০৬. ট্রেনটা হুস-হুস ঝকঝক করতে করতে

ট্রেনটা হুস-হুস ঝকঝক করতে করতে অবশেষে স্টেশনে থামলো। মাঝখানে আবার কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল ডিসট্যান্ট সিগন্যালের পারে। ডাউন দেয়নি। সিগন্যালটা থানার একেবারে কাছে। আগে জানলে, ইস আনু গিয়ে ওখানেই দাঁড়াত। কে আসত এতদূর কষ্ট করে স্টেশন পর্যন্ত বয়ে।

ট্রেন দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে লোকে লোকে থইথই হয়ে গেল প্ল্যাটফরম। আনু কাছে যেতে পারছে না, কিছু দেখতে পারছে না। বাবা তাকে স্টেশনে পাঠিয়েছেন পানু ভাইকে আনবার জন্যে। সঙ্গে ইয়াসিন আছে। ইয়াসিন বলল, খোকাবাবু ইরকম কি দেখতে পাবেন? আপনাকে হামার কাঁধে লিয়ে লি।

ইয়াসিন নিচু হয়ে কাঁধ পেতে দিল তার। একলাফে আনু সওয়ার হলো তার ওপর। যাঃ ভারী খারাপ দেখাচ্ছে। আগে ভাবেনি, কাঁধে উঠে খারাপ লাগছে খুব। হাসি পাচ্ছে। ক্লাশের কেউ দেখে ফেললে যা খেপাবে। আরে ঐতো।

পানু ভাই হাত নেড়ে নেড়ে ডাকছেন, আনু আনু।

সেকেণ্ড ক্লাশে এসেছেন পানু ভাই। রেলেব লোক তো। চাট্টিখানি কথা নয়। আনু খুশির তোড়ে পা ছুঁড়তে থাকে। ইয়াসিন ঊর্ধ্বমুখ হয়ে শুধোয়, ভাইয়া?

আরে আমাকে নামাও না।

একদৌড়ে আনু ভিড় ঠেলে পানু ভাইর কাছে গিয়ে হাজির হয়। তিনি তার হাত দু হাতে ধরে ফেলেন।

এসেছিস?

ইয়াসিন এসে লম্বা সালাম ঠেকে। দাঁত বার করে জানায়, হামি ইয়াসিন সেপাহি, বড় খোকাবাবু। আপনার সামনে কী আছে?

পানু ভাই আনুকে জিগ্যেস করেন, বাসা কদুর রে?

আনন্দে এতক্ষণ একটা কথা বলতে পারে আনু। এবারে সে মহা উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠল, এই তো, এখানে। গোড়াগাড়ি নেবে? টমটম আট আনা নেবে। হ্যাঁ চলো টমটমে যাই।

টমটম ওঠার ভারী শখ ছিল আনুব। প্রথম যেদিন এসেছিল ওরা মহিমপুর, হেঁটেই গিয়েছিল বাসায়। সারা মহিমপুরে টমটম মাত্র তিনটে। তাও আগে থেকে ভাড়া হয়ে থাকে; দূরের গায়ে ভাড়া করে প্যাসেঞ্জারেরা নিয়ে যায়। আজ আনু দেখে এসেছে, দুটো টমটম দাঁড়ানো।

টকাটক টকাটক শব্দ তুলে টমটম চলতে লাগল লাল সুরবির রাস্তা দিয়ে। কোচোয়ান আবার পথ থেকে লোক সরাবার জন্যে হাতের ছড়িটা ঘুরন্ত চাকায় ছোঁয়াচ্ছে, শব্দ উঠছে কররররঠক। অবাক হয়ে আন দেখছে পানু ভাইকে।

কতকাল সে দেখেনি। মনেই পড়ে না শেষ কবে দেখেছে। শোর যখন তাকে দেখেছিল আনু, তখন কী রোগা আর ফ্যাকাশে ছিলেন পানু ভাই। চুলগুলো ছিল বাঁয়ে সিথি করা, বালিশের নিচে রেখে ইস্ত্রি করা জামা পরতেন তখন। এখন একেবারে অন্য মানুষের মতো মনে হচ্ছে সেই পানু ভাইকে। ধরতে গেলে যেন চেনাই যায় না। মাথার চুল পেছন দিকে উটিয়ে সিঁথি করেছেন, ধোবাবাড়ির ধোয়া শার্ট পরেছেন, গা থেকে আবছা একটা মিষ্টি গন্ধ বেরুচ্ছে। ট্রেনে আসবার ক্লান্তি এতটুকু লেখা নেই কোথাও। সেকেণ্ড ক্লাশ তো বাড়ির মতো। শুয়ে বসে যেমন খুশি আসো। ভিড় নেই, কী মজা! আনু এবার পানু ভাইকে বলে সেকেণ্ড ক্লাশে চাপরে, রাজশাহী–টাজশাহী যাবে। আবার সিগারেট খেতে শিখেছেন পানু ভাই। গুনগুন করে গান গাইছেন।

হঠাৎ চোখে চোখ পড়ে গেল। লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিল আনু। পানু ভাই গান থামিয়ে হেসে জিগ্যেস করলেন, কিরে? লেখাপড়া করছিস, না, খালি টো-টো?

ধেৎ। আমাকে ফোরে নিতেই চায় না, হেডমাস্টার আমাকে নিজে পরীক্ষা করে তবে ফোরে নিয়েছে।

তাই নাকি?

কেমন অদ্ভুত একরকম চোখ করে পানু ভাই কথা বলেন, যেন জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছেন, তার চোখটা সেইসব স্বপ্নের ছবি দেখে ফিকফিক করে হাসছে। আনু প্রতিবাদ করে ওঠে, বাবাকে জিগ্যেস কোরো না তুমি? এখানে সব নতুন বই। তাই আমি বলে সব পড়ে ফেলেছি।

বাহ। আর চাই কী?

পানু ভাই আবার গুনগুন করেন খানিকক্ষণ। তারপর হঠাৎ শুধোন, হারে, বাবা আমার চাকরির কথা শুনে কী বলল?

কী খুশি সকলে। বাবা মিলাদ পড়ালো সেদিন। আমি ইস্টিশনের দোকান থেকে জিলিপি কিনে এনেছিলাম তিন সের।

হাঃ হাঃ হাঃ।

গলা খুলে হাসতে থাকেন পানু ভাই। তার হাসির শব্দ চাকার শব্দ একাকার হয়ে এক তালে বাজতে থাকে। আনু ভেবেই পায় না এতে হাসবার কি আছে? কিন্তু সেও হেসে ওঠে। বলে, কত লোক হয়েছিল।

চারদিকে দেখতে থাকেন পানু ভাই তার হাসি-হাসি চঞ্চল চোখ মেলে।

মহিমপুর তো বেশ শহর।

আবার নদী আছে পানু ভাই। নদীর পাড় থেকে কাঞ্চনজঙ্ দেখা যায়। কাল সকালে তোমাকে নিয়ে যাবো।

কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘার নামে বিশেষ উৎসাহ দেখা গেল না পানু ভাইর। বরং তিনি আনুকে অবাক করে দিয়ে জিগ্যেস করলেন, মাছ কেমন নদীতে? জানিস?

আনু হঠাৎ প্রসঙ্গটা বুঝতে পারে না। তার মনে পড়ে যায়, তাড়াতাড়িতে খেয়াল করেনি, পানু ভাই যখন বাক্স নামিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন তিনটে বড় বড় হুইল লাগানো ছিপ দেখেছিল। ছিপগুলো ইয়াসিনের হাতে দিয়ে পানু ভাই বলেছিলেন, হুঁশিয়ারি সে লে জানা। বহুৎ নাজুক হয়।

মুঝে মালুম হ্যায় বড়া খোকাবাবু।

আনু বিস্মিত গলায় বলে টমটমের দুলুনিতে দুলতে দুলতে, তুমি ছিপ দিয়ে মাছ ধরো?

দূর বোকা! ছিপ দিয়ে মাছ ধরবো না তো কি বাঘ মারবো?

তা পানু ভাই যদি বলতেন যে ছিপ দিয়ে বাঘও তিনি মারেন তাহলেও অবিশ্বাস করতো না আনু। কারণ, তার ভাই জগতের সবচে অসম্ভব অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চকর কাজ করেন— রেলের স্টেশন মাস্টার তিনি। কেমন অজানা এক রহস্যের ঘ্রাণ তার চারপাশে। আনু যেন একেবারে সম্মোহিত হয়ে যায়। তার বিশ্বাসই হয় না, এই লোকটা, এই পানু ভাই, তার বড় ভাই।

টমটমওলা ঘাড় বাঁকিয়ে জিগ্যেস করে, কোনটে খাড়া করিম? বাসার গেটৎ?

বাসার সামনে এসে গেছে টমটম। আনু আধো উঠে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এক্কেবারে গেটে লাগাও।

গাড়ির আওয়াজ পেয়ে আপারা সব ছুটে এসেছেন দরোজায়। তাদের একপাশে মা মাথায় ঘোমটা তুলে দিতে দিতে এসে দাঁড়ালেন। মুখখানা তার থিরথির করে কাঁপছে, যেন পানিতে ছায়া পড়েছে। আনু লাফ দিয়ে নামবার সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন করে উঠল সবাই। সে গুঞ্জনের কোনো অর্থ নেই, একটা সুরের মতো।

পানু ভাই সবার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। খামোকা মাথার চুলে হাত ঘষলেন, তারপর বড় আপা মেজ আপাকে জিগ্যেস করলেন, কেমন আছিস?

কাছে আসতেই, আনু দেখে, মা-র চোখে পানি। সে পানি ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে। মুছবার চেষ্টা করছেন না। পানু ভাই কাছে আসতেই তার গায়ে হাত রেখে মা এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। আনুর বড় অদ্ভুত লাগলো। আপারা সবাই হাসছেন, তাদের হাসি হাসি মুখগুলো ছবির মতো জ্বলজ্বল করছে, পানু ভাইকে লজ্জিত বিব্রত দেখাচ্ছে, মা কাঁদছেন অথচ তার মুখেও হাসি। আনু একেবারে অবাক হয়ে গেল।

হঠাৎ পানু ভাই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আনুকে জিগ্যেস করলেন, ভাড়া কতরে?

আট আনা।

টমটমওলা একগাল হেসে বলল, না মুই আট আনা নিবার নই। এক টাকা দেন তোমরা।

আনু ধমকে ওঠে, কিসের এক টাকা?

কেনে? হামার খুশি নাগে না? বড় খোকা বাড়িতে আইচ্চেন, হামাকে তোমরা এক টাকা দিবেন না কেনে?

পানু ভাই তাকে আস্ত একটা টাকাই দিয়ে দিলেন।

বাবা উঠোনে একটা মোড়ায় বসে মুরগির বাচ্চাগুলোকে খুদ দিচ্ছিলেন। চোখ তুলে তিনি বললেন, এলি?

পানু ভাই তাঁর কাছে এসে কদমবুসি করল। বাবা তখন আরো মুঠো মুঠো খুদ দিলেন ছড়িয়ে দিয়ে হাতটা একেবারে খালি করে ফেললেন। তারপর হঠাৎ গরম হয়ে বললেন, এদ্দিন গেল একটা চিঠি নাই পত্র নাই, এই তোমার আক্কেল, আঁ? এখানে কেউ তোমার কিছু না? চাকরি পেয়ে চিঠি দিলে, আর আমি উদ্ধার হয়ে গেলাম? এই স্বাস্থ্য হয়েছে? আনু বুঝতে পারে, বাবা একটুও রাগ করেননি, যদিও গম্ভীর গলায় কথা বলছিলেন। পান ভাই দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোচ্ছিলেন, আমতা আমতা করছিলেন, হাসি পাচ্ছিল আনুর। তার এখন কত কাজ। পানু ভাইর সুটকেশ দুটো নতুন আর কী বড়। আনু যতক্ষণ না সেই সুটকেশ দুটো খুলতে পারছে, ভেতরটা ছটফট করছে। পানু ভাইর হাত ধরে সে টান দেয়। বলে, ঘরে এসো না মা ডাকছে।

বাবা আবার মুরগির বাচ্চাগুলোকে টি–টি আয় আয় বলে ডাকতে থাকেন।

সুটকেশে চাবি লাগাতেই আনু জিগ্যেস করে উঠল, আমার গার্ডের বাতি পানু ভাই?

ডালাটা লাফিয়ে উঠল সুটকেশের। পানু ভাই মুখ তুলে বললেন, দূর পাগল। গার্ডের বাতি দিয়ে তুই কী করবি?

বারে, তোমাকে বললাম যে!

চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়েছেন আপারা। সেজ আপা বলেন, আনুর যে কী কথা। জানো পানু ভাই, আনু না গার্ড হবে। আপাকে বলেছে।

যাহ্। আমি মারবো কিন্তু?

মেজ আপা ধমকে ওঠেন, ছিঃ আনু।

পানু ভাই তখন বলেন, গার্ডের বাতি পাবি কোথায়? তুই যখন গার্ড হবি, তখন রেল থেকে দেবে। তোর জন্যে অন্য একটা জিনিস এনেছি।

সঙ্গে সঙ্গে আনুর নাকের ভেতরে সুটকেশের খোলা ডালা থেকে উঠে এসে চামড়া আর ন্যাপথলিনের পাকানো ঝাঝালো ঘ্রাণ লাগে। মাথার ভেতরটা রিমঝিম করতে থাকে। বুকটা ঢিপঢিপ করে ওঠে। পানু ভাই একেবারে তলায় হাত ঢুকিয়ে একটা চৌকো বাক্স বার করে আনেন। আনুর সামনে তুলে ধরে বলেন, বলত কি?

আনু প্রায় লাফিয়ে কেড়ে নেয় বাকসটা। চেঁচিয়ে ওঠে, আমার আমার বলে। আপারা তাকে ছেকে ধরেন, দেখি দেখি করে। আনু একটানে বাক্সটা খুলে দেখে ছোট্ট একটা টেবিল ঘড়ি। ঘড়ির ওপরে একটা প্যাচার ছবি। সেকেণ্ডের কাটা টিকটিক করছে, তালে তালে প্যাঁচার চোখ দুটো একবার ডানে একবার বামে তাকাচ্ছে। আনু ঘড়িটা মাথার ওপর তুলে বাঃ কী মজার বলে নাচতে লাগল এক পায়ে। খিলখিল করে হেসে উঠল সালু আপা মিনু আপা।

পানু ভাই জিগ্যেস করলেন, কি পছন্দ? আবার অ্যালার্ম আছে। দেখিস, কী সুন্দর বাজে। আনু ঘড়িটা নিয়ে একদৌড়ে বাবার কাছে চলে যায়। বাবা ঘড়িটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। দেখেন উজ্জ্বল চোখে। প্যাঁচাটার কাণ্ড দেখে হো-হো করে হেসে ওঠেন। বলেন, মানুষের কী বুদ্ধি দ্যাখ, আনু।

একেবারে সত্যির প্যাঁচা যেন, না বাবা?

বাবা যেন কত হালকা হয়ে গেছেন, বয়স তাঁর কমে গেছে এক মুহূর্তে। ঝরঝরে গলায় তিনি বলতে থাকেন, কত দাম হবে? পানুটা চিরকাল খরুচে। তোর জন্যে এনেছে, এবার থেকে ঘড়ি ধরে পড়তে হবে। অ্যালার্ম দিয়ে রাখবি, টুনটুন করে বাজবে ভোর পাঁচটায়, ঘুম থেকে উঠবি তখন।

আরে, প্যাঁচাটা সত্যি ভারী সুন্দর এঁকেছে তো!

বাবার হাত থেকে ঘড়িটা কেড়ে নিয়ে মা-কে দেখাতে যায় আনু। মা রান্নাঘরে। গিয়ে দেখে বড় আপা পরোটা বেলছেন আর মা খুন্তি দিয়ে মোহনভোগ নাড়ছেন। ভারী মিষ্টি একটা ঘ্রাণ উঠেছে। জিভেয় পানি এসে যাচ্ছে। আনু ঘড়িটা মেঝের ওপর বসিয়ে বলে, বড় আপা, দ্যাখ।

আরে, এটা কী?

বড় আপা বেলন থামিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন।

তোকে দিল পানু ভাই?

হ্যাঁ, আমাকে। আর কাউকে না।

তখন পানু ভাইর গলা শোনা গেল বাইরে, ডাকছেন, তুই কোথায় গেলি ফতেমা? ফতেমা। বড় আপা মুখ নামিয়ে তাড়াতাড়ি আবার পরোটা বেলতে লাগলেন। মা বললেন, যা না, ডাকে তোকে।

বড় আপা মাথা আরো নামিয়ে নেন। ডাকতে ডাকতে পানু ভাই এসে হাজির হন রান্নাঘরের দরজায়। বলেন, তুই এখানে? দ্যাখ তো পছন্দ কিনা।

বলে একটা নীল ঝলমলে শাড়ি বড় আপার কোলে ছুঁড়ে দিলেন পানু ভাই।

ওর সঙ্গে ব্লাউজ পিসও আছে। বাব্বাঃ, আমি কি মেয়েদের জিনিস কিছু বুঝি না পছন্দ করতে পারি? আর যেমন কপাল, সবগুলোই মেয়ে এ বাড়িতে। কিরে, কেমন?

আনু, ওকে একটা টুল দে।

মার কথায় চৈতন্য হয় আনুর। সে একটা টুল এনে মুছে দেয় বসবার জন্যে। পানু ভাই বসেন। তাকিয়ে থাকেন বড় আপার দিকে। বড় আপা তেমনি মুখ নিচু করে আড়-চোখে কাপড়টা একবার দেখে। নীল জমিন, পূর্ণিমা রাতের আকাশের মতো জ্বলজ্বল করছে। চওড়া রূপোলি জরির কাজ করা পাড়। আনুর খুব ভালো লাগে। বড় আপা কোনোদিন একটা ভালো কাপড় পরেন না। গলে; কাপড় পরলে ওকে কী সুন্দর লাগে, দেখতে! সেদিন থিয়েটার দেখতে গিয়েছিল মা–র পুরনো সবুজ শাড়িটা পরে, একেবারে জমিদার বাড়ির মেয়ের মতো লাগছিল বড় আপাকে। ম ঝংকার দিয়ে ওঠেন, এ কেমন মেয়ে? ভাই একটা জিনিস দিলে মানুষ কত খুশি হয়, বলে, আর একটা কী হয়েছে? মনিষ্যির জাত না?

পানু ভাই বলেন, না, ও যা লাজুক। চিঠি দেখেই বুঝেছি। সবার জন্যে সব লিস্টিতে আছে, ফতেমার কোন নামই নেই।

বলতে বলতে পানু ভাই কোলের কাছ থেকে দুটো মোড়ক তুলে ধরেন। আনু উদগ্রীব হয়ে ওঠে, আরে, এটা আবার কি?

মোড়ক খুলাতে দেখা গেল, একটা রূপোর পানের বাটা আর এক জোড়া নরম কালো কুচকুচে চাট। মা–র সামনে রেখে পানু ভাই বললেন, মা, তোমার জন্যে।

কড়াইটা উনোন থেকে নামিয়ে মা জিনিস দুটো হাতে নিয়ে কী খুশি হয়ে ওঠেন। গগনে আগুনে ঘাম ছুটতে থাকে তার। হাসিতে আলো হয়ে ওঠে মুখটা। বলেন, তুই আবার আমার জন্যে খরচ করতে গেলি কেন?

খরচ আর কি?

মা অনেকক্ষণ ধরে নেড়ে চেড়ে দেখলো! পানের বাটাটা খুলে ছোট ছোট বাটিগুলো তুলে দেখলেন আর হাসলেন। তারপর পানু ভাইর দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন থেকে মাসে মাসে টাকা জমাস পানু। পাঁচ টাকা দশ টাকা করে জমালেই বছরান্তে কত টাকা হয়। আনু, যাতো জিনিসগুলো ঘরে রেখে আয়।

মার জিনিস, বড় আপার শাড়ি, নিজের ঘড়ি নিয়ে আনু এ ঘরে এসে দেখে এক মহা হুলস্থুল কাণ্ড—-ছড়ানো জিনিসপত্র, শাড়ি, ক্রুশকাটা, উল, ডিএমসি সুতো, স্নো, পাউডার, ফিতে, সাবান নিয়ে আপার বিছানা জুড়ে বসেছেন। এ ওর জিনিস মিলিয়ে দেখছে, গালে ঠোনা দিচ্ছেন, হেসে উঠছেন, কাপড়গুলো বুকে লাগিয়ে লাগিয়ে পরখ করছেন। বাবার জন্যে কার্পেটের জায়নামাজ আর পাঞ্জাবির কাপড় এনেছেন পানু ভাই। জায়নামাজটা জলচৌকির ওপর এরি মধ্যে কে বিছিয়ে দিয়েছে। ঘরটা একেবারে নতুন লাগছে। আনুর টেবিল ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা বাজে।

বাবা তাকে ডেকে নিলেন।

চলতো, বাজার থেকে আসি। থলেটা নিয়ে আয়।

বাবা বাসার সামনে খুব আস্তে আস্তে পায়চারি করছেন আর কথা বলছেন বড় জমাদার সাহেবের সঙ্গে।

বাজারে গিয়ে দেখে সবে বাজার বসেছে। বড় বড় মাছ ধপাস ধপাস করে এনে ফেলছে শান বাঁধানো চত্বরের ওপর। ওপাশে বুড়ো বেহারি খাসির রানগুলো ঝুলিয়ে রাখছে। বাজারের পেছনে মজা পুকুরটা কচুরি পানায় সবুজ হয়ে আছে।

কিরে, মাছ নিবি না মাংস?

আনু কিছু বলে না। সে কী বলবে? বাবা তার উত্তরের অপেক্ষা না করেই মাছগুলার কাছে এগুলেন। বললেন, বীরেন, আজ একটা রুইয়ের মাথা দিতে হয়।

মাঝি হেসে বলে, কর্তা, আইজ কেনে তোমরা আইচ্চেন। মোক্ খবর দিলে, মুই দিয়া আনু হয়।

আচ্ছা, হয়েছে। বড় ছেলে বাড়ি এসেছে মাঝি। ভালো দেখে দিও। কেমন?

ঝপাং করে আনুর থলেতে আস্ত একটা প্রকাণ্ড রুইয়ের মাথা তুলে দেয় মাঝি। কাকো কি লাল! ফুলের মতো। টপটপ করে রক্ত পড়ছে। কিছুতেই দাম নেবে না সে। বাবা জোর করে দুটো টাকা গুঁজে দিলেন তার হাতে। তারপর ভালো শিলআলু নিলেন দুসের। নতুন টম্যাটো উঠেছে।

কত করে হে?

পাঁচসিকা সের।

পাঁচসিকে! —-আচ্ছা দাও, আধসের।

বাইরে বেরিয়ে আনুকে বললেন, ভাল লাগছে খুব?

নাহ্।

আনু একহাতে থলেটা ধরে জোরে জোরে হাঁটতে থাকে বাসার দিকে। ওজন ছিল সত্যি। কিন্তু ওজনটাকে কিছুই মনে হয় না তার। কদিন পরে রুইয়ের মুড়ো কিনলেন বাবা। স্বাদটা ভুলেই গিয়েছিল আনু। এত ভালো লাগে তার। রাতে কখন খেতে বসবে সেই ছবিটা আনুর জিভে সরস করে তোলে।

বাসায় এসে দেখে রান্নাঘরের বারান্দায় বসে পানু ভাই হাত নেড়ে নেড়ে গল্প বলছেন আর সিগারেট খাচ্ছেন। আপারা ঘন হয়ে বসেছে। মা বসে বসে সরু চাল বাছছেন। থলেটা বারান্দায় নামিয়ে দিয়ে আনু বলল, পানু ভাই! মার সামনে তুমি সিগারেট খাও?

হা-হা করে হেসে উঠলেন পানু ভাই। আপারা গড়িয়ে পড়ল এ ওর গায়ে। পানু ভাই তার পাছায় একটা চাপড় মেরে বললেন, মার সামনে খেলে কিছু হয় না। মা তো মা।

আনুও তখন হাসতে হাসতে তার হাঁটু ঘেঁষে বসলো। সে এখন ইস্টিশানের গল্প শুনবে। সবাইকে সে থামিয়ে দিয়ে পানু ভাইর হাত ধরে জিগ্যেস করে, তুমি ফোনে কথা বলো, না পানু ভাই? আর ঘটাং–ঘটাং করলে একটা বল বেরিয়ে আসে না?

.

নদী এইখানে বাঁক নিয়েছে। পানু ভাই মাঝিকে বললেন নৌকা বাঁধতে। ছিপগুলো ধরে ছিল আনু, সেগুলো নিলেন তিনি। বললেন, নেমে আয়। সাবধানে নামবি।

লাফ দিয়ে নৌকো থেকে নামলো তাবা। তারপর ফাঁকা ঝাউবনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে লাগল। মহিমপুর থেকে কতদূর চলে এসেছে তারা। পানু ভাই মাছ ধরবে। মাথার ওপরে বেলা দুপুরের রোদ গনগন করছে। ধুধু নদী চর, প্রান্তর, পানি দেখাচ্ছে বিশাল একটা ছবির মতো। আবার পানিটা আয়নার মতো জ্বলছে, চোখ রাখা যায় না।

পানু ভাই চলছেন আগে আগে। তার কাঁধে ছিপ তিনটে। আর পেছনে আনু। তার হাতে ঝোলানো দুটো বার্লির কৌটা। ওর মধ্যে আধার আছে। আজ সারা সকাল ধরে মেথি হিং দিয়ে, বোলতার চাক ভেঙে, চাল ভেজে বানিয়েছেন পানু ভাই। মার কি বকা! পানুভাই শুনে হাসেন। মা খালি বলছিলেন, তুই কোথা থেকে শিখলি এসব? ভদ্দরলোকের ছেলেরা ধরে? যতো সব আলসে, অকম্মার বদনেশা। পানু ভাই একটুও প্রতিবাদ করেন নি। একমনে তিনি আধার বানিয়ে চলেছেন। বার আনুকে দিয়ে বাজার থেকে এক আনার পোনামাছ আনিয়েছিলেন, একটা কৌটোয় পানি দিয়ে পোনাগুলো তাজা করে রেখেছেন। আনু অবাক হয়ে গিয়েছিল, এই ছোট মাছগুলোকে বা মাছ খেতে আসে। মাছ, মাছ খায। কী অবাক কাণ্ড! আনুর খুব আসতে ইচ্ছে করছিল, মাছ ধরা দেখবে সে। কিন্তু বলতে সাহস হয়নি। পানু ভাই যেন মনের কথা পড়তে পারেন। আধার বানাতে বানাতে তিনি বলছিলেন, আজ তো তোর ছুটি, চল তুই আমার সঙ্গে।

ঈদের জন্যে বন্ধ দিয়েছে স্কুল।

ঝাউবনের ভেতর দিয়ে চারদিকে সন্ধানী চোখ ফেলে ফেলে হাঁটেন পানু ভাই। তারপর একটা জায়গা এসে বলে, খুব চিন্তিত আঃ আনমনা গলায়, এ জায়গাটা মন্দ না।

বলেই তিনি খাড়া পাড় বেয়ে নামতে থাকেন তরতর করে। আনুর খুব কষ্ট হয় নামতে। দুএকবার সে পড়ে যায়, গায়ে বালি লাগে, কিন্তু পানু ভাই ফিরেও তাকান না। একেবারে পানির কাছে এসে তিনি বলেন, বুঝলি, এইসব জায়গায় মাছ থাকে। নদী বাঁক নিয়েছে কিনা, পানির খুব তোড়, তাই মাছগুলো এদিকে এসে সব জড়ো হয়ে থাকে।

আনু হাঁ হয়ে যায় শুনে। এইসব কাণ্ড নাকি? একটা জায়গা বেছে নিয়ে পানু ভাই ছিপ ফেলে বসেন। তিন তিনটে ছিপ। আনু চোয়াল ঝুলিয়ে তাঁর কাণ্ডগুলো দেখে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ভেসে থাকা যাত্রা তিনটের দিকে। পানু ভাই তাকে একটা ফানার দিকে নজর রাখতে বলেন, তাতে সে বড় খুশি হয়ে যায়। একমুহূর্ত চোখ এদিক ওদিক সরায় না। একটা স্বপ্নের মতো লাগে আনুর।

এই বেলা তিনটের রোদ, ঝিকমিক করতে থাকা নদী, আকাশে কালো বিন্দুর মতো একটা দুটো পাখি, স্রোতের মুখে ভেসে চলা বড় বড় নৌকার মন্থর চলে যাওয়া, পাশে নিবিষ্ট মনে বসে থাকা পানু ভাই, পাড়ে ঝাউবনে বাতাসের সরসর আর কোথা থেকে উঠে আসা নিবিষ্ট সব শব্দ–বাতাসে মানুষের বহুদূর থেকে ভেসে আসকণ্ঠ, নদীর ছলছল সব মিলিয়ে এক অপরূপ মায়ার সৃষ্টি হয় আনুর মনে। সে যেন এখানে নেই, কোথাও নেই, পৃথিবী ছাড়িয়ে এক রহস্যময় জগতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবা, মা, আপারা, ইয়াসিন সেপাই, সুরেন স্যার, ড্রয়িং স্যার, মহিমপুর ইস্টিশান, পোস্টাফিসে চিঠি আনতে যাওয়া সব কতদূর ফেলে এসেছে আনু। সেখানে আর ফিরে যাবার কথা মনেও হচ্ছে না তার। মনে হচ্ছে, এখানে এইভাবে সে পৃথিবীর শেষদিন পর্যন্ত বসে থাকবে পানু ভাইর পাশে।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ান পানু ভাই। চমক ভাংগে আনুর। তাকিয়ে দেখে, তিনি একহাতে ছিপটা ধরে আছেন শক্ত করে, সরসর করে হুইল থেকে সুতো খুলে, নদীর অতলে চলে যাচ্ছে। আনুও উঠে দাঁড়ায়। চঞ্চল হয়ে একবার পানু ভাইর দিকে একবার নদীর দিকে তাকায়। দ্রুত কণ্ঠে জিগ্যেস করে, কি? মাছ?

কোন জবাব দেন না পানু ভাই। তার কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ফুটে উঠেছে। নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরেছেন তিনি। মাথার ফিনফিনে চুলগুলো বাতাসে ঝিরঝির করে উড়ছে। সুতো নাড়া বন্ধ করে আস্তে আস্তে বায়ে কয়েক পা হেঁটে গেলেন পানু ভাই চোখ তাঁর নদীর পানিতে। আনু কিছু বুঝতেই পারে না, কি ব্যাপার। তার ভারী গর্ব হয। মুগ্ধ চোখে পানু ভাইকে সে দেখতে থাকে।

আস্তে আস্তে সুতো গুটোতে থাকেন পানু ভাই। তারপর একসময় থেমে যান। নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে থাকেন। পানিতেও কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। হঠাৎ আবার টান পড়ে সুতোয়, সরসর করে খুলে যেতে থাকে, ট্রিং ট্রিং শব্দ করতে থাকে হুইল, পানু ভাই বলেন, জোর গোত্তা মারছে রে। সের পাঁচেক হবে।

কী?

মাছটা।

সুতোর টানেই ওজন বুঝতে পারেন পানু ভাই? অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন এক স্বপ্নরাজ্যের মানুষ মনে হয় তাঁকে আনুর। মিনিট দশেক এরকম খেলা চলে পানির অতলে মাছটার সঙ্গে ডাঙায় দাঁড়ানো পানু ভাইয়ের। একসময়ে হঠাৎ এক ঝটকায় ছিপটা তুলে ফেললেন তিনি। গোড়ালির ওপর ঘুরে একেবারে উলটে মুখ হয়ে যান। শূন্যে ধনুকের মতো লেজ বানাতে থাকে। আনু দৌড়ে যায় ধরবার জন্যে।

রিঠা মাছ! কেমন নীলচে ধূসর রং, আবার গোঁফ আছে দ্যাখো{ বশীটা গিয়ে গেঁথেছে নিচের ঠোঁটে একেবারে এ ফেঁড় ও ফোড় হয়ে। আনু সন্তর্পনে হাত রাখে মাছটার গায়ে। কী ঠাণ্ডা, একেবারে বরফের মতো। মাথার ওপরে খসখসে, পাখনা নড়ছে এখনো, মসৃণ। আনুর খুব ইচ্ছে হয়, সে যদি এরকম মাছ ধরতে পারতো, অবাক হয়ে যেত সবাই। পানু ভাইকে বলে, বাবা রিঠামাছ যা ভালবাসে।

তাই নাকি রে?

দেখো তুমি।

পানু ভাই পকেট থেকে ছুরি বের করে মাছের পেটটা চিরে ফেলেন। বের করে দেন আতুরিটা। তারপর খালুইয়ের ভেতরে রেখে দিয়ে আবার ছিপ নিয়ে বসেন। আনু জিগ্যেস করে, কেন?

তাহলে আর পচবে না। এসব মাছ আবার তাড়াতাড়ি নরোম হয়ে যায়, বুঝলি? কিরে তোর ছিপে এখনো কিছু পড়ল না যে!

ছোট ছিপটা আনুকে দেখতে দিয়েছিলেন। তার ফান্য এখনো স্থির। একটু একটু দুলছে কেবল স্রোতের দোলায়। পানু ভাইর ফানাটা আবার ঝাঁকুনি দিয়ে তলিয়ে গেল।

 বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। ফেরবার পথে পানু ভাই চা খাবার জন্যে বসেছিলেন ইস্টিশানের দোকানে।

ওহে, আমাকে একটা কড়া চা দিও! আর একে মিষ্টি, কি আছে?

অমিরতি দেই?

দাও, দুটো দিও। কিরে দুটো খেতে পারবি না আনু?

দোকানে যারা বসেছিল তারা শুধালো মাছের কথা। কেউ কেউ বলল, বাহু, ছিপে আপনার গুণ আছে যাহোক! বাজারে সাত আট টাকার মাছ হবে। তাও তাজা পাবেন কোথায়?

আপশোষ করতে কবতে তারা মাছগুলো দেখল আঙুল দিয়ে নেড়ে চেড়ে। আনুর খুব বাহাদুর মনে হচ্ছে নিজেকে। সেও তো ছিল পানু ভাইর সঙ্গে।

মা দেখেই বলে উঠলেন, সারাদিন চরে–চরে ঘুরে চেহারা কী করেছে দুজন। এ বদ নেশা তোর কোত্থেকে এলো পানু? ওখানে এই করে বেড়াস নাকি?

হ্যাঁ, তাহলেই হয়েছে। রেল কোম্পানির জামাই কিনা আমি।

আনু যেন চুপসে যায়। মা যে কী একটা! মা তাকে ধমকে ওঠেন, এখন পড়তে বসো গে। আর ঝিমিয়ে কাজ নেই।

উঃ, আনুর সারা গা এমন মটমট করছে, একটু শুতে পেলে ভারী ভালো হতো। তার কি উপায় আছে? রান্নাঘর থেকে তার পড়বার টেবিল যে দেখা যায়। আনু গিয়ে বই নিয়ে বসে। মন বসে না বইয়ের পাতায়। চোখের সামনে বারবার ফিরে ফিরে আসে দুপুরের রোদে জ্বলা নদীটার ছবি। যেন জীবনে আর কখনো সে যেতে পারবে না সেখানে। আস্তে আস্তে বইয়ের ওপর কখন ঘুমিয়ে পড়ে আনু তা নিজেও জানতে পারে না। প্যাচা–মুখ ঘড়িটা তার চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে টিক–টি–টিক করে চলে অবিরাম।

.

যাবার দিন সকালে তনুকে ডেকে ছোট ছিপটা দিয়ে দিলেন পানু ভাই। আর দুটো বশী, দু রকম। বললেন, মা–কে বলিস না কিন্তু। আর শোন, ছুটির দিন ছাড়া খবরদার যাবি না। যেতে হলে ইয়াসিনকে সাথে নিয়ে যাস।

আচ্ছা।

যা বলবে, তাতেই রাজি আনু। এত খুশি হয়েছে সে ছিপটা পেয়ে। পানু ভাই যে কেন একটা আস্ত ছিপ তাকে দান করে দিলেন, ভেবে কিসসু কুলকিনারা করতে পারে না। ভারী অবাক লাগে তার। বিশ্বাসই হতে চায় না। ছিপটা সে লুকিয়ে তুলে রাখবে ঘরের চালে, কেউ দেখতে পাবে না। মাঝে মাঝে বার করে দেখবে। আবার তুলে রাখবে।

মা–বাবাকে সালাম করে বাড়ি থেকে বেরুলেন পানু ভাই। মা দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে যতদূর দেখা যায় তাকিয়ে রইলেন। আপারা বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। সেই টমটমটা এসেছে আজ। ইয়াসিন মাল তুলে দিয়ে জোর–পায়ে চলল ইস্টিশানের দিকে। আনুও উঠে বসলো টমটমে। বাবা ভেজা গলায় বললেন, পৌঁছে চিঠি দিস পানু।

তারপর মৃদুস্বরে উচ্চারণ করলেন, খোদা হাফেজ। আল্লাহু গফুরুর রহিম।

আপাদের দিকে তাকিয়ে পানু ভাই ছবির মতো হাসলেন।

আসিরে।

টমটম চলতে লাগল। সারা রাস্তায় একটা কথা হলো না দুজনের। পানু ভাই যদি দেখে ফেলেন আনুর চোখে পানি টলটল করছে। সে বসে বসে ছিটের নকশী খুঁটতে থাকে; মনটাকে জোর করে ধরে রাখতে চায়। কিন্তু আর বুঝি পারা যাবে না। বুকের মধ্যে হু–হুঁ করছে আনুর।

গাড়িতে উঠে একটা টাকা দিলেন তাকে পানু ভাই। তারপর ছাড়বার সময় হলে ইয়াসিনের সঙ্গে নেমে এলো সে। ইয়াসিন হাত তুলে বলল, সালাম খোকাবাবু, সালাম।

 বাঁশি বাজল। হুইসিল পড়ল। শেষবারের মতো ঢং ঢং করে উঠল ঘণ্টা। হিস–হিস করে উঠল ইঞ্জিন। সরে যেতে লাগল পানু ভাইয়ের গলা বাড়ানো জানালাটা। আনু হাঁটতে লাগল সঙ্গে সঙ্গে। তারপরে দৌড়লো। তারপর হঠাৎ থেমে গেল প্ল্যাটফরমের শেষপ্রান্তে। গাড়িটা ঝক ঝক করতে করতে বেরিয়ে গেল। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল দূরের বাকে। আনু চোখ ফিরিয়ে দেখে তার চোখ বরাবর ইস্টিশানের খাড়া সাইনবোর্ড মহিমপুর। বাংলা, উর্দু আর। ইংরেজিতে লেখা। লেখাটাই যেন কিছু পড়তে পারছে না সে। ইয়াসিন তার হাত ধরে বলল, চলিয়ে ছোটা খোকাবাবু। আপনি ভি এরকম কেতো যাইবেন নৌকরি লিয়ে। হাঁ, সাচ বোলছি। হাঁ, হাঁ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *