১১. পদ্মঝি হোটেলের কাজে ভর্তি হইল

পরদিন পদ্মঝি হোটেলের কাজে ভর্তি হইল। বেচু চক্কত্তিও বসিল গদির ঘরে। ইহারা কেহই যে বিশ্বাসযোগ্য নয় তাহা হাজারি ভাল করিয়াই বুঝিত। তবে কথা এই যে, ক্যাশ থাকিবে নরেনের কাছে। বেচু চক্কত্তি দেখাশোনা করিয়াই খালাস।

হাজারির মনে হইল সে তাহার পুরোনো দিনের হোটেলে আবার কাজ করিতেছে, বেচু চক্কত্তি তাহার মনিব, পদ্মঝিও ছোট মনিব।

পদ্ম যখন আসিয়া সকালে জিজ্ঞাসা করিল–-ঠাকুর মশায়, ইলিশ মাছ আনাব এবেলা না পোনা?–তখন হাজারি পূর্ব অভ্যাসমতই সম্ভ্রমের সঙ্গে উত্তর দিল, যা ভাল মনে করো পদ্মদিদি। পচা না হোলে ইলিশই এনো।

বেচু চক্কতি পাকা ব্যবসাদার লোক এবং হোটেলের কাজে তাহার অভিজ্ঞতা হাজারির অপেক্ষা অনেক বেশী। সে হাজারিকে ডাকিয়া বলিল–হাজারি, একটা কথা বলি, তোমার এখানে ফাস্ট আর সেকেন কেলাসের মধ্যে মোট চার পয়সার তফাৎ রেখেচ, এটা ভাল মনে হয় না আমার কাছে। এতে করে সেকেন কেলাসে খদ্দের কম হচ্ছে, বেশী লোক ফাস্ট কেলাসে খায় অথচ খরচ যা হয় তাদের পেছনে তেমন লাভ দাঁড়ায় না। গত এক মাসের হিসেব খতিয়ে দেখলাম কিনা! নরেন বাবাজী ছেলেমানুষ, সে হিসেবের কি বোঝে?

হাজারি কথাটার সত্যতা বুঝিল। বলিল–আপনি কি বলেন কর্তা?

–আমার মত হচ্ছে এই যে ফাস্ট কেলাস হয় একদম উঠিয়ে দাও, নয়তো আমার হোটেলের মত অন্ততঃ দুআনা তফাৎ রাখো। শীতকালে যখন সব সস্তা, তখন এ থেকে যা লাভ হবে, বর্ষাকালে বা অন্য সময় ফাস্ট কেলাসের খদ্দেরদের পেছনে সেই লাভের খানিকটা খেয়ে গিয়েও যাতে কিছু থাকে, তা করতে হবে। বুঝলে না?

–তাই করুন কর্তা। আপনি যা বোঝেন, আমি কি আর তত বুঝি?

বেচু চক্কত্তি খুব সন্তুষ্ট আছেন হাজারির ব্যবহারে। ঠিক সেই পুরোনো দিনের মতই হাজারির নম্র কথাবার্তা–যেন তিনিই মনিব, হাজারি তার চাকর। যদিও পদ্মঝি ও তিনি দুজনেরই দৃঢ় বিশ্বাস হাজারি যা কিছু করিয়া তুলিয়াছে, সবই কপালের গুণে, আসলে তাহার বুজিসুদ্ধি কিছুই নাই, তবুও দুজনেই এখন মনে ভাবে, বুদ্ধি যত খাক আর না-ই থাক–বুদ্ধি অবশ্য সকলের থাকে না–লোক হিসাবে হাজারি কিন্তু খুবই ভাল।

.

সকালে উঠিয়া হাজারি এক কলিকা গাঁজা সাজিবার উদ্যোগ করিতেছে। এই সময়টা সকলের অগোচরে সে একবার গাঁজা খাইয়া থাকে, হোটেলে গিয়া আজকাল সে-সুবিধা ঘটে না। এমন সময় অতসীকে ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া সে তাড়াতাড়ি গাঁজার কলিকা ও সাজসরঞ্জাম লুকাইয়া ফেলিল।

অতসীর মুখের দিকে চাহিয়া বলিল–কি মা?

–কাকাবাবু, আপনি কবে বম্বে যাচ্ছেন?

–আসছে মঙ্গলবার যাব, আর চার দিন বাকি।

–আমার বড় ইচ্ছে হচ্ছে আপনাকে নিয়ে এঁড়োশোলা যাব, আমাদের বৈঠকখানায় আবার আপনাকে আর বাবাকে চা জলখাবার এনে দেবো–যাবেন কাকাবাবু?

হাবির চোখে জল আসিল। কি তুচ্ছ সাধ! মেয়েদের মনে এই সব অতি সামান্য আশা-আকাঙ্খাই কি সব সময়ে পূর্ণ হয়? কি করিয়া সে এঁড়োশোলা যাইবে এখন? ছেলে-মানুষ, না হয় বলিয়া খালাস!

মুখে বলিল–মা, সে হয় না। কত কাজ বাকি এদিকে, সে-তো মা জান না। নরেন ছেলেমানুষ, ওকে সব জিনিস দেখিয়ে বুঝিয়ে না দিয়ে–

–আজ চলুন আমায় নিয়ে। গরুর গাড়ীতে আমরা বাপে-মেয়েতে চলে যাই–কাল বিকেলে চলে আসবেন। তা ছাড়া টেঁপিও বলছিল একবার গাঁয়ে যাবার ইচ্ছে হয়েছে। চলুন কাকাবাবু, চলুন–

–তা নিতান্ত যদি না ছাড় মা, তবে পরশু সকালে গিয়ে সেই দিনই সন্ধ্যার পরে ফিরতে হবে। থাকবার একদম উপায় নেই–কারণ তার পরদিনই বিকেলে রওনা হতে হবে আমায়। বোম্বাইয়ের ডাকগাড়ী রাত আটটায় ছাড়ে বলে দিয়েছে।

.

বৈকালে চূর্ণীর ধারের নিমগাছটার তলায় হাজারি একবার গিয়া বসিল। পাশের চুন-কয়লার আড়তে হিন্দুস্থানী কুলিরা সেই ভাবে সুর করিয়া সমস্বরে ঠেঁট হিন্দীতে গজল গাহিতেছে, চূর্ণীর খেয়াঘাটে ওপারের ফুলে-নবলার হাটের হাটুরে লোক পারাপার হইতেছে– পুরোনো দিনের মতই সব।

সে কি আজও বেচু চক্কত্তির হোটেলে কাজ করিতেছে? পদ্মঝিয়ের মুখনাড়া খাইয়া তাহাকে কি এখনি সদ্য আঁচ বসানো কয়লার উনুনের ধোঁয়ার মধ্যে বসিয়া ও-বেলার রান্নার ফর্দ বুঝিয়া লইতে হইবে?

সেই পদ্মদিদি ও সেই বেচু চক্কত্তির সঙ্গে সকালবেলাও তো কথাবার্তা হইয়াছিল। দাঁড়িপাল্লায় পাল্লা বদল হইয়াছে, পুরোনো দিনের সম্বন্ধগুলি ছায়াবাজির মত অন্তর্হিত হইল কোথায়? বোম্বাই…বোম্বাই কত দূরে কে জানে? টেঁপিকে লইয়া, অতসী বা কুসুমকে লইয়া যদি যাওয়া যাইত! ইহারা যে-কেহ সঙ্গে থাকিলে সে বিলাত পৰ্য্যত যাইতে পারে– দুনিয়ার যে-কোন জায়গায় বিনা আশঙ্কায় বিনা দ্বিধায় চলিয়া যাইতে পারে।

তখনকার দিনে সে কি একবারও ভাবিয়াছিল আজকার মত দিন তাহার জীবনে আসিবে? নরেনকে যেদিন প্রথম দেখে সেইদিনই মনে হইয়াছিল যে সুন্দর ছবিটি-–টেঁপি লাল চেলি পরিয়া নরেনের পাশে দাঁড়াইয়া, মুখে লজ্জা, চোখে চাপা আনন্দের হাসি–তখন মনে হইয়াছিল এসব দুরাশা, এও কি কখনও হয়?

সবই ঠাকুর রাধাবল্লভের দয়া। নতুবা সে আবার কবে ভাবিয়াছিল যে সে বোম্বাই যাইবে দেড়-শ টাকা মাহিনার চাকুরি লইয়া?

পরদিন অতসী আসিয়া আবার বলিল–কবে এঁড়োশোলা যাবেন কাকাবাবু? টেঁপিও যাবে বলছে, কাকীমাও বলছিলেন গাঁয়ে থেকে সেই অজি দু-বছর আড়াই বছর এসেছেন আর কখনও যান নি। ওঁরও যাবার ইচ্ছে। একদিনের জন্যেও চলুন না?

.

আবার স্বগ্রামে আসিয়া উহাদের গাড়ী চুকিল বহুদিন পরে। হাজারিদের বাড়ীটা বাসযোগ্য নাই, খড়ের ঘর এত দিন দেখাশোনার অভাবে নষ্ট হইয়া গিয়াছে–ঝড়ে খড় উড়িয়া যাওয়ার দরুন চালের নানা জায়গা দিয়া নীল আকাশ দিব্যি চোখে পড়ে।

অতসী টানাটানি করিতে লাগিল তাদের বাড়ীতে সবসুদ্ধ লইয়া যাইবার জন্য, কিন্তু টেঁপির মা রাজী নয়, নিজের ঘরদোরের উপর মেয়েমানুষের চিরকাল টান–ভাঙা ঘরের উঠানের জঙ্গল নিজের হাতে তুলিয়া ফেলিয়া টেঁপির সাহায্যে ঘরের দাওয়া ও ভিতরকার মেজে পরিষ্কার করিয়া নিজের বাড়িতেই সে উঠিল। টেঁপিকে বলিল–তুই বস মা, আমি পুকুরে একটা ডুব দিয়ে আসি, পেয়ারাতলার ঘাটে কতদিন নাই নি।

পুকুরের ঘাটে গিয়ে এ-পাড়ার রাধু চাটুজ্জের পুত্রবধুর সঙ্গে প্রথমেই দেখা। সে মেয়েটির বয়স প্রায় টেঁপির মায়ের সমান, দুজনে যথেষ্ট ভাব চিরকাল। টেঁপির মাকে দেখিয়া সে তো একেবারে অবাক–বাসন মাজা ফেলিয়া হাসিমুখে ছুটিয়া আসিয়া বলিল–ওমা, দিদি যে! কখন এলে দিদি? আর কি আমাদের কথা মনে থাকবে তোমার? এখন বড়লোক হয়ে গিয়েচ সবাই বলে। গরীবদের কথা কি মনে পড়ে?

দুজনে দুজনকে জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।

কিছুক্ষণ পরে রাধু চাটুজ্জের পুত্রবধুকে সঙ্গে লইয়া টেঁপির মা ঘাট হইতে ফিরিল। মেয়েটি বাড়ী ঢুকিয়া টেঁপিকে বলিল–চিনতে পারিস মা?

–ওমা, কাকীমা যে, আসুন আসুন–

-এস মা, জন্ম-এইস্ত্রী হও, সাবিত্রীর সমান হও। হ্যাঁ গা তা তোমার কেমন আক্কেল? মেয়েকে আনলে, অমনি জামাইকেও আনতে হয় না? শুনেছি চাঁদের মত জামাই হয়েছে। এ চুড়ি কে দিয়েছে–দেখি মা। ক ভরি! একে কি বলে? পাশা? দেখি দেখি–কখনও শুনিও নি এসব নাম। তা একটা কথা বলি। তোমাদের রান্না এ-বেলা এখানে হওয়ায় উপায়ও নেই–আমাদের বাড়ীতে তোমরা সবাই এ-বেলা দুটো ডালভাত–

টেঁপি বলিল–সে হবে না কাকীমা। অতসী-দি এসেছে আমাদের সঙ্গে জানেন না? অতসীদি সবাইকে বলেছে খেতে। সেখানেই নিয়ে গিয়ে তুলছিল আমাদের–মা গেল না, জানেন তো মার সাত প্রাণ বাঁধা এই ভিটের সঙ্গে–রাণাঘাটের অমন বাড়ী, কলের জল–শহর জায়গা, সেখানে থাকতেও মা শুধু বাড়ী-বাড়ী করে–আহা বাড়ীর কি ছিরি! ফুটো খড়ের চাল, বাড়ী বললেও হয়, গোয়াল বললেও হয়–

–বাপের বাড়ীর নিন্দে করিস নে, যা যা–আজ না হয় বড়লোক শ্বশুর হয়েছে, এই ফুটো খড়ের চালের তলায় তো মানুষ হয়েছ মা–

হাসি-গল্পের মধ্য দিয়া প্রায় ঘণ্টা দুই কখন কাটিয়া গেল। ইহাদের আসিবার খবর পাইয়া এ-পাড়ার ও-পাড়ার মেয়েমহলের সবাই দেখা করিতে আসিল। জামাইকে সঙ্গে করিয়া না আনার দরুন সকলেই অনুযোগ করিল।

টেঁপির মা বলিল–জামাইয়ের আসবার যো নেই যে! রেলের হোটেলের দেখাশুনো করেন, সেখানে একদিন না থাকলে চুরি হবে। উপায় থাকলে আনি নে মা?

অতসীর দুর্ভাগ্যের কথা সকলেই পূর্বে জানিত। গ্রামসুদ্ধ লোক তাহার অন্ত দুঃখিত। সবাই একবাক্যে বলে, অমন মেয়ে–দেবীর মত মেয়ে। আর তাই কপালে এই দুঃখ, এই কচি বয়সে।

সন্ধ্যার দেরি নাই। অতসীদের বৈঠকখানায় বসিয়া অতসীর বাবার সঙ্গে হাজারি কথাবার্তা বলিতেছিল। হরিচরণবাবু কন্যার অকাল-বৈধব্যে বড় বেশী আঘাত পাইয়াছেন। হাজারির মনে হইল যেন এই আড়াই বৎসরের ব্যবধানে তাঁর দশ বৎসর বয়স বাড়িয়া গিয়াছে। মেয়েকে দেখিয়া আজ তবুও একটু সুস্থ হইয়াছেন।

হরিচরণবাবু বলিলেন–এই দেখ তোমার বয়সে আর আমার বয়সে–খুব বেশী তফাৎ হবে না। তোমারও প্রায় পঞ্চাশ হয়েছে–না-হয় এক-আধ বছর বাকি। কিন্তু তোমার জীবনে উদ্যম আছে, আশা আছে, মনে তুমি এখনও যুবক। কাজ করবার শক্তি তোমার অনেক বেশী এখনও। এই বয়সে বম্বে যাচ্ছ, শুনে হিংসে হচ্ছে হাজারি। বাঙালীর মধ্যে তোমার মত লোক যত বাড়বে ঘুমন্ত জাতটা ততই জাগবে। এরা পঁয়ত্রিশ বৎসর বয়সে গলায় তুলসীর মালা পরে পরকালের জন্য তৈরী হয়–দেখছ না আমাদের গাঁয়ের দশা? ইহকালই দেখলি নে, ভোগ করলি নে, তোদের পরকালে কি হবে বাপু? সেখানেও সেই ভূতের ভয়। পরকালে নরকে যাবে। তুমি কি ভাবো অকৰ্মা, অলস, ভীরু লোকদের স্বর্গে জায়গা দেন নাকি ভগবান?

এই সময় পুরানো দিনের মত অতসী আসিয়া উঁহাদের সামনে টেবিলে জলখাবারের রেকাবি রাখিয়া বলিল–খান কাকাবাবু, চা আনি, বাবা তুমিও খাও, খেতে হবে। সন্ধ্যের এখনও অনেক দেরি–

কিছুক্ষণ পরে চা লইয়া অতসী আবার ঢুকিল। পিছনে আসিল টেঁপি। সেই পুরোনো দিনের মত সবই–তবুও কত তফাৎ! অতসীর মুখের দিকে চাহিলে হাজারির বুকের ভিতরটা বেদনায় টনটন করে। তবুও তো মা বাপের সামনে অতসী বিধবার বেশ যতদূর সম্ভব বর্জন করিয়াছে। মা বাপের চোখের সামনে সে বিধবার বেশে ঘুরিতে-ফিরিতে পারিবে না। ইহাতে পাপ হইবে।

হরিচরণবাবু সন্ধ্যাহ্নিক করিতে বাড়ীর মধ্যে গেলেন।

অতসীর দিকে চাহিয়া হাজারি বলিল–কেমন মা, তোমার সাধ যা ছিল, মিটেছে?

–নিশ্চয়ই কাকাবাবু। টেঁপি কি বলিস? কতদিন ভাবতুম গাঁয়ে তো যাবো, সেখানে টেঁপিও নেই, কাকাবাবুও নেই। কাদের সঙ্গে দুটো কথা বলব?

–কাল আমার সঙ্গে রাণাঘাট যেতে হবে কিন্তু মা।

–বাঃ, সে আমি বাবা-মাকে বলে রেখেছি। আপনাকে উঠিয়ে দিতে যাব না কি রকম? কাকাবাবু, টেঁপি এখন দিনকতক আমার কাছে এখানে থাক না? তাহলে আপনাকে গাড়ীতে তুলে দিয়ে আসবার সময় ওকে সঙ্গে করে আনি। নরেনবাবু মাঝে মাঝে এখানে আসবেন এখন।

নয়নের কথা বলাতে টেঁপি বাপের অলক্ষিতে অতসীকে এক রাম-চিমটি কাটিল।

–কাকাবাবু পুজোর সময় আসবেন তো! এবার আমাদের গাঁয়ে আমরা ঠাকুর পুজো করব।

–পুজোর তো অনেক দেরি এখন মা। যদি সম্ভব হয় আসবো বই কি। তবে তুমি যদি পুজো করো তবে আবার চেষ্টা করব।

টেঁপি বলিল–তোমাকে আসতেই হবে বাবা। মা বলেচে এবার প্রতিমা গড়িয়ে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা করবে। এখনও তিন-চার মাস দেরি পুজোর–সে-সময় ছুটি নিয়ে আসবে বাবা, কেমন তো?

রাধু মুখুয্যের পুত্রবধু নাছোড়বান্দা হইয়া পড়িয়াছিল, রাত্রে তাহাদের বাড়ীতে সকলকে খাইতে হইবেই। টেঁপির মা সন্ধ্যাবেলা হইতেই রাধু মূখুয্যের বাড়ী গিয়া কুটিয়াছে, মোচা কুটিয়া, দেশ কুমড়ো কুটিয়া তাহাদের সাহায্য করিতেছে। সে সরল গ্রাম্য মেয়ে, শহরের জীবনযাত্রার চেয়ে পাড়াগাঁয়ের এ জীবন তাহার অনেক ভাল লাগে। সে বলিতেছিল–ভাই, শহরে-টহরে কি আমাদের পোষায়? এই যে কুমড়োর ডাঁটাটুকু, এই এক পয়সা। এই এতটুকু করে কুমড়োর ফালি এক পয়সা। সে ফালি কাটতে বোধ হয় পোড়ারমুখো মিন্সেদের হাত কেটে গিয়েছে। আমার ইচ্ছে কি জান ভাই, উনি চলে গেলে আমি তিন-চার দিনের মধ্যে আবার গাঁয়ে আসব, পুজো পর্যন্ত এখানেই থাকব। মেয়ে-জামাই থাকল রাণাঘাটের বাসায়, ওই সব দেখানো করুক, ওদেরই জিনিস। আমার সেখানে ভাল লাগে না।

স্বামীকে কথাটা বলিতে হাজারি বলিল–তোমার ইচ্ছে যা হয় করো–কিন্তু তার আগে ঘরখানা তো সারানো দরকার। ঘরে জল পড়ে ভেসে যায়, থাকবে কিসে?

টেঁপির মা বলিল–সে ভাবনায় তোমার দরকার নেই। আমি অতসীদের বাড়ী থেকে কি ওই মুখূয্যের বাড়ী থেকে ঘর সারিয়ে নেব। জামাইকে বলে যেও খরচ যা লাগে যেন দেয়।

.

রাধু মুখূয্যের বাড়ী রাত্রে আহারের আয়োজন ছিল যথেষ্ট–খিচুড়ি, ভাজাভুজি, মাছ, ডিমের ডালনা, বড়াভাজা, টক, দই, আম, সন্দেশ। অতসীকেও খাইতে বলা হইয়াছিল কিন্তু সে আসে নাই। টেঁপি ডাকিতে গেলে কিন্তু অতসী বলিল, তাহার মাথা ভয়ানক ধরিয়াছে, সে যাইতে পারিবে না। 

শেষরাত্রে দুখানা গাড়ী করিয়া সকলে আবার রাণাঘাট আসিল। দুপুরের পর হাজারি একটু ঘুমাইয়া লইল। ট্রেন নাকি সারারাত চলিবে, কখনও সে অতদূর যায় নাই, অতক্ষণ গাড়ীতেও থাকে নাই। ঘুম হইবে না কখনই। যাইবার সময়ে টেঁপির মা ও টেঁপি কাঁদিতে লাগিল। কুসুমও ইহাদের সঙ্গে যোগ দিল।

অতসী সকলকে বুঝাইতে লাগিলছি—ছিঃ, কাঁদে না, ওকি কাকীমা? বিদেশে যাছেন একটা মঙ্গলের কাজ, ছিঃ টেঁপি, অমন চোখের জল ফেলো না ভাই।

হাজারি ঘরের বাহির হইয়াছে, সামনেই পদ্মঝি।

পদ্মঝি বলিল–এখন এই গাড়ীতে যাবেন ঠাকুর মশায়?

–হ্যাঁ, পদ্মদিদি এবেলা খদ্দের কত?

–তা চল্লিশ জনের ওপর। সেকেন কেলাস বেশী।

–ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছিলে তো?

পদ্মঝি হাসিয়া বলিল–ওমা, তা আর বলতে হবে? যতদিন বাজারে পাই, ততদিন ইলিশের বন্দোবস্ত। আষাঢ় থেকে আশ্বিন–দেখেছিলাম তো ও হোটেলে!

–হ্যাঁ সে তোমাকে আর আমি কি শেখাবো? তুমি হোলে গিয়ে পুরোনো লোক। বেশ হুঁশিয়ার থেকো পদ্মদিদি। ভেবো তোমায় নিজেরই হোটেল।

পদ্মঝি এক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটাইল। হঠাৎ ঝুঁকিয়া নীচু হইয়া বলিল–দাঁড়ান ঠাকুর মশাই, পায়ের ধূলোটা দেন একটু—

হাজারি অবাক, স্তম্ভিত। চক্ষুকে বিশ্বাস করা শক্ত। এ কি হইয়া গেল! পদ্মদিদি তাহার পায়ের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া পায়ের ধূলা লইতেছে! এমন একটা দৃশ্য কল্পনা করিবার দুঃসাহসও কখনো তাহার হয় নাই। কোন সৌভাগ্যটা বাকী রহিল তাহার জীবনে?

স্টেশনে তুলিয়া দিতে আসিল দুই হোটেলের কর্মচারীরা প্রায় সকলে–তা ছাড়া অতসী, টেঁপি, নরেন। বাহিরের লোকের মধ্যে যদু বাঁড়ুয্যে। যদু বাঁড়ুয্যে সত্যই আজকাল হাজারিকে যথেষ্ট মানিয়া চলে। তাহার ধারণা হোটেলের কাজে হাজারি এখনও অনেক বেশী উন্নতি দেখাইবে, এই তো সবে শুরু।

অতসী পায়ের ধূলা লইয়া বলিল–আসবেন কিন্তু পুজোর সময় কাকাবাবু, মেয়ের বাড়ীর নেমন্তন্ন বইল। ঠিক আসবেন–

টেঁপি চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল–খাবারের পুঁটুলিটা ওপরের তাক থেকে নামিয়ে কাছে রাখো বাবা, নামাতে ভুলে যাবে, তোমার তো হুঁশ থাকে না কিছু। আর রাত্তিরেই খেও, ভুলো না যেন। কাল বাসি হয়ে যাবে, পথেঘাটে বাসি খাবার খবরদার খাবে না। মনে থাকবে? তোমার চিঠি পেলে মা বলেচে রাধাবল্লভতলায় পুজো দেবে।

চলন্ত ট্রেনের জানালার ধারে বসিয়া হাজারির কেবলই মনে হইতেছিল পদ্মদিদি যে আজ তাহার পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিল এ সৌভাগ্য হাজারির সকল সৌভাগ্যকে ছাপাইয়া ছাড়াইয়া গিয়াছে।

সেই পদ্মদিদি!

ঠাকুর রাধাবল্লভ, জাগ্রত দেবতা তুমি, কোটি কোটি প্রণাম তোমার চরণে। তুমিই আছ। আর কেহ নাই। থাকিলেও জানি না।

16 Comments
Collapse Comments

অসংখ্য ধন্যবাদ!
এতো কষ্ট করে অনলাইনে পড়ার ব্যবস্থা করার জন্য!
এরকম না হলেএতো সুন্দর কিছু মনে হয় পড়া হতো না।

Swasata Bhattacharyya March 21, 2020 at 1:36 am

Thanks a lot

ভালো লাগলো।

অসাধারণ

Inspiring story.!!

মশিউর রহমান July 9, 2020 at 7:30 pm

প্রায় একই সময়ে দুজন পড়িয়াছি| নিজেকে কিছুটা হইলেও ভাগ্যবান মনে করিতেছি|

মশিউর রহমান July 9, 2020 at 7:24 pm

শুরুতেই একটুখানি আশংকা করিয়াছিলাম যে গল্পটার শেষের দিকটা হয়তো খুবই কষ্টকর হইবে|কিন্তু তাহা না হইয়া লেখাটা আমার মনের মতো হইয়াছে! পছন্দের লেখক বিভূবাবূ| ভালোবাসা পাঠাইলাম সহস্রাধিক

i thought so,,, we are same bro

Great story!

অনবদ্য অসাধারণ একটা উদ্দামি জীবন কাহিনী পড়লাম গল্পের মাধ্যমে,,, শেষ থেকে শুরু করার মধ্য দিয়ে অনেক অনুপ্রাণিত হলাম,, ঘুরে দাড়ানোর সাহসের সঞ্চার হলো আমার মনে প্রানে এই রচনা পড়ার মধ্য দিয়ে,,। দুদান্ত অনুপ্রেরণা মূলক জীবন শৈলী পড়লাম আজ হাজারি চরিত্রের মাধ্যমে,,, আমি মনে প্রানে পূর্বের তুলনায় বহু গুন অনুপ্রাণিত হলাম বিভুতিভূষন বন্দোপাধ্যায়ের অনবদ্য রচনা আর্দশ হিন্দু হোটেল গল্প টি পঠনের মধ্য দিয়ে।

বিভূতিবাবু!আপনি পারেনও বটে!

unprecedented novel

দারুণ উপন্যাস।বার বার পড়তে ইচ্ছে করে।
এটা ২য় বার পড়লাম।পথের পাঁচালী,অরণ্যাক
কয়েকবার করে পড়া হয়ে গেছে।
আশ্যর্য্য লেখনি শক্তি।বার বার পড়লেও আশ
মেটে না।

মোস্তাফিজুর রহমান April 26, 2023 at 9:11 pm

সুখপাঠ্য উপন্যাস যাকে বলে ! তবে বিধবা বিবাহের প্রতি একটু নমনীয় হলে আমাদের সুখের মাত্রা হতো সীমাহীন !

Brilliant story

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *