০৫. সকালবেলার লাল আলো

সকালবেলার লাল আলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। মহিমপুরের নির্জন পথে এখনও এখানে ওখানে লেগে রয়েছে অন্ধকার।

আনু ঘুমিয়েছিল। সালু আপা তার চোখে ফোঁটা ফোঁটা পানি দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিল। বিরক্ত হয়ে চোখ মেলে আনু জিগ্যেস করল, কী?

কিন্তু তার বিরক্তি চোখেই পড়ল না সালু আপার। বরং খুশিতে ডগমগ হয়ে সে বলল, ফুল কুড়োতে যাবিনে? দেখ তো বেলা কত হয়েছে?

আরে তাই তো! ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে আনু জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। নিম গাছটার নিচে, রান্নাঘরের পেছনে বিরাট লাল সূর্য আস্তে আস্তে ভেসে। উঠছে আকাশে। তার অভিমান হলো সালু আপার ওপর। বলল, তুমিই তো বেলা করলে! আমাকে আরো আগে ডাকলে না কেন? ঠিক ও বাড়ির খোকা এসে সব ফুল এতক্ষণে নিয়ে গেছে।

তবু ঘর থেকে বেরোয় আনু। মনটা কেমন খুঁতখুঁত করে তার। আর একটু সকালে উঠলেই কেমন তাজা শিউলি পাওয়া যেত। শিশির ভেজা ঘাসে পা ডুবিয়ে ফুল কুড়োতে যা মজা! এত বেলা করে গিয়ে শুধু শুধু বাসি ফুল কুড়োনো বইত আর কিছু নয়।

পথে বেরিয়ে আনুর ভারী ভালো লাগল শীতসকালের আমেজ ভরা শহরটিকে। মাত্র কয়েকমাস হলো ওরা এসেছে মহিমপুরে। এটা নাকি মহকুমা সদর। কিন্তু হলে হবে কী, শুনতেই যা। বর্ষাকালে কাদায় যদি ঘর থেকে এক পা বেরুনো যায়। যেদিকে তাকাও শুধু পানি আর কাদা। আবার যখন গরম পড়ে তখন পথে এত ধুলো ওঠে যে, আনুদের কোয়ার্টার থেকে থানা এক মিনিটের পথ, এইটুকু হেঁটে যেতেই হাঁটুভর্তি ধুলো হয়ে যায়। আনুর শুধু ভালো লেগেছে এই শীতকালটা। লেপ মুড়ি দিয়ে মিটমিট করে চোখ খুলে জানালা দিয়ে পথটাকে দেখতে ভারী সুন্দর লাগে। কেমন পাথরগুলো ভিজে গিয়েছে শিশিরে। লালমাটি বিছিয়ে রয়েছে পুরু কাঁথার মতো। আর থানার পেছনে বড় শিউলি গাছটা অ্যাতোগুলো ফুল ছড়িয়ে রেখেছে ঘাসের ওপর। সালু আপার সাথে রোজ ফুল কুড়োতে আসে আনু। এসে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে গাছটার দিকে। ডালগুলো বুড়ো হয়ে গেছে, পাক ধরেছে, বাকল উঠে গেছে, তবু তারি গায়ে চিকন চিকন ডাল বেরিয়েছে, সেই ডালে ফুল। সালু আপা ধমক দেয় একেকদিন, হাঁ করে গাছ দেখলে কি আর ফুল কুড়োনো যায়? নিশ্চয় পোকা এখুনি এসে পড়বে। তখন নিসর্গে ফুল।

আবার তখন দুহাতে ফুল কুড়োতে শুরু করে আনু। ও আবার বলে, আনু গাছে উঠতে পারবি?

একবার গাছটায় চোখ বুলিয়ে নেয় অনু! পরে বলে, হুঁ।

তবে ওঠ। উঠে ডানদিকের বড় ডাল ধবে ঝকালে কিন্তু মেলা ফুল ঝরবে। তুই ওঠ।

তারপর ঝুরঝুর করে, ডাল থেকে নাড়া পেয়ে, আরো কত শিউলি যে ছড়িয়ে পড়ত তার আর হিসেব নেই।

একেকদিন বাবা আসতেন আনুদের সাথে। অনুরা ফুল কুড়িয়ে তখন জমা করত তাঁর কাছে। তারপর তিনজন একসঙ্গে ফিরে আসতে বাসায়। বাসায় এসে চা–মুড়ি খেতে খেতে মালা গাথতো সালু আপা, আনু একটা একটা করে ফুল তুলে দিত তার হাতে। বাবা কিন্তু আনুদের আসবার অনেক আগেই শিউলি গাছের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেখানে গিয়ে পায়চারি করতেন আর আনতস্বরে সুর করে সুরা পড়তেন। ভারী মিষ্টি গলা ছিল বাবার। কান পেতে শুনতে ইচ্ছে করত আনুর। আকাশ থেকে আসা অশরীরি গানের মতো মনে হতো তার।

কোনো কোনো ভোরসকালে ঘুমের ঘোরে আনু শুনতে পেত, বাবা নামাজ পড়ছেন। দীর্ঘ কোন এক সুরা করুণ সুরে আবৃত্তি করে যেতেন তিনি। আনু তন্ময় হয়ে যেত শুনতে শুনতে। কেন যেন তার পানি এসে যেত চোখে। বালিশে মুখ গুঁজে নিস্পন্দ পড়ে থাকত সে।

আজ তাড়াতাড়ি শিউলি তলায় আনু সালু আপাকে নিয়ে গিয়ে দেখে, বাবা সেই কখন থেকে সেখানে পায়চারি করছেন। পথের দুধারে নিবিড় গাছপালা আর বড় বড় আমগাছ। আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাবা সুরা পড়ছেন। চোখ দুটো তাঁর প্রায় বুজে এসেছে। ওদের দেখে তিনি আনমনে একটু হাসলেন। তারপর আরো কিছুক্ষণ সুরা পড়ে কাছে এসে বললেন, কিরে, এতক্ষণে ঘুম ভাঙ্গলো তোদের? আরো:সকাল করে উঠবি। খুব সকালে উঠবি। শুধু ফুল কুড়োনোর জন্যেই কি এত ভোরে ওঠা?তারপর বিশেষ করে আনুকেই যেন তিনি বলেন—-বড় বড় লোক, তারা সব খুব ভোরে উঠতেন। এক্কেবারে ভোরে। কাকপাখির নামগন্ধ নেই পর্যন্ত তখন।

সালু আপা আনুর হাত ধরে টানে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে। ক্রমেই থালার মতো সূর্য জেগে উঠছে আকাশে। আর তারই লাল আলোয় বাবার মুখখানা রাঙা দেখাচ্ছে। তিনি বলে চলেছেন, আর্লি টু বেড আর্লি টু রাইজ, মেকস ম্যান হ্যাপি অ্যান্ড ওয়াইজ।

আনু ঠিক বুঝতে পারল না কথা কটির অর্থ। বাবা তাকে বুঝিয়ে দিলেন। তারপর হেসে বললেন, যাও ফুল কুড়োওগে তাড়াতাড়ি। নইলে বাসায় আবার চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।

ফুল কুড়োতে কুড়োতে আনু ভাবে, বাবা কত ভোরে ওঠেন। নিশ্চয়ই বাবা অনেক বড়। বাবার মতো বড় কেউ নেই।

বাসায় ফিরে এসে দেখে বড় আপা আর মেজ আপা তখন চায়ের জোগাড় করেছেন। সেজ আপা রাতের বিছানাগুলো ঝাড়ছেন। লেপগুলো ভাজ করে তুলে রাখছেন। মেজ আপাকে তার নাম ধরে একেকসময় আনু ডালু আপাও বলে ডাকে। ডালু আপা বলতে ভারী মিষ্টি লাগে আনুর।

আর মিনু আপার শুধু শুধু শয়তানি মতলব। কাজকর্ম কিছু করবে না, কিন্তু ভাব করে যেন কত কী রাজকার্যে ব্যস্ত। আনু গিয়ে রান্নাঘরে বড় আপার আঁচল ঘেঁষে বসে পড়লো। তিনি ওর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, এ দেখেছ আনু এখনো মুখ ধোয়নি, চা খেতে এসেছে। যা শীগগীর করে মুখ ধুয়ে আয়।

কী আর করে আনু। বাবা শুনলে খুব রাগ করবেন। শীতকালে মুখ ধুতে যা কষ্ট! গাল–মুখ চোখ ঠাণ্ডা পানিতে যেন কেটে যেতে চায়। গুটি গুটি পায়ে কুযযার পাড়ে আসে আনু। এসে দেখে, মা কাপড়ে সাবান দিয়ে রাখছেন। এতে দুপুরবেলায় যখন ধোওয়া হবে, ময়লা কাটবে ভালো। মাকে অত সকালে কাপড়ের স্থূপ নিয়ে কুয়োর পাড়ে বসতে দেখে কেমন মায়া করলো আনুর। মনিরের মা–র কথা মনে পড়ল। তাদের মতো ঝি থাকলে মার আর কোন কষ্ট ছিল না।

মনিরের কথায় সেই অবাক করা খেলনাটার কথা মনে পড়ে গেল। চোং–এর ভেতরে চোখ রেখে ঘুরোলেই ভাঙা চুড়ির টুকরোগুলো নতুন নতুন নকশা হয়ে ওঠে। বড় আপার খুব পছন্দ হয়েছিল ওটা। বড় আপা একেকদিন আনুর হাত থেকে খেলনাটা নিয়ে বারান্দায় বসে অনেকক্ষণ ধরে নকশার খেলা দেখতেন। তখন তার মুখে ফুটে উঠত আবছা একটা হাসি, যে হাসিটা কোনদিন ভুলতে পারবে না আনু। অস্পষ্ট এক চিলতে একটা হাসি, ঈদের চাঁদের মতো, দেখা যায় কিনা, আনু একটু চোখ বুঝলেই একেবারে স্পষ্ট দেখতে পায়। হাসিটা তার মনকেও অজান্তে কখন প্রসন্ন করে তোলে।

মুখ ধোবার জন্যে পানি তুলে দিলেন মা। বললেন, ফুল কুড়োনো হয়ে গেল এরই মধ্যে? ধন্যি ছেলে, নিত্যি নিত্যি ফুল কুড়োনো চাইই চাই। কী হয় বাপু এত শিউলি এনে?

অভিমান হয় আনুর। বলে, কেন, সালু আপাই তো বলেছে শিউলির বোটা দিয়ে রঙ হয়। সেই রং–এ তুমি নাকি জরদা করবে।

মা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর তাড়াতাড়ি বললেন, আচ্ছা যা, তুই চা খেয়ে পড়তে বোস। খালি বেড়ানো!

আনু বুঝতেই পারে না, মার মেজাজ আজকাল এত তেতো হয়ে যাচ্ছে কেন। সে আস্তে আস্তে উঠে আসে।

বড় ঘরের বারান্দায় সবাই গোল হয়ে বসেছে চা খেতে। হঠাৎ আনুর নজরে পড়ায় চিৎকার করে ওঠে, দেখেছ বাবা, মিনু আপা কতগুলো দুধ ঢাললো ওর কাপে। দেখেছ?

আহা নিক। তুইও নে।

এত মিষ্টি করে বললেন বাবা যে আনুর মনটা ঝিরঝির করে উঠল। সেও ভাবলো, নিক না। মিনু আপা সারাক্ষণ তার সঙ্গে দুষ্টুমি করে, জ্বালাতন করে মারে, সে সব কিছুই এখন মনে পড়ল না আনুর। সে এক মুঠো মুড়ি তার কাপে ঢেলে সুড়ৎ সুড়ৎ করে খেতে লাগল। চায়ের সঙ্গে ভারী স্বাদ হয়েছে। ও–রকম চায়ে মুড়ি ঢেলে সালু আপা মিনু আপাও খাচ্ছে। মেজ আপা সঙ্গে বসেননি। তিনি একটা থামে ঠেস দিয়ে খাচ্ছেন। ছবির মতো লাগছে।

চা খেতে খেতে বাবা মাকে বললেন, আমার সুটকেশ গোছানো হয়েছে?

কেন?

উদ্বিগ্ন হয়ে আনু জিগ্যেস করে। উত্বে দেন মেজ আপা, বাবা আজ মফস্বলে যাবে আনু।

সত্যি?

আনুর যেন বিশ্বাস হতে চায় না।

হ্যাঁ।—বাবা বললেন।

তাহলে কবে তুমি আসবে?

তার কি ঠিক আছে? কাজ যদ্দিনে হয়। এই দিন তিনেকের মধ্যেই ফিরব আমি।

শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় আনুর। আনমনে চায়ের কাপে চুমুক দেয় সে। নতুন করে মুড়ি নিতে ভুলে যায়। একেবারে কিছুই আর ভালো লাগে না তার।

কেন যে বাবা বেছে বেছে এই থানার চাকরিটা নিয়েছেন, ভেবেই পায় না আনু। খালি অভাব আর অভাব। তার ওপর একদিনের জন্যে সুস্থির নেই। আজ এখানে কাল সেখানে এই করে। মাসের অর্ধেকটাই বা বাইরে বাইরে কাটান। আর যখন তিনি থানার অফিসে এক গাদা কাগজপত্র নিয়ে বসে থাকেন তখন কেমন বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে আনুর মন। মনে হয় তিনি বুঝি আনুর বাবা নন। কেমন গম্ভীর আর দৃঢ় মুখখানা। দেখে ভয় করে আনুর। পালিয়ে আসতে ইচ্ছে করে। তাই পারতপক্ষে আনু কোনদিন থানার পথ মাড়াতো না। কত ছেলের বাবা কত কী কাজ করে। তার এক বন্ধু ছিল ডাক্তারের ছেলে। তার বাবা কানে স্টেথিসকোপ লাগিয়ে বুক দেখতেন, ইঞ্জেকশন দিতেন, আবার ঘোড়ায় চড়ে রুগী দেখতে যেতেন দূর দুর গাঁয়ে। মাথায় শোলার হ্যাঁট, প্যান্ট পায়ের কাছে জড়িয়ে ক্লিপ দিয়ে আটকানো, একপাশে। ঝোলানো ওষুধের কালো ব্যাগটা ঘোড়া চলতো আস্তে আস্তে, বেশ লাগতো আনুর। দুপকেট ভর্তি টাকা নিয়ে ফিরতেন তিনি আর আনতেন আম, লিচু, না হলে পাকা পেপে। পিন্টুর বাবাও বেশ। পিন্টুর বাবা বকশীবাবু অস্ট্রেলিয়া বিলাত কত জায়গায় পাট পাঠান, ইচ্ছা করলে নিজেও যেতে পারেন, যান না। মনিরের বাবার কাজও কত সুন্দর। মাসের মধ্যে চারবার ঢাকা যাচ্ছেন। ওদের মিল বসছে সিরাজগঞ্জে, কাপড়ের মিল। মনিরের বাবা কত বড় লোক। দোতলা বাড়ি। মনির রোজ ছাদে উঠতে পায়। ছাদে উঠতে এত মজা লাগে আনুর!

খুব ভোরে যারা ওঠেন তারা নাকি বড় লোক। বাবাও তো বড় লোক। বাবা তবে কেন অমন বিশ্রী একটা চাকরি করেন? চোর ঠ্যাঙ্গায় বলে ছেলেরা তাকে ঠাট্টা করে। আবার কেউ কেউ বলে দারোগার ছেলে পাজি হয়, মিশতে চায় না তার সঙ্গে।

সেজ আপা একদিন তাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন, যারা বলে আনু, তাদের বলবি, দারোগা না থাকলে তোদের বাড়িতে চুরি হলে কি করবি? একেবারে ফকির হয়ে যাবি।

মুখে মুখে কথার জবাব আনু কোনদিন দিতে পারে না। সেজ আপা শিখিয়ে দিলেও তা আর বলা হয় না।

মাস্টার সাহেবের কাছে পড়ছিল আনু। তিনি বললেন, আজ তোমার কী হয়েছে?

কিছু না।

তো পড়ছ না কেন?

বারে, পড়ছি তো।

বলে আনু মন দেয় বইয়ের পৃষ্ঠায়। এবার সত্যি সত্যি মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকে সে। আর মাস্টার সাহেব তার কলেজের বই খুলে নিজেও পড়ছেন। আনুর খুব ভালো লাগে মাস্টার। সাহেবকে। রোজ সকালে সাড়ে নটার ট্রেনে রংপুর যান কলেজ করতে। আবার ফিরে আসেন সন্ধ্যায়। বাবার কাছে সে শুনেছে, মাস্টার সাহেব নাকি খুব গরিব, কষ্ট করে যারা লেখাপড়া করে তারা অনেক বড় হয়। আনু খুব খুশি হবে, যেদিন মাস্টার সাহেব পাশ করে খুব বড় চাকরি করবেন।

আনুকে একটুও বকেন না মাস্টার সাহেব। বাড়িতে থাকলেও মনে হয় বাড়িতে নেই। একটুও সাড়া পাওয়া যায় না। বাইরের ঘরে চুপচাপ পড়ে থাকেন। আনুকে কত অদ্ভুত সব ছবি এনে দেন, বিলিতি ছবি, কাগজ থেকে কাটা ছবি। আনুকে একটা খাতা করে দিয়েছেন; সেই খাতায় ছবিগুলো সেঁটে রাখে আনু। অবসর সময়ে বসে বসে দেখে। কত দেশের ছবি, গম ক্ষেতের ছবি, হ্রদের ছবি, পাহাড়–পর্বতের ছবি। পাহাড় দেখতে এত ভালো লাগে আনুর প্রথম যেদিন ধরলার পাড়ে ভোর বেলায় বাবার সঙ্গে সে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখল, রোদে এক মুহূর্তের জন্যে ঝলমল করে উঠেই আবার নীল হয় চূড়াটা, আনুর মনে হলো জেগে জেগে এক অপূর্ব রঙিন স্বপ্ন দেখছে সে।

বড় আপা ভেতর থেকে দরোজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আনুকে ফিসফিস করে জিগ্যেস করলেন, মাস্টার সাহেবকে ভাত দেব নাকি জিগ্যেস কর।

মাস্টার সাহেব হঠাৎ কেমন চঞ্চল হয়ে উঠলেন। তাড়াতাড়ি বললেন, আজ ছুটি। ঈদে মিলাদুন্নবী। কলেজ নেই আমার।

তাই তো! আনুরও মনে ছিল না, আজ তার স্কুলও বন্ধ। বড় আপা আরো এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলেন তখন। মাস্টার সাহেব এতক্ষণ বইয়ের পাতায় মনোযোগ রেখেছিলেন, চোখ তুলে খুব ঝরঝরে গলায় বললেন, পড়ো আনু পড়ো। সময় নষ্ট করতে নেই।

বাবা চলে গেলেন বেলা দশটা নাগাদ। যাবার সময় আজ আনুকে ডেকে আস্ত একটা সিকি দিয়ে গেছেন। সিকি! অন্যদিন হলে বাসার সবাইকে একবার করে না দেখিয়ে ছাড়ত না। আজ তার সেই যে মনটা ম্লান হয়ে গেছে সকাল বেলায় আর কিছু ভালো লাগছে না। আজ সে সিকিটা পেয়ে চকোলেটের দোকান থেকে দুটো চকোলেট কিনে ফিরে এলো।

বাসায় এসে বিছানায় শুয়ে শুয়ে চুষতে লাগল চকোলেট। ভাবল, তাকে অবহেলায় শুয়ে থাকতে দেখে সবাই এসে আদর করবে! কিন্তু কেউ তাকে তাকিয়েও দেখল না। তখন অভিমান হলো আরো। তার চোখের সামনে দেয়ালটা শাদা—বাঁশ ছেচে তার ওপর সিমেন্টের পলাস্তরা করে চুনকাম করে দিয়েছে। একেক জায়গায় ভেঙে বাঁশ বেরিয়ে পড়েছে। ভারী বিশ্রী লাগছে; আনু উঠে দাঁড়াল। পেন্সিল নিয়ে দেয়ালে, তার পড়ার টেবিলের ওপরে একটা হাঁস আঁকলো। তারপর পাশে বড় বড় করে লিখল আর্লি টু বেড আর্লি টু রাইজ, মেস ম্যান হ্যাঁপি অ্যান্ড ওয়াইজ। লিখতে লিখতে ক্ষয়ে গেল পেন্সিলটা। তাতে কী? আনুর এখনো তিন আনা আছে, সে নতুন একটা পেন্সিল কিনে নেবে।

বড় আপা এ ঘরে এলেন। আনু বলল, একটা জিনিস খাবি আপা?

কিরে?

মুঠো করে চকোলেটটা তার হাতে গুঁজে দেয় আনু। কেমন লজ্জা করে। বড় আপার মুখটা হাসিতে রাঙা হয়ে ওঠে। নিয়ে চলে যেতে চান তিনি। আনু তার আঁচল ধরে টানে।

বাইরে গেলে ওরা সবাই দেখবে। আমার কাছে যে আর নেই।

আচ্ছা, আচ্ছা।

চৌকির কোনায় বসে বড় আপা মোড়কট খুলে মুখে পুরে দেন। চুষতে গিয়ে বুড়িদের মনে গাল বসে যায় তার। আনু হাসে। বড় আপা বলেন, খুব মিষ্টিরে! তুই খেয়েছিস?

ভাই বোনদের ভেতরে আনু সবচে ভালোবাসে বড় আপাকে। ওর মনে হয়, ওর মতো তাকে কেউ এত ভালোবাসে নি। আনু শুনেছে, ও যখন কোলে, তখনই বড় আপার স্কুলের লেখাপড়া শেষ হয়ে গেছে। তারপর কত জায়গা থেকে বিয়ে এসেছে বড় আপার, কিন্তু কোনটাই বাবার পছন্দ হয় নি। মনের মতো কাউকেই খুঁজে পাননি তিনি। আর যাদের পছন্দ হয়, তাদের সাথে বিয়ে দিতে অনেক টাকা লাগে। অত টাকা কোথায় পাবেন বাবা? তার বাবার যে টাকা নেই—-এই কথাটা আনু সেই ছোটবেলা থেকে উঠতে বসতে শুনে এসেছে। সেই ছোটবেলা থেকে টাকার প্রতি এক দুর্বোধ্য রহস্যবোধ শেকড় গেড়ে বসেছে আনুর মনে। আলীবাবার গল্পে যখন গুহার দরোজা খুলে যায় আর ঝলমল করে লক্ষ লক্ষ হীরে মণি মুক্তো চুণী পান্না, শুনতে শুনতে আনুর চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে যেত। তার মনে হতো, সে নিজেই যেন সেই গরিব কাঠুরে আলীবাবা। মনে হতো, সে যদি ও–রকম একটা গুহার সন্ধান পেয়ে যেত কোনদিন! তাহলে কী মজাটাই হতো। কার কাছে যেন শুনেছিল, অনেক সময় গাছের কোটরে বুড়ো বুড়ো বটগাছের শেকড়ের ফাঁকে গর্তের মধ্যেও মণি মুক্তো লুকোনো থাকে। কতদিন সে কত গাছের কোটরে উঁকি দিয়ে দেখেছে। একদিন হয়ত পেয়েই যাবে আনু। সেদিন মা আর মুখ কালো করে থাকবেন না, বাবার আর থানায় চাকরি। করতে হবে না, তাদের আর কোনো কষ্টই থাকবে না। একরাতে আনু স্বপ্ন দেখেছিল উঠোন ভর্তি ছড়ানো রাশি রাশি নতুন টাকা, আর তার ওপরে মজা করে লাফাচ্ছে আনু, টাকাগুলো মুঠো ভরে তুলছে, ঢেলে ফেলছে, টুং টুং শব্দ উঠছে মিষ্টি বাজনার মতো।

আনু বুঝতেই পারে না বাবা মা কেন এত অস্থির হয়ে উঠেছেন বড় আপা মেজ আপা সেজ আপার বিয়ে দেবার জন্যে। সবার কাছে সে শোনে, ছোট দারোগার বউ বলে, পিন্টু বলে, কোর্ট দারোগার বুড়ি ফুপু বলে। এত বড় বড় সব মেয়ে। এদের ঘরে রাখে নাকি? ঘরে রাখলে মুখে কালি দেবে একদিন। আনু ভাবতে পারে না, মুখে কালি দেবে কী করে তার আপারা? তার বিশ্বাসই হয় না, না বলে না কয়ে তার বড় আপা কারো সাথে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবে। গা শিরশির করে ওঠে আনুর। সেদিন ছোট দারোগাদের বাড়িতে তার ব্যাট বল গিয়ে পড়েছিল। সেইটে আনতে গেছে, তাকে ধরে ফেললেন ছোট দারোগার বৌ।  আদর করে বসালেন। আনু উসখুস করছিল, তার খেলা দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বৌটাকে তার একেবারে পছন্দ না। মাকে সারাক্ষণ কী সব বলে আর মা-র মুখ আঁধার হয়ে যায়। আনুকে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মাস্টার সাহেবের কথা জিগ্যেস করলেন। তারপর হাতে একটা। কাউনের মিষ্টি মোয়া দিয়ে শুধোলেন, তার বড় আপার সঙ্গে মাস্টার সাহেব হেসে হেসে কথা। বলে কিনা, একলা ঘরে দেখা হয় নাকি, মাস্টার সাহেব সারাদিন বাড়ি ছেড়ে একদণ্ড বাইরে যায় না কেন? এই সব। আনু প্রত্যেকটা কথার বিরুদ্ধে সজোরে মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করে। তখন ছোট দারোগার বৌ তার গালে ঠোনা দিয়ে বলেন, আরে, সেদিন আমি দেখলাম মাস্টার তোর আপার হাত ধরে আছে। তুই না ভাই? তুই ধরতে পারিস না?

আনু অবাক হয়ে যায়। সত্যি দেখেছে নাকি বৌটা? সত্যি বড় আপার হাত ধরে ছিল মাস্টার সাহেব? আনুর চোখ ছলছল করে ওঠে। ফাঁদে পড়া পাখির মতো ছটফট করে সে। মাথা নেড়ে বলে, যাঃ। মাস্টার সাহেব কত ভালো।

সেইজন্যেই তো তোর বাবা নিজে খেতে পায় না, আবার বাড়িতে পর পুরুষ যোয়ান ছেলে এনে পুষছে।

তারপর তার হাতে আরো দুটো মায়া গুঁজে দিয়ে সাবধান করে দেন ছোট দারোগার বউ, খবরদার, কাউকে বলবি না, আমি কী বললাম। বুঝলি? তোর মাকেও না। আমি বাবা। তোদের সাতে–পাঁচে থাকতে চাই না। আমার মন পরিষ্কার। তাই পেটের কথা বলে ফেলি। আর বলব না বাবা, তওবা, তওবা। যাহ্।

এক দৌড়ে বেরিয়ে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে আনু। কিন্তু খেলায় আর মন বসে না। তার দেরি দেখে ছেলেরা খুব ক্ষেপে গেছে। তাদের হাতে বল–ব্যাট সব ছেড়ে দিয়ে সে চুপ করে পথের। ধারে কালভার্টের ওপর বসে থাকে। আজ হাটবার। হাটের দিকে তোক যাচ্ছে, বাকে করে আলু–পটল চালের বস্তা নিয়ে, কুমড়ো কাঁধে ঝুলিয়ে, মুরগিগুলো ঠ্যাং জড়ো করে বেঁধে। আবার সরষের তেল যাচ্ছে ভাড়ে করে। থানার কাছে অফিসার জলচৌকি পেতে বসেছে। সেখানে সব তেলওলা এসে ভঁড় রাখছে আর তাদের তেল খাঁটি কিনা পরখ করে দেখছে অফিসারটা। একেকজনের কাছ থেকে এক পো আধসের তেল আবার তুলে রাখছে আলাদা একটা টিনে। হাত জোড় করে মাফ চাইছে একজন।

আনুর মনে পড়ে যায়, পয়লা দিন দেখেই মেজ আপা না সেজ আপা বলেছিল বেশ্যার মতো। হোক খারাপ কথা, ঠিক বলেছে। ছোট দারোগার বউ তাছাড়া কি? কী বিচ্ছিরি কথা বলে আর পি পিচ্ করে হাসে। আবার রাতে একেকদিন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গায়। চেরা গলা, একটুও মিষ্টি লাগে না শুনতে, তার কত ঢং। একটা কথাই বারবার করে ঘুরে ফিরে গায়—-প্রিয়, মধুরাতে সাজিল মন। গানের আওয়াজ পেলেই বাবা কেমন অস্থির হয়ে ওঠেন। আনুকে বলেন, ঘুমো, ঘুমোসনি কেন?

আনু ভাবে, দূর ছাই, তারচে বিয়ে হয়ে যাক তার আপাদের। তাহলে খুব শিক্ষা হয় সবার। কেউ আর কিছু বলতে পারবে না তখন আনুকে। তখন আনু সবার সামনে বুক ফুলিয়ে যাবে। তখন কেউ কিছু বললে আর ছেড়ে দেবে না আনু। ইয়াসিনের কাছে চমৎকার কুস্তি সে শিখে নিয়েছে। তখন আর কেউ কিছু বলতেই সাহস পাবে না আনুকে।

কিন্তু বিয়ে দিতে গেলে যে অনেক টাকা লাগে। এত টাকা কোথায় পাবেন বাবা? চাচার কাছে গিয়েছিলেন, চাচাও ফিরিয়ে দিলেন খালি হাতে। ফিরে এসে বাবা কী রাগ করলেন মা–র ওপর! তারপর নিজেই বললেন, নাহ, তোমার আর দোষ কি?

সেদিন আপারা ভয়ে লজ্জায় কেউ আর বাবার সামনে আসেননি।

কদিন আগে মহিমপুর থেকেই দুটো বিয়ের কথা এলো বড় আপা মেজ আপার জন্যে। একজনের একটা সাইকেলের দোকান আছে। আনু ইস্টিশানের কাছে তার দোকানটা দেখেছে, আর একজন টাউন ক্লাবের লাইব্রেরিয়ান, বাড়িতে নাকি বিস্তর ধানের জমি আছে। মেজ আপা আই. এ. পরীক্ষা দেবে প্রাইভেটে সামনের বছর, পড়াশোনার খুব শখ ওর। বিয়ের কথা শুনে কেঁদে সারা হলো। বড় আপার কিন্তু কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেল না। আগের মতোই রানা নিয়ে ব্যস্ত, উঠোন ঝাড় দিচ্ছেন, বিছানা পাতছেন বিকেল বেলায়। যেন তার নয়, অন্য কারো বিয়ের কথা চলছে।

সাইকেলের দোকানটা দেখেছে আনু। ঝকঝকে দুটো নতুন সাইকেল রাখা, শো–কেসে পার্টস সাজানো আর সামনে মেরামতি হয়। লোকটা ভারী ফুলবাবু। ফিনফিনে জামা গায়ে সারাক্ষণ আশেপাশের দোকানে বসে আড্ডা মারছে। আবার ট্রেন এলে খামকা প্ল্যাটফরমে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। কী যেন খোঁজে, চারদিকে পাতিপাতি করে দেখে ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট ঝুলিয়ে। আবার ফিরে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দোকানে গেলাশে চা খায়। আবার লাইব্রেরিয়ান ভদ্রলোকটি রোজ বিকেলে টাউনক্লাবের দরোজা খোলেন কোথা থেকে হাঁটতে হাঁটতে এসে। দারোয়ান ঘর ঝাড় দেয়। হ্যাঁজাকটা বার করেন তিনি। তেল ভরে দিলে নিজ হাতে জ্বালান। রেডিওটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গান ধরেন! আনু মাঝে মাঝে রেডিওর গান শুনতে আসে এখানে। লোকটা যা কালো আর মোটা। মুটা সেই আন্দাজে কচি, একেবারে দশবারো বছরের ছেলের মতো! হাসি পায় দেখলে। এদের সঙ্গে বিয়ে হবে নাকি আপাদের? মা-র কিন্তু একটু পছন্দই হয়েছে।

সেদিন অনেক রাতে কি করে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় আনুর। চারদিকে অন্ধকার থইথই করছে। প্রথমে ভয় পেয়ে আতকে উঠেছিল আনু, কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছিল। তারপরেই ফিরে এসেছে সাহসটা। বাবার গলা শোনা যাচ্ছে। বাবার বিছানার পাশে এসে বসেছেন মা। পান খাচ্ছেন বুঝি। কুটকুট করে সুপুরি ভাঙার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বাবা মাকে বলছেন, না তা হয় না। ঐ অপদার্থ দুটোর সাথে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেয়ে পানিতে ফেলে দেওয়া ঢের ভালো। বুঝেছ?

মা আহত স্বরে বললেন, কত তুমি জামাই আনছো রোজ! এক পয়সা দাবি নাই, বাড়ির অবস্থা ভালো, আর কি চাও? এক সাথে দুই কাজ হতো, ঝামেলা কত কম।

বাবা সে সব কিছুই শুনলেন না। বললেন,তার চে মেয়েদের গলা টিপে মারবো। কী বংশ কী লেখাপড়া—-সবদিক থেকে দেখবে না তুমি?

বাবার এমন কঠিন কণ্ঠস্বর আনু কোনদিন শুনেছে বলে মনে পড়ল না। অন্ধকারে তার গাও ছমছম করে উঠল। পাত্র দুটো যে বাবার পছন্দ হয়নি, এত খুশি হয়েছে আনু—-কিন্তু সে খুশিটাও কেমন যেন ভয়ের মতো দলা পাকিয়ে শক্ত হয়ে রইলো তার বুকের ভেতরে। মা অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর এক সময়ে বললেন, এতগুলো টাকা ঢালতে পারবে না, কোন্ জজ ম্যাজিস্টার এসে তোমার জামাই হবে তুমিই জানো।

আহা, ওদের ভালো ঘরে বিয়ে দিতে হবে তো? তোমার বড় ছেলে সে তো লেখাপড়াই করলো না। অন্তত জামাই নিয়ে যদি দশজনের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারো, তাও তো বংশের নাম থাকে।

বাবার কণ্ঠস্বর অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে। একটু যেন বিষণও শোনাচ্ছে। যেন নিজেকেই কথাগুলো বলছেন বাবা। বললেন, টাকারই যুগ পড়েছে এখন। আমাদের ছোটবেলায় দেখতাম লোকে অমুক বাড়ির ছেলে বলে পরিচয় দিলে আর কিছু লাগত না। তা আমি কি আর ম্যাজিক জানি যে তুড়ি দিলেই টাকা আসবে? অধর্ম করবো না বলেই তো নইলে তুড়ি দিলেও টাকা আসে। একেকটা এমনও কেস আসে, সুযোগ তো কত হয়েছিল, পাঁচ দশ হাজার হাতে গুঁজে দিয়ে যায়। নিলেই হয়। কিন্তু আল্লাহর কাছে জবাব দেব কী? আল্লাহ্ যখন হাশরের মাঠে ডেকে জিগ্যেস করবেন—-গোলাম হোসেন, তোমাকে দিলাম জুলুম আর অন্যায় থেকে মানুষকে রক্ষা করতে, তুমি তারই গোলাম হয়ে গেলে? কী জবাব দেব তখন বলো? এও আল্লাহর এক পরীক্ষা আনুর মা।

 মা হঠাৎ নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে কেঁদে ফেললেন। তার কান্নাবিকৃত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, তুমি তো আর বাসায় থাকো না। তুমি পেটেও ধরো নি। দিন রাত্তির পাড়াপড়শির কথা শুনতে কেমন লাগে তা তুমি বুঝবে কী করে?

শুনে আনুর মনটা হু–হুঁ করে উঠল। কান্না পেল। চলচ্ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠল আপাদের চেহারা, ঘোট দারোগার বৌয়ের পিচপিচে হাসি, চাচার মুখ, সাইকেলের দোকান, টাউনক্লাবের রেডিওটা। টাকা তো দিতে চায় লোকে, কেন নিতে চায় না বাবা? কী হয় নিলে? বাবার ওপর ভীষণ আক্রোশ হতে থাকে তার। আল্লাহ্ যখন জিগ্যেস করবে তখন আল্লাহ্ কী বুঝবে না দরকার ছিল খুব তাই নিয়েছে বাবা। আল্লাহ্ সব জানে। তবু বাবা কেন জেদ করে থাকে? বাবা কি! ধর্ম আর অধর্ম কথা দুটো কতবার বাবার মুখে শুনেছে সে; ভালো করে প্রসঙ্গ বোঝেনি, অর্থ স্পষ্ট হয়নি, কিন্তু এতটুকু বুঝতে পেরেছে আনু, যে একটা শক্ত দড়িতে তারা অসহায়ের মতো বাঁধা পড়ে গেছে। বালিশে মুখ গুঁজে আনু ভাবে আমি যখন বড় হব, আমি কিছু মানবো না, কিছু শুনবো না।

ঘুম থেকে উঠে দেখে বেলা অনেক হয়ে গেছে। ফুল কুড়োবার জন্যে সালু আপা তাকে ডেকে ডেকে একাই চলে গেছে কখন। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আনু দেখতে পেল একে একে সবাইকে—-মা, বাবা, বড় আপা, মেজ আপা, সেজ আপা, মিনু আপা, ছোট আপা। তবু সবাইকে কেমন নতুন আর অচেনা মনে হলো আনুর। মনে হলো, কাউকে সে কোনদিনই চিনতো না। মনে হলো, যেন সবাই অন্য বাড়ি থেকে বেড়াতে এসেছে।

বাবা নেই, বাসাটা তাই বড় খালি খালি ঠেকছে। দুধ নেবে গো সেই কখন হেঁকে গেছে, আকাশে গড়িয়ে পড়েছে দুপুর, বড় বড় গাছের ছায়াগুলো ক্রমেই লম্বা হয়ে আসছে আর আনুদের বাসাটা যেন আরো একেলা হয়ে যাচ্ছে। বাসার কাছেই থানা বলে প্রায় দুপুরবেলাতেই বাবা আসতেন একটু চোখ বুজতে। কিন্তু আজ তো বাবা নেই। বাবা গেছেন মফস্বলে। মা আপারা শোবার ঘরে কেউ শুয়ে কেউ মেঝেয় বসে গল্প করছেন, উল বুনছেন।

আনু হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিল ইস্টিশানে। একা একা বসে ছিল গোডাউন শেডে পাটের বেলের ওপর। সেখানেও ভালো লাগল না তার। তখন আবার ফিরে এলো বাসায়।

বাইরের ঘরে এসে ঢুকতেই মাস্টার সাহেব বিছানা ছেড়ে উঠে বসে বললেন, আনু, তোমাদের একটা চিঠি এসেছে এইমাত্র। ওই তো টেবিলের ওপর দ্যাখো।

আনু চিঠিখানা হাতে নিয়ে জিগ্যেস করে, কার চিঠি মাস্টার সাহেব?

কী জানি।

আনু তাকিয়ে দেখে খামের ওপরে লেখা ফ্রম পানু, ঢাকা।

পানু, পানু ভাই! ঢাকা থেকে লিখেছেন! একদৌড়ে চিঠিখানা নিয়ে আনু ভেতরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, মা, মা, বড় আপা, পানু ভাইয়ের চিঠি এসেছে।

বড় আপা তাড়াতাড়ি খাম ছিঁড়ে চিঠিখানা বার করলেন। আর সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে গোল হয়ে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইলো। তিনি দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলেন একবার, তারপর হেসে ফেললেন। তখন সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল বড় আপার নিঃশব্দ হাসিটা। বললেন, মা, ভাইয়া চাকরি পেয়েছেন।

 চাকরি!

সবাই সমস্বরে বলে উঠল।

হ্যাঁ, রেলের। অ্যাসিসট্যান্ট স্টেশন মাস্টার।

ধক করে উঠলো আনুর বুকের ভেতর। রেলের চাকরি! স্টেশন মাস্টার! আনু কি স্বপ্ন দেখছে। খপ করে সে চিঠিটা কেড়ে নিতে গেল, আমি আগে দেখি।

তুই কী দেখবি? ভাগ্‌।

সেজ আপা থাপ্পড় দিয়ে তার উদ্যত হাতটা ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু আজ রাগ করলো না আনু। বরং সে গোড়ালির ওপর খুশিতে এক পুরো চক্কর কেটে চেঁচিয়ে উঠল, হিপ হিপ হুররে।

সবাইকে চিঠিটা পড়ে শোনালেন বড় আপা। মাইনে ভালো। এবার ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসবেন। কার কী চাই যেন আগে থেকেই লিস্টি করে পাঠিয়ে দেয়। মা বাবাকে সালাম আর সবাইকে স্নেহাশীষ। ছোট্ট এতটুকুন। তবু কী খুশি একেকজন। বারবার পড়েও যেন ফুরুচ্ছে না। মা তো দুবার পড়েও যেন কোনো অর্থ উদ্ধার করতেই পারলেন না, এত খুশি হয়েছেন তিনি। বারবার বলছেন,

আমি কিছু দেখতে পারছি নারে। পানুকে বলব এবার আমাকে একটা চশমা করে দেয় যেন। একবর্ণ পড়তে পারি না।

পড়বেন কী করে? আনু দেখেনি বুঝি? মার চোখে পানি এসে গিয়েছে।

সালু আপা বলল, আমি এক বাক্স ডি-এম-সি সুতো আর এক ডজন সোনামুখি সুঁই।

মেজ আপা বড় আপাকে ঠেলা দিয়ে বললেন, তুই কী নিবিরে?

উত্তরে কিছুই বললেন না বড় আপা। শুধু ম্লান হাসলেন। আনুর এত খারাপ লাগে, বড় আপার একটুও শখ নেই। সারাদিন শুধু কাজ করবে, ছাই মাখাবে হাতে, মাথায় খড়ি পড়ে যাবে। যাকগে, তার কী? আনু নিজেই একটা চিঠি লিখবে। বলবে, আমার জন্যে একটা সত্যিকারের গার্ডের বাতি এনো পানু ভাই। আর তারপর হঠাৎ উদার হয়ে গেল মনটা। সে। আরো লিখে দেবে, বড় আপার জন্যে একটা খুব ভালো শাড়ি আনে যেন পানু ভাই।

ঘরে ঝোলানো একটা ছবি ছিল পানু ভাইর। মা সেদিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন। তাকে একেবারে নতুন দেখালো তখন। তখন যেন মনে পড়ল সবার। তখন সবাই ছবিটার দিকে তাকাল।

বাবা মফস্বল থেকে ফিরে এসে চিঠিখানা পড়লেন। চিঠিখানা আনু এ কদিন নিজের হেফাজতে রেখেছিল বাবাকে দেবে বলে। পকেটে করে ক্লাশেও নিয়ে গেছে। মুন্সেফের ছেলে দেবুর সঙ্গে খুব ভাব। দেবুকে দেখিয়েছে চিঠিটা। আর বলেছে, পানু ভাই তার জন্যে। গার্ডের বাতি নিয়ে আসবে। দেবু তাকে এখন থেকেই চীনেবাদাম খাইয়ে রাখছে, বাতিটা এলে একদিনের জন্যে সে খেলতে নেবে।

পড়া শেষ করে বাবা বললেন, যাক, পানুর তবে একটা হিল্লে হলো এবার, কি বলিস? আনু, তুমিও লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে আরো বড় চাকরি করবে। অনেক মাইনের। কেমন?

শুনে বোকার মতো হাসতে থাকে আনু। বাবা মনে করেন আনুর বিশ্বাস হচ্ছে না। তাই তিনি আবার বললেন, হ্যাঁ তাই তো। মিছে কথা কি বলছি? আনু তখন ম–স্ত বড়লোক, কত টাকা। কত কী। ঢুকতে দারোয়ানের কাছে নাম লেখাতে হবে। বলতে হবে আমি সিভিল সার্জনের কাছে যাবো।

বাবার বড় শখ আনু সিভিল সার্জন হয়। আনুকে বাবা একটানে নিজের হাটুর ওপর তুলে বসিয়ে দেন। পা দোলাতে থাকেন। আনুর ভারী লজ্জা করে। সে কি ছোট এখনো? বড় আপাকে দেখে আরো লজ্জা করে তার। বড় আপা বলেন, বাবা তুমি হাতমুখ ধোবে না? নামাজের বেলা যায়।

ওরে তাই তো। নাম তো বাবা। যাঃ।

আনুর পাছায় চটাস্ করে একটা মিষ্টি থাপড় লাগিয়ে দেন বাবা। তারপর কাপড় ছেড়ে ওজু করতে বসেন। মফস্বল থেকে পাকা পেপে এনেছেন বাবা। সেইগুলো কাটা হচ্ছে রান্নাঘরে। আনু একদৌড়ে সেখানে গিয়ে উবু হয়ে বসে। যেন একাই সে আজ সবগুলো খেয়ে ফেলবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *