০৩. আমিনবাগের এই এলাকা

এই সেদিন অবধি আমিনবাগের এই এলাকা ছিল পাড়াগাঁর মতন। কাঁচা রাস্তা। কলার ঝোঁপ, কাঁঠালের গাছ। এখন সেখানে নতুন পীচের রাস্তা হয়েছে। রাতারাতি উঠেছে দালান কোঠা। রাজধানী ঢাকা এখন প্রসারিত এই আমিনবাগ অবধি। দোতলা হলুদ জাপান কনসুলেট পার হয়ে রাস্তাটা ঘুরে চলে গেছে মতিঝিল কলোনির ভেতর। সকাল দুপুর বিকেল সবসময়েই এলাকাটা কেমন নিঝুম নিঃশব্দ হয়ে থাকে।

পার্টিশনের পর পরই এই এলাকায় জমি কিনে ছোট্ট একতলা বাড়ি করেছিলেন তাহমিনার বাবা ডাঃ কামাল আহমেদ। সামনে অনেকটা জমি। সেখানে বাগান। তেকোণ ইটের বৃত্তের মাঝখানে একটি কী দুটি গোলাপ ফোঁটা গাছ, মধুমল্লিকা, রজনীগন্ধা, সূর্যমুখী, আরো কত কী। একদিকে একটা শিশু খেজুরের চিকচিক সরু সবুজ।

একধারে গ্যারেজ। আসমানি রঙের মরিস মাইনরে করে পেশেন্ট দেখতে বেরোন কামাল সাহেব। তাহমিনা যায় ভার্সিটিতে। বড় ছেলে জাকি যায় অফিসে। কখনো কখনো মেজ ছেলে লাবলু চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যায় এই মরিসে করে। গেল বছর পাশ করে অবধি লাবলু এখনো বসে আছে। তাকে, কামাল সাহেব বলেন—- হবে, হবে, সবই হবে, অত তাড়াহুড়ো করতে নেই। লিলির স্কুল থেকে বাস আসে। বাসে করেই যায় সে। মালেকাবাণু খুব কম বেরোন গাড়িতে। তবুও গাড়িটার বিরাম নেই। চব্বিশ ঘণ্টা চলার ওপরেই আছে। ভোর সকালেই দিনকার খবরের কাগজ হাতে করে মরিসে গিয়ে বসেন কামাল সাহেব। বাসায় বসে পড়বার মত সময়ও তার হয় না। ফেরেন দুপুরে একঝলকের জন্যে। তারপর সেই যে যান, আসতে আসতে রাত নটা দশটা। তাই সংসারের সবকিছু, সব ভার মালেকাবাণুর হাতে। রান্না থেকে শুরু করে ড্রয়ার থেকে খরচের টাকা বের করে নিখুঁত হিসেব রাখা থেকে, জাকি আর লাবলুর মনমত রঙ জেনে বিছানার বর্ডার সেলাই করা অবধি সব কিছু সারাদিন করেন তিনি। ওটা ফুরুলো, এটা আনতে হবে; অমুকের অমুক দরকার; আজ লাবলুর গোটা দশেক টাকা দরকার; তাহমিনা নতুন একটা শাড়ি দেখে এসেছে সব যেন মালেকাবাণুর জানবার কথা। সব যেন তারই করবার কথা। অথচ এতটুকু অভিযোগ নেই কোনোখানে। এত চুপচাপ থাকেন যে, তিনি যে আছেন তা চট করে অনুভব করা যায় না। অথচ না থাকলে মনে হয় কোথায় যেন কি নেই।

মালেকাবাণুকে দেখে প্রথম দিনই ফারুক মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাহমিনা বলেছিল, আমার মার মত আর দুটি মা হয় না। দেখবে তোমাকে কত আদর করেন উনি।

ফারুক পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বলেছিল, আপনার কথা ওর মুখে অনেক শুনেছি খালাআম্মা। কেউ দেখিয়ে না দিলেও চিনতে আমার এতটুকু কষ্ট হতো না।

উত্তরে মালেকাবাণু হেসেছিলেন। বসতে দিয়েছিলেন নিজের হাতে শেলাই করা আসন পেতে। তারপর একটা পিরিচে করে ফল কেটে এনে দিয়েছিলেন।

তোমার সাথে আলাপ হয়ে ভারী খুশি লাগল ফারুক। উনি এখনো ফেরেননি, নইলে দেখতে এতক্ষণ ওর সাথে বসে গল্প করতে হতো তোমায়।

কেন খালাআম্মা?

ফারুক গ্লাশ নাবিয়ে রাখল। তাহমিনা বারান্দায়, এখান থেকেই তার শাড়ির মৃদু ভাঁজ ভাঙার শব্দ আসছিল। মালেকাবাণু বললেন, জানো না, সেদিন আমরা সবাই তো তোমাদের নাটক দেখতে গিছলাম। তাহমিনার সাথে যে তুমি অভিনয় করবে তা আমরা আগেই ওর কাছ থেকে শুনেছিলাম।

ও। ফারুক সলজ্জ হাসলো, বলল, কেমন লেগেছিল?

ভালো, খুব ভালো। উনিও তোমার কথা বলছিলেন সে রাতে।

তাই নাকি? সে আমার সৌভাগ্য।

এমন সময় বাইরে কার পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। এক জোড়া জুতোর হালকা ছন্দময় ধ্বনি। ফারুক হঠাৎ কথা থামিয়ে কান পাতল। মালেকাবাণু গ্লাশ আলমিরার তাকে রাখতে রাখতে বললেন, জাকি ফিরল। মিনুর বড় ভাই। বার্মাশেলে ভালো মাইনেয় কাজ করছে। অফিস থেকে এলো।

ও। তারপর একটু থেমে বলল, লাবলু কোথায়? বাসায় নেই?

ওমা, তুমি সবাইকে চেনো দেখছি।

ফারুক যেন লজ্জিত হলো। মাথা নিচু করল একটু। উনি বললেন, কোথায় আড্ডা মারছে কে জানে। পাশ করে অবধি তো ঐ এক কাজ তার। বাবুর এখন একটা কাজ হলেই বাঁচি। হয়ে যাবে শীগগিরই। আজকাল কাজ পেতে অমন একটু আধটু দেরি হয়ই খালাআম্মা।

লাবলুকে দেখেছ তুমি ফারুক?

না।

দেয়ালে একটা ফটোর দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, অই তার ছবি। আর এদিকেরটা জাকির।

ফারুক সেদিকে তাকিয়ে বলল, লাবলু কিন্তু ঠিক আপনার মত দেখতে হয়েছে।

বলো কি, ছবি দেখেই? মালেকাবাণু স্নেহের এবং হয়ত একটু আত্মগর্বের হাসি হাসলেন। তারপর বললেন, তুমি একটু বসো, আমি পিরিচ রেখে আসিগে।

আচ্ছা।

ফারুক চুপচাপ বসে আসনে নখের আঁকিবুকি কাটতে লাগল। এমন সময় বারান্দায়, দোরপর্দার একটু দূরে, কার গলা শুনতে পেল সে। হয়ত জাকির স্বর। তাহমিনাকে বলছে, লোকটা কে রে মিনু?

জাকির প্রশ্নের সুরটা কেন যেন ভালো লাগল না ফারুকের। একটু অস্বস্তি বোধ করল সে। নড়েচড়ে পিঠ সোজা করে বসলো। আর তার প্রশ্নের উত্তরে তাহমিনা নিচু গলায় কি বলল তা ভালো করে শুনতে পেল না। কিন্তু পরক্ষণেই জাকির গলা আবার শোনা গেল, তোকে নিয়ে আর পারা গেল না। তাই বলে বাসায় আনবি? যা খুশি তাই করগে।

কী বকছ, দাদা। আস্তে বলো, শুনবে ও।  

পায়ের শব্দ শুনে বোঝা গেল জাকি সাথে সাথে চলে গেল। তারপরেই পাশের কামরা থেকে গুনগুন শোনা গেল তার। হয়ত কাপড় বদলাচ্ছে জাকি। একটু পরেই ঘরে এসে ঢুকলো। তাহমিনা। ভার্সিটি থেকে যখন দুজনে বেরিয়েছিল, তখন ওর পরনে ছিল অসম্ভব নীল রঙের বিনিপাড় শাড়ি। মাথায় নীল টেপ। দুদিকে বিনুনি করা। আর পায়ে সমতল হালকা স্ট্রাপ দেয়া স্যাণ্ডেল। এখন সে তা বদলে ফেলেছে। শুধু সাদা একটা শাড়ি। চওড়া ফ্যাকাশে লালপাড় দেয়া। মাথার সেই বিনুনি খুলে ফেলেছে। ঢেউয়ের মত একরাশ চুল পিঠের ওপর ছড়ানো। মুখের মিহি প্রসাধনটুকু মুছে গিয়ে এখন সেখানে শুধু শুভ্রতা। তাহমিনা এসে ঠিক মাঝখানে দাঁড়াল ক্ষণেক। ফারুক তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তাহমিনা বলল, কই আমাদের বাড়িটা কেমন বললেন না তো?

ভারী নিরিবিলি। আরো বলব? আশ্চর্য গোছানো। থাকতে ইচ্ছে করে। শেষের কথাগুলো বলল নিচু গলায়।

তাহমিনা একটু এগিয়ে এলো, তাই নাকি? আমার কিন্তু মোটেই পছন্দ হয় না।

কেন?

তাহমিনা দূরে চৌকির বাজু ধরে বসে বলল, ইতস্তত কপট সুরে, যা নিরিবিলি। একটু যদি পড়তে পারা যায় মন দিয়ে।

অবাক করলেন। ফার্স্ট ইয়ারে এসেই পড়াশোনা?

কেন না? ইংরেজি অনার্স কি খুব সোজা নাকি?

মোটেই না, মোটেই না।

ফারুক মাথা দোলালো হাসতে হাসতে। তারপর বলল, যাই বলুন, আমি নিজে থার্ড ইয়ারে উঠেও কিন্তু পড়ায় মন দিতে পারছি না। কেমন যেন হতেই চায় না।

তাহমিনা একটু উদ্বেগভরা স্বরে বলল, পাশ করবেন কী করে? মানে, ফার্স্টক্লাশ নিতে হবে তো?

দরকার নেই আমার।

ঠিক এই সময়ে ঘরে ঢুকলেন মালেকাবাণু। শুধালেন, কি দরকার নেই ফারুক?

পরীক্ষায় ফার্স্টক্লাস, খালাআম্মা।

কেন?

মালেকাবাণু এসে আবার বসলেন ফারুকের সাথে কথা বলতে। আর তাহমিনা প্রায় সারাক্ষণ চুপ করেই রইল বসে। সন্ধ্যা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরের রাস্তা। বিদ্যুতের আলোয় উজ্জ্বল হয় উঠেছে। পথের পীচ দেখাচ্ছে কেমন নীলাভ। কেউ কেউ হাঁটছে। একটা দামি মোটর বেরিয়ে গেল। চারদিকের বাতাসে কোন মিষ্টি ফুলের গন্ধ।

আরো কিছুক্ষণ পরে ফারুক উঠল। মালেকাবাণু আবার একদিন আসতে বলে দোর অবধি এগিয়ে এলেন। আর গেট অবধি এগিয়ে দিতে এলো তাহমিনা একেলা। গেটের এ পাশে। দাঁড়িয়ে সে বলল, এসে কিন্তু মার সাথেই শুধু গল্প করে গেলেন। ভারী স্বার্থপর আপনি। তাই নাকি! জানা ছিল না আমার।

এক মুহূর্ত দুজনে চুপ। ছোট্ট লিলি বাইরে থেকে গেটের কাছে এসে দাঁড়াল। একবার তাকাল দুজনার দিকে। তাহমিনা শুধালো, কোথায় গিছলি রে? সারা বিকেল পাত্তাই নেই।

অইতো, রানুদের বাসায়। জানো রানুরা আজ

থাক এখন। পড়তে যা! লিলি বুঝি উৎসাহে বাধা পেয়ে ক্ষুণ্ণ হলো। বলল, বারে যাচ্ছি তো।

লিলি চলে গেল মুখ ভার করে। ফারুক হেসে বলল, মিছেমিছি মন খারাপ করে দিলেন বেচারির।

যা দুষ্টু। আপনার কিন্তু অনেক সময় নষ্ট হলো আজ।

দূর। চলি তাহলে।

আচ্ছা।

তাহমিনা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে উঠে এলো বারান্দায়। জাকি সেখানে বেতের চেয়ার টেনে দেয়াল–আলোর নিচে ইংরেজি পত্রিকা ওলটাচ্ছিল। চোখ তুলে বলল, চলে গেল নাকি?

হু।

মালেকাবাণু ঘরে উঠে আসছিলেন। তাহমিনা তাকে বলল, আচ্ছা মা, দাদা কী রকম লোক বলোত?

কেন কি হয়েছে এরি মধ্যে আবার?

তখন যে ওসব বলল, যদি শুনে থাকে, তাহলে কী ভাববে? কাল ভার্সিটিতে মুখ দেখাতে পারব?

কি বলেছে শুনি?

কি আবার বলবে? তোমার ছেলের কাছ থেকে শোনো।

তাহমিনা গটগট করে তার নিবে কামরার দিকে চলে গেল। জাকি আবার চোখ ফিরিয়ে নিল কাগজের ওপরে। মালেকাবাণু ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। বুঝতে পারলেন না কি ব্যাপার? আর তাহমিনাই বা এতক্ষণ খুশি থেকে হঠাৎ ছুতনো কথায় মুখভার করে চলে গেল কেন? কিন্তু পরমুহূর্তেই অস্পষ্ট হাসির রেখা ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে। যেন কী একটা হঠাৎ তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *