০১. সারারাত যেন ঘুম আসে না আনুর

অচেনা – সৈয়দ শামসুল হক

সারারাত যেন ঘুম আসে না আনুর। ট্রেন কখন মহিমপুর পৌঁছুবে সেই ভাবনা তার। হুট করে স্টেশন আসে, ঘুরঘুটি অন্ধকারের মধ্যে প্ল্যাটফরমে ভূতের মতো মানুষগুলোকে ছুটোছুটি করতে দেখা যায়। একটা টেমি হাতে কে ডাকতে ডাকতে চলে যায়– চাচা, চাচাগো, কোথা থেকে যেন খট খট ঘটাং ঘটাং শব্দ উঠতে থাকে, আনু জিগ্যেস করে–হ্যাঁ বাবা এসে গেছি আমরা?

আরে না। তোর ঘুম নেই লক্ষ্মীছাড়া। ঘুমো।

কিন্তু আনু ভয় পায় না। বাবা অমন ধমক দিলেও সে শুয়ে পড়ে না। জানে বাবা ঐ রকমই, তাকে কিস্‌সু বলবেন না। সান্তাহারে তিনঘণ্টা বসে থাকবার পর যখন গাড়ি এলো, বাবা বলেছিলেন, এইবার আমরা এসে গেছি। সেই কথাটা শুনে অবধি আনুর ঘুম গেছে। নইলে তার আগে চমৎকার ঘুমোচ্ছিল সে মার পাশে ওয়েটিং রুমের বেঞ্চিতে। শোবার আগে বাবা মিষ্টি কিনে এনেছিলেন এক হাঁড়ি। দুটোর বেশি খেতে পারে নি।

ট্রেনে কিস্‌সু খেতে পারে না আনু। বাবার সঙ্গে কত জায়গায় ঘুরেছে সে। বাবার শুধু বদলির চাকরি। বদলিটা খুব পছন্দ আনুর, কেবল চাকরিটা একেবারেই ভালো লাগে না। কত ছেলের বাবা ডাক্তার, উকিল, সার্কল অফিসার, কত কী!–আর কেবল তার বাবাই কোথা থেকে বেছে বেছে দারোগা হয়েছেন। ছেলেরা ঠাট্টা করে; বলে–দারোগার ব্যাটা, পালা পালা, ধরে হাজতে নিয়ে যাবে। আনুব তখন জেদ হয় খুব। একেকবার ছেলেগুলোকে ধাওয়া করে; যেন সত্যি সত্যি ধরবে। কিন্তু একি; সবাই ভয় পাওয়া দূরে থাক, একটু দৌড়ে গিয়েই খিলখিল করে হাসতে থাকে। তখন আনু বুঝতে পারে, তার কোনো জোর নেই, কিছু নেই। সে একা।

একেকদিন বাড়িতে এসে ধুপধাপ করে এটা ফেলে, ওটা সরায়, পরে মার কাছে গিয়ে বলে মা, তুমি বাবাকে আর থানায় যেতে দিও না।

কেন রে?

মা অবাক হয়ে জিগ্যেস করেন কাঁধ থেকে ধোয়া ভিজে কাপড়গুলো তারে মেলে দিতে দিতে। একটা কাক খা-খা করতে থাকে রান্নাঘরের চালে বসে। পর মুহূর্তেই মা ভ্রূকুটি করে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন কাকটা। তিনি বোধহয় আনুর অবাক-করা কথাটা ভুলেই যান। আনু তখন হাতের কঞ্চিটা দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে বলে, হ্যাঁ মা দিও না। ডাক্তার সাহেবের বৌ বলে, দারোগার ছেলে খারাপ। লাট্টুকে আমার সঙ্গে মিশতে না করে দিয়েছে।

মা-র হাতটা থেমে যায়। একটু চুপ করে থাকেন তিনি। আনুর দিকে তাকিয়ে দেখেন। তারপর হেসে ফেলেন। তখন আনুর রাগ হয় খুব। বলে, না আমি শুনবো না। লাট্টুর মা বলে কেন?

বলুক গে তুই আর যাসনে। নে, কাপড়টা ধর।

আনু একগাদা কাপড় কোলে করে দাঁড়িয়ে থাকে। তখনও ঘ্যানঘ্যান করে, তুমি বাবাকে বলো কিন্তু মা। কত ছেলের বাবা কত ভালো চাকরি করে।

কিন্তু বদলিটা পছন্দ। কত দেশ দেখা যায়। ইস, কত জায়গায় গেছে আনু। একেকদিন ছেলেদের মধ্যে তার খাতির হয়ে যায় ভারী। তাদের সে গল্প শোনায়। নিজেকে বড় বাহাদুর মনে হয় তার। রেললাইনের পাশ দিয়ে আসবার সময় সে হয়তো ভয়ে ভয়ে বলেছে—-এই জঙ্গলে ভাই বাঘ থাকতে পারে। তখন আনু সগর্বে ঘোষণা করে, বাঘ এলে রেললাইন দিয়ে আমি দৌড়ুবো। একেবারে চলে যাবো নাটোর; আবার দৌড়ুবো, আবার রাজশাহী, আবার দৌড়ে দৌড়ে আদমদিঘী চলে আসবো—-বাঘ আমাকে ধরতেই পারবে না।

ছেলেরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। এক দৌড়ে যে এখান থেকে রাজশাহী যাওয়া যায় না, এখান থেকে অনেক দূর—- তা কারো খেয়াল হয় না। যেন সত্যি সত্যি আনু তা পারবে। তাদের চোখের সামনে ছায়াবাজির মতো অস্পষ্ট একেকটা শহরের ছবি ভেসে ওঠে। জলজলে রোদ, ঝিমঝিম দুপুর তারা কল্পনায় দেখতে পায়। বুনো পাখি ডাকছে করর ঠক্‌ করর ঠক্, গরুর গাড়ি যাচ্ছে ক্যাঁচ-ক্যাঁচ-ক্যাঁচ-ক্যাঁচ করতে করতে, কাঁচামিঠে আম ধরেছে বড় বড়—- আনুকে তাদের অন্যজগতের মানুষ মনে হয়।

আবার আরেকদিন হয়ত বিকেলে ঝিমিয়ে থাকা রেলস্টেশনে ওরা খেলতে আসে। সারা স্টেশন ফাঁকা। মিষ্টির দোকানগুলোর ঝাঁপ বন্ধ। গাড়ি একটা আসবে সেই রাত দশটায়। গুদামের পাশে কয়েকটা মালগাড়ি দাঁড়ানো। গুদামে পাটের বস্তা পাহাড়ের মতো উঁচু। ওজন করবার কলটা দেখতে যেন বিরাট বিদঘুটে একটা সেলাইয়ের মেশিন। দাঁড়ানো দুটো একটা এই রকম মালগাড়ি যেন পেটে কত দেশবিদেশের রহস্য পুরে চুপ করে আছে। আনু তাদের গায়ে খুব সন্তর্পণে হাত রাখে এত আস্তে, যেন ওগুলো একেকটা মানুষ। আদর করে। বানান করে করে পড়ে গায়ের লেখাগুলো–ই, বি, আর। রেলের গাড়িটার গায়ে লেখা নট টু বি লুজ শান্টেড। মানে বুঝতে পারে না। একটা মালগাড়ির গায়ে সাদা একটা চাকা বসানো—-যেমন মোটর গাড়িতে দেখা যায়। কেউ ওতে হাত দিতে গেছে হয়ত, লাফ দিয়ে তার হাত সরিয়ে দেয় আনু। উত্তেজনায় তার শরীর কাঁপতে থাকে। সে ছাড়া আর কেউ তো জানে না, ওটা হচ্ছে ব্রেকের চাকা। ঘোরালেই ব্রেক খুলে যাবে, গাড়ি তখন ছাড়া পেয়ে হুস্ হুস্ করে ছুটতে থাকবে, সান্তাহার পার্বতীপুর কোথায় চলে যাবে, কেউ থামাতে পারবে না। ছেলেরা অবাক হয়ে সাদা চাকাটা দেখে। কেউ বলে—- যাঃ, ইঞ্জিন না হলে যাবে কী করে? আনু জবাব দেয় গম্ভীর হয়ে, ইঞ্জিনই সব নাকি? বাবার সঙ্গে ইঞ্জিন ছাড়াও গাড়ি দেখেছি কত।

হবেও বা। আনু কত জায়গায় ঘুরেছে, কত দেখেছে, ওরা তো আর কোথাও যায়নি! আনুর তখন গর্ব হয় খুব। সঙ্গে সঙ্গে কেমন একটা নিস্পৃহতা জাগে তার ভিতরে। পরম উদাস কণ্ঠে সে বলে, জানিস আমরা এখান থেকেও চলে যাবো। বাবা খুব শীগগীর বদলি হবে।

কোথায় রে?

চট করে কোনো জায়গার নাম মনে পড়ে না আনুর। তার পানু ভাই থাকে ঢাকায়। ঢাকায় থেকে পড়ে। আনু এক মুহূর্ত ইতস্তত করে অবলীলাক্রমে বলে, ঢাকায়।

ইস। ঢাকা যাবি ভাই?

হ্যাঁ, না তো কী? দেখিস।

এবার আনুর বাবা বদলি হলো মহিমপুরে। বাঁধাছাঁদা করবার সময় বাবা মাকে বলেছিলেন, ছেলেমেয়েগুলোর কিছু লেখাপড়া হলো না। বছরের শেষে বদলি। না এখানে পরীক্ষা দিতে পারল, না ওখানে গিয়ে নতুন ক্লাশে ভর্তি হতে পারবে।

তিনি বড় বড় ছালার মধ্যে হাড়ি বাসন রুটি বেলবার বেলন, ভাঙা একটা বেতের বাক্স, আধমণ পেঁয়াজ ভরে চলেছেন। তাঁর হাতের আর কামাই নেই। বড় আপা সাহায্য করছে মা-কে। আর কারো দেখা নেই। না মেজ আপা, সালু আপা, ডালু আপা কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আর ওরা সব ওদের বন্ধুদের কাছে গেছে। চলে যাচ্ছে কিনা! গলা ধরে ধরে গল্প করছে।

বাবা লেখাপড়া নিয়ে দুঃখ করেছিলেন। কিন্তু আনু ভেবেই পায় না দুঃখ করবার কী আছে! খামকা তার মন খারাপ করে দিতে পারেন বাবা! কেন, পানু ভাই ঢাকায় পড়ছে। সে এবার ক্লাশ ফোরে পড়ছে। গত বছর সেকেণ্ড হয়েছিল না সে? মাস্টার মশাই বলছিলেন প্রাইজ দেবে আনুকে। তা এখান থেকে চলে গেলে, আর কে আসবে প্রাইজ নিতে? এতে যা একটু মন খারাপ হয় আনুর। আর বড় আপার তো পড়া শেষ হয়ে গেছে। তার বিয়ে হয়ে যাবে। বিয়ের জন্য বাবা কত চেষ্টা করছেন। হ্যাঁ, লেখাপড়া একেবারে করে না মেজ আপা। এত ফাজিল হয়েছে। খালি গল্প, গান আর পাড়া বেড়ানো। মাকে পর্যন্ত একটু কাজ করে দেয় না।

বাবা বলেন, আনু, হোন্ডলটার ওপর চেপে বসতো বাবু।

লাফিয়ে চড়ে বসে আনু। খুব করে জাততে থাকে। বাবা কষে টান লাগান চামড়ার স্ট্যাম্প ধরে। ঘামে তার মুখটা ভিজে ওঠে। বলেন, ভেতরে কটা বালিশ দিয়েছিস, অ্যাঁ?

সেই মহিমপুরে আসা।

ভোর বেলায় গাড়িতে উঠেছিল। কারু সঙ্গে দেখা হয়নি আনুর। ছেলেদের বলে দিয়েছিল ইস্টিশানে আসিস ভাই। কিন্তু স্টেশনে এসে তাদের মনে পড়ে নি। স্টেশনে এলেই আনু যেন অন্য মানুষ হয়ে যায়। সব কিছু ভুলে যায়। বুকের মধ্যে কেমন শিরশির দুপদুপ করতে থাকে। কোথাও যাবার জন্যে আনুর মনটা হুহু করে ওঠে। যেন এক মুহর্ত বসে থাকা যাবে না, থাকলে পৃথিবীর কত কী যেন সে আর দেখতে পাবে না; যেন পৃথিবী কোথাও একটা বিরাট মজাদার মেলা খুলে তাকে ডাকছে।

ধড়মড় করে উঠে বসলো আনু। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে গাড়িটা থেমে আছে। একটা ইস্টিশান। ভোরের আবছা আলোয় কেমন বৃষ্টি ধোয়া মনে হচ্ছে। দূরে একফালি ঘন বনের মাথায় জমেছে মিহি কুয়াশা। প্ল্যাটফরমে পোড়া কয়লা দেখাচ্ছে ভিজে ভিজে।

ওঠ, ওঠ, মহিমপুর এসে গেছে দ্যাখ।

বাবা তাকে একটানে পায়ের উপর দাঁড় করিয়ে দেন। তারপর গলা বাড়িয়ে চিৎকার করে কুলি ডাকেন। কিন্তু তার আগেই দুজন সেপাই এসে দাঁড়ায়। সালাম করে। আর একটু পরেই আসে আরেকজন। আনু তার পোশাক দেখে, মাথার টাক দেখে, গোঁফ দেখে, কেমন করে যেন বুঝতে পারে, এ হচ্ছে বড় জমাদার।

মেজ আপা আনুকে ডেকে ফিসফিস করে বলে, আমার আরেক জোড়া স্যাণ্ডেল কোন্ ট্রাঙ্কে আছে, জানিস ভাই?

আনু অবাক হয়ে তাকায়। বুঝতে পারে না। বলে, কেন?

দেখ না, এটার ফিতে ছিঁড়ে গেছে।

মা বুঝি শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি ঝামটা দিয়ে উঠলেন, এখন কে তোর স্যাণ্ডেল বার করবে?

বারে আমি যাবো কী করে?

খালি পায়ে যাবি। কে দেখতে আসছে তোকে?

কাঁদো কাঁদো হয়ে যায় যেন মেজ আপা।

বাবা নিচে নেমে গেছেন। সেখান থেকে দরোজা দিয়ে গলা বাড়িয়ে কী বলতে এসেছিলেন, মার কথা শুনে বললেন, আহা, আবার কি হলো?

মা তার জবাব না দিয়ে ঘোমটা টেনে দিলেন ভালো করে। এখন তাকে নামতে হবে। সবার আগে লাফ দিয়ে নামে আনু। সবাই যখন নেমে আসে আনু দেখে মেজ আপা সালু আপার স্যান্ডেল জোড়া পায়ে দিয়েছে। আর সালু আপার পা খালি।

একটা গরুর গাড়ি এসেছে। ওতে সব মালপত্র যাবে। আর এই টুকুন তো পথ। রেল লাইনের ধারে ধারে হেঁটে গেলে আধমাইলও নয়। হেঁটে যাবে সবাই। জমাদার সাহেব বললেন, নাকি স্যার, আরেকটা গাড়ি ডাকব? মেয়েরা রয়েছে।

না, না, তার দরকার হবে না। বরং দিব্যি একখানা মর্নিং ওয়াক হয়ে যাবে। কী বলিস? বলতে বলতে সবার উপরে স্মিত মুখ ঘুরিয়ে আনলেন বাবা। তারপর জমাদার সাহেবকে বললেন, তাহলে আমি বরং এখানেই ফজরের নামাজটা পড়ে নেই।

ঠিক তখন বেজে উঠলো গার্ডের বাঁশি। হুস হুস করে চলতে শুরু করল ট্রেন। ঝকঝক করে আঁধারের মধ্যে গাড়িটা দূরে মিলিয়ে যেতে লাগল। প্ল্যাটফরমে পড়ে রইলো ছড়ানো বাক্স প্যাটরা, সুপুরির বস্তা, পোস্টাফিসের ব্যাগ, মাছের বাক্স। আনু একেবারে প্ল্যাটফরমের শেষ মাথা পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে গেল বড় আপার সঙ্গে।

আনুর সবচেয়ে ভালো লাগে বড় আপাকে। সারাক্ষণ যেন কী ভাবে বড় আপা, যেন কত দুঃখ ওর মুখটা একেবারে কালো আর এইটুকু করে রাখে। আনুকে কোনদিন বকে না, মারে না, আনুর জিনিস নিয়ে কাড়াকাড়ি করে না। সারাক্ষণ বড় আপার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করে আনুর। আনু যখন বড় হবে, যখন তার নিজের বিরাট বাড়ি হবে, যখন তার অনেক টাকা হবে তখন বড় আপাকে সে অনেক কিছু বানিয়ে দেবে, তার সঙ্গে রাখবে। কতদিন ক্লাশে যখন পড়া ভালো লাগেনি, তখন মনে পড়ে গেছে বড় আপার কথা। বসে বসে আনু তখন স্বপ্ন দেখেছে বড় আপাকে নিয়ে। দেখেছে, আনু বড় হয়ে গেছে। বড় আপার মুখখানা হাসিতে খুশিতে ফর্সা লাল দেখাচ্ছে। কোনো কিছুর অভাব নেই। সবাই ওদের দিকে দেখিয়ে বলছে—-ওরা কত সুন্দর!

ফিরে এসে দেখে নামাজ শেষে মোনাজাত করছেন বাবা। ভোরের আলোয় তার মুখ এত শান্ত দেখাচ্ছে যেন একটা ছবি দেখছে আনু। বাবা মোনাজাত শেষ করেই দেখতে পেলেন আনুকে। উঠে আনুর মাথায় মুখে সেই হাত দুটো মাখিয়ে দিয়ে বললেন, চল।

ওরা স্টেশন ঘরের ভেতর দিয়ে বেরুলো না। ট্রেনটা যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকের লাইন ধরে হাঁটতে লাগল সবাই। বাবা গল্প করতে লাগলেন জমাদার সাহেবের সঙ্গে। পেছনে মা বড় আপা মেজ আপা সালু আপা ডালু আপা। আর একেবারে শেষে আনু। আনু এর মধ্যে ভাব করে ফেলেছে সেপাইয়ের সঙ্গে। একজন গেছে মালের সঙ্গে গরুর গাড়িতে। আরেকজন তাদের পেছনে চলেছে। আনু জিগ্যেস করে গম্ভীর গলায়, হাঁ সেপাই, তুমি এই থানায় কাজ করো?

জি খোকা বাবু।

কী নাম তোমার?

ইয়াসিন আছে।

তুমি বেহারি?

ভ্রু কুঁচকে আনু জিগ্যেস করে। কিন্তু ভারী মজা লাগে তার কথা বলবার ঢং। আর কী মোটা গোঁফ, দুটো আমপাতার মতো বড় বড়। ইয়াসিন হেসে ফেলে। আবার তেমন জোরে হাসে না, সামনে হুজুর যাচ্ছেন যে! গলা নামিয়ে বলে, হাঁ বেহারি তো আছি খোকাবাবু। ফিন বেহারি নাই। এখন বাঙ্গালি আছি আমি। এহি হামার মুলুক আছে।

তুমি ছাতু খাও?

ও ভি খাই তো। এখন তো মাছ খায় খোকাবাবু। আমি একরোজ পকায়ে দিব, আপনি খাবেন, মা ভি খাবেন, বোলবেন কী রকম কে কভি খায় নাই। হাঁ।

শুনে ডালু আপা খিলখিল করে হেসে উঠে। মার আঁচল টেনে বলে, মা দ্যাখো আনু সেপাইটার রান্না খাবে।

ওর তো খালি ঐ সব।

চলতে চলতে মা তাঁর বিরক্তি প্রকাশ করেন। আনু তখন খুব গম্ভীর হয়ে চলতে থাকে। পথ থেকে একটা কঞ্চি কুড়িয়ে নেয়। সেটা দিয়ে ভোরের শিশিরে ভিজে থাকা লজ্জাবতীর দল ছোঁয়। কেমন আস্তে বুজে আসে ওরা। আনু পিছিয়ে পড়ে সবার থেকে।

রেল লাইনের পাশে এত লজ্জাবতী যে বিস্ময়ে আনু সব কিছু ভুলে যায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে। একটাকে বোজায়, আবার আরেকটা অমনি রেখে দেয়। আর থানকুনি গাছ কত! পয়সার মতো গোল গোল পাতাগুলো থিরথির করে কাঁপছে ভোরের বাতাসে। এত থানকুনি গাছও একসঙ্গে আগে আর দেখেনি আনু। এখন ভাবনা কী? মা যদি ফোঁড়ার ওষুধ করতে চান তো আনু একদৌড়ে এক কোচড় থানকুনি এনে দিতে পারবে।

আনু, ও আনু।

বাবা সামনে থেকে ডাক দেন। অনেক পিছিয়ে পড়েছে সে। আনু দৌড়ে এসে বাবার হাত ধরে। বলে, কী বাবা?

জমাদার সাহেব বলেন, এই বুঝি আপনার ছোট ছেলে?

হ্যাঁ। ক্লাশ ফোরে পড়ছে। ভেরি শার্প অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্ট।

আনু বুঝতে পারে তার প্রশংসা করছেন বাবা। সে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। জমাদার সাহেব অকারণে নিঃশব্দে হাসতে থাকেন। বাবা বলেন, আর আমার ছোট মেয়ে মিনু, সে সঙ্গে নেই। ওদের মামা এসেছিল নিয়ে গেছে।

হাঁটতে হাঁটতে ডিস্ট্যান্ট সিগন্যালের কাছে এসে পড়েছে ওরা। সিগন্যালের পাশ দিয়ে ডানে রাস্তা নেবে গেছে। সেই রাস্তা ধরলো ওরা। রাস্তার দুপাশে পাতলা বাঁশ-বন। একটুখানি হাঁটতেই বড় রাস্তা এসে গেল। বড় রাস্তার ওপরেই থানা।

হালকা লাল রং। আবার ছাদের কাছে শাড়ির পাড়ের মতো নীল রেখা। তাইতে খেলনা বাড়ির মতো দেখাচ্ছে। সামনে শান বাঁধানো বিরাট বারান্দা। বারান্দার নিচে মাঠ। থানার বামে কোয়ার্টারগুলো। ওরা এসে দেখল গরুর গাড়িটা তখনো এসে পৌঁছয়নি।

থানা থেকে ছোট দারোগা সাহেব বেরিয়ে এলেন। এসে বাবাকে আদাব করলেন। তারপর সবাইকে নিয়ে গেলেন নিজের বাসায়।

আমার এখানেই ছেলেমেয়েরা নাশতা করে নিক স্যার। একটু আরাম করুক।

বাবা তার সঙ্গে চলে গেলেন থানা দেখতে।

কোনো নতুন বাড়ির ভেতরে এলে আনু একেবারে চুপসে যায়। দারোগার বৌ সবাইকে বসতে দিলেন ঘরে। আনু চুপ করে এককোণে মায়ের পাশে চোখ নামিয়ে বসে রইলো। মা বললেন, মেয়েরা হাতমুখ ধোবে ভাই।

যাক না, কুয়োতলায় পানি তোলাই আছে। যাও তোমরা।

ছোট দারোগার বৌ আঙ্গুল তুলে পথ দেখিয়ে দিলেন। মা বললেন, আনু, যা না সঙ্গে।

আনু যেন বেঁচে গেল। একলাফে বাইরে এসে দাঁড়ালো সে। তার পরে এলো বড় আপা ওরা।

কুয়োতলায় উবু হয়ে বসে দাঁত মাজতে মাজতে মেজ আপা হিহি করে হাসতে হাসতে সেজ আপাকে বলল, ছোট দারোগার বৌ এত গয়না পরেছে কেন রে?

সেজ আপা গলা নিচু করে বলে, তবু আনু শুনতে পায়।

ঠিক বেশ্যাদের মতো দেখতে। ম্যাগো!

বড় আপা ঘুরে তাকাতেই চুপ হয়ে যায় ওরা। বড় আপা এবার আনুকে দেখেন। আনু জানে, ওটা খারাপ কথা শুনতে নেই। সে যেন আদৌ শোনেনি এ রকম মুখ করে একটা ডাল দিয়ে কষে দাঁতন করে চলে। কানে তার আবার ভেসে আসে মেজ আপার হি-হি। কি যে, খালি হাসতে পারে মেয়েটা! যখন ছোট দারোগার বৌ আসেন তাদের নাশতার জন্যে ডাকতে, সবাই পেটে হাসি চেপে মুখ কাঠ করে রাখে।

তা গয়না গায়ে একটু তার বেশিই। বোধ হয় ওদের অনেক টাকা, মনে মনে ভাবল আনু। তার বাবার মতো যে সবাই নয়, এটা অনেক দিন আগেই সে বুঝেছে। কিন্তু তার জন্যে একটুও রাগ হয় না বাবার ওপর, বরং কেমন মায়া করে। মনে হয়, সে যখন অনেক বড় হবে, অনেক টাকা রোজগার করবে, তখন বাবাকে এনে দেবে। বাবা সবাইকে গয়না বানিয়ে দেবেন, গাড়ি কিনবে আনু, আর নতুন জুতো। ট্রেনে করে কত দূরে দূরে যাবে আনু। জংশনে গিয়ে ছবি দেখে আসবে। একবার পানু ভাইয়ের সঙ্গে ছবি দেখতে গিয়েছিল সে। তার মতো একটা ছোট ছেলে ছিল ছবিতে। কী চমৎকার ঘোড়ার পিঠে চড়ে সে কাঁহা কাঁহা যাচ্ছিল।

নাশতা শেষে বাবা এসে নিয়ে গেলেন ওদের কোয়ার্টারে। গেটের সামনে গরুর গাড়ি উপুড় হয়ে আছে ল্যাজ তুলে। গরু দুটো ঘাস খাচ্ছে। আর সেপাইরা ট্রাঙ্ক বিছানা বাক্স টেনে নিয়ে যাচ্ছে ভেতরে।

বাড়ির গন্ধটা ভারী পছন্দ হয় আনুর। ভেতরে ঢুকতেই মনটা ভুরভুর করে ওঠে তার। একটা নিম গাছ বড় হয়ে উঠেছে রান্না ঘরের পেছনে, আর বাড়িতে ঢুকবার মুখেই লেবুগাছ। গন্ধটা বুঝি লেবু পাতার। আনু নাক তুলে ঠাহর করবার চেষ্টা করে। বাবা বলেন, আনু শীগগির যা ভেতরে। তোর জায়গা পছন্দ করে নে। নইলে ওরা সব ভালো জায়গা নিয়ে নেবে দেখিস। আরে তাই তো! বাবা হাসতে হাসতে ওকে নিয়ে আসেন ভেতরে। হাঁক পেড়ে বলেন, কিরে ডালুসালু তোরা আনুকে কোথায় জায়গা দিলি? ও যে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। তখন কি একটা কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। আপারা এঘর ওঘর ছুটোছুটি করতে থাকে। সালু আপা একটা জানালার শিক ধরে চেঁচিয়ে ওঠে নাচতে নাচতে।

আমি এইখানে থাকব। এখানে থাকব।

 বাসাটা ছোট। একটা বড় ঘর, রান্নাঘর আর বাইরে ছোট্ট একটা ঘর—এই। উঠোনটা খুব বড়। রান্নাঘরের সামনে আগে যারা ছিল তারা গাঁদা ফুল লাগিয়েছিল। কদিনের অযত্নে মলিন হয়ে গেছে। টুকরো কাগজ, ন্যাকড়া, দেশলাইয়ের কাঠিতে গাছের তলা নোংরা হয়ে আছে। জালি বেড়ায় ভাংগন ধরেছে এর মধ্যেই। লেবুগাছটায় লেবু নেই একটাও। পাড়ার বখাটে ছেলেরা হয়ত পেড়ে নিয়ে গেছে। মিষ্টি একটা ঘ্রাণ শুধু পাতা থেকে পাওয়া যাচ্ছে ভেতরে। ঢুকেই আনু যা প্রথমে টের পেয়েছিল।

গাছপালার ঘ্রাণ ওর ভারী ভালো লাগে। এর আগে যেখানে ছিল, জায়গাটা এত শুকনো আর বালু বালু যেখানে কোন গাছ হতে চায় না। আর যে দুএকটা গাছ ছিল তাও এত নিরস আর ধুলো মলিন যে মনটা খারাপ হয়ে যায়। সারাদিন কেবল রোদ আর রোদের হলকা। সে হলকায় দশ হাত দূরের জিনিস সুম সুম করে কাঁপতে থাকে, যেন আয়নার মধ্যে একটা ছবি অবিরাম কাঁপছে। সে জায়গায় শুধু তরমুজ, ফুটি আর খরমুজ কাকুড় হতো। গাঁয়ের মানুষেরা একেক দিন এনে দিয়ে যেত এই এত এত। কচকচ করে চিবোতো সে লম্বা কাকুড়গুলো। তরমুজগুলো কুয়োর মধ্যে ফেলে রাখত ঠাণ্ডা হবে বলে। ঠাণ্ডা হলে দুপুর বেলায় বালতি দিয়ে তুলে এনে কাটা হতো।

বড় ঘরটার একদিকে বেড়ার পার্টিশন। ওপাশে ছোট্ট জায়গাটায় চৌকি পড়ল বাবার জন্যে আর আনুর জন্যে। আর এ পাশে থাকবে মা আর আপারা।

আনু তার ছোট্ট সুটকেশটা খুলে ফেলেছে। বইগুলো বার করে খবর কাগজ বিছিয়ে সাজিয়ে ফেলল টেবিলে। একটা বড় পোস্টার ছিল—তাতে অধিক খাদ্য ফলান লেখা, আর একদিকে ধান ভর্তি মাঠ, মাঠের পাশে গোলাঘর আর এক চাষী তার বৌ আর ছেলেমেয়েদের ছবি আঁকা—সারা ছবি চকচকে হলুদ রং-এ ভারী উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। সেই পোস্টারটা খুলে বেড়ার পার্টিশনের গায়ে লাগালো আনু। শুলে পর ঠিক তার চোখের সামনে থাকবে। এই ছবিটা এত ভালো লাগে তার! চাষীর বৌ আর ছেলেমেয়েদের সাদা হাসিগুলো দেখতে দেখতে তার মনটাও খুশি হয়ে ওঠে, যখনই সে তাকায়। লাগিয়ে, চৌকির ওপর বসে, ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো আনু।

বড় আপা কী বলতে এসেছিলেন, হঠাৎ থেমে, খুশি হয়ে উঠলেন।

বাহ্, তুই সব সাজিয়ে ফেলেছিস আনু!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *