০৯. তিনদিন পরে রাত আটটার গাড়িতে

তিনদিন পরে রাত আটটার গাড়িতে মামা এলেন। সংগে আরো দুজন। দুজনেই প্যান্ট বুশ শার্ট পরা, একজনের হাতে সব সময় সিগারেট, আরেক জনের চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা। দুজনে নিজেরা নিজেরা কি বলে আর হাসে। তার মধ্যে চশমা পরা লোকটা কম হাসে। সিগারেটওয়ালা প্রায় কাতুকুতু দেয়ার মতো করে আনুকে বগলে বগলে টানে আর খালি জিগ্যেস করে তোমার কবোন? কোন বোন বেশি আদর করে? কে ভালো গান গায়? কার চুল লম্বা? একটারও জবাব দিতে পারে না আনু। ভীষণ লজ্জা করে তাব। লোকটার গায়ে মাখনো সেন্ট, তার গন্ধে মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে আনুর। লোকটা নতুন সিগারেট ধরানোর জন্যে হাত ছাড়তেই আনু প্রায় ছুটে পালায়।

মামা আড়ালে ডেকে ধমকান, বেয়াদব ছেলে! মেহমানদের কথার জবাব না দিয়ে উঠে আসে! দারোগার ব্যাটা আর শিখবে কত!

তারপর গলা খাকারি দিয়ে মা যন রান্নাঘরে। সেখানে রান্নার জোগাড় করছে আপারা। আজ মেহমান বাড়িতে। মা মুরগির খাঁচা থেকে সেই দশটার সময় দুটো বের করে জবেহ্ করেছেন। পালক ছাড়ানো, দেখতে দুটো কেবল–হওয়া বাচ্চার মতো, শুয়ে আছে গামলায় গরম পানিতে। গরম মশলার খোশবু ছড়িয়েছে। মামা উবু হয়ে বসতেই মা একটা পিড়ি টেনে দিলেন, মাথায় ঘোমটা টানলেন! মামা বললেন, তোমরা একটু যাও।

আপারা উঠে যেতেই অনুচ্চ কণ্ঠে মামা হাত নেড়ে নেড়ে কী বলতে লাগলেন মাকে। আনু বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। একবার ভাবল, কাছে যায়। আবার সংকোচ হলো। বাবা বলেছেন আনুকে পছন্দ করতে। আনু তখন পায়ে পায়ে বাইরের ঘরের দিকে আসে। কিন্তু তার আগেই সেজ আপা, নে আপা, ছোট আপা, সালু আপা, মিনু আপা বেড়ার ফাঁক দিয়ে দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে। নিজেরা ঠেলাঠেলি করছে। মিনু আপা হাসতে গেছে তার মুখ চেপে ধরলো মেজ আপা।

শোবার ঘরে এসে দেখে খাটো করে রাখা হারিকেন। বড় আপা নামাজের চৌকিতে এক কোণে চুপ করে বসে আছে। তার দুহাত কোলের ওপর, যেন এখুনি উঠে যাবে। উলি না। আনুকে দেখে ম্লান হাসলো বড় আপা। বড় আপা কখনো হাসে না। হাসলে এত সুন্দর লাগে, মনে হয় নতুন মানুষ, ও যেন আনুর বড় আপাই না, অন্য কেউ, একেবারে ছবি।

বড় আপা নিঃশব্দে অনেকক্ষণ হাসে। তখন আনু একটা কথাও না বলে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। একটা হাত টেনে নিল মুখের ওপর। সুন্দর চেনা চেনা গন্ধ। আনু টের পায়, বড় আপা আজ লুকিয়ে মুখে সর মেখেছে। হাতের ভেতরটা ভারী মিষ্টি হয়ে আছে তার।

পরদিন বড় আপাকে দেখল ওরা।

চশমা পরা লোকটা হচ্ছে পাত্র। আনুর খুব অস্বস্তি লাগে। বুলুর বাবা বড় আপাকে নিয়ে এসে তার মুখোমুখি বসলেন। আনু বসল তার আরেক পাশে। ভেতর থেকে এ বাড়ি ও বাড়ির সবাই তাকিয়ে রইল। সবাই মিলে আজ বড় আপাকে সাজিয়েছে। মার গয়নাগুলো পরিয়েছে। তোলা নীল শাড়িটা থেকে চামেলী আতরের গন্ধ দিচ্ছে। হাতের নখে ঠিকরে পড়ছে হ্যাঁজাকের আলো। বুলুর বাবা তার দোকান থেকে একদিনের জন্যে ধার দিয়েছেন। হ্যাঁজাকটা। শুম শুম করছে তার তেল পোড়ার শব্দ। বড় আপাকে জমিদারের বউযের মতো লাগছে। বুকের মধ্যে দুপদুপ করছে আনুর।

মামাই কথা পাড়লেন—- মেয়ে দেখতে হবে না কাশেম মিয়া। আমার ভাগনী বলে নয়, এরকম মেয়ে দুচার জেলায় হয় না। রান্না, সেলাই, নামাজ–রোজা, আদব–তমি সব কিছুতেই বরাবর কাবেল। ম্যাট্রিক পাশ করেছিল সেকেণ্ড ডিভিশনে। এতদিন আমরা বিয়েশাদির কথা—- বড় মেয়ে খান্দানি পাত্র শিক্ষিত নওশা তো আর হাতের তুড়িতে আসে না।

বলেই মামা অন্দরে চোখ ঠারলেন। শেষে বললেন, সওয়াল করুন, নাশতা–পানি জুড়িয়ে যাচ্ছে। কই আক্কাস কথা কও না?

আক্কাস অর্থাৎ সিগারেট সর্বক্ষণ যার হাতে হেঁ হেঁ করে হাসল। তারপর কোল বালিশ টেনে। গলা সাফ করে জিগ্যেস করল, আপনার নাম?

ফাতেমা খাতুন।

বড় আপা একটুও ভয় পায়নি। গলা একটুও কাপল না। কেবল কেমন যেন লজ্জা জড়ানো—- তাও ভালো করে ঠাহর হয় না। বড় আপাকে এই নিয়ে আট নজন দেখে গেল। একবার এসেছিল একজন, তাকে খুব পছন্দ হয়েছিল আনুর। রায়বাজারে এক ছোট দারোগা ছিল, মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে শীস দিত আর হাঁটত বিকেল বেলায়, চিনিচম্পা কলা খেতে খুব ভালোবাসত, ঠিক তার মতো দেখতে। সকালের গাড়িতে এসে রাতের গাড়িতেই চলে গিয়েছিলেন। যাবার সময় আনু সংগে সংগে ইস্টিশান পর্যন্ত গেছে। অন্ধকারে হঠাৎ তাকে দেখে লোকটা ভারী লজ্জা পেয়েছিল, তার সংগে কথা বলতে ভারী ইচ্ছে করছে লোকটার। সেও ঘুর ঘুর করছে। কিন্তু কথা হয়নি। লোকটা গিয়ে আর কোনো খবর দেয় নি।

জিগ্যেসবাদ চলল অনেকক্ষণ ধরে। মামা বাইরে গেলেন, বুলুর বাবা বাইরে গেলেন, পাত্র কথা বলল বড় আপার সংগে। আনু বসে রইল সারাক্ষণ। বুলুর বাবা বাইরে গেলে বড় আপা যেন খুব ভয় পেল। ভাল করে কথা বলতে পারল না। নিঃশ্বাস যেন গলার মধ্যে আটকে রইলো। আবার যখন ওরা ফিরে এলেন, বড় আপা নড়ে চড়ে বসলো। বড় আপাকে নিয়ে ভিতরে এলো আনু। বারান্দায় বুলু খাবার সাজাচ্ছে খানচায়। মা, মেজ আপা, বুলুর মা তুলে তুলে দিচ্ছেন।

আনুর পছন্দ হয়নি। কিন্তু বলতে পারল না কাউকে। বড় আপা শোবার ঘরে গেল। তাকে সংগে যেতে হলো। বড় আপা তার আঙুল ধরে আছে শক্ত করে। ঘরে যেতেই সালু আপা, মিনু আপা, ছোট আপা, সেজ আপা ঘিরে ধরল। সবার চোখ মুখ দিয়ে খুশি লাফিয়ে পড়ছে। গা টিপছে, হাসছে, ঢলে ঢলে পড়ছে। এমনকি বড় আপাকেও খুব খুশি লাগছে, কিন্তু দেখাচ্ছে না। আনু বলতে পারল না কাউকে। আনু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল জানালার শিক ধরে, এক পা ভাঁজ করে আরেক পায়ে ঠেকিয়ে। অনেকক্ষণ বসে থেকে তার পা ধরে গেছে। বড় আপাকে বললে যেন এখুনি ডাকবাংলা, নদীর পাড়, চৌধুরীদের দালান, দুতিন মাইল বেড়িয়ে আসতে পারবে।

রান্নাঘরে আনুকে খেতে দিয়েছিলেন মা। মামা চটি চটপট করতে করতে এসে একটা মোড়া টেনে বসলেন। উদ্বিগ্ন হয়ে মা জিগ্যেস করলেন, কি বলল ছেলে?

কি বলবে। সব আমার হাতে। পাকা কাজ না হলে আমি হাতই দিই না। তোমরা দুতিন গণ্ডা পাত্র দেখলে, খালি মুরগি পোলাও ধ্বংস।

অপ্রস্তুত হয়ে মা জড়সড় হয়ে বসলেন। আনুকে বললেন, আনু আর একটা গোশত দিই? আনু মাথা নাড়ল। কিন্তু নিল। অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন মামা! পরে গলা নামিয়ে বললেন, দাবি দাওয়া খুব বেশি। তাই সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি। ওখানে তোমার ভাবীকে দিয়ে কায়দা করতে হবে। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো।

মা একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আল্লাহ্ এবার মুখ না তুললে আমার আর দিশা নেই ভাইজান।

তুলবে, বুবু তুলবে। আমি সামনের মাসেই তারিখ ফেলব, তুমি সাফ নিশ্চিন্ত থেকো। আনু, যাও তো পান নিয়ে এসো বাবা।

আনু ঢকঢক করে পানি খেল পুরো এক গেলাস। তারপর যেতে যেতে বারান্দার কাছে এসে চোখ ফিরিয়ে দেখল আর মামা ফিসফিস করে কি বলছেন। পান সে যতক্ষণ খুশি দের করে আনতে পারে, মামা রাগ করবেন না। আনু আর পান আনলো না। আনু গিয়ে রাতের রাস্তায় জোড়া সুপারি গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে রইল। তার পছন্দ হয়নি, এ কথা কাউকে বলা যাবে না। তার ইচ্ছে করছে বলতে, কিন্তু তাহলে বড় আপা হয়ত মুখটা আঁধার করে ফেলবে। আনু ফিরে এসে দেখল, বড় আপা শুয়ে রয়েছে। মাথার কাছে তোলা কাঁচের জগ আর পাতলা গেলাস চারটে। হয়ত ঘুমের মধ্যে হাত লেগে ভেঙে যাবে। মাথার কাছ থেকে একটা একটা করে সরিয়ে রাখল আনু।

পরদিন ভোরে মামা যাবার আগে বললেন, আনুর মা, তো আমার কি করলে?

এ প্রশ্নের জন্যেই যেন কাল থেকে বুক কাঁপছিল আনুর মার। তিনি চোরের মতো আনুকে একবার দেখলেন। আনু তখন পরম সাহসে তার ছিপ বার করে উঠোনে বসে বসে তেল খাওয়াচ্ছে। সে শুনতে পেল মা বলছে, আমার এ দুর্দিনে টাকা কোথায় ভাইজান? দারোগা সাহেবের বিপদের পর উপরে আল্লাহ্ জানে কী করে দিন যাচ্ছে এই ছেলেমেয়েদের নিয়ে।

খুব গম্ভীর হয়ে শুনলেন মামা! আনু ছিপটাকে ধনুকের মতো বাকিয়ে আবার ছেড়ে দিল। চমৎকার তার হয়েছে ছিপটা। পাঁচ সাত সের পর্যন্ত ভাঙবে না।

শেষ অবধি রাহা খরচ দিতে হলো মামাকে। মামা খুব অন্যমনস্ক হয়ে বাড়ি থেকে বেরোলেন। মার কথার ভালো করে জবাব দিলেন না। যাবার সময় আনুকে একবার বলেও গেলেন না। আনু আর ইস্টিশনে গেল না।

রান্নাঘরে পানি খাবার ছুতো করে এসে আনু দেখল মা সেখানেও নেই। ছাগলের বাচ্চাগুলো তরকারির খোসা চিবোচ্ছে। মা কুয়োতলায় বসে হাঁপাচ্ছেন আর গতরাতের সুরুয়া লাগা দস্তর খানা আছড়ে আছড়ে সাবানের ফেনায় সাফ করছেন। মার খুব কষ্ট হচ্ছে। মা তাকে। দেখে লজ্জা পেলেন যেন। কোনো রকমে থুপথাপ করে কাপড় রেখে হাত ধুতে ধুতে নিচু গলায় বললেন, বুলুদের হ্যাজাকটা দিয়ে আসবি?

.

পনেরো দিন ধরে মুখর হয়ে রইল বাড়ি বড় আপার বিয়ের গল্পে। মামা তো বলেই গেছেন, পছন্দ অপছন্দ তার হাতে, সামনের মাসে তারিখ দেখবেনই। মা আবার শেফালির বোঁটাগুলো রোদে বার করে শুকোচ্ছেন। বুলুর বাবাকে টাকা দিয়েছেন ঢাকা থেকে শাড়ি আনতে। বড় আপাকে দিয়ে একটা কাজও আর করিয়ে নেন না মা। একটা কিছু করতে। এলে হাত থেকে কেড়ে নেন। গাল পেড়ে সামনে যে মেয়েকে পান, বলেন, তোরা করিস কি? খালি আড্ডা আর খাওয়া। লেখাপড়া তো মাথায় উঠেছে।

বড় আপা এখন রোজ রাতে মুখে সর মাখে। সেদিন গুন গুন করে গানও গাইছিল। পরশুদিন নতুন স্যাণ্ডেল পরে আনুকে নিয়ে টাউন হলে থিয়েটার দেখতে গিয়েছিল। বাবাকে আনু বলে এসেছিল বিয়ের কথা। বাবা জিগ্যেস করেছিলেন, তোর পছন্দ হয়েছে আনু?

উত্তরে সে মাথা কাত করে জানিয়েছে– হ্যাঁ। বাবাকেও সে বলতে পারেনি। আনুর পছন্দ হয়নি। মা তাহলে খুব কষ্ট পাবে। বড় আপা আবার ঘরের সব কাজ করতে শুরু করবে। ময়লা কাপড় পরবে, গোসল করবে সেই বিকেল বেলায়, একদিনও বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার। জন্যে আর বলবে না আনুকে।

বড় আপা চলে যাবে! আনুর খুব খারাপ লাগে। বড় আপাকে আরেকদিন নিয়ে যাবে বকশীদের বাড়িতে। বকশীদের মেয়েগুলো একদিন আনুকে বলছিল, তোর দিদির নাকি বিয়ে? একদিন নিয়ে আসবি বেড়াতে?

আনু নিয়েই যেত। বড় আপা যেতে চায় না। হাসে আর বলে, ওদের নিয়ে যা। কিন্তু অন্য কোনো আপাকে নিয়ে বেড়াতে ভালো লাগে না আনুর। তার উৎসাহে যেন পানি পড়ে।

.

আয়নার মতো নিজেকে দেখা যাচ্ছে নদী থেকে একটু দূরে খালের পানিতে। আনু ছিপ হাতে নিয়ে ভাবে, বেলে মাছ পেলে বড় আপা খুব খুশি হতো। বেলে মাছ কী মিষ্টি, নারে? বড় আপা বলবে আর খাবে।

ইস ইস। ছিপ ধরে প্রচণ্ড টান দেয় আনু। কয়েকটা পচা পানা এসে ঠেকেছে। একটা দোলা দিয়ে বড়শিটাকে বাঁ হাত দিয়ে কাছে আনে, তারপর পানা ছাড়িয়ে নতুন একটা পোনামাছ গেথে টুপ করে আবার পানিতে ফেলে দেয়। ভাসতে ভাসতে ফানাটা স্থির হয়ে আসে। আনু আস্তে আস্তে তখন কাঁধ নামিয়ে দুহাঁটুর মাঝখানে ছিপটা রেখে বসে। ঝোঁপের মধ্যে কোথাও একটা পাখি ডাকতে থাকে তা টুক টুক, তা টুক টুক।

বাবাকে বললেও হতো। বাবাকে বললে, বাবা খুব শক্ত চিঠি লিখে দিতেন মাকে। মিনু আপাটা পড়ে না কেন? আমি বলতে যাবো। আমি বললেও পারতাম বাবাকে। বাবা আমাকে বললেন, তোর মামা টাকা চেয়েছিল নাকি রে? আমি তখন মাথা নেড়ে চোখে মুখে বললাম, না, না। মা যদি মামাকে টাকা দিত, কি বলতাম বাবাকে? আমার একটুও পছন্দ হয়নি। বাবাকে বললেও হতো। বললে, চিঠি লিখে দিতেন। বাবাকে বললাম না কেন?

কোল থেকে খরখর করে নেমে যাচ্ছিল ছিপটা। দুহাতে আঁকড়ে ধরে পড়ি পড়ি করে উঠে দাঁড়াল আনু। দুতিন পা এগিয়ে একেবারে পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে আড় করে একবার টানলো। স্রোতের উলটো দিকে টানছে। কি? আবার একটু ডানদিকে ফেরালো ছিপটা। ছিপ এলো, বড়শি রয়ে গেছে সেখানেই। মাছটা নড়ছে না। চুপ করে দম নিচ্ছে বুঝি। বড় কই হবে। কই না। কই হলে গোঁত্তা মারত হঠাৎ। একবার ডানে, একবার বামে কয়েকবার দুলিয়ে হু–উ–স করে ডাঙায় তুলে ফেলল ছিল্। সংগে সংগে গোড়ালির ওপর ঘুরে আকাশ পানে হা করে তাকিয়ে দুলতে দুলতে আনু দেখে রূপোর করনির মতো ফলি মাছটা দাপাচ্ছে, ভাজ হচ্ছে আবার সোজা হচ্ছে। পিঠের ওপর আটকেছে বড়শি। খানিকটা ছাল শুধু ধূসর মাংস ছিলে উলটে গেছে। খুব লেগেছে মাছটার। বড়শিটা গিললে কষ্টই পেতি না। নিচে দিয়ে। যাচ্ছিলি কেন? খুব সাবধানে খুলে আনে আনু। নিচে দিয়ে যাবার সময় বাঁকা হয়ে জোরে ভেসে উঠেছিল, তখন গেঁথেছে।

পেট থেকে আতুরি বার করে ছুরিটা পকেটে রাখে আনু। তারপর একটা গর্ত বানায়, গর্তটা আপনা আপনি ভরে ওঠে পানিতে। কতগুলো ঘাস ছিঁড়ে বিছিয়ে মাছটাকে সেখানে রাখে আনু। একটা বড় নৌকা নদী থেকে তাঁদের মধ্যে ঢোকে—- পলাশ বাড়ির হাট আছে। কালকে। আরো কয়েকটা নৌকা গেছে।

একটা বেলে পেলে হতো। ছোট্ট, এই আধ হাত মতো হলেও হয়। বেলে কেউ পছন্দ করে না। কেবল সে আর বড় আপা। আবার ছিপ ফেলে আনু। বাবাকে বললেও পারতাম। বাবাকে বললাম না কেন?

বুলু ভাইকে বললেও হতো। বুলু ভাইকে বললাম, আসতে, এলো না। সালু আপার সংগে ক্যারম খেলছে দুপুর থেকে। মা ঘুমিয়ে কি, নইলে দিত এক বকুনি। দিতাম যদি মাকে ডেকে।

অনেকক্ষণ কিছু ওঠে না। ছিপ উঠিয়ে আনে আনু। টোপ বদলায় অনেকক্ষণ ধরে। একটা তাজা পোনা লাগায়। লাগিয়ে আবার ফেলে। ফেলে চুপচাপ বসে থাকে। নৌকাটা এখন আর দেখা যাচ্ছে না।

মামাকে যদি টাকা দিতেন মা? ইস্, দেবে কী আমি তাহলে বাবাকে বলে দিতাম। মা একটা বোকা। মা খুব বোকা। মা কিস্‌সু বোঝে না। বাবাকে বললাম না কেন? আমি একটা বোকা। আমি খুব বোকা। আমি বোকা। শুনলে, বাবা রাগ করবেন। বাবাকে বললাম না কেন?

আস্তে আস্তে বেলা পড়তে থাকে। পেছনে বাজপড়া তাল গাছটায় কাক বসে আছে। কা কা করছে। একটা ঢিল ছুঁড়তে গিয়ে ছিপ নড়ে গেল। যাকগে। আমি খুব বোকা। কাকটা উড়ে গেল।

বাবাকে বলব। আবার যখন দেখতে যাবো বাবাকে, বলব। বলব, আমার পছন্দ হয়নি। বলব, মামা টাকা চেয়েছিল। আমি খুব চেঁচামেচি করেছিলাম কিনা, তাই মা টাকা দেয়নি। আমি অমন না করলে, দিত টাকা মামাকে। মামা সব টাকা নিয়ে যেত। বাবাকে বলব। আমি ভারী বোকা। বাবাকে সব বলব। আবার যখন দেখা করতে যাবো, প্রথমেই বলব।

ছিপ তুলে আনে আনু। পশ্চিম দিকে আকাশ লাল হয়ে এসেছে। মা এতক্ষণে উঠোন ঝাড় দিয়ে ওজু করতে বসেছেন। ছোট আপারা বেণী করছে বারান্দায় বসে বসে। বড় আপার জন্যে বেলে মাছ একটা পেলে হতো। বেলে মাছের জন্যে কাল পুলের নিচে যাবে আনু। সেখানে একবার দশটা পেয়েছিল আনু। পকেট থেকে সুতা বের করে ফলি মাছটার ঠোঁটে গেঁথে হাতে ঝুলিয়ে নিল সে। আরেক হাতে কাঁধের পরে ফেলল ছিপটাকে। খালের পানি সুন্দর কুলকুল করছে। যেন যেতে দিতে চায় না। আজ রেল লাইন ধরে ধরে বাসায় যাবে আনু। হোক সন্ধ্যে মা বকুক। মা কি জানে? মা কিসসু জানে না। মা একটা বোকা। মা খুব বোকা। মা যদি বোকা না হতো, আনু একটুও দুঃখ পেত না।

আনু বাসার উঠোনে এসে দাঁড়ায়। ছিপটাকে বারান্দায় রাখে ঠেস দিয়ে। মা নামাজ পড়ছেন। মাছটা দেয় সেজ আপার হাতে। ওরা অবাক হয় এতবড় মাছ দেখে। আনু একটুও হয় না। আনু হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসে। নামাজ থেকে উঠে এসে মাছ দেখে মা তাকে বকুক না। সে মন খারাপ করবে না, শুয়ে পড়বে না, ইস্টিশনে যাবে না, রাস্তায় গিয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকবে না। আনু এখন পড়বে। আনু পড়তে শুরু করে। আনু বই নিয়ে পড়তে ব্রু করে। আনু ইংরেজি বই থেকে দাগানো শব্দগুলোর মানে মুখস্থ করে মনে মনে। ছমাস। থেকে কিসসু পড়া হয়নি।

যেন আজ নিজেও জানে, আনু বড় হয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *