১১-১৫. তারপরও কিরীটী একটা সপ্তাহ

তারপরও কিরীটী একটা সপ্তাহ বাড়ি থেকে বের হল না।

একান্ত উদাসীন ও নিষ্ক্রিয়ভাবে সে তার সময় কাটাতে লাগল তাস নিয়ে পেসেন্স খেলে খেলেই।  

কিন্তু লক্ষ্য করেছিলাম, তাশ নিয়ে সর্বক্ষণ উদাসীন থাকলেও কিছু একটার প্রত্যাশায় যেন তার দেহের প্রতিটি ইন্দ্রিয় উন্মুখ হয়ে রয়েছে।

সমস্ত অনুভূতি তার যেন যাকে বলে সেতারের তারের মত চড়া সুরেই বাঁধা হয়ে আছে।

ঠিক এমনি সময় একদিন বেলা এগারোটা নাগাদ রীতিমত যেন হন্তদন্ত হয়ে নির্মলশিব এসে ঘরে প্রবেশ করল কিরীটীর।

কি আশ্চর্য! মিঃ রায়–

কিরীটী পূর্বের মতই তাস নিয়ে খেলছিল, সঙ্গে সঙ্গে মুখ তুলে হাতের তাসগুলো একান্ত অবহেলায় টেবিলের উপরে একপাশে ঠেলে দিয়ে, যেন আপাতত তার প্রয়োজন। ফুরিয়েছে, নিশ্চিন্ত দৃষ্টিতে নির্মলশিবের মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, কি, ইতিহাসের আবার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে-এই তো নির্মলশিব বাবু?

কি আশ্চর্য! ইতিহাস—

হ্যাঁ,–নির্বিকার ভাবেই পুনরাবৃত্তি করে কথাটা কিরীটী।

কি আশ্চর্য! সুব্রতবাবু, এক গ্লাস জল!

আমি দরজার কাছে উঠে গিয়ে জংলীকে এক গ্লাস জল দিতে বললাম।

জংলী জল আনার পর চো চো করে এক গ্লাস জল প্রায় এক টানেই নিঃশেষ করে নির্মলশিব বলে, আর এক গ্লাস।

জংলী শূন্য গ্লাসটা নিয়ে চলে গেল।

কিন্তু ততক্ষণে এক গ্লাস জল পান করে কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে নির্মলশিব।

সে বললে, আবার খুন হয়েছে আমার এলাকায় মিঃ রায়!

জানতাম হবে। নির্বিকার ভাবেই কিরীটী কথাটা বলে।

জানতেন?

হ্যাঁ, এবং আপনার কাছে সংবাদটা পেয়ে দুটো ব্যাপার অন্তত প্রমাণিত হল।

দুটো ব্যাপার?

হ্যাঁ।

মানে?

প্রথমত আপনার ঐ এলাকার সঙ্গেই যে স্বর্ণমৃগয়ার একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে আমার সেই অনুমানটা, এবং দ্বিতীয়ত খুব শীঘ্রই পূর্বের সেই হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঘটবে সেটা। বিশেষ করে যে সংবাদটার জন্য এই কয়দিন সত্যিই আমি অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু যাক সেকথা। নিহত ব্যক্তিটি কে—তার কোন পরিচয় পেলেন বা তাকে আইডেনটিফাই করতে পারা গিয়েছে?

না, তবে—

তবে কি?

লোকটার বাঁ হাতে হিন্দীতে উল্কি করে করে নাম লেখা আছে—

কি নাম লেখা আছে?

ভিখন—

কি, কি বললেন? কি নামটা বললেন? উত্তেজিত কণ্ঠে কিরীটী প্রশ্নটার পুনরাবৃত্তি করল।

ভিখন।

ভিখন?

হ্যাঁ।

লোকটার গায়ের রঙ কালো? আবার প্রশ্ন করল কিরীটী।

হ্যাঁ।

কপালে ডানদিকে একটা কাটা দাগ আছে?

আছে-কি আশ্চর্য!

নাকের উপর একটা আঁচুলি আছে?

আছে। কিন্তু কি আশ্চর্য। এসব কথা, মৃতদেহ সম্পর্কে এত ডিটেলস্ আপনি জানলেন কি করে? আপনি কি মর্গে গিয়ে ইতিমধ্যে মৃতদেহটা দেখে এসেছেন নাকি মিঃ রায়?

না, আপনিই তো দেখেছেন!

কি আশ্চর্য! তা তত দেখেছিই, কিন্তু আপনি এত সব জানলেন কি করে?

বাঃ, আপনিই তো বললেন সব! যাক সেকথা, কি ভাবে লোকটাকে হত্যা করা হয়েছে?

শ্বাসরুদ্ধ করেই অর্থাৎ স্ট্রাগল করেই অবিশ্যি তাকে হত্যা করা হয়েছে, তবে কি বলব মিঃ রায়, কি আশ্চর্য, কোন রকম ভাবে কোন স্লাঙ্গল করার কোন চিহ্নই গলায় নেই মৃতের।

পোস্টমর্টেমে বুঝি প্রমাণিত হয়েছে?

কি আশ্চর্য! পোস্টমর্টেম এখনও তো হয়ইনি। পুলিশ সার্জেনের তাই মত।

অভিমত! ও, তা মৃতদেহটা আবিষ্কৃত হল ঠিক কোথায়?

কালীঘাট ব্রিজের তলায়।

হত্যাকারীর তাহলে বলুন এখনও কিছুটা ধর্মভীতি রয়েছে।

কি আশ্চর্য। তার মানে?

এটা বুঝলেন না—সম্মুখেই পতিতোদ্ধারিণী মা গঙ্গা, আর হাত বাড়ালেই সর্বপাপহারিণী সর্বমঙ্গলা মা কালী। হত্যার পাপ যদি হয়েই থাকে, তাতেই স্থলন হয়ে গিয়েছে।

কথাগুলো বলে কিরীটী মৃদু হাসতে লাগল।

.

১২.

আমি কিন্তু তখনও রীতিমত অন্ধকারে হাতড়াচ্ছি।

মৃতের অনুরূপ কোন ব্যক্তিবিশেষকে স্মৃতির সাহায্যে মনের মধ্যে তোলপাড় করে খুঁজছি।

কিরীটী এমন সময় আবার কথা বললে, আপনার অনুসন্ধানের কাজটা তো এবার অনেক সহজ হয়ে এল নির্মলশিববাবু!

কি আশ্চর্য! সত্যি বলছি, দয়া করে আপনার হেঁয়ালি ছেড়ে সহজ করে যা বলবার বলুন।

সহজ করেই বলছি। কিন্তু তার আগে আপনার উপরে যে কাজের ভার দিয়েছিলাম, তার কি করলেন বলুন তো?

কোন কাজ?

বিশেষ কোন নম্বরের ট্যাকশির বা ভ্যানের ওভারসিজ লিঙ্কে যাতায়াত আছে কিনা সংবাদটা পেলেন কিছু?

না। গত কদিন ভিন্ন ভিন্ন নম্বরের অন্তত গোটা পঁচিশেক ট্যাকশি ও ভ্যান ঐ অফিসে যাতায়াত করতে দেখা গিয়েছে।

হুঁ। সোনার কারবারীরা খুবই সতর্ক আছে দেখছি। তবে টোপ যখন গিলেছে একবার, ফসকে যেতে নিশ্চয়ই পারবে না।

কি আশ্চর্য! টোপ গিলেছে!

হ্যাঁ। ভিখনের মৃত্যুটা সেই টোপ গেলবারই আকাট্য নিদর্শন।

নির্মলশিব তারপর আরও কিছুক্ষণ ধরে নানা ভাবে নানা প্রশ্ন করে কিরীটীর কাছ থেকে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার করে জানবার—যাকে বলে আপ্রাণ চেষ্টা করল, কিন্তু কিরীটী সেদিক দিয়েই গেল না আর।

নির্মলশিব যেন একটা বিষণ্ণই হয়ে পড়ে।

কিছুক্ষণ মুখ গোমড়া করে বসে থাকে।

অবশেষে একসময় বলে, আমি কিন্তু একজনকে অ্যারেস্ট করব বলে একপ্রকার স্থিরই করে ফেলেছি ইতিমধ্যে মিঃ রায়।

অ্যারেস্ট করবেন? কাকে? এতক্ষণে মুখ তুলে তাকাল কিরীটী, একটু যেন কৌতুকের সঙ্গেই।

আর্থার হ্যামিলটনকে। নির্মলশিব বললে।

সে কি! কেন?

আমার স্থির বিশ্বাস ওকে অ্যারেস্ট করলেই ঐ দলটার অনেক গোপন কথা পাওয়া যাবে।

সত্যিই পাওয়া যাবে মনে করেন?

নির্ধাৎ পাওয়া যাবে।

এ ধারণা আপনার কেন হল বলুন তো?

কেন?

হুঁ।

ও একটি বাস্তুঘুঘু।

বাস্তঘুঘু।

হ্যাঁ। ওকে চাপ দিলেই অনেক কিছু প্রকাশ হয়ে পড়বে। নির্ঘাত ও অনেক কিছু জানে।

কিরীটী প্রত্যুত্তরে এবারে হাসল।

কি আশ্চর্য। হাসছেন যে?

কারণ তাতে করে আপনি, যেটুকু এ কদিন এগিয়েছেন তার দশগুণ আপনাকে পিছিয়ে আসতে হবে।

কি আশ্চর্য! তাহলে আমি কি করব বলতে পারেন?

আজ নয়, তিনদিন বাদে আসুন এই সময়, বলব।

কি আশ্চর্য! কিন্তু

কিন্তু নয়। জানেন না, সবুরে মেওয়া ফলে। শনৈঃ শনৈঃ পর্বত লম্বন করতে হয়—শাস্ত্রের বচন।

অতঃপর কতকটা ক্ষুন্ন মনেই বেচারী নির্মলশিবকে সেদিনের মত বিদায় নিতে হল।

.

আরও আধ ঘণ্টা পরে।

সহসা কিরীটী গাত্রোখান করে বলল, চল্ সুব্রত, বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসা যাক।

বেলা তখন প্রায় বারোটা।

গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রের তাপে বাইরেটা তখন যে ঝলসে যাচ্ছে অনায়াসেই সেটা বোঝা যায় ঘরের মধ্যে বসেও।

বললাম, এই অসময়ে?

বেরুবার আবার সময় অসময় আছে নাকি? চল–ওঠ!

অগত্যা উঠতেই হল।

এবং ঐ প্রখর রৌদ্রতাপের মধ্যে বাইরে বের হয়ে পদব্রজেই কিরীটী নির্বিকারচিত্তে পথ অতিক্রম করে চলল এবং বলাই বাহুল্য আমাকেও তার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলতে হল।

হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য করলাম কিরীটী ওভারসিজ লিঙ্কের অফিসের দিকেই চলেছে।

তবু জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় চলেছিস?

পান খাব। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে হাঁটতে হাঁটতে বলে।

কিন্তু চলেছিস কোথায়?

বললাম তো পান খেতে।

পান?

হ্যাঁ, লোকটা–-মনে নেই পানওয়ালাটা চমৎকার পান সাজে রে, সেদিন চমৎকার লেগেছিল! বলতে বলতে হঠাৎ কিরীটী দাঁড়িয়ে যায়।

 দাঁড়ালি কেন?

না, কিছু না চল—চলতে শুরু করে আবার।

কয়েক পা চলে আবার কিন্তু দাঁড়ায়।

এবার মিনিট দুই-তিন দাঁড়িয়ে থেকে আবার চলতে শুরু করে।

ব্যাপারটা কিন্তু এবার কিছুটা অনুমান করেই পিছনে তাকালাম।

হাত দশ-পনেরো দুরে দেখি, একটি জীর্ণ বেশ পরিহিত পথের ভিক্ষুক লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

মৃদুকণ্ঠে এবারে কিরীটী বলল, ঐ ভিখিরীটা বোধহয় ভিক্ষে চায় না সুব্রত।

পুনরায় হাঁটতে শুরু করে এবং হাঁটতে হাঁটতেই কথাটা বলে কিরীটী।

তাই মনে হচ্ছে নাকি?  

হুঁ, সেই দোরগোড়া থেকেই একেবারে দেখছি অনুগত দেবর লক্ষ্মণের মতই আমাদের অনুগমন করে আসছে।

কথাটা কিরীটী বললে বটে, তবে মনে হল কিরীটী অতঃপর যেন আর পিছনের ভিখারীটার দিকে কোন মনোযাগই দিল না।

হাঁটতে লাগল।

ততক্ষণ আমরা পানের দোকানের কাছাকাছি এসে গিয়েছি।

কিন্তু আজ দেখলাম, পানের দোকানে অন্য একটি লোক বসে।  

কিরীটী ক্ষণকাল লোকটার দিকে তাকিয়ে বলে, চার আনার ভাল পান সেজে দাও তো।

মিঠা না সাদা পান বাবু?

মিঠা নয়, সাদা। জর্দা কিমাম দিয়ে দাও।

লোকটি পান সাজতে লাগল।

আড়চোখে লক্ষ্য করে দেখলাম সেই ভিখারীটা অল্পদূরে একটা লাইটপোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাত পেতে পথচারীদের কাছে ভিক্ষা চাইছে।

.

১৩.

কিরীটী অদূরবর্তী সেই ভিখারীর কথা উল্লেখ করার পর থেকেই আমার নজরটা সেই ভিখারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল।

কিরীটী যখন পানওয়ালার সঙ্গে কথা বলছে, আমার নজর তখন ভিখারীর প্রতিই নিবদ্ধ।

একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম।

হঠাৎ সেই সময় কিরীটীর চাপা কণ্ঠস্বরে চমকে উঠি।

সুব্রত!

কি?

ঐ ভিখারী সাহেবকে চিনতে পারছিস?

অ্যাঁ! কি বললি?

বলছি ঐ ভিখারী সাহেবটিকে চিনতে পারছিস?

সত্যি কথা বলতে কি, তখনই লোকটা ভিখারীর ছদ্মবেশে যে আসলে কে বুঝে উঠতে পরিনি বলেই সেই দিকেই তখনও তাকিয়ে ছিলাম।

এবার কিরীটীর কথায় অদূরে দণ্ডায়মান ভিখারীর দিকে ভাল করে তাকালাম আর একবার।

চেহারা দেখে লোকটার বয়স ঠিক ঠিক বোঝবার উপায় নেই।  

তবে মোটামুটি মধ্যবয়সী বলেই লোকটিকে মনে হয় ছদ্মবেশ থাকা সত্ত্বেও। পরিধানে একটা জীর্ণ সেলাই-করা মলিন ঝলমলে গরম প্যান্ট।

গায়ে অনুরূপ একটা টুইডের ওপন-ব্রেস কোট।

মাথায় একটা বহু পুরাতন জীর্ণ ফেল্ট ক্যাপ!

মুখভর্তি খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। হাতে একটা মোটা লাঠি।

ভিক্ষার জন্য পথচারীদের কাছে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকলেও সেটা যে একটা ভেক মাত্র সেটা এবারে লোকটার দিকে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবার পরই বুঝতে পারলাম।

এবং ভিক্ষাটা যখন একটা ভেক মাত্র, লোকটার পোশাক ও বাইরের চেহারাটার মধ্যেও যে ছল রয়েছে, সেটাও তো সহজেই অনুমেয়।

কিন্তু তবু যেন চিনতে পারলাম না লোকটাকে।  

এমন সময় কিরীটীর মৃদু আকর্ষণে ওর মুখের দিকে তাকাতেই নিম্নকণ্ঠে সে বললে, চ-গলাটা বড় শুকিয়ে গিয়েছে, সামনে ঐ পান্থ পিয়াবাস থেকে চা দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নেওয়া যাক।

আমি এবারে কিরীটীর প্রস্তাবে দ্বিরুক্তি মাত্রও না করে রাস্তা অতিক্রম করে অপর দিককার ফুটপাতের সামনের দোকানটার মুখোমুখি প্রায় চায়ের রেস্টুরেন্টের দিকে এগিয়ে চললাম।

এবং ঠিক যেন ঐ সময়েই একটা চকচকে ভ্যান আমাদের পাশ কাটিয়ে গিয়ে পাশের দোকানটার সামনে রাস্তার উপরে ব্রেক কষে দাঁড়াল।

ভ্যানটার গায়ে একটি নর্তকীর ছবি আঁকা ও তার মাথায় লেখা উর্বশী সিগারেট!

ভ্যানটা প্রায় আর একটু হলেই আমাদের চাপা দিয়ে যাচ্ছিল—এমন ভাবে গা ঘেঁষে গিয়েছিল।

যাই হোক, দুজনে এসে অপর ফুটপাতে পান্থ পিয়াবাস রেস্টুরেন্টের মধ্যে প্রবেশ করলাম।

ছোট রেস্টুরেন্ট, ঐ সময়টা প্রায় নির্জনই ছিল।  

মাত্র একটি চা-পিয়াসী লোক বসে বসে চা পান করছিল।

ঘর বলা যায় না—একটা চিলতে-মত জায়গায় রেস্টুরেন্টটি।  

সিলিং থেকে দুটি ঘূর্ণমান পাখা এবং দুটি পাখাই যে কতকালের পুরানো তার ঠিক নেই। ঘড়ং ঘড়ং একটানা শব্দ তুলে যেভাবে ঘুরছে তার তুলনায় হাওয়া কিছুই দিচ্ছে না।

 ছোট ঐ একচিলতে জায়গার মধ্যেই কাঠ ও চট সহযোগে একটা পার্টিশন দিয়ে চা ও অন্যান্য সব কিছু তৈরির ব্যবস্থা।

অর্থাৎ রেস্টুরেন্টের রন্ধনশালা বা প্যান।

আর বাকি অংশে মালিকের ছোট টেবিল ও টুলটি ছাড়া ছটি টেবিল ও প্রত্যেক টেবিলের সঙ্গে চারটি করে চেয়ার পাতা।

হোটেলের মালিকের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছিই হবে বলেই যেন মনে হল।

রীতিমত কৃষ্ণবর্ণ ও গোলালো মাংসল চেহারা লোকটার। গায়ে বোধ হয় একটা মার্কিনের পাঞ্জাবি।

ঘরে ঘূর্ণমান ইলেকট্রিক পাখা থাকা সত্ত্বেও হাতে একটি তালপাতার পাখা সবেগে চালনা করছিল লোকটা থেকে থেকে, কারণ লোকটা ঘেমে একেবারে স্নান করে যাচ্ছিল।

আমাদের রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করতে দেখেই সবেধন নীলমণি ছোকরা চাকরটি এগিয়ে আসে।

কি দেব বাবু?

দু কাপ চা দে। কিরীটী বললে।

রাস্তার দিকে মুখ করে দরজা ঘেঁষে একেবারে দুজনে বসলাম দুটো চেয়ার টেনে।

কিরীটীর দিকে চেয়ে দেখি সে যেন অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বাইরের দিকে।

এবং চেয়ে আছে—যেন মনে হল, রাস্তার অপর ফুটপাতের ধারে সামনের দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই উর্বশী সিগারেটের ভ্যানটার দিকেই।

আর ঐ সঙ্গে নজরে পড়ল, খাকী বুশ-কোট ও প্যান্ট পরিহিত—বোধ করি ঐ ভ্যানেরই ড্রাইভারটা, পাশের দোকানটার সমানে দাঁড়িয়ে দোকানদারের সঙ্গে কথা বলছে।

ছোকরা চাকরটা এসে দুকাপ চা আমাদের দুজনের সামনে টেবিলটার উপরে নামিয়ে দিয়ে গেল।

কিরীটীর কিন্তু যেন সেদিকে ভ্রূক্ষেপও নেই।

থেকে থেকে ওষ্ঠধৃত সিগারটায় টান দিতে দিতে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। বাইরের দিকে দেখলাম তখনও।

বললাম, কি দেখছিস?

উর্বশী সিগারেট খেয়েছিস কখনও সুব্রত? পালটা প্রশ্ন করে আমার প্রশ্নের জবাবে কিরীটী।

না। বললাম।

খেয়ে দেখ—এই নে, বলে পকেট থেকে সত্যি সত্যিই একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে দিল।

আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, সেদিন যে ঐ দোকান থেকে দু-তিন প্যাকেট সিগারেট ও কিনেছিল তারই একটা।

কি বলব ভাবছি

এমন সময় কিরীটী আবার বললে, তা যা-ই বলিস, সিগারেটের ব্যবসা কিন্তু লাভজনক।

বললাম, জানি।

লেকের ধারে একটা বিরাট নতুন বাড়ি হয়েছে দেখেছিলাম—

নজর করিনি, কোন বাড়িটার কথা বলছিস?

বিরাট চারতলা গেট ও লনওয়ালা বাড়িটার কথা বলছি। বাড়িটা শুনেছি এক বিড়ির ব্যবসায়ীর-হনুমানজী বিড়ি। কিন্তু–

কি?

মোহিনী বিড়ি, মহালক্ষ্মী বিড়ি, হনুমানজী বিড়ি, হাউইজাহাজ বিড়ি, রেলমার্কা বিড়ি নানা-ধরনের জিজ্ঞাপন দেখেছি, কিন্তু সিগারেট বলতে তো সবেধন নীলমণি ন্যাশন্যাল টোবাকো কোম্পানি। হঠাৎ উর্বশী সিগারেট যে কোথা থেকে এলেন বুঝতে তো পারছি না! তাছাড়া এর আগে ঐ নামটা চোখে পড়েছে বলেও তো মনে পড়ছে না।

তুই তো আর সিগারেট খাস না, খেলে হয়ত নজরে পড়ত।

তা বটে! অনেকগুলো প্যাকেট ভ্যান থেকে নামাচ্ছে দেখছি!

হুঁ। ব্যবসাটা বেশ জমে উঠেছে মনে হচ্ছে। তাই ভাবছি উর্বশীর আবির্ভাব কবে থেকে হল এ শহরে?

আমি ব্যাপারটায় আদৌ মনোযোগ দিইনি গোড়া থেকেই। তাই একটু হালকাভাবেই কথাগুলো বলছিলাম।

কিন্তু কিরীটীর পরবর্তী কথায় হঠাৎ যেন এতক্ষণে মনে হল আমার, কিরীটীর আজকের দ্বিপ্রহরের অভিযানটা ঐ পানের দোকানটিকে কেন্দ্র করেই।

এবং এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, এই খর রৌদ্রতাপেও কিরীটীকে ঐ পানের দোকানটিই ঘরের বাইরে টেনে এনেছে।

কিন্তু নিশ্চয়ই তোর সীতা মৈত্র—আমাদের সেক্রেটারি দিদিমণি সিগারেট খায় না সুব্রত!

বলাই বাহুল্য, কিরীটীর ঐ কথার সঙ্গে সঙ্গেই আমার দৃষ্টি পানের দোকানটার প্রতি আকৃষ্ট হয়।

দেখলাম, আশ্চর্য, সত্যিই সীতা মৈত্রই তো!!

কাঁধে একটা র‍্যাশন ব্যাগের মত ব্যাগ ঝুলিয়ে পানের দোকানটার দিকে চলেছে ছাতা মাথায় দিয়ে।

সেই দিকেই তাকিয়ে রইলাম।

সীতা মৈত্র সোজা উর্বশী সিগারেট ভ্যানটার মধ্যে উঠে বসল এবং সঙ্গে সঙ্গেই ভ্যানটা ছেড়ে দিল।

ব্যাপারটা যেমনি বিস্ময়কর তেমনি আকস্মিক।

অতঃপর কিংকর্তব্য! মনে মনে বোধ হয় নিজের অজ্ঞাতেই তাই ভাবছিলাম।

হঠাৎ ঐ সময় আবার কিরীটীর কথায় চমকে উঠলাম, তোর নাম কি রে?

চেয়ে দেখি কিরীটীর সামনে দাঁড়িয়ে তখন রেস্টুরেন্টের সবেধন নীলমণি ছোকরাটি।

এজ্ঞে গদাই।

গদাই কি?

এজ্ঞে ঢোল।

কত মাইনে পাস এখানে?

এজ্ঞে কিছুই না।

হঠাৎ সেইসময় হোটেলের মালিকের গর্জন শোনা গেল, এই গদাই, এদিকে আয়!

গদাই তাড়াতাড়ি মনিবের ডাকে এগিয়ে গেল।

ওঠ সুব্রত। কিরীটী মৃদু হেসে বললে।

কোথায় যাবি?

কোথায় আবার যাব–বাড়ি যেতে হবে না?

রেস্টুরেন্টের দাম মিটিয়ে দিয়ে দুজনে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম।

কয়েক পা অগ্রসর হতেই একটা খালি ট্যাকশি পাওয়া গেল।

হাত-ইশারায় ট্যাকশিটা থামিয়ে কিরীটী আমাকে নিয়ে ট্যাকশিতে উঠে বসল।

পথে কিরীটী একেবারে চুপ করে বসে রইল চলন্ত ট্যাকশির মধ্যে।

বুঝলাম গভীরভাবে কিছু একটা ও চিন্তা করছে।

এসময় কোন প্রশ্ন করলেও জবাব মিলবে না।

.

১৪.

দিন দুই পরে একদিন দ্বিপ্রহরে।

কিরীটীর বাড়িতেই তার ঠাণ্ডাঘরে বসে কৃষ্ণার সঙ্গে গল্প করছিলাম।

গত পরশু সকালে কিরীটী কৃষ্ণাকে বলে গিয়েছে বর্ধমানে সে যাচ্ছে একদিনের জন্য। কিন্তু দুইদিন হতে চলল প্রায় তার এখনও দেখা নেই।

কৃষ্ণার সঙ্গে সেই আলোচনাই হচ্ছিল।

হঠাৎ তার বর্ধমানে কি দরকার পড়ল? শুধালাম আমি।

তা তো কিছু বলে যায়নি। কৃষ্ণা জবাব দেয়।

নির্মলশিববাবুর ব্যাপারেই গেল নাকি?

কে জানে!

ঐ দিনই বেলা তিনটে নাগাদ কিরীটী ফিরে এল।

শুধালাম, হঠাৎ বর্ধমান গিয়েছিলি যে?

এই ঘুরে এলাম। একটা সোফার উপরে বসতে বসতে কিরীটী জবাব দেয়।

তাই তো জিজ্ঞাসা করছি, হঠাৎ সেখানে কি কাজ পড়ল?

কাজ তেমন কিছু নয়, শ্বশুরবাড়ির দেশটা দেখে এলাম।

কার–-কার শ্বশুরবাড়ির দেশ?

তিলোত্তমার। কিন্তু সখি—এবারে কিরীটী কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বললে, রন্ধনশালায় কিছু কি অবশিষ্ট আছে?

আছে।

তাহলে স্নানটা সেরে নিই।

কিরীটী উঠে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল।  

কিরীটী মুখ খুলল আহারাদির পর। আমি, কৃষ্ণা ও কিরীটী তিনজনে তখন ঠাণ্ডাঘরে এসে বসেছি।

গভীর জলের মাছ-এইটুকু বোঝা গেল আজ। হঠাৎ কিরীটী একসময় বললে।

কিরীটীর খাপছাড়া কথায় ওর মুখের দিকে তাকালাম।

কিরীটী ওষ্টধৃত পাইপটায় একটা টান দিয়ে, পাইপটা হাতে নিয়ে এবার বললে, বেচারী নির্মলশিব তাই কোন হদিস করতে পারেনি!

তুই আহলে হদিস করতে পেরেছিস, বল? প্রশ্ন করলাম আমি।

পুরোপুরি হদিস করতে পারিনি বটে তবে মোটামুটি রাস্তাটা—মনে হচ্ছে বোধ হয় খুঁজে পেয়েছি।

রাস্তা।

হ্যাঁ, চারটে ঘাঁটির সন্ধান পেয়েছি কিন্তু শেষ অর্থাৎ পঞ্চম ঘাঁটিটা কোথায় সেটা জানতে পারলেই কিভাবে কোথা দিয়ে চোরাই সোনার লেন-দেনটা হয় জানতে পারতাম।

চারটে ঘাঁটির সন্ধান পেয়েছ! কৃষ্ণা প্রশ্ন করে এবার।

হ্যাঁ, এক নম্বর ঘাঁটি হচ্ছে ওভারসিজ লিঙ্ক, দু নম্বর চায়না টাউন, আর তৃতীয় ঘাঁটি পানের দোকানটি এবং অনুমান যদি আমার ভুল না হয় তো চতুর্থ ঘাঁটি হচ্ছে পান্থ পিয়াবাস। অবিশ্যি স্বীকার করতেই হবে, খুব planned way-তে কারবারটা চলছে যাতে করে কোনক্রমে কোন দিক থেকে তাদের উপরে সন্দেহ না জাগে কারও বিন্দুমাত্রও।

কিরীটীর কথার মধ্যে ঐ সময় ঘরের কোণে রক্ষিত ফোনটা ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠল।

কিরীটীই তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ফোনটা ধরল, হ্যালো! কে, বাজোরিয়া? হ্যাঁ,–রায় কথা বলছি। পাওয়া গিয়েছে। Good-সুসংবাদ। আজ থেকেই তাহলে ফ্ল্যাটটা পাওয়া যাবে বলছ! তবে আজই যাব! হা হা-আজই। সব ব্যবস্থা করে ফেল। ঠিক আছে।

কিরীটী ফোনটা নামিয়ে রেখে এসে পুনরায় সোফায় বসল।

কি ব্যাপার, কে ফোন করেছিল? কি ফ্ল্যাটের কথা বলছিলে ফোনে? কৃষ্ণা শুধায়।

ওভারসিজ লিঙ্কের উপরে একটা খালি ফ্ল্যাট পাওয়া গিয়েছে। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বলে।

ওভারসিজ লিঙ্কের উপর খালি ফ্ল্যাট!

হ্যাঁ।

তা হঠাৎ ফ্ল্যাটের তোমার কি প্রয়োজন হল?

এক বাড়িতে বেশি দিন থাকা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল নয়। তাই একটু বাসা বদল আর কি।

মানে সেখানে তুমি যাচ্ছ?

হ্যাঁ, একটা সুটকেসে কিছু জমা-কাপড় আর বেডিং তৈরি করে রাখ।

কি হেঁয়ালি শুরু করলে বল তো! বলে কৃষ্ণা।

বাঃ, ঐ দেখ! হেঁয়ালি এর মধ্যে কি দেখলে? দিনকতক গিয়ে এই ফ্ল্যাটটায় থাকব একটু নিরিবিলিতে ভাবছি।

ফ্ল্যাটটায় থাকবে!

হ্যাঁ, অবিশ্যি একা নয়,–সহ সুব্রত।

আমি? প্রশ্নটা করে আমি কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম।

কি আশ্চর্য, নিশ্চয়ই তুই! কি আশ্চর্য! নির্মলশিবকেও অবশ্যি নেওয়া যেত কিন্তু ভিখারী সাহেবের চক্ষুকে কি ফাঁকি দিতে পারবে নির্মলশিববের ঐ বিশেষ প্যাটার্নের চেহারাটা?

কোন আর প্রতিবাদ করলাম না। কারণ বুঝতে পেরেছি তখন, সবটাই কিরীটীর পূর্বপরিকল্পিত।

এবং এও বুঝতে পেরেছি, ওর সঙ্গে গিয়ে আমাকে সেই ফ্ল্যাটে আপাতত কিছু দিন থাকতে হবে। কেন যে তার মাথায় হঠাৎ ঐ পরিকল্পনার উদ্ভব হয়েছে তারও কোন উত্তর যে আপাতত ওর কাছ থেকে পাওয়া যাবে না তাও জানি।

তাই বললাম, তাহলে আমি উঠি!

উঠবি? ব্যস্ত কেন, বোস্।

বাঃ, তোর সঙ্গে যেতে হবে বললি!

হ্যাঁ, সে তো রাত এগারোটায়। এখন বোস, সন্ধ্যানাগাদ বের হয়ে যাবি, তারপর রাত ঠিক এগারোটায় গিয়ে হাজির হবি ৫নং ফ্ল্যাটে।

কিন্তু–

আমি থাকব। অতএব কিন্তুর কোন প্রয়োজন নেই।

তুই কখন যাবি?

যথাসময়ে।

.

বলাই বাহুল্য ওভারসিজ লিঙ্কের ফ্ল্যাটে গিয়ে না উঠলে এই ব্যাপারের গুরুত্বটা সত্যিই বোধ হয় অত শীঘ্র উপলব্ধি করতে পারতাম না।

আর সেখানে না গেলে অত তাড়াতাড়ি সীতা মৈত্রর পরিচয়টাও পেতাম না।

অথচ সীতা মৈত্রের পরিচয়টা জানা যে আমাদের কতখানি প্রয়োজন ছিল সেটা পরে বুঝতে পেরেছিলাম।

আর এও বুঝেছিলাম, সেবারে কিরীটীর সূক্ষ্ম দৃষ্টি কতদূর পর্যন্ত দেখতে পায়।

যাক যা বলছিলাম—

রাত এগারোটা বেজে ঠিক সাত মিনিটে গিয়ে ৫নং ফ্ল্যাটে পৌঁছাতেই দরজা খুলে গেল।

কিরীটী পূর্ব হতেই তার কথামত ফ্ল্যাটে উপস্থিত ছিল। সে আহ্বান জানাল, আয়।

ভিতরে প্রবেশ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠবার সময় যথাসম্ভব বাড়িটার গঠনকৌশল ও প্ল্যান দেখে নিয়েছিলাম।

প্রায় সাত কাঠা জায়গার উপরে বাড়িটা।

ভিতরে একটা চতুষ্কোণ বাঁধানো আঙিনা।

সেই আঙিনার দক্ষিণদিকে সোজা খাড়া প্রাচীর দোতলা পর্যন্ত উঠে গেছে।

সেই প্রাচীরের ওপাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে একটা টিনের শেড দেওয়া মোটর রিপেয়ারিংয়ের কারখানা।

তারপরেই তিনতলা দুটো বাড়ি পাশাপাশি।

ঐ দুটো বাড়ির মধ্য দিয়ে অপ্রশস্ত কাঁচারাস্তা কারখানায় প্রবেশের। সেই বাড়ি দুটো রাস্তার উপর।

রাস্তা থেকে বুঝবারও উপায় নেই যে বাড়িটার দক্ষিণদিকে অতখানি জায়গা নিয়ে একটা অমন বিরাট গাড়ি মেরামতের কারখানা রয়েছে।

পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিম দিকে পর পর সব ফ্ল্যাট।

এক এক তলায় ছটি করে ফ্ল্যাট।

এক-একটি ফ্ল্যাটে তিনখানি করে ঘর—পরে জেনেছিলাম, বাথ ও কিচেন ছাড়া।

তিনদিকেই অর্থাৎ পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিমে বারান্দা এবং বারান্দার গায়ে গায়ে ফ্ল্যাটগুলো।

সিঁড়িটা বরাবর পূর্ব-উত্তর কোণ দিয়ে উপরে উঠে গিয়েছে।

বারান্দায় দাঁড়ালে নিচের বাঁধানো আঙিনাটা দেখা যায়।

আঙিনার অর্ধেকটায় মোটা ও ভারী ত্রিপল খাটানো। দোতলা ও তিনতলার মত আঙিনার তিনদিকে নিচেও বারান্দা আছে।

নিচের তলায় উত্তর ও পশ্চিম দিকে গোটাচারেক যে ঘর ছিল সে ঘরগুলোও ওভারসিজ লিঙ্কের ভাড়া নেওয়া।

পরে অবিশ্যি জেনেছিলাম সে কথাটা।

অর্থাৎ বাইরে রাস্তা থেকে যে ওভারসিজ লিঙ্কের অফিস দেখা যায় সেটাই সবটা নয়, ভিতরেও অনেকটা অংশ জুড়ে তাদের কারবার।

.

৫ নং ফ্ল্যাটের ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখি, আকারে ঘরটা বেশ বড়ই।

একদিকে দুটো খাট পাতা, খাটের উপরে সজ্জা বিছানো।

একধারে একটি টেবিল ও দেওয়াল-আলমারি।

ঘরের মাঝখানে একটা ক্যামবিসের আরামচেয়ারে বসে, সামনে ছোট একটা চতুষ্কোণ টুলের উপরে তাস বিছিয়ে কিরীটী বোধ হয় পেসেন্স খেলছিল।

আমাকে দরজা খুলে দিয়ে পুনরায় গিয়ে বসে পেসেন্স খেলার দিকে মন দিল।

দরজা বন্ধ কর দে সুব্রত। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী বললে।

দরজাটা খোলাই ছিল, এগিয়ে গিয়ে ভিতর থেকে ছিটকিনি এঁটে দিলাম।

ঘরের সামনে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেই সামনের বড় ট্রামরাস্তাটা এদিক থেকে ওদিক বহুদূর পর্যন্ত চোখে পড়ে।

বারান্দাটা একবার ঘুরে অন্য ঘর দুটোও একবার দেখে নিলাম।

বাকি দুটো ঘর খালি।

ফিরে এলাম আবার কিরীটী যে ঘরে বসে বসে তাস নিয়ে পেসেন্স খেলছিল সেই ঘরে।

.

১৫.

আরও কিছুক্ষণ পরে ঐ রাত্রেই।  

কিরীটী কিন্তু তখনও দেখি বসে বসে একমনে পেসেন্স খেলছে। হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি রাত সাড়ে এগারোটা বাজে।

কি রে, তোর ব্যাপার কি বল তো? জিজ্ঞাসা করি কিরীটীকে।

কেন? মাথা না তুলেই জবাব দেয় কিরীটী।

না, তাই জিজ্ঞাসা করছি। এখানে এলি কি পেসেন্স খেলবার জন্যে।

তাস সাজাতে সাজাতে কিরীটী বললে, একেবারে মিথ্যে বলি কি করে, কতকটা তাই বটে।

মানে?

বেশ নিরিবিলি, বসে বসে রাত কাবার করে দিলেও কারও আপত্তির কিছু থাকবে না। তুই যদি দেখতিস-ইদানীং কৃষ্ণা কি রকম খিটখিট করে তাস হাতে দেখলেই! সে যাক গে, তোর আপত্তি থাকলে—ঘণ্টাখানেক তুই ঘুমিয়ে নিতে পারিস!

ঘুমিয়ে নেব–মানে?

ঘুমোবি! ঘুমের ঘুম ছাড়া অন্য কোন মানে আছে নাকি?

হ্যাঁ, শুয়ে পড়।

আর তুই বুঝি বসে বসে পেসেন্স খেলবি?

কি করি ব! পেসেন্স খেললে তবু জেগে থাকতে পারব।

বুঝলাম কিরীটী আপাতত জেগে থাকতেই চায়—তা সে যে কারণেই হোক না কেন।

আমি আর কোন কথা না বলে রাস্তার ধারের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম।

রাত্রি গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় রাস্তাও নির্জন হয়ে আসছে।

রাস্তায় পথিকের চলাচল কমে এসেছে।

গ্রীষ্মের রাত, নচেৎ এতক্ষণে রাস্তা হয়ত একেবারে নির্জন হয়ে যেত।

হঠাৎ ঐ সময় নজরে পড়ল, রাস্তার ওদিকে পান্থ পিয়াবাস রেস্টুরেন্টটা তখনও খোলা আছে।

ভিতরে এখনও আলো জ্বলছে এবং দরজা এখনও খোলা।

এত রাত্রেও পাপিয়াবাসের অর্গল খোলা! এখনও কি খরিদ্দারের আশা করে নাকি!

পানের দোকানটা এই ফুটপাতে হওয়ায় বোঝা যায় না ওখান থেকে যে, ওটা খোলা। কি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

মধ্যে মধ্যে ট্যাকশি ও প্রাইভেট গাড়িগুলো রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছে, তবে সংখ্যাটা অনেক কম।

রিকশারও টুং-টুং শব্দ শোনা যায়।

রাস্তার দুধারের সমস্ত দোকানই বন্ধ।

গ্রীষ্মের রাত-রাস্তায় খাটিয়া পেতে সব শোবার ব্যবস্থা করছে।

ঝিরঝির করে বেশ একটা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছিল।

তাছাড়া দিনের বেলায় ও রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত মানুষের চলাচলে, যানবাহনের ভিড়ে, নানাবিধ শব্দে গমগম-করা সেই রাস্তা যখন নির্জন হয়ে যায় তার দিকে তাকিয়ে থাকতে কেমন যেন একটা নেশা ধরে।

তাই বোধ হয় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম।

একসময় খেয়াল হতে তাড়াতাড়ি ঘরে এসে ঢুকলাম, কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখি ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে।

টেবিলটার তাস সাজানো রয়েছে কিন্তু কিরীটী ঘরে নেই।

কোথায় গেল কিরীটী?

পাশের ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটা খোলাই ছিল। সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম ঘরটা অন্ধকার।

সদর দরজার দিকে তাকালাম, সেটা কিন্তু বন্ধ।

বাথরুমেই হয়ত গিয়েছে—মনে করে শয্যায় এসে বসলাম।

কিন্তু পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট করে আধ ঘণ্টা কেটে গেল, কিরীটীর দেখা নেই।

এতক্ষণ কারও বাথরুমে লাগে নাকি!

শয্যা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি এমন সময় পাশের অন্ধকার ঘরটা থেকে কিরীটী বের হয়ে এল।

কোথায় ছিলি রে?

ছাদে গিয়েছিলাম।

ছাদে।

হ্যাঁ, দেখছিলাম বাথরুমে যাতায়াত করবার জন্য সুইপারদের যে ঘোরানো লোহার সিঁড়িটা আছে সেই সিঁড়িটা দিয়ে সোজা ছাতে চলে যাওয়া যায়। রাত নটার সময় এসে ঘুরে ফিরে দেখতে দেখতেই অবশ্য সব জানা হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু এত রাত্রে ছাতে গিয়েছিলি হঠাৎ?

উর্বশীর খোঁজে।

উর্বশী?

হ্যাঁ রে—সেদিনকার সেই সিগারেট উর্বশীর খোঁজে!

ছাতে উর্বশীর খোঁজে গিয়েছিলি মানে?

বোস, তোকে তাহলে সব বলি।

সাগ্রহে শয্যাটার উপর আবার বসলাম।

.

কিরীটী বলতে লাগল, ছাতে গেলেই তোর চোখে পড়বে এই বাড়ির পিছনে একটা গ্যারাজ ও মোটর রিপেয়ারিংয়ের কারখানা আছে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি ওটার নাম হচ্ছে। লাটুবাবুর গ্যারাজ ও মোটর রিপেয়ারিং শপ। অবিশ্যি খোঁজটা দিয়েছিল নির্মলশিবের লোকই।

নির্মলশিবের লোক! মানে তুই তাহলে তাকে খোঁজ নিতে বলেছিলি?

অবশ্যই। যাক শোন, কিছু দূরপাল্লার মালবাহী লরির গ্যারাজও ঐ লাটুবাবুর গ্যারাজটা। কলকাতা টু পুরুলিয়া, কলকাতা টু হাজারীবাগ ইত্যাদি প্লাই করে। নির্মলশিবের সেই নিযুক্ত লোকটি বেশ বুদ্ধিমান। চোখ খুলেই সে সব দেখেছিল। এবং সে-ই আমাকে খবর দেয় উর্বশী সিগারেটের একটা ভ্যানও নাকি ঐ গ্যারাজেই থাকে।

উর্বশী সিগারেটের ভ্যানটার কথা তাহলে তুই আগে থাকতেই জানতিস?

না।

তবে?  

তুই আসার ঘণ্টাখানেক আগে এখানে এসে সে আমাকে ঐ খবরটা দিয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, আরও একটা খবর সে দিয়ে গিয়েছে।

কি?

ঐ ভ্যানটি ছাড়া উর্বশী সিগারেটের অন্য কোন ভ্যানের নাকি অস্তিত্বই নেই। যাই হোক, তাই দেখতে গিয়েছিলাম ছাত থেকে উর্বশী সিগারেটের ভ্যানটা গ্যারাজে ফিরে এসেছে কিনা।

দেখতে পেলি?

পেয়েছি। কিন্তু আজ রাত অনেক হল, আর না। এবারে একটু ঘুমোবার চেষ্টা করা যাক।

সে রাত্রের মত আবার কিরীটী মুখ বন্ধ করল।