৪. আমরা চিঠি লিখি, ডাকবাক্সে ফেলি

আমরা চিঠি লিখি, ডাকবাক্সে ফেলি। কিছু কিছু চিঠি ঠিক সময়ে ঠিক মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। কিছু চিঠি নানা ডাকখানার মোহরে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে কয়েক দিন পর যথাস্থানে হাজির হয়। কিছু কিছু চিঠিপত্র আরও কিছুদিন ডাক বিভাগের আদর-আপ্যায়ন উপভোগ করার সৌভাগ্য লাভ করে। এসব চিঠিপত্রের ঠিকানায় লাল-কালো কালি দিয়ে কাটাকুটি থাকে কিন্তু কে বা কারা এই কাটাকুটি করে ঠিকানা সংশোধন করার দায়িত্ব বহন করেন, সে খবর আমরা রাখি না। রাখার প্রয়োজনও অনুভব করি না।

শীতের রাতে যেসব রেলযাত্রী লেপ মুড়ি দিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেন, তারা কী গার্ডসাহেব বা ড্রাইভারের রাত্রি যাপনের কাহিনী জানেন! নাকি জানতে চান? আমরা নিজেদের কাজটুকু হলেই খুশী কিন্তু কে বা কারা এই কাজ সম্পন্ন করল, তা জানতে, বুঝতে চাই না।

দুর্ঘটনাক্রমে শৈলেনদার সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয় না হলে হয়তো আমিও জানতে পারতাম না, আর-এল-ও অফিসের অন্দরমহলে কে বা কারা নীরবে কত হারিয়ে যাওয়া মানুষকে আবার আমাদের কাছে এনে দিচ্ছেন। খামের উপর ঠিকানা ছিল শ্রীদাশু দাস, গগন ডাক্তারের বাগান, পাইকপাড়া, কলকাতা। না, পাইকপাড়া পোস্ট অফিসের কেউই গগন ডাক্তারের বাগান কোথায় তা খুঁজে পেল না। আশেপাশের কয়েকটি পোস্ট-অফিসেও চিঠিটা পাঠানো হল, ওদের ওখানেও গগন ডাক্তারের বাগানের হদিস পাওয়া গেল না।

এবার চিঠিটিকে ফেরত পাঠাবার পালা কিন্তু কোথায় ফেরত পাঠাবে? অগতির গতি আর-এল-ও। রিটার্ন লেটার অফিস।

চিঠিটা খুলেই শৈলেনদা অবাক। শুধু চিঠি না, সঙ্গে একশ টাকার দুটি নোট। চিঠির উপরে পত্রপ্রেরকের বোম্বের ঠিকানা ছিল ঠিকই কিন্তু তবু শৈলেনদা সঙ্গে সঙ্গে চিঠিটা ফেরত পাঠালেন না। ভাবলেন, হয়তো এই টাকাটি দাশুবাবুর খুবই জরুরী দরকার। চিঠিটি ফেরত পাঠালে তো তিনি টাকাটি পাবেন না। তাই নানা কথা ভাবনা চিন্তা করার পর শৈলেনদা চিঠিটা পড়লেন।…

শ্রদ্ধেয় দাশুদা, আমার নাম মনীষা। উকিল প্রমথনাথ বন্দ্যো পাধ্যায়ের যে মাতৃহীন শিশুপুত্র চন্দন আপনার স্নেহ-ভালবাসার জোরে বড় হয়, তিনি আমার স্বামী। চন্দনকে আপনি নিশ্চয়ই ভোলেননি। আপনাকেও আমার স্বামী জীবনে ভুলতে পারবেন না। বিয়ের পর থেকেই ওঁর কাছে আপনার কথা শুনেছি। উনি সব সময় বলেন, পাঁচ বছরের শিশু মৃত্যু কি, তা তো জানে না। তাই আমিও ঠিক বুঝতে পারিনি, মা মারা গিয়েছেন। বাবা আর দাশুদার কথা মত আমি ভাবতাম, মা সত্যি সত্যি ভগবানের কাছে বেড়াতে গিয়েছেন। কিন্তু সে যাইহোক, দাশুদা চব্বিশ ঘণ্টা আমাকে এমন করে আগলে রাখতেন যে আমি মার অভাব অনুভব করার সুযোগ পেতাম না।

চিঠিতে আর কত কথা লিখব? আপনি বোধহয় জানেন না, আপনার সেই চোখের মণি চন্দন বাবা পড়াশুনা করার জন্য বহুকাল বিদেশে ছিলেন। লেখাপড়া শেষ করে ওখানে চাকরিও করেছেন। আমিও তখন বিদেশে থাকি এবং ওখানেই আমাদের বিয়ে হয়।

আমার স্বামী যখন বিদেশে পড়াশুনা করছিলেন, তখনই আমার শ্বশুরমশাই হঠাৎ মারা যান এবং তার জিনিসপত্র তিন কাকার বাড়িতে চলে যায়। তাই আমার স্বামী অনেক চেষ্টা করেও বহুকাল আপনার ঠিকানা যোগাড় করতে পারেননি। আমরা বছর দেড়েক আগে এ দেশে ফিরেছি এবং মাত্র কয়েকদিন আগে আমার শ্বশুরমশায়ের একটা পুরানো ডায়েরীতে আপনার একটা ঠিকানা পেয়েই এই চিঠি লিখছি।

আমার স্বামীই আপনাকে চিঠি লিখতেন কিন্তু তিনি হঠাৎ জরুরী কাজে দিন দশেকের জন্য বিলেত যাওয়ায় আমিই চিঠি লিখছি

আমার স্বামী লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াবার বহু আগেই বাবা-মাকে হারিয়েছেন এবং তাদের সেবা-যত্ন করার কোন সুযোগ পেলেন না। তাইতো ওঁর ঐকান্তিক ইচ্ছা আপনি আমাদের কাছেই থাকুন। তাছাড়া আপনি তো বোধহয় বিয়েও করেননি। আমাদের মনে হয়, এখানে থাকলে অআনার কোন কষ্ট বা অসুবিধা হবে না। আপনার চন্দন বাবার কথা তো বাদই দিচ্ছি। আপনাকে কাছে পেলে আমিও তো মনে করব শ্বশুরের সেবা করছি।

আপনি শুনে নিশ্চয়ই সুখী হবেন যে আমাদের একটি পুত্র সন্তান আছে। আমাদের জন্য না হলেও এই দাদুভাই-এর জন্য আপনি নিশ্চই যথাশীঘ্র সম্ভব আমাদের কাছে চলে আসবেন। আপনার আসার খরচ বাবদ এই সঙ্গে ২০০,০০ টাকা পাঠালাম এবং রওনা হবার আগে অবশ্যই কাউকে দিয়ে আমাদের একটা টেলিগ্রাম পাঠাবেন। আমরা নিশ্চয়ই স্টেশনে উপস্থিত থাকব।

আপনার প্রতীক্ষায় রইলাম।

চিঠিটা পড়ে শৈলেনদা আপন মনেই হাসেন। হাসবেন না? চিঠিটা পড়েই বুঝতে পারেন, এই দাশু নিশ্চয়ই প্রমথ উকিলের বাড়িতে কাজ করতেন এবং ইনি যে চন্দনবাবুকে পুত্র তুল্য স্নেহ করতেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আজকাল অধিকাংশ ছেলেমেয়েই তাদের বাবা-মাকে দেখে না। যেসব ছেলেমেয়েরা জীবনে উন্নতি করে, তারা যেন বাবা-মাকে আরও বেশি অপছন্দ করে। ব্যতিক্রম আছে বৈকি কিন্তু এরা যেন বিরল ব্যতিক্রম।

মনীষার চিঠির উপরের দিকে এক পাশে ওদের মালাবার হিলস এর ঠিকানা ছাপা। বাড়িতে দুটি টেলিফোন আছে। সুতরাং শৈলেনদা সহজেই বুঝতে পারেন, চন্দনবাবু শুধু প্রতিষ্ঠিত না, অত্যন্ত সুপ্রতিষ্ঠিত। হয়তো বিরাট কোন কোম্পানীর ডিরেক্টর। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যে উচ্চশিক্ষিত, সে বিষয়েও কোন সন্দেহ নেই। অতীত দিনের একজন গৃহভৃত্যের জন্য এরা এত ব্যাকুল?

নিজের মনের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দেন। হবে না? সত্যিকার শিক্ষিত মানুষ কি কখনও অকৃতজ্ঞ হয়?

শৈলেনদা আরও কয়েকবার চিঠিটা পড়লেন। না পড়ে পারলেন না। সারা মন আনন্দে খুশিতে ভরে গেল। হবে না? এ সংসারে মানুষের দৈন্য দেখতে দেখতে কে ক্লান্ত না? তাইতো অকস্মাৎ কোন উদার মহৎ প্রাণের সন্ধান পেলে মন নিশ্চয়ই খুশিতে ভরে যাবে।

এইসব কথা বলতে বলতে হঠাৎ উনি একটু থামেন। তারপর বললেন, বুঝলে বাচ্চু, চিঠিটা নিয়ে মহা সমস্যায় পড়লাম।

কেন?

শুধু পাইকপাড়া না, আশেপাশের সব পোস্ট অফিসই দেখেছে ওদের এলাকায় গগন ডাক্তারের বাগান বলে কোন অঞ্চল নেই।…

ওর কথার মাঝখানেই আমি বলি, কলকাতার উত্তর-দক্ষিণ দুদিকেই এককালে অনেক বাগানবাড়ি ছিল ঠিকই কিন্তু পাটিশানের পর সেসব জায়গায় কত ঘরবাড়ি উঠেছে যে..

এবার উনি আমার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললেন, ঠিক ঠিক। নতুন রাস্তাঘাট দোকান-বাজার ঘরবাড়ি হাউসিং এস্টেট ইত্যাদি যা কিছু হয়েছে, তা তো ঐসব বাগানবাড়ি বা জমিদারদের বিরাট বিরাট বাড়ি-টাড়ির জায়গাতেই হয়েছে।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ।

শৈলেনদা একটু হেসে বললেন, লালবাজারের গোয়েন্দাদের মত কর্পোরেশন ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট অর গভর্নমেন্টের হাউসিং ডিপার্টমেন্টে খোঁজখবর নিতে নিতে গগন ডাক্তারের বাগানের খবর জুটে গেল। আরও একটু খোঁজ নিতেই বেরিয়ে গেল, ওখানকার পুরানো বস্তি বাসীদের কোথায় কোয়ার্টার্স দেওয়া হয়েছে।…

তারপর ঐ কোয়ার্টসগুলোতে খোঁজ নিতেই… উনি আমার দিকে তাকিয়ে মাথা এদিক-ওদিক দুলোতে দুলোতে মুচকি হেসে বললেন, ওহে শ্ৰীমান, এ খবরের কাগজের রিপোর্টারী না যে কিছু একটা লিখে দিলেই হল।

আমি শুধু হাসি।

হঠাৎ শৈলেনদা গম্ভীর হয়ে বললেন, সমস্ত খোঁজখবর নেবার পর ঐ অঞ্চলের একজন সিনিয়র পোস্টাল ইন্সপেক্টরকে সঙ্গে নিয়ে আমি নিজেই মনীষার চিঠি নিয়ে হাজির হলাম দাশুবাবুর আস্তানায়।

মুহূর্তের জন্য একটু থেমে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সত্যি বলছি বাচ্চু, সেদিনের কথা আমি জীবনেও ভুলব না।…

পাকা তিন-চারতলা বাড়ির কয়েকটি ব্লক। অতীতদিনের কয়েক শ বস্তিবাসীকে এখানে ঠাঁই দিয়ে সরকার মহৎ কাজ করলেও এই আধুনিক নরক দেখে শৈলেনদার মাথা ঘুরে যায়। কচি-কাঁচা থেকে বুড়োবুড়ি মানুষ আর বেড়াল-কুকুর-গরু-ছাগল আর শুয়োরের এমন মিলে-মিশে অবাধ স্বাধীনতাভোগের এমন বিরল দৃশ্য দুনিয়ার আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না। এমন স্বর্গরাজ্যে দাশু দাসকে আবিষ্কার করা খুব সহজসাধ্য হয়নি।

জানো বাচ্চু, মাঠের এক পাশে একটা ভাঙা খাঁটিয়ায় বৃদ্ধকে দেখেই বুঝলাম, মৃত্যু ওর সামনে এলে উনি বোধহয় তাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরবেন।

আমি বললাম, যেসব বুড়োবুড়িকে পরের দয়ায় বেঁচে থাকতে হয়, তাদের সবার অবস্থাই ঐ রকম।

যাইহোক আমি ওকে চিঠিটা পড়ে শোনাতেই উনি হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমি জানতাম, আমার চন্দনবাবা আমাকে ভুলে যেতে পারে না, পারে না, পারে না।

আমি কোন কথা বলি না। চুপ করে ওর কথা শুনি। শৈলেনদা আবার বলেন, তারপর ঐ চিঠি আর টাকা হাতে নিয়ে পাগলের মত চিৎকার করে বললেন, ওরে, আমার চন্দনবাবার বউ চিঠি লিখেছে, টাকা পাঠিয়েছে। আমি আর এখানে থাকব না। আমি বোম্বাই চলে যাব। শৈলেনদা আবার একটু থামেন। তারপর বললেন, সত্যি বলছি বাচ্চু, পরশপাথরের ছোঁয়ায় যেমন লোহালঙ্কড়ও সোনা হয়, মনীষার ঐ চিঠিটা পেয়ে ঐ মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটাও যেন আনন্দে খুশিতে যৌবনের দিনগুলোতে ফিরে গেল।

আমি একটু হেসে বললাম, ভালবাসার পরশপাথরের ছোঁয়ায় সবকিছুই সম্ভব।

ঠিক বলেছ ভাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *