প্রতিরোধ

প্রতিরোধ

সেই আকালের দিনে কাঙাল কঙ্কালের মেলায় মনাই আর রাধার সঙ্গে সুবলের পরিচয়। তখন থেকে সবাই জানে সুবলকে—সে কবি-গায়ক। সেই থেকেই সুবল সকলের ভালবাসার ও শ্রদ্ধার পাত্র, সুবল সকলের আপনার।

আকাল গেছে, আবার মানুষ ভিটায় ফিরে এসেছে। আবার শুরু হয়েছে জীবনের গান–বাঁচার অভিমান। মনাই দাস ছাড়েনি সুবলকে। বলেছে, দুঃখের দিনে শান্তি দিছ, নিজে না খাইয়া খাওয়াইছ। তোমারে নি ছাড়তে পারি?

মনাই আবার বুক বেঁধেছে। পীতাম্বর সার সেই লম্বা মোটা খাতাটায় টিপ সই দিয়ে, টাকা নয়, নিয়ে এসেছে বীজধান। আবার পীতাম্বরেরই মাঠে লেগেছে ভাগচাষে।

সেই থেকে সুবল মনাইয়ের অতিথি। তা-ও আজ কয়েকবছর আগের কথা। পুরনো ঘা যেন শুকিয়ে আসছে। তবু সুবলের নিস্তার নেই। তার ডাক নিরন্তর। সেই আকালের গান তাকে অমর করে রেখেছে। যে অবুঝ শিশুরা আজ বড় হয়েছে, তারা সুবলের গানে জানতে পারে দেশে একদিন এসেছিল মন্বন্তর। সেই দুর্দিনের সাক্ষী থাকবে তার গান– মানুষের শত্রুদের সেই নিষ্ঠুর কাহিনী। সময় নেই, অসময় নেই। আজও মনাইয়ের বউ রাধা সুবলকে ধরে বসে, হেই গান গাও!

সুবল ধরে :

শুন গো দেশবাসী, শুন মন দিয়া,
কহিতে পরান কান্দে, কান্দে আকুল হিয়া।
রাজায় রাজায় যুদ্ধু হইল, মইল উলুখড়,
আশি টাকা মণ চাউল হইল বাড়ল ধানের দর।
শুকনা মাঠ দৈত্যের মতো হা কইরা রইছে,
পানি দেওয়ার নোক নাই সব মরণ শয্যা লইছে,
কামারশালে আগুন নাই– হাপরে নাই টানা–
বাজারে নাই লোহা–কামারের পগটে নাই দানা।

শুনতে শুনতে রাধার মনে সেই পুরনো ঘায়ের পোকাগুলো যেন কিলবিলিয়ে ওঠে। সেই বিরাট ক্ষুধা, দুরন্তু প্রলোভন, দুনিয়ার সে কদর্য রূপ ভুলবে না সে কোনওদিন। সুবলের গলা আরও করুণ হয়ে ওঠে :

এমুন মহা মন্বন্তর জন্মে দেখি নাই
মায়ের বুকে সন্তান মরে এক ফোঁটা দুধ নাই।
ছিটাল কাটালের ভাত লইয়া মায়ে পুতে ঝগড়া
(ও হরি কইমু কি) সন্তানেরে ফাঁকি দিয়া, করে পচা অন্নের বখরা।

কিন্তুক ব্যাপারডা কী জানেননি আপনারা? বলেই ঠাস-ঠাস্ করে হাততালি দিয়ে গেয়ে উঠত সে,

নোটের গোছা বান্ধে গেঁজে হাইসা চোরা ব্যাপারী,
ও হরি মাথা খাও, পিছা মারো এমন আড়তদারির।
প্যাটের জ্বালায় পোলা মরে, বস্ত্র জ্বালায় মা দেয় গলায় দড়ি,
হায়রে–পেট কাঁপাইয়া, দাঁত দেখাইয়া, হাসে ড্যাকরা চোরাকারবারি।
চক্ষের জলে বুক ভাসে ভাই কইতে দুঃখের কথা,
হাইয়ো সুবল সাধুর সাথে সব কও—দূর কর এই অরাজকতা।

শুধু এই আহ্বান জানিয়ে তৃপ্তি পায়নি সুবল। মানুষের আর নিজের দুঃখ তাকে এমনই নির্মম করে তুলেছিল যে, সে মানুষের শত্রুদের আঙুল দেখিয়ে গেয়েছে :

রহিম চাষী মনাই চাষীর ক্ষয় ধরে গো হাড়ে
আড়তদার রঘুসাউ গুদামে বইয়া চাউলের পোকা ঝাড়ে।
ও-ভাই চাউলের বস্তায় পচানি ধরেছে;
সোনা মিয়ার আড়তে ভাই বস্তা নাহি ধরে,
ও ভাই– কলিরাজা মরণ বাড় বেড়েছে।

এ গান শুনে স্থানীয় দারোগাবাবু তাকে আচ্ছা করে ধমকে দিয়েছিল। বলেছিল, গাঁয়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে এ গান গাওয়া চলবে না। কিন্তু আর আর মানুষগুলো চাষা বলেই নাছোড়বান্দা। তারা সুবলকে নিয়ে এ গাঁয়ে ও গাঁয়ে টানাটানি করে, বসায় গোপন আসর। তাই মনাইয়ের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব পেয়েছে সে। রাধার প্রিয় সহচর সুবল।

মনাই সারাদিনই থাকে কাজে কর্মে। সুবল আর রাধা সারাদিন বসে বসে গান বাঁধে, গান গায়—গল্প করে।

রাধা আর সেই কঙ্কাল রাধা নেই। গায়ে মাংস লেগেছে, দেহের রেখায় রেখায় ফুটেছে উদ্দীপ্ত যৌবনের ধার। যেন সেই আগের রাধা। সেই আয়ত চঞ্চল চোখ, পাতলা চাপা ঠোঁট, স্ফীত যৌবনের গরিমায় উদ্ধত বুক।

সুবলের বড় সাধ রাধার ওই রূপকে সুরের মায়া দিয়ে জড়িয়ে রাখে—একটি গান বাঁধে। কিন্তু লজ্জা করে, সঙ্কোচ লাগে সুবলের। না জানি রাধা কী ভাববে। হয় তো তার সুবল-সখার ওপর রুষ্ট হবে। রাধাকে দুঃখ দিতে পারবে না সে। কিন্তু রাধার জিভের বাক নেই। সে একদিন বলেই ফেলে, আমারে চাইয়া চাইয়া দেখো, আর নিশ্বাস ফেলাও ক্যান? কিছু কও না যে?

সুবল লজ্জায় এতটুকু হয়ে যায়। পরমুহূর্তেই হেসে বলে, তুমি হইলা আমার সখার বধূ, তোমারে দেখুম না—দেখুম কারে! দুইটা চোখ ভইরা খালি তোমার রূপই দেখি আর ভাবি কালার মনমোহিনী রাইমণিও কি এমুনই আছিল?

রাধা মিষ্টি গলায় খিলখিল করে হেসে ওঠে। হ, তুমি হইলা কবি, তোমার লগে নি মাইনষে কথায় পারে?

সুবল বলে, কিন্তুক তোমার ওই রূপের ধারে আমার মুখে ক্যান কথা আটকাইয়া যায়?

রূপ না ছাই! রাধা ঘাড় ফিরিয়ে বাঁকা চোখে হেসে চলে যায়। সুবল তাড়াতাড়ি একতারাটা পেড়ে গান ধরে :

ও সখী তোমার রূপের আলোয় আলো পড়ে আমার চোখেতে
কালো ভোমরা পাগল হইল, পুইড়া মইল, তোমার রূপেতে।
ও বঙ্কিম নয়ন তুইলা আমার পানে চাইও না
কালসাপিনী মনমোহিনী কেশ দুলাইও না,
ওই হাসি দিয়া ভুলাইও না এই মিনতি করি তোমার পায়েতে।

গান শেষ করে সুবল রাধার অভিনন্দনের জন্য হাসিমুখে বসে থাকে। একটা গভীর তৃপ্তির আবেশে চোখ জড়িয়ে আসে তার। এমন তৃপ্তি সে পেয়েছিল মন্বন্তরের গান বেঁধে। এমন তৃপ্তি পেয়েছিল যাত্রার দল থেকে বেরিয়ে প্রথম যেদিন সে একতারাটা নিয়ে পথে এসে দাঁড়িয়েছিল। তার গান-মুগ্ধ লোকেরা বাবাজি বলে যখন তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করেছিল, সে বলেছিল, নাম আমার সুবল সাধু! লোকে বলেছিল, বিনয়ের অবতার! তা–কুণ্ঠাইকার সাধু গো? গয়া না কাশীর?—এ ঠাট্টার কী সুন্দর জবাব দিয়েছিল সুবল। আহা!—গেয়েছিল—

রসিক জনে ঠাট্টা করেন দেইখ্যা জনম দুখীরে
শুইনা হাসেন সাধু পরিচয়–
ও হরি–কইয়া দেও তোমার জনম সুখীরে;
সাধু মাঝে চোর বাটপার ব্রহ্মচারি নয়!

এ গান শুনে চারিদিক থেকে সেই সাধুবাদ, সেই অভিনন্দন ভুলবে না সুবল। সুবলের বাল্যগুরু কমরুদ্দিন ফকির। সে তাকে ডাকত, সুবল সাধু। তাই সে এই পরিচয় দেয় লোকের কাছে। আজ রাধাকে নিয়ে যে গান সে গাইল—তা বড় আকস্মিক। তৈরি না করেও এ গান তার সর্বাগ্রে আপনিই এসে গেছে।

কিন্তু রাধা গেল কই? গান শুনে তো কিছু বলতে এল না! হয় তো লজ্জা পেয়েছে। সুবল রান্নাঘরে গিয়ে উঁকি দেয়। রাধা নেই। ঢেঁকিঘরে দেখে সেখানেও নেই। গেল কোনখানে? সুবল বাড়ির পিছনে আসে।—হ হাসতেছে বুঝি? কামরাঙা গাছের গোড়াটায় বসে বসে যেন হাসির দমকে দমকে ফুলছে। সামনে গিয়ে সুবল আড়ষ্ট স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। এ কী–কাঁদছে! ব্যগ্র গলায় প্রশ্ন করে সে, কী হইল সখী,আমার গান শুইনা দুঃখু পাইছ? কান্নার আবেগে রাধা কথা বলতে পারে না। কী এক পুঞ্জীভূত বেদনার অশেষ কান্নায় যেন সে ভেঙে পড়েছে। ক্ষোভে-দুঃখে সুবলের বুক ভরে ওঠে। গান গেয়ে সে দুঃখ দিল তার সখীকে বিস্মিত ক্ষুব্ধ প্রশ্ন জমাট বেঁধে ওঠে তার মনে। বলে, আমি না জাইনা গাইছি সখী, আমারে ক্ষমা করো। তোমারে তো আমি দুঃখ দিতে চাই নাই!

চোখ মুছে রাধা কান্না জড়ানো গলায় বলে, তোমার দোষ নাই, আমারই কপাল মন্দ। এই রূপ দিয়া কী করুম সখা, ধুইয়া জল খামু? এই রূপ দেইখা তোমার বন্ধু শান্তি পায় না।

আবার অশ্রুর বন্যা আসে রাধার চোখে। সুবল বিস্মিত প্রশ্ন করে ক্যান?

রাধা বলে, তুমি কি দেখো না, তোমার বন্ধু আমার লগে কথা কয় না। আমারে য্যান্ ঘিন্না করে। আমারে আর ভাল লাগে না তার। তবে আর এই পরানের কি দাম আছে, কও?

-হ। সত্যিই তো, সুবল কিছুদিন থেকে দেখছে মনাই যেন কেমন আনমনা। কাজকর্মের পর বাড়িতে গুম হয়ে বসে থাকে। কথাবার্তা নেই, কেমন চিন্তিত ব্যথিত উদাসীন।

কিন্তুক ক্যান্ সখী? সুবলের বড় অস্বস্তি লাগে।

—আমার এই পোড়া রূপই সার–মাকাল ফলের বাহার। এই রূপের কথা শুনলে পরে আমার বড় কষ্ট লাগে। কান্নার আবেগে রাধার গলা প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। তোমার বন্ধু আমার কাছ থেইক্যা…একটা পোলা চায়। বলতে হৃৎপিণ্ডটা যেন ছিঁড়ে যেতে চায় রাধার।–কিন্তু আমার যে পোলা হইব না গো! আমি যে–

বন্ধ্যা কথাটা উচ্চারণ করতে গিয়ে ড়ুকরে ওঠে সে। সুবলের বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। আহা! সত্যিই তো। রাধা আর মনাইয়ের এতবড় দুঃখের কথাটা তো কোনওদিন ভেবে দেখেনি সে! মুখ ফুটে কোনও কথা বলতে পারে না সে রাধাকে। আনমনে একতারাটার তারে ঘা দেয় সে। এর কোনও প্রতিকার তো জানা নেই তার। এ তো স্বয়ং ভগবানের হাত, মানুষের সৃষ্টিকর্তা তিনি! দীর্ঘ নিশ্বাসে ভারী হয়ে ওঠে সুবলের বুক। বলে, কাইন্দো না। কী করবা, মাইষের হাত নাই এইতে। কামনা করি তোমার য্যান্ ঘর-ভরা পোলাপান হয়।

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে গুনগুনিয়ে ওঠে সে :

প্রভু অবুঝ মোরা, বুঝি না তোমার রঙ্গ হে!
মা করিয়ে গড়েছে যারে দিয়েছে এতেক রূপ,
তবু শুন্য বুক, শূন্য গর্ভ এ তোমার কেমন রঙ্গ হে?

এমন সময় আসে মনাই। বড় ব্যস্ত মনে হয় তাকে। সঙ্গে তার আরও অনেক লোক—শ্রীশ, ফকির, মধু, হেম, মানু অনেকে। ব্যাপারটা কী? সুবল এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে মানুকে, ব্যাপার কী তোমাগো মানু? মানু রহস্যজনক ভাবে হাসে। সুবলের কানের কাছে মুখ নিয়ে কী যেন বলে ফিসফিস করে।

—হ? অহন কি কামারবাড়ি যাইতেছে? সুবলের মুখ বিস্মিত হাস্যে ভরে ওঠে।

হ। তোমারে কিন্তু গান করিতে হইব, সাধু! মাথা ঝেঁকে হেসে বলে মানু।

—আরে নিচ্চয়, নিচ্চয়।

চিঁড়ে-মুড়ির পুঁটলি নিয়ে বেরিয়ে আসে মনাই। সুবলকে বলে, হেই কাইল লাগাত ঘরে ফিরুম, বোঝলা সাধু? চলি।

চকিতে ঢেঁকি-ঘরের পাশে রাধার ব্যাকুল-জিজ্ঞাসু মুখের দিকে একবার কটাক্ষ করে আবার বলে। সে, ডর নাই। কামার বাড়ি যাইতেছি। কাম রইছে মেলা। সঙ্গীদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে।

পরদিন ভোরবেলা রাধা উঠোন নিকোতে নিকোতে বোধ হয় মনাইয়ের দুর্ব্যবহারের কথা মনে রেখেই চোখের জল ফেলছিল, আর সুবল একতারাটার তারে আনমনা খেয়ালি হাতে ঘা দিচ্ছিল।

এমন সময় হঠাৎ চতুর্দিক গমগম করে ওঠে ঢাকের শব্দে। চকিতে রাধা খাড়া হয়ে ওঠে, থরথর করে কেঁপে ওঠে তার সর্বাঙ্গ। জলে ভেজা চোখে তার শঙ্কা না পুলক..বোঝা যায় না। মনাইরা কী তা হলে সত্যি সত্যি শুরু করলে?

আচমকা থেমে যায় সুবলের হাত। চোখ দুটো তার চকচকিয়ে বড় হয়ে ওঠে। তা হলে শুরু হল? তারা দুজনে ছুটে গিয়ে ওঠে দাওয়ার ওপর। তাকায় মাঠের দিকে।

হ্যাঁ, সত্যিই শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে—তাই পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটোছুটি করছে পীতাম্বর সা। বুক চাপড়াচ্ছে, শাসাচ্ছে, গালগাল দিচ্ছে একটা অসহায় খেপা কুকুরের মতো।

সরু আল পথ বেয়ে দলে দলে নারী-পুরুষ শিশু বৃদ্ধ জমা হয়েছে। ঘিরে রেখেছে, ব্যুহ রচনা করেছে পাকা ফসলের মাঠ ঘিরে।

বিসর্জনের বোল ভুলে গেছে ঢাকিরা। উৎসবের পাগলা মানের বোল যেন কথা কইছে ঢাকের পিঠে।

জীবনভর পেটের জ্বালার পরিসমাপ্তি করবে আজ তারা। তাই আজন্ম ক্ষুধার্ত আর ম্যালেরিয়া রোগীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে মাঠে। নিজেদের পেটের দানা আজ তারা কেড়ে নেবে। লড়াই তারা করবে, প্রাণ তারা দেবে, তবু ঘাড় থেকে তারা ঝেড়ে ফেলবে বহুদিনের সঞ্চিত সমস্ত ঝামেলা, কাঁটার বোঝা।

গভীর উত্তেজনায় রাধা সুবলের একটা হাত চেপে ধরে। সুবল ভাবছে, শ্রীশ, মধু, হেম, ফকির, মানু, মনাইদের কথা। রোগা ক্ষীণজীবী ঝগড়াটে স্বার্থপর মানুষগুলির মধ্যে প্রাণের এত আবেগ। এরা সেই তারা—যাদের সম্বন্ধে সুবল কতদিন গভীর চিন্তায় ড়ুবে গিয়ে বলেছে, ভগমান। তোমার রাজ্যে মানুষকে আঁধিয়ার করেছে কে?

কিন্তু আজ এ কী দিন এল?

সুবল একতারাটা নিয়ে মাঠের দিকে পা বাড়ায়। কী গান গাইবে সে আজ! আজ তো তাকে গাইতে হবে ঢাকের তালে তালে!

গাঁয়ের ধারে ধারে ভিড় করা মানুষগুলোর চোখে যেন কী এক উল্লসিত স্বপ্নের ছায়া নেমে এসেছে!

সুবলের মনে পড়ে মনাইয়ের কথাগুলি : জোতদারের ঘরে এবার অর্ধেক ফসল তারা তুলে দিয়ে আসবে না। তিন ভাগের দু ভাগ তারা নেবে, এটা হক–ন্যায্য প্রাপ্য। বলে, সবই তো আমাগোর। পীতাম্বরের আছে কী? তার বাপ ঠাকুরদা জমি কিনা রাখছিল, হের লেইগা অর্ধেক ধানে তার হক থাকব নাকি? বীজ ধানের থেইক্যা শুরু কইরা– ভিজে-পুইড়া হালার আমাগো পরান শুকাইয়া গেল—আর আধ বখরা দিমু তারে! ক্যান? মরুম? দেনায় জমি গেছে, ভিটা গেছে আর আছে কী?

রাধা বলত একটা মিঠে বোকাটে কটাক্ষ করে, এইডা তো জগতের নিয়ম! ভাগে কাম করো না তোমরা?

মনাই যেত চটে। বলত, তুই চুপ থাক্‌ দেহি! চির দিনই এই অনিয়ম অনাচার থাকব নাকি? আমাগো হক নাই এট্টা? আমরা কি গরু?

-হা, হাঁচা কথা কইছ ভাই। সুবল সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করত মনাইকে,-আমাগো হক আছে, হেই কথা ভাবব কেডা আমরা না ভাবলে?

তাকে আসতে দেখে সবাই চিৎকার করে ওঠে—সাধু আইয়ো, কবি আইয়ো। সুবল একেবারে মাঝখানে এসে ঘাড় কাত করে, গালে একটা হাত দিয়ে সুর দেয়, হা-আ আ-হা-রে…

ঢাকিরা এগিয়ে আসে সুবলের কাছে। সুবল ধরে ঢাকের তালে তালে :

হায়—একি ঘটন ঘটল কলির রাজ্যে
মরা মাইনষের হকের লড়াই
ঢাকের বোলে বাজছে!

ধান কাটতে কাটতেই সবাই ধুয়া দিয়ে ওঠে :হায় হায় রে!

সুবলের বুকের মধ্যে দুলে ওঠে। এক উন্মত্ত নেশায় যেন পাগল হয়ে ওঠে সে। ঢাকের তালে তালে নাচতে দেখে ঢাকিদের মগজেও যেন কেমন নেশা চেপে যায়। তাদের কোমর দোলানি শুরু হতে থাকে আস্তে আস্তে সারা দেহ এঁকেবেঁকে ওঠে সাপের মতো।…সুবল আবার ধরে :

আমার খুনের দানা কাইটা লমু মানিনা হুকুমদারি
কলিজার খুনের পরদায়–প্রাণ বাঁচামু সত্যযুগের হকদারি।

হায় হায় রে! ধারালো কাস্তের দুরন্ত বেগের সঙ্গে ধুয়া দিয়ে ওঠে সবাই।

সারাটা বেলা সুবল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়ায়। কোথাও বাকি নেই। সারাটা পরগনা জুড়েই পড়েছে ধান কাটার পালা। শহরে দেখা সেই মেশিনের মতো সবাই একযোগে নেমে পড়েছে মাঠে। সুবলকে অভিনন্দন জানায় সবাই। পরগনার প্রাণ সুবল। তাদের এই অভিনব নতুন দিনে সমস্ত ত্ৰাসটুকু সুবল যেন নীলকণ্ঠের মতো গিলে নিয়েছে। তাই অসহ্য ভাষার আবেগে সুবলের জিহ্বা চঞ্চল, কণ্ঠ ক্লান্তিহীন।

অন্ধকার ঘোর হয়ে আসে। বাড়ি ঢুকতেই শুনতে পায় মনাই বলছে, জলটুকু খাইয়া ফেলা রাধা। মহেশ ঠাকুরের পড়া জল, মা ষষ্ঠীর চরণ ধোয়া। এর লেইগা হেই নিমাইহাটা গেছিলাম। কপালে যদি থাকে। বিস্মিত রাধা বলে, হ? নিমাইহাটা গেছিলানি? হা আমার পড়া কপাল! একটা সশব্দ দীর্ঘ নিশ্বাস পড়ে তার।

সুবলও কম বিস্মিত হয় না। এর মধ্যে ধান কেটে মনাই নিমাইহাটা ঘুরে এসেছে। হতাশায় নুয়ে পড়া মনটায় তার এত আশা, এত অনুপ্রেরণা কোত্থেকে এল?

–নে-খাইয়া ফেলা। আর বাতাস লাগাইস না। বাইরে হাওয়া লেগে পড়া জলটুকুর মাহাত্ম্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে মনাই বলে। রাধা আর দ্বিরুক্তি না করে ঢক করে খেয়ে ফেলে জলটুকু।

অন্ধকার উঠানে দাঁড়িয়ে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে সুবল যুক্তকর কপালে ছোঁয়ায়।

কিছুদিনের মধ্যে ধানকাটা প্রায় শেষ হয়ে আসে। সুবলের ডাক পড়ে এখানে। তাকে নিয়ে মাতে সবাই ধানকাটার গানে, শোনে তাদের বোবা মনের অবোধ্য, অব্যক্ত ভাষা–সুবলের গলায়।

কিন্তু সুবলের চোখে মুখে একটা বিস্ময়ের ঘোর যেন সদাই লেগে আছে। সে রাধাকে দেখে আর থমকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। ব্যাপারটা কী? এটু য্যান্ কেমুন মনে হয়? হ!

কিন্তু বলতে পারে না কিছু। লজ্জা হয়, সঙ্কোচ হয়, দ্বিধা আসে মনে। হয় তো তা নয়। তবু এমন স্পষ্ট হয়ে ঠেকে সুবলের চোখে—যে সে নিজেকে আর অবিশ্বাস করতে পারে না। একদিন বলেই ফেলে, এট্টা কথা কমু সখী, অপরাধ লইয়ো না।

রাধার মুখে হঠাৎ কেমন লালচে ছোপ ধরে যায়। লজ্জিত জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় সে সুবলের দিকে। সুবলের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। বেশ দৃঢ় ভাবেই বলে, তোমার পোলা হইবে সখী!

হঠাৎ যেন একটা ভারী জিনিসে ধাক্কা খেয়ে রাধা কেঁপে উঠে টলতে থাকে। চোখ দুটো বুজে আসে। পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সুবল ধরে ফেলে তাকে তাড়াতাড়ি। কী হইল রাধা?

কয়েক মুহূর্ত মাত্র। একটু পরেই রাধা আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তবু চোখের পাতা তার এত ভারী হয়ে এসেছে যে সে সুবলের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারে না। কয়েক মাস ধরে যে সন্দেহ সে মনে মনে গোপনে পোষণ করে আসছে, তাকেই দ্বিধার সঙ্গে প্রকাশ করে, বোধ হয়।

সুবলের মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।—বোধ হয় না, তাই। এ আর কিছু না। তুমি নিজের দিকে চাইয়া দেখো না নাকি—আঁই? তা নাইলে–তার উৎসুক দৃষ্টিটা রাধার কটিবন্ধনের কাছে গিয়ে থেমে যায়। বলে কতদিন থেইক্যা?

প্রায়..চার-পাঁচ মাস। আমার কিছু– রাধার মুখে আর কথা ফোটে না। এত অসম্ভব লজ্জাবতী সে কবে থেকে হল!

সুবল কপাল চাপড়ায়—হা পোড়া কপাল! এই পাঁচটা মাস তুমি মনাইরেও কিছু কও নাই?

রাধার ঘর্মাক্ত হাতটা ছেড়ে দিয়ে সে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, মনাই..মনাইহে! মানুষডা গেল কুনঠাঁই?

উচ্ছ্বসিত হয়ে বেরিয়ে পড়ে সে বাইরে।

রাধা চকিতে ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে কোমর থেকে কাপড়টা খুলে ফেলে। নিজের সামান্য স্ফীত জঠর সে মুগ্ধ বিস্ময়ে নিরীক্ষণ করতে থাকে। আলতো ভাবে খুব সাবধানে গভীর মমতায় হাত বুলোয়। হ, ক্যামুন য্যান লাগে! গভীর সুখে তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। সে আজ বিজয়িনী, সে আজ সত্যি গরবিনী। কারও চেয়ে কোনও অংশে কম নয় সে। তার ইচ্ছে করে পেটের উপর কান পেতে শোনে তার সমাগত সন্তানের হৃৎস্পন্দন। কিন্তু তা হবার নয়। না হোক—সে স্পষ্ট অনুভব করে তার মধ্যে রয়েছে আর একটা মানুষ—ছোট্ট এইটুকু।—তার মনাইয়ের সন্তান রাধার সন্তান!

গভীর সুখানুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে সে। সত্যিই তো মানুষটা গেল কুনঠাঁই। সে কি জানে না রাধা তার সন্তানের মা হতে চলেছে? বাড়ির বাইরে এসে সে মাঠের দিকে তাকায়। হ–মাঠের উপর অনেক লোকজন জমা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে! ব্যাপারটা কী? এক পা এক পা করে এগোয় সে।

ও! সভা ডেকেছে পীতাম্বর সা, সোনা মিয়া, জহুরুদ্দিন–সব জোতদারেরা। ক্যান? দেশের অমঙ্গল হয়েছে, সর্বনাশ ডেকে এনেছি আমরা? অর্ধেক পথ থেকেই ফিরে আসে রাধা। মানুষডা হেই ঢ্যামনাগো কথা শুনছে বুঝি?

পোড়া কপাল!

পেছন পেছন সুবল আসে হন্তদন্ত হয়ে।

শোনো শোনো সখী, এট্টা কথা শোনো! খুশি উপচে পড়ে তার গলায়– বড় ভাল কলি মনে আইছে, শোনো দেখি! গুন্ গুন্ করে ধরে সে :

তা না না–না–না-রে–
পরান ছেঁচিয়া সোনা তুলিল নিজ ঘরে,
সোনায় আনিল সোনা মলিনার গর্ভে
জননীর হাসিতে মা লক্ষ্মীগোলা ভরে।
অঘটন নয় হে সখি—শোন সখার কথা—
ভণ্ড কলি পরাস্ত, হাসি খুশি মুক্ত বটে স্বরগের দেবতা!..

রাধা বিস্মিত শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয়ে ওঠে, হ, বড় মানানসই গাইছ কিন্তুক সখা। পরান ছেঁচিয়া সোনা তুলিল নিজ ঘরে– বড় হাচা গান গাইছ।

সুবল মুচকে হেসে বেমক্কা জিজ্ঞাসা করে ফেলে, কেউরে খুঁজতে আইছিলা নাকি সখী?

উঁহু! রাধা মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

সুবল গম্ভীর হবার চেষ্টা করে। আমি ভাবলাম বুঝি কোন মানুষরে খুঁজতে আইছ! তা হঠাৎ চোখাচোখি হতেই উভয়ে অজস্র হাসির আঘাতে ভেঙে পড়ে।

—যাঃ ফাজিল কুনঠাঁইকার!

কুটিল কটাক্ষ হেনে রাধা তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়। পদক্ষেপের চঞ্চল বেগে তার সর্বাঙ্গ দুলে দুলে ওঠে, নেচে নেচে ওঠে। তার দোলায়মান দেহে ফুটে ওঠে মত্ত নাচের ভঙ্গি, হৃদয়াবেগের দৈহিক প্রতিচ্ছবি। সুবল গেয়ে ওঠে :

জনম তপস্যা তব সফল হইল গরবিনী।
হেলিয়া দুলিয়া চলে স্বামী-সোহাগিনী।
আহা—হেলিয়া দুলিয়া চলে–

গান শেষ করে বলে, বন্ধুর আসতে কিন্তু দেরি হইব সখী। তাগো সমিতির ঘরে নাকি সভা হইব!

রাধা ক্ষুব্ধ হয়। হ,মানুষটার য্যান্ দিশা নাই। সমিতি আর সভা, এত ল্যাঠা ক্যান্। সুবল বুঝতে পারে রাধার অভিমান! অপরাধটা গায়ে পেতে নিয়ে ওর মনের কথাটাই সে প্রকাশ করে দেয়, একটা গোলমাল হইতে পারে, হামলা হইব বইল্যা মনে হইতেছে।

রাধা চমকে ওঠে—সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। গ্রামবাসীর আশঙ্কা তা হলে সত্যি!

সুবল রীতিমতো গম্ভীর হয়ে ওঠে। বলে, সখী এই দুনিয়ায় মানুষের কিছুতে হক কাড়তে হইলে পরান দিয়া লড়তে হয়। সোয়ামী তোমার হকদারির যোদ্ধা-লড়াই শেষ করতে হইবে না তারে?

-হ। রাধা স্বীকার না করে পারে না।

পীতাম্বর সার সভা শেষ হয়। লোকজন ফিরতে থাকে রিক্ত মাঠের ওপর দিয়ে। রাধা ঘরে যায়। সন্ধ্যা দিতে হবে।

সুবল কেমন উদাস হয়ে যায়—দিগদিগন্তহীনশূন্য মাঠের দিকে চেয়ে। সমস্ত ফসল কাটা হয়ে গেছে, শুধু চোখে পড়ে এখানে সেখানে জল-ঘাসের হেলানো মাথা, বিলের কচুরিপানার উত্তোলিত ডগা বিরাট বিল জুড়ে ছাওয়া।…আবার আসরে পৌষ, কাটা হবে ফসল, সকলের গোলা হবে ভরতি। অনাহার নয়, দেনা নয়, রোগ নয়, মৃত্যু নয়, মা লক্ষ্মী থাকবে ঘরে বাঁধা। আর আবার রাধার দেহে নতুন সন্তান সম্ভাবনা হয় তো ফুটে উঠবে রেখায় রেখায়। আহা মানুষের সে জীবন কী সুন্দর না জানি কেমন!

ক্রমশ রাত্রির অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। রাধা বলে : সন্ধ্যা বাতি দিতে গিয়া আমার হাত থেইক্যা ধুপতি পইড়া গেছে। সখা, কেমুন করিতেছে মনড়া। তোমার বন্ধুরে একবার ডাইকা লইয়া আহ!

দ্বিরুক্তি না করে সুবল বেরিয়ে পড়ে। খানিকটা যেতেই দেখে-দক্ষিণের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। আর একটু পরেই দাউ দাউ করে ওঠে লেলিহান আগুনের শিখা। ভেসে আসে একটা চাপা আর্তনাদ-কোলাহল। কার বাড়িতে আগুন লাগল? এগোবার উপক্রম করতেই হঠাৎ একটা শব্দে চমকে সে রাস্তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কে যেন আসছে! কিন্তু লোকটা সুবলের সামনে এসেই দাঁড়িয়ে পড়ে। রুদ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করে, কে?

মনাইকে চিনতে পেরে সুবল সামনে আসে। বলে, আমি সুবল, ব্যাপার কী?

আইছে, তারা আইয়া পড়ছে। আগুন লাগাইয়া দিছে সমিতির ঘরে। চল—ঘরে চল! কেমন ব্যস্ত এবং ক্রুদ্ধ শোনায় মনাইয়ের গলা।

বাড়ি এসে কিছু চিড়ে মুড়ি বেঁধে নেয় সে কাপড়ে। সব শুনে রাধা সমস্তই ব্যবস্থা করে দেয়।

হুলিয়া বাইরইছে আমাগো, বোঝনি? নিমাইহাটার বংশী মণ্ডলের বাড়িতে চললাম রাধা। দেখিস, পারবি তো?

রাধা গর্জে ওঠে, আমি শিবদাস মোড়লের মাইয়া না? ধান কাড়বনি আমার কাছ থেইক্যা? কত মায়ের দুধ খাইছে ঢ্যামনারা দেইখ্যা লমু। তুমি যাও গা—দেরি কইরো না।

সুবল কোথাও যেতে অস্বীকার করে। মনাইয়ের কানে কানে বলে, তোমার বউ যে পোয়াতি, আমারে দেখতে হইব না?

হ? মনাই ও আবার বেঁকে বসে। বলে, তবে আর যামু না। পরান দিতে হয়—এইখানেই দিমু।

কিন্তু রাধা দৃঢ় গলায় আপত্তি জানায়—তোমারে ধইরা লইয়া যাইব যে? তুমি থাকতে পারবা না–যাও! জোর করে সে মনাইকে সরিয়ে দেয়।

তারপর সবাই রুদ্ধ নিশ্বাসে প্রতীক্ষা করে থাকে। সমস্ত গ্রামটাই প্রতীক্ষা করে থাকে অনিবার্য লড়ায়ের দৃঢ় প্রতিরোধের জন্য। শত্রুর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকে সবাই। জান কবুল, তবু ধান ছাড়বে না কেউ। এ তাদের অভাব-অনটন রোগ-শোককে ছাড়িয়ে বাঁচায় অভিযান।

রাত্রি ভোরেই হঠাৎ ওঠে আর্ত কোলাহল। এসেছে, শত্রু এসেছে? ধড়মড় করে উঠতে গিয়ে সুবলের ধাক্কা লেগে একতারাটা পড়ে যায়। যাক যাক। চকিতে একবার সেদিকে দেখে সে বেরিয়ে পড়ে।

ড়ুকরানি শুনে শ্রীশের বাড়িতে ঢোকে সে!

সব শেষ করে দিয়েছে! শ্রীশের বউ পড়ে আছে উঠানে—গালের কশ বেয়ে রক্ত ঝরছে তার। ঘরের সমস্ত ঘটিবাটিকাঁথা লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে উঠোনের ওপর।

পুলিশের লোক আমার মায়েরে মাইরা ফেলাইছে।

সুবল চকিতে ফিরে দেখে শ্রীশের বারো বছরের ছেলে গোলার কাছে মায়ের উপর পড়ে চিৎকার করছে, মা…মা গো!…

সুবলের বুকের মধ্যে কান্না ঠেলে আসে। ছুটে বেরিয়ে আসে সে।

সাধু…সাধু.

সুবলকে ডাকছে রহিমের বড় মেয়ে। রহিমকে মেরে ফেলেছে ওরা। জমাট বেঁধে উঠেছে তাজা রক্ত রহিমের পাঁজরায়। রহিম! রহিম! কবি সুবলের দাঁতে দাঁত চেপে বসে যায়। নির্মম নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে তার পদক্ষেপ। এ লড়াই কি শেষ লড়াই।

মাইরা ফেলাইল গো…বাঁচাও!

উলঙ্গ মানুর বউকে তাড়া করে আসছে পশুর দল।

মার–মার…

বহু দূর থেকে মেয়েরা ছুটে আসছে দা কুড়ুল লাঠি ঝাঁটা যা পেয়েছে তাই নিয়ে। সর্বাগ্রে রহিমের বউ-হাতে কাটারি! আশ্চর্য! একদিন পেটের জ্বালায় রহিমকে ছেড়ে না সে অপরকে নিকা করেছিল! অপরের পর্দানশীন বিবি সে!

ডাকাতগুলি ততক্ষণে ধরে ফেলেছে মানুর বউকে। ইস্! পাশবিক ধর্ষণের এমন বীভৎস রূপ কল্পনা করতে পারে না সুবল। ধানকাটা মাঠের শক্ত খোঁচা খোঁচা ডাঁটিগুলোর উপর ফেলে হিংস্র কুকুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে সব। ভোরের স্পষ্ট আলো ঝাপসা হয়ে আসে সুবলের চোখে। পীতাম্বর সা-র উল্লসিত মুখটা কুৎসিত অট্টহাসে কেমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।

-মার-মার

মারমুখী মেয়ের দলকেকাছাকাছি এসে যেতে দেখে ডাকাতগুলো পীতাম্বর সার পেছন পেছন ছুটে পালায়।

মানুর বউয়ের কাছে উদ্বেগে ভেঙে পড়ে সব। —হায় ভগবান বাঁচবনি?

.

পুলিশ নিয়ে পীতাম্বর সার দল ঘুরে আবার গ্রামের মধ্যে ঢোকে। রাধা! রাধা একলা রয়েছে মনে হতেই সুবল ছোটে গায়ের দিকে।

থেকে থেকে বন্দুকের শব্দে গ্রাম কেঁপে ওঠে। কেঁপে ওঠে সুবলের বুকের ভেতর। প্রাণপণ গতিতে সে ছোটে।

গুড়ুম!…তালা লেগে যায় সুবলের কানে।

সুবল-সুবল? কে যেন ডাকছে সুবলকে। পেছন ফিরে দেখে—মনাই। কেন আসছে? সে কি জানে না পুলিশ এসেছে গাঁয়ে। তছনছ, খুনখারাপি, ধর-পাকড় ভীষণভাবে হচ্ছে গাঁয়ের মধ্যে, জেনে দেখেও সে আসছে কেন?

আধখানা জিভ প্রায় বের করে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়ায় মনাই। মুখের দুই কশে থুথু জমে উঠেছে ফেনার মতো।

কেমুন মানুষ তুমি—আইয়া পড়লা যে? সুবল ধমকে ওঠে—উৎকণ্ঠিত গলায়।

 মনাইও অনুরূপ উৎকণ্ঠায় বলে, গেরামের অবস্থাটা দেখছনি?

আরে হের লেইগাই তো তুমি নিমাইহাটা গেছিলা। এইখানেই আইলা কোন কামে?

উদ্বেগে মনাইয়ের গলা কাঁপে, পারলাম নারে সুবল সখা, মনডার মধ্যে কেমুন করতেছিল, পারলাম না থাকতে। রাধার পেটে না পোলা! কতদিনের আশা-মনডা মানল না।

আমি আছিলাম না? বলতে বলতে সুবল চলতে আরম্ভ করে। তোমারে যদি অহন ধইরা লইয়া যায়?

হ, সে আশঙ্কাও অস্বীকার করে না মনাই। তবু বলে উৎকণ্ঠিত করুণ গলায়, রাধারে বারেক ভাল দেইখ্যা আবার আমি যামুগা।

এ-দিক থেকে পুলিশ সরে গেছে। নিরুপদ্রবে মনাই আর সুবল এগিয়ে যায়।

বাড়িতে ঢুকেই মনাই থমকে দাঁড়িয়ে ড়ুকরে ওঠে, রাধা!

রাধার মুখে সাড়া নেই। অক্ষত গোলার সামনে উবু হয়ে পড়ে আছে রক্তাক্ত রাধা।

মনাই পাগলের মতো ছোঁ মেরে রাধাকে বুকে তুলে নেয়।—রাধি রে।

রাধার তলপেটটা যেন কে ছিঁড়ে দিয়েছে। অনর্গল রক্তধারায় ভিজিয়ে দিয়েছে মাটি।

হ, রাধার পেটে না পোলা আছিল? বড় আশা বহু দিনের…। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে মনাইয়ের বুকে!

সুবল মনাইকে জড়িয়ে ধরে।

একটা পোলা আছিল। একটা– হু হু করে কেঁদে ফেলে মনাই।

সুবলের বুকে আগুন জ্বলে। রাধার রক্তে ধোয়া মাটির উপর দাঁড়িয়ে কম্পিত ঠোঁটে কী যেন সে ফিসফিস্ করে বলে। বলে আর তার চোখের দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়ে আসে। বলে, তোমারে ভুলুম না কোনওদিনের তরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *