি দেখে কোনওদিন কেউ ডাকতে আসেনি তাকে। সাইনবোর্ডটির বয়স বেড়ে গিয়ে টিন বেরিয়ে পড়েছে।

তাই নবদ্বীপ যেতে হয়। সেইখানে কিছু বায়না পাওয়া যায়। এখনও দুর জেলা থেকে ডাক আসে। বর্ধমান, বাঁকুড়া, আরও তলায় মেদিনীপুর, উঁচুতে মানভূম–প্রবাসের বাঙালিরা ডাকেন কখনও সখনও। কীর্তনের খোঁজে সবাই নবদ্বীপেই আসেন এখনও। কৃষ্ণভামিনী কাছে না থাকলেও বাবাজিরা ঠিকানা দিয়ে পাঠিয়ে দেয় এখানে। না গিয়ে উপায় কী?

বছর দুয়েক আগে, রাধামাধব আখড়ার রাখহরি বাবাজি একদিন গানের শেষে এসে বলেছিল, কেষ্ট, আচায্যি মশাই বলছিলেন, এবার তোমার আখেরটা একটু দেখতে হয়।

ধ্বক করে উঠেছিল কৃষ্ণভামিনীর বুক। কেন বাবাজি? গান জমেনি?

বাবাজি বলেছিল, রাধেমাধব। এমনটি আর কার জমে গো। আচায্যি বলছিলেন, কেষ্টর বয়স হল। আখেরের কিছু না করলে শেষ বয়সটা.. একটু থেমেই আবার বলেছিল, তোমার কথা সবাই ভাবেন। তাই বলছিলাম, সব গুটিয়ে-সুটিয়ে একেবারে নবদ্বীপেই চলে এসো। শেষ বয়সটা রাধামাধবের সেবা করে…।

ধ্বকধ্বকানিটা থেমেছিল, যন্ত্রণাটা বুকের কমেনি কৃষ্ণভামিনীর। শেষ বয়স! যে কথাটি অনেকবার তার রক্তস্রোত বলে গেছে কানে কানে, আজ সকলে মিলে বলছে সেই কথা। সময় হয়ে এসেছে। বেলা যায়, বেলা যায়। কৃষ্ণভামিনী বুঝেছিল, শুধু তার রূপ নয়, আরও কিছু আছে। বিলাপের দুই জায়গায় স্বর ছিঁড়ে গিয়েছিল। বুক ভরে দম নিয়ে, গলার শির ফুলিয়েও শেষরক্ষে হয়নি।

বাবাজি আরও বলেছিল, গলার আর দোষ কি বলো। যেখানে আছ, সেখানে থাকলে অনাচার তো একটু হবেই।

অনাচার অর্থে নেশা ভাং আর শরীর পীড়নের ইঙ্গিত করেছিল বাবাজি। একেবারে মিছে বলেনি। কিন্তু নবদ্বীপে এসে থাকলে কি সে সবের কিছু কমতি হবে? একে তো সে-আশ্রয় হবে পরের আশ্রয়। কৃষ্ণভামিনীর তাতে বড় ঘৃণা। আর, রাখহরি বাবাজি যখন ভালবাসবে, তখন? অমন ঢুলঢুল চোখ বাবাজির, কেষ্টকে ভাল না বেসে তার উপায় কি।

সে ভালবাসার আশ্রয় তো সইবে না তার।

তবে আখেরের ব্যবস্থা করেছিল কৃষ্ণভামিনী। মালীপাড়ার মেয়ে সে, নিজের জীবন তাকে শিখিয়েছে অনেক কিছু। রাধাকে পেয়েছিল সে আটবছর বয়স থেকে। আরও বারো বছর খাইয়ে পরিয়ে বড় করেছে, গান গেয়ে, দেহ পণ্য করে। কীর্তনে দীক্ষাও দিয়েছে অনেকদিন। মালীপাড়ার কারবারে ছেড়ে দেয়নি পুরোপুরি। মেয়েটার রং ঢং আছে। গলাটি একটু খর, তবে মন্দ নয়। কিন্তু বড় মাথা মোটা। দিন রাত্রই সেজে গুজে আছে। সন্ধে হলেই উঁকি ঝুঁকি মারবে এ-দিকে ও-দিকে। মালীপাড়ার মন্ত্র পড়ছে তো কানে দিবানিশি। এখন রক্তে বড় জ্বালা।

প্রথম দিকে শেখাবার অতটা চেষ্টা ছিল না কৃষ্ণভামিনীর। গত দুবছর থেকে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরেছে সে রাধাকে। তালিম দিচ্ছে চুলের মুঠি ধরে। গতবছর নবদ্বীপের বায়নার জায়গায় জায়গায় নিয়ে গেছল তাকে।

আখেরের ব্যবস্থা করেছে সে। কাউকে বলে দিতে হয়নি। তার গান, গায়িকা কৃষ্ণভামিনী, তারও যে আখের আছে, সেকথা ভেবে কেন মন পোড়ে।

বঁধু, পিরিতি করিয়া রাখিলে যদি,
অভিসার নিশি কাটে কেন।
না রাখিতে নিশি কাটে না যেন।

খঞ্জনিতে দুবার ঝুন ঝুন করে কৃষ্ণভামিনী বলল, নে, মানের গানটা ধর।

রাধা উসখুস করছে। এ বাড়িতে আরও তিনঘর মেয়ে আছে। এ সময়ে তাদের কাছে বসে রাধা তাদের বাসরলীলার কাহিনী শোনে। বলল, কোনটা?

কালকে যেটা হয়েছে।

ভয়ে ভয়ে বলল, আমার মনে পড়ছে না মাসি।

কৃষ্ণভামিনী রাগে জ্বলে উঠল। বলল, তা তো তোর মনে পড়বে না। চিরকাল বারোভাতারি তোর কপালে আছে, খণ্ডাবে কে।

তারপর একমুহূর্ত চুপ করে থেকে গুন গুন করে উঠল সে।

তুমি সুনাগরী রসের আগরী
তেজহ দারুণ মান।
সখীর বচনে কমলনয়নী
ঈষৎ কটাক্ষে চান।…..

রাধা গান ধরতে না ধরতেই, গগন এসে ঢুকল। কৃষ্ণভামিনী চেয়েও দেখল না। রাধার ভ্রূ দুটি নেচে উঠল শুধু।

এ আসরে সে নিতান্ত বেমানান। ময়লা হাফশার্ট গায়ে, তালিমারা ফাটা ফুলপ্যান্ট পরা রিকশাওয়ালার সঙ্গে কোনও মিল নেই এ ঘরের। এ ঘরের সাজানো-গোছানো অল্পসল্প জিনিস, পরিষ্কার যুগল শয্যা, সব কিছুতেই বিপরীত।

দেওয়াল থেকে খোলটি পেড়ে, কপালে ঠেকিয়ে একটু দূরেই বসল সে। কৃষ্ণভামিনীর চোখের পাতা নড়ল না। কিন্তু খঞ্জনির রিনিঠিনি খোলের বোলে একাত্ম হয়ে গেল। রাধারও গলা ছাড়ল।

.

গগন লোকটি এ তল্লাটের নয়। বছর দশেক আগে, বর্ধমানের এক গ্রাম থেকে, চলে এসেছে কৃষ্ণভামিনীর পিছনে পিছনে। কৃষ্ণভামিনী গাইতে গিয়েছিল সেখানে।

লোকটির পেছু নেওয়া নজরে ছিল তার। দেখেই বুঝেছিল, অন্তঃসারশূন্য গেঁয়ো বাউণ্ডুলে। ঘর বউ জোটেনি কপালে। রেস্ত থাকলে একটু আসকারা দিত হয়তো কৃষ্ণভামিনী। মাগনা পিরিতে মন দূরের কথা, শখও ছিল না একটু।

লোকটি কয়েকদিন এ-দিক সেদিক করে হঠাৎ এসে বলেছিল, তোমার সঙ্গে এট্টুস খোল বাজাব ভাই।

আজকে যেমন অপরাধীর মতো হেসে এসে দাঁড়াল, সেদিনও তেমনি করে এসে দাঁড়িয়েছিল। তখন কৃষ্ণভামিনীর শ্রাবণের খরস্রোত দেহে, আশ্বিনের ঢল বয়সের হিসেবে। চোখের পাতার নিঃশব্দ ঝাপটাতেই তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিল পারেনি। ওদিকে আবার গগনের একটু চ্যাটাং চ্যাটাং কথা ছিল। বলেছিল, আমার রং কালা, ট্যাঁকও কালা, একটু বাজাতে চাই খালি।

বাজিয়েছিল। বাজিয়ে নিয়েছিল কৃষ্ণভামিনী। তেওড়ার ঢং-এ দুঠুকী বাজাতে বাজাতে গোলাপী নেশার মতো ঢুলছিল গগন। আর চোখ দিয়ে যেন চাটছিল কৃষ্ণভামিনীকে। দেখে শুনে ভামিনী রং ফিরিয়ে কালেংড়া সুরে গেয়ে উঠেছিল,

মতলবে তোর মন ঠাসা,
ঘরের ভাতে কাগের আশা।
নাগর পথ দেখ হে ॥

গগন দমেনি। একমুহূর্ত থেমে তাল চড়িয়ে দিয়েছিল আড়খেমটার। এমন বাজিয়েছিল, পথ দেখানো যায়নি একেবারে গগনকে।

তারপর বছর চলে গেছে। নানান কাজ করে, গগন রিকশা কিনে বসেছে এখানে। সারাদিনে দুটি কাজ এখন। রিকশা চালানো, ওইটি পেটের। কৃষ্ণভামিনীর সঙ্গে খোল বাজানো, ওইটি শুধু শখ না আর কিছু, টের পাওয়া যায়নি দশ বছর ধরে। এখন কৃষ্ণভামিনীরও দরকার হয়ে পড়েছে তাকে। তবে, গগনের ওই লালাঝরা চোখ দুটিকে কোনওদিন আসকারা দেয়নি সে। রিকশাওয়ালার কাছে, কীর্তন গায়িকা কৃষ্ণভামিনী বেচতে পারে না নিজেকে। মাগনা মানিনী নয়, কৃষ্ণভামিনীর মান আছে।

মালীপাড়ার মেয়েরা ফোঁসলায় গগনকে, কী আশায় আছ? না হয় রিকশাই চালাও, আর মেয়েমানুষ নেই এ সোম্সারে!

আছে। কার ঘরে যাতায়াত নেই গগনের। তার রিকশাওয়ালা বন্ধুরা বলে, ওরে শালা, কেষ্টভামিনীর মধু যে চলে যাচ্ছে বছরে বছরে। যারা খাওয়ার তার খেয়ে নিলে। তোকে ব্যাটা পাকাচুল বাছতে হবে ভামিনীর।

গগন বলে, তা জানি। চাকে মধু না থাক, মোম তো থাকবে। ভামিনীর পাকাচুল, সেও যে অনেক ভাগ্য।

এই মরেছে, শালা কুত্তা নাকি রে।

গগন হাসে। মাথা গুঁজে সোয়ারি বয়। তখন বোঝা যায়, তারও বয়সে শীতের বেলা লেগেছে।

কৃষ্ণভামিনী তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, মরণ! রিকশাওয়ালা হলেই অমন নোলা হয়।

কথায় কথায় গগন দু একবার, ভামিনীর বাড়িতেই থাকবার প্রস্তাব করেছে। খাওয়াটা থাকাটা যদি এখানেই ব্যবস্থা হত, মন্দ হত না। ভামিনী উগ্রচণ্ডী মূর্তি নিয়ে তেড়ে এসেছে, বেরো বেরো বেরো।

রাধার ঠেকে ঠেকে যাচ্ছে। ভামিনী খঞ্জনির খুনখুন শব্দ থামিয়ে বলে, হল না মুখপুড়ি, একটু হেসে গা। হারমোনিয়া ছাড়, খালি গলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গা। আগে বল

বলে নিজেই বলে, সখী, আমার মন নেই, কাকে বলে। আমার চোখ নেই, কাকে দেখাও। আমি বধির, শুনতে পাইনে সই। তবুও ওইখেনে কে দেখা দেয়? কে, ও?

সখী কেন কুঞ্জের ধারে দাঁড়িয়ে কালা,
ফিরে যেতে বল্।

এদিকে গগনের হাত যেন অবশ। খোলে চাঁটি নেই। হাঁ করে তাকিয়ে আছে কৃষ্ণভামিনীর দিকে। রুখে উঠল কৃষ্ণভামিনী, আ মরণ?

মরবার আগেই ঘিচ ঘিচ করে খোল কথা বলে উঠল, ফিরে যেতে বল।

রাধা হাসে মিটমিট করে। জোরে হাসতে ভয় পায়। মাসি গলায় পা দেবে যে!

আশ্চর্য! রাধা চোরা চোখে বিজলি হানে গগনকে। তার কটা রঙের শরীরের রেখায় বড় ঝাঁজ। নেশা করার মতো স্থূল টকটকে ঠোঁট দুটিতে যেন মনে মনে কী বলে। দেখেশুনে ঘেন্না করে কৃষ্ণভামিনীর। ছুঁড়ির রুচি বলে কিছু নেই। গগনের রকম-সকমও তেমনি। রাধার হাসিতে ঢুলে ঢুলে খোল বাজায়।

বেলা গেল। পৌষের বেলা, এল কখন, গেল কখন, কে জানে। এর মধ্যেই ঘরের মধ্যে মশার শানাই বাজছে। স্থির হয়ে বসতে দেয় না একদণ্ড। ঘরে ঘরে, ধোয়া মোছা, সাজগোজা চলেছে। বাতি জ্বলছে বারোবাসরে।

গান শেখানো শেষ হল। গগন উঠতে যাবে। কৃষ্ণভামিনী বলল, রাধি, রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস কর, ওর খোল বাজাবার কত চাই।

গগন বলল, খুব রেগে গেছ বাপু। দশ বচ্ছর যখন দেওনি, থাক। সবটা একসঙ্গেই দিয়ো না হয়।

কৃষ্ণভামিনী বলল, বাকি বকেয়া আমি ভালবাসিনে। টান মেরে আঁচল নামিয়ে চাবির গোছ খুলতে খুলতে বলল, আর রাস্তার মানুষের সামনে, ছোটলোকের মুখে ছোট কথাও শুনতে চাইনে।

কালো মুখে, হলদে চোখে গগনকে বোবা অসহায় জানোয়ারের মতো মনে হয়। এক মুহূর্ত নির্বাক থেকে বলল, আচ্ছা বাপু, আর কোনওদিন কিছু বলব না। এবার থেকে সময়মতো আসব।

বলে না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেল। রিকশা বার করতে যাবে। দরজার পাশ থেকে রাধা বলল, চললে খোলুঞ্চি খুড়ো?

গগন বলল, হ্যাঁ লো। তোর মাসির যা রাগ।

রাধা বলল ঠোঁট ফুলিয়ে, তা বলে আমি তো আর রাগ করিনি।

গগন বলল হেসে, করবি কেন। তুই তো আর কেষ্টভামিনী নোস। তা হ্যাঁরে, রাতে কেউ আসবে নাকি তোর মাসির গান শুনতে?

আজ? হ্যাঁ, ওপারের মধুর ভটচায আসবে রাত দশটায়।

থাকবে বুঝি রাত্রে?

কী জানি। তুমি আসবে?

সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে গেল গগন। রাস্তার উপর থেকে কে একজন শিস দিয়ে উঠল রাধার দিকে চেয়ে। রাধা হাসল। মালীপাড়া জমে উঠেছে শীতের সন্ধ্যায়।

জুড়িয়ে এল রাত দশটাতেই। শীতে আপাদমস্তক ঢেকে কোঁকাতে কোঁকাতে এল মথুর ভট্টাচার্য। তার পিছনে পিছনে গগন।

কৃষ্ণভামিনী সেজেছে। শান্তিপুরের নীলাম্বর তার বড় প্রিয়। রঙটি মাজা মাজা হলেও মানায়। মুখে স্নো-পাউডার মেখেছে, জামার গলাটি একটু বেশি কাটা। চওড়া ঘাড়ে ও গলায় বয়সের ঢেউ পড়েছে। ঢাকা পড়েছে একটু চওড়া বিছে হারে। পানরাঙানো ঠোঁট, পায়ে আলতা। ভট্টাচার্যকে দেখে অভ্যর্থনা করল, আসুন ভট্টচায মশাই।

মথুর বলল বুড়োটে গলায়, অ্যাাঁ? আসব? তা আসব। কিন্তু, তোমার সেই মেয়েটি, কী নাম তার? রাধা, হ্যাঁ রাধা! আজ তার মুখে একটু ভাব-সম্মিলনের গান শুনব। তোমার গান তো অনেক শুনেছি কেষ্টভামিনী।

চকিত ছায়ায় এক মুহূর্তের জন্য কৃষ্ণভামিনীর মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। অনেক শোনা হয়েছে, অনেক। গান শুনবে লোকে, কিন্তু কৃষ্ণভামিনীর দিন বুঝি আর নেই। ভাব-সম্মিলনের মিলন কোলাকুলির রস উপছে পড়বে না বুঝি আর তার গানে। পরমুহূর্তেই হাসল পঞ্চম ঋতুর শীতার্ত শুষ্ক হাসি যেন। ভাল, ভালই তো। সে আসল, রাধা যে তার সুদ। তারই গান শুনুক লোকে। বলল, বেশ তো, শুনবেন, বসেন।

মথুর বসল। ভূতের মতো বেমানান, তালি মারা প্যান্টটা পরে হাঁ করে বোকা চোখে গগন তাকিয়েছিল ভামিনীর দিকে। চোখে চোখ পড়তে, চমকে খোল নামাল সে।

রাধা তখন অন্য ঘরে। ভামিনী বলল, বসুন, ডেকে নিয়ে আসি। রাধাকে নিয়ে তখন অন্য ঘরে টানাটানি। ছাড়িয়ে নিয়ে এল ভামিনী। মথুর বলল, এসো এসো।

.

পৌষ সংক্রান্তি গেল। উত্তরায়ণে বাঁক নিল সূর্য। সোনার মতো রোদে, ছায়া বেঁকে গেল একটু দক্ষিণে। দিনের ঘোমটা খুলতে লাগল একটু একটু করে।

দোসরা মাঘ রাধাকে নিয়ে রওনা হল ভামিনী। গগনও এসে, ঢাকা রান্দায় তুলে দিল রিকশা। শ্রীখোল নিল কাঁধে। সেও যায়। না গিয়ে পারে না। বাজাবার বড় সাধ। দশ বছর ধরে নবদ্বীপে সেও চেনা হয়ে গেছে। কেষ্টভামিনীর খোলবাবাজি তার নাম হয়েছে। গগন বড় খুশি। আর, আজকাল অপরে খোল ধরলে একটু বাদে বাধো লাগে ভামিনীর। গগনের সেখানে বেশ নাম। তবে, বেশিদিন থাকতে পারে না। পেট চালাতে হবে তো। দু-চারদিন বাদেই ফিরে এসে রিকশা নামায়।

মালীপাড়ার মেয়ে পুরুষেরা বলে, কেষ্ট খেতে দিলে না বুঝি?

গগন বলে, আমি কেন খাব?

রওনা হল তারা। পাড়ার মেয়েরা মুখ বেঁকিয়ে বলল, মাগীর ঠ্যাকার দেখলে গা জ্বালা করে। স্টেশনে গিয়ে ভামিনী দুটি টিকিটের টাকা দিল গগনের হাতে। গগন তিনটি টিকিট কেটে নিয়ে এল।

নবদ্বীপে আসর জমে উঠেছে সংক্রান্তির দিন থেকেই। সকলেই অভ্যর্থনা করল কৃষ্ণভামিনীকে। আখড়ায়, মন্দিরে, চেনাশোনা বাড়িতে। রাধাকে গতবছরই সবাই দেখেছে। গতবছর রাধা বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি। তবে, রাধার কাছ ঘেঁষাঘেষির জন্য সকলেই বড় ঠেলাঠেলি করেছে। গগন খোলুঞ্চিকেও চেনে সকলে। রাখহরি বাবাজির আখড়াতেই আস্তানা নিল ভামিনী।

মহাজন মশাইয়েরা এসে ঠাঁই নিয়েছেন এক এক জায়গায়। আসরে দেখা হয় সকলের সঙ্গে। সকলেই ডেকে কুশল জিজ্ঞেস করলেন ভামিনীর।

পরদিন গানের আসরে বসল ভামিনী। লোকারণ্য হল সেই আসরে। প্রথম দিন। সে কৃষ্ণ রাধা ভজল, খোল করতাল ভজল, মান্য গণ্য মহাজন গুরুজন ভজল। তারপর ধরল,

প্রভু না বাঁধিয়ে টানো,
কী যেন টানে টানো
আমারে জনম ভরিয়ে টানো
পিরিতি রশিতে বাঁধিয়া টানো।
টানো হে।
ধূলায় পড়ে, কাঁটায় ফুটে
রক্ত ঝরে, জ্বালায় পুড়ে,
মরিব, তবু টানো হে নাথ ॥

অনেকক্ষণ গাইল ভামিনী। কিন্তু তেমন সাড়া শব্দ পড়ল না। নিজেকে বড় ক্লান্ত লাগল ভামিনীর। ঠোঁট শুকিয়ে উঠতে লাগল। চোখের কটাক্ষে সেই রং ফুটছে না। সুরের দোলায় দোলায় হাত উঠছে না তেমন করে।

এক ফাঁকে বাইরে এল। রাখহরি বলল, কী হয়েছে তোমার কেষ্ট?

কেন?

গলায় যে তোমার বয়সা ধরেছে।

বয়সা? হেসে উঠল ভামিনী। বলল, এ বয়সে আবার বয়সা কী বাবাজি? সে তো ছেলেমানুষের ধরে।

রাখহরি বলল, এ বয়সেও ধরে গো! গলায় তোমার দোঁআসলা জট পাকাচ্ছে কেন?

দোআঁসলা জট। আচমকা শীতের কাঁপ ধরে গেল যেন ভামিনীর বুকে।

হেসে বলল, একটু চা খেয়ে নিতে হবে।

রাখহরি ভামিনীর আপাদমস্তক তীক্ষ্ণ চোখে দেখে হঠাৎ মিষ্টি হেসে বলল, থাক না। এবার না হয় থাক। তোমার রাধাকে গাইতে দাও। দেখা যাক কেমন শিখেছে। রাখহরির চোখের দিকে তাকিয়ে ভামিনীর রাঙা শুকনো ঠোঁটও বেঁকে উঠল। কিন্তু গাইতে বলল রাধাকেই।

রাধা ভ্রূ তুলে, ঠোঁট ফুলিয়ে গাইল,

আমারে, অবলা পেয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে
বাঁধিলে পিরিতি ফান্দে।
অতি অভাগিনী কুট নাহি জানি
ফান্দ খোলে কি ছান্দে।

গলা একটু খরো। কিন্তু কাঁচা গলার চড়া সুরে, আর কাঁচা বয়সের কিশোরী ঠমকে আসর গুন গুন করে উঠল। কোথায় ছিল আসরের এই হাসি ও আনন্দাশ্রু।

অন্ধকার চেপে আসছে কৃষ্ণভামিনীর মুখে। তবু হাসছে। শীত, বড় শীত। গুড়গুড় করে কেঁপে কেঁপে উঠছে বুকের মধ্যে। কেন? চুলের মুঠি ধরে যাকে শিখিয়েছে, সেই রাধার গুণে বলিহারি যাচ্ছে সব। তার সুদের ঐশ্বর্য।

স্বয়ং মোহিনী মল্লিক মহাজন আশীর্বাদ করলেন ভামিনীকে, বাঃ বেশ! শুধু আখেরের স্বার্থে এমনটি শিখানো যায় না মা। তুমি, সত্যিকারের আখেরের কাজ করেছ।

বড় সুখ, তবু মুচড়ে মুচড়ে ওঠে বুক। কীর্তন গায়িকা কৃষ্ণভামিনী আর নেই, আখেরের কাজ আছে। এমন মহাজন কেন হল না ভামিনী, যে সুদের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে।

কেবল দুটো দিন গগন চুপচাপ খোল বাজাল। আর অপলক চোখে চেয়ে দেখল ভামিনীকে। যতবার চোখাচোখি হল, তার হ্যাংলামো দেখে ভামিনী বিরক্ত হয়ে ফিরিয়ে নিল মুখ। মরলে ওকে হাড় কখানা চিবুতে দিয়ে যাবে।

দুদিন পরে, গগন বিদায় নিল। বলে গেল, আবার আসবে মাঘেই।

ভামিনী মনে মনে বলল, পাছ ছাড়লে বাঁচি।

তারপর গান চলল আখড়ায় আখড়ায়। রাধা এবার ভাসিয়ে দিল নবদ্বীপ। যা গায়, সবই মানিয়ে যায়। একদিন কৃষ্ণভামিনীরও যেত। যা করত, যা বলত, যা গাইত, তাই ভাল লাগত লোকের। খরস্রোতা কৃষ্ণভামিনীকে দেখছে সে রাধার মধ্যে। সবাই রাধার পিছনে পিছনে।

রাত্রে রাধাকে বুকে নিয়ে আদর করল ভামিনী। বলল, রাধি, আমার মান রেখেছিস তুই, মান রেখেছিস।

বলতে বলতে চোখ ফেটে জল এল। রাধা অবাক হল। একটু বিরক্তও। বলল, এ আবার তুমি কী শুরু করলে বাপু। ঘুমোতে দেও।

ঘুমোতে দিল তাকে। নিজের হাতে ভাল করে কম্বল ঢেকে দিল। হয়, এমনটি হয়। এত জনে জনে, মহাজনে, সবাই মিলে চোখে মুখে তাকে বন্দনা করছে। হবে না। এক সময়ে কৃষ্ণভামিনীরও যে হয়েছিল।

আসরে আর ভাল করে ভামিনীকে কেউ সাধেও না। রোজ গাওয়াও হয় না তার। তবু আসরে থাকতে হয়, বসতে হয়।

বায়না পাওয়া গেছে কয়েকটি। বায়নার শর্ত রাধা, তবে কৃষ্ণভামিনীকেও চাই। চাই বইকী। সুদকে একলা ছাড়বে কী করে সে।

মাঘের শেষে এল আবার গগন। এসে দেখল, ভামিনীর চোখের কোলে কালি। মুখখানি শুকনো। চলতে ফিরতে, পিঠে ব্যথা, কোমরে ব্যথা। যেন এতদিনে সত্যি সত্যি বুড়ি হয়ে গেছে সে। পা ছড়িয়ে বসে। তেমন সাজাগোজা নেই। যেন মালীপাড়ার সুকী মাসি।

গগন বলল, শরীলটা তোমার খারাপ দেখছি যে।

মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল ভামিনী, শরীলটা ছাড়া বুঝি আর কিছু দেখতে পাও না ওই মরাখেগো চোখে।

গগন বলল, তাও দেখতে পাই।

কী দেখতে পাও?

তোমার দুঃখু।

মরে যাই আর কী! উনি এলেন আমার দুঃখু দেখতে, হুঁ!

তারপর হঠাৎ কি হল ভামিনীর। ভীষণ খেপে উঠল, বলল, গতরখেগো মিনসে, আর কবে ছাড়বে পেছন? মলে? তবে আগে মরি, তা পরে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়ো।

গগন একেবারে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। তাড়াতাড়ি বলল, আচ্ছা তাই হবে, তাই হবে, তুমি চুপ করো এখন।

বলে সরে পড়ল।

মাঘমাসের শেষ কটা দিন কাটিয়ে, যাত্রা শুরু হল। গুটি সাতেক বায়না আছে। কৃষ্ণনগরে, চোতখণ্ডে, রামপুরহাট, ধানবাদে, গোটা দেশটায় প্রায়।

সব জায়গাতেই সবাই ছুটে এল কৃষ্ণভামিনীর নাম শুনে। মুঠি ভরে পয়সা আর বাহবা দিয়ে গেল রাধাকে। তবে, কৃষ্ণভামিনীকেও বাহবা দিয়েছে সবাই। সে নইলে, এমন মেয়ে সাকরেদ আর কার হয়।

চোতখণ্ড অবধি সঙ্গে রইল গগন। ওখানেই কাছাকাছি তার জন্মভূমি। সে বিদায় চাইলে ভামিনী বলল, আগে বলোনি কেন? আমার খোল বাজাবে কে?

গগন বলল, পেটের ব্যবস্থা দেখতে হবে তো আমাকে। ট্যাঁক যে ফাঁক।

ভামিনী বিরক্ত হয়ে বলল, না হয় খেতেই দেব।

হলদে চোখে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল গগন, তা পারব না বাপু আমি। খোল বাজিয়ে জোগাড় করে দিয়ে যাচ্ছি।

সেইদিনই বর্ধমান শহর থেকে জুটিয়ে দিয়ে গেল একজনকে। ভামিনী ঠোঁট উলটে বলল, মুরোদ বড় মান তার ছেঁড়া দুটো কান। আপদ কোথাকার। ও আবার খাবে খোল বাজিয়ে।

পয়লা বৈশাখ ফিরে এল কৃষ্ণভামিনী আর রাধা। রোজগারে একটু ভাঁটা পড়েছিল কয়েকবছর। এবার সুদসুদ্ধ আদায় করে নিয়ে এসেছে ভামিনী। কিন্তু বুকের কাঁটার মতো একটা লোক পেছন নিয়েছে বর্ধমান থেকে। যত জায়গায় তারা গেছে, সব জায়গায় গেছে লোকটা। ভাবও হয়েছে খুব রাধার সঙ্গে। রাধার আসকারাতেই এখানেও ছুটে এসেছে।

বুকে বড় ধুকুপুতু ভামিনীর। গগনের মতো হলেও ভাল ছিল। কিন্তু লোকটি অল্পবয়সী, পয়সাওয়ালা উগ্ৰক্ষত্রিয় ঘরের ছেলে। সহজে ছাড়বে না। ভাব জমাবার চেষ্টা করছে ভামিনীর সঙ্গে। রাধার সঙ্গে পিরিত হয়েছে। একেবারে দূর দূর করতে পারেনি।

ফিরে এসে রাধা বলল, মাসি লোকটা কিন্তু দুদিন থাকবে এখানে।

ভামিনী গম্ভীর গলায় বলল, না।

রাধা ফুঁসে উঠল, হ্যাঁ, থাকবে।

অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কৃষ্ণভামিনী। কিন্তু সে তেজ নেই তার। নিস্তেজ গলায় বলল, মুখপুড়ি, বেশি অত্যাচার করলে গলাটা যে যাবে।

রাধা হুকুমের সুরে বলল, যাক। গলার জন্যে কি কারও ঘরে লোক আসা বাদ ছিল? অন্ধকার মুখে চুপ করে রইল ভামিনী। বুকটার মধ্যে পুড়তে লাগল চাপা আগুনে। চোখের মণিতে সে আগুন নেই। অঙ্গুলি সংকেতের সেই নির্দেশ নেই। রাজেন্দ্রাণী কৃষ্ণভামিনী নেই।

সারা বাড়ি মজা দেখল। রাধা আর তার লোকটিকে নিয়ে গুলজার করল সবাই। মালীপাড়ার বুড়ি ছুঁড়ি সবাই বলল, মাগীর তেজ একটু কমেছে।

 কীসের তেজ। কোনও তেজ তো কোনওদিন ভামিনী দেখায়নি কাউকে। সে যা, তাই তো সকলের কাছে তেজ।

গগন এল যথাপূর্বং। আসতে লাগল রোজ আগের মতোই। রাধার লোকটি বিদায় নিয়েছে। সব সময় ভামিনীর কথা মানে না রাধা। তবু, ঝগড়া করে, টেনে হিঁচড়ে তাকে নিয়ে বসে ভামিনী। গান গায়। খোল বাজায় গগন।

রাধাকে দেখাতে গিয়ে গলা খুলতেও লজ্জা করে কেন যেন ভামিনীর। সপ্তমে বাঁধা রাধার গলা টং টং করে বাজে। ভামিনীর গলা বেসুরো ঢ্যাবঢ্যাবে শোনায় সেখানে। অপ্রতিভ হয়ে খাঁকারি দেয়, আবার তোলে গলা। বলে, নে বল–

রাধা বলে, থাক বাবু, তুমি বরং একটু শুয়ে থাকোগে।

বলে উঠে যায়। কথা সরে না ভামিনীর মুখে। শুধু বসে থাকে চুপ করে। হঠাৎ একসময়ে খেয়াল হয়, মুখোমুখি খোল কোলে করে বসে আছে গগন। ভ্রূ কুঁচকে বলে, বসে আছ যে?

গগন বলে অপ্রতিভ হেসে, যদি এট্টু গাও, তা হলে বাজিয়ে যাই।

কে, আমি? রস যে প্রাণে ধরে না দেখছি। গাইব এবার ঘাটে গিয়ে, পালাও পালাও।

আরও একটি বছর গেল এমনি। রাধার সেই পিরিতের ছেলেটি এসেছে মাসে একবার করে। এ বছরও ঘুরেছে সঙ্গে সঙ্গে। সঙ্গে মালীপাড়ায়ও এসেছে। এবার ফিরে এসে রাধা দুদিন বাদেই বলল, মাসি আমি চলে যাব।

ধ্বক করে উঠল কৃষ্ণভামিনীর বুকের মধ্যে। চার বছর আগে রাখহরির কথায় এমনি ধ্বক করে উঠেছিল। গানের গলা নেই, আজ কথা বলবারও গলা নেই ভামিনীর। হাঁ করে তাকিয়ে রইল রাধার নির্বিকার দৃঢ় মুখের দিকে। খানিকক্ষণ পর বলল, কোথায় যাবি?

ওর সঙ্গে।

ওর মানে, সেই পিরিতের লোকটির সঙ্গে। বুকের মধ্যে কনকন করছে কৃষ্ণভামিনীর। পঞ্চম ঋতুর দারুণ শীতে নেমেছে হিমপ্রবাহ। গলা গেছে, গান গেছে, ধমক ঠমক গেছে। সুদ যাচ্ছে আজ, আসল খেয়ে গেছে কবে। মধুর ভটচাযরা কবেই ছেড়ে গেছে। টাকা পয়সা সোনাদানাও কিছু রানীর ঐশ্বর্য নেই। এ বয়সে আর কীসের বেসাতি করবে। কে আসবে এ ঘরে।

ভামিনী বলল, ভীত করুণ চোখে তাকিয়ে বলল কীর্তন গায়িকা কৃষ্ণভামিনী, যাবি মানে? তোকে খাইয়ে পরিয়ে বড় করলাম, শেখালাম পড়ালাম, আমাকে কোথায় রেখে যাবি?

রাধা বলল কটকট করে, খাইয়েছ পরিয়েছ বলে, আইন নেই যে, তুমি আমাকে চিরদিন ধরে রাখবে। মন চাইছে যাকে, তার সঙ্গেই চলে যাব।

মন চেয়েছে! এ বুঝি ভালবাসা। থিয়েটার বায়স্কোপে এমনি পিরিতের আজকাল নাকি বড় ছড়াছড়ি। কিন্তু দুদিনে যে তেজ ভেঙে যাবে। ঘরের বউ না, কুলটা। তোকেও যে একদিন এমনি করে এক রাধাকে খাওয়াতে পরাতে হবে।

গম্ভীর গলায় বলল ভামিনী, যা!

এমন আচমকা আর নির্বিকারভাবে বলল ভামিনী যে, রাধাও একমুহূর্ত থমকে রইল। কুঁকড়ে উঠল ঠোঁট দুটি।

ভামিনী বাইরের দরজার কাছে গিয়ে দক্ষিণ দিকে দেখল। একটা রিকশাওয়ালা যাচ্ছিল। তাকে বলে দিল, তোমাদের গগন রিকশাওয়ালাকে একটু ডেকে দিয়ো তো।

ওদিকে যাবার তাড়া লেগেছে। আর তিন ঘরের মেয়েরা সবাই হেসে কুটিপাটি হচ্ছে। খবর রটেছে সারা মালীপাড়া। সবাই একবার করে দেখতে আসছে রাধা আর তার নাগরকে। রাত দশটায় চলে যাবে ওরা।

ভামিনী বসেছিল বাতি জ্বালিয়ে। মনটা বড় গান করতে চাইছে, পারছে না ওদের কথার ফিসফিস খিলখিল হাসিতে।

একটু পরেই এল গগন। বলল, তুমি নাকি ডেকেছ?

ভামিনী বলল, হ্যাঁ। বলছিলাম, আমার একটা লোক দরকার। রোজগেরে লোক। আমাকে রাখতে পারে এই রকম।

কয়েক মুহূর্ত হাঁ করে চেয়ে রইল গগন। বৈশাখ মাস। সারা গায়ে ধুলো বালি গগনের। কালো মুখে ঘাম। তারপরে হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে হাসল গগন। অন্যদিকে চেয়ে বলল, তা আমাকে যদি বলো…এখনও রিকশাটা চালাই, রোজগারও হয়। আমি তোমার কাছে থাকতে পারি।

ভামিনী বলল, তোমার যদি মন চায়। থাকা তো নয়, আমাকে রাখাও বটে।

গগন বলল, তা তো বটেই। তবে আজকের রাত থেকেই থাকি?

কৃষ্ণভামিনীর চোখে যন্ত্রণা ও ঘৃণা। বলল, এসো।

খাওয়াটাও আজ থেকে তা হলে এখানেই হবে?

তাই হবে।

গগন বেরিয়ে গেল। ঘণ্টাখানেক পর ফিরে এল। একটু খাটো হলেও কোঁচা দিয়ে আজ ধুতি পরে এসেছে গগন। গায়ে ক্ষারে কাচা জামা, গলায় একখানি সুতির চাদর। পায়ে অবশ্য টায়ার কাটা স্যান্ডেলটিই আছে।

এই বেশে তাকে রিকশা চালিয়ে আসতে দেখে সবাই হইচই করে উঠল। ভামিনীর বাড়ির মেয়েরাও হেসে কুটিপাটি। ওমা! একি খোলুঞ্চি খুড়ো।

ও-দিকে যাবার সময় হল। বিদায় নিল রাধা, গগন আর ভামিনীর কাছ থেকে। ভামিনী নীরব। গগন বলল, সুখে থাকিস, বুঝে চলিস।

চলে গেল ওরা। তারপরে সবাই উকিঝুঁকি দিতে লাগল ভামিনীর ঘরে।

ভামিনী রান্না শেষ করল। চোখ না তুলে, মাটির দিকে চেয়ে আসন পেতে খেতে দিল গগনকে। খাওয়া হলে, গা ধুয়ে, ঘোয়া কাপড় পরে গগনের সামনে এসে দাঁড়াল। হাসবার চেষ্টা করছে, পারছে না। বুকটা বড় ধড়ফড় করছে। ঠাট বাট করতে হবে। কিন্তু রক্তে সে দোলা নেই। বয়সের ভারে অচল।

তবুও হেসে তাকাল চোখের চারপাশে কোঁচ পড়েছে। সেই চোখে অসহায় ইঙ্গিত। গগন হেসে মাথা নামাল।

দরজা বন্ধ করল ভামিনী। জানালা বন্ধ করল। বাতিটা কমাল, কিন্তু জ্বলতেই লাগল। সামান্য অস্পষ্টতা। তারপর কাছে এসে হাত ধরল গগনের।

গগন চমকে উঠে বলল, কই, হারমনিয়া পাড়লে না?

ঈষৎ বিরক্ত হয়ে বলল ভামিনী, কেন?

গাইবে না?

কৃষ্ণভামিনী বলল, শোবে না?

তেমনি অপ্রস্তুতভাবে হাসতে গিয়ে আজ প্রথম গগনের মুখটা বিকৃত হয়ে গেল। বলল, কেষ্টভামিনী, ওইটির জন্য তোমার কাছে আসিনি। তুমি যা দেবে, সব নেব। কিন্তু তুমি কেষ্টভামিনী। বলে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ঢোক গিলে বলল, তোমার কাছে থেকে বাজাব, তাই চেয়েছি এতকাল ধরে।

বিস্মিত সংশয়ে ফিরে তাকাল কৃষ্ণভামিনী। পরমুহূর্তেই চোখে জল এসে পড়ল তার। রুদ্ধগলায় বলল, কেন?

গগন বলল, বাবারে! সব ভুলে গেলাম। কেত্তন-গায়িকে কেষ্টভামিনীর গান শুনে, সে কি ভুলতে পারি? আজ যদি ডাকলে, এট্টু বাজাতে বলো আমাকে।

কে বলবে। কে কথা বলবে। হৃদয়ের সব গান আজ আর এক গানের রসে যে গলা বুজিয়ে দিয়েছে।

হারমোনিয়ম পেড়ে দিল গগন। শ্রীখোলটিতে কপাল ঠেকিয়ে কোলে নিয়ে বসল। বলল, গাও।

হারমোনিয়মে সুর উঠল। কৃষ্ণভামিনী সুর দিল। সুর উঠল স্বর উঠল। সেই স্বরে পঞ্চম ঋতু পেরিয়ে ষষ্ঠ ঋতুর বাতাস লাগল।

সারা মালীপাড়াটা প্রেতিনীর মতো ফিসফিস করে হাসতে লাগল, কেষ্টভামিনী আবার গাইছে গো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *