গন্তব্য

গন্তব্য

ঝোড়ো কাকের মতো স্টিমার থেকে হুমড়ি খেয়ে এসে ডাঙায় পড়ল মানুষগুলো। এদিকে ও-দিকে ছিটকে পড়ল বাক্স বিছানা টুকিটাকি নানা লটবহর। হইচই লেগে গেল একটা ভীষণ।

মানুষগুলো যেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে রাতারাতি পাড়ি জমিয়েছে শত্রুদের আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচাতে। এমনি একটা ব্যস্ত ত্রাসের ভাব। আলুথালু ময়লা জামাকাপড়। উসকো খুসকো চুল। আর শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেরই একটা রাতজাগা রুগ্ন ক্লান্ত ভাব। বসে যাওয়া চোখগুলো যেন পায়ের তলায় মাটি হারিয়ে ফেলেছে এমনিই একটা অসহায় দৃষ্টি, বাঁচবার জন্য শেষ চেষ্টায় উঠে পড়ে লাগার মতো।

বর্ষার প্রথম ধাক্কায় মেতে ওঠা পদ্মা উল্লাসে গান করে চলেছে গোঁ-গোঁ করে। ঝোড়ো হাওয়ার তরঙ্গে তরঙ্গায়িত সে সুর। মাটি খেয়ে নেওয়ার একটা উগ্ৰ ক্ষুধায় বার বার ঝাঁপিয়ে পড়ছে পাড়ে।

একটা বোঁচকার উপর দাঁড়িয়ে যতটা সম্ভব উঁচু হয়ে প্রসন্ন দলের লোকদের ডাকতে লাগল, ওহে অনন্ত, ও পরির মা, এই যে এ-দিকে এসো। আরে ওই নিকুঞ্জ, ও-দিকে কুনঠাই যাচ্ছিস? এদিকে, হ্যাঁ। আর বাঁকার বউয়ের আঁচলটা ধরে রাখিস্ টগরি। পরেশ, বুড়ো গোবিন্দ কামারকে হাত ধরে রাখি তুইও আবার দেখতে পায় না।

অনেক হাঁকাহাঁকির পর প্রসন্নদের দলটা বোলতার মতো আলাদা হয়ে গেল যাত্রীর ভিড় থেকে। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল প্রসন্ন।

এরা সব পরিচিত আশেপাশের গাঁয়ের লোক। একসঙ্গে ভিটেমাটি ছেড়ে বেরিয়েছে। প্রসন্ন এ দলের নেতা। অর্থাৎ সে-ই সবাইকে একজোট করে রাখে, নজর রাখে সকলের উপর। কখন কী করতে হবে, কোনদিকে যেতে হবে—হেঁকে ডেকে প্রসন্নই সে নির্দেশ দেয়।

ওহে ও প্রসন্ন, এবার কী করতে হবে? বুড়ো কামার জিজ্ঞেস করল।

চলো এবার, যে যার জিনিসপত্তর গুছিয়ে নিয়ে চলল। রেলগাড়িতে উঠতে হবে এবার।

ছোট থেকে বড়, সকলেই কিছু না কিছু হাতে বগলে নিয়ে প্রস্তুত। প্রসন্নর হাঁক পড়তেই তাড়া খাওয়া গরুর পালের মতো ছুটতে আরম্ভ করল সব। এ-সব আগে থেকেই বলা কওয়া আছে। যে ঢিলে মারবে পেছিয়ে পড়বে, তবে সে গেল। জায়গা তো পাবেই না, হারিয়ে যাওয়াও সম্ভব।

মুশকিলে পড়ল বাঁকার বউ, তার সঙ্গে প্রসন্নর মেয়ে টগরি আর বুড়ো কামার গোবিন্দ।

বাঁকার বউয়ের পেটে প্রায় দশমাসের শত্রু, ভরা ভরতি পেট। রাখ ঢাক নেই। পেট বেড়েছে যেন জালার মতো, দাঁড়িয়ে পায়ের পাতা দেখতে পায় না আজ দুতিন মাস। কিন্তু জার তার পেটে। লোকে তাই বলে কয়, সন্দেহ করে। ঘেন্না করে লোকে। আজ প্রায় ন দশ মাস বাঁকা মরেছে—অপঘাতে, কালনাগিনীর দংশনে। নিকুঞ্জর মার নাকি হিসাব আঙুলের কড়ায়। এখন জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি। গত বছরের আশ্বিনের মাঝামাঝি মাকালীর গলা থেকে নাগিনী নেমে এসে পরানটা নিয়ে গেল বাঁকার, আর দর্শন দিল না। বাঁকা গেল, বউয়ের আরম্ভ হল ফুসুর ফুসুর গুজুর গুজুর এর তার সঙ্গে। মানো না মানো, এই ভগমানের দেওয়া চোখ দিয়ে সে সব দেখেছে। তার মাস খানেক পরেই তো মাগী পেটে করে নিয়ে এল জার, কোত্থেকে তা কে জানে বলে নিকুঞ্জর মা ঠোঁট বাঁকায়।

প্রসন্ন আধাআধি বিশ্বাস করে কথাটা। কিন্তু বিপদের সময় মানুষকে দেখতে হয়। বিশেষ করে আবার পোয়াতি মেয়েমানুষ। তাই নিজের মেয়ে টগরিকে সে রেখে দিয়েছে বাঁকার বউয়ের পাশাপাশি।

বুড়ো কামার গোবিন্দ কানা। পরেশ আছে তার পাশে। তবু নতুন পথঘাট। তাতে আবার তাড়া আছে। আছে গোলমাল। বগলে কাঁথা আর হাতে বহুদিনের সাবেকি হ্যারিকেন।

—এই, দাঁড়াও দাঁড়াও, নামাও সব গাট্টি বোঁচকা, দেখি কী আছে?

প্রসন্নের দলটা থমকে দাঁড়াল মিলিটারি পোশাক পরা এক দল লোকের সামনে। তাদের সঙ্গে ছিল আরও কয়েকজন সাদা পোশাকের বাবু।

—কিছুই নাই ভাই। প্রসন্ন হাত জোড় করে বলল, আমরা গরিব মানুষ, আমাদের আর কী থাকবে। তাড়াতাড়ি যেতে দিননইলে আবার গাড়িতে জায়গা পাব না।

কিন্তু তা হল না। ন্যাশনাল গার্ডের আর কাস্টমস অফিসারের দল ঝুকে পড়ল বাক্স বিছানাগুলোর উপর। খুলে উলটে পালটে দেখে ছেড়ে দিল। কিন্তু চেঁচিয়ে উঠল নিকুঞ্জর মা। দু ভরি সোনা পাওয়া গেছে তার ছোট টিনের সুটকেশটায়।

কেঁদে চেঁচিয়ে একাকার কাণ্ড করল নিকুঞ্জর মা। তবে গার্ডের লোকটা ভাল ছিল। ছেড়ে দিল সে।

হুটপাট করে এসে সবাই যখন গাড়ি ধরল তখন আর তিলধারণের জায়গা নেই। যেখানেই যায়, জায়গা নেই। সকলেই পাশের কামরা দেখিয়ে দেয়।

ফার্স্ট ক্লাশের একজন খালি গায়ে পৈতাধারী নাদুস-নুদুস আরাম করে বসা যাত্রী বললেন প্রসন্নকে, জায়গা যখন নেই, রাতটা কাটিয়ে কালকে চিটাগাং মেইলে চলে যেয়ো না বাপু।

বহুকষ্টে প্রসন্ন নিজেকে সামলে নিল একটা কটু কথা বলতে গিয়ে। আরও খানিকটা ঘুরে একটা কামরার উপর ঝোঁক পড়ে গেল প্রসন্নর।

ওঠ এখানে, ওঠ সব। হেঁকে উঠল সে।

ভেতরের যাত্রীদের চাপ দেওয়া দরজাটা ঠেলে হুড়মুড় করে উঠতে আরম্ভ করল সব সেই কামরাটায়।

জায়গা নেই, জায়গা নেই! চেঁচিয়ে উঠল গাড়ির মধ্যেকার যাত্রীরা।

আর জায়গা নেই! এ বাঁধভাঙা বন্যা রুখবে কে? প্রসন্ন ঠেলে উঠিয়ে দিতে লাগল সবাইকে। নিকুঞ্জর মা, কামার বুড়ো, পরেশ, অনন্ত, পরির মা, মুক্ত…সবাইকে। কিন্তু টগরি আর বাঁকার বউ কোথায় গেল? এক সোমত্ত মেয়ে আর এক পোয়াতি বউ?

ফিরে দেখে খানিকটা পিছনে বসে পড়েছে বাঁকার বউ, তার সঙ্গে টগরি। অনিশ্চিত আশঙ্কায় কেঁপে উঠল প্রসন্নর বুকটা পোড়া কপাল, বউটা এখানেই বিয়োতে বসল নাকি?

সে যাবার উদ্যোগ করতেই আবার উঠেই দাঁড়াল ওরা। এগিয়ে আসতে আরম্ভ করল আস্তে আস্তে। জয় মা কালী! মনে মনে মা-কে ডেকে প্রকাশ্যে খিঁচিয়ে উঠল, না এলেই হত, এমন যখন অবস্থা।

অত্যন্ত জড়সড় হয়ে পড়ল বাঁকার বউ কথাটা শুনে। ঘোমটার আড়ালে চোখের জলের ঢল নেমে এল যন্ত্রণায় আর অপমানে।

জবাব দিল টগরি, তবে তখন এনেছিলেই বা কেন? পোয়াতি কুকুরেরও ক্ষমতা নাই, তোমাদের সঙ্গে ছোটে।

ফুট কাটল নিকুঞ্জয় মা, পেটে ধরা পাপ, কষ্ট হবে বইকী। নেও এখন উঠে এসো।

নিকুঞ্জর বউ হাসল মুখ টিপে। বিরক্ত হয়ে আস্তে বলল নিকুঞ্জ, প্রসন্নকাকার যত বাজে বোঝা বয়ে বেড়ানো অভ্যাস। ..

পরির বাচাল বিধ্ব যুবতী বউদি মুক্ত বলে উঠল, পেট না ঢাক। মানুষের না অসুরের ছাও আছে পেটে?

তোমরাই অসুরের ছাও পেটে ধরো। বয়স সম্পর্কে জ্ঞান না করেই বলে উঠল টগরি।

ধমক দিল প্রসন্ন, থাক আর চোপা করিসনে, গাড়িতে ওঠ।

উঠলে কী হবে। অন্ধকূপ না হোক, আলো জ্বালানো, দম আটকানো কুপ বটে কামরাটা। মানুষে মালে, ভ্যাপসা গরমে আর একটা বিশ্রী প্যাচপ্যাচানিতে, দুর্গন্ধে আর কলরবে নরকের একটা জীবন্ত দৃশ্য যেন অভিনীত হচ্ছে।

প্রসন্নর দলের কারওরই বসবার জায়গা নেই। একমাত্র বুড়ো কামার দু বেঞ্চির মাঝে কোনও রকমে বসে পড়েছে জোর করে। ভাবটা, আগে বসি—তারপর যা খুশি করো।

ইতিমধ্যে ঝগড়া লেগে গেছে নিকুঞ্জর মার সঙ্গে অন্য একজন সমবয়সী মহিলার। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে পরির মা আর পরির বিধবা বউদি মুক্ত।

প্রসন্নদের দলটাকে আপদের গুষ্ঠি অ্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তাই এই ঝগড়া। কথাটা গায়ে লেগেছে প্রসন্নরও। এমনকি টগরিও জুত করে বসা যাত্রীদের কথায় জ্বলছিল।

তাদের বিপক্ষে ও-দিকে আবার ফোড়ন কাটছিল সিগারেট মুখে একটা চালিয়াত গোছর ছোকরা। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল শহুরে ফ্যাশানের জামাকাপড়-পরা গলায় রুমাল বাঁধা একটি চটকদার মেয়ে। মাঝে মাঝে তার কথায়, কথার মধ্যে দুচারটে ইংরেজি শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। যে জন্য শেষটায় টগরি প্রায় হিংস্র হয়ে আক্রমণ করল মেয়েটাকে।

কী অত ইংরাজি ফলাচ্ছেন আপনি। একটু মুখ সামলে কথা বলবেন।

শাট আপ! অপর মেয়েটির কাছ থেকে এমন অপ্রত্যাশিতভাবে বিদেশি কথার ধমকানিটা এল যে, কামরার সমস্ত মানুষগুলো একযোগে চমকে উঠে ফিরে তাকাল। সব চেয়ে বেশি ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল কামরার বুড়োরা। দৃশ্যটা উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।

কিন্তু টগরির মধ্যে আছে একটা বেয়াড়া গ্রাম্য ধার। সে-ও রুষে ফুঁসে গর্জে ওঠে। ফলে নাটক জমে উঠল।

আগে এসে জায়গা দখল করেছেন বলে বুঝি আর সব মানুষ আপদ হয়ে গেল? টগরি চুপ করে থাকতে পারল না। লজ্জা করে না আপনাদের এ ভাবে ঝগড়া করতে?

ধমক দিল প্রসন্ন।

ইতিমধ্যে গাড়ি চলতে শুরু করেছে।

রাজবাড়ি স্টেশন পেরোতেই বুড়ো কামার হেঁকে উঠল, ওহে প্রসন্ন, পাকিস্তান ছাড়িয়েছি তো?

কথা শুনে হাসির ধুম পড়ে গেল একটা। জবাব দিল নিকুঞ্জ : এখনও অনেক দেরি। তুমি এখন ঘুমুতে পারো কামার।

প্রসন্নর একটা কীর্তি প্রথমে চোখে পড়ল বাঁকার বউয়ের। সে টগরি ঠাকুরঝিকে গা টিপে কথাটা বলল ফিসফিসিয়ে। টগরি দেখল—সত্যি, সকলের দিক আড়াল করা মুখটা প্রসন্নর চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে।

টগরির মনে পড়ল; ভোর রাত্রে বাড়ি থেকে বেরুবার সময় দু চোখ ভরা জল নিয়ে বলেছিল তার বাবা, আমাদের অনেক পুরুষের ভিটা এটা টগরি, তোর মরা মায়ের সব চিহ্ন আটকা রইল ভিটার সঙ্গে।

কেঁদেছিল সকলেই। ঘরে ঘরে বুকভরা একটা আর্তনাদে রাত্রি ভোরের অন্ধকার যেন আরও খানিকটা জমাট হয়ে উঠেছিল! কিন্তু পথচলার লাঞ্ছনায় গঞ্জনায় সকলের কায়া দূর হয়ে গিয়েছিল।

গাড়িতে ওঠার পর সকলেরই মনে পড়েছে একটা উৎকণ্ঠার ছায়া। উদ্বেগে সন্দেহে দ্বিধায় মানুষগুলো ভিড়ের ভিতরে কেমন অস্থিরতা অনুভব করছে। যে দেশে তারা চলেছে, কী রকম সংবর্ধনা অপেক্ষা করে আছে তাদের জন্য কে জানে। কে জানে কোথায় পাওয়া যাবে আশ্রয়। কোথায় গিয়ে খুঁজে নিতে হবে রুজি-রোজগারের বন্দোবস্ত।

কান্না পেল বাঁকার বউয়ের আর টগরির। হাতের চেটো দিয়ে চোখ মুছল গোবিন্দ কামার। নাকি কান্নার সুরে অভিশাপ দিতে লাগল নিকুঞ্জর মানাম গোত্রহীন শত্রুদের-যারা তাকে ভিটা ভাড়া করিয়েছে, দেশ ছাড়া করিয়েছে।

আত্মীয় কুটুম যাদের আছে হিন্দুস্থানে, এ গাড়ির মধ্যে অভিজাত সম্মানটুকু দখল করেছে তারাই। সকলের প্রতি একটা কৃপার আভাস তাদের চোখে।

ইতিমধ্যে সিগারেট মুখে সেই চালিয়াত ছোকরাটি উঠে পড়ে বসবার জায়গা করে দিয়েছে টগরি আর বাঁকার বউকে। রীতিমতো সশ্রদ্ধ আর নরম গলায় অনুরোধ জানিয়েছে। সে সমান রক্ষা করছে টগরিও। ছোকরা ভদ্রলোকটিকে ওর মধ্যেই কষ্টসৃষ্টে পাশে বসিয়ে নিয়েছে সে।

দলের লোক হলেও ব্যাপারটাতে চোখ টাটিয়েছে মুক্তর। সে কটকটে চোখে ছোকরাটির সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে টগরির বসার ভঙ্গিটা লক্ষ করতে লাগল। অসন্তুষ্ট হয়েছে নিকুঞ্জের মা-ও।

মালের উপর মানুষ, মানুষের উপর মাল, ঘামে গরমে দুর্গন্ধে গাড়িটা হু হু করে ছুটে চলেছে একটা ক্রদ্ধ গর্জন করে। জোলো হাওয়া কয়লার গুঁড়ো নিয়ে ঝাপটা খেয়ে এসে পড়তে লাগল যাত্রীদের চোখে মুখে।

বাঁকার বউ ঢলে পড়েছে টগরির উপর। কামার বুড়ো আচমকা এক একটা নিশ্বাস ফেলছে আর বকবক করছে ঘুমঘোরে বকুনির মতো। আর এ দলের নেতা প্রসন্ন সম্পূর্ণ আলাদা একটা মানুষের মতো দল ছেড়ে হাঁ করে বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে আছে। স্বপ্নাচ্ছন্ন, বিহ্বল!

শেষ রাত্রে দিকে কামরাটা নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল, অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল মানুষগুলো। সমস্ত দুশ্চিন্তা দুর্ভোগের ক্লান্তি ভরা চোখের পাতাগুলো ভারী হয়ে এসেছিল।

হঠাৎ আচমকা হট্টগোল শুনে প্রাণ ফিরে পেল গাড়িটা।

দর্শনা।

পাকিস্তানের সীমান্ত স্টেশন।

আবার বোঁচকা বুঁচকি খোলার পালা। কয়েকজন মিলিটারি আর সাদা পোশাকপরা লোক উঠে এল।

সকলের আগে নিকুঞ্জর মা তার টিনের সুটকেশটা এগিয়ে দিল। দেখো বাপু, কিছুই নেই।

থাকবে কী করে। যে দু ভরি সোনা গোয়ালন্দে তার প্রাণ উড়িয়ে নিয়েছিল, সেটুকু মুখে পুরে রেখেছে সে। তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল কামরাটা বে-আইনি মূল্যবান বস্তু কিছু পাওয়া গেল না।

প্রায় দেড় ঘণ্টা পর দর্শনা থেকে গাড়ি ছাড়ল।

যদি রাখেন হরি, তবে মারে কে। এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন।

আর একজন বললেন, আপনার ওই তেঁতুলের হাঁড়িটাতেই বুঝি হরিঠাকুর আছেন?

আজ্ঞে হাঁ, প্রায় দশহাজার টাকার সোনা। ফেলে তো আসতে পারি না। ভদ্রলোক গান ধরলেন একটা।

হাসির রোল পড়ল।

—আর ভয় নাই তো? বলে নিকুঞ্জর মা মুখ থেকে বের করল তার প্রাণ দুভরি সোনা।

ক্রমশ আকাশ ফরসা হয়ে হল।

গাড়ি দাঁড়াল শেষবারের জন্য শেষ নিশ্বাস ছেড়ে।

কলকাতা।

বাক্স বিছানা লটবহর ধুপধাপ করে পড়তে আরম্ভ করল প্লাটফর্মের উপর। –ওরে নিকুঞ্জ, দেখিস জিনিসপত্তর খোয়া না যায়। প্রসন্ন হাঁক দিল।

—পরেশ, কামারকে ধর। হুটপাট করে এখন নামবার চেষ্টা করিসনে টগরি, বোস, ধীরে সুস্থে নামব।

—তবে আমরা এসে পড়েছি? কামার জিজ্ঞেস করল।

ভীষণ কোলাহলের মধ্যে ড়ুবে গেল সে কথা।

পরির মা ল্যাংচাতে আরম্ভ করেছে। কার একটা ভারী ট্রাঙ্ক তার পায়ের উপর পড়ে গিয়ে থেতলে গেছে পায়ের পাতা। আন্দাজে সে ধরে নিয়েছে, ট্রাঙ্কটা মুক্তর।

পরেশের পিসির গা ঘুলিয়ে উঠল। সারারাত যে গুমসনি আর ঝাঁকানিতে কেটেছে। একটা ওয়াক তুলে বলল সে, পরেশরে, আমাকে একটু বমি করবার জায়গায় নিয়ে চল বাবা।

-এখন একটু চেপে রাখো, নামতে দাও আগে। বিরক্ত হয়ে বলল পরেশ।

তা বললে কী হয়! যে ঝাঁকানি গেছে সারাটি রাত। অসুরের মতো গাড়ি, সারাটা রাত দুলিয়েছে। তার মধ্যে কোথায় কাঁচা মাটি আর গাঙের জলের সোঁদা গন্ধ, আর কোথায় টিন তেল কালি ধোঁয়ার বিদ্ঘুটে উৎকট নাড়ি ঘুলিয়ে ওঠা গন্ধ। আর একবার ওয়াক তুলে সেখানেই বসে পড়ল পরেশের পিসি। পরেশ মুখ খিঁচিয়ে একবার বুড়ির মরণ কামনা করল। বেশি কিছু বলাও মুশকিল। এ বিদেশে বিভুয়ে পিসির সম্বলের উপর নির্ভর করেই তাকে থাকতে হবে। কামারকে অনন্তর কাছে রেখে পিসির দিকে এগুলো সে।

মুক্তকে দেখা গেল মাথায়-ট্রাঙ্ক একটা কুলির পিছনে ছুটতে আর চেঁচাতে। দ্যাখো তো ড্যকরা মিনষির কাণ্ড, ব্যাটা ট্র্যাঙ্কটা আমার কেন নিয়ে যাচ্ছে? আরে ওই অজাত ..।

কুলিটা এবার মেজাজ দেখিয়ে ট্রাঙ্কটা প্রায় আছড়ে ফেলল মেঝের উপর। লেও বাবা, লেও। বুঝতে পারল এখানে হবে না কিছু। নতুন খদ্দেরর সন্ধানে ছুটল সে।

প্রসন্নদের দলটা গেটের দিকে এগুতে আরম্ভ করল।

গেটের কাছে বিরাট জগদ্দল পাথরের মতো মানুষ আর লটবহর জমাট হয়ে উঠেছে। ক্রমশ তার পিছনের জমাট বেঁধে উঠতে লাগল মালবাহী যাত্রীদের একটা ঠাসা লম্বা মিছিল।

বাঁকার বউয়ের নাকের পাশে একটা যন্ত্রণার রেখা পড়েছে। হাঁপ লাগছে তার, অসহ্য ভারী লাগছে, পা দুটো। টগরি সাবধানী সান্ত্রির মতো আগলে চলেছে তাকে ঠেলা-ধাক্কার হাত থেকে।

গেটের বাইরে এসেই যতখানি সম্ভব জায়গা জুড়ে যে যার সংসার পেতে ফেলতে ব্যস্ত হল।

—আপনাদের আত্মীয়স্বজন নেই বুঝি কলকাতায়? টগরিকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল সেই ছোকরাটি।

নিজেদের লোকের মতো লাগল টগরির ছেলেটিকে। বলল, না। আপনাদের?

—আমাদেরও কেউ নেই। খুশির আভাস দেখা গেল ছোকরাটির রাতজাগা গর্তে বসা চোখ দুটোতে।

কলকাতার লোকেরা অত্যন্ত বিরক্ত মুখে ভূ কুঁচকে সংবর্ধনা জানাল পুবের এই আশ্রয়প্রার্থীদের। দু-একজন জঞ্জাল বলল, বাঙাল বলতে শোনা গেল কাউকে কাউকে। বাজারের দর চড়বে এদের জন্য—এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হয়ে গেল সবাই।

.

সতেরো দিন পরে।

শিয়ালদা স্টেশনের যাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গাটুকুতে পা ফেলবার স্থান নেই আর কোথাও। আরও লোক এসেছে, সংসার পেতেছে আরও অনেকগুলো পরিবার। শিশুদের মলমূত্র পরিত্যাগ থেকে শুরু করে সবই চলছে। মানুষ মানুষ মালে দুর্গন্ধে, মলমূত্র ইতস্তত বিক্ষিপ্ত নানান জঞ্জাল নরক গুলজার।

—দুইডা পয়সা দেন বাবু। কিছুদিন থেকে সকালবেলা ওই একই কণ্ঠস্বর শোনা যায়, আপনাগো আশায়ই পাকিস্তান ছেড়ে এসেছি, কিছু দেন হিন্দুবাবুরা।

আর প্রসন্ন কানে আঙুল দেয়, মাথার চুলগুলোকে ছিঁড়ে ফেলার জন্য টানা হেঁচড়া করতে থাকে। চারিপাশের লোকজনকে বিস্মিত করে দিয়ে কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখের জল মোছে।

ওই ভিখারির গলার স্বরটা যে বুড়ো গোবিন্দ কামারের। পুঁজি বলতে তার কিছু ছিল না। সামান্য একটু জমির উপর ভরসা করে নিজের ভিটেয় পড়েছিল সে। কিন্তু এখানে, হিন্দুস্থানের এ রাজধানীতে এ ছাড়া তার অন্য গতি বাতৃলে দিতে পারেনি কেউ।

পারেনি প্রসন্ন। বুক ফেটে গেছে, চেঁচিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হয়েছে। তবু পারেনি একবারও বলতে তার গাঁয়ের কামারকে, কামার তুমি ভিক্ষে কোরো না। তার নিজের তো কিছু নেই। সে ছিল সামান্য একটা দোকানের গোমস্তা। এই নিকুঞ্জ জেলা শহরের একটা প্রেসে কাজ করত। পরেশ ছিল এক ডাক্তারের কম্পাউন্ডার। কেউ তারা ভরসা করে বলতে পারেনি কিছু কামারকে।

পরির মার ঘায়ে পচ্ ধরার অবস্থা। পরেশের পিসি সেই থেকে ভূমিশায়িনী। রুক্ষ চুলে, রুক্ষ চেহারায় টগরিকে দেখতে হয়েছে বিধবার মতো।

একটা গভীর শঙ্কা ভয় ভাবনা ছায়াপাত করেছে বাঁকার বউয়ের চোখে। মুহূর্ত গুণছে সে পেটের ওপর হাত রেখে। সময় ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু এমন একটা জায়গাও তো চোখে পড়ে না, যেখানে সে নিশ্চিন্তে জন্ম দিতে পারে তার সন্তানকে। একটুখানি আড়াল, একটু নিরাপদ একটা জায়গা।

সে ভয় প্রসন্নরও আছে। আছে বোধ হয় আরও অনেকের। সকলেই অত্যন্ত বিব্রত হয়ে যায় বাঁকার বউয়ের দিকে চেয়ে। চিন্তিত হয়ে ওঠে সকলেই। নিকুঞ্জের মা বলে পাপের পেট, কিন্তু মেয়েমানুষ বলেই বোধহয় গায়ে তার কাঁটা দিয়ে ওঠে। হায় পোড়া কপাল, মাগী বিয়য়াবে কোথায় এ মেলা বাজারের মধ্যে?

আর বলতে গেলে সব মানুষগুলোই রাত্রিদিন ফঁাচ ফঁাচ করে হাঁচে। জ্বরো গলায় গোঙায়। রুক্ষ নোংরা রোগীদের ভিড় বলে মনে হয়।

কলকাতার লোকেরা চমকে উঠে। চার বছর আগেকার কলকাতাকে মনে পড়ে যায় পুবের এই আশ্রয়প্রার্থীদের দেখে। অর্থাৎ দুর্ভিক্ষের ভিখারিদের কথা।

প্রত্যহ ভোরবেলা পরেশ নিকুঞ্জ অনন্ত আর সেই ছোকরাটি যায় কলকাতার ভিতরে রাস্তায় রাস্তায় গলিতে গলিতে একটা বাড়ির জন্য। আর প্রত্যহ ব্যর্থতায় পরিশ্রমে ঘৃণায় জ্বালায় স্টেশনের বাঁধানো বোয়াকের মাটিতে গা এলিয়ে দেয় ফিরে এসে। কলকাতায় আর একটা কুকুরের নাকি থাকবার জায়গা নেই।

কিন্তু আজ সতেরো দিন পর ওরা ফিরে এসে বলল-চলো, বাড়ি পেয়েছি।

সত্যি? একটা সাড়া পড়ে গেল। ব্যস্ত হয়ে উঠল প্রসন্ন। গা ঝাড়া দিয়ে উঠল পরেশের পিসি। ভগবানকে ডাকল নিকুঞ্জর মা। পরির মা খোঁড়া পায়ে উঠে দাঁড়াল।

বাঁকার বউয়ের চোখে জল এল! হাসি দেখা দিল তার শুকনো ঠোঁটে। তাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেল টগরি! বলল, পোড়াকপালি তোর পয় আছে, ভাগ্যিমন্ত হবে তোর ছেলে।

প্রসন্নদের দলটা উঠল আবার লটবহর নিয়ে।

টগরির পাশে এসে দাঁড়াল সেই মেয়েটি, ট্রেনের সেই কুঁদুলে জায়গাদখলকারিনী। মিনতি করল সে, আপনাদের সঙ্গে আমাদের নেবেন। আমি, মা, বাবা আর একটা ছোট ভাই, আর কেউ নেই।

নিশ্চয়ই!

টগরি হাত ধরল তার।

অপ্রসন্ন হল প্রসন্ন টগরির এ সম্মতিতে। মুক্ত বলল, মেয়েটার ঢং সবতাতেই। নিকুঞ্জর মা বলেই ফেলল, হ্যাঁ, আরও কাঁড়িখানেক জোগাড় করো।

.

স্টেশন এলাকা ছেড়ে প্রসন্নদের দলটা চলল। নারী-পুরুষ-শিশু বৃদ্ধের গৃহস্থালি কাঁধে-মাথায় এক দীর্ঘ মিছিলের মতো চলেছে দলটা।

রাস্তায় লোকেরা দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল এই মিছিল।

মানুষগুলো এ-দিক ছাড়া কি আর দেখতে পারে না? বাঁকার বউ সঙ্কুচিত হয়, আড়াল করে রাখে নিজেকে। কলকাতার সমস্ত লোকগুলো যেন একদৃষ্টে চেয়ে আছে তার দিকে। মাগো, কী বেহায়া!

এ মিছিল দেখে ট্রামের স্পিড় বেড়ে গেল। বাস অনেকটা দূর দিয়ে ছুটে গেল। যাত্রী হিসাবে এ মিছিলকে এড়িয়ে না গিয়ে উপায় নেই তাদের।

আগে আগে চলছে পরেশ, নিকুঞ্জ, অনন্ত আর সেই ছোকরাটি।

কলকাতার মধ্যে ঢুকে নতুন সংশয় এল প্রসন্নর মনে। তার মনে পড়ল টগরির জন্য কাপড় আনতে গিয়ে সেদিনের সেই ব্যাপারটা। একটি মাড়োয়ারির দোকানে ঢুকেছিল সে কাপড় কিনতে। দুচার কথার পর হঠাৎ মাড়োয়ারিটি হেসে জিজ্ঞেস করেছিল তাকে : তুমি বুঝি বাঙাল আছ মশায়?

আর তাই শুনে পাশের কয়েকজন বাঙালি ভদ্রলোক এমন হো হো করে হেসে উঠেছিলেন যে প্রসন্নকেও ছলছল চোখে হাসিচ্ছলে দাঁত বার করতে হয়েছিল একটু।

সংশয় এল তার মনে! কলকাতায় কি সেই সব ভদ্রলোকের পাশেই থাকতে হবে নাকি তাদের?

অবশেষে দলটা এসে থামল অনেক পথঘাট পেরিয়ে বড় রাজপ্রাসাদের মতো একটা বাড়ির সামনে। নিস্তব্ধ নির্জন বাড়িটা। যেন ভুতুড়ে বাড়ি।

—এই বাড়ি? প্রসন্ন থমকে গেল।

—হাঁ, মরতে তো পারব না। জবাব দিল নিকুঞ্জ। খালি পড়ে আছে এতবড় বাড়িটা। প্রসন্নর দ্বিধাচ্ছন্ন চোখ পড়ল বাঁকার বউয়ের উপরে। নেতিয়ে পড়েছে বউটা, যন্ত্রণায় কেমন কালো হয়ে উঠেছে মুখটা। সমস্ত দলটাই অসহ্য ক্লান্তিতে হাঁপাচ্ছে।

আঁতকে উঠল নিকুঞ্জর মা বাঁকার বউয়ের দিকে চেয়ে। টগরি চেঁচিয়ে উঠল, কি, ইয়ার্কি করতে এসেছ নাকি সব? চলো তো চলো।

বাঁকার বউকে নিয়ে এগুলো সে। সঙ্গে প্রসন্নও। তারপরে সমস্ত দলটাই।

হঠাৎ বাড়িটার দরজায় দেখা দিল লাঠি হাতে এক বিরাট চেহারার দারোয়ান ক্যায়া মাংতা? হিয়া ভিউ নেহি মিলতা।

সকলে হেসে উঠল লোকটার কথায়। নিকুঞ্জর মা বলল, গাড়ল কোথাকার! পরেশ বলল, ভিক্ষে করতে আসিনি, বাস করতে এসেছি।

ক্যায়া? হাতের লাঠিটা বায়কয়েক বন্ধন ঘুরিয়ে দিল দারোয়ানটা। কিন্তু থেমে পড়ল নিশ্চল মেয়েপুরুষগুলোর মুখের দিকে চেয়ে। কেমন যেন ভয় করতে লাগল তার এই দলটাকে। পথ ছেড়ে দিয়ে বাইরে ছুটে বেরিয়ে গেল সে।

নিস্তব্ধ প্রকাণ্ড ভুতুড়ে বাড়িটা এতগুলো মানুষের কোলাহল যেন প্রাণ ফিরে পেল। জেগে উঠল রাক্ষুসে মায়াপুরী এক লহমায়। প্রতিধ্বনির সাড়া পড়ল খিলানে খিলানে। পায়রাগুলো ডেকে উঠল বক বকম করে।

অপেক্ষাকৃত একটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঘরে টগরি শুইয়ে দিল বাঁকার বউকে। নিকুঞ্জর মা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ঢুকল সেই ঘরে। মুখ বিকৃত করে বলল, কই লো মুক্ত! জাঁকিয়ে বসল সে বাঁকার বউয়ের পাশে।

মুক্ত তার ট্রাঙ্ক খুলে বার করল এক গাদা পুরনো কাপড়, আর ছোট্ট লাল টুকটুকে একটি জামা।

অসুরের ছাওয়ের জামা-ই বটে! বলে মুক্ত হেসে ছুড়ে দিল জামাটা বাঁকার বউয়ের গায়ে। বলল, নে, ছিল। সেই কবেকার! পেটের আমার পেথথম আর শেষ শব্দুর। কিন্তু রইল না। বলতে বলতে মুক্তর চোখ দুটো ছলছলিয়ে উঠল।

আরও নিশ্চিন্তে এলিয়ে পড়ল বাঁকার বউ। ব্যথায় নীল ঠোঁটে হাসি লেগে লেগে রয়েছে তার একটু।

—নে বাপু, আর ভোগাসনি। খিঁচিয়ে উঠল নিকুঞ্জর মা। আলতো করে একটু হাত বুলিয়ে দিল আদর করে। চোখের কোণে টলমল করে কয়েক ফোঁটা জল। বলল, মায়ের নাম নে। কী কবি, কপালের ভোগান্তি তো কেউ রুখতে পারে না!

মুক্ত বলল, যা টগরি, বাইরে যা। তোর বাবাকে ছটফট করতে বারণ কর। বলে দরজাটা বন্ধ করে দিল সে।

প্রকাণ্ড বাড়িটার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে বিরাট দলটা। সকলেই ব্যস্ত, কিন্তু কথা বলছে আস্তে। উকুণ্ঠিত হয়ে আছে সব প্রসূতির ঘরের দিকে।

এই সময়ে আবার একটা হট্টগোল উঠল। অনেকগুলো ভারী বুটের শব্দ কাঁপিয়ে তুলল বাড়িটা। সশস্ত্র পুলিশের একটা দল হলঘরে এসে ঢুকল।

প্রসুতির ঘরে শিশুর কান্না শোনা গেল। যে প্রসবের ভূমিতে জন্ম নিয়েছে রাজারাজড়ার ছেলেরা, বিনা দ্বিধায় বাঁকার বউ সেখানে তার সন্তানের জন্ম দিল।

নিকুঞ্জর মা দরজা খুলে একগাল হেসে বলল, ছেলেটার মুখে বাঁকার মুখ একেবারে বসানো।

সত্যি? প্রথানুযায়ী কে যেন উলু দিয়ে উঠল।

উরে বাবারে। কে যেন আর্তনাদ করে উঠল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে।

সেই সঙ্গে একটা ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা গেল : নিকালো বাহার।

বন্দুকধারী পুলিশেরা এসেছে থানা থেকে—এ বাউণ্ডুলে ঘরছাড়া ভিটেছড়া বদমাশগুলোকে তাড়িয়ে দিতে।

—এমনিতেও মরতে আছি, হয় মরব। কঠিন গলায় বলল নিকুঞ্জ।

তবু আমরা এ বাড়ি ছাড়ব না। যাব না পথে ঘাটে মরতে। বলল প্রসন্ন। এগিয়ে চলল সে হলঘরের দিকে। পিছনে চলল পরেশ, নিকুঞ্জ, অনন্ত, সেই ছোকরাটি। টগরিও চলছে। আস্তে আস্তে সমস্ত মানুষগুলোইে লটবহর রেখে চলল তাদের সঙ্গে হলঘরের দিকে।

মোকাবিলা করার মতো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠেছে সকলের ক্লান্ত রুক্ষ মুখগুলো। শিশু, বৃদ্ধ, মেয়ে পুরুষ সবাই ভিড়েছে—চলেছে, এ বাড়ি তারা ছাড়বে না, মরবে না, সে কথা জানাতে।

নতুন বাচ্চাটা তারস্বরে চেঁচাতে লাগল। আর তারই প্রতিধ্বনি উঠল রাজবাড়ির প্রতিটি কোণে, প্রতিটি খিলানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *