০৯. আশরাফ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে

আশরাফ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল, আরো সকালে আসা উচিত ছিল আমার। দেরি হয়ে গেলো।

সে–কী। আসুন।

 আশরাফ নিজেই ভেতর থেকে আরেকটা চেয়ার টেনে নিয়ে এসে পাশে বসলো। বলল, কেমন লাগছে এই এলাকা?

খুব ভালো।

আপনারা শহুরে মানুষ তাই। আমাদের চোখে এর সব বিউটি মরে গেছে। উপমা দিলে বলতে হয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এর সব দেখেছি আর কোনো গোপন রহস্য নেই।

বলেই উচ্চকণ্ঠে হাসল আশরাফ।

যাকগে সেসব কথা। আঠারো বছর বনে বনে ঘুরে খাস বুনো হয়ে গেছি। আপনাদের এখনো ভালো লাগবে।

ভালো আমার লেগেছে। সকালে ঘাট অবধি গিছলুম।

ও তাই নাকি?

ও দিকে ঘুরে দেখবার ইচ্ছে আছে।

বেশ তো, চলুন না। দাঁড়ান, তার আগে তাহমিনার সঙ্গে দুটো কথা বলে আসি। কী যে বিপদ হয়েছে আমার!

কী রকম?

এই ফার্ম নিয়ে। আপনি বসুন, আমি চট করে আসছি।

আচ্ছা।

আশরাফ চলে গেলে পর ফারুক আবার ডুবলো তার ভাবনায়। কাল নিস্তব্ধ গভীর রাতের সেই ঘটনার কথা সে ভাবল। একই ছবিকে বারবার ঘুরিয়ে দেখতে লাগল নানান কোণ থেকে। আশরাফ শোবার ঘরের দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে ডাকল, তাহমিনা।

বিছানার ওপর উবু হয়ে শুয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল তাহমিনা। হাতে ছিল বই, কিন্তু চোখ ছিল না সেদিকে। ডাক শুনে তাড়াতাড়ি উঠে বসল। বুকের ওপর শাড়ি ঠিক করতে করতে বলল, আপনি!

হ্যাঁ, কথা ছিল। তোমার সময় হবে?

তাহমিনা দোরপর্দা সরিয়ে ডাকল, ভেতরে আসুন।

না ঠিক বসব না।

বলতে বলতে আশরাফ ঘরের কার্পেট মাড়িয়ে একটা নিচু চেয়ারে এসে বসলো। তাহমিনা কাছে এসে শুধালো, কি বলবেন?

কাল রাতে সেই যে নতুন অর্ডার কটার কথা বলেছিলাম—-

হ্যাঁ।

বেশ বড় অর্ডার সব কটাই

তাহমিনা জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল।

ছ নম্বর প্লট থেকে সাপ্লাই দিতে হবে। সেখানে আমার যাওয়া দরকার। নইলে কাজ হবে না।

তাহমিনা দূরে একটা চেয়ারে বসে বলল, বেশ তো।

তুমি বলছ যাব?

কেন যাবেন না, যা ভাল হয় তাই করবেন।

কিন্তু এদিকে সব একেলা ফেলে? আবিদও হাসপাতালে, ওরই বা কী হয়, সেও একটা ভাবনা। তোমাকে এ সময়ে রেখে যাই কী করে তাই ভাবছি।

আপনি যান, আমার জন্যে ভাববেন না। কবে যাবেন?

গেলে আজকেই। সন্ধ্যেয় বেরুলে কাল প্রায় ভোরে গিয়ে পৌঁছুবো।

আপনি তাই করুন।

কিন্তু বেশ কয়েকদিন দেরি হবে যে।

হোক না। আপনি যান। আবদুল ওরা তো রইল।

বলতে গিয়ে তাহমিনার স্বর একটু কাঁপল। কিন্তু সে অতি সামান্য। আশরাফ বুঝতে পারল না ঠিক। বলল, উনি কতদিন আছেন?

কে? ফারুক?

হ্যাঁ।

তাহমিনা চমকে উঠল। ও কথা শুধালো কেন আশরাফ? না কি সব কিছু জেনে গেছে, তাকে সন্দেহ করছে? তাহমিনা আড়চোখে মুহূর্তের জন্য তাকালে তার দিকে।

কিন্তু কিছুই বোঝা গেল না। দ্রুত কোলের ওপর চোখ নামিয়ে সে বলল, চলে যাবে শীগগীরই। দুএকদিনের মধ্যেই। একটু থেমে বলল, দুর্ঘটনার কথা শুনে অবধি থাকতে চাইছে না।

ও।

আশরাফ যেন কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল এইটুকু কথা বলে। কিছুটা চিন্তিত দেখাল ওকে। শেষে বলল, এক কাজ করো না, আফিয়া এসে কটা দিন থাক এখানে। তুমিও একেলা হবে না তাহলে, কী বল?

কেন?

তাহমিনার মুখ থেকে হঠাৎ প্রশ্নটা গড়িয়ে পড়ল। আশরাফ তার দিকে তাকাল, অবশ্যি তুমি যদি দরকার মনে না কর, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। এমনি বলছিলাম।

তাহমিনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তাহলে আশরাফ ওরকম কিছু ভেবে বলেনি। আশরাফ উঠে দাঁড়াল। তারপর ঘুরে বলল, ভালো কথা, বোট আমি নিয়ে যাচ্ছি। তোমার যদি সদরে যেতে হয়?

সে ব্যবস্থা হবে একটা।

আচ্ছা। কোনো খবর পেলে দেরি করো না, সদরে যেও। কী থেকে কী হয় বলা যায় না। অবিশ্যি আমার যদুর মনে হয় ভয়ের কিছু নেই। আর ভয়েরই বা কী। তুমি ভেবো না ওসব।

তাহমিনা ম্লান হাসল শুধু প্রত্যুত্তরে।

আশরাফের পেছনে পেছনে তাহমিনা এলো বাইরের বারান্দায়।

আশরাফ সমুখে আসতে আসতে বলল, আসুন ফারুক সাহেব, বেরুবেন বলছিলেন।

হ্যাঁ চলুন। কথা হলো?

হ্যাঁ। আজ বিকেলেই কাজে চলে যাচ্ছি—- এই সন্ধ্যেয়—- ফিরব কদিন পর।

ও।

থেকে যান না কদিন। আমি ঘুরে আসি। ও–ও ভালো হয়ে আসুক। সারা সুন্দরবন আপনাকে চিনিয়ে দিতাম। তাহমিনার দিকে ফিরে বলল, বলো না ওকে থেকে যেতে।

ফারুক তাহমিনার দিকে আধো চেয়ে উত্তর করলো, পারলে থাকতাম বৈকি। আবার আসব।

আশরাফ এবার বলল, তাহলে দুপুরে আমার ওখানেই খাবেন আজকে।

শুধু শুধু আপনি আমাকে টানছেন। তারচেয়ে চলুন। ফারুক সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল।

আশরাফ বলল, কি বল তাহমিনা?

তাহমিনা প্রায় কিছুই বলল না এর উত্তরে। ফারুক ঠিক রাজি হতে পারল না। অবশেষে বিকেলে চা খাবে এই ঠিক হলো। আশরাফ শেষে বলে গেল, তুমিও এসো তাহমিনা। একসাথেই এসো।

আচ্ছা। আসব। ফারুক, দেরি করো না কিন্তু। কাল রাতে কিছু খাও নি।

এই তো এখুনি এসে যাবে।

আশরাফ ফারুকের হয়ে উত্তরটি দিল।

.

বাংলোর আশেপাশে কাছাকাছি ঘুরে বেড়াল ওরা। মাঝে মাঝে দুএক ঘর বসত। তার পরেই আবার অরণ্য। এর ভেতর দিয়েই মানুষ তার পায়ে চলার পথ করে নিয়েছে। আশরাফ গাছ চিনিয়ে দিচ্ছিল। বলছিল কী করে তা কাটা হয়, চালান হয়। হাঁটতে হাঁটতেই তার কাছে সে শুনলো সব কিছু। আঠারো বছর আগে কী করে আশরাফ আবিদের বাবার ফার্মে ঢোকে, সে গল্পও করল। এমনি করে ঘুরতে ঘুরতে বেলা হলো বেশ কিছুটা। ফারুক ফিরে এলো। তাহমিনা বলল, দেখলে?

দেখলাম।

নাও এবার গায়ে পানি দিয়ে এসো। গরম করে দিইছি, নইলে নতুন পানি, গায়ে বসে যাবে। পায়ে শ্লিপার গলিয়ে ফারুক একটু হেসে, একটু থেমে, বলল, স্বাস্থ্য বলে যে একটা কিছু আছে আজ তা মনে পড়ল। তুমি না থাকলে তো ঠাণ্ডা পানিই গায়ে দিতাম।

এই করেই তো শরীরটা নষ্ট করলে।

কেন, খুব ভেঙে গেছে নাকি?

কই, না একটু।

তাহমিনা চলে যেতে যেতে বলল। তারপর নিজেই অবাক হলো, ও কথা বলতে গেল কেন? তিন বছরে ফারুক আরো সুন্দর হয়েছে, আরো দৃপ্ত হয়েছে। কিন্তু সে কথা কি বলা যায়?

ফারুক কী ভাববে?

খেতে বসে ফারুক বলল, এই বুনো জায়গায় এ সব যোগাড় করলে কোত্থেকে বল তো?

কেন, আমরা কি লতাপাতাই খেয়ে থাকি মনে করেছ?

না, তা কেন? আশা করিনি।

তুমি তো রান্নাঘরে যাওনি। গেলে দেখতে ঢাকার যে কোনো বড় হোটেলের সাথে পাল্লা দেয়া যেতে পারে।

আশ্চর্য!

ওই চপটা নিও। ফেলে রেখো না।

তাহমিনা সমুখে প্লেট এগিয়ে দেয়। একটু পরে বলে, দুপুরে ঘুমুবে তো?

কেন?

শুধাচ্ছি। বিকেলে আবার ওদের চায়ে যেতে হবে না?

না– দুপুরে ঘুমোনার অভ্যেস নেই। খবর কাগজের লোক আমরা, আমাদের ঘুমের কি আর টাইম বেটাইম আছে?

তাহমিনা ওর মুখের দিকে একবার চোখ তুলে পিরিচের ওপর নামিয়ে নিল। ফারুক তাকে একটু খুশি করবার জন্যেই যেন বলল, তাহোক, ঘুমিয়ে পড়লে ডেকে দিও তাড়াতাড়ি।

আচ্ছা।

আবদুল গ্লাশে স্বচ্ছ ঠান্ডা পানি জাগ থেকে ঢেলে দিল। হাত ধোবার গরম পানি এগিয়ে রাখল সমুখে।

.

বেলা প্রায় দুটো এখন। চারদিক স্তব্ধ। কোনো সাড়া নেই, শব্দ নেই। শুধু দূর–সবুজ রোদে পুড়ে যাচ্ছে। হলুদ শীটের মত রোদ এসে ছড়িয়ে পড়েছে যদুর দেখা যায়। ফারুক বিছানায় শুয়ে ছিল। তন্দ্রা নামছে তার চোখের ভিতরে। এই অরণ্যের সবুজের আঘ্রাণ যেন সে নিতে পারে, এত সূক্ষ্ম এখন তার অনুভূতি। আকাশ পাতাল সে ভাবতে লাগল আধো তন্দ্রার ভিতরে। এমন সময় পায়ের শব্দ। মুখ ফিরিয়ে সে শুধালো, কে, আবদুল?

জি হুজুর, ঘুরে যাচ্ছিলাম এদিক দিয়ে। কিছু বলবেন?

আবদুল দোরপর্দার ওধারে এসে দাঁড়িয়ে শুধালো।

এক গ্লাশ পানি।

গ্লাশে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফারুক বলল, লেবু কেটে দিয়েছ পানিতে না? তোমার মেম সায়েব কী করছে?

ঘুমুচ্ছেন।

ও।

আচ্ছা আবদুল—-ফারুক আধো উঠে বসলো, তোমার সায়েবের শিকার ঘর কোন দিকে জানো?

কেন? ডানহাতে পেছনের প্রথম ঘরের পরেরটাই তো। আপনি দেখেন নি?

না। আমাকে দেখাতে পারো?

খুব।

মেম সায়েবকে বলে দরকার নেই। ঘুমুচ্ছে। চুপ করে চাবি নিয়ে আসতে পারবে? বকশিস দেব।

আবদুল একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ফারুক মরিয়া হয়ে উঠেছে। সে দেখবেই কি আছে। ওই কামরায়, যাকে তাহমিনার এত ভয়?—- যার জন্যে সে মিছে অবধি বলেছে, চাবি নেই? ফারুকের বিশ্বাস হয় নি। আবদুলকে চুপ করে থাকতে দেখে সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ও ঘর তুমি কোনোদিন খোলো নি?

খুলেছি হুজুর।

চাবি কোথায় জানো না?

জানি।

তাহলে ভাবছ কেন? আমি শুধু দেখব বৈতো নয়? যাও। ফারুক নিচু গলায় প্রায় তার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল। তারপর শ্লিপিং শার্টের বোতাম ধরে অপেক্ষা করল উত্তরের। কিন্তু

কিন্তু কী আবদুল? উনি কিছু বলবেন না। আমি বলে দেব।

আচ্ছা আমি নিয়ে আসছি।

কিছুক্ষণ পরে আব্দুল এসে বলল, আসুন। ও ঘরের আরেকটা চাবি আমার কাছেই থাকে। যেন এক রহস্যের রাজ্যে যাচ্ছে, একটু সাড়া পেলেই সব মিলিয়ে যাবে শূন্য বাতাসে; যেন এক অরণ্য–হরিণের শিকারে যাচ্ছে সে, একটু শব্দ উঠলেই সেই ঘাইমৃগী পালিয়ে যাবে এমনি সাবধানে, সন্তর্পণে পা ফেলল ফারুক। আব্দুল পাশে পাশে ফিসফিস করে বলল, সায়েব আমাদের এ এলাকার সবচে নামজাদা শিকারী। একটা টিপও ফসকাতে পারে না ওঁর হাত থেকে, এমনি। আর সে কী শিকারের নেশা। দিন নেই রাত নেই শুধু বনে বনে শিকার আর শিকার।

ফারুক একবার দাঁড়িয়ে কান পাতল তাহমিনা জেগে উঠেছে নাকি। না। সে এবার শুধালো, শুনেছি, আগে নাকি এরকম ছিল না।

হ্যাঁ হুজুর। এই অল্পদিন হলো মাত্র প্রায় এক বছর হবে। এর আগেও যেতেন, খুব কম। তখন বাঘও মেরেছেন। কিন্তু এ বছর চোখে যা পড়েছে, তা আর নিস্তার পায় নি। আসুন। ফারুকের চোখের সামনে অদেখা এক রাজ্যের তোরণ যেন খুলে গেল। মাথার ওপরে স্কাইলাইট। অনেক ওপরে। লাল আর নীল কাঁচের বর্ণালী ছায়া এসে পড়েছে চারদিকে। কখনো কখনো সম্পাত হয়ে সৃষ্টি করেছে বেগুনি আভা। সাঁঝের রঙে যেন ভরে গেছে সমস্ত কামরা। ধূসর আর ম্লান। অদ্ভুত ঠাণ্ডা। বাইরের ঝলসানো রোদের পাশে অবিশ্বাস্য রকমে শীতল। একধারে দীর্ঘ পরিচ্ছন্ন এবং বার্নিশ করা আলমিরায় কয়েকটা বন্দুক খাড়া করে রাখা। ঝকঝক করছে। নীল নীল একটা দ্যুতি বেরুচ্ছে। ইস্পাত কী ঠাণ্ডা। আর ঘরের মাঝখানে বিরাট টেবলের ওপর কার্টিজ শূন্য স্ট্রাম্প পড়ে রয়েছে। কেউ হয়ত ছুঁড়ে ফেলে গেছে। আর তুলে রাখা হয়নি। দেয়ালের নিচু চারটে প্রশস্ত র‍্যাকে রাখা চারটে কুমির। ভেতরে খড় পোরা। মেঘের মত ঘোলা উদাস চোখ তাদের। আর মাথার ওপরে বুনো মোষের মাথা। টনি রঙের পশমওলা। এখুনি হয়ত শিং নেড়ে অন্ধের মত তেড়ে আসবে। ফারুক সম্মোহিত তাকিয়ে রইল। বাঘের পুরু সোনালি ছালটা কী কোমল! ব্যাবিলনের কোনো রাণীর ঘাড়ের ওপরে উজ্জ্বল এমনি চিতার ছাল বুঝি জড়ানো থাকতো শুভ্র মসৃণ পিঠ অবধি। একদিন আবিদের গুলি খেয়ে লাফিয়ে উঠেছিল আকাশে আক্রোশে, ধনুকের ছিলা ভাঙা মুদ্রায়। তারপর পাকা ফলের মত ঝুপ করে পড়ে গেছে নিঃসাড় হয়ে। মাথার ওপরে খানিকটা গুলির ছেঁড়া চিহ্ন। মাথাটা নিচের দিকে ঝুলছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন মুখ লুকিয়ে হাসছে অরণ্যের সম্রাট।

ফারুকের সারাটা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। আবদুল কী যেন বলছে, হয়ত শিকারের ইতিহাস বলছে, ভালো করে কানে আসছে না তার। যেন প্রতিহত হয়ে ফিরে যাচ্ছে। যেন সে রূপোর কাঠিতে ঘুমিয়ে পড়া এক হিংস্রতার নীল দেশে দাঁড়িয়ে।

আলমিরার পাল্লা খুলে ধরল আবদুল। একটু শব্দ উঠল তীক্ষ্ণ। একটা নখ তুলে ধরল সে। বেড়ালের চোখের মত রঙ তার। ভারী অথচ তীক্ষ্ণ। বাঘের নখ হুজুর।

কিন্তু ফারুক অবচেতন মনে অনুসন্ধান করে চলেছে আরো কিছু। সে উদঘাটন করতে চায় সেই রহস্য, যার জন্য তাহমিনা তাকে এ ঘরে আনে নি। বোবা সে তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক। আবদুল ওটা রেখে দিয়ে এবারে কুমিরের একজোড়া দাঁত তুলে নিল হাতে। আর এমন সময়ে, ঠিক এমন সময় আর্ত, ভীত, মিহি, দুর্বোধ্য চিৎকার শোনা গেল তাহমিনার, আবদুল! ঘুমে সারামুখ থমথমে ভারী হয়ে গেছে তার। কপালের ওপর সেঁটে রয়েছে একগুচ্ছ চুল। আলুথালু শাড়িতে দুপুর ঘুমের ভাঁজ। মুহূর্তকাল তীব্র স্তব্ধ হয়ে রইল তাহমিনা। তারপর ফেটে পড়ল, হাঁপাতে হাঁপাতে উচ্চারণ করল, কোত্থেকে চাবি নিয়েছ? কে তোমাকে বলেছে? বেরিয়ে যাও ঘর থেকে বেরিয়ে যাও বলছি আবদুল।

আবদুলের সারা শরীর কেঁপে উঠল। ধরাগলায় একবার মাথা নিচু করে বলল, মেমসাব।

কোন কথা শুনব না, বেরিয়ে যাও।

আবদুল বেরিয়ে গেল। তাহমিনা এসে দাঁড়াল ফারুকের সমুখে। তাহমিনার চোখে ভয়াবহ শূন্যতা। সে পাগলের মত, ভূতগ্রস্তের মত, বলে চলল, কে তোমাকে এখানে আসতে বলেছে? কী দেখতে এসেছো? বল, বল।

ফারুক চুপ করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল বিহ্বল হয়ে। তাহমিনা কি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে? এমন করছে কেন? সে দুহাতে ওর বাহু মূল ধরে ঝাঁকি দিয়ে ডাকল চাপা স্বরে, তাহমিনা, তাহমিনা।

হাত সরিয়ে নিল ও।

চলে যাও এ কামরা থেকে।

কিন্তু গেল না সে। একটু থামল তাহমিনা। তারপর নিমেষে কী যে হয়ে গেল তা ফারুক বুঝতে পারল না। তাহমিনা দুহাতে আলমিরার সমস্ত নখ আর দাঁত ছুঁড়ে ফেলল মাটিতে। বাঘের সেই উজ্জ্বল ছাল ধরে টান দিল! একটু নড়ে স্থির হয়ে গেল ওটা। তারপর কর্ড ছিঁড়ে মঝের ওপর ভাঁজ হয়ে লুটিয়ে পড়ল। আর তাহমিনা বলে চলেছে—- দ্যাখো, দ্যাখো, এইসব দেখতে এসেছ। দ্যাখো, দ্যাখো তুমি।

ফারুক এবার তাকে আঁকড়ে ধরল। উচ্চারণ করল একবার তার নাম। একটু পরে সহসা শান্ত হয়ে এলো তাহমিনা। বুঝতে পারল সে কি করছে। ফারুকের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিজের বিছানার ওপর গিয়ে লুটিয়ে পড়ে ছেলেমানুষের মত কাঁদতে লাগল। ছোট ছোট তরংগের মত দেই তার কেঁপে উঠল। সে অনুভব করতে পারল ফারুক এসে দাঁড়িয়েছে কামরায়। ঠিক তার পাশেই। মুখ লুকিয়ে রেখেই কান্নাগলায় বলল, আমি কী করব ফারুক? আমার এ–কী হোলো? কেন আমার এমন হোলো? কেন? কেন?

তাহমিনা, আমি এমন হবে জানলে ওখানে যেতাম না। অজান্তে তোমাকে আঘাত দিইছি। আঘাত তোমাকে আমি দিতে চাইনি।

না, ফারুক না।

কী না, তাহমিনা?

তাহমিনা বালিশ থেকে তবুও মুখ ফেরাল না।

ফারুক অপেক্ষা করল আরো কিছুক্ষণ। কোন কথাই বলল না ও। শেষ অবধি একটু ইতস্তত করে বলল, তাহমিনা শোনো, আমি তারচে চলে যাই।

কেন ফারুক?

চলে যাওয়াই আমার ভালো। আমি যাই।

তাহমিনার সারাটা শরীর শুধু কান্নার অভিঘাতে কেঁপে উঠল আরো। মুখ ডুবিয়ে নিল বালিশের আরো গভীরে। ফারুক কি করবে কিছুই ভেবে পেল না। তাহমিনা জোরে জোরে দুবার শ্বাস নিল। আর সে ভয় পেয়ে কাছে এসে তার পিঠের ওপর আলতো হাত রেখে শঙ্কিত গলায় শুধালো, কি হলো তোমার তাহমিনা?—-তাহমিনা!

আমার কোন দোষ নেই, আমি কোনোদিন মা হতে পারব না ফারুক। বালিশের ভেতর। থেকে এই অস্পষ্ট উচ্চারিত বিজড়িত কথাটি তীক্ষ্ণ হয়ে এসে বিধল ফারুককে। সে চমকে উঠল। একি বলছে তাহমিনা? সে কি উন্মাদ হয়ে গেছে? নিজের কানকে সে যেন বিশ্বাস করতে পারল না? পাথরের মত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

আর তাহমিনাও যেন বিশ্বাস করতে পারল না নিজের কানকে। যে কথা সে আজ এক বছর হোলো টের পেয়েছে, যে কথা সে বলবার জন্য ফারুককে কাছে চেয়েছে, যে কথা কাল। ফারুক আসা অবধি তাকে মৃদু অবিরাম আগুনে পুড়িয়েছে তা সে উচ্চারণ করেছে। এই প্রথম উচ্চারণ করেছে। আর তার দ্বিধার অবকাশ নেই। আর তার ফেরবার পথ নেই। তাই নিমেষে তার কান্না আর ফোঁপানো থেমে গেল। স্থির হয়ে তেমনি উবু হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে নিস্পন্দ পড়ে রইল।

ফারুকের চোখে পড়ল নিমেষের এই পরিবর্তন। গোটা পৃথিবী ধোঁয়ায় ধূসর অস্বচ্ছ অবাস্তব হয়ে এল তার সমুখে। সমস্ত বোধ তার শিথিল হয়ে গেল। আস্তে আস্তে তার কাছে স্পষ্ট হয়ে এল তাহমিনার চিঠি লেখা থেকে এই মুহর্ত অবধি প্রতিটি ব্যবহার, প্রতিটি কথার অর্থ। টুকরো টুকরো ঘটনা যা অসংলগ্ন বলে একটু সময় আগেই মনে হয়েছিল, এখন তার সূত্র সে যেন উদ্ধার করতে পারল। বিদ্যুতের মত কাল থেকে আজ অবধি তাহমিনার প্রতিটি মুখ ভেসে উঠল। তার মনে হোলো ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে সে পারবে না। তার ভীষণ ভয় করলো। সে একটু পর পালিয়ে এলো নিজের কামরায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *