০৬-১০. বসলাম পাশাপাশি দুজনে দুটি চেয়ারে

বসলাম পাশাপাশি দুজনে দুটি চেয়ারে।

আজও মনে আছে, রূপ অনেক এ পোড়া চোখে পড়ছে কিন্তু রূপের সঙ্গে বুদ্ধির ওরকম খর্য সত্যিই বুঝি আর চোখে পড়েনি।

কিরীটী ফেরার পথে আমার প্রশ্নের উত্তরে সেদিন বলেছিল, তিলোত্তমা!

সত্যিই তিলোত্তমা।

আপনাদের কি করতে পারি বলুন? পুনরায় তরুণী প্রশ্ন করল।

আপনাদের ম্যানেজারের সঙ্গেই আমার দরকার ছিল।

মিঃ মল্লিক তো এখন নেই, আপনি তা হলে কাল দুপুরের দিকে আসুন। তবে কোন অর্ডার-সাপ্লাইয়ের ব্যাপার হলে আমাকে বলতে পারেন।

অবশ্য অর্ডার-সাপ্লাইয়ের ব্যাপারই। তবে—

কি সাপ্লাই করতে হবে?

আমার নিজস্ব একটা ছোটখাটো কেমিকেলের কারখানা আছে। তাই কিছু অর্ডার আমি ফরেন থেকে পেয়েছি। আপনাদের থু দিয়ে সেটা আমি সাপ্লাই করতে চাই।

ও! তা সেরকম কোন সাপ্লাই তো আমরা করি না।

অবশ্যই আপনাদের আমি একটা ওভার-রাইডিং কমিশন দেব।

আপনি বরং কাল এসে ম্যানেজার মিঃ মল্লিকের সঙ্গেই দেখা করবেন।

বেশ, তাই করব। আমাদের কথাটা তাহলে তাকে বলে রাখবেন।

কি নাম বলব। তরুণী প্রশ্ন করে।

কিরীটী কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল, বাইরে পুরুষকণ্ঠে একটা বচসা শোনা গেল।

আরে রেখে দে তোর সেক্রেটারি দিদিমণি! ঘরে লোক আছে, দেখা করবে না! তার বাপ দেখা করবে, চোদ্দ পুরুষ করবে—হামভি আর্থার হ্যামিলটন হ্যায়!

সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম আমাদের সামনে উপবিষ্টা তরুণীর মুখ থেকে অমায়িক ভাবটা যেন মুহূর্তে নির্বাপিত হয়ে গেল।

.

সমস্ত মুখখানা তো বটেই এবং দেহটাও সেই সঙ্গে যে কঠিন ঋজু হয়ে উঠল।

পাশ থেক একটা প্যাড ও পেনসিল তুলে নিয়েছিল। তরুণী ইতিমধ্যে, বোধ করি কিরীটীর নামটাই টুকে নেবার জন্য, হাতের পেন্সিল হাতেই থেকে গেল।

পরমুহূর্তেই একটা দমকা হাওয়ার বেগে ঘরের সুইংডোর ঠেলে খুলে যে লোকটি ঠিক ভগ্নদূতের মতই ভিতরে এসে প্রবেশ করল সে দর্শনীয় নিঃসন্দেহে।

 আমরা যে ঘরের মধ্যে বসে আছি তা যেন ভ্রক্ষেপ করল না।

তীক্ষ্ণকণ্ঠে সামনের চেয়ারে উপবিষ্ট তরুণীকে সম্বোধন করে বললে, আমি জানতে চাই সীতা, তুমি আমার ওখানে ফিরে যাবে কিনা? Say–yes or no?

আগন্তুককে দেখছিলাম আমি তখন।

ঢ্যাঙা লম্বা চেহারা।

একমুখ দাড়ি, ঝোড়ো কাকের মত একমাথা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, তৈলহীন রুক্ষ।

ডান কপালে দীর্ঘ একটা ক্ষতচিহ্ন।

নাকটা তরোয়ালের মত যেন ধারাল, তীক্ষ্ণ।

পরিধানে একটা জীর্ণ মলিন ক্রি-ভাঙা কালো গরম কোট ও অনুরূপ সাদা ময়লা জিনের প্যান্ট। গলায় লাল বুটি-দেওয়া পুরাতন একটা টাই।

আরও চেয়ে দেখলাম, তরুণীর মুখখানা অসহ্য ক্রোধে আর আক্রোশে যেন সিঁদুরবর্ণ ধারণ করেছে।

আগন্তুক আবার বললে, say–yes or no!

বেয়ারাটাও ইতিমধ্যে আগন্তুকের সঙ্গে সঙ্গেই তার পিছনে ঘরে এসে ঢুকেছিল।

বেচারী মনে হল যেন আকস্মিক ঘটনায় একটু হতভম্ব হয়েই নির্বাক হয়ে গিয়েছে।

সহসা তরুণী সেই হতভম্ব নির্বাক বেয়ারার দিকে তাকিয়ে বললে, এই, হাঁ করে চেয়ে দেখছিস কি? দারোয়ানকে ডাক?

সঙ্গে সঙ্গে খিঁচিয়ে উঠল আগন্তুক যেন, কি, দারোয়ান দেখাচ্ছ! আর্থার হ্যামিলটনকে আজও চেনোনি সুন্দরী। সব ফাঁস করে দেব। সব একেবারে চিচিং ফাঁক করে দেব।

সহসা ঐ সময় পিছনের সুইংডোরটা আবার খুলে গেল এবং স্ল্যাক ও হাফশার্ট পরিহিত বিরাট দৈত্যাকৃতি একজন লোক এসে যেন অকস্মাৎ ঘরের মধ্যে ঢুকল ও বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে ডাকল, আর্থার।

সঙ্গে সঙ্গে জোকের মুখ যেন নুন পড়ল।

.

হ্যামিলটন সাহেব সেই ডাকে ফিরে দাঁড়িয়ে আগন্তুকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ক্ষণপূৰ্ব্বের এত হম্বিতম্বি যেন দপ্ করে নিভে গেল।

মুহূর্তে যাকে বলে একেবারে যেন চুপসে গেল মানুষটা।

ইয়ে–স স্যার–র–

কথাটা বলতে গিয়ে তোতলায় হ্যামিলটন।

কাম অ্যালং! তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

প্রভুভক্ত কুকুর যেমন প্রভুর ডাকে তাকে অনুসরণ করে, ঠিক তেমনি করেই যেন মাথা নিচু করে নিঃশব্দে সেই দৈত্যাকৃতি আগন্তুকের সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয় গেল হ্যামিলটন।

দেখলাম সেক্রেটারি দিদিমণি যেন কেমন বিব্রত ও থতমত খেয়ে বসে আছে।

আকস্মিক যে এমনি একটা ব্যাপার ঘটে যাবে, বেচারীর যেন ক্ষণপুর্বে স্বপ্নেরও অগোচর ছিল।

কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বললে, তাহলে আমরা আজকের মত আসি!

তরুণী যেন চমকে ওঠে। বলে, অ্যাঁ, যাবেন?

হ্যাঁ! আমরা চলি।

বেশ।

অতঃপর কিরীটীর নিঃশব্দ ইঙ্গিতে কিরীটীর পিছনে পিছনে আমি ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।

কিউবিকলের বাইরে এসে এদিক ওদিক তাকালাম, কিন্তু সেই হলঘরের মধ্যে কোথায়ও ক্ষণপূর্বের দৃষ্ট সেই বিচিত্র বেশভূষা পরিহিত আর্থার হ্যামিলটন বা দৈত্যাকৃতি সেই লোকটাকে দেখতে পেলাম না।

শুধু তাই নয়, হলঘরে আগে যাদের কাজ করতে দেখেছিলাম তাদেরও কাউকে। আর দেখতে পেলাম না ঐ সময়।

হলঘরটা তখন শূন্য।

দুজনে বাইরে বের হয়ে এলাম।

.

০৭.

রাস্তায় পড়ে কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে তখনও ভাবছি, ব্যাপারটা কি হল?

কিরীটীও স্তব্ধ হয়ে হেঁটে চলেছে।

কিন্তু কিরীটী খুব বেশি দূর অগ্রসর হল না।  

পনেরো বিশ গজ হেঁটে গিয়ে ঐ ফুটপাতেই একটা পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে হিন্দুস্থানী পানওয়ালাকে বলে, বেশ ভাল করে জর্দা কিমাম দিয়ে দুটো পান তৈরি করতে।

পানওয়ালা পান তৈরি করে দিল।

পান নিয়ে দাম মিটিয়ে দিয়ে, পান মুখে পুরে দিয়ে বেশ আরাম করে কিরীটী চিবুতে লাগল সেই দোকানের সামনেই ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়ে।

নড়বার নামগন্ধও নেই যেন।

বুঝতে পারি, ঐ সময় পান কেনা ও পান খাওয়া কিরীটীর একটা ছল মাত্র।

কিছু সময় হরণ করতে চায় সে ঐখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিশেষ কোন উদ্দেশ্যেই।

ইতিমধ্যে দেখি দিব্যি পানওয়ালার সঙ্গে এটা-ওটা আলাপ শুরু করে দিয়েছে কিরীটী।

চার প্যাকেট কি এক নতুন ব্র্যাণ্ডের উর্বশী-মার্কা সিগারেটও কিনল, যে সিগারেট কস্মিনকালেও খায় না। এবং সর্বক্ষণ ওর মধ্যেই যে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এদিক-ওদিকে, বিশেষ করে অদূরবর্তী ওভারসিজ লিঙ্কের অফিসের দিকে নিবন্ধ হচ্ছিল সেটা অবশ্য

আমার নজর এড়ায় না।

প্রায় আধ ঘণ্টা পরে, একটু বোধ হয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ কিরীটী হাত ধরে আকর্ষণ করে নিম্নকণ্ঠে বললে, আয় সুব্রত!

কোথায়?

আয় না! বলে আমার হাতটা ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে চলল।

বাধ্য হয়েই যেন কিরীটীকে আমি অনুসরণ করি।

কোথায় যাচ্ছি, কি ব্যাপার, কিছুই বুঝতে পারি না।

রাস্তার ধারে ট্যাকশি পার্কে একটা ট্যাকশি দাঁড়িয়ে ছিল, এতক্ষণে নজরে পড়ল কিরীটী সেই দিকেই হনহন করে হেঁটে চলেছে।

সোজা গিয়ে কিরীটী খালি ট্যাকশিটায় উঠে বসল আমাকে নিয়ে।

তারপরেই ট্যাকশি-চালককে চাপাকণ্ঠে বললে, সামনের ঐ ট্যাকশিটাকে ফলো করে চল সর্দারজী।

নজর করে দেখলাম সামনেই অল্পদূরে তখন একটা বেবী ট্যাকশি চৌরঙ্গীর দিকে ছুটে চলেছে।

হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম রাত নটা বাজে প্রায়।

রাস্তায় তখন নানাবিধ যানবাহনের রীতিমত ভিড়। এবং থিয়েটার রোড পর্যন্ত বেশ সমগতিতে এসে ট্রাফিকের জন্য আগের গাড়ির গতি ও সেই সঙ্গে আমাদের গাড়ির গতিও হ্রাস হয়।

কিরীটী ইতিমধ্যে ট্যাকশির ব্যাকে বেশ আরাম করেই বসেছিল, যদিও তার তীক্ষ্ণ সতর্ক দৃষ্টি বরাবরই নিবদ্ধ ছিল সামনের চলন্ত ট্যাকশির উপরেই।

গাড়ির গতি আর হ্রাস হতে এতক্ষণে কিরীটী মুখ খুলল, সত্যি কথা বলতে কি সুব্রত, একান্ত ঝোঁকের মাথায়ই বাড়ি থেকে সন্ধ্যায় বেরোবার মুহূর্তে কল্পনাও করতে পারিনি এমন একটা সরস রোমাঞ্চকর রাত্রি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

বলা বাহুল্য, কারণ ইতিমধ্যে কিরীটীর মনোগত ইচ্ছাটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল।

তা যা বলেছিস। যোগাযোগটা অপূর্ব বলতেই হবে। মৃদুকণ্ঠে জবাব দিলাম আমি।  

কিরীটী আমার জবাবে সোৎসাহে বলল, অপূর্ব কিনা জানি না এখনও, তবে অভূতপূর্ব নিশ্চয়ই।

তুই যে সত্যি-সত্যিই নির্মলশিববাবুর স্বর্ণমৃগয়ার অকুস্থলের সন্ধানেই আজ বেরিয়েছিস, সত্যিই কিন্তু আমি প্রথমটায় কল্পনাও করতে পারিনি কিরীটী।

তবে তুই কি ভেবেছিলি, সত্যি-সত্যিই আমি হাওয়া খেতে বের হয়েছি?

না—তা নয়—

তবে?

আচ্ছা তোর কি মনে হয় কিরীটী, ঐ ওভারসিজ লিঙ্কই সত্যি সত্যি নির্মলশিববাবুর স্বর্ণমৃগয়ার অকুস্থল?

ততখানি এত তাড়াতাড়ি ভেবে নেওয়াটা কি একটু কল্পনাধিক্যই মনে হচ্ছে না? না ব্রাদার—no so fast! বঙ্কিমী ভাষায় বলব, ধীরে রজনী, ধীরে।

তা অবশ্যি ঠিক। তবে ঘটনাচক্রে অনেক সময় অনেক অভূতপূর্ব ব্যাপারও ঘটে তো!

তা যে ঘটে না তা আমি অবশ্যি বলছি না, তবে—

তবে?

তবে সীতা মেয়েটি সত্যিই অনিন্দনীয়া। কি বলিস?

হুঁ।

হুঁ কি রে? ভাল লাগল না দেখে তোর মেয়েটিকে? আমার তো মনপ্রাণ এখনও একেবারে ভরে রয়েছে।

সত্যি নাকি?

হুঁ।

আর আর্থার হ্যামিলটন? তার সম্পর্কে তোকই কিছু বললি না!

লোকটা রসিক নিঃসন্দেহে, এইটুকুই বলতে পারি।

কি বললি, রসিক?

নয়? অমন একটি মেয়ের চিত্তহরণ যে একদা করে থাকতে পারে, সে রসিকজন বৈকি। সত্যিই কবি যে বলে গিয়েছেন একদা প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে কথাটা খুব খাঁটি কিন্তু তুই যা বলিস।

তা তোর কিসে মনে হল যে ঐ আর্থার হ্যামিলটন একদা সীতার মনপ্রাণ সত্যি সত্যিই হরণ করেছিল?

কেন, সোজাসুজি এসে একেবারে বললে শুনলি না, ফিরে যাবে কিনা বল?

তার মানে বুঝি—

অতশত জানি না তবে আমার যেন মনে হল ক্ষণপূর্বে সেক্রেটারি সীতার ঘরে বৃত্ররূপী যে দৈত্যের আবির্ভাব ঘটেছিল, সেই বৃত্রই ঐ শচীদেবীকে কোন এক সময় বেচারী ইন্দ্ররূপী দুর্বল আর্থার হ্যামিলটনের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে।

তুই বুঝি ঐ কাব্য মনে মনে এতক্ষণ ধরে রচনা করছিলি কিরীটী?

হ্যাঁ, ভাবছিলাম—

কী?

দধীচীর মত নিজ অস্থি দিয়ে ঐ দুর্বল ইন্দ্রকে যদি গিয়ে বলি, লহ অস্থি, কর নির্মাণ বজ্র-সংহার ঐ দৈত্যাসুর বৃত্রকে!

হো হো করে হেসে উঠি আমি।

হাসছিস কিন্তু বেচারীর সে-সময়কার করুণ মুখখানার দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখলে তোরও ঐ কথাই মনে হত।

ইতিমধ্যে মেট্রোর কাছ বরাবর আমরা এসে গিয়েছিলাম।

আগের ট্যাকশিটা সোজা এগিয়ে গিয়ে ডাইনে বাঁক নিল। তারপর কিছু দূরে এগিয়ে বাঁ দিকে ঢুকে পড়ল।

আমাদের ট্যাকশিচালক সর্দারজী ঠিক তাকে অনুসরণ করে যায়।

শেষ পর্যন্ত আগের ট্যাক্সিটা কুখ্যাত চীনাপাড়ার এক অখ্যাত চীনা হোটেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

বাবুজী, উও আগারি ট্যাকশি তো রুখ গিয়া!

হিঁয়াই রোখো সর্দারজী।

লক্ষ্য করলাম, আগের ট্যাকশি থেকে নেমে আথার হ্যামিলটন সাহেব ট্যাকশির ভাড়া মিটিয়ে দিচ্ছে।

ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে হ্যামিলটন হোটেলের ভিতরে গিয়ে প্রবেশ করল।

বলা বাহুল্য আমরাও একটু পরে সেই হোটেলেই গিয়ে প্রবেশ করলাম দুজনে।

.

০৮.

ভিতরে প্রবেশ করে যেন একটু বিস্মিতই হই।

এমন পাড়ায় অখ্যাতনামা একটি চীনা হোটেলে বেশ কসমোপলিটন ভিড়।

হোটেলটায় প্রবেশ করবার মুখে হোটেলের নামটা লক্ষ্য করেছিলাম। বিচিত্র নামটিও।

চায়না টাউন।

বেশি রাত নয়—মাত্র সাড়ে নয়টা তখন।

ভিতরে প্রবেশ করে দেখি, কসমোপলিটন খরিদ্দারের ভিড়ে তখন গমগম করছে হোটেলের হলঘরটি।

এক পাশে ড্রিঙ্কের কাউন্টার। তারই গা ঘেঁষে বাঁয়ে প্যানট্রির দরজা এবং ডাইনে ছোট একটি ডায়াস।

ইংরাজী অর্কেস্ট্রা সহযোগে একটি ক্ষীণাঙ্গী, মনে হল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়েই হবে, নানাবিধ যৌনাত্মক অঙ্গভঙ্গি সহকারে নাকিসুরে কি একটা দুর্বোধ্য ইংরাজী গান গেয়ে চলেছে।

চারপাশে টেবিল চেয়ারে জোড়ায় জোড়ায় নানাবয়সী পুরুষ ও নারী, কেউ খেতে খেতে, কেউ কেউ আবার ড্রিঙ্ক করতে করতে সেই যৌনরসাশ্রিত সঙ্গীত উপভোগ করছে।

একটা বিশেষ ব্যাপার ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নজর করছিলাম—উজ্জ্বল আলো নয়-ঈষৎ নীলাভ স্রিয়মাণ আলোয় সমস্ত হলঘরটি স্বল্পালোকিত বলা চলে।

রীতিমত যেন একটা রহস্যনিবিড় পরিবেশ হোটেলটির মধ্যে।

ইতিমধ্যে দক্ষিণ কোণে একটা টেবিলে হলঘরের নিরিবিলিতে হ্যামিলটন সাহেব জায়গা করে বসে গিয়েছে লক্ষ্য করলাম। ..

তারই পাশে আর একটা খালি টেবিল তখনও ছিল, কিরীটী আমাকে নিয়ে সেই দিকেই এগিয়ে চলল।

নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে আমরা টেবিলটার দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম মুখোমুখি।

হ্যামিলটনের অত কাছাকাছি গিয়ে বসতে আমার যেন ঠিক মন সরছিল না, কিন্তু দেখলাম হ্যামিলটন আমাদের দিকে ফিরেও তাকাল না।

সে অন্যদিকে অন্যমনস্ক ভাবে তখন চেয়ে আছে।

কিন্তু হ্যামিলটনের সঙ্গের সেই দৈত্যাকৃতি লোকটাকে আশেপাশে কোথাও নজরে পড়ল না।

ইতিমধ্যে একজন ওয়েটার দেখলাম একটা পুরো বোতল, একটা গ্লাস ও একটা কাচের জাগভর্তি জল এনে হ্যামিলটন সাহেবের সামনের টেবিলের উপরে নামিয়ে রাখল।

বোয়।

কিরীটীর আহ্বানে সেই লোকটাই আমাদের সামনে এগিয়ে এল।

দুটো কোল্ড বিয়ার।

তাড়াতাড়ি বললাম, আমি তো বিয়ার খাই না!

কিরীটী নির্বিকার ভাবে জবাব দিল, খাস গ্লাসে নিয়ে বসে থাকবি।

কি আর করা যায়, চুপ করেই থাকতে হল অগত্যা।

ওয়েটার কিরীটীর নির্দেশমত দুবোতল ঠাণ্ডা বিয়ার ও দুটো গ্লাস এবং একটা প্লেটে কিছু কাজুবাদাম আমাদের টেবিলে রেখে গেল।

ইতিমধ্যে লক্ষ্য করেছিলাম হ্যামিলটন সাহেব গ্লাসের আধাআধি রাম ঢেলে তাতে জল মিশিয়ে বার দুই চুমুক দিয়েই গ্লাসটা প্রায় অর্ধেক করে এনেছে।

কিরীটী দু গ্লাস বিয়ার ঢালল।

নে-না খাস অন্তত মুখের কাছে তোল!

কিরীটীর নির্দেশমত তাই করি।

সময় গড়িয়ে যেতে থাকে। অর্কেস্ট্রা সহযোগ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সুন্দরী তখন দ্বিতীয় সংগীত শুরু করেছে। হ্যামিলটন ড্রিঙ্ক করে চলেছে। লোকটা যে সুরারসিক বুঝতে দেরি হয় না।

.

ঘড়ির দিকে তাকালাম একসময়, রাত সাড়ে এগারোটা।

হলঘরের ভিড়টা তখন অনেকটা পাতলা হয়ে গিয়েছে বটে, তবু মধুলোভীদের ভিড় একেবারে কমেনি।

সকলের চোখেই নেশার আমেজ। ঘরের মধ্যে তখনও যারা উপস্থিত তাদের তখন যেন নেশা জমাট বেঁধে উঠেছে।

ইতিমধ্যে হ্যামিলটন সাহেব রামের বড় বোতলটি প্রায় নিঃশেষিত করে এনেছে।  

এবং সাহেবের যে রীতিমত নেশা ধরেছে সেটা তার দিকে তাকালেই বোঝা যায়।

কিরীটী ফিসফিস করে আমাকে বললে, চল সাহেবের সঙ্গে একটু আলাপ করে আসি।

এতক্ষণ যে এত কষ্ট করে কিরীটী হোটেলে বসে আছে সেও ঐ কারণেই সেটা পুর্বেই বুঝতে পেরেছিলাম।

কিন্তু তবু ইতস্তত করি।

কি হল, ওঠ?

কিন্তু যদি চিনে ফেলে আমাদের!

নেশার ঘোরে আছে, চল্।

চল।

কিরীটীর সঙ্গে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালাম।

হ্যামিলটন সাহেবের টেবিলে আরও দুটি চেয়ার ছিল। তারই একটা টেনে নিয়ে আমি বসলাম এবং কিরীটী অন্যটায় বসতে বসতে বললে, গুড ইভনিং মিঃ হ্যামিলটন!

নেশায় ঢুলুঢুলু চোখ দুটি খুলে তাকাল আমাদের দিকে হ্যামিলটন সাহেব।

কে? জড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন করে হ্যামিলটন।

তুমি আমাকে চিনবে না হ্যামিলটন-আমার নাম রথীন বোস।

আঃ-বোস! বলে নিঃশেষিত গ্লাসটার পাশ থেকে বোতলটা তুলে উপুড় করে ধরল কিন্তু বোতলটায় তখন একবিন্দুও তরল পদার্থ অবশিষ্ট ছিল না।

কিরীটী মৃদু হেসে বলে, ওর মধ্যে তো একবিন্দুও নেই, ঢালছ কি?

নেই! বলে বোতলটা কম্পিত হাতে সামনে তুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল, নেই-ইয়েস, সত্যিই নেই—অল ফিনিশড!

ড়ু ইউ লাইক টু হ্যাভ মোর, মিঃ হ্যামিলটন?

গড ব্লেস ইউ মাই বয়। আই হ্যাভ নট এ ফারদিং লেফট ইন মাই পকেট।

কিরীটী ততক্ষণে ওয়েটারকে ডেকে হ্যামিলটনের শূন্য গ্লাসটার জায়গায় অন্য একটা ভর্তি গ্লাস এনে দিতে বললে।

ওয়েটার এনে দিল নির্দেশমত একটা গ্লাস।

সানন্দে নতুন গ্লাসটা তুলে নিয়ে দীর্ঘ একটা চুমুক দিয়ে জড়িত স্বরে হ্যামিলটন বললে, গড উইল ব্লেস ইউ মাই বয়, গড উইল ব্লেস ইউ। দ্যাট ডার্টি স্নেক, দ্যাট ফিলাদি স্নেক গেভ মি ওনলি ফিফটিন রুপিজ। তাতে কি কিছু হয় মিঃ বোস, তুমিই বল? একজন ভদ্রলোকের এক রাত্রের ড্রিঙ্কের খরচাও হয় না!

তা তো নিশ্চয়ই, কিন্তু তুমি তো ইচ্ছা করলে সীতার কাছ থেকে নিতে পার!

সীতা! ডোন্ট টক অ্যাবাউট হার। জুয়েল, হার্টলেস উয়োম্যান। জান, সে চলে যাবার পর থেকেই তো আমার এই অবস্থা। শি হ্যাজ ফিনিশড মি, শি হ্যাজ ফিনিশড মি। আই অ্যাম গন-গন ফর এভার। কিন্তু তবু-তবু আমি তাকে ভালবাসি।

তুমি তাকে সত্যিই ভালবাস হ্যামিলটন?

সহসা হাত বাড়িয়ে কিরীটীর একটা হাত চেপে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল হ্যামিলটন, হা হা-বাসি—বিশ্বাস কর বোস—দো শি হ্যাজ ডেজার্টেড মি—তবু, তবু তাকে আমি ভালবাসি। আই লাভ হার, আই লাভ হার, আই লাভ হার লাইক এনিথিং। শি ইজ মাই ম্যারেড ওয়াইফ–শি ইজ-কথাটা শেষ হল না হ্যামিলটনের।

অকস্মাৎ আমাদের পিছন থেকে সরু মিহি গলায় কে যেন ডাকল, হ্যামিলটন!

কে? ও চিরঞ্জীব।

আগন্তুক ততক্ষণে বগলের ক্রাচের সাহায্যে আমাদের সামনাসামনি এসে দাঁড়িয়েছে।

বেঁটেখাটো মানুষটা, দৈর্ঘ্যে পাঁচ ফুটের বেশি হবে না।

রোগা লিকলিকে চেহারা।

পরিধানে একটা ঝলঝলে কালো রঙের পুরাতন জীর্ণ স্ল্যাক ও গায়ে অনুরূপ একটা ওপন-ব্রেস্ট কোট।

ভিতরে ময়লা একটা ছিটের শার্ট, তাও গলার বোতামটা খোলা।

মাথায় নিগ্রোদের মত ছোট ছোট চুল–ঘন কুঞ্চিত।

ছড়ানো কপাল, চাপা নাক, দৃঢ়বদ্ধ ওষ্ঠ।

ছোট ছোট কুতকুতে দুটি চক্ষু যেন সতর্ক শিকারী বিড়ালের মত।

ডান পা-টা বোধ হয় পঙ্গু-অসহায়ভাবে ঝুলছে।

এস চিরঞ্জীব, তোমাকে এদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই—মাই বেস্ট ফ্রেন্ড অ্যান্ড ওনলি অ্যাডমায়ারার চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল অ্যান্ড মাই ফ্রেন্ডস বোস–

কিন্তু হ্যামিলটনের আগ্রহে এতটুকু সাড়াও যেন দিল না চিরঞ্জীব।

সে বললে, তুমি এখানে বসে আছ আর তোমার জন্য পকের্টে টাকা নিয়ে আমি তোমাকে সারা দুনিয়ায় খুঁজে বেড়াচ্ছি!

টাকা! আর ইউ রিয়েলি সেয়িং মানি।

ইয়েস–

ও গড ব্লেস ইউ মাই বয়। ইউ ডোন্ট নো হাউ আই অ্যাম ব্যাডলি ইন নিড অফ মানি! দাও দাও-হাত বাড়াল হ্যামিলটন।

সে কি, পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি নাকি? চল, আমার বাড়ি চল।

চল, চল-টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায় হ্যামিলটন।

আর একটু হলেই পা বাড়াতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল হ্যামিলটন, কিন্তু পলকে হাত বাড়িয়ে পতনোদ্যত হ্যামিলটনকে ধরে চিরঞ্জীব হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল।

কেমন বিহ্বল হয়েই যেন ওদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি।

হঠাৎ কিরীটীর মৃদু কণ্ঠস্বরে ওর দিকে মুখ ফেরালাম।

বন থেকে বেরুল টিয়ে সোনার টোপর মাথায় দিয়ে! টিয়া পাখি উড়ে গেলসুব্রতচন্দ্র এবারে গৃহে চল!

তারপরই হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললে, উঃ, রাত বারোটা বাজতে মাত্র চোদ্দ মিনিট। গৃহিণী নিরতিশয় ব্যাকুল হয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই।

তা হবারই তো কথা, সান্ধ্যভ্রমণ যদি মধ্যরাত্রি পর্যন্ত গড়ায়-মৃদু হেসে বললাম আমি, ব্যাকুলা তো হবেনই।

তাড়াতাড়ি বিল চুকিয়ে দিয়ে আমরা হোটেলের বাইরে চলে এলাম।

হোটেলের বাইরে এসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম।

একটু আগে হ্যামিলটনকে নিয়ে এই পথেই চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল হোটেল থেকে বের হয়ে এসেছে।

কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না।

কিরীটী আমাকে তাড়া দিয়ে বলল, নেই হে বন্ধু সে টিয়া পাখি অনেক আগেই উড়ে গিয়েছে। এবারে একটু পা চালিয়েই চল, কারণ পাড়াটা বিশেষ করে এই মধ্যরাত্রে তেমন সুবিধার নয়।

ট্রামরাস্তায় এসেও অনেক অপেক্ষার পর ট্যাকশি মিলেছিল সেরাত্রে এবং কিরীটীকে তার গৃহে নামিয়ে দিয়ে বাসায় পৌঁছতে রাত সোয়া একটা বেজে গিয়েছিল।

.

০৯.

সেই রাত্রের পর পুরো দুটো দিন কিরীটী আর বাড়ি থেকে কোথাও এক পাও বেরুল না।

কেবল নিজের বসবার ঘরে বসে বসে দুটো দিন সর্বক্ষণ পেসেন্স খেলা নিয়েই মেতে হইল।

তৃতীয় দিনও দ্বিপ্রহরে গিয়ে দেখি বসবার ঘরে চারিদিকে লাল পর্দা টেনে এয়ারকন্ডিশন মেশিন চালিয়ে ঠাণ্ডায় বসে পেসেন্স খেলছে সে।

আজ কিন্তু সত্যিই আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটবার উপক্রম হয়।

কারণ গত দুটো দিন আমার মনের মধ্যে সর্বক্ষণ সেরাত্রের ঘটনাগুলি ও কতকগুলো নরনারীর মুখ ভেসে ভেসে উঠছিল।

মনে মনে একটা আঁচও করে নিয়েছিলাম যে, অতঃপর নিশ্চয়ই তোড়জোড় করে কিরীটী গিয়ে ওভারসিজ লিঙ্কে হানা দেবে।

কিন্তু কিরীটী যেন সেরাত্রের ব্যাপার সম্পর্কে একেবারে বোবা।

ধৈর্যচ্যুতি ঘটতও হয়ত আর একটু পরেই, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে সিঁড়িতে জুতোর শব্দ পেয়ে উৎকর্ণ হই।

জুতোর শব্দটা ঠাণ্ডা ঘরের দরজা বরাবর যখন প্রায় এসেছে, কিরীটী তাস সাজাতে সাজাতেই আমাকে বললে, দরজাটা খুলে দে সুব্রত, নির্মলশিব এলেন!

সত্যি দরজা খুলে দিতে নির্মলশিবই এসে ঘরে প্রবেশ করল।

ঘরে পা দিয়েই নির্মলশিব বলে, আঃ, প্রাণটা বাঁচল! কি আশ্চর্য! কি ঠাণ্ডা।

কিরীটী তাস সাজাতে সাজাতেই বলল, মল্লিক সাহেবের সঙ্গে আলাপ হল নির্মলশিববাবু?

কি আশ্চর্য! তা আর করিনি! খাসা লোক—তবে—

তবে আবার কি?

প্রচণ্ড সাহেব।

তা বাঙালীরা ধুতি ছেড়ে কোট পাতলুন পরিধান করলে একটু সাহেব হয়ে পড়েন বৈকি। কিন্তু যেজন্য আপনাকে সেখানে যেতে বলেছিলাম তার কোন সংবাদ পেলেন কিনা?

কি আশ্চর্য! তা পেয়েছি বৈকি।

পেয়েছেন তাহলে!

হ্যাঁ।

বিদেশে কোন মালটা বেশি রপ্তানি হয় ওদের, জানতে পারলেন কিছু?

হ্যাঁ। চা, চাটনি আর ছাতি।

ছাতি?

হ্যাঁ,–আমব্রেলা। আমেরিকায় নাকি প্রচুর চা আর ছাতি চালান যাচ্ছে আর বোয়ামে বোয়ামে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে আমের আচার।

আমের আচার আর ছাতার স্যাম্পল দিলে বুঝি আপনাকে?

স্যাম্পল মানে?

না, বলছিলাম, শুধু ছাতি আর আমের আচার-সিঙ্গাপুরী কলা নয়!

বেচারী নির্মলশিব, কিরীটীর সূক্ষ্ম পরিহাস উপলব্ধি করবে কি করে? আমি কিন্তু ততক্ষণে রুদ্ধ হাসির বেগটা আর না সামলাতে পেরে হো-হো করে হেসে উঠলাম।–

কি আশ্চর্য! সুব্রতবাবু, আপনি হাসছেন?

নির্মলশিববাবুর কথায় কিরীটীও এবারে হেসে ওঠে।

.

যাক, সীতা আর আর্থার হ্যামিলটনের খোঁজ নিয়েছিলেন নির্মলশিববাবু? কিরীটী আবার প্রশ্ন করল।

কি আশ্চর্য! নিয়েছিলাম বৈকি। হাজবেন্ড অ্যান্ড ওয়াইফ। তবে বর্তমানে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ওদের সেপারেশন হয়ে গিয়েছে।

ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে?

না, তা হয়নি বটে, তবে—

তবে কি?

ওরা বছরখানেক হল আলাদা ভাবে বসবাস করছে।

হুঁ। আর চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল? তার কোন সংবাদ পেলেন?

আপনার অনুমানই ঠিক। চায়না টাউন হোটেলের মালিক লোকটা।

তাহলে লোকটার দুপয়সা আছে বলুন?

কি আশ্চর্য! তা আর নেই? হোটেলটা খুব ভালই চলে। লোকটি সজ্জন সন্দেহ নেই। আর মুরগীর রোস্ট যা করে না, আশ্চর্য, একেবারে যাকে বলে ফার্স্ট ক্লাস, অতি উপাদেয়!

মুরগীর রোস্ট বুঝি খাইয়েছিল আপনাকে?

নিশ্চয়ই। দু-প্লেট ভর্তি।

আমি এবার প্রশ্ন করলাম, দু-প্লেটই খেলেন?

কি আশ্চর্য! দিলে আর খাব না? না মশাই, আমার অত প্রেজুডিস নেই।

তা তো সত্যিই, আগ্রহভরে যখন বিশেষ করে সে দিয়েছে। কিন্তু নির্মলশিববাবু শত্রুশিবিরে গিয়ে ঐ ধরনের প্রেজুডিসটা বর্জন করাই ভাল জানবেন।

কিরীটী শান্ত মৃদুকণ্ঠে কথাগুলো বললে।

কথাটা বলেই কিরীটী আবার পূর্বপ্রসঙ্গে ফিরে এল, আচ্ছা নির্মলশিববাবু, ওভারসিজ লিঙ্কের ম্যানেজার ভদ্রলোকটির চেহারাটা কেমন? মানে বলছিলাম কি, দেখতে শুনতে কেমন? খুব লম্বাচওড়া দৈত্যের মত কি?

কি আশ্চর্য! কই না তো!

তবে কি রকম দেখতে?

রোগা লিকলিকে, একটু আবার খখানা। নাকিসুরে কথা বলে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, একটা চোখও আবার বিশ্রীরকম ট্যারা।

একটা পা খোঁড়া নয়?

খোড়া! কই না তো?

হুঁ। বলুন তো কিরকম চেহারাটা তার ঠিক ঠিক?

নির্মলশিব বর্ণনা করে গেল মল্লিক সাহেবের চেহারাটা।

ওভারসিজ লিঙ্কের ম্যানেজারের চেহারার বর্ণনাটা মনে হল নির্মলশিবের মুখে শুনে ঠিক যেন মনঃপূত হল না কিরীটীর।

ব্যাপারটা যেন কিছুটা তার প্রত্যাশার বাইরেই মনে হল।  

বুঝতে পারি লোকটার চেহারার একটা বর্ণনা কিরীটীর মনের মধ্যে ছিল। সেই বর্ণনার সঙ্গে না মেলায় সে যেন একটু চিন্তিতই হয়ে পড়েছে।

কিছুক্ষণ অতঃপর কিরীটীর মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হয় না।

ভ্রূ দুটো কুঞ্চিতই হয়ে থাকে। তারপর এক সময় ভ্র দুটো সরল হয়ে আসে। চাপা খুশির একটা ঢেউ যেন কিরীটীর মুখের উপর দিয়ে খেলে যায়।

মৃদু কণ্ঠে সে বলে, সত্যি, আমারই ভুল হয়েছিল, ঘটোৎকচের মাথায় বা সেই ভদ্রলোকের মস্তিষ্কে তো অতখানি বুদ্ধি থাকতে পারে না!

কিরীটীর উচ্চারিত ঘটোৎকচ কথাটা নির্মলশিবের কানে গিয়েছিল, সে বলে, কি আশ্চর্য! ঘটোৎকচ আবার কে মিঃ রায়?

 একটা দৈত্য। ওভারসিজ লিঙ্কে আমরা সেরাত্রে একটা দৈত্যাকৃতি লোক দেখেছিলাম, কিরীটী তার কথাই বলছে নির্মলশিববাবু। জবাব দিলাম আমি।

কি আশ্চর্য! তাই বলুন। আপনারা মিঃ গড়াই! গজানন্দ গড়াইয়ের কথা বলছেন। তা সত্যি—আমি মশাই একটু লেটে বুঝি। বলেই প্রাণ খুলে হো হো করে হেসে উঠল নির্মলশিব।

.

১০.

নির্মলশিবের কাছ থেকে আরও সংবাদ পাওয়া গেল ওভারসিজ লিঙ্ক সম্পর্কে।

ম্যানেজার লোকটা অফিসে বড় একটা থাকেই না। ঐ গজানন্দ গড়াই-ই সব একপ্রকার দেখাশোনা করে বলতে গেলে। আর অফিসে সর্বদা থাকে সেক্রেটারি দিদিমণি সীতা মৈত্র। আর একটা প্রশ্ন করেছিল কিরীটী নির্মলশিবকে।

যে সমস্ত মাল ওরা এদেশ থেকে অন্যান্য দেশে পাঠায়, সে সমস্ত মাল সাধারণত কিসে যায়?

বলাই বাহুল্য, সে সংবাদটা দিতে পারেনি নির্মলশিব সাহেব কিরীটীকে।

অবশেষে নির্মলশিব গাত্রোত্থান করেছিল। এবং বিদায় নেবার পূর্বে যখন সে কিরীটীকে শুধাল, এবার আমাকে কি করতে হবে বলুন মিঃ রায়!

কিরীটী মৃদু হেসে বলে, একটা বা দুটো বিশেষ নম্বরের ট্যাকশি কিংবা কোন ভ্যান নিশ্চয়ই ওভারসিজ লিঙ্ক অফিসে ঘন ঘন যাতায়াত করে আমার ধারণা। ধারণাটা আমার সত্য কিনা, একটু লক্ষ্য রাখবেন তো নির্মলশিববাবু!  

কি আশ্চর্য! এ আর এমন শক্ত কথা কি, আজই এখুনি গিয়ে একজন প্লেন ড্রেসকে ওখানে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টার জন্য পোস্ট করে রাখছি।

হ্যাঁ, তাই করুন। আপাতত ওইটুকুই করুন।

নির্মলশিব বিদায় নেওয়ার পর আমি জিজ্ঞাসা করি, তোর কি তাহলে সত্যি সত্যি ধারণা ঐ ওভারসিজ লিঙ্কটাই হচ্ছে স্বর্ণমৃগয়ার ঘাঁটি?

তাই আমার এখন মনে হচ্ছে সুব্রত।  

কিন্তু কেন, সেটাই তো জিজ্ঞাসা করছি! কারণ সেরাত্রে ওভারসিজ লিঙ্ককে কেন্দ্র করে পর পর যে ব্যাপারগুলো ঘটেছিল সেগুলোকে স্রেফ ঘটনাচক্র ছাড়া আর কি বলা যায়।

জানবি, ঘটনাচক্রই বহু ক্ষেত্রে নিষ্ঠুর সত্যেরও ইঙ্গিত দেয়। আমি অবিশ্যি ব্যাপারটা নিছক একটা ঘটনাচক্রই বলি না, বলি, সাম্ আনসিন্ ফোর্স, কোন অদৃশ্য শক্তি আমাদের অজ্ঞাতেই আমাদের সত্যপথে চালিত করে, যেটা বহু ক্ষেত্রেই আমরা জীবনে অনুভব করি। কিন্তু এক্ষেত্রে কেবল ঐ ঘটনাচক্র ও আনসিন ফোর্সেরই ইঙ্গিত ছিল না। দেয়ার ওয়্যার সামথিং মোর!

কি?

প্রথমত স্বর্ণমৃগয়ার ব্যাপারটা যে সত্য, সেটা পূর্বেই আমার মন বলেছিল একটি কারণে!

কি, শুনি?

সংবাদপত্র লক্ষ্য করলেই দেখতে পেতিস, গত বছর-তিন সময়ের মধ্যে জাহাজঘাটায় এবং প্লেনের ঘাঁটিতে পাঁচ-পাঁচটা বিরাট গোল্ড বা সোনার স্মাগলিংয়ের ব্যাপার ধরা পড়েছে। এবং সেইসুত্রে এক বা ততোধিক লোক স্মাগলার হিসেবে ধরা পড়লেও আসলে তারা চুনোপুঁটি মাত্র। এই ব্যাপারের আসল রুইকাতলার টিকিটিও স্পর্শ করতে পারেনি পুলিস কোনদিন। তবে ঐ সঙ্গে আরও একটা সংবাদে প্রকাশ, পাঁচবারের মধ্যে বারতিনেক বিরাটকায় দৈত্যাকৃতি একটা লোককে বিভিন্ন অকুস্থানের আশেপাশে নাকি দেখা গিয়েছে; অবশ্য ঐ ব্যাপারের সঙ্গে তাকে কোনরকম সন্দেহই পুলিস করতে পারে নি। মাস আষ্টেক পূর্বে আমাদের সাউথের ডি. সি.-র সঙ্গে তাঁর জীপে চেপে এক জায়গায় যাচ্ছিলাম। পথের মাঝে ট্রাফিকের জন্য ডি. সি.-র জীপটাও দাঁড়ায়। পাশেই এমন সময় একটা নতুন ঝকঝকে ডজ কিংসওয়ে গাড়ি এসে দাঁড়ায় ব্রেক কষে। সেই গাড়ির মধ্যেই একটা দৈত্যাকৃতি লোক অর্থাৎ আমাদের ঐ ঘটোৎকচ বা গজানন্দ গড়াইকে আমি চাক্ষুষ প্রথম দেখি এবং বলাই বাহুল্য মুগ্ধ ও আকৃষ্ট হই।

তারপর? শুধালাম আমি।

সেই সময়ই ডি. সি. লোকটার প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে হঠাৎ বলেছিলেন, মিঃ রায়, ঐ যে গাড়িটার মধ্যে দৈত্যের মত একটা লোক দেখছেন, বিখ্যাত তিনটে গোল্ড স্মাগলিংয়ের কেস যখন ধরা পড়ে, দুবার এরোড্রোম ও একবার জাহাজঘাটায়, ঐ লোকটাকে নাকি আশেপাশে দেখা গিয়েছিল।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, ওকে সন্দেহ করলেও আজ পর্যন্ত লোকটার একটি কেশও স্পর্শ করা যায়নি।

কিরীটী বলতে লাগল, যাই হোক, সেই যে ঘটোৎকচকে আমি গাড়ির মধ্যে দেখেছিলাম, ভদ্রমহোদয়কে কেন যেন আর ভুলিনি। এবং সেদিন নির্মলশিবের সমস্ত ব্যাপার মনোযোগ দিয়ে শুনে আমার মনে হল, স্বর্ণমৃগয়ার ব্যাপারটার দক্ষিণ কলকাতার মধ্যেই কোথাও ঘাঁটি আছে। অবিশ্যি সেখানেও আমি কিছুটা যোগবিয়োগ করে আমার অনুমানকেই প্রাধান্য দিয়েছি বরাবরের মত।

যথা?

আমার অনুমান ভুলও হতে পারে। তবে যা মনে হয়েছিল—

কি?

যোগ-বিয়োগটা করেছিলাম আমি দক্ষিণ কলকাতা অঞ্চলেই সংঘটিত দুটি বীভৎস ও রহস্যপূর্ণ হত্যাকাণ্ড থেকে। সে হত্যাকাণ্ড দুটো তোমাদের সকলেরই জানা।

কোন্ দুটি হত্যাকাণ্ড?

যে হত্যাকাণ্ড দুটোর কথা সেদিন নির্মলশিবের কাছে আমি উল্লেখ করেছিলাম।

মানে সেই পুলিস অফিসার মোহিনীমোহন–

হ্যাঁ, এবং দ্বিতীয়ত সে নিহত ব্যক্তির পরিচয়ের কোন হদিস এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

সে যাই হোক আমার বক্তব্য হচ্ছে প্রথমত, আবার কিরীটী বলতে লাগল, সেই দ্বিতীয় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির ভয়াবহ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নিদর্শন অর্থাৎ তার টুকরো টুকরো দেহখণ্ডগুলো এই দক্ষিণ কলকাতাতেই পাওয়া গিয়েছিল এবং দ্বিতীয়ত সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাত্র সাত দিন পূর্বে এই এলাকারই অন্যতম পুলিস অফিসার মোহিনীমোহনের রহস্যময় নিরুদ্দেশের ব্যাপার ঘটে। যাই হোক আপাতত ঐ দুটি কারণই সেদিন যেন অলক্ষ্যে আমার মনকে দক্ষিণ কলকাতার প্রতিই আকৃষ্ট করে। একটা ব্যাপার কি জানিস সুব্রত, বহুবার আমার জীবনে আমি দেখেছি, ঐ ধরনের ইঙ্গিত মনকে আমার কখনও প্রতারিত করেনি।

শুধু কি সেই কারণেই সেদিন সন্ধ্যায় তুই অকস্মাৎ বের হয়েছিলি সন্ধ্যাভ্রমণের নাম করে?

না। আর একটা কারণ ছিল অবিশ্যি সেদিনকার সান্ধ্যভ্রমণের পশ্চাতে।

কী?

ঐ ভাবে সোনা স্মাগল করা যে এক-আধজনের কর্ম নয়, সুনিশ্চিতভাবে তাদের যে একটা গ্যাং বা দল আছে এবং নির্দিষ্ট সুচিন্তিত একটি কর্মপদ্ধতি আছে, কথাটা কেন যেন আমার মনে হয়েছিল এবং ঐ সঙ্গে এও মনে হয়েছিল ঐ সব কিছুর জন্য চাই একটি মিলনকেন্দ্র, যে মিলনকেন্দ্রটির বাইরে থেকে একটা সকলের চোখে ধূলো দেওয়ার মত, শো থাকবে।

অর্থাৎ?

অর্থাৎ একটা অফিস।

অফিস?

হ্যাঁ, অফিস। কিন্তু অফিস-সংক্রান্ত ব্যাপার সাধারণত ক্লাইভ স্ট্রীট বা ডালহাউসি অঞ্চলেই হয় অথচ সেখানে আবার পুলিশেরও আনাগোনা বেশি। সেক্ষেত্রে স্বর্ণমৃগয়া করছে যারা তাদের পক্ষে দক্ষিণ কলকাতায় অফিস করাটাই হয়ত নিরাপদ হবে। বিশেষ করে সেই জন্যেই একবার যতটা সম্ভব আশপাশটা ঘুরেফিরে দেখবার জন্য বের হয়েছিলাম সেই সন্ধ্যায় যদি ঐ ধরনের কোন কর্মস্থল মানে অফিস ইত্যাদি চোখে পড়ে। কিন্তু ভাগ্যদেবী বরাবরই দেখেছি আমার প্রতি প্রসন্ন। সেদিনও তাই ঘটল। ঘুরতে ঘুরতে ওভারসিজ লিঙ্কের অফিসের কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ একটা ব্যাপারে আমি সচকিত হয়ে উঠলাম।

কি ব্যাপার?

ঘটোৎকচ

ঘটোৎকচ?

হ্যাঁ, তাকে দেখলাম একটা ট্যাকশি থেকে নেমে ওভারসিজ লিঙ্কের অফিসবাড়িতে ঢুকতে। সঙ্গে সঙ্গেই ওভারসিজ লিঙ্ক আমার মনকে আকর্ষণ করে। তারপর যখন শুনলাম তোর মুখে বাড়িটা নতুন, বুঝলাম অফিসটাও নতুন, নামটাও দেখলাম বিচিত্র এবং সাইনবোর্ডে বোল্ড লেটার্সে তাদের বিজ্ঞাপিত কাজকারবারটার সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে মনকে আমার সন্দিগ্ধ করে তুলল যেন সঙ্গে সঙ্গেই। সর্বোপরি সেখানে ক্ষণপূর্বে ঘটোৎকচের যখন প্রবেশ ঘটেছে-যাকে ইতিপূর্বে সোনার স্মাগল কেসে অকুস্থলের আশেপাশে দেখা গিয়েছিল বারতিনেক। অতএব কালবিলম্ব না করে আমি অন্দরে পা বাড়ালাম। কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করে ঘটোৎকচকে প্রথমটায় না দেখে হতাশ হয়েছিলাম, তবে হতাশা আর রইল না। তিলোত্তমা সন্দর্শনের পর।

অর্থাৎ?

দেহ ও মন পুলকিত ও চমৎকৃত হল। কিরীটী মৃদু হেসে বললে।

তাহলে তোর ধারণা কিরীটী, নির্মলশিবের রহস্যের মূলটা ঐ ওভারসিজ লিঙ্কের সঙ্গে জড়িত?

সেই রকমই তো মনে হচ্ছে। বিশেষ করে সেরাত্রে সেখানকার আবহাওয়া ও তিনটি প্রাণীকে দেখবার পর থেকে।

তিনটি প্রাণী?

হ্যাঁ। ঘটোৎকচ, তিলোত্তমা ও আর্থার হ্যামিলটন।

কিন্তু–

I have not yet finished। অমন একটা কাজের জায়গায় তিলোত্তমা কাব্যও যেমন বেখাপ্পা তেমনি ঘটোৎকচ পর্বের জুলুম ও হ্যামিলটনের নিরুপায়তা সব কিছুই যেন কেমন একটা এলোমেলো—জট পাকানো। জট পাকানো মানেই গোলযোগ, অতএব যোগ-বিয়োগ করে নিতে আমার অসুবিধা হয়নি। তাই

তাই কি?

তাই সেদিন তার কেসের আলোচনা প্রসঙ্গে নির্মলশিবকে যে আশ্বাস দিয়েছিলাম সেটাও যে মিথ্যে নয় সেটাও সেরাত্রে ওখানে হানা দেবার পর সুস্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম।

মানে দলে ভাঙন ধরেছে?

হ্যাঁ, এসব কারবারে সাধারণত যা হয়ে থাকে। মারাত্মক লোভের আগুনে সব ধ্বংস হয়ে যায়—মানে নিজেরাই শেষ পর্যন্ত নিজেদের ধ্বংসের বীজ বপন করে। কথাটা নির্মলশিবকেও বলেছিলাম। কিন্তু সে গা দিল না কথাটায়। অবিশ্যি নিজে থেকে তারা ধ্বংস না হলেও এটা বুঝতে পারছি যে তাদের দিন সত্যিই সংক্ষিপ্ত হয়ে এসেছে।

যেহেতু কিরীটী-শনির দৃষ্টি তাদের ভাগ্যের উপর পড়েছে।

হাসতে হাসতেই এবার আমি কথাটা বললাম।