১৬. তাহমিনা চলে যাবার পর

তাহমিনা চলে যাবার দেড় বছর পর আবিদ এলো ঢাকায়। এই দীর্ঘ দেড় বছর সে কোথাও বেরোয় নি। সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করেছে। ব্যবসারও সমস্ত কাজ প্রায় ছেড়ে দিয়েছে আশরাফের হাতে। ভালো মন্দ সে যা করছে তাই ভালো। মাঝে মাঝে জরুরি কাগজপত্রে সই করে ও শুধু। আর মোটা টাকার দরকার হলে চেকে। তার উচ্ছল প্রাণ বন্যায় একটা পাথর চাপা পড়ে রুদ্ধ হয়ে গেছে। নিরানন্দ দিন আর নীরব মুহর্ত। ডেক চেয়ারে বসে থাকাটা একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে তার • খেতে খেতে কোনদিন মুখে গ্রাস তুলে হয়ত চুপ করে থাকে অনেকক্ষণ। আবদুল অস্বস্তি বোধ করে পাশে দাঁড়িয়ে। তবু হয়ত সে তেমনি চুপ করে ভাবছে। তারপর হঠাৎ চমক ভেঙে দ্রুত খাওয়া শেষ করে ন্যাপকিনে মুখ মুছে উঠে আসে। আবদুলের দেখে শুনে ভালো লাগে না। কোন কোন দিন আশরাফকে সে ক্ষোভের সাথে বলে, হুজুর, এরচে আমাকে বিদেয় দিন, চলে যাই।

কিন্তু তাই বলে সত্যি সত্যি সে চলে যায় না। সব সময় ছায়ার মত আবিদের সাথে সাথে থাকে। অনেক রাতে উঠে আবিদের কামরা দেখে আসে।

আশরাফও ভাবছিল এমন করে আর কদিন? দিনে দিনে আবিদের শরীর ভেঙে পড়ছে। অথচ জিগ্যেস করলে, বললে, কানই দেয় না। স্পষ্ট সে বুঝতে পেরেছিল, এমন করে বেশি দিন চললে একটা কিছু হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া কি নিয়ে ও বেঁচে থাকবে? কি তার অবন? এমন স্তব্ধ পাথর জীবন সে বইবে কী করে? একদিন আশরাফের মনে হয়েছে যদি সে আত্মহত্যা করে। আফিয়াকে সে বলেছিল কথাটা। সেও সায় দিয়েছে, কিছুই বিচিত্র নয়। পরদিন আশরাফ বাংলোয় গিয়ে সব বন্দুক কিওরিও ঘরে রেখে তালা বন্ধ করে চাবি নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। শুধু একটা বন্দুক দিয়েছে আবদুলকে।

এটা তোর কাছে রাখবি। কাছছাড়া করবি না আর বাংলোয় আনবি না কখনো, তোর কামরাতেই রেখে দিস।

আবদুল একটু বিস্মিত হয়ে বলেছে, আচ্ছা।

কয়েকদিন পর আবিদ আশরাফকে বলেছে, রাইফেল সব বন্ধ করে চাবি নিয়ে গেছেন, না?

তবে কি আবিদ সত্যি সত্যিই আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল? আশরাফ চমকে উঠল। বলল, হ্যাঁ।

আবিদ একটু কাল তার দিকে তাকিয়ে তারপর হাতের বই ওলটাতে ওলটাতে বাইরের দিকে চোখ রেখে শান্ত গলায় বলেছিল, আপনার ভয়, আত্মহত্যা করব। না করব না। এইখানে। একটু হাসল সে, তাহলে অনেক আগেই করতুম। যে মরেছে সে আবার মরে না।

মরে না ঠিকই, আবিদও হয়ত মরতে চায় না, তবুও আশরাফ দেখেছে দিনের পর দিন যে অযত্ন আর বিশৃঙ্খলা চলেছে তাতে মন্দ একটা কিছু হবার আশঙ্কা আছে পুরোপুরি। তাই একদিন আফিয়া আর খোকাকে সে নিয়ে এলো এ বাংলোয়। তারপর থেকেই আবিদের পুরোপুরি ভার আফিয়ার ওপর। ধীরে ধীরে সে ফিরিয়ে আনলো সংসারের শ্রী আর শৃঙ্খলা নিপুণ হাতে। আবিদের নাওয়া খাওয়ার ধরাবাধা সময় হলো। ইচ্ছেমত ডেকচেয়ারে বসে আকাশ পাতাল ভাববার তার আর অবকাশ বইল না। সে সময় আফিয়া কাছে এসে গল্প করতো। তাকে ভুলিয়ে রাখতে চাইতো। বার থেকে দেখলে মনে হতো ঠিক আগের মতই আবার সব কিছু চলছে, শুধু একটু কাছে এলেই আজো অনুভব করা যায় সেই শূন্যতা। আফিয়া মাঝে মাঝে কথা তুলত। কিন্তু আবিদ আর আগের মত উড়িয়ে দিত না ম্লান হেসে, শুধু চুপ করে থাকত। তার এই নীরবতা দেখে একটু আশান্বিত স্বরে আফিয়া হয়ত বলে, তাহলে কবে যাবে বলো? নাকি খোকার আব্বা যাবে?

আমার ভালো লাগছে না ভাবী। আমি কিছু ভাবতে পারছিনে। একটু পরে আবিদ নিজেই শুরু করে, আচ্ছা ভাবী, তোমরা তো মেয়ে ওর কি একবারও আমার কথা মনে পড়ে না?

পড়ে বৈকি? দেখো, তুমি গেলেই আসবে। এদ্দিনে ভুল বুঝতে পেরেছে ও।

না, পড়ে না। আর ভুল বলছ কাকে? তুমি তো সব শুনেছ। না, না, ভুল ও হয়ত করে নি।

আফিয়া ইঙ্গিতটি বুঝতে পারে। নীরব হয়ে যায়। এরপরে তার আর কিছু বলবার থাকে না। আবিদ উদাস সুরে প্রায় নিজেকেই বলে, তুমিও পারলে না। বলো, এরপরেও আসবে? ও যেমন আছে তেমনি থাক, আমি গিয়ে অন্তরায় হবে না। হতে চাই না। আমি এমনিই বেশ আছি।

তোমাকে একটু কফি দিই, না?

দাও।

আফিয়া একটি ছল করে কিছুক্ষণ দূরে সরে থাকতে চায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *