মরশুমের একদিন

মরশুমের একদিন

আর আমরাই বুঝি ক্ষমা করব বিদ্রোহিনী বিশ্বাসঘাতিনী নারীকে। নিজের অন্তঃপুরে মায়ের মতো সম্মান দিয়ে রেখেছিলাম, তা তোমার ভাল লাগল না।

আচমকা এই নাটকীয় পরিচিত গলা শুনে স্টেজ, ড্রেস ও সিনের দোকান স্টেজ অ্যান্ড ড্রেস প্যারাডাইসের বিখ্যাত প্রোপ্রাইটর শ্রীযুক্ত চারুচন্দ্র চক্রবর্তী চমকে ফিরে দাঁড়ালেন। গলার স্বর শুনেই ভ্রূ কুঁচকে অভিনেতাকে আঁতিপাতি করে সারা ঘর খুঁজতে লাগলেন। টেবিলের তলা, আলমারির ফাঁকে, দরজার আড়ালে। নেই। কিন্তু ভোরবেলা গদিতে বসতে যাওয়ার মুহূর্তে লোকটা একী খেলা শুরু করল তার মনিবের সঙ্গে!…ভাবলেন, হয়তো উঠোনের গাদা করা মঞ্চের কাঠের ফ্রেমগুলোর পিছন থেকেই লোকটার স্বর শোনা যাচ্ছে। আর তাঁর সেই ভাবার মুহূর্তেই আবার সেই স্বর ধ্বনিত হল।

তুমি কি বুঝিবে নারী লুপ্ত গৌরবের শীর্ণ মহিমা, তুমি কি বুঝিবে উন্মুক্ত শিখার জ্বালা, তুমি কি বুঝিবে এই..

চক্রবর্তী বিস্মিত ক্রোধে লক্ষ করলেন তাঁর মরশুমের জন্য নতুন তৈরি ভেলভেটের স্ক্রিনটা ঘরের এক কোণে লুটোপুটি খাচ্ছে এবং গলার স্বরটা তার ভিতর থেকেই যাচ্ছে শোনা। একটানে তিনি সেটা খুলে ফেলতেই দেখা গেল তাঁর বিশিষ্ট কর্মচারি ড্রেসার ও পেন্টার নবীন চিত হয়ে শুয়ে। কপালে হাত ঠেকিয়ে মনিবকে নমস্কার করছে, পেন্নাম হই কর্তা।

রাগের চোটে চক্রবর্তী তাঁর সামনের নড়বড়ে দাঁতগুলো জিভ দিয়ে একদফা আন্দোলিত করে বললেন, কী বোঝাচ্ছ তুমি?

নবীন উঠে দাঁড়িয়ে বুকে হাত দিয়ে বলল, এই বুকের মর্মন্তুদ বেদনা। অর্থাৎ বলছে চাণক্য মূখ। নারী মুরা, চন্দ্রগুপ্তের মাতাকে। আর আগের কথাটা হচ্ছে

থাক! চক্রবর্তী দারুণ রোষে গর্জন করে উঠলেন।

হ্যাঁ, থাক। নির্বিকারভাবে কথাটি বলে নবীন জিজ্ঞেস করল, মোর পুত্ররত্ন কি গতকাল তার। পিতার সন্ধানে এসেছিল হুজুর?

খবরদার! আমি তোমার মনিব, সে-কথা ভুলে যেয়ো না বলে দিচ্ছি। চক্রবর্তী প্রায় হুমড়ি খেয়ে তার মান্ধাতার আমলের মেহগনি কাঠের মস্ত নড়বড়ে চেয়ারটার উপর গিয়ে পড়লেন।

তাড়াতাড়ি মুসলমানি ঢঙে আদাব করে বলল নবীন, বান্দাকে মাফ করবেন জাঁহাপনা!

সাবধান নবীন! এবার সত্যই চক্রবর্তী চেঁচিয়ে উঠলেন।

নবীন চকিতে প্রায় সামরিক কায়দায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল। লোকে বলে ব্রহ্মা নাকি নিজের হাতে গড়েছিলেন নবীনকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত এমন নিখুঁত ও সুপুরুষ বুঝি কমই দেখা যায়। গায়ের বর্ণ যাকে বলে দুধে-আলতায়। এক সময়ে ওই চেহারায় ছিল কী জেল্লা আর যেন পাথরে খোদা মূর্তির মতো। লোকে বলে, হতচ্ছাড়া নষ্টামো করে চেহারাটা খেয়েছে। তার ওই কালো বিশাল চোখ দিয়ে বিশ্বজয় করতে পারার ইঙ্গিতও করেছে কেউ কেউ।

তার দিকে তাকিয়ে চক্রবর্তীর নিষ্ঠুর মুখের রেখাগুলো মিলিয়ে আসছিল। চেহারাটায় জাদু আছে ছোঁড়ার। কিন্তু স্ক্রিনটার দিকে চোখ পড়তেই টেবিলটার উপর দড়াম করে এক ঘুষি কষিয়ে বললেন, তুমি আমার ব্যবসা চালাতে দেবে কি না।

তা নইলে আমার চলবে কী করে?

তবে নতুন স্ক্রিনটা কোন্ আক্কেলে তুমি মাটিতে পেতেছ?

কাল রাতে নৈহাটিতে যাত্রা করিয়ে ভোররাতে মাল নিয়ে গঙ্গা পার হয়ে এসেছি। ভীষণ ঘুমে কাতর অবস্থায় শুতে গিয়ে দেখলাম এ প্যারাডাইস হলের মশকেরা

তাকে বাধা দিয়ে চক্রবর্তী বলে উঠলেন, সেইজন্য তুমি আলমারি থেকে ওই নতুন স্ক্রিনটা বার করে পাতবে?

পাতিনি কর্তা, গায়ে দিয়েছি।

আবার দুর্নিবার ক্রোধে চক্রবর্তীর সামনের দাঁতগুলো নড়েচড়ে উঠল, কোনও কথা শুনতে চাইনে, গেট আউট। তোমাকে আমি বরখাস্ত করলাম।

বলে বায়নাপত্রের বইটা খুলে পাতা উলটে যেতে লাগলেন। তাঁর ছেড়া কামিজের ফাঁক দিয়ে এখানে ওখানে শিথিল চামড়া উঁকি মারছে। গায়ের রঙটা এই ঘরের গত এক যুগের পুরনো হলদে রঙের মতো, আর ওই চেয়ারটার মতোই নড়বড়ে শরীর। জোড়া প্রায় চুলশূন্য, গোঁফজোড়া সন্তর্পণে ছাঁটা। বোধ হয় কিঞ্চিৎ কালো রঙ মাখা। মাথায় বাবরি রাখবার অপচেষ্টায়, ঘাড় অবধি নাগাল না পাওয়া চুলের অবস্থা ত্রিশঙ্কুর মতো। মনিবোচিত গাম্ভীর্যের সঙ্গে তিনি নিশ্চুপ। 

নবীন রাতজাগা ক্লান্ত চোখে যথেষ্ট গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বলল, এখনও তেরোটি বায়না রয়েছে নানান জায়গায়। চুঁচড়ো, শ্রীরামপুর, তেলেনিপাড়া, শ্যামনগর, জগদ্দল—

থাক থাক, সে আমাকে বলতে হবে না, শান্ত মোটা গলায় বললেন চক্রবর্তী।

নবীন তবু বলল, ন জায়গায় যাত্রা, চার জায়গায় থিয়েটার।

জানি জানি; কাজ চালাবার লোক আছে আমার, বলেই চক্রবর্তী পাতা উলটানো বন্ধ করে একেবারে স্তব্ধ হয়ে রইলেন।

ক্ষণিক নীরব। নবীন নিশ্বাস ছেড়ে বলল, তবে বাকি পাওনাটা মিটিয়ে দেওয়া হোক।

চক্রবর্তী নীরব। বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে কড়ে আঙুলের নখ খুঁটছেন।

নবীনের ঠোঁট চকিতে একবার বেঁকে সোজা হয়ে গেল। বলল, আমার কাজ আছে।

তবে তো আমার মাথা কিনেছ। সামনের দাঁতের সারি একবার কেঁপে উঠল চক্রবর্তীর। বললেন, তার আগে স্ক্রিনটা ভাঁজ করে তোলা হোক!

স্ক্রিনে হাত দিয়েই বলল নবীন, একটু চা না হলে জমছে না।

চোখ ঘোঁচ করে বললেন চক্রবর্তী, তা জমবে কেন? কখন শুনব এক পাঁট মাল না হলে জমছে। সকালবেলা বউনিবাটা নেই, কিছু নেই।

কেন? এক বিস্ময়ের ভাব দেখা গেল নবীনের চোখে। মনিবগিন্নি কি বাপের বাড়ি গেছেন?

অর্থাৎ চক্রবর্তীর দুরন্ত দামাল তৃতীয় পক্ষ যার কপালের টিপের ঝিলিক দেখলেই তিনি সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন। চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেন তার খোঁজ কেন?

তা হলে বউনির আগে এক গেলাস চা

বটে? খুবই বেয়াড়াপনা দেখছি যে? দাঁড়াও, বউটাকে—

কাজ যখন শেষ হল, তখন সূর্য প্রায় মাঝ আকাশে।

ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘরের পাশে সিঁড়িতে কার পদশব্দ শোনা গেল। চক্রবর্তী এক বিচিত্র হুঁশিয়ারি কটাক্ষ করল নবীনের দিকে। নবীনের চোখে ঝিলিক দিয়ে উঠল হাসি।

দরজার পরদাটা একবার দুলে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গে একখানি মুখ উঁকি মারল পরদার ফাঁকে। চক্রবর্তীর তৃতীয় পক্ষ ভানুমতী। চলতি কথায় যাকে বলা যায় দজ্জাল সুন্দরী। মুখখানি শরতের আকাশ, ক্ষণে ক্ষণে তাতে বিচিত্র আনোছায়ার খেলা। ভূ কুঁচকে, কপালের টিপটা একটু কাঁপিয়ে বলল, সকালবেলাই কাকে কীসের এত তম্বি হচ্ছে শুনি?

হুজুরের সামনে মোসাহেবের মতো অবস্থা হল চক্রবর্তীর। সামনের দাঁত নড়ল, মুখের সমস্ত রেখাগুলো মিলিয়ে গেল, চোখের পাতা করল পিটপিট। নড়বড়ে দাঁতে হাসি ফুটবে ফুটবে অবস্থা।

ইতিমধ্যে ভানুমতীর নজর পড়ে গেল নবীনের দিকে আর সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত শরীরটাই বেরিয়ে এল পরদার আড়াল থেকে। যেন মুখে তার আচমকা হাজার পাওয়ারের ফোকাস পড়েছে, ও মা! তুমি রয়েছ? তা সাত সকালে তোমাদের কী হল বাপু?

ততক্ষণে নবীনের স্ক্রিন ভাঁজ করা হয়ে গেছে। সেটা আলমারির মধ্যে পুরে দিয়ে বলল, কিছু হয়নি তো! একটু চায়ের জন্য এত কথা।

মরণ আর কী! ভানুমতীর চোখের মণি চকিতে চক্রবর্তীকে এক ঘাই মেরে ফিরে গেল নবীনের দিকে। একটা স্নেহ শাসনের ভাব ফুটে উঠল তার মুখে, তা তুমি আমাকে ডেকে বললেই তো পারতে। আমি না তোমার বউদি! দেওরের আবার এত লজ্জা কীসের?

নবীন চোরা চক্ষে মনিবকে একবার দেখে নিল। ইস! কড়ে আঙুলটা বুড়ো আঙুলের ঘা খেয়ে খেয়ে এবার রক্তপাত না হয়!

বটে! ভারী ভদ্রলোক তো! কটাক্ষটা দুর্জয় হয়ে উঠল ভানুমতীর। ভদ্রতা নিজের গিন্নির কাছে গিয়ে করো। আসছি, পালিয়ো না যেন। তারপর ফিরল চক্রবর্তীর দিকে। বাজারে লোক পাঠাও, উনুনে আগুন পড়বে এখুনি, বুঝলে?

বলে টিপ কাঁপিয়ে অদৃশ্য হল ভানুমতী।

কিন্তু চক্রবর্তীর মুখ কঠিন হল না মোটেই। বরং ভারী মিষ্টি হয়ে এল। একটা কোপ কটাক্ষ করে বলল, তোর চেহারাটার মতো তোর কাজ নয় কেন বল তো?

চেহারাটা বোধহয় আমার নয়।

তাই না বটে! যাক, নৈহাটি থেকে মাল সব খালাস হয়েছে?

হয়ে আর উপায় কী? আমার ছেলেটা এসেছিল কাল?

চক্রবর্তী সে কথার ধার দিয়েও গেল না। চোখ বড় বড় করে বলল, পরথম্ পদটা কীসের থেকে বলছিলি? সেই যে, বলে চক্রবর্তী নিজেই নাটকীয় সুরে শুরু করল, আর আমরাই বুঝি ক্ষমা করব বিদ্রোহিনীকে? নিজের… আঃ ভুলে গেলাম ছাই। কোন পালার কথা ওটা? 

সিরাজদ্দৌল্লা বলছে ওর সেই খচ্চর মাসিটা, ঘসেটি বেগমকে, বলেই নবীন ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেল, আমার ছেলেটা কাল টাকা নিয়ে গেছে?

চক্রবর্তীর ভ্রূ কুঁচকে গেল। সামনের দাঁতের সারিতে ঝড় বইল। সড়াৎ করে সামনের ড্রয়ারটা খুলে এক চিলতে ন্যাকড়া দিয়ে বাঁধা একষট্টি টাকা ছুড়ে ফেলে দিল নবীনের সামনে। এই নাও, শেষ সম্বল। শালার মরশুম না, আকাল। আজ বাদে কাল সপ্তমী পুজো, এখন পর্যন্ত টাকাই আদায় হল না। এখন ওই একষট্টি টাকা থেকে দু জায়গায় মালা যাওয়ার কুলি খরচা, নৌকো ভাড়া, তোমার আর আমার ঘরের খরচ সামলাতে হবে। তা ছাড়া দুটো আলাদা পেন্টার, ড্রেসার না হলে কাজ বন্ধ। আবার এখুনি বলে গেল বাজারে পাঠাও। আমি কেটে পড়ছি বাবা।

কিন্তু সে কাটবার আগেই একটা নাদুস-নুদুস যমকালো লোক ঢুকল দোকানে। বলল, নমস্কার।

নবীন লক্ষ করে দেখল নমস্কারটার ভঙ্গি পৌরাণিক পালার নায়কের মতো। চক্রবর্তী বসাল তাকে, কী চাই বলুন?

নবীন হালদারকে চাই।

কারণ?

আর বলবেন না মশাই, বলতে বলতে লোকটা বার বার অচেনা নবীনের দিকে তাকাতে লাগল আর ঘাম ঝাড়তে লাগল কপাল থেকে। বলল, আমাদের আজ রাত্রেই পার্থসারথি পালা। অর্জুন যে করবে, সে ব্যাটা একটা পুরনো ঝগড়ার ফ্যাকড়া তুলে কেটে পড়েছে, এখন আমাদের মান যায়। শুনেছি আপনার বিশিষ্ট কর্মচারী নবীনবাবু অর্জুনের পাটে একেবারে ওস্তাদ।

চক্রবর্তী নিদারুণ গম্ভীর। বায়নাপত্রের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বলল, মিথ্যা শোনেননি।

লোকটা বিভীষণ বপু নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল টেবিলের উপর। তাকে আমাদের চাই-ই চক্কোত্তি মশায়।

অতি উত্তম কথা। একটুও খিঁচ নেই চক্রবর্তীর গলায়। যাত্রা না থিয়েটার?

আজ্ঞে যাত্রা।

বেশ। তা হলে ড্রেস-পেন্টের বায়নাটা দিয়ে যান।

কালোবপু চমকে গেল, সে তো মশাই আমরা অন্য জায়গায় বায়না দিয়ে ফেলেছি।

টকাটক চক্রবর্তীর সামনের দাঁত নড়ে উঠল, গভীরতর হল নাকের পাশের কোঁচ। তা হলে সেখান থেকেই অর্জুনের ব্যবস্থা করবেন, নবীন হালদারের অর্জুন হবে না।

লোকটির কালো রং বেগুনী হল। বায়না কী করে ফিরিয়ে নিই বলুন?

চক্রবর্তী মাথা নেড়ে বললেন, মাফ করবেন।

কয়েক মুহূর্ত রুদ্ধশ্বাস নিস্তব্ধতা।

লোকটা একেবারে অসহায়ের মতো বলে উঠল, নবীনবাবু এটা শুনলেও কি এই জবাব পাব?

চক্রবর্তী নবীনকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, সামনেই রয়েছে, জিজ্ঞেস করুন।

চোখাচোখি হল নবীনে আর চক্রবর্তীতে। লোকটা নমস্কার করে খোশামোদের মতো বলল, শুনলেন তো সবই।

শুনলাম। একষট্টি টাকার বাণ্ডিলটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে চক্রবর্তীর দিকে ছুড়ে দিল নবীন। বলল, শ্যামনগরওয়ালারা টাকাটা আগাম দিয়ে গেছে। তারপর লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি তো শুনলেন সব।

মহা ফাঁপরে পড়ার মতো লোকটা বলল, তা হলে

ব্যবস্থা একটা হতে পারে। চক্রবর্তী বললেন, কত টাকার কন্ট্রাক্টে কত টাকা বায়না দিয়েছেন?

আজ্ঞে, আশি টাকায় পাঁচ টাকা বায়না।

ভাল কথা, পঁচাত্তর টাকায় আপনাদের প্লে করিয়ে দেব, তা ছাড়া নবীনের টাকা তো আপনারা দেবেনই। ওই বায়নাটা বাতিল করে দিনগে।

লোকটার চোখ ঝলসে উঠল আশা। তবু বলল, কিন্তু আগের ড্রেসওয়ালাদের কাছে ভারী বদনাম হয়ে যাবে।

তা হলে মাফ করতে হল। চক্রবর্তী পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেল।

বেশ, তা হলে আপনার কথাই রইল। লোকটা একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

ওদিকের পরদার ওপাশ থেকে ডাক পড়ল চুড়ির ঝনাৎকারে। নবীন আসছি বলে পরদা সরিয়ে ভিতরে গেল।

ভানুমতী ঠোঁট টিপে চা আর খানচারেক রুটি, গুড় দু হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নবীন আসতেই বলল, ধরো তাড়াতাড়ি, হাত পুড়ে গেল।

নবীন চায়ের গেলাস নিজের হাতে নিল। বলল, রুটি খাব কেমন করে?

ধরে থাকব নাকি থালাটা? ঠিক বিদ্রূপ নয়, তবু বেঁকে উঠল ভানুমতীর ঠোঁট।

তার চেয়ে মাটিতে রেখে খাব। আর একহাতে থালা নিল নবীন।

আচমকা মেঘে ছেয়ে গেল ভানুমতীর মুখ। বলল, এতই খারাপ এই হাত দুটো?

না, তা বলিনি।

কিন্তু নবীনের কথা শেষ হওয়ার আগেই ভানুমতী সিঁড়ির অর্ধেক উঠে থেমে গিয়ে বলল, ইচ্ছে হয়তো ওপরে বসে খেতে পারো।

ওপর? যেন কত সমস্যা নবীনের এমনভাবে জিজ্ঞেস করল।

ভেবে দেখো, তাতে আবার জাত যাবে কিনা! প্রায় উড়ন তুবড়ির মতো ভানুমতী উঠে গেল।

ভেবেই দেখল নবীন। না, উপরে যাওয়া হবে না। কত তাহলে মুশকিলে পড়ে যাবে খানিকটা। উঠানটাও স্টেজের ফ্রেম আর পুরনো সিনের গাদায় বিশ্রী হয়ে আছে। বিপরীত দিকের গুদাম ঘরটায় মানুষের সাড়া পেয়ে পিছল উঠোন সন্তর্পণে পেরিয়ে সেখানেই গেল সে। ঘরটা দিনের আলোতেও সাংঘাতিক। অন্ধকার উঠোনের জমি থেকেও কয়েক ফুট নীচে তার মেঝে। সে দরজায় এসে দাঁড়াতেই ভিতর থেকে একটা মোটা ভাঙা মোটা গলা ভেসে এল, এসো দাদা, এসো।

কে রে বিপনে নাকি? অন্ধকারে ঠাওর করতে পারল না নবীন।

আজ্ঞে বিপিনবিহারী লয় খালি। ফনে আর সানাও আছে। বলে বিপিন অন্ধকার ফুড়ে দরজায় এসে হাজির হল।

এরা সকলেই চক্রবর্তীর রোজ মাইনের কুলি। মরশুমের সময় এদের হাতছাড়া করা যায় না। মাল বওয়াটা বড় কথা নয়, মঞ্চ বাঁধা ও সিন খাটানো এদের কাজ। আর তেমন দরকার হলে ড্রেসারের সাহায্যে কখনও কখনও কাটা সৈনিকের পোশাকও পরিয়ে দিতে হয়।

কী হচ্ছে বাবুদের? নবীন জিজ্ঞেস করল।

সে এক মজার ব্যাপার। বিপিন কেশো গলায় হেসে বলল, সানা শালার চিড়িয়া ফুড়ত কেটেছে, বসে বসে এখন গজগজ করছে।

চিড়িয়া মানে, বউ?

বউ শালা পাবে কোথায় গো, রাঁড়! চলো না, বসবে।

ততক্ষণে অন্ধকারটা একটু থিতিয়ে এসেছে। ঘরের দূর কোণে ওদের স্যাঁতানো মাদুরটায় গিয়ে বসল নবীন। বলল রুটি কটা হাতে তুলে, চলবে নাকি?

বিপিন হাত বাড়িয়ে দিল, লয় কেন?

তিনজনকে তিনটে রুটি দিয়ে নবীন একটা খেতে লাগল। সানা খাচ্ছে না দেখে জিজ্ঞেস করল, কী হল রে সানা?

ফনে বলল, দোস্তের আমার দুঃখ হয়েছে। সানার হাঁটুতে হাত রেখে বলল, ওরে শালা, খেতে না পেলে ঘরের বউ কেটে পড়ে তার আবার বাজারি বউ। লে লে খেয়ে লে। সানার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল! ও শালীর জাতকে বিশ্বাস করতে নেই।

হ্যাঁ রে, ত শালার জাতকে বিশ্বাস আছে। বিপিন বিদ্রূপ করে উঠল। নবীনকে বলল, এঠা বাজে কথা লয় দাদা?

নবীন বলল, তোর মনে কী হয়?

আমার কথা হচ্ছে, পেট হল সবার বড়। সব পিরিতই ফস্কা গেরো পেট যদি না ভরে। মাথা নেই তার মাথা ব্যথা। রাঁড়ের পিরিত রাখ, আমাদের মেয়েমানুষ নিয়ে ঘর করা এ দুনিয়ায় শালা চলবে না।

ঠিক বলেছিল বিপনে। ফনের কথার সুরে বোঝা গেল গত রাত্রের নেশার ঘোরটা তার পুরো কাটেনি এখনও। আরে তোর আছে কী? কথায় বলে ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার। তুই শরীল খাটিয়ে খাস, সেও খায়। তাতে বিশ্বাস আর অবিশ্বাস!

ধুর! ও-সব আমাদের লয় বাবা।

সানার তবু ক্ষোভ যায় না। নাঃ ও জাতকে বিশ্বাস নেই।

চুপ কর! ধমকে উঠল বিপিন।

অন্ধকারে এই তিনটে ভুতুড়ে মানুষের মধ্যে নবীনও এদের কথায় জমে গেল। সে দেখল কোথায় যেন একটা মস্ত সত্য রয়ে গেছে। বিপিন আর ফনের কথায়। বলল, দ্যাখ সানা, একটা কথা বলি। তোর জন্মের ঠিক নিশ্চয় আছে?

সকলেই চমকে উঠল প্রশ্নটা শুনে। সানা বলল, যে শালা বেঠিক বলবে, তার জিভ ছিঁড়ে লোব?

বেশ, আধিভৌতিক কিছু একটা বলার মতো চোখ মুখ কুঁচকে বলল নবীন, মায়ের পেটে জন্মেছিস বাপের ব্যাটা, পানু মালাকারের ছেলে তুই, কেমন তো?

বাপের ব্যাটার মতোই বলল সানা, লিশ্চয়!

বহুত আচ্ছা! এবার বল, মা তোর মেয়েমানুষ ছিল কি না?

লইলে জন্মাব কেমন করে ঠাকুর।

এবার নবীন বলল সবাইকে, তোমরা সব শুনেছ সানার কথা? তারপর বলল সানাকে, মেয়েমানুষের জাতকে বলছিস বিশ্বাস নেই। তবে বল, যে তোকে পেটে ধরেছে সে ছাড়া তোর বাপের নাম জানে কে?

এক মিনিট ঝিম ধরে রইল সানা। পরেই তাড়াতাড়ি নবীনের পায়ে হাত বুলিয়ে বলল, ঠিক বলেছ ঠাকুর। মায়ের কথাটা মনেই ছিল না।

শাবাশ দাদাঠাকুর। বিপিন তো চাপড় মেরেই বসল নবীনের পিঠে। গো মুখ আমরা। আসল কথাটা ভুলে যাই। আসলে দুনিয়াটাই বিগড়ে গেছে।

হ্যাঁ বাবা। ফনে তার নেশার গলায় বলল, ইটেজ বেঁকে থাকলে ওতে কেষ্ট ঠাকুরকেও বাঁকা দেখা যায়। এ দুনিয়া ঢেলে না বাঁধলে চলবে না, যা!

ঠিক! নবীনের চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল। শূন্যে নিবদ্ধ সুন্দর চোখ দুটো তার যেন হাজার কুদ্ধ কথা বলে চলেছে। সব শালা ঢেলে সাজাতে হবে।

বাইরে থেকে চক্রবর্তীর চিৎকার শোনা গেল, নবীন, নবা কোথায় রে?

অন্ধকার গুদামের কোণে আর এই পরিবেশটাতে চক্রবর্তীর ডাকটা ভারী বেসুরো মনে হল।

বিপিন বলল, লাও, ডাক পড়েছে। দ্যাখ বোধ হয় নতুন বায়না এল।

নবীন উঠে পড়ল। সে তো এসেইছে সকালে, তৈরি হয়ে।

সানা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু যাই বল, বড় দাগা দিয়েছে।

ফনে বলল, চেছে ফেল। মাটি নরম হলেই দাগ পড়বে।

তাই না বটে। বিপিনের গলার স্বরে সকলে চমকে উঠল। বাবা! লোকটা এমন গোখরোর ফণা তুলে গজরাচ্ছে কেন? কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হল গলাটা যেন ভিজে উঠেছে। বলল সে, দাগ আবার কীসের, পাথর করে ফেলব বুক।

একটা অতিকায় গরিলার মতো এঁটো থালা গেলাস নিয়ে থপথপ করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল বিড়বিড় করতে করতে ঘর-মেয়েমানুষ…চুপ, চুপ মেরে যা সব।

নবীনের মনে হল অন্ধকারটা যেন ঘন হয়ে উঠেছে। অন্ধকারের ভিতর থেকে সানার গলা শোনা গেল, শালা, ভালবাসাটা পাপ।

জবাবে ফনে দরাজ গলায় বলে উঠল, যাই বল বাবা, আমি কিন্তু প্রাণভরে কেবল ভালবাসব।

নবীন তাড়াতাড়ি বাইরের দিকে গেল। এ অন্ধকার গুদাম ঘরটায় নিজেকে অচেনা লাগে।

দোকান ঘরে সেই কালো লোকটা সবে উঠতে যাচ্ছিল। নবীনকে দেখে দাঁড়াল আবার। এই যে নবীনবাবু, চললাম দাদা। আপনার এক রাত্রে পাঁচ টাকা ঠিক হয়ে গেল! কথা রইল, সন্ধ্যা ছটার মধ্যে যাবেন। তারপর হঠাৎ কাছে এসে ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বলল, মালটাল চলে তো।

নবীন ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, চলে বই কী! তবে, ফরাসি সাম্রাজ্যে বাস করি, খাঁটি ফরাসি মদ না হলে আমার জমে না।

লোকটা চোখ মেরে বলল, আমরা এখন ইংরেজ ছেড়ে খাদি রাজ্যে বাস করলেও খাস আমেরিকান মাল দিয়ে আপনাকে একেবারে জমিয়ে দেব।

কালো বপু কেঁপে উঠল হাসিতে। নবীন হঠাৎ অসম্ভব গম্ভীর হয়ে বলল, দাদা বোধ হয় পার্থসারথীর কেষ্ট সাজবেন।

জবাবের পরিবর্তে লোকটা বিগলিত হয়ে গেল হাসিতে।

দেখেই বুঝেছি। নবীন বলল, দু কাপ চায়ের বন্দোবস্ত রাখবেন, তা হলেই হবে। জায়গাটা কোথায়?

—মূলাজোড়। গিয়ে আমার নাম করবেন তা হলেই

নমস্কার, আসুন তা হলে। নবীন সরে গেল।

লোকটা কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুতের হাসি নিয়ে বেরিয়ে গেল।

চক্রবর্তী বলে উঠল, তোর চেহারার মতো যদি তোর কাজগুলো হত। লোকটা হয়তো চটেই গেল।

কোনও জবাব দিল না নবীন সে কথার।

চক্রবর্তী ভ্রূতে একটু বিরক্তি ফুটিয়ে বলল, এসো, বসো, সামনের কন্ট্রাক্টগুলোর হিসেব-নিকেশ করে রাখা যাক।

নবীন এগিয়ে বসল মনিবের পাশে, লোহার চেয়ারে। চক্রবর্তী বায়নাপত্র খুলে হঠাৎ বলল, আচ্ছা তুই তো অনেক বই পড়েছিস কেমন?

হঠাৎ এই প্রসঙ্গে নবীনের চোখে বিস্ময় কেন?

মনিবগিন্নিকে কেউ বউদি বলে, শুনেছিস? টাল খেয়ে উঠল চক্রবর্তীর সামনের দাঁত।

তা আমি বলেছি নাকি? নবীনের মুখে চোরা হাসি চোখে পড়লে চক্রবর্তী বোধ হয় মারামারি শুরু করত।

বলল, তবে যে সে কী একটা বলল তখন?

বললই বা! আমি তো কিছু বলিনি।

হ্যাঁ, খাপ আর তলোয়ার সবসুদ্ধ কখানা আছে? পর মুহূর্তেই চক্রবর্তী একেবারে কাজের কথায় ফিরে এল।

কিন্তু নবীনের চোখ দুটো কেবলই বাইরের দিকে ছুটে ছুটে যেতে লাগল। ছেলেটা আসে না কেন এখনও? গত দুদিন থেকে এখন পর্যন্ত তার বাড়ি যাওয়া সম্ভব হয়নি। এ লাইনের কাজই এরকম। অথচ দুমাইল দূরেই তার বাড়ি, এই জি. টি. রোডের প্রায় ধারেই। কাল ফিরে গেছে ছেলেটা পুজোর নতুন জামাকাপড়ের আশায় এসে।

হিসেব-নিকেশ করতে বেশ খানিকটা বেলা হয়ে গেল। নবীন পুজোর কদিন কোথায় কোথায় যাবে সব ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার পর চক্রবর্তী বলল, ভদ্রেশ্বরে ওদের সাজাহান পালায় তোকে তো আবার অষ্টমীর দিন নাবতে হবে।

হ্যাঁ, করতে হবে ঔরঙ্গজেবের পার্টটা।

এখন তো তবে তোকে একবার সিরামপুর যেতে হয়। কাশী ভড়ের কাছ থেকে দুটো বর্ম, খান দশেক তলোলায়ার খাপসুদ্ধ আর ফিমেল বেণীওয়ালা চুল খান চারেক।

হ্যাঁ, তা তো যেতেই হবে। কিন্তু ছেলেটা

ওহো! ভ্রূ তুলল চক্রবর্তী, বাবুপাড়ায় একবার যেতে হবে সেই ছোঁড়া চারটের জন্যে। কুলির তো দরকার। আর একবার নয়ন দাশ পেন্টারের কাছেও যেতে হবে।

আড়চোখে একবার দেখে নিল সে। বলল, এতগুলো কাজ, লোক মাত্র দুটো। দোকানে তো একজনকে বসতেই হবে।

নবীনও একবার আড়চোখে চক্রবর্তীকে দেখে নিস্পৃহ গলায় বলল, তা তো হবেই।

তোকে আবার আজ একটা পেলেও করতে হবে। বোঝা গেল সমস্যায় পড়েছে চক্রবর্তী।

তা তো করতেই হবে, নবীন বলল।

আবার একবার চক্রবর্তী দেখে নিল নবীন হাসছে কিনা। বলল, তা হলে

যা আজ্ঞা হয়, বলল নবীন।

তোর একবার বাড়িতে যাওয়াও দরকার বোধ হয়?

দরকারই তো।

অসহায়ভাবে বলল চক্রবর্তী, তা হলে আমিই যাব সিরামপুর।

আর দোকানে বসবে কে? নবীনের চোখ কুঁচকে উঠল।

তুই।

তা হলে বাড়িতে যাব কী করে। আর খদ্দেরও তো পটবে না আমার কথায়! চাপা হাসির ছলনা নবীনের চোখে।

এতক্ষণে চক্রবর্তী খেঁকিয়ে উঠল। তা হলে যা খুশি করগে যা।

নবীন সটান দাঁড়িয়ে সেলাম করে বলল, সেই আজ্ঞাই করুন জাঁহাপনা।

এই সময় গুঁইরাম ঢুকেই হি হি করে হেসে উঠল। মেয়েমানুষের মতো সরু গলায় বলল হাততালি দিয়ে, এই দ্যাকো তবলচি ঠাকুরের কাণ্ড। এখানেও কি পেলে বলছ নাকি গো?

চক্রবর্তীর হাড় জ্বলে উঠল ইরামকে দেখে। তা তুমি সক্কালবেলায় মরতে এয়েছ কেন?

ও মা গো, সক্কাল কোথা দেখলে, বেলা দুকুর গড়ায়, ন্যাকা মেয়ে মানুষের মতো বলল ইরাম। নবীনকে বলল, তোমাকে একবার সুলতাদিদি যেতে বলেছে তবলচি ঠাকুর।

মরণ নেই তোমার সুলতাদিদির? কঠিনভাবে বলতে গিয়েও কোথায় যেন একটা কোমলতার আভাস পাওয়া যায় নবীনের গলায়। চোরা চোখে তাকিয়ে দেখলে, চক্রবর্তী তার দিকেই চোখ ঘোঁচ করে তাকিয়ে আছে।

হা বাপু, ঠোঁট ফুলিয়ে ইরাম বলল, না গেলে বলেছে মাথা কুটে মরবে।

মরেই তো গেছে, মরবে আর কবার। চলো একবার ঘুরে আসি, বলে আবার সে দেখল চক্রবর্তীকে। বলল, তা হলে ঘুরে আসি কর্তা। টাকা পয়সার ব্যবস্থা ঠিক রাখুন। আর ছেলেটা এলে—

কথার মাঝপথেই চক্রবর্তী চেঁচিয়ে উঠল, কই রে বিপনে, বাজারটা করে নিয়ে আয়।

গুঁইরামের সঙ্গে পথে বেরিয়ে এল নবীন।

নরম হাওয়ায় দিনটা যেন দুলছে। রোদটা ভারী আরাম দিল নবীনকে। কোথায় যেন ঢাক বাজছে। ঢাকের শব্দেই আরও যেন গভীরভাবে মনে পড়ে গেল নবীনের, শুরু হয়েছে শারদোৎসব। ছেলেমেয়েগুলো হতাশায় বেদনায় না জানি কতখানি দুমড়ে পড়েছে। আর মিনু তার বউ, ছোট বউ, ছোট বউ ডাকবার আর কেউ নেই নবীন ছাড়া। না, সে মেয়েটার তো কিছুই চাইবার নেই এক তার স্বামীকে ছাড়া। আশ্চর্য! একটি বাহারি শাড়ি, এক চিমটি সোনা, বাইরের আনন্দ একটু, কিছুই না। তার চোখে নবীনের শরীর থেকে ক্রমাগত মাংস ঝরে যাওয়া, পরম ক্লান্তি, জীবনের একমাত্র সংকট। সন্তানের রক্তহীনতা তার একমাত্র আতঙ্ক। না, এত ভালাবাসা ঠিক নয়। সেই নতুন আবেগে থরো থরো ভাবটাই আজ পর্যন্ত পুরনো হল না। সাপের মতো আঁকড়ায় না, অথচ নিরন্তর টান দেয়। যা পুজোর সময় ওকে একটা কিছু দেওয়া দরকার। কিন্তু, তিক্ততা নয়, বিষাদে বেঁকে উঠল নবীনের ঠোঁট। সঙ্গে সঙ্গে মিনুর বকুনিভরা চোখ দুটিও মনে পড়ে গেল। একটা নিশ্বাস ফেলে এগুলো নবীন।

পথটার দুই ধারে সবই প্রায় পুরনো দোতলা বাড়ি, জায়গাটা নাম করা বেশ্যা পল্লী। দোতলা বাড়ির সারির শেষেই টালি ছাওয়া দরমার ঘর। ওগুলো একটু নিচু শ্রেণীর বেশ্যাদের ঘর। দিনের বেলাটা এখানে নীরব। গাড়ি ঘোড়া অন্যান্য ব্যবসায়ে ব্যস্ত কিছুটা, নয় তো ঝিমিয়ে থাকে। সন্ধ্যায় এ পথের জেল্লা বাড়ে, দেশি-বিদেশি শরাবের দোকানে আলো জ্বলে আলেয়ার মতো।

একটা দোতলা বাড়িতে নবীন ঢুকে উপরে উঠতেই একগাদা মেয়ে তাকে ঘিরে ধরল। এসেছে গো, আমাদের তবলচিদার এসেছে।

অভ্যর্থনার বহর দেখে বোঝা গেল নবীন এখানে বিশেষভাবে পরিচিত এবং সেটা তবলচি হিসাবেই।

সুন্দরী সুলতা বসবার জায়গা দিয়ে বলল, দাদা তো আমাদের ভুলেই গেছে।

ভোলাভুলি নয়, এখন মরশুমের সময়, দম ফেলারই সময় নেই। নবীন বসল।

বাড়ির কর্তী এসে বসল জাঁকিয়ে কাছে। তা বলি ছেলে, মরশুম একলা তোমাদের? পরবের সময়, মেয়েগুলোর বুঝি আর একটু গান বাজনা করার সাধ যায় না?

যাবে না কেন? নবীন হাসল। তবলচির অভাব কি?

একটি মেয়ে অভিমান ভরে মুখ ফেরাল, দাদার খালি ওই এক কথা।

সুলতা বলে উঠল, এ তল্লাটের তবলচি দেখতে আমাদের বাকি নেই তবলচিদা, বলছ কাকে? মড়ারা একে তো হ্যাংলাপনা করবে, তার মধ্যে সব ঢোলক গোঁসাই।

একটি মোটা মতো মেয়ে, গতরাত্রের রেশ থাকায় কিঞ্চিৎ অপ্রকৃতিস্থ। এসে বলল, যাই বলল, বাজাতে তোমাকে হবেই দাদা। সেদিন এক মুখপোড়া গঁপো এসেছিল। তার কী ঢং গো। ড়ুগিটাতে যখনই ঘা মারে, মুখটাকে এমন করে আর এমন হাসবে, বলে সে সেই তবলচির ভঙ্গিটা দেখাল। আর অমনি একটা হাসির রোল পড়ে গেল মেয়েদের মধ্যে।

কে একজন বলে উঠল, ইচ্ছে হয় শালাকে খেংরে দূর করে দিই।

কেউ কেউ নবীনের গুণগান শুরু করল। মাইরি, দাদার হাত পড়লেই মনে হয় তবলা বেজে উঠেছে।

কর্ত্রী সবাইকে থামিয়ে বলল, না বাজালে চলবে না ছেলে, সে তুমি বেবুশ্যে বলে যতই তফাত রাখো।

বাঃ, নবীন ভ্রূ তুলে হাসল। তফাত আবার কীসের? পয়সা নিই তবলা বাজাই।

সেই তো কথা বাবা। কী বলল, টাকা দিয়েও তোমাকে কিনতে পারলাম না। আর বলে সে সুলতার দিকে বিচিত্র ভঙ্গিতে তাকাল।

সুলতা মুখ নিচু করে বলল, সে চেষ্টা কী কম করেছি মাসি। একটু ঢলা তো দূরের কথা, তোমার তবলচি ছেলে আমার সে মুখ পুড়িয়ে দিয়েছে। সুলতার নিশ্বাসে শুধু আফসোস নয়, বেদনার আভাস পেয়ে কারও কারও ঠোঁট বেঁকে উঠল।

একটি চঞ্চল মেয়ে বলে উঠল, টেপা হাসি হেসে, যাই বলল দাদা, ভগবানে তোমার চেহারাখানিও দিয়েছিল বটে। লোভ হয় কিন্তু, বলে খিলখিল করে হেসে উঠল।

নবীন কপট গাম্ভীর্যে বলল, তবে তোরা বলতে থাক। আমি উঠি।

কর্ত্রী সবাইকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল। তা হলে ছেলে

বেশ! নবীন উঠে দাঁড়াল। সপ্তমী দশমী দুদিন বাজাব। তবে সন্ধ্যারাত্রে দু ঘন্টা, তা ছাড়া পারব না।

বেশ! বেশ! কর্ত্রী খুশি হয়ে উঠল, তাই হবে। একটু মিষ্টিমুখ করে টাকাটা তুমি আগাম নিয়ে যাও।

না, কোনওটাই হবে না। তাড়া আছে। তা ছাড়া আমি বাজিয়ে টাকা নিয়ে যাব। একটু হেসে বলল, ভয় নেই। বলেছি যখন আসব।

বেরিয়ে এল নবীন। আসবার সময় টালির চালগুলোর অধিবাসীরা সকলেই তবলচি দাদাকে ডেকে কুশল জিজ্ঞেস করে নিল। এরা হল নিম্নস্তরের।

একটি মেয়েকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়াল নবীন। কীরে বিন্দু, তোর কী হল?

বিন্দু মাথা তুলল না।

কি, গান শোনার খদ্দের আছে বুঝি? নবীন জিজ্ঞেস করল।

বিন্দু মাথা নাড়ল। নবীন বলল, আমাকে তবলচি নিবি?

বিন্দু মাথা তুলল। ঠাণ্ডা গলায় বিষাদে বলল, তোমাকে নেওয়ার সামখ কোথায় তবলচিদা? আমরা যে আটচালাওয়ালি!

বটে? নবীন হাসল। কবে তোর গান?

নবমীর দিন।

কত টাকা দিবি?

বিন্দু মাথা নিচু করে রইল নিশ্চুপে।

আরে বাপু দুটো মিষ্টি তত খাওয়াবি?

বিন্দুর মুখে হাসি ঝলকে উঠল। পেট ভরে খাওয়াব তোমাকে তবলচিদা।

বেশ। তবে সন্ধ্যারাত্রে বুঝলি? হনহন করে বেরিয়ে এল নবীন সেখান থেকে।

দোকানে এসে দেখল বিপিন ড্রেস গোছাচ্ছে। জিজ্ঞেস করল, কত কোথায়?

কর্তা ওপরে, বিপিন বলল, তোমার ছেলে এসেছে, মনিবগিন্নি ডেকে নিয়ে গেছে ওপরে।

এসেছে? ডেকে নিয়ে আয় তো বিপনে। নবীনের চোখে সংশয় ঘনিয়ে এল। কর্তা আবার টাকা দিলে হয়। নইলে আজও যদি ছেলেটাকে ঘুরে যেতে হয়, তা হলে বেচারার মুখের দিকে আর তাকানো যাবে না।

বিপিন এসে বলল, ঠাকরুন তোমার ছেলে নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, যাও তুমি।

ও! হাসি পেল নবীনের। ভিতরে এসে দেখল ছেলের হাত ধরে ভানুমতী গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে আসতেই বলল, তোমরা এমন পাষণ্ড কেন বলো তো। তিনটে বাচ্চা নিয়ে বউটা একলা রয়েছে, আর আজকে ষষ্ঠি পুজো। শুকনো মুখে ছেলে এসেছে বাপের খোঁজে।

জানা কথা শুনে হাসল নবীন। দুঃখের হাসি। জানি। কিন্তু এ তো আমার শখ নয়? বাউণ্ডুলে কাজ তুমি ছেড়ে দাও বাপু। বিনা দ্বিধায় কথাটা বলল ভানুমতী, তোমার মনিবের মতো লোকের চলে এ কাজ, তোমার পোয় না।

নবীন বলল, এ জগতে কোন্ কাজে কজনার পোষায়?

ভানুমতী ছেলেটার মুখটা তুলে ধরে বলল, ওর যখন খিদে পাবে কষ্ট হবে, তখন কি ও জগতের দিকে তাকাবে, না বাপের দিকে?

সত্য কথাটা শুনে নীরব রইল নবীন। তবু মূল সত্য তার কথাটাই।

ভানুমতী বলল, যাই বলো বাপু, তোমার আছে বলেই বোধ হয় এ শুকনো মুখ দেখে তোমাদের বুক ফাটে না। আর যাদের নেই….

বলতে বলতে গলাটা বুজে এল তার, চোখের কোণে জল। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল, এ পোড়া সংসারের ধাত বুঝিনে, কাকেই বা বলব।

ছেলের হাত ধরে ঘরে ঢুকল নবীন। তার একটুও মায়া হল না ভানুমতীর চোখের জলে। তার নিজের পুত্রস্নেহ কি কম? তার চেয়েও ভানুমতীর বেশি? কখনও নয়। তার আসল কথা হল, এ পোড়া সংসারের ধাত বোঝে না সে। এ শুকনো মুখ দেখলে নবীনের বুক ফাটে না, কে বলেছে একথা ভানুমতীকে। কিন্তু

চক্রবর্তী ঢুকে টাকা দিল নবীনকে। বলল, তোর টাকা আর সারাদিন চলবার খাবার।

টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল নবীন। পথে বেরিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, কিছু খেয়েছিস সকালে।

ছেলে ঘাড় নাড়ল, কাল রাতের ভাত ছিল, তাই খেয়েছি।

তোর মা? ছেলের মুখের দিকে তাকাল নবীন। মিনুর অবিকল মুখ ছেলেটার। কী করছে তোর মা?

মা? সংশয় দেখা দিল ছেলের মুখে। একটু পরে বলল, মা কাজ করছে।

আর তোর ছোট বোন দুটো?

খেলা করছে।

তোর পেট ভরেনি ভাত খেয়ে, না? নবীন তাকাল ছেলের দিকে।

ভরেছে তো, অন্যদিকে তাকিয়ে বলল ছেলে।

আশ্চর্য! নবীন দেখল দায়ে পড়ে ছেলেটা কেমন মিছে কথা বলছে। কাছে টেনে নিয়ে বলল ছেলেকে, চল না, কিছু খেয়ে নিবি।

মিনুর মতো তাকাল ছেলেটা বাপের দিকে। বাবার জামার আস্তিনে মুখ ঢেকে বলল, কিনে দিয়ে খাবার, বাড়ি নিয়ে যাব।

কী ছেলে! একলা খাবার খেতে তার সংকোচ। কিন্তু বুকটার মধ্যে এমন মোচড় দিয়ে ওঠে কেন?

একটা কাপড়ের দোকানে ঢুকে ছেলের একটা ইজের ও শার্ট আর মেয়েদের দুটো ফ্রক কিনল। কিনে টাকা হিসেব করে জিজ্ঞেস করল দোকানদারকে, টাকা চার পাঁচের মধ্যে শাড়ি পাওয়া যাবে একটা?

পাওয়া যাবে না কেন? মোটা আটপৌরে শাড়ি পাওগা যাবে পাঁচ টাকায়। ছেলে তাড়াতাড়ি বাপকে বলল, মা শাড়ি কিনতে বারণ করেছে।

থাক। ঠোঁট টিপে বেরিয়ে এল নবীন জামা ফ্রকের দাম দিয়ে। আটপৌরে কেন, শত টাকার চুমকি বাহারও মিনুর বুকে একটুও শান্তি দিতে পারবে না। তার জীবনের চুমকিই যে আজ মরচে ধরে যাচ্ছে। না, ভানুমতী এ পোড়া সংসারের ধাত বোঝে না।

সামান্য কিছু খাবার কিনে দিল সে ছেলেকে। পাঁচটা টাকা নতুন শার্টের পকেটে ভরে দিয়ে বলল, তোর মাকে দিস, কেমন? আর ঘরে চাল বাড়ন্ত নেই তো?

দুদিনের চাল আছে, ছেলে বলল। তারপর একটু হেসে বাবার হাত ধরে বলল, খাবারটা মাকে দিয়ে দোব রাতে খেতে?

কেন?

মায়ের আজ ষষ্ঠীর উপোস যে!

বটে? নিজের দাড়িওয়ালা খসখসে গালটা নবীন ঘষে দিল ছেলের গালে। তোমরাও একটু খেয়ো, কেমন? মাকে বলল, আমি অনেক রাত্রে একবার ঘুরে আসব বাড়ি থেকে।

ছেলেকে বাসে তুলে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে বাবুপাড়ার দিকে। সেখান থেকে শ্রীরামপুর।

.

কিন্তু মনটা বড় খারাপ করে দিয়েছে ভানুমতী। তোমাদের আছে বলে বুক ফাটে না। কী কথা! এ বুকের সমস্ত কথা কি তুমি জানো মনিবগিন্নি? নবীন বেশ্যার বাড়িতে তবলা বাজায়, কিন্তু রেডিয়ো, রেকর্ড কোম্পানির দরজায় দরজায় দিনের পর দিন মাথা ঠোকেনি সে! বড় আশায় বুক বেঁধে রাজধানীর ছোট বড় থিয়েটারের মালিকদের দোরে ধন্না দেয়নি সে! কী মঞ্চে, কী পরদায় একবার পরখ হওয়ার সুযোগ চায়নি সে পায়ে ধরে?

কিন্তু বন্ধ দরজা ও নিরেট মুখ দেখে ফিরে আসতে হয়েছে তাকে। আসতে হয়েছে চক্রবর্তীর স্টেজ অ্যান্ড ড্রেস প্যারাডাইসের পেন্টার আর ড্রেসার হয়ে। মরশুমের দিনে শখের দল ডাকাডাকি করে দেয়, দু চারটে টাকা আর অজস্র প্রশংসার প্রীতিমূল্য।

হায়! অথচ দেশে সমর্দারের তো অভাব নেই। তবু সেই সবই পুরনো থিয়েটার, পুরনো অভিনেতা, পুরনো নাটক, এমন কী গলার স্বরও পুরনো। কেন এ বিকৃতি?

সত্যি, এ পোড়া সংসারের ধাত বোঝে না ভানুমতী। চোখের জলে তা নিভবে! মোটেই নয়। একেবারে পুড়িয়ে দাও এ পোড়া ভিতের সংসার।

সন্ধেবেলা শ্রীরামপুর থেকে মূলজোড়। নাটক শুরু হতে দেরি হল না।

পার্থের ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল ভানুমতীর কথাটা। ওহহ, সত্যিই ভানুমতী যে সন্তানহীনা! তাই তার চোখে এত অবুঝ চোখের জল, নিজের না থাকার মস্ত বেদনাতে তাই এত অবুঝ কান্না।

.

রাত্রি আড়াইটার সময় নবীন গঙ্গা পেরিয়ে মূলাজোড় থেকে এপারে চলে এল। পথে ফরাসি পুলিশের টহল, সন্ধানী দৃষ্টি, কৈফিয়ত, জিজ্ঞাসা।

পেন্টিংয়ের সুটকেশটা দোকানে রেখে দেওয়ার জন্য পেছনের দরজা দিয়ে অন্ধকার উঠোনে ঢুকল নবীন। দোকানের দরজাটা খোলা পেয়ে ভিতরে ঢুকে সুইচ টিপল। সুটকেশটা রাখতেই ঠুন ঠুন শব্দে চমকে ফিরল নবীন। ভানুমতী।

কী হল? চমকানি কাটাবার চেষ্টা করল নবীন। বলল, ঘুম নেই চোখে?

বিচিত্র গলায় বলল ভানুমতী, কোনওদিনই ছিল না।

দু পা এগিয়ে এসে বলল, ছেলেমেয়েদের জন্য কটা জামা কিনেছি, নিয়ে যেয়ো। তারপর আরও এক পা এগিয়ে বলল, কিছু খাবে?

আশ্চর্য! আশ্চর্য দৃষ্টি ভানুমতীর চোখে। কী চায়, কী চায় মেয়েটা নবীনের কাছে। এক মুহূর্ত চোখে চোখ রাখল নবীন। পরমুহূর্তে মাথা নিচু করে বলল, আমাকে মাপ করো ভানু, মাপ করো। আমার ছেলেকে আমি তোমাকে চিরদিনের জন্য দিয়ে দেব, তোমাকে মা ডাকবে সে। তবু

সে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ করল। ভানুমতী ডাকল, দাঁড়াও।

ফিরল নবীন। হ্যাঁ, স্বচ্ছ হয়ে আসছে ভানুমতীর চোখ। চকিতে অদৃশ্য হয়ে নতুন জামাগুলো এনে নবীনের হাতে দিল সে। বলল, ওদের পরতে দিয়ো কাল।

দোব, বলে আর ভানুমতীর জলভরা চোখের দিকে না তাকিয়ে নবীন বেরিয়ে পড়ল। চোখের জলে এ পোড়া সংসার নিভবে না জেনেও এ কান্না বুঝি।

সামনে দীর্ঘ দু মাইল পথ। মিটমিটে আলো, নিস্তব্ধ, নিঃসাড়। এ-দেশের ফরাসি প্রহরীর সন্ধানী দৃষ্টি। পথটা হেঁটে ঘেমে উঠল নবীন।

আম আর পিপুল গাছের বেষ্টনীর মধ্যে অন্ধকারে মান্ধাতার আমলের বাড়িটা। নিঃশব্দ। নোনা ইটের গন্ধ লাগে। নবীন ডাকল দরজায় আস্তে শব্দ করে, মিনু, ছোটবউ, ছোটবউ দোর খোলো।

সাড়া দিয়ে মিনু দরজা খুলে দিল। বলল, এই বুঝি অনেক রাত? রাত তো শেষ।

হোক। নবীন দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল, আবার যে সময় হয়ে এল ছোটবউ।

কথা আটকায় গলায়। বলল, তবু তোদের যে ধরে রাখতে পারছিনে।

মিনু পায়ের ধুলো নিল নবীনের। বলল, ষষ্ঠী গেল, আজ সপ্তমী, আশীর্বাদ করো।

আশীর্বাদ! বলল নবীন, বেঁচে-থাক বলতে আমার লজ্জা করে ছোটবউ, তবু বলছি, তুই বেঁচে থাক। না হলে, বলতে বলতে সে দরজায় এল। পানু কবরেজের কাছে একটু ছেলেটাকে পাঠিয়ে দি, ওষুধ নিয়ে আসবে।

বেরিয়ে পড়ল সে।

অন্ধকার হালকা হয়ে আসছে! ছেঁড়া মেঘের ভিড় আকাশে।

চোখের জল মুছে দাঁতে দাঁত ঘষল নবীন। শা–লা!

আবার দোকান। বন্ধ ঘর। ভোর হয়েছে। নবীন গেল গুদাম ঘরটার দিকে বিপিন, সানাদের ডাকতে। ওদের নিয়েই নৌকায় উঠতে হবে।

বিপনে! ডাকল সে।

ভেতর থেকে সাড়া এল, চলে এসো ডানকোণা বরাবর।

নবীন কাছে যেতে যেতে বলল, আসার সময় নেই, বেরুতে হবে।

সে কাছে আসতেই বিপিন একটা দেশলাইয়ের কাঠি ধরিয়ে বলল, ওই দ্যাখো ঠাকুর।

নবীন দেখল, গুদামের খুঁটিতে গলায় দড়ি ঝোলানো একটা মূর্তি।

কে?

বিপিন বলল, সানা।

ফনে বলল, শালা আমার পিরিতে পোড় খেয়েছে। হতভাগা, পিরিতের রীতই বোঝে না। পেটে ভাত নেই…

অন্ধকারে ড়ুবে গেল তার কথা।

বিপিন বলল, দ্যাখো ঠাকুর, কাণ্ড দ্যাখো। যে সব ছোঁড়া দুনিয়া চেনে না, তাদের এমন মরাই ভাল। হ্যাঁ, যাই কর্তাকে খবরটা দিইগে।

ফনের দরাজ গলা আবার শোনা গেল, যে যাই করো বাবা, আমি শুনছি না, আমি কেবল প্রাণভরে ভালবাসব, শালা।

তারপর হঠাৎ নবীনের কাছে উঠে এসে চোখ বড় বড় করে বলল, এ সেই বাঁকা ইস্টেজের ব্যাপার ঠাকুর বুঝলে? ঢেলে বাঁধতে হবে। চলো বাইরে যাই, শালা থাকুক।

নবীন বেরিয়ে এল। এ পোড়া সংসারের ধাত কি বোঝে না ভানুমতী? সকলেই বোঝে। যারা বোঝেনি, তারা একটু বুঝুক।

দোকানের টেবিলে মাথাটা পেতে দিল নবীন। ইস! শালা, মরশুমের একটা দিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *