শেষ মেলায়

শেষ মেলায়

প্রথম দেখা পলাশপুরে।

মেলার পুবে—যেখানে গোধূলির লাল আলো যাবার আগে থরথর করে কাঁপছিল সেইখানে সেই মনিহারি দোকানটার পাশে। গোলা খড়ি-মাটির পোঁছ দেওয়া মাটির হাঁড়ি আর বাসনগুলোতে একাগ্রচিত্তে রঙিন তুলির চিত্রাঙ্কন করে চলেছিল মোহন। জৌলুস বাড়াবার খাতিরে সামনে মাদুর পেতে ছড়িয়ে রেখেছিল– কিছু রঙিন কাচের চুড়ি।

নতুন ধানের আর তেলেভাজার কড়া ঝাঁজের গন্ধে, গোধূলি আলোর লুকোচুরি খেলা রঙিন চুড়ির গায়ে– সমস্ত কিছু মিলিয়ে মেলাটাই একটা গভীর আকর্ষণে টানছিল গাঁয়ের ঘরের আটপৌরে মানুষগুলোকে। সমস্ত আবহাওয়া যেন কী এক গভীর রসাবেগে চঞ্চল।

হেঁসেলের আর মাঠের কাজ না হোক, ব্যস্ততার কমতি নেই। কমতি নেই চেঁচামেচির, কারণে অকারণে ভিড়ের মাঝে হারিয়ে যাওয়ার অসংখ্য শঙ্কা, ব্যাকুলতা। লাভ ক্ষতির হিসাবের গোলমাল ছাপিয়ে ওঠেনি প্রীতি আর প্রেমের কলকাকলীকে। চিলের ছোঁ-মারা উধাও খাবারের জন্য প্রচণ্ড কান্না।

গোধূলির স্বল্প ছায়ায় ভিড়ের বাড় ঝিমিয়ে এসেছে। আগামীকালের কাজ সারছে মোহন—ছড়ানো চুড়ি আর আঁকাজোকা মাটির বাসনের মাঝখানে। মাঝে মাঝে খদ্দেরদের সঙ্গে কথা বলছে, জিনিস দিচ্ছে, পয়সা নিচ্ছে আর কোলের উপর হাঁড়ি নিয়ে ঝুঁকে পড়ছে তুলি নিয়ে।

কত সে অসংখ্য পট—মাটির বাসনের গায়ে। বাদ যায়নি অনাদি আমারের কামারশালা, ঘরের পিঠে বাবুদের জমিতে মানু শেখ আর অবিলাসের (অবিনাশ) নিরেন দেওয়া মাটিকাটার ছবি। খাঁদুপিসির ঢেঁকি-ঘরের পটও উঠেছে পাঁচ-পো হাঁড়িটার সরায়। কিন্তু কী সর্বনাশ! খাঁদুপিসির ছেলের বউয়ের ঘোমটা খসা মূর্তিখানিও যে উঁকি মারছে– সরাখানির পটে! মনে মনে হেসে ওঠে মোহন। দেখলে পরে খাঁদুপিসি ঘাড় মটকে ছাড়বে।

বিলান দেশের ভাতের হাঁড়িটার গায়ে মা লক্ষ্মীর বাহন পাচার চোখ দুটো আঁকতেই খিলখিল হাসির শব্দে চমকে উঠল মোহন।

প্যাঁচার মুখ হলেন, কি মানুষের?

একদল মেয়ের ঝাঁক থেকে ডাগর কটা মেয়েটা বিদ্রূপ ভরে ঠেটি বাঁকিয়ে তেরছা করে চাইলে মোহনের দিকে। কথা শুনে সবাই হেসে উঠে ঢলে পড়ল এ ওর গায়ে।

কপাল থেকে চুলের গোছাটা সরিয়ে কটমট করে ফিরে তাকাল মোহন। তার কালো অঙ্গ চকচক করে উঠল গোধূলির আলোয়। পাঁশুটে তুলির আঁচড় পড়ে গেল মা-লক্ষ্মীর কোল ভরা ধানের শিষে।

পরমুহূর্তেই মোহন হেসে উঠে বলল, প্যাঁচা ক্যানে, মানুষই বটেক। মিলিয়ে দেখে লাও ক্যানে তোমার মুখের সঙ্গে!

সুভদ্রার কটা মুখ মুহূর্তে পাংশু হয়ে উঠল। সেই ক্ষণেই একটা কঠিন জবাব মুখে না এসে ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল শুধু। ধারালো কাস্তের মতো চোখ দুটো চকচক করে উঠল।

সঙ্গিনীরা সব চকিতে সন্ত্রস্ত ভীত মুখে একবার মোহন আর একবার সুভদ্রার দিকে তাকায়। একটা ভীষণ অঘটনের জন্য যেন সবাই প্রস্তুত।

অমনি হাসিখুশি মোহনও যেন চকিতে গোঁয়ার গোবিন্দ হয়ে উঠেছে। এমনিই একটা তিক্ত হাসি ঠোঁটে সে কটকট করে অকিয়ে রইল সুভদ্রার দিকে।

কিন্তু না। সুভদ্রার পান খাওয়া রক্ত-রেখায়িত ঠোঁট ধনুকের ছিলার মতো বেঁকে উঠেছে বাঁকা-কঠিন হাসিতে। বলল, আমি হলেন মহারাজ–বলে হবু’র ডোবার ব্যাংটা, বিষ্টা জলে মুখ দেখে কয়—হবু যেন চ্যাংটা। গিরস্তি বউদের ছামুতে জিজ্ঞেস করে লাও ক্যানে উটে কার মুখ। বলে, দাঁতের মধ্যে এটোলি কত রঙ্গ দেখালি। চল লো-চল, ব্যাং নাগ (রাগ) করলে সাপের প্যাটে যায় মানুষের পা চাপা পড়ে। খিলখিল করে হাসতে হাসতে মেয়ের দল এগিয়ে গেল।

মোহনের হাত পা কানে কে যেন গেল আগুন ছড়িয়ে দিয়ে। ইচ্ছে করল ছুটে গিয়ে ওই কা দেহ ধুলোয় ফেলে বে-পটকা যাঁড়ের মতো এলোপাথাড়ি ঠেঙায়। কিন্তু নিজের গাধর নয়। বিদেশ। তা ছাড়া পরের মেয়ে বহুড়ি। শুধু চেঁচিয়ে উঠল, গিরস্তি বউ কি বাজার বউ ঠাওর করতে লারলাম। সময় বুঝে বুঝিয়ে দিয়ে যেয়ো ক্যানে?

মেয়েদের দল থমকে দাঁড়াল। আবার ফিরে গেল তাড়াতাড়ি।

এখানে সেখানে লক্ষ আর হারিকেন জ্বলে উঠছে। ঘনিয়ে আসছে আধার। মেলার উত্তরে ঢোলকে ঘা পড়ছেড়ুম ড়ুম ড়ুম্। গাওনা বাজনা হবে, ডাক আসছে আসরের।

মোহন সব গুটোতে আরম্ভ করে। কথাটা বলে বড় খুশি হয়নি সে। শান্তি পায়নি। এখন মনে হচ্ছে, এমন কথা না বললেই বুঝি ভাল হত। তবু কটা মেয়ের দেমাকের কথা ভেবে মনে মনে হাসতে হাসতে চুড়িগুলো তুলে তুলে একটা সাজিতে ভরতে লাগল সে। আজকের মতো বেচা কেনা এখানেই শেষ। এখন শুধু ভোলা থাকবে খাবারের দোকানগুলো। লোকজন গান বাজনা শুনবে—খাবার কিনবে, খাওয়াবে—খাবে। আর খোলা রইল কাপড় মনিহারির দোকান। নতুন করে খুলতে থাকল উত্তরের দরমা ছাওয়া খুপরি ঘরগুলো। বেশ্যাদের ঘর। গাওনা শুনে সকলে .. আসবে ফুর্তি করতে। গঙ্গা-সার দোকানে জ্বলে উঠেছে মাঝারি ডে-লাইটখানি। সারা মেলার সমস্ত আকর্ষণ তখন ওই ডে-লাইটের আলোর ঝিলিমিলি নানান রকম বোতলগুলোর গায়ে। মোহন সব গুছিয়ে তুলে উঠবে এমন সময় একদল লোক এসে হাজির। সঙ্গে তাদের সেই মেয়েদের দলটা। সকলের আগে কোমরে হাত দিয়ে বেঁকে দাঁড়াল সুভদ্রা। দুটুকরা অঙ্গারের মতো দুটো চোখ দিয়ে একবার মোহনকে দেখে বাঁকা ঠোঁটে হেসে বলল, বুঝতে পারলে বাজারি বউ কি গিরস্তি, তাই বুঝতে আসলাম। ই মানুষটা বুলে আমাদের বেবুশ্যে। বলে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল মোহনকে। যেমনি বলা অমনি জোয়ান মানুষগুলো হিংস্র জানোয়ারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল মোহনের উপর। চলল কিল চড় লাথি নিষ্ঠুরভাবে। তছনছ করে দিল চুড়ি হাঁড়ির বোঝা।

একজন চুলের মুঠিতে একটা হেঁচকা টান মেরে বলে উঠল, শালা তু গিরস্তি বহুড়ি ঝিকে বলিস বেশ্যা?

মনিহারি দোকানের মালিক হেঁকে উঠল, আরে এই, মারছিস কেন?

এবার সবাই ছেড়ে দেয়। বলে, গালি দিয়েছে শালো মেয়ামানুষদের। মনে রাখিস ইটা পলাশপুরের মেলা। মেয়েমানুষদের ইজ্জত আছে।

মোহনের কষ বেয়ে চাপ চাপ রক্ত গড়িয়ে এল। নীচের ঠোঁটের মাঝখানটা কেটে ফাঁক হয়ে গেছে খানিকটা। বাঁ চোখের উপরটা ফুলে নীলাভ গুলিমতো হয়ে উঠেছে।

এক অদ্ভুত হাসি নিয়ে ঠোঁটের রক্ত মুছতে মোহন ফিরে তাকাল সুভদ্রার দিকে। সুভদ্রাও তার দিকেই তাকিয়েছিল।

ভাঙা-চোরা জিনিসগুলোর দিকে দেখে ভূ টান করে রক্তাক্ত ঠোঁটে হাসি নিয়ে ফিরে তাকাল সুভদ্রার দিকে আবার। ততক্ষণে সুভদ্রার অঙ্গারের মতো চোখ দুটো কে যেন এক গাদা জল ঢেলে নিভিয়ে দিয়েছে। বুকের মধ্যে এক ভীষণ ঝড়ের আবেগে তাঁর ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল থরথর করে। চকিতে পিছন ফিরে ঝড়ের বেগে সে চলে গেল।

আর সবাই খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল। আসর জমানোর ঢাক পেটানো তখনও চলছে। আসর থেকে হরিবোল ধ্বনি উঠেছে। বহু লোকের একটা চাপা কোলাহল আসছে ভেসে।

মোহন মনিহারি দোকানের বিচ্ছুরিত আলোয় হাতিয়ে দেখল। কোনও বস্তুটাই আর আস্ত নেই। ভাঙা-চোরা জিনিসের ভিতর থেকে পয়সার থলিটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল সে।

অদূরেই দৈনিক ছ পয়সা ভাড়া করা চালা-ঘরটায় এসে লক্ষ জ্বালিয়ে রেখে গামছা নিয়ে বেরুল সে। ঘরের পেছনেই একটা পুকুর। সেখানে ড়ুব দিয়ে স্নান করে নিল।

আসরের ঢাক থেমেছে। গান ভেসে আসছে দু-কে কলি। আসরের বাহবা ধ্বনিও শোনা যাচ্ছে দু চারটে।

মোহন কাপড় ছেড়ে ফতুয়াটা গায়ে দিয়ে ঘর বন্ধ করে বেরুল।

চৈত্র রাত্রি। একটু একটু গরম পড়েছে বটে, মিঠে মিঠে হাওয়াও আছে। পৃথিবীর নিরেট অন্ধকারকে রহস্যময় করে তুলেছে ছোট্ট এক ফালি চাঁদ। কোনও কিছুই স্পষ্ট নয়—তবু সব কিছুই যেন মূর্তি ধরে সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

মোহন খানিকটা এগুতেই তার দুহাত দূরে একটা মূর্তি দেখে সে থমকে দাঁড়াল। ঘোমটা ঢাকা মূর্তি। মোহন জিজ্ঞেস করল, কে হে?

তুমি কে বটে?

মেয়েমানুষের গলা শুনে একটু বিস্মিত হলেও চকিতে একটা সন্দেহ খেলে গেল তার মনে। বলল, আমি মোহন, দরিদ্দ চিত্তকর। তুমি কে বটে?

পলাশপুরের লাগাত নলি গড়ের গণেশ কামারের মেয়্যা সুভদ্রা আমি। সুভদ্রা ঘোমটা খুলে ফেলল। একবার মোহনের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে।

সুভদ্রাকে চিনতেই মোহনের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ইজ্জত বাঁচাবার লেগে কি আবার লোকজন ডেকে নিয়ে আসছ নাকি?

কথাটা শেষ করবার আগেই বিস্ময়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল মোহন। স্পষ্ট দেখল সুভদ্রার চোখের কোণে দু ফোঁটা জল চকচক করছে।

আঁচলের গিট খুলে কয়েকটা টাকা বাড়িয়ে ধরল সুভদ্রা। অপরাধ হয়েছে, মাপ করে দেও। টাকা কটা লিয়ে মাল কিনে লিয়ে আসো।

সি হবেকনি! মোহন আবার হেসে উঠল। দরিদ্দ হলেও তোমাদের প্যাঁচার মন খাটো লয় গো গণেশ কামারের মেয়্যা। ও টাকা তুমি ফিরিয়ে লাও।

না! সুভদ্রা দু পা এগিয়ে এল। টাকা না লিলে বুঝব তুমার রাগ যায় নাই। ক্ষ্যামা করোটাকা লাও। গোঁসাইয়ের আখড়ায় বাপ ভায়ের ছামুতে আসর থেকে পালিয়ে আসছি, দেরি হলে খোঁজ পড়ে যাবে।

মোহন তবু জোড়-হাতে অনুনয় করে, পা চাপা না পড়লেও—ও টাকা লিলে কিন্তু ব্যাং-এর মিত্যুর সামিল হবেক।

আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে বলল সুভদ্রা, জন্ম বেধবা, বাপ ভায়ের গলগ্রহ; আমার কপাল খারাপ, তাই আমার মুখও খারাপ। মানুষে বেথা দেওয়া স্বভাব। মাপ করো–টাকা লাও।

তোমারে কু-কথা আমিও বুলছি। ও শোধবোধ হয়ে গেছে।

না! গলা ভেঙে এল সুভদ্রার! পর-পুরুষের ছামুতে অ্যামন করে কথা বুলি নাই কখনও, বুকের মধ্যে কাঁপন লাগছে। দেরি করো না, লাও। পয়সা দিয়ে আমার অপরাধ শোধ হবে না, তবু লিতে হবে। আপত্য করো নালাও। বলে চট করে টাকা কটা মোহনের ফতুয়ার পকেটে গুঁজে দিয়ে পিছন ফিরে এগিয়ে গেল সে।

ক্ষণিক বিমুঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে মোহন অনুচ্চ গলায় ডাকল, ওহে ও নলিগড়ের মেয়া, একটা কথা শুনো!

দূরে দাঁড়াল সুভদ্রা। মোহন দু এক পা এগুতে বলল, চৈত-সংক্রান্তির দিন কোপগড়ের মেলায় যেয়ো। তোমার প্যাঁচার নিমন্তন্ন রইল। যাবা তো?

দূর থেকে হালকা সুর ভেসে এল দুবার, আচ্ছা, আচ্ছা! আখড়ার পথে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। এদিকে মেলাতে গান জমে উঠেছে।

সেদিকে আর মোহনের যেতে ইচ্ছে করল না। ফতুয়ার পকেটে টাকা কটায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইল সে।

.

মোহন সুভদ্রার আবার দেখা হল কোপগড়ের মেলায়।

চৈত্রের ঝোড়ো হাওয়ায় এলোথেলো চুলে একমুখ ধুলো নিয়ে এসে দাঁড়াল সুভদ্রা মোহনের সাজানো দোকানের ধারে। বড় লজ্জা করছে সুভদ্রার। মনে হচ্ছে যেন বড় বেশি বেহায়াপনা করে ফেলেছে সে কোপগড়ে এসে, তাই ভাল করে তাকাতে পারে না মোহনের দিকে।

আরে বসো বসো! মোহন তাড়াতাড়ি হাঁড়ি চুড়ি সরিয়ে একটু জায়গা করে দেয়। ওরে বাবা প্যাঁচার কী ভাগ্যি! কার সাথে আসলে?

সুভদ্রা বসে না। বলে, বাপের সাথে! আসতে কি চায়? বলে বুড়ো হয়েছি, অত দূরের মেলায় যেতে পারবেক নি। অনেক কয়ে লিয়ে আসছি। হাতুড়ি বাঁটালোর দোকান খুলবে বলে। হুই পশ্চিম তরফে দুকান লিয়ে বসেছে। বলতে বলতে ধুলোমাখা কটা মুখ তার লাল হয়ে ওঠে।

মোহন তাড়াতাড়ি খাবারের দোকান থেকে দুটো মিষ্টি আর এক ঘটি জল এনে দেয়। বসো ক্যানে, খানিক জল খাও?

সুভদ্রার আরও লজ্জা বাড়ে। বলে, না না, ইসব ক্যানে আনলে?

তা বললে কী চলে? তুমি ব্যাং-এর অতিথি, মিষ্টি মুখ করতে হবেক নি?

সুভদ্রা গম্ভীর হয়ে বলে, তবে তুমার রাগো যায় নাই বলো? ব্যাং প্যাঁচা বুলতেছ বারবার?

মোহন তাড়াতাড়ি বলে জোড়হাতে, আহা, রাগ, করো না নলি গড়ের মেয়্যা। বড় ভাল লাগে বুলতে—তাই। রাগো তো বলব না।

চোখাচোখি হতেই আবার দুজনে হেসে ফেলে। সুভদ্রা বলে, হাত মুখ ধোবার লাগে, না হলে সোয়াস্তি নাই।

বেশ। চলো ক্যানে নদীতে যাই। দাক্ষিনে পলকের রাস্তা। যাবা?

চলো। বাপ দেখলে কিন্তুক

মোহন ততক্ষণে হাঁক পাড়তে শুরু করেছে; আরে ও গহর কথা গেলছিস?

বারো তেরো বছরের একটি ছেলে আসতে সে বলে, এট্টু বস, নদী থিকে আসছি বুঝলি?

ছেলেটা সম্মতি জানিয়ে গদিতে বসে।

পথে চলতে চলতে সুভদ্রা বলে, ঘর কি তুমার এই কোপগড়েই?

না! ভিটে খানিক আেছে তুমার গিয়ে বোলপুরে। কিন্তু আমি বারোমাসই ঘুরে ঘুরে বেড়াই মেলায় বাজারে। প্যাটের লেগে বারামাস কাটে। তা—

দুশ্চিন্তাটাও সঙ্গে সঙ্গেই মনে উদয় হয়। বলে, মানুষ জনার যা অবস্থা হবার লাগছে, মেলাগুলান সব পড়ে যাবে। চাষ আবাদ নাই, পরে শহরকে যেতে হবে কুলির কাম ধরতে। বলে মোহন হেসে ওঠে।

ক্ষয় পাওয়া ক্ষীণ নদী। সুভদ্রা হাত মুখ ধোয়। কানের পিঠে মাথায় একটু জল দিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে নেয়।

মোহন খানিকটা দূরে বসে হঠাৎ এক অজানা আবেগে হেঁড়ে গলায় গান গাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় চেঁচিয়ে ওঠে, তুমি কে পাগলিনী হে, বহুদিনের চেনা বলে মনে হতেছে!..

হাত মুখ ধুতে ধুতে সুভদ্রার কটা মুখ আবার লাল হয়ে ওঠে। লজ্জার আবেগে সাদা সাদা দাঁত দিয়ে সে নীচের ঠোঁটটা চেপে ধরে।

হাত মুখ ধোয়া হয়ে গেলে চলতে চলতে হঠাৎ সুভদ্রা বলে, তুমি বেয়া করো নাই?

মোহন হা হা করে হেসে ওঠে। বলে, পাইসা কুথা যে, বেয়া করব? বাপেরা কি দেখে মেয়্যা দিবে বলে? জমি নাই, মেলায় ঘুরবার লেগে মেয়্যা কানে দিবে লোকে?

একটু চুপ করে থেকে বলে, সাথে সাথে ঘুরবেক, অ্যামন মেয়্যা এট্টা পেলে পরে বেয়া করতে-সাধ যায়। বলে চোখ বাঁকিয়ে চায় সুভদ্রার দিকে।

হঠাৎ কীসের এক আঘাতে সুভদ্রার বুকের মধ্যে আলোড়ন ওঠে। পদবিক্ষেপগুলো অসমান আঁকা বাঁকা হয়ে পড়ে। কিন্তু কিছু বলে না।

মোহন আবার বলে, দুচার পইসা জমাতে হবেক, বেয়া এট্টা করবার লেগে। বয়স হল তো? বলে সুভদ্রার দিকে চেয়ে বলে, আহা, ঢ্যালা মাঠে চলো ক্যানে, আলে উঠে আসো।

নিজেকে সামলে সুভদ্রা তাড়াতাড়ি আলে উঠে আসে। কিন্তু মোহনের হাসি ভরা মুখের দিকে আর চাইতে পারে না। মেলায় এসে মোহন মিষ্টি দুটো সুভদ্রার হাতে দেয়। এটু জল খেয়ে নাও, প্রাণটা ঠাণ্ডা হবে। বলে ঘটিটা বাড়িয়ে দেয়।

সুভদ্রা অন্যদিকে ফিরে মিষ্টি খেয়ে জল খায়।

মোহন বলে, গহরা, এট্টা পান লিয়ে আয় ক্যানে। বুলিস মিঠে পান দিতে।

না না বাধা দেয় সুভদ্রা। পান খাবেকনি আমি?

বলে উঠে দাঁড়াতেই বছর তিনেকের একটি উলঙ্গ হৃষ্টপুষ্ট ছেলে এসে মা, মা বলে তাকে জড়িয়ে ধরে।

অমা গো! সুভদ্রা তাকে বুকে তুলে নেয়। বলে, দেখো, মা হারিয়ে ফেলে, খুঁজে বেড়াচ্ছে। আহা, এটু খানিক খুঁজে দেখোনা ক্যানে, ছ্যালের মা-টা গেল কুথা?

মোহন হাঁ করে খানিকক্ষণ সুভদ্রাকে দেখে হঠাৎ বলে, তুমার ছালে পিলে নাই–না?

অকস্মাৎ এমন একটা প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না সুভদ্রা। জবাব দিতে গিয়ে গলাটা বুজে এল তার। ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল।

আহা-হা, কাঁদো ক্যানে? ম্লান হয়ে যায় মোহন। বলে, ভুল করে দুঃখ দিয়েছি, কেঁদো না।

এমন সময় একটি মেয়েমানুষ পাগলের মতো ছুটে এসে সুভদ্রার বুক থেকে ছেলেটাকে ছোঁ মেরে তুলে নেয়। বুকের ধন বুকে পেয়ে এক ঘা কসিয়ে দেয় ছেলেটার পিঠে। সুভদ্রাকে পেয়ে, হারামজাদা ছালে আমার প্রাণ উড়িয়ে নেছিল। বুকটার মধ্যে কেমন করতে লেগেছে হারিয়ে থেকে। ভাল মানুষের কাছকে আসছিল, না হলে কুন ঘাটে যেতাম বলো।

ফিরে যেতে যেতে বলে, চ তোর বাপ কোথা গেল আবার দেখি।

মেলার জনারণ্যে মিশে গেল তারা। কিন্তু মোহন আর সুভদ্রা কী এক অব্যক্ত বেদনায় যেন মূক হয়ে রইল।

খানিকক্ষণ পর মোহন বলে, দুকখু করো না সুভদ্দা। তুমার কোলে ছালে বড় ভাল লাগল তাই বুলছি। ভগবান বড় নিদ্দয়, না হলে

কথা শেষ না করে সে সুভদ্রার নতমুখের দিকে তাকিয়ে আবার বলে, এট্টা বেয়া ক্যানে করো না তুমি?

দূর! সুভদ্রার মুখ আবার রাঙা হয়ে ওঠে।

দূর ক্যানে, ল্যায্য কথা বুলছি। বেধবা তো কী, পানে (প্রাণে) এট্টা সাধ আহ্লাদ তো আছে?

আচ্ছা, আচ্ছা। প্রসঙ্গটা চাপা দিয়ে ওঠে দাঁড়ায় সুভদ্রা। আমি চলল্যাম। দেরি হলে বাপ হামলে উঠবেক।

শেষকালে আবার একটু ঠাট্টা না করে পারে না মোহন। বলে, শুনো, এটা শোলক বলি। তাকের উপর শিশিটা লড়ে চড়ে পড়ে না। যে না বলতে পারে সে জন্ম কানা। মানে কী হল-জবাব দিয়ে যাও ক্যানে?

জবাব দেওয়ার আগেই সুভদ্রার চোখ দুটো হেসে ওঠে, বলে, চৈকের মণি (চোখ) হল।

মোহন হেসে বলে, তুমার নয়ন দুখানি ঠিক তাই। পাগল কালো ভোমরার পারা, লড়ে চড়ে, ভয় লাগে-পড়ে বুঝি যাবে।

আ মাগো! সুভদ্রা খিলখিল করে হেসে ওঠে। তুমার কৈ ভাল নয় বাপু! কবিয়াল নাকি তুমি?

হো-হো করে হেসে উঠল মোহন। তাড়াতাড়ি সুন্দর চিত্র করা সরা ঢাকা হুঁড়ি তুলে নিয়ে বলে, তুমার নেগে কিছু ব্য রাখছি, লিয়ে যাও। আপত্য করতে পারবে না। লাও।

কী আছে?

সি তুমি দেখে লিয়ো। আর এট্টা কথা

ব্যাকুল আবেগে যেন কেঁপে ওঠল মোহনের গলা—কোপগড়ের মেলা আজই শ্যাষ। মাঝে বোশেখ আর জষ্টি, যদি দিনকাল ভাল থাকে, মনে যদি থাকে প্যাঁচাকে, আষাঢ় মাসে রথের মেলায় জয়পুর হাটে আইসো। আসবা তো?

এমন করে কেন মোহন বলে! বুকটার মধ্যে আথালি-পাথালি করে সুভদ্রার। ঘাড় কাত করে বলে, আসব।

তুমার বাপকে লিয়ে এইসসা, তার ছামুতে অনেক কথা আছে।

সুভদ্রা এগুতে আরম্ভ করে। মোহন পাশে পাশে চলে। আর চির খাওয়া মোটা ঠোঁট দুটো কাঁপে। কী যেন বলতে চায়! শেষটায় না থাকতে পেরে বলেই ফেলে, একখান ছোটমোটো ভিটে আর মা দুর্গের কোলে গণেশ ঠাকুরের পারা একটা ছালের বড় সাধ আমার, সি কথাটাই তুমার বাপকে বুলব সুভদ্দা।

ঠিক এই সময় একটা গোঁ-গোঁ শব্দে চমকে উঠল তারা।..কোপগড়ের তেপান্তর ভেঙে দুরন্ত কাল-বৈশাখীর ঝড় হু-হু করে ছুলে এল। ধুলোয় চোখ ভরে দিয়ে অন্ধকার হয়ে উঠল মেলা। মোহন চেঁচিয়ে উঠল, মনে রেখো রথের মেলা, জয়পুরহাটে।

সুভদ্রার উত্তর হাওয়ায় উড়িয়ে নিল। হাওয়ার টানে কথা শোনাল একটা আর্তনাদের মতো।

.

তারপর গেল কাল-বৈশাখী, গেল কাট-ফাটা জ্যৈষ্ঠ ধরিত্রীর বুক চিরে রন্ধ্রে রন্ধ্রে আগুন ভরে দিয়ে। তারপরেই এল আষাঢ় দাদুরি ডাহুকির প্রাণে সাড়া জাগিয়ে। প্লাবনের প্রথম সঙ্কেত দেখা দিল আকাশের গাঢ় কালিমায়।

সুভদ্রা এল জয়পুর হাটের মেলায়। মোহন গেয়েছিল—তুমি কে, পাগলিনি হে! সেই পাগলিনির মতোই এল সুভদ্রা আষাঢ়ের ঝড় জল মাথায় করে। মোহনের সে স্বপ্ন আজ তারও বুকে দানা বেঁধে উঠেছে, ছোটমাটো একখান ভিটে। আর গণেশ ঠাকুরের পারা একটি ছালে। দুমাসের প্রতিটি ক্ষণে নিরালায় ঝামেলায় শুধু সেই কথা। কথা নয়, কথা আজ গান হয়েছে হৃদয়ের, ধ্যান হয়েছে জীবনের।

মোহন হেসে অভ্যর্থনা জানাল, আসো আসো। আজকে আমার মেলা জমল। কী ভাগ্যি ভুলে যাও নাই?

কিন্তু সুভদ্রা চমকে উঠল মোহনকে দেখে। একী শরীল হয়েছে তুমার?

ভাবছ ক্যানে? মোহন হেসে বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে। অনিন্দার ব্যানো হয়েছিল—সেরে যেছে। কথায় বলে, কষ্ট না করলে কেষ্ট মিলবেনি। পাইসা জমাতে লাগছি।

সুভদ্রা হাসতে পারে না। মোহন আবার বলে, ভিটে সমসার (সংসার) করতে পাইসা চাই না—একটুকুন মাটি করতে হবে, নইলে ঘুরতে হবেক মেলায় বাজারে।

সুভদ্রা বলে, তা তুমার শরীল এমন হয়ে যেছে ক্যানে? নিজেকে দুঃখু দাও তুমি।

পাগল। মোহন হো-হো করে হাসে, দিনকালটা দ্যাখেছ? বিলান দ্যাশে শুনি দুর্ভিক্ষ আসছে, শরীলের জল্লস থাকবে ক্যামন করে? এটু দুব্বল হয়েছি, সামনে আকাল আসলে একেবারে মিশে যাব ধুলোয়।

সুভদ্রা মনে মনে ড়ুকরে উঠল, হেই মাগো, মানুষটার মুখে কথা আটকায় না।

তুমার বাপকে লিয়ে আসো নাই? মোহন জিজ্ঞেস করে।

বাপের আর উঠবার ক্ষ্যামতা নাই। ভয় হয়েছিল বুঝি আসতে পারবনি শ্যাষে

এতক্ষণে লজ্জায় ঢেকে এল সুভদ্রার গলা, পলাশপুরের কামারেরা আসছিল। মায়ের নাম লিয়ে তাদের পাছু পাছু চলে আসছি।

একা একা? বিস্মিত হাস্যে ভরে উঠল মোহনের মুখ, একেবারে পাগলির পারা নাকি? সুভদ্রা লজ্জায় মুখ ফেরায়।

তবে ইবারটাই শ্যাষ। ধুলো ঝাড়বার মতো দু হাত চাপড়াতে চাপড়াতে বলে মোহন, ঘুরতে আর মন লাগে না। পলাশপুরের মেলায় তুমার বাপকে বলে সব লিয়ে থুয়ে কোপগড় ঘুরে আক্কেবারে বোলপুর।

আরও সুদীর্ঘ আটমাস! সুভদ্রার চোখ দুটো মোহনের রুগ্ন শরীরটাকে যেন একবার লেহন করে নিল। কিছু বলতে চাইল। কিন্তু পারল না।

সত্যই, ভিটে মাটি করতে হবে, পাইসা চাই না?

আটমাস মোহনই বলে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে।

সুভদ্দা! সেবারের মতো আবার গলা কেঁপে উঠল মোহনের, ঠাকুর করে আকাল না আসে। আটটা মাস কাটিয়ে দিব। করিয়ালের গায়েন শুনছ সি, সুখের পরে দুখ—এনারা হলেন দুভাই। এক ভাই ছাড়বেক, এক ভাই আসবে।

বলতে বলতে হাসতে হাসতে মোহনের দু চোখে টলমল করে উঠল দু ফোঁটা জল।

মাঝে আটটা মাস তারপর চিত্তকর মোহনের ভিটে মাটি, সমসার গণেশঠাকুরের পারা একখানা ছালে। তাড়াতাড়ি জল মুছে বলে, তখন কিন্তু ভুলে যেয়ো না তুমার প্যাঁচাকে!

তারপর হু-হু করে কেটে গেল আটটা মাস। শীতের রুক্ষ অবরোধ ভেঙে দক্ষিণা হাওয়া ছুটে এল প্রান্তর ভেঙে নলিগড়ে। পাতা ঝরল, পথ ছাইল। কিন্তু সে পথে বিপণি বয়ে মেলার দোকানিরা আসছে কোথায়! ঝরা-পাতা মর্মরিয়ে সুদীর্ঘ পথ বয়ে চলেছে শুধু মিছিল। কঙ্কালের মিছিল।

চৈত্রের দুপুরে নিস্তব্ধ পলাশপুর ড়ুকরে ড়ুকরে কাঁদছে পথে বাজারে ঘরে ঘরে। খর জ্যৈষ্ঠ না আসতেই পাঁশুটে প্রান্তরের ফাটল দানবের মতো হাঁ করে আছে থরথর করে কাঁপছে।

মেলা বসল না।

নির্জন মেলায় মাটিতে ভেঙে পড়ল সুভদ্রা, আমার ভিটে, সমসার–গণেশ ঠাকুরের পারা ছ্যালে খেয়ে লিছিস্ তু মা ধরিত্তি।

তবু শেষ আশা নিয়ে সে ছুটল কোপগড়ের দিকে। চৈত-সংক্রান্তির মেলা। যদি সুভদ্রার প্যাঁচার দেখা সেখানে পাওয়া যায়!

আছে, আছে!

দূর থেকে দেখা যায় কোপগড়ের মেলায় কারা যেন বসে আছে। অনেক মানুষ। মাথা নেড়ে নেড়ে এ ওর সঙ্গে কথা বলছে। কালো কালো অনেক মানুষ। কিন্তু ঘর দেখা যায় না একটাও। শুধু মানুষ আর ধোঁয়ার একটা কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে আকাশের দিকে।

ছুটে কাছাকাছি এসেই থমকে দাঁড়াল সুভদ্রা। ছলাৎ করে দেহের রক্ত মাথায় উঠে এল।

মানুষ নয়। ওরা শকুন।

পাখার ঝাপটা দিয়ে শকুনের দল বিস্মিত হয়ে ফিরে তাকাল। মৃত কঙ্কালে ছাওয়া এ তেপান্তরের শ্মশানে জ্যান্ত মানুষ শকুনেরা অনেকদিন দেখেনি।

শকুনের মেলা থেকে মাথা তুলল একটা বিকটাকার কুকুর। উগ্র দুর্গন্ধে আকাশ বাতাস ভরপুর।

সুভদ্রা হামলে পড়ল মাটিতে, তু খেয়ে নিছিস মা-ধরিত্তি, আমার ভিটে, সোমসার, গণেশ ঠাকুরের পারা ছালে, আমার প্যাঁচাকে তু খেয়ে নিছিস!…

নিবিষ্টচিত্তে খানিকক্ষণ সুভদ্রাকে দেখে রক্তাক্ত লাল ঝুটি নেড়ে একটা গৃধিনী আর বিকটাকার কুকুরটা আস্তে আস্তে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *