৩. বাঙালীকে যারা ঘরকুনো বলেন

বাঙালীকে যারা ঘরকুনো বলেন, তারা সত্যি বাঙালীর ইতিহাস জানেন না। আজ নয়, বাঙালী চিরকালই ঘর ছেড়ে অজানা দেশ দেশান্তরের পথে বেরিয়ে পড়েছে। সেই অনাদি অতীতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেও বাঙালী সেনারা যোগ দিয়েছিল। তবে হ্যাঁ, বাঙালী সেনারা সত্যাশ্রয়ী পাণ্ডবদের পক্ষে ছিল না। ওঁরা লড়াই করেছিলেন কুরুর পক্ষে। শুধু সে সময় নয়, বাঙালী চিরকালই রাজাদের দলে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর কিছু বাঙালী ক্ষেপে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু তাদের ঠাণ্ডা হতেও বেশি সময় লাগেনি। তারপর সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সময় কিছু বাঙালী রাজার বিরুদ্ধে হাতিয়ার ধরেছিল কিন্তু তাদের সহস্রগুণ বেশি বাঙালী তখন দেবজ্ঞানে রাজসেবা করেছেন। আগস্ট বিপ্লবের সময়ও বাঙালী রাজদ্রোহীদের চাইতে অনেক অনেক বেশি সংখ্যক বাঙালী পুলিস ও গোয়েন্দা সে বিদ্রোহ দমনে সব শক্তি নিয়োগ করেছিল। অজিও আমরা অনেকেই এস. পি. ম্যাজিস্টেট, মন্ত্রী দেখলে গদগদ না হয়ে পারি না।

বাঙালীর রক্তেই বোধহয় রাজভক্তির বীজ লুকিয়ে আছে। পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করলেও লর্ড ক্লাইভ বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাছাড়া ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ঘর-সংসার সামলাতে কয়েকটা বছর তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। তারপর একটু ফুরসত পাবার পর লর্ড ক্লাইভ বেরিয়ে পড়লেন এবং এলাহাবাদ যাবার সময় সঙ্গে নিলেন কলকাতা শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব মহাশয়কে। হাজার হোক একে রাজা নবকৃষ্ণ, তার উপর স্বয়ং লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে বেরিয়েছেন। সুতরাং সাঙ্গপাঙ্গ অনেক ছিল এবং তাদেরই একজনের নাম গঙ্গাধর। শ্রীমান গঙ্গাধরের হাতে তৈরি তামাক না খেলে রাজা নবকৃষ্ণের তৃপ্তি হতো না।

যমুনা যেখানে পুণ্য পবিত্র জাহ্নবীতে আত্মসমর্পণ করে আত্মহারা হয়ে লুপ্ত সরস্বতীর সঙ্গে একাকার হয়েছে, সেই ত্রিবেণী সঙ্গমের শোভা দেখবার সময় লর্ড ক্লাইভ রাজা নবকৃষ্ণের সুপারিশে গঙ্গাধরের হাতে তামাক খেয়ে এমনই মুগ্ধ হয়ে যান যে সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ সহস্র মুদ্রা ও কোম্পানিতে একটি স্থায়ী চাকরি দেন। ব্যস! সঙ্গে সঙ্গে একটি প্রবাসী বাঙালী পরিবারের জন্ম হল।

গঙ্গাধরের আদি নিবাস ছিল হুগলী। এবং তিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন। তার গলায় পৈতা থাকলেও পেটে শাস্ত্রজ্ঞান ছিল না। শুধু তাই নয়। পিতামহের শত চেষ্টাতেও তিনি শালগ্রামশিলার সেবা করতেও শিখলেন না বলে ঘর থেকে বিতাড়িত হন। শ্রীমান গঙ্গাধর মন্ত্র-তন্ত্র না জানলেও তামাক খেতে বড় ভালবাসতেন এবং সাজতেনও ভাল। ঐ বিদ্যাটুকু সম্বল করেই তিনি একদিন ঘুরতে ঘুরতে কলকাতা শহরে হাজির। বিধির বিধান কে খণ্ডাবে! একদিন আহিরীটোলার গঙ্গার ঘাটে রাজা নবকৃষ্ণের এক বিশ্বস্ত কর্মচারীর সঙ্গে এই ব্রাহ্মণ সন্তানের পরিচয় হয় ও তিনি তার দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনে বড়ই বিচলিত হন। ওঁরই কৃপায় গঙ্গাধর রাজা নবকৃষ্ণের রাজবাড়িতে প্রথমে আশ্রয় লাভ ও পরে স্নেহভাজন কৃপাপাত্র হয়ে ওঠেন।

যাই হোক লর্ড ক্লাইভ ও রাজা নবকৃষ্ণের বিদায়ের পর গঙ্গাধর কিছুকাল বিলাস-ব্যসনে জীবন কাটালেও অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কোম্পানির চাকরি করেন। ইতিমধ্যে হুগলী দেবানন্দপুর-ভাস্তাড়া অঞ্চলের এক ব্রাহ্মণ সপরিবারে তীর্থ ভ্রমণে এলে অত্যন্ত বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের একান্ত অনুরোধে গঙ্গাধর তার কন্যাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর গঙ্গাধর চাকরির সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানির কন্ট্রাক্টারী শুরু করেন ও প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। গঙ্গাধর মৃত্যুর সময় দুটি স্ত্রী, নটি পুত্র, পাঁচটি কন্যা, পাঁচটি নাতি-নাতনী, একটি অট্টালিকা, চার-পাঁচশ ভরি সোনা, প্রায় মনখানেক রূপা, বিশ-ত্রিশ মণ বাসন-কোসন ও প্রায় পনেরো হাজার টাকা নগদ রেখে যান। তখন বোধ হয় সত্যি রাম-রাজত্ব ছিল!

গঙ্গাধরের মৃত্যুর পরই পরিবারের মহা অশান্তি দেখা দেয় ও আস্তে আস্তে সোনার সংসার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। বছর দশেকের মধ্যে গঙ্গাধরের বংশধররা প্রায় সারা উত্তরপ্রদেশে ছড়িয়ে পড়েন। ইতিমধ্যে ইংরেজ রাজত্বের পাকা বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে। অফিস আদালতের সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়া শেখার বিধি-ব্যবস্থা ও ডাক্তারখানা চালু হল এবং এই সমস্ত বিভাগেই বাঙালীর প্রভাব-প্রতিপত্তি ও একাধিপত্য ছড়িয়ে পড়ল। কোর্ট-কাছারির কৃপায় বাঙালী উকিলবাবুরা তো রাজা হয়ে গেলেন। লোকে সাধে কি বলত, লড়ে টোপী-ওয়ালা, খায় ধোতিওয়ালা! এইরকম এক ভাগ্যবান উকিল ছিলেন গঙ্গাধরের পঞ্চম পুত্র শ্রীধর বাঁড়ুজ্যে। কোম্পানির অনেক ইংরেজ কর্মচারীই এই শ্রীধর ব্যানার্জীর বন্ধু ছিলেন ও কালেক্টর লঙ সাহেবের কৃপায় তার জ্যেষ্ঠপুত্র ডাকমুন্সীর চাকরি পান। এর কিছুকাল পরে ডাকবিভাগ কালেক্টরের হাত থেকে সিভিল সার্জেনের অধীনে চলে যায় এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অশ্ব ডাক চালু হয়। শ্রীধর নন্দন ডাক অশ্বের কালেক্টর হন।

শ্রীধরবাবু সব পুত্রদেরই কিঞ্চিৎ ইংরেজি শিখিয়েছিলেন এবং সেই সামান্য ইংরেজি জ্ঞানের দৌলতে অন্য একটি পুত্রও অশ্ব ও গোডাক বিভাগে কাজ পান। এর নাম কামিনীরঞ্জন।

কামিনীরঞ্জন সত্যি একটি রত্ন ছিলেন। নিজের কর্ম দক্ষতায় উনি যে শুধু মাত্র ডেপুটি পোস্ট মাস্টার হন তাই নয়, সিপাহী বিদ্রোহের সময় উনি যেভাবে ইংরেজ সেনাপতি ও অফিসারদের সেবা করেন, তার তুলনা বিরল। বিদ্রোহী সিপাহী ও মুসলমানরা ইংরেজসেবক বাঙালীদের শত্রু মনে করতেন বলে তাদের অনেকের উপরই অকথ্য অত্যাচার হয়। ধন-সম্পত্তি ছাড়াও বহু বাঙালীকে প্রাণ হারাতে হয়। বিদ্রোহীরা কামিনীরঞ্জনকেও খুন করার পরিকল্পনা করেছিল কিন্তু উনি সে খবর আগেই জানতে পেরে পোস্ট অফিসের দামী ও দরকারী জিনিসপত্র ছাড়াও কিছু বিশ্বস্ত কর্মীকে নিয়ে পালিয়ে যান।

কামিনীরঞ্জন আত্মগোপন করে থাকার সময় বিশ্বস্ত কর্মী ও ইংরেজ সমর্থক কিছু সুচতুর গ্রামবাসীদের সাহায্যে বিদ্রোহী দলের গোপন খবর সংগ্রহ করে অত্যন্ত গোপনে ওয়াটসন সাহেবের এক ঘনিষ্ঠ অফিসারের কাছে পাঠাতেন অনেক সময় কামিনীরঞ্জন নিজেও জীবন বিপন্ন করে সাধুসন্ন্যাসী-ফকিরের বেশে শত্রু শিবিরে প্রবেশ করে সংবাদ সংগ্রহ করতেন। যাদের সক্রিয় ও ঐকান্তিক সাহায্যে মহামান্য ইংরেজ সরকার বিদ্রোহ দমনে সমর্থ হয়, তাদের অন্যতম এই বাবু কামিনীরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় মহোদয়।

দেশে শান্তি স্থাপনের পর ইংরেজ সরকার প্রকাশ্যে ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রচুর অর্থ ও ডেপুটি কালেক্টরের পদ দিয়ে পুরস্কৃত করেন। সে সময় উত্তরপ্রদেশের বেশ কিছু বাঙালী চরম রাজভক্তি দেখাবার জন্য এই দুর্লভ সম্মান লাভ করেন।

কামিনীরঞ্জনের কাহিনী, সৌভাগ্যের ইতিহাস এখানে শেষ নয়। কোম্পানির জমানা শেষ হবার পর স্বয়ং মহারানী ভিক্টোরিয়ার শাসন ব্যবস্থা চালু হবার কিছুকালের মধ্যেই ছোটলাটের ব্যক্তিগত সুপারিশে ও আগ্রহে কামিনীরঞ্জন বিহার ও উত্তরপ্রদেশে বিশাল জমিদারীও লাভ করেন। একদা অশ্ব ও গো-ডাক বিভাগের নগণ্য কর্মচারীর সৌভাগ্যের ইতিহাস এখানেও শেষ হল না।

মহারানী ভিক্টোরিয়ার শাসনব্যবস্থা চালু হলে কিছু ইংরেজ অফিসারকে দেশে পাঠান হল, নতুন কিছু অফিসার দেশ থেকে এখানে এলেন। আবার বেশ কিছু উচ্চপদস্থ অফিসারকে কম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে বদলী করা হল। এই রদবদলের বাজারে ল্যাঙ্কাশায়ার ফিফথ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন বার্জম্যানকে এলাহাবাদে কমিশনার নিয়োগ করা হল। কোন অজ্ঞাত কারণে বহু ইংরেজ অফিসারই এই নিয়োগের খবর জেনে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হলেন এবং তারা অনেকেই ওঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎও করতেন না। এই সব ইংরেজদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বহু গণ্যমান্য ভারতীয়রাও বার্জম্যানকে এড়িয়ে চলতেন কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন শুধু কামিনীরঞ্জন।

কামিনীরঞ্জন নতুন কমিশনার সাহেব ও মেমসাহেবের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আনন্দের জন্য প্রাণ ঢেলে দিলেন ও দু-হাতে জলের মত অর্থ ব্যয় করতেন। ক্যাপ্টেন বার্জম্যান সর্বশক্তিমান কমিশনার হলেও লাটসাহেব ছিলেন না, কিন্তু প্রভুভক্ত কামিনীরঞ্জন ওঁকে খুশি করার জন্য সব সময় হিজ একসেলেনসী বলে সম্বোধন করতেন।

বন্ধু কুমুদবিহারী একদিন বললেন, কামিনীরঞ্জন, এতগুলো ইংরেজ অফিসারকে চটিয়ে নতুন কমিশনার সাহেবকে খুশি করা কী বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে?

কামিনীরঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন, দেখ কুমুদবিহারী, আমি কমিশনার সাহেবকে নিয়োগ করিনি। স্বয়ং মহারানী ভিক্টোরিয়া ওঁকে এখানে পাঠিয়েছেন। যিনি পৃথিবীব্যাপী এতবড় সাম্রাজ্য চালাচ্ছেন, আমি কি করে তার মনোনীত নতুন কমিশনার বাহাদুরকে সম্মান ও মর্যাদা না দিয়ে পারি।

তা ঠিক কিন্তু…

ওঁকে বাধা দিয়ে কামিনীরঞ্জন বললেন, তাছাড়া কে বলতে পারে, কমিশনার সাহেব স্বয়ং মহারানীর প্রিয়পাত্র বা আত্মীয় না।

কুমুদবিহারীও রাজভক্ত এবং রাজ অনুগ্রহেই জীবনে বহু উন্নতি করেছেন কিন্তু ওঁর মাথায়ও এত কিছু চিন্তাভাবনা আসেনি। উনি গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে বললেন, তা তো বটেই।

এবার কামিনীরঞ্জন একটু হেসেই বলেন, দেখ কুমুদবিহারী, হু এভার ম্যারেজ মাই মাদার, ইজ মাই ফাদার! যিনিই মাকে বিয়ে করবেন, তিনিই আমার বাবা।

ওঁর কথায় কুমুদবিহারী হোহো করে হেসে ওঠেন। বলেন, ইউ আর রাইট, মাই ডিয়ার ফ্রেণ্ড! ইউ আর রাইট, মাই ডিয়ার ফ্রেণ্ড! ত্রিবেণী সঙ্গম দিয়ে গঙ্গা-যমুনার জল আরো গড়িয়ে যায়। কমিশনার সাহেব ও তার মেমসাহেবের সঙ্গে কামিনীরঞ্জনের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ধীরে ধীরে গভীর হৃদ্যতা ও বন্ধুত্বে পরিণত হয়। কামিনীরঞ্জন বুঝতে পারেন, কমিশনার সাহেব শুধু ক্ষমতা পেয়ে খুশি না। উনি আরও অনেক কিছু আশা করেন। প্রভুভক্ত জমিদারও তার সে সুপ্ত আশা আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে কোন ক্রটি করেন না। যখন তখন সাহেব-মেম সাহেবকে দামী দামী জিনিসপত্র উপহার দেন। তারপর সাহেবের জন্মদিনে উনি ওঁকে একটা অত্যন্ত দামী হীরার আংটি দিতেই মেম সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, খামিনী, আমি কী অপরাধ করলাম যে তুমি বার্জ-কেই শুধু উপহার দিলে?

কামিনীরঞ্জন গদগদ হয়ে হাসি মুখে বললেন, হিজ একসেলেনসী দয়া করে অনুমতি দিলে আমি আপনাকে হীরের নেকলেস উপহার দেব।

ও! লাভলি! শুনেই মেমসাহেব আত্মহারা হয়ে যান।

আধ গেলাস হুইস্কী একসঙ্গে গলায় ঢেলে দিয়ে কমিশনার সাহেব বললেন, খামিনী, তুমি শুধু আমার বন্ধু না, আমার স্ত্রীরও বন্ধু।…

ইওর একসেলেনসী, আমি কী আপনাদের বন্ধু হবার যোগ্য? আমি নিছক ভক্ত মাত্র!

একে হুইস্কী, তার উপর অত দামী হীরের আংটি। বার্জম্যান ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বললেন, নো খামিনী, তুমি আমাদের দুজনেরই বন্ধু।

পেটে আরও দু-পাঁচ পেগ হুইস্কী পড়ার পর কমিশনার গড় গড় করে বলে যান, ইউ সী খামিনী, আমি বোকা না..

ছি, ছি, ইওর একসেলেনসী, এ কি কথা বলছেন?

…হার ম্যাজেস্টি দ্য কুইন আমাকে ভাল না বাসলে এই সাঁইত্রিশ বছর বয়সে আমি কমিশনার হই না কিন্তু আমি জানি অনেকেই আমাকে পছন্দ করে না। এমন কি বহু ব্লাডি নেটিভ জেন্টলম্যানও আমাকে এড়িয়ে চলে।

ইওর একসেলেনসী, ওরা পাপী, ওরা হতচ্ছাড়া।

কমিশনার সাহেব ওর কথা শুনেও শোনেন না। উনি আপনমনে বলেন, তুমি যেভাবে আমাদের সেবা করছ, তার জন্য আমরা শুধু খুশি না, উই আর গ্রেটফুল।

এটা তো আমার কর্তব্য ইওর একসে..

হঠাৎ বার্জম্যান গর্জে ওঠেন, স্টপ! ব্লাডি খামিনী! কাম অন! আমরা তিনজনে নাচব!

কামিনীরঞ্জনের জীবনে সে এক অবিস্মরণীয় দিন। পুণ্য তিথিও বলা চলে।

তিনজনে মিলে নাচ শুরু হলেও নেশার ঘোরে কয়েক মিনিটের মধ্যেই বার্জম্যান ঢলে পড়লেন কিন্তু মেমসাহেব কামিনীরঞ্জনকে নিয়ে নাচ থামালেন না। কিছুতেই না। মাঝে মাঝে মেমসাহেব ওয়াইনের গেলাসে চুমুক দেন। কামিনীরঞ্জনও একটু হুইস্কী দিয়ে শুকনো গলা ভিজিয়ে নেন। নাচ চলে মৃদুমন্দ গতিতে। নাচতে নাচতে কথাও হয়।

জানো খামিনী, বার্জ কী বলে?

কী বলেন?

বার্জ বলে, খামিনী নেটিভ হলেও বোধহয় ইংরেজ মহিলার গর্ভে জন্মেছে। তা না হলে এত সুন্দর দেখতে হয়?

কামিনীরঞ্জনের মনে খুশি ও গর্বের বন্যা বয়ে যায়। বলেন, হিজ একসেলেনসী, আমাকে সত্যি স্নেহ করেন।

আই অলসো লাভ ইউ খামিনী!

একশবার! হাজার বার তা স্বীকার করি।

রাত আরো একটু গম্ভীর হয়। বার্জম্যান সাহেব মুহূর্তের জন্য আত্মসম্বিৎ ফিরে পেয়েই আবার একটু হুইস্কী খেয়েই শুয়ে পড়েন। চোখ বন্ধ করেই উনি জড়িয়ে জড়িয়ে বলেন, নাচ থামালেই আমি তোমাদের চাকরি খেয়ে দেব।

গভীর রাত্রি ও ওয়াইনএর সম্মিলিত মাদকতার প্রভাবে মেমসাহেবও কেমন যেন একটু বদলে যান। কামিনীরঞ্জনকে আরো কাছে টেনে নেন। তারপর হঠাৎ একটি চুম্বন।

কামিনীরঞ্জন চমকে ওঠেন। অনিন্দে, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। তারপর নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলেন, মেমসাহেব, একি করলেন?

খামিনী, ইউ আর এ লাভলি ম্যান! তোমার সঙ্গে নাচতে আমার খুব ভাল লাগছে।

বাট হিজ একসেলেনসী…

ড্যাম ইওর হিজ একসেলেনসী! ও যদি জনস্টোনের ঐ হতভাগী বউটাকে নিয়ে রেগুলার স্ফুর্তি করতে পারে, তাহলে আমি তোমাকে কেন কিস করতে পারব না?

মেমসাহেবের কথা শুনেও ওর ভাল লাগে। সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয় কিন্তু হিজ একসেলেনসীর সামনে…

মেমসাহেব এবার ওকে দুহাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে আবার একটি চুম্বন করেন।

এবার আর কামিনীরঞ্জন চুপ করে থাকতে পারেন না। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলেন, মেমসাহেব, হিজ একসেলেনসী আমাকে গুলী করে মারবেন।

মিসেস বার্জম্যান হাসতে হাসতে বলেন, এখন আমি তোমাকে নিয়ে সারা রাত শুয়ে থাকলেও তোমার হিজ একসেলেনসী জানতে পারবে না। ভুলে যেও না, প্রায় দুবোতল হুইস্কী ওর পেটে গেছে।

দিন এগিয়ে চলে। কমিশনার দম্পতির সঙ্গে কামিনীরঞ্জনের সম্পর্ক আরো নিবিড় হয়। কমিশনার সাহেব ট্যুরে যাবার সময় মাঝে মাঝে স্ত্রীকে ছাড়াও কামিনীরঞ্জনকেও সঙ্গে নিয়ে যান। আবার সাহেব একলা গেলে কামিনীরঞ্জন সকাল সন্ধ্যেয় কোঠীতে গিয়ে মেমসাহেবের তদারকী করেন।

এখন আর বার্জম্যান সাহেবকে কেউ এড়িয়ে চলেন না। বরং সবাই ওকে খুশি করতে ব্যস্ত। রাজা-মহারাজা-জমিদাররা ছাড়াও গণ্যমান্য নেটিভরা ওকে নিত্য উপঢৌকন পাঠান। হাজার-হাজার লাখ-লাখ মূল্যের সেসব উপহার। সাহেব-মেমসাহেব দুইজনেই খুশি কিন্তু দুইজনেই কামিনীরঞ্জনকে বলেন, এখন সবাই আমাদের খুশি করতে ব্যস্ত কিন্তু আমরা জানি তুমি ছাড়া আর কেউ আমাদের রিয়েল ফ্রেণ্ড না।

হিজ একসেলেনসী, আমি কী এই দুর্লভ সম্মানের উপযুক্ত?

রাজকার্যের জন্য কমিশনার সাহেবকে মাঝে মাঝেই বাইরে যেতে হয়। কখনো দুএকদিন, কখনো আবার পাঁচ-সাতদিন। এই অবসরে মেমসাহেবের সঙ্গে কামিনীরঞ্জনের সম্পর্ক হঠাৎ মোড় ঘুরল।

সেদিন সন্ধ্যে থেকেই দারুণ জল-ঝড়। কামিনীরঞ্জন ঐ জল-ঝড় উপেক্ষা করেই মেমসাহেবের খোঁজ-খবর নিতে এলেন কোঠীতে। ইচ্ছা ছিল ঘণ্টাখানেক থেকেই ফিরে যাবেন কিন্তু ঝড়-বৃষ্টির বেগ এত বাড়ল যে ঘর থেকে বের হওয়াই অসম্ভব। এইসব চিন্তা-ভাবনা করতে করতেই দুজনে একটু-আধটু ড্রিঙ্ক করলেন। তারপর ঝড়-বৃষ্টির তেজ আরও বাড়তেই মেমসাহেব বললেন, খামিনী, এই ঝড়-বৃষ্টির রাত্রে আমি শুধু চাকর-বাকরদের ভরসায় থাকতে পারব না। আজ তুমি আমার কাছে থাকবে।

না, না, মেমসাহেব তা হতে পারে না। আপনি প্লীজ..

হোয়াট না? না? তুমি আজ আমার কাছে থাকবে। এটা আমার অর্ডার।

মনে মনে যত ইচ্ছাই থাক, মুখে কামিনীরঞ্জন বার বার আপত্তি করলেন। অনুনয়-বিনয়ও করলেন কিন্তু কে কার কথা শোনে? আরও খানিকটা ড্রিঙ্ক করার পর মেমসাহেব কামিনীরঞ্জনকে নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকলেন।

না, এখানেও কামিনীরঞ্জনের জীবন-নাট্যে যবনিকা পড়ল না। বছরখানেক পর হঠাৎ একদিন কমিশনার সাহেব গোপনে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে জনস্টোন সাহেবের সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে উধাও হয়ে গেলেন। পরে অবশ্য জানা গেল, ওরা দুজনে মিশরে গেছেন।

কমিশনার সাহেবের উধাও হবার খবরে কামিনীরঞ্জন প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও মেমসাহেব বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। মেমসাহেব ওকে বললেন, খামিনী, অযোধ্যার নবাব বিন্ধ্যাচল পাহাড়ের যে ছোট্ট প্যালেসটা আমাকে দিয়েছেন, আমি সেখানেই থাকব। তুমি আমার সব বিধিব্যবস্থা করে দাও।

শুধু মেমসাহেবের না কামিনীরঞ্জনেরও জীবনে নতুন অধ্যায় শুরু হল। মেমসাহেব বছরের অনেক সময়ই বিন্ধ্যাচলের প্যালেসে কাটালেও রাজা-মহারাজা-নবাবদের প্রদত্ত অন্যান্য কোঠীতেও মাঝে মাঝে কিছুদিন কাটান। কামিনীরঞ্জন জমিদারী দেখাশুনার অজুহাতে মাঝে মাঝেই মেমসাহেবের কাছে কিছুদিন কাটান।

সত্যি বলছি খামিনী, ইংরেজরা ভালবাসতে জানে না। তুমি আমার হাজব্যাণ্ড না কিন্তু তোমার কাছে আমি যে ভালবাসা, যে আদর পাই তা কোন ইংরেজ স্বামী দিতে পারবে না।

সত্যি মেমসাহেব?

হ্যা খামিনী। মেমসাহেব কামিনীরঞ্জনের গলা জড়িয়ে ধরে বলেন, খাজুরাহো টেম্পল দেখেই আমি বুঝেছি, ইণ্ডিয়ান নেটিভরা সত্যি ভালবাসতে জানে।

দুরন্ত প্রাণচঞ্চল পাহাড়ী নদীর মত কামিনীরঞ্জনের জীবনধারাও বার বার তার গতিপথ বদলেছে। বছর দুই পর এক বান্ধবীর সঙ্গে ডালহৌসী পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে এক দুর্ঘটনায় মেমসাহেব মারা গেলেন।

মেমসাহেবের অকস্মাৎ মৃত্যু কামিনীরঞ্জনের ব্যক্তিগত জীবনে যত দুঃখ বা বেদনার কারণই হোক, লাভও কম হল না। মেমসাহেবের কয়েক লক্ষ টাকার গহনা ও হীরা-জহরত ছাড়াও নানা জায়গায় চার পাঁচটি প্যালেস ও কোঠী ওরই দখলে এল।

বিহারের গঙ্গাতীরের অর্ধখ্যাত শহরের রাজাবাবুদের পরিবারের এই হল আদি ইতিহাস। তবে এইসব কাহিনী মহেন্দ্রবাবুরা কাউকে বলেন না। বলতে পারেন না। উনি যে সাতটি প্যালেসের জন্য গর্ব করেন, তার অধিকাংশই যে বার্জম্যান সাহেবের ছিল এবং তার মেমসাহেবের সঙ্গে ওর পূর্বপুরুষের অবৈধ সম্পর্কের জন্যই ওদের দখলে অসে, সে কথা কী কাউকে বলা যায়। বলা যায় না আরও অনেক কিছু।

অধিকাংশ অভিজাত পরিবারের মানুষজনই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধবকে অতীত ঐতিহ্যের দীর্ঘ কাহিনী না বলে থাকতে পারেন না কিন্তু যা বলেন না, বলতে পারেন না, সে ইতিহাস কাহিনী বোধ হয় আরও দীর্ঘ, আরও রহস্যপূর্ণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *