০৩. হোটেলে ফিরিয়া হাজারি ঠাকুর

হোটেলে ফিরিয়া হাজারি ঠাকুর একটি দুঃসাহসের কাজ করিল।

মতি চাকর পূর্ব হইতেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। তাহাকে তুলিয়া বলিল–মতি, আমি রাত তিনটের গাড়ীতে বাড়ী যাচ্চি। এত লুচি কি হবে, বাড়ীতে দিয়ে আসি। তুমি থাকো, আমি কাল সকাল দশটার গাড়ীতে এসে রান্না করবো, কর্তা মশায়কে বলো।

মতি অবাক লইয়া বলিল–এত রাত্রে লুচি নিয়ে বাড়ী রওনা হবে।–

–এত লুচি কি হবে? এখানে থাকলে কাল সকালে বারোভূতে খাবে তো। আমার জিনিস নিজের বাড়ী দিয়ে আসি। আমার বাড়ীতে ছেলেমেয়ে আছে, তারা খেতে পায় না, তাদের দিয়ে আসি! ছ’টা পয়সা তো খরচ।

হাজারি আর ঘুমাইল না। টেঁপির জন্য তার মন-কেমন করিয়া উঠিয়াছে। কুসুম যেমন, টেঁপিও তেমন। আরও দুটি ছেলে আছে ছোট ছোট। তাদের মুখ বঞ্চিত করিয়া এত লুচি এখানে রাখিয়া পদ্ম ঝি আর কর্তামশায়ের বাড়ীতে খাওয়াইয়া কোন লাভ নাই।

রাত সাড়ে তিনটার সময় গাংনাপুর স্টেশনে নামিয়া হাজারি নিজের গ্রামের পথ ধরিল এবং সাড়ে তিন কোশ পথ হাঁটিয়া ভোর হইবার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে পৌঁছিল।

এঁড়োশোলা এক সময়ে বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল–এখন পূর্বের শ্রী নাই। গ্রামের জমিদার কর বাবুরা এখান হইতে উঠিয়া কলিকাতা চলিয়া যাওয়াতে গ্রামের মাইনর স্কুলটির অবস্থা খারাপ হইয়া পড়িয়াছে। বড় দীঘিটা মজিয়া গিয়াছে, ভদ্রলোকের মধ্যে অনেকে এখান হইতে বাস উঠাইয়া কেহ রানাঘাট, কেহ কলিকাতা চলিয়া গিয়াছেন। নিতান্ত নিরুপায় যারা তারাই গ্রামে পড়িয়া আছে।

হাজারির বাড়ীতে দুখানা খড়ের ঘর। ছোট উঠান, একদিকে কাঁঠাল গাছ, অন্যদিকে একটা সজনে গাছ এবং একটা পেয়ারা গাছ। এই পেয়ারা গাছটা হাজারির মা নিজের হাতে পুঁতিয়াছিলেন– বেশ বড় বড় পেয়ারা হয়, কাশীর পেয়ারার বীজের চারা।

হাজারির ডাকাডাকিতে হাজারির স্ত্রী উঠিয়া দোর খুলিয়া, এ অবস্থায় স্বামীকে দেখিয়া বলিল–এসো, এসো। শেষ রাতের গাড়ীতে এলে কেন গো? এই দুরান্তর রাস্তা, অন্ধকার রাত–আবার বড্ড সাপের ভয় হয়েছে–সাপের কামড়ে দু-তিনটি মানুষ মরে গিয়েছে এর মধ্যে।

–আমাদের গাঁয়ে?

–আমাদের গায়ে নয়–নতুন কাওয়া পাড়ায় একটা মরেচে আর বামন পাড়ায় শুনচি একটা–অত বড় বোঁচকাতে কি গো?

হাজারি লুচির আসল ইতিহাস কিছু বলিল না। স্ত্রীর আনন্দপূর্ণ সাগ্রহ প্রশ্নের উত্তরে সে কেবল বলিল–পেয়েছি গো পেয়েছি। ভগবান দিয়েছেন, সবাই মিলে খেয়ে নাও মজা করে। টেঁপিকে খুব করে খাওয়াও, ও পেট ভরে খাবে আমি দেখি।

.

সেদিন সকালের গাড়ীতে হাজারি রাণাঘাটে ফিরিতে পারিল না।

দুপুরের পরে হাজারি কুসুমের বাপের বাড়ী বেড়াইতে গেল।

এই গ্রামেই গোয়ালপাড়ায় কুসুমের জ্যাঠামশায় হরি ঘোষের অবস্থা এক সময় যথেষ্ট ভাল ছিল, এখনও বাড়ীতে গোহাল-পোরা গরুর মধ্যে আট-দশটি অবশিষ্ট আছে, দুটি ছোট ছোট ধানের গোলাও বজায় আছে।

হাজারিকে হরি ঘোষ খুব খাতির করিয়া খেজুর পাতার চটে বসিতে দিল। বলিল–কবে আলেন বাবাঠাকুর? সব ভালো।

–তোমরা সব ভাল আছ?

–আপনার ছিচরণের আশিব্বাদে এক রকম চলে যাচ্ছে। রাণাঘাটেই কাজ কচ্চেন তো?

–হ্যাঁ। সেখান থেকেই তো এলাম।

–আমাদের কুসুমের সঙ্গে দেখা-টেখা হয়?

হাজারি পাড়াগাঁয়ের লোক, এখানকার লোকের ধাত চেনে। কুসুমের সঙ্গে সর্বদা দেখা শোনা বা তাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি টানের কোন পরিচয় সে এখানে দিতে চায় না। ইহারা হয়তো সহজ ভাবে সেটা গ্রহণ করিতে পারিবে না। গ্রামে কথাটা রাষ্ট্র হইয়া গেলে লোকে নানারূপ কদৰ্থ টানিয়া বাহির করিবার চেষ্টা করিবে তাহা হইতে। সুতরাং সে বলিল

–হ্যাঁ,–দু-একবার হয়েছিল। ভাল আছে।

–এবার যদি দেখা হয়, একবার আসতে বলবেন ইদিকে। তার গাঁয়ে আসবার দিকে তত টান নেই, শহরে দুধ বেচে চালানো যে কি মিষ্টি লেগেছে!

হাজারি কথার গতি অন্য দিকে ঘুরাইবার উদ্দেশ্যে বলিল–এবার আবাদপত্র কি রকম হোল বল?

-ধানের আবাদ করিচি বারো বিঘে আর বাকী সব তরকারি। কুমড়ো দু-বিঘে, আলু, পেঁয়াজ,–তা এবার আকাশের অবস্থা ভাল না বাবাঠাকুর, ক্ষেতে মাটি ফেটে যাচ্চে!

তরকারির কথায় হাজারির নিজের গোপনীয় উচ্চাশার কথা মনে পড়িল। তরকারি তাহার গ্রাম হইতে কিনিলে রাণাঘাট বাজারের চেয়ে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। এখন হইতেই সে আনাজপত্র লইয়া যাইবে।

হৰি ঘোষকে বলিল–আচ্ছা, তোমাদের আলু ক’মণ হতে পারে?

–বাবাঠাকুর তার কি কোন ঠিক আছে? তবে ত্রিশ-চল্লিশ মণ খুব হবে।

–তুমি সমস্ত আলু আমায় দিতে পারবে? নগদ দাম দেবো।

হরি ধোষ কৌতূহলের সহিত জিজ্ঞাসা করিল–বাবাঠাকুর, আজকাল কাঁচামালের ব্যবসা করচেন নাকি?

–ব্যবসা এখনও করিনি, তবে করবো ভাবচি। সে তোমায় বলব একদিন।

গোয়ালপাড়া হইতে আসিবার পথে একটা খুব বড় বাঁশবনের মাঝখান দিয়া পথ। এখানে লোকজন নাই, এঁড়োশোলা গ্রামেই লোকজনের বসত নাই। আগে ছিল–ম্যালেরিয়ায় মরিয়া হাজিয়া লোকশূন্য হইয়া পড়িয়াছে। শুধুই বড় বড় আম-কাঁঠালের বাগান ও বাঁশবনের জঙ্গল।

এই বাঁশবনের মধ্যে পুরোনো দিনে পালিত পাড়া ছিল, হাজারি বাল্যকালেও দেখিয়াছে। পালিতেরা বেশ বর্ধিষ্ণু ছিল গ্রামের মধ্যে, পূজাপার্বণ, দোল-দুর্গোৎসব পৰ্যন্ত হইয়াছে বাজেন পালিতের বাড়ী। এখন জঙ্গলের মধ্যে পালিতদের ভিটাটা পড়িয়া আছে এই পর্যন্ত। দিন মানেই বোধ হয় বাঘ লুকাইয়া থাকে।

বাঁশঝাড়ে কটকট করিয়া শুকনো বাঁশের শব্দ হইতেছে–ঘন ছায়া, শুকনো বাঁশপাতার ও সোলার শব্দ। ফিঙ্গে, শালিখ পাখীর কলরব। হাজারির মনে হইল, আজ যেন তার হোটেলের দাসত্ব-জীবন গতে মুক্তির দিন। সেই ভীষণ গরম উনুনের সামনে বসিয়া আজ আর তাকে ডেকচিতে ভাত-ডাল রান্না করিতে হইবে না। পদ্ম ঝিয়ের কড়া তাগাদা ও মুরুব্বিয়ানা সহ্য করিতে হইবে না। বাঁশবনের ছায়ায় পূর্ণ শান্তিতে সে যদি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরিয়া ঘুমায়–তাহা হইলেও কেহ কিছু বলিতে পারিবে না।

এই মুক্তি সে ভাল ভাবেই আবাদ করিতে চায় বলিয়াই তো হোটেল খুলিবার কথা এত ভাবে।

সে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়াছে, এইবার কিছু টাকা হইলেই সে রাণাঘাটের বাজারে হোটেল খুলিয়া দিতে পারে।

হাজারি সত্যই চিন্তা করিতে আরম্ভ করিল, টাকা কোথায় ধার পাওয়া যাইতে পারে। এক গ্রামের গোসাঁইরা বড় লোক, কিন্তু তাহারা প্রায় সবাই থাকে কলিকাতায়। এখানে বৃদ্ধ কেশব গোসাঁই থাকেন বটে কিন্তু লোকটা ভয়ানক কৃপণ–তিনি কি হাজারির মত সামান্য লোককে বিনা বন্ধকে, বিনা জামিনে টাকা ধার দিবেন?

হাজারির জামিন হইবেই বা কে!

তাহার অবস্থা অত্যন্তই খারাপ। দু’খানা মাত্র চালাঘর। রান্নাঘরখানা গত বর্ষায় পড়িয়া গিয়াছে–পয়সা অভাবে সারানো হয় নাই, উঠানের আমতলায় রান্না হয়–বৃষ্টির দিন এখন ক্রমশঃ চলিয়া গেল, এখন তত অসুবিধা হয় না।

বেলা প্রায় পড়িয়া আসিয়াছে।

হাজারি বাড়ী ফিরিয়া দেখিল, তাহার ছোট মেয়ে টেঁপি ঘরের দাওয়ায় বসিয়া উল বুনিতেছে। টেঁপি বাবাকে দেখিয়া বলিল–তোমার জন্য আসন বুনচি বাবা-কাল তুমি যদি থাকো, কালকের মধ্যে হয়ে যাবে। তোমার সঙ্গে দিয়ে দেবো।

হাজারি মনে মনে হাসিল। বেচু চক্কত্তির হোটেলে সে রঙীন পশমের আসন পাতিয়া খাইতে বসিয়াছে–ছবিটি বেশ বটে। পদ্ম ঝি কি মন্তব্য করিবে তাহা হইলে?

মেয়েকে বলিল–দেখি কেমন আসন? বা বেশ হচ্ছে তো, কোথায় শিখলি তুই বুনতে?

টেঁপি বলিল–মুখুয্যে-বাড়ীর নীলা-দি আর অতসী-দি’র কাছে। আমি রোজ যাই দুপুরে, ওরা আমায় গান শেখায়, বোনা শেখায়।

–ওরা এখনও আছে? হরিচরণবাবু চলে যান নি এখনও?

–ওরা নাকি এ মাসটা থাকবে। থাকলে তো আমারই ভাল–আমি কাজটা শিখে নিতে পারি। কি চমৎকার গান গাইতে পারে অতসী-দি! আজ শুনবে বাবা?

–তুই গান শিখলি কিছু?

টেঁপি লাজুক স্বরে বলিল–দু-একটা। সে কিছু নয়। তুমি অতসী-দির গান যদি শোনো, তবে বলবে যে কলের গানের রেকর্ড শুনচি। ওদের বাড়ী খুব বড় কলের গানও আছে। রোজ সন্ধ্যের পর বাজায়। কত রকমের গান আছে–যাবে শুনতে সন্ধ্যের পর? অতসী-দি নিজে কল বাজায়। আমিও যাবো তোমার সঙ্গে–অতসী-দিকে বলবো বাবা এসেছে, ভালো ভালো বেছে গান দেবে।

 হাজারি বলিল–হ্যাঁরে, হরিচরণবাবুর শরীর সেরেচে জানিস?

–তা তো জানিনে, তবে তিনি বৈঠকখানায় বসে রোজই তো সবার সঙ্গে গল্প করেন। একদিন বৈঠকখানায় কলের গান বাজিয়েছিলেন। কি চমৎকার কীৰ্ত্তন!

সঙ্গীত-শিল্পের প্রতি বর্তমানে হাজারির তত আগ্রহ নাই, হাজারির উদ্দেশ্য হরিচরণবাবুকে বলিয়া কহিয়া অন্ততঃ শ’দুই টাকা ধার করা যায় কিনা, সেদিকে।

হরিচরণ মুখুয্যে মহাশয় এ গাঁয়ের মধ্যে একমাত্র শিক্ষিত, অবস্থাপন্ন ও সম্ভ্রান্ত লোক। তাঁহারা এ গ্রামের জমিদার–কিন্তু অনেক দিন হইতেই গ্রাম ছাড়িয়াছেন। প্রকাণ্ড তিন-মহলা বাড়ী পড়িয়া আছে, দু-একজন বৃদ্ধা পিসী-মাসী ছাড়া বাড়ীতে আর কেহ এতদিন ছিল না।

আজ মাস চার-পাঁচ হইল হরিচরণ মুখুয্যের একমাত্র পুত্র কলিকাতায় মারা যায় বসন্ত রোগে। পুত্রের মৃত্যুর পর হইতেই আজ প্রায় তিন মাস হইল হরিচরণবাবু সপরিবারে দেশের বাটীতে আসিয়া যে কেন বাস করিতেছেন–সে খবর হাজারি রাখে না। তবে ইহা জানে যে, হরিচরণবাবু গ্রামের উত্তর মাঠে একটি দীঘি খনন করিবার জন্য জেলা বোর্ডের হাতে অনেকগুলি টাকা দান করিয়াছেন এবং পুত্রের নামে একটি ডিসপেনসারী করিয়া দিবেন গ্রামে। হরিচরণবাবু কারো বাড়ী যান না। নিজের বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন সব সময়। তার দুই মেয়ে ও স্ত্রী এখানেই, তাছাড়া চাকর-বাকর ও দু’জন দরোয়ান আছে বাড়ীতে।

সন্ধ্যার পর সাহসে ভর করিয়া হাজারি হরিচরণবাবুর পৈতৃক আমলের বৈঠকখানার উঠানে গিয়া দাঁড়াইল। বৈঠকখানা বাড়ীর সামনে বড় বড় থামওয়ালা সাদা মার্বেল পাথর বাঁধানো বারান্দা। বারান্দার সামনে একটা মাঝারি গোছের কামরা, পাশে একটা ছোট কামরা, পূর্বে নবীনবাবু বলিয়া ইহাদের এক সরিক বড় বৈঠকখানার পাশে পৃথক ভাবে নিজের জন্য আর একটি বৈঠকখানা তৈরী করিয়াছিলেন–তিনি আজ পঁচিশ বৎসর হইল নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যাওয়াতে, উক্ত বৈঠকখানা ঘর বর্তমানে বিচালি রাখিবার জন্য ব্যবহৃত হয়।

হাজারি টেঁপিকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিল। টেঁপি বলিল–বাবা তুমি বোসো, আমি অতসী-দিকে বলিগে তুমি এসেছ কলের গান শুনতে। এখুনি দেবে গান।

বৈঠকখানার সামনে হাজারিকে দাঁড় করাইয়া রাখিয়া টেঁপি পাশের ছোট্ট দরজা দিয়া বাড়ীর মধ্যে সরিয়া পড়িল।

ঘরের মধ্যে তেলের চৌপায়া লণ্ঠন জ্বলিতেছে। ইহা সাবেকী কালের বন্দোবস্ত, এখনও ঠিক বজায় আছে। হাজারি বারান্দায় দাঁড়াইয়া ইতস্ততঃ করিতেছে ঘরে ঢুকিবে কিনা, এমন সময় ঘরের ভিতর হইতে স্বয়ং হরিচরণবাবু বারান্দায় বাহির হইয়াই সামনে হাজারিকে দেখিয়া বলিলেন–কে?

হাজারি বিনীত ভাবে হাত জোড় করিয়া মাথা নীচু করিয়া প্রণাম করিয়া বলিল–বাবু, আমি হাজারি—

–ও, হাজারি! কি মনে করে, এসো এসো। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন, ঘরের মধ্যে এসো। মাস-দুই তোমায় দেখিনি। তোমার মেয়ে মাঝে মাঝে আসে বটে, আমার বড় মেয়ে অতসীর সঙ্গে তার বেশ ভাব।

হরিচরণবাবুর বয়স পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন হইবে, গৌরবর্ণ, লম্বা আড়ার চেহারা, বড় বড় চোখ –গলার স্বর গম্ভীর। তিনি খুব শৌখীন লোক ছিলেন। এখনও এই বয়সেও এবং ছেলে মারা যাওয়া সত্ত্বেও বেশ শৌখীনতা ও সুরুচির পরিচয় আছে তার আটপৌরে পোশাকেও।

হাজারি আসলে আসিয়াছে টাকা ধার করিবার কথা বলিতে। কিন্তু বৈঠকখানা ঘরে ঢুকিয়া প্রকাণ্ড বড় সেকেলে প্রমাণ সাইজের আয়নাখানায় নিজের আপাদ-মস্তক দেখিয়াই তাহার সাহসটুকু সব উবিয়া গেল।

হরিচরণবাবুর নির্দেশ মত সে একখানা চেয়ারে বসিল।

হরিচরণবাবু বলিলেন–চা খাবে হাজারি?

হাজারি আমতা আমতা করিয়া বলিল–আজ্ঞে, চা আমি–থাকগে, সে কেন আবার কষ্ট–

হরিচরণবাবু বলিলেন–বিলক্ষণ! কষ্ট কিসের? আমি তো চা খাবোই এখন, দাঁড়াও আনতে বলি

এই সময় টেঁপি বৈঠকখানার যে দোর অন্তঃপুরের দিকে, সেখানে আসিয়া দাঁড়াইল। হরিচরণবাবুকে বৈঠকখানার মধ্যে দেখিয়াও সে বেশ সহজ ভাবেই বলিল–বাবা দাঁড়াও, অতসী-দি কলের গান বাজাচ্চে-আমি বলেছি আমার বাবা তোমাদের কলের গান শুনতে এসেচে

হরিচরণ বাবু বলিয়া উঠিলেন–কলের গান শুনতে এসেচ হাজারি! তা আমাকে বলতে হয় এতক্ষণ। শুনতে আসবে এর আর কথা কি? তোমরা দু-পাঁচজন আস-ধাও, বড় আনন্দের কথা। গ্রাম তো লোকশূন্য হয়ে পড়েচে। ওরে খুকি, তোর বাবার জন্যে আর আমার জন্যে দু’ পেয়ালা চা আনতে বলে দে তোর অতসী-দিদিকে।

হাজারি মনে মনে টেঁপির উপর চটিয়া গেল। হতভাগা মেয়েটা সব দিল মাটি করিয়া। কে তাহাকে বলিয়াছিল কলের গান শুনিতে সে যাইতেছে মুখুয্যে বাড়ীতে? অতঃপর টাকার কথা উত্থাপন করা কি ভালো দেখায়? নাঃ, যত ছেলেমানুষ নিয়া হইয়াছে কারবার!

হরিচরণবাবুর মেয়ে অতসী এই সময় দু’ পেয়ালা চা-হাতে ধরে ঢুকিল। প্রথমে হাজারি সামনে টেবিলে একটি পেয়ালা নামাইয়া অন্য পেয়ালাটি হরিচরণবাবুর হাতে দিল। অতসীয় বয়স আঠারো-উনিশ, বেশ ধপধপে ফর্সা, সুন্দর মুখশ্রী–ডাগর ডাগর চোখ–এক কথায় অতসী সুন্দরী মেয়ে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অথচ সহজ অনাড়ম্বর সাজগোজ, হাতে কয়েক গাছি সরু সোনার চুড়ি এবং কানে ইয়ারিং ছাড়া অলঙ্কারেরও কোন বাহুল্য নাই।

হরিচরণবাবু বলিলেন–তোমার হাজারি কাকা–প্রণাম কর অতসী।

অতলী আগাইয়া আসিয়া হাজারির সামনে নীচু হইয়া প্রণাম করিয়া পায়ের ধূলা লইল। হাজারি সঙ্কুচিত হইয়া বলিল–থাক থাক এসো মা, রাজরাণী হও মা–এসো, কল্যাণ হোক।

অতসীকে হরিচরণবাবু বলিলেন–তোমার হাজারি কাকা গান শুনবেন। গ্রামোফোনটা নিয়ে এসো।

অতসীর সঙ্গে টেঁপি খুব ভাব করিয়াছে। টেঁপির বাবাকে অতসী এই প্রথম– দেখিল বন্ধুর পিতা কি রকম দেখিতে, কৌতূহলের সহিত সে চাহিয়া দেখিতেছিল, বাবার কথায় বাড়ীর মধ্যে চলিয়া গেল এবং কিছুক্ষণ পরে চাকরের হাতে দিয়া গ্রামোফোন রেকর্ডের বার বাহিরে পাঠাইয়া দিল।

হরিচরণবাবু চাকরকে বলিলেন বাজাবে কে? তোর দিদিমণি আসছে না?

–দিদিমণি যে বল্লেন আপনি বাজাবেন–

–আমি ভাল চোখে দেখতে পাব না। তাকেই পাঠিয়ে দিগে যা– একটু পরে অতসী, টেঁপি এবং পাড়ার আরও দু-তিনটি মেয়ে ঘরে ঢুকিল। কলের গান বাজনা শুরু হইল এবং চলিল ঘণ্টা-দুই। আরও একবার চা দিয়া গেল চাকরে, কিন্তু পরিবেশন করিল অতসী।

সব মিটিয়া চুকিয়া যাইতে রাত্রি প্রায় সাড়ে ন’টা বাজিয়া গেল। হাজারি ছটফট করিতেছিল, গান শুনিতে সে এখানে আসে নাই।

গান বন্ধ হইলে অতসী, টেঁপি ও মেয়ের দল যখন বাড়ীর মধ্যে চলিয়া গেল, তপন হাজারি সাহসে ভর করিয়া বলিল–আপনার কাছে একটা আর্জি ছিল বাবু।

হরিচরণবাবু বলিলেন–কি বল?

–আমার কিছু টাকা দরকার, যদি আমায় কিছু ধার দিতেন, তাহলে আমার একটা মস্ত বড় আশার কাজ মিটতো।

–মেয়ের বিয়ে দেবে?

–আজ্ঞে না বাবু, তা নয়, ব্যবসা করবো।

–কি ব্যবসা?

–বাবু আপনি তো জানেন আমি হোটেলে কাজ করি। আপনার কাছে লুকোবে না। আমি নিজে একটা হোটেল খুলতে চাচ্ছি এবার। টাকাটা সেজন্যে দরকার।

–কত টাকা দরকার?

–অন্তত দুশো টাকা আমায় যদি দয়া করে দেন বাবু, আমার খালধারের কাঁঠাল বাগান আমি বন্ধক রাখচি আপনার কাছে। এক বছরের মধ্যে টাকাটা শোধ করবে।

হরিচরণবাবু ভাবিয়া বলিলেন–বাগান বন্ধক রেখে টাকা আমি দিতাম না, দিতাম তো তোমাকে এমনি দিতাম, কিন্তু অত টাকা এমন সময় আমার হাতে নগদ নেই।

হাজৰি এ-কথার পরে আর কোনো কথা বলিতে পারিল না, বিশেষত সে জানিত হরিচরণবাবু উদার মেজাজের মানুষ, সত্যবাদী লোক। টাকা হাতে থাকিলে, হাতে টাকা না থাকার কথা বলিতেন না।

অতলী আসিয়া বলিল–কাকা, আপনি একটু বসুন। টেঁপি খেতে বলেছে, মা ছাড়বে না। মেয়েরা, যারা গান শুনতে এসেছিল, সবাইকে না খাইয়ে যেতে দেবেন না। একটু দেরি হবে। না হয় আপনি যান, আমি ঝি’র সঙ্গে পাঠিয়ে দেব এখন। হরিচরণবাবু বলিলেন –তোমার যদি বিশেষ কাজ না থাকে, একটু বসে যাও না হাজারি। তোমার সঙ্গে দুটো কথা কই। কেউ বড় একটা আসে না আমার এখানে–। হাজারি বসিল।

–তুমি কোথায় কোন হোটেলে কাজ কর?

–আজ্ঞে রাণাঘাট, বেচু চক্কত্তির হোটেলে, রেল-বাজারের মধ্যে।

–কত মাইনে পাও?

–বাবু সে আর বলবার কথা নয়, খাওয়া আর সাত টাকা মাসে। তাই ভাবছিলাম পরের তাঁবে থাকবে না। এদিকে বয়স হলো, এইবার একটা হোটেল খুলে নিজে চালাবো।

–হোটেল চালাতে পারবে?

–তা বাবু আপনার আশীর্বাদে একরকম সবই জানি ও-লাইনের। বাজার আর রান্না, হোটেলের দুটো মস্ত কাজ, এ যে শিখেচে, সে হোটেল খুলে লাভ করতে পারে। আমি অনেকদিন থেকে চেষ্টা করে ও দুটো কাজ শিখে নিইচি–খদ্দের কি চায় তাও জানি। চাকরি করি রাঁধুনীর বটে বাবু কিন্তু আপনার বাপ-মায়ের আশীর্বাদে, আপনার আশীর্বাদে চোখ-কান খুলে কাজ করি।

–বেশ ভাল।

উৎসাহ পাইয়া হাজারি তাহার বহুদিনের আশা ও সাধ একটি আদর্শ হিন্দু হোটেল প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে অনেক কথা বলিল। চূর্ণীনদীর ধারে বসিয়া অবসর মুহূর্তে তাহার সে স্বপ্ন দেখার কথাও গোপন করিল না। তাহার রান্না খাইয়া কলিকাতার বাবুরা কি রকম সুখ্যাতি করিয়াছে, যদু বাঁড়ুয্যের হোটেলে তাহাকে ভাঙ্গাইয়া লইবার চেষ্টা, কিছুই বাদ দিল না। হরিচরণবাবু বলিলেন–দেখ হাজারি, তোমার কথা শুনে তোমার ওপর আমার হিংসে হয়। তোমার বয়েস হোলে কি হবে, তোমার জীবনে মস্ত বড় আশা রয়েছে একটা কিছু গড়ে তুলবো। এই আশাই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, আমার ছেলেটা মারা যাওয়ার পর আমার জীবনে যেন সব-কিছু ফুরিয়ে গিয়েছে মনে হয়। আর যেন কিছু করবার নেই, ক’রে কি হবে, কার জন্যে করবো এই সব কথা মনে ওঠে। তা ছাড়া জীবনে কখনোই কিছু দরকার হয়নি। বাবার সম্পত্তি ছিল যথেষ্ট–নতুন কিছু গড়ে তুলবো এ ইচ্ছে কোনদিন জাগেনি। তোমার বয়েস হোলে কি হবে, ওই একটা আশাই তোমায় যুবক করে রেখে দেবে যে! আমার মাথায় এত পাকা চুল ছিল না। খোকা মারা যাওয়ার পরে জীবনের উদ্যম, আশা ভরসা যেমন চলে গেল, অমনি মাথার চুল পেকে উঠলো। তবে এখন ইচ্ছে আছে খোকার নামে একটা স্কুল করে দেবো। আবার ভাবি, স্কুলে পড়বেই বা কে? আমাদের এ অঞ্চলে তো লোকের বাস নেই। তার চেয়ে না হয় একটা ডাক্তারখানা করে দিই। উদ্যমই জীবনের সবটুকু, যার জীবনে আশা নেই, যা কিছু করার ছিল সব হয়ে গেছে–তার জীবন বড় কষ্টকর। যেমন ধরো দাঁড়িয়েচে আমার। খোকা মারা না গেলে আজ আমার ভাবনা হে হাজারি! ভেবেছিলুম কয়লার খনি ইজারা নেবো–কত উৎসাহ ছিল। এখন মনে হয় কার জন্যে করবো? তাই বলচিলুম, তোমায় দেখে হিংসে হয়। তোমার জীবনে উদ্যম আছে, আশা আছে–আমার তা নেই। আর এই দেখ, এই পাড়াগাঁয়ে একলাটি আছি পড়ে, ভালো লাগে কি? ভালো লাগে না। কখনো থাকিনি, কিন্তু বাইরে আর হৈ-চৈ-এর মধ্যে থাকতে ভাল লাগে না। ওই মেয়েটা আছে, কলের গান এনেচে একটা– বাজায়, আমি শুনি। ওর মায়ের জন্যে বেছে বেছে ভক্তি আর দেহতত্ত্বের গান কিনে দিইচি, যদি তা শুনে তার মনটা একটু ভাল থাকে। মেয়েমানুষ, কষ্টটা লেগেছে তার অনেক বেশী।

হাজারি এই দীর্ঘ বক্তৃতার সবটা তেমন বুঝিল না–কেবল বুঝিল, পুত্রশোকে বৃদ্ধের মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে।

সে সহানুভূতিসূচক দু-চার কথা বলিল। বেশী কথা অনেকক্ষণ ধরিয়া গুছাইয়া বলিতে কখনো সে শেখে নাই, তবুও পুত্রশোকাতুর বৃদ্ধের জন্য তাহার সত্যকার দুঃখ হওয়াতে, ভাবিয়া ভাবিয়া মনে মনে বানাইয়া কিছু বলিল।

হরিচরণবাবু বলিলেন–আর একটু চা খাবে?

–আজ্ঞে না। চা খাওয়া আমার তেমন অভ্যাস নেই, আপনি খান বাবু।

এমন সময় টেঁপি আসিয়া বলিল–বাবা, যাবে?

হাজারি হরিচরণবাবুর কাছে বিদায় লইয়া মেয়েকে সঙ্গে করিয়া বাহির হইল। জ্যোৎস্না উঠিয়াছে, ভড়েদের বাড়ীর উঠানে রাঙাকাঠ কাটিয়াছে–রাঙাকাঠের গন্ধ বাহির হইতেছে। সিধু ভড় দাওয়ায় জাল বুনিতেছিল, বলিল–দা-ঠাকুর কনে ছেলেন এত রাত অবদি?

হাজারি বলিল–বাবুর বাড়ী। বাবু ছাড়েন না কিছুতে, চা খাও, কলের গান শোন, শেষে তো টেঁপিকে না খাইয়ে ছাড়লেন না গিন্নী মা। হাজারির বড় ভাল লাগিয়াছিল আজ সন্ধ্যাটা। বড় লোকের বৈঠকখানায় এমন ভাবে বসিয়া চা সে কখনো খায় নাই, খাতির করিয়া তাহার সঙ্গে কোনো বড় লোকে মনের কথাও কখনো বলে নাই। কলের গান তো আছেই। মেয়েকে বলিল–টেঁপি কি খেলি রে? টেঁপি একটু ভোজনপ্রিয়। খাইতে ভালবাসে আর গরীবের মেয়ে বলিয়াই অতসীর মা তাহাকে না খাওয়াইয়া ছাড়েন না। বলিল–পরোটা, মাছের ডালনা, সুজি, পটলভাজা, আলুভাজা–

হাজারির স্ত্রী অনেকক্ষণ রান্না সারিয়া বসিয়া আছে, বলিল–এত রাত্তির পজ্জন্ত ছিলে কোথায় সব? পাড়া বেড়ানো শেষ হয় না যে তোমাদের, বসে বসে কেবল ঘুম আসচে–

টেঁপি বলিল–আমি খেয়ে এসেছি মা, অতসী-দিদির মা ছাড়লেন না কিছুতে। আমি কিছু খাবো না।

–হ্যাঁরে, তুই খেয়ে এলি! ওবেলার সেই বাসি লুচি তোর জন্যে রয়েছে যে! লুচি খাবি না?

অনেকদিন ইহাদের সংসারে এমন সচ্ছলতা হয় নাই যে, লুচি ফেলিয়া ছড়াইয়া ছেলে-মেয়েরা খাইতে পায়। বলিয়াও সুখ।

টেঁপি বলিল–তুমি খাও মা। আমি খুব খেয়ে এসেছি। সেখানেও তো পরোটা, সুজি, মাছের ডালনা, এই সব খাইয়েছে। আজ দিনটা বেশ কাটল–না মা? ভাল খাওয়া সকাল থেকে শুরু হয়েচে আর রাত পর্যন্ত চলেচে।

আহারাদি শেষ করিয়া হাজারি বাহিরে বসিয়া তামাক খাইতে লাগিল।

হরিচরণবাবুর কথায় তাহার অনেকখানি উৎসাহ আজ বাড়িয়া গিয়াছে।

লুচি! টেঁপি কত লুচি খাইতে পারে, সে তাহার ব্যবস্থা করিবে। তাহার এই সব লোভাতুর ছেলে-মেয়ের মুখে ভাল খাবার-দাবার সে দিতে পারে না–কিন্তু যাতে পারে সে চেষ্টা করিবার জন্যই তো সুযোগ খুঁজিয়া বেড়াইতেছে।

হরিচরণবাবুর টাকা আছে বটে, কিন্তু তাহার মত লোভাতুর ছেলে-মেয়ে নাই তাহার ঘরে, কাহাদের মুখে সুখাদ্য তুলিয়া দিবার আশায় তিনি খাটিবেন?

আজ হরিচরণবাবুর নিকট হইতে সে টাকা ধার পায় নাই বটে, কিন্তু এমন একটা জিনিস পাইয়া আসিয়াছে, যাহার মূল্য টাকা-কড়ির চেয়ে বেশী।

তাহার সংসারে ছেলে মেয়ে আছে, টেঁপি আছে, তাহাদের মুখের দিকে চাহিয়া তাহার হাতে পায়ে বল আসিবে, মনে জোর পাইবে। হরিচরণবাবুর জীবন শেষ হইয়া গিয়াছে। তাহার বয়স ছেচল্লিশ হইলে কি হয়, টেঁপি যে ছেলেমানুষ। তাহার নিজের সুখ কিসের? টেঁপিকে একখানা ভাল শাড়ী কিনিয়া দিলে ওর মুখে যে হাসি ফুটিবে, সেই হাসি তাহাকে অনেক দূরে লইয়া যাইবে কর্মের পথে।

আহা, যদি এমন কখনো হয়।

যদি টেঁপিকে একটা কলের গান কিনিয়া দেওয়া যায়? গান এত ভালবাসে যখন…

হয়তো স্বপ্ন…কিন্তু ভাবিয়াও তো আনন্দ। দেখা যাক না কি হয়।

বাঁশঝাড়ে শন শন শব্দ হইতেছে। রাত অনেক হইয়াছে। গ্রাম নীরব হইয়া গিয়াছে। এতক্ষণে হাজারি স্ত্রীকে বলিল–ওগো, আমার গামছাখানা বড্ড ময়লা হয়েচে, একটু সোডা দিয়ে ভিজিয়ে দাও তো, কাল খুব সকালে কেচে দিও আমি কাল সক্কালে উঠেই রাণাঘাট যাবো।

সকালে কেন, এখুনি কেচে দিই। ভিজে গামছা নিয়ে যাবে কি করে, এখন কেচে হাওয়ায় মেলে দিলে রাত্তিরের মধ্যে শুকিয়ে যাবে।

.

সকালে উঠিয়া হাজারি ঠাকুর রাণাঘাট চলিয়া আসিল।

হোটেলে ঢুকিবার আগে তাহার ভয় করিতে লাগিল। কর্তাবাবু এবং পদ্ম ঝি তাহাকে কি না জানি বলে। একদিন কামাই করিবার জন্য কৈফিয়ৎ দিতে দিতে তাহার প্রাণ যাইবে।

হইলও তাই।

ঢুকিবার পথেই বসিয়া স্বয়ং বেচু চক্কত্তিমশায়–খোদ কর্তা। হাজারিকে দেখিয়া হাতের হুঁকা নামাইয়া কড়া সুরে বলিলেন–কাল কোথায় ছিলে ঠাকুর? হাজারি মিথ্যা কথা বলিল না। বাড়ীতে কাহারও অসুখ ইত্যাদি ধরনের বানানো মিথ্যা কথা সে কখনও বলে না। বলিল–আজ্ঞে, অনেক দিন পরে বাড়ী গেলাম কর্তামশায়, ছেলে-মেয়ে রয়েছে–তাই একটা দিন–

–না বলে-কয়ে এভাবে হোটেল থেকে পালিয়ে যাবার মানে কি? কার কাছে ছুটি নিয়ে গিয়েছিলে?

এ কথার জবাব সে দিতে পারিল না। লুচি দিতে গিয়াছিল বাড়ীতে, তাহা বলিতেও বাধে। সে চুপ করিয়া রহিল।

–তোমার হাড়ে হাড়ে বদমাইশি ঠাকুর–পদ্ম ঝি ঠিক কথা বলে–দেখতে ভালমানুষ হলে কি হবে? তুমি এত বড় একটা হোটেলের রান্নাবান্না ফেলে রেখে একেবারে নিউদ্দিশ হয়ে গেলে কাউকে কিছু না বলে? বলি একেবারে নাকের জলে চোখের জলে সবাই মিলে–গাঁজাখোর, নেমকহারাম কোথাকার! চালাকির আর জায়গা পাওনি?

বেচু চক্কত্তির গলার জোর আওয়াজ পাইয়া পদ্ম ঝি ব্যাপার কি দেখিতে আসিল এবং দোরে উঁকি মারিয়া হাজারিকে দেখিয়াই বলিয়া উঠিল–এই যে! কি মনে করে! আবার যে উদয় হ’লে? কাল আমি বলি আর দরকার নেই, ও আপদ বিদেয় করে দেন কৰ্ত্তা, গাঁজা খেয়ে কোথায় নেশায় বুঁদ হয়ে পড়েছিল–চেহারা দেখচেন না?

হাজারি একটু শঙ্কিত হইয়া উঠিয়া দেওয়ালে টাঙানো গজাল-আঁটা ছোট্ট আয়নাখানায় নিজের মুখখানা দেখিবার চেষ্টা করিল–কি দেখিল পদ্ম ঝি তাহার চেহারাতে! গাঁজা তো দূরের কথা, একটা বিড়ি পর্যন্ত সকাল হইতে সে খায় নাই!

–যাও, কাল একটা ঠিকে ঠাকুর আনা হয়েছিল, তার মজুরি এক টাকা, আর জল খাবারের চার আনা তোমার এ মাসের মাইনে থেকে কাটা যাবে। ফের যদি এমন হয়, সেই দিনই বিদেয় করে দেবো মনে থাকে যেন–বেচু চক্কত্তি রায় দিলেন।

হাজারি অপ্রতিভ মুখে রান্নাঘরের মধ্যে গিয়া ঢুকিল–সেখানেও নিস্তার নাই। কর্তার হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইলেও, পদ্ম ঝির হাতে অত সহজে পরিত্রাণ পাওয়া দুষ্কর। পদ্ম ঝি হাজারির পেছন পেছন রান্নাঘরে ঢুকিয়া বলিল–করবে না তো তোমার কাজ ওরা–কেন করবে?…একা হাঁড়ি ঠেলো আজকে–যেমন বদমাইশ তার তেমনি। একা বড় ডেকচি নামাও, ফেন গালো, ভাত বাড়ো খদ্দেরদের–-কাল সব কাজ মুখ বুজে ও-ঠাকুর করেছে একা–নবাবপুত্তর গাঁজা খেয়ে কোথায় পড়ে আছেন আর ওর জন্যে খেটে মরবে সবাই–উড়ঞ্চুড়ে মডুইপোড়া বামুন কোথাকার।

পদ্ম ঝি রাগের মাথায় ভুলিয়া গিয়াছিল, এই মাত্ৰ বেচু চক্কত্তি বলিয়াছেন যে, কাল হাজারির বদলে ঠিকা ঠাকুর রাখা হইয়াছিল যাহার মজুরি হাজারির মাহিনা হইতে কাটা যাইবে।

হাজারি অবাক হইয়া বলিল, একা কি রকম? এই তো ঠিকে ঠাকুর রাখা হয়েছে বল্লেন কর্তাবাবু?

পদ্ম ঝি সামলাইয়া লইবার চেষ্টায় বলিল–হইছিল তো। হয়নি তো কি? কর্তামশায় কি মিথ্যে কথা বলেন তোমার কাছে? যদি না-ই বা পাওয়া যেত ঠাকুর তবে ঠাকুরকে একা খাটতে হোত না? তোমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করবার সময় নেই আমার–মুর্শিদাবাদ আসবার সময় হোল। এখুনি ইষ্টিশানের খদ্দের সব আসবে। ডাল সাঁৎলে ফেলো তাড়াতাড়ি, চচ্চড়িটা চড়িয়ে দ্যাও।

মুর্শিদাবাদ ট্রেন সশব্দে আসিয়া প্লাটফর্মে দাঁড়াইল। এইবার কিছু খরিদ্দারের ভিড় হইবে।

হাজারি ছোট ডেকচিটার মধ্যে হাত ডুবাইয়া ভাল সাঁৎলাইতেছে, এমন সময় বাহিরে গদির ঘরে বেচু চক্কত্তির চড়া গলার আওয়াজ এবং তর্কবিতর্কের শব্দ শুনিয়া সে রান্নাঘরের দোরের কাছে আসিয়া বাহিরের ঘরের দিকে চাহিল।

যতীশ ভটচাজের সঙ্গে কর্তামশায়ের কথা কাটাকাটি হইতেছে। যতীশ ভটচাজ অনেক দিন হইতে তাহাদের খরিদ্দার–আগে আগে নগদ পয়সা দিয়া খাইয়া যাইত, আল মাস-ছয় হইতে মাসিক হারে খায়। বয়স পঞ্চাশ-বাহান্ন, ম্যালেরিয়া রোগীর মত চেহারা, মাথার চুল প্রায় পাকিয়া গিয়াছে, রং পূর্বে ফর্সা ছিল, এখন পুড়িয়া আধকালো হইয়া আসিয়াছে প্রায়। পরনে ময়লা ধুতি, গায়ে লংক্লথের ময়লা পাঞ্জাবি, পায়ে বিবর্ণ কেম্বিসের জুতা।

বেচু চক্কত্তি বলিতেছেন–না, আপনি অন্যস্তর চেষ্টা করুন ভটচাজ মশাই। আমি পারবো না সোজা কথা। হোটেল খুলিচি দু’পয়সা রোজগারের চেষ্টা, অন্নছত্তর তো খুলিনি?

যতীশ ভটচাজ, বলিতেছে –টাকার জন্যে আপনি ভাববেন না চক্কত্তি মশাই। এ ক’ মাসের বাকী আমি এক সঙ্গে দেবো।

–না মশাই–আপনি অন্যন্তর চেষ্টা করুন। যা গিয়েচে, গিয়েচে–আর আপনাকে খাইয়ে আমি জড়াতে রাজী নই।

যতীশ ভটচাজ, বেশ নরম সুরে বলিল–না না, যাবে কেন? বিলক্ষণ! পাই-পয়সা শোধ করে দেবো। তবে পড়ে গিইচি একটু ফেরে কর্তামশাই, (খুব খোশামোদ জুড়ে দিয়েচে!) তা এই কটা দিন যেমন খাচ্চি তেমনি খেয়ে যাই–সামনের মাসের পয়লা দোসরা–

–না মশাই, সামনের মাসের পয়লা দোসরার এখনো ঢের দেরি। ওসব আর চলবে না। মাপ করবেন, আপনি অন্যন্তরে দেখুন–

যতীশ ভটচাজের চেহারা দেখিয়া হাজারির মনে হইল, লোকটা খুব ক্ষুধার্ত, সকাল হইতে কিছু খায় নাই। এত বেলায় না খাওয়াইয়া কর্তামশাই তাড়াইয়া দিতেছেন, কাজটা কি ভালো? হয়ত কিছু কষ্টে পড়িয়া থাকিবে, নতুবা দুমুঠা খাইবার জন্য লোকে এত খোশামোদ করে না।

হাজারির ইচ্ছা হইল, একবার সে বলে–কর্তামশাই আমি আজ খাবো না–কাল দেশে একটা নেমন্তন্ন ছিল খেয়ে শরীর খারাপ আছে। আমার ভাতটা না হয় ভটচাজ মশাই খেয়ে যান–কিন্তু কথাটা বলিলে কর্তামশায়ের অপমান করা হইবে, বিশেষ করিয়া পদ্ম তাহা হইলে তাহাকে আস্ত রাখিবে না।

যতীশ ভটচাজ শেষ পর্যন্ত না খাইয়া চলিয়া গেল।

হাজারি ভাবিল–আহা, পুরোনো খদ্দের–ওকে এক থাল ভাত দিলে কি ক্ষতি হোত হোটেলের–আমি যদি কখনো হোটেল করি, খেতে এসে কাউকে ফেরাবো না–এতে আমার হোটেল উঠে যায় আর থাকে। একে তো ভাত বেচে পয়সা–তার ওপর খিদের সময় লোককে ফেরাবো?

ট্রেনের প্যাসেঞ্জার খরিদ্দারগণ আসিয়া পড়িয়াছে। খাইবার ঘরে বেশ ভিড়। মতি চাকর আজ দশ-বারোটি লোক জুটাইয়া আনিয়াছে। পদ্ম আসিয়া বলিল–দশ থালা ভাত বাড়ো–দু’থালা নিরিমিষ্যি। আলুর ডালনা দিও।

আধঘণ্টা পরে মুর্শিদাবাদ ট্রেনের খরিদ্দার বিদায় হইলে, অপ্রত্যাশিত ভাবে বনগাঁয়ের ট্রেনের সময় কতকগুলি লোক খাইতে আসিল। বেলা দেড়টা, এ সময় নূতন লোক প্রায়ই আসে না, পদ্ম ঝি যখন হাঁকিল, পাঁচ থালা ভাত ঠাকুর–হাজারি তাহাকে ডাকিয়া চুপি চুপি বলিল–ডাল একেবারেই নেই–দু’জনের মত হবে কি না–

পদ্ম ঝি ডেকচির কাছে আসিয়া নীচু হইয়া দেখিয়া চাপা কণ্ঠে বলিল–ওমা, এ তো একেবারেই নেই বল্লে হয়! এখন খদ্দের খাওয়াবো কি দিয়ে? তোমার দোষ, যখন ডাল কমে আসছে, এখনও দু’খানা টেরেন্ বাকি, তখন একটু ফেন মিশিয়ে সাঁৎলে নিলে না কেন? কতবার তোমায় বলে দেওয়া হয়েছে। ফেন আছে?

হাজারি বলিল–আছে।

–আছে তো দু’বাটি দ্যাও ডালে ফেলে– দিয়ে একটু নুন দিয়ে গরম করে নাও। হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখচো কি?

হাজারি এ ধরনের কাজ কখনো করে নাই। করিতে তাহার বাধে। সে সত্যই ভাল রাঁধুনী। ইচ্ছা করিয়া হাতের ভাল রান্নাটা নষ্ট করিতে বা এভাবে খরিদ্দার ঠকাইতে তাহার মন সরে না। কিন্তু পদ্ম ঝির হুকুম না মানিয়া উপায় কি? বাধ্য হইয়া ডালে ফেন মিশাইয়া খরিদ্দার বিদায় করিতে হইল।

ছুটি পাইল সেদিন প্রায় বেলা আড়াইটায়।

একটুখানি গড়াইয়া লইয়া রোদ একটু পড়িয়া আসিলে সে চূর্ণীনদীর তীরে তাহার অভ্যাসমত বেড়াইতে চলিল। আজ ক’দিন নদীর ধারে যায় নাই–আর সেই পরিচিত নির্জন নিমগাছটার তলায় বসিয়া গাছের গুঁড়ি ঠেস্ দিয়া ওপারের খেয়াঘাটের দিকে এবং শান্তিপুর যাইবার রাস্তার দিকে চাহিয়া থাকে নাই। বেশ লাগে জায়গাটা।

আর ওখানে গিয়া বসিলেই হাজারির মাথায় হোটেল সংক্রান্ত নানা রকম নতুন কথা আসে, অন্য কোথাও তেমন হয় না।

 আজ জায়গাটাতে গিয়া বসিতেই হাজারির প্রথমে মনে হইল, হোটেল চলে রান্নার গুণে। যাহারা পয়সা দিয়া খাইতে আসিবে, তাহারা চায় ভাল জিনিস খাইতে–ফেন-মিশানো ডাল খাইতে তারা আসে না।

পদ্ম ঝিয়ের অনাচারের দরুন বেচু চক্কত্তির হোটেল উঠিয়া যাইবে। তাহার নিজের হোটেল ততদিনে খোলা হইয়া যাইবে। তাহার রান্নার গুণেই হোটেল চলিবে। হঠাৎ হাজারি লক্ষ্য করিল, যতীশ ভটচাজ, চূর্ণীর খেয়াঘাটে দাঁড়াইয়া আছে। বোধ হয় পার হইয়া ওপারে যাইবে।

–ও ভটচাজ মশায়–ভটচাজ মশায়—

যতীশ চাহিয়া দেখিয়া উঠিয়া হাজারির কাছে আসিল।

–কোথায় যাবেন?

–যাচ্ছি একটু ফুলে-নবলা, আমার ভায়রাভাই থাকে, তারই ওখানে। দেখলে তো হাজারি তোমাদের চক্কত্তি মশায়ের কাণ্ডটা আজ! বলি টাকা কি আমি দিতাম না? দুপুরবেলা না খাইয়ে কি-না বল্লে অন্য জায়গায় চেষ্টা করুন গিয়ে। ভাত-বেচা বামুন যদি ছোটলোক না হয়, তবে আর কে হবে! বিড়ি আছে? দাও তো একটা–

হাজারি নিকট হইতে বিড়ি লইয়া ধরাইয়া বলিল–দুশো ঝাঁটা মারি শহরের মাথায়। আর থাকচি নে। যাচ্ছি ফুলে-নবলা, আমার বড় ভায়রাভাই পাৰ্বতী চক্কত্তি সেখানে একজন নামকরা লোক। পার্বতী দাদা একবার বলেছিল ওদের জমিদারী কাছারীতে একটা চাকরি করে দেবে। পালচৌধুরীদের জমিদারী। মস্ত কাছারী। সেখানেই যাচ্ছি। একটা হিল্লে হয়ে যাবেই।

হাজারি বলিল–একটা কথা বলি ভটচাজ মশাই, যদি কিছু মনে না করেন–

যতীশ ভটচাজ, বলিল–কি?–টাকাকড়ি এখন কিছু নেই আমার কাছে তা বলে দিচ্ছি। তবে দেনা আমি রাখবো না–খাওয়ার টাকা আগে শোধ দিয়ে তখন অন্য কথা। সে তুমি বলে দিও চক্কত্তি মশাইকে।

হাজারি বলিল–টাকাকড়ির কথা বলিনি। বলচিলাম, আপনি আহার করেচেন?

যতীশ ভটচাজ, কিছুমাত্র না ভাবিয়া সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর দিল–না। কোথায় করবে? এত বেলায় চক্কত্তি মশায়ের হোটেল থেকে ফিরে আর ভাত কে আমার জন্যে নিয়ে বসে ছিল?

হাজারি খপ করিয়া যতীশ ভটচাজের ডান হাতখানা ধরিয়া বলিল–আমার সঙ্গে চলুন ভটচাজ মশায়–আমি আপনাকে রেঁধে খাওয়াবো আজ। আসুন আমার সঙ্গে—

যতীশ ভটচাজ বলিল–কোথায়? কোথায়? আরে না, না হাজারি, আজ ও-সব থাক, আমি জল-টল খেয়ে–আর এমন অবেলায়–

হাজারি নাছোড়বান্দা। তাদের হোটেলের একজন পুরানো খদ্দের আজ পয়সা নাই বলিয়া সারাদিন অনাহারে থাকিয়া রাণাঘাট হইতে চলিয়া যাইতেছে–কি জানি কেন, এ ব্যাপারটার জন্য হাজারি যেন নিজেকেই দায়ী করিয়া বসিল।

যতীশ ভটচাজ বলিল–আমি তোমাদের হোটেলে আর যাবো না কিন্তু হাজারি। আচ্ছা তুমি যখন ছাড়চো না তখন বরং একটু জল-টল খাওয়াও।

–হোটেলে নিয়েই বা যাবো কেন? আসুন না জল-টল নয়, ভাত খাওয়াবো রেঁধে। যতীশ ভটচাজ ব্যস্ত হইয়া বলিল, না না, ফুলে-নবলা যেতে পারবো না আজ তাহলে। আজ সেখানে পৌঁছুতেই হবে।

নিকটেই কুসুমের বাড়ী, একবার হাজারি ভাবিল ভটচাজকে সেখানে লইয়া যাইবে কি না। শেষে ভাবিয়া-চিন্তিয়া তাহাই করিল। ভদ্রলোককে নতুবা কোথায় বসাইয়া সে খাওয়ায়?

কুসুমের বাড়ীর দোরে কড়া নাড়িতেই কুসুম আসিয়া দোর খুলিয়া হাজারিকে দেখিয়া হাসিমুখে কি বলিতে যাইতেছিল, হঠাৎ যতীশ ভটচাজের দিকে দৃষ্টি পড়ায় সে লজ্জিত হইয়া নীচুস্বরে বলিল–বাবাঠাকুর কি মনে করে? উনি কে সঙ্গে?

–ওর জন্যেই আসা। উনি বামুন মানুষ, আজ সারাদিন খাওয়া হয়নি। আমার চেনাশুনা–আমাদের হোটেলের পুরোনো খদ্দের। পয়সা ছিল না বলে খেতে দেয়নি কর্তামশাই। উনি না খেয়ে শান্তিপুর চলে যাচ্ছিলেন, আমার সঙ্গে দেখা–ধরে আনলুম। উকে কিছু না খাইয়ে তো ছেড়ে দেওয়া যায় না। বাইরের ঘরটা খুলে দাও গিয়ে—

কুসুম ব্যস্ত হইয়া বাহিরের ঘরের দোর খুলিতে গেল। যতীশ ভটচাজ, কিছু দূরে দাঁড়াইয়া ছিল–হাজারি তাহাকে ডাক দিয়া বাহিরের ঘরে বসাইল। তাহার পর বাড়ীর ভিতর যাইতেই কুসুম উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলিল–কি করবেন বাবাঠাকুর, রান্না করবেন? সব যোগাড় করে দিই। আর ততক্ষণ ধরে যা-কিছু আছে, ও বাবাঠাকুরকে দিই, কি বলেন?

হাজারি বলিয়া–রান্না করে খাওয়াতে গেলে চলবে না কুসুম। উনি থাকতে পারবেন না; ফুলে-নবলা যাবেন। আমি বাজার থেকে খাবার কিনে আনি–এখানে একটু বসবার জন্যে নিয়ে এলাম।

কুসুম দিয়া বলিল–বাবাঠাকুর, আপনি ব্যস্ত হবেন না দিকিনি। আমি সব যোগাড় করচি জলখাবারের। আমার ঘরে সব আছে, ঘরে থাকতে বাজারে যাবেন খাবার আনতে কেন? আমার বাড়ীতে যখন ব্রাহ্মণের পায়ের ধূলো পড়েছে, তখন আমার ঘরে যা আছে তাই দিয়ে খেতে দেব–কিন্তু বাবাঠাকুর, সেই সঙ্গে আপনিও–মনে থাকে যেন। হাজারি প্রতিবাদ-বাক্য উচ্চারণ করার পূৰ্বেই কুসুম ঘরের মধ্যে চলিয়া গেল–অগত্যা হাজারি বাহিরের ঘরে যতীশ ভটচাজের কাছে ফিরিয়া আসিল।

যতীশ ভটচাজ, বলিল–তোমার কোনো আত্মীয়ের বাড়ী নাকি হে?

–না, আত্মীয় নয়, এরা হোল ঘোষ-গোয়ালা। এই বাড়ীতে আমার ধর্মমেয়ের বিয়ে হয়েছে, ওই যে দোর খুলে দিলে, ওই মেয়েটি।

পনেরো মিনিট আন্দাজ পরে ঝন ঝন করিয়া শিকল নড়িয়া উঠিতে হাজারি বাহিরের বাড়ীর অক্ষয়ের দিকে দাওয়ায় গিয়া দাঁড়াইল–দাঁড়াইয়া দাওয়ার দিকে চাহিয়া অবাক হইয়া গেল। দু’খানি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আসন পাতা–দু’বাটি জ্বাল দেওয়া দুধ, দুখানা থালে ফল-মূল কাটা, বড় বাতাসা, ছানা, দুটি মুখ-কাটা ভাব। ঝকঝকে করিয়া মাজা দুটি কাঁসার গ্লাসে দু’গ্লাস জল।

হাসিমুখে কুসুম বলিল–ওঁকে ডাকুন, সেবা করতে বলুন। যা বাড়ীতে ছিল একটু মুখে দিয়ে নিন দু’জনে।

–তা তো হোল–কিন্তু আমি আবার কেন কুসুম?

–মেয়ের বাড়ী যে–না খেয়ে যাবার কি জো আছে? ডাকুন ওকে।

যতীশ ভটচাজ খাইতে বসিয়া যেরূপ গোগ্রাসে খাইতে লাগিল, দেখিয়া মনে হইল, সে বড়ই ক্ষুধার্ত ছিল। তাহার থালায় একটুও কিছু পড়িয়া রহিল না। কুসুম পান সাজিয়া বাহিরের ঘরে পাঠাইয়া দিল, খাওয়ার পরে। যতীশ ভটচাজ বিদায় লইবার সময় বলিল– তোমার মেয়েটিকে একবার ডাকো হাজারি, আশীৰ্বাদ করে যাই।

কুসুম আসিয়া গলায় কাপড় দিয়া দু’জনকেই প্রণাম করিল। যতীশ ভটচাজ বলিল– মা শোনো, সারাদিন সত্যিই খাইনি। ভারি তৃপ্তির সঙ্গে খেলাম তোমার এখানে। তুমি বড় ভাল মেয়ে, ছেলেপিলে নিয়ে সুখে থাকো, আশীৰ্বাদ করি।

হাজারি যতীশ ভটচাজের সঙ্গে চলিয়া আসিল।

পথে আসিয়া বলিল–ভটচাজ মশাই, একটা হোটেল নিজে খুলবো অনেক দিন থেকে ইচ্ছে আছে। আপনি কি বলেন?

–অনায়াসে করতে পারো। খুব লাভের জিনিস–তোমার হবেও। তোমার মনটা বড় ভালো। কিন্তু পয়সা পাবে কোথায়?

–তাই নিয়েই তো গোলমাল। নইলে এতদিন খুলে দিতাম–দেখি, চেষ্টায় আছি–ছাড়চি নে–ওই যে আমার মেয়ে দেখলেন, ওই কুসুম, ও একবার টাকা দিতে চেয়েছিল। তা কি নেওয়া ভাল? ও গরীব বেওয়া লোক, কেন ওর সামান্য পুঁজি নিতে যাবো? তাই নিই নি। নিলে ও এখুনি দেয়–তবে সে টাকা খুব সামান্য। তাতে হোটেল খোলা হবে না।

যতীশ ভটচাজ চূর্ণীর খেয়ার ধারে আসিয়া বলিল–আচ্ছা, চলি হাজারি–তুমি হোটেল খুললে তোমার হোটেলে আমি বাঁধা খদ্দের থাকবো, সে তুমি ধরে নিতে পারো। আর কোথাও যাবো না–তোমার মত রান্না ক’টা ঠাকুর রাঁধতে পারে হে? বেচু চক্কত্তির হোটেলে আমি যে যেতাম শুধু তোমার নিরামিষ রান্না খাওয়ার লোভে! ভাল চলবে তোমার হোটেল। এদিগরে তোমার মত রাঁধতে পারে না কেউ, বলে যাচ্ছি।

যতীশ ভটচাজ তো চলিয়া গেল, কিন্তু হাজারির মনে তাহার শেষ কথাগুলি একটা খুব বড় বল ও প্রেরণা দিয়া গেল।

সে জানে, তাহার হাতের রান্না ভাল–কিন্তু খরিদ্দারের মুখে সে কথা শুনিলে তবে না তৃপ্তি। ক্ষুধার্ত ব্রাহ্মণকে খাওয়াইয়াছিল বটে–কিছু সে যাইবার সময় যাহা দিয়া গেল হাজারির মনের আনন্দ ও উৎসাহের দিক দিয়া দেখিতে গেলে তাহা খুব মূল্যবান ও সার্থক প্রতিদান।

হাজারি যখন হোটেলে ফিরিল, তখন বেলা বেশী নাই। রতন ঠাকুর ডাল-ভাত চাপাইয়া দিয়াছে, মতি চাকর বা পদ্ম ঝি কেহই নাই। গদির ঘরে বেচু চক্কত্তি কাহাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলিতেছিল।

হোটেলের রান্নাঘরে ঢুকিলে কিন্তু হাজারির মনে নতুন বলের সঞ্চার হয়। বরং ছুটি পাইয়া বাহিরে গেলেই যত দুর্ভাবনা আসিয়া জোটে–প্রকাণ্ড উনুনের উপরে ফুটন্ত ডেকচির সামনে বসিয়া হাজারি নিজেকে বিজয়ী বীরের মত কল্পনা করে। তখন না মনে থাকে কুসুমের কথা, না মনে থাকে অন্য কোনো কিছু। অবসাদ আসে কাজ হাতে না থাকিলে, এ বরাবর দেখিয়া আসিতেছে সে।

ইতিমধ্যে রতন ঠাকুর ফিরিল।

হাজারিকে চুপি চুপি বলিল–একটি কথা আছে। আমার দেশের একজন লোক এসেছে–আমার কাছে থেকে চাকরি খুঁজবে। বড় গরীব–তাকে বিনি টিকিটে খাওয়ার ঘরে ঢুকিয়ে খেতে দিতে হবে। তোমার যদি মত হয়, তবে তাকে বলি।

হাজারি বলিল–নিয়ে এসো, তার আর কি। গবীর মানুষ খাবে, আমার কোনো অমত নেই। রতন ঠাকুর খুব খুশী হইয়া চলিয়া গেল। রাত্রে তাহার লোক যখন খাইতে আসিল, রতন ঠাকুর হাজারিকে ডাকিয়া ইঙ্গিতে লোকটাকে চিনাইয়া দিতে, হাজারি পরিতোষ করিয়া তাহাকে খাওয়াইল।

পদ্ম ঝিয়ের অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি এড়াইয়া লোকটা বিনা টিকিটে খাইয়া চলিয়া গেল–কেহ কিছু ধরিতেও পারিল না।

এই রকম চলিল, এক-আধ দিন নয়, দশ-বারো দিন। একদিন আবার তাহার অন্য এক সঙ্গী জুটাইয়া আনিয়াছে, তাহাকে বিনামূল্যে খাইতে দিতে হইল।

ব্যাপারটি সামান্য, হাজারি কিন্তু একটা প্রকাণ্ড শিক্ষা পাইল ইহা হইতে। এত সতর্ক ব্যবস্থার মধ্যেও চুরি তো বেশ চলে। বেচু চক্কত্তির টিকিট ও পয়সাতে ঠিক মিল আছে, সুতরাং তার দিক দিয়া সন্দেহের কোন কারণ নাই–পদ্ম ঝি যে পদ্ম ঝি, সে পৰ্যন্ত বিন্দুবিসর্গ জানিল না ব্যাপারটার। ভাত তরকারি কিছু মাপ থাকে না যে কম পড়িবে। সুতরাং কে ধরিতেছে? কেন? এ ধরনের চুরি ধরিবার কি উপায় নাই কোনো?

কয়দিন ধরিয়া হাজারি চূর্ণীর ঘাটে নির্জনে বসিয়া শুধু এই কথা ভাবে। ঠাকুরে ঠাকুরে ষড়যন্ত্র করিয়া যদি বাহিরের লোক ঢুকাইয়া খাওয়ায়, তবে সে চুরি ধরিবার উপায় কি? অনেক ভাবিয়া একটা উপায় তাহার মাথায় আসিল একদিন বিকালে। থালায় নম্বর যদি দেওয়া থাকে, আর টিকিটের নম্বরের সঙ্গে যদি তার মিল থাকে, তবে থালা এঁটো হইলেই ধরা পড়িবে অমূক নম্বরের থালার খদ্দের বিনা টিকিটে খাইয়াছে–না পয়সা দিয়া খাইয়াছে।

মাঝে মাঝে তদারক করিলেই জিনিসটা ধরা পড়িবে। তা ছাড়া থালা মাজিবার সময় ঝি বা চাকরের নিকট হইতে এঁটো থালার নম্বরগুলি জানিয়া লইলেই হইবে।

হাজারি খুব খুশী হইল। ঠিক বাহির করিয়াছে বটে–একটা ফাঁক অবিশ্যি আছে, সেও জানে–যদি কলাপাতায় খাইতে দেওয়া হয়। যদি বিনা নম্বরী থালা সেই লোকটা বাহির হইতে আনে–তাহাতে নিস্তার নাই, কারণ ঝি-চাকরের চোখে তখনই ধরা পড়িবে। এঁটো থালা সেই লোকটা কিছু মাজিতে বসিতে পারে না হোটেলের মধ্যেই। কলার পাতায় কেহ খাইতেছে, ইহা চোখে পড়িলে তখনি ঝি-চাকরে সন্দেহ করিবে বলিয়া হঠাৎ কেহ সাহস করিবে না কাহাকেও পাতায় ভাত দিতে।

দুশো-আড়াইশো টাকা যদি যোগাড় করা যায়, তবে এই রেলবাজারেই আপাতত হোটেল খুলিয়া দেওয়া যায়। টাকা দেয় কে?

যতীশ ভটচাজের কথা তাহার মনে পড়িল।

বেচারী বড় কষ্টে পড়িয়াছে! শেষে কিনা ভায়রাভাইয়ের বাড়ী চলিয়াছে আশ্রয় প্রার্থনা করিতে। লোকে কি সোজা কষ্ট পাইলে তবে কুটুম্বস্থানে যায় চাকুরির উমেদার হইয়া!

যদি সে হোটেল খোলে, যতীশ ভটচাজকে আনিয়া রাখিবে। বৃদ্ধ মানুষ, দুটি করিয়া খাইতে পারিবে আর কিছু হাত খরচ মিলিবে। ইহার বেশী তাহার আর কিসেরই বা দরকার।

প্রতিদিনের মত আজও বেলা পড়িয়া আসিল। গত দু’বৎসর যেরূপ হইয়া আসিতেছে। সেই একই ঘোড়ানিম গাছ, সেই একই চূর্ণীর খেয়াঘাট, পালেদের সেই একই কয়লার ডিপোতে মুটে ও সরকার বাবুর সঙ্গে ঝগড়া চলিতেছে–সবই পুরাতন।

দিন যায়, কিন্তু তাহার সাধ পূর্ণ হইবার তো কোনো লক্ষণই দেখা যাইতেছে না। বরং দিন দিন আরও ক্রমে অবস্থা খারাপের দিকেই চলিয়াছে।

সামান্য মাইনে হোটেলের–কি হইবে ইহাতে? বাড়ীতে টেঁপিকে একখানা ভাল শখের কাপড় দেওয়া যায় না, পেট পুরিয়া খাইতে দেওয়া যায় না।

টেঁপির মা গরীব ঘরের মেয়ে। যেমন বাপের বাড়ীতে কখনও সুখের মুখ দেখে নাই, স্বামীর ঘরে আসিয়াও তাই। সংসারে গভীর খাটুনি খাটিয়া ছেলেমেয়ে মানুষ করিতেছে– মুখ ফুটিয়া কোনোদিন স্বামীর কাছে কোনো আদর-আবদার করে নাই–ছেঁড়া কাপড় সেলাই করিয়া পরিতেছে, আধপেটা খাইয়া নিজে, ছেলেমেয়েদের জন্য দু-মুঠা বেশী ভাত জল দিয়া রাখিয়া দিতেছে হাঁড়িতে, তাহারা সকাল বেলা খাইবে। কখনো কোনোদিন সেজন্য বিরক্তি প্রকাশ করে নাই, অদৃষ্টকে নিন্দা করে নাই।

হাজারি সব বোঝে।

তাই তো সে আজকাল সৰ্ব্বদা একমনে উপায় চিন্তা করে–কি করিয়া সংসারের উন্নতি করা যায়। চক্কত্তি মশায়ের হোটেলে রাঁধুনীবৃত্তি করিলে কখনও যে উন্নতি করা যাইবে না। আর পদ্ম ঝির ঝাঁটা খাইয়া মাঝে পড়িয়া হাড় কালি হইয়া যাইবে।

ভগবান যদি দিন দেন, তবে তাহার আজীবনের সংকল্প সে কার্যে পরিণত করিবে। হোটেল একখানা খুলিবে।

কুসুমের সঙ্গে এই যে আলাপ হইয়াছে, হাজারি এটাকে পরম সৌভাগ্য বলিয়া মনে করে। কুসুম চমৎকার মেয়ে–প্রবাস-জীবনে কুসুমের সাহচর্য্য, তাহার মধুর ব্যবহার–হোক না সে গোয়ালার মেয়ে–কিন্তু বড় ভাল লাগে, আরও ভাল লাগে এইজন্যে যে ঠিক কুসুমের মত স্নেহ প্রবণ কোনো আত্মীয় মেয়ের সংস্পর্শে সে কখনও আসে নাই।

অনেকখানি যে নির্ভর করা যায় কুসুমের ওপর। সব বিষয়ে নির্ভর করা যায়। মনে হয়, এ কাজের ভার কুসুমের উপর দিয়া নিশ্চিন্ত হওয়া যায়, সে প্রতারণা করিবে তো নাই-ই, বরং প্রাণপণ-যত্নে কাজ উদ্ধার করিবার চেষ্টা করিবে, যেমন আপনার লোকে করিয়া থাকে।

হাজারি যদি নিজের দিন ফিরাইতে পারে, তবে কুসুমের দিনও সে অমন রাখিবে না।

টেঁপিও তার মেয়ে, কিন্তু টেঁপি বালিকা, কুসুম বুদ্ধিমতী। ও যেন তার বড় মেয়ে–যে বাপের দুঃখকষ্ট সব বোঝে এবং বুঝিয়া তাহা দূর করিবার চেষ্টা করে। মন-প্রাণ দিয়া চেষ্টা করে। মেয়েও বটে, বন্ধুও বটে।

সকালে সেদিন রতন ঠাকুর আসিল না।

পদ্ম ঝি আসিয়া বলিল, ও-ঠাকুর আজ আর আসবে না, কাল বলে গিয়েছে; তরকারী গুলো তুমি কুটে নাও, নিয়ে রান্না চাপিয়ে দাও, আমি আঁচ দিয়ে দিচ্চি।

হাজারি প্রমাদ গণিল। আজ হাটবার, দুপুরে অন্তত একশো দেড়শো হাটুরে খরিদ্দার খাইবে; একহাতে তাহাদের রান্না করা এবং খাওয়ানো সোজা কথা নয়।

পদ্ম ঝিয়ের কথামত সে বঁটি পাতিয়া তরকারি কুটিতে বসিয়া গেল–বেলা সাড়ে আটটার সময় সবে ডাল-ভাত নামিয়াছে–এমন সময় একজন খরিদ্দার টিকিট লইয়া খাইতে আসিল।

হাজারি বলিল–আজ্ঞে বাবু, সবে ডাল-ভাত নেমেছে, কি দিয়ে খাবেন?

লোকটি রাগিয়া বলিল–নটা বেজেছে, মোটে ডাল-ভাত? কি রকম ঠাকুর তুমি? যদু বাঁড়ুয্যের হোটেলে এতক্ষণ তিনটে তরকারি হয়ে গিয়েছে। এ রকম করলেই তোমাদের হোটেল চলেচে?

হাজারি বলিল–ন’টা তো বাজেনি বাবু, সাড়ে-আটটা।

লোকটার মেজাজ রুক্ষ ধরনের। বলিল–আমি বলচি নটা, তুমি বলচো সাড়ে-আটটা! আবার মুখে মুখে তর্ক? আমি ঘড়ি দেখতে জানিনে?

–সে কথা তো হয় নি বাবু। ঘড়ি কেন দেখতে পাবেন না, আপনারা বড় লোক। কিন্তু ন’টা বাজলে কেষ্টনগরের গাড়ী আসে। সে গাড়ী তো এখনো আসে নি?

–আবার তর্ক? এক চড় মারবো গালে–

বোধ হয় লোকটা মারিয়াই বসিত, ঠিক সেই সময় পদ্ম ঝি গোলমাল শুনিয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া বলিল–কি হয়েছে বাবু?

লোকটা পদ্ম ঝিয়ের দিকে ফিরিয়া বলিল–তোমাদের এই অসভ্য ঠাকুরটা আমার সঙ্গে মুখোমুখি তর্ক করচে, কি জানোয়ার। হোটেলের রাঁধুনীগিরি করতে এসে আবার লম্বা লম্বা কথা, আজ দিতাম তোমাকে একটি চড় কষিয়ে, টের পেতে তুমি মজা–

পদ্ম ঝি বলিল–যাক বাবু, আপনি ক্ষ্যামা দেন। ওর কথায় চটলে কি চলে? আসুন, আপনি খাবেন এখানে।

-–খাবো কি, তোমাদের ঠাকুর বলচে এখনও কিছু রান্না হয় নি। তাই বলতে গেলাম তো আমার সঙ্গে তর্ক। রান্না হয় নি তো টিকিট বিক্রি করেছিলে কেন তোমরা? দেখাবে তোমাদের মজা! যত বদমায়েশ সব।

পদ্ম ঝি ঝাঁজের সহিত বলিল–ঠাকুর, তুমি কি রকম মানুষ? বাবুর সঙ্গে মুখোমুখি তককো করা তোমার কি দরকার ছিল? রান্না কেনই বা হয় না। যা হয়েচে তাই দিয়ে ভাত দাও, আর মাছ ভেজে দাও। যান বাবু আপনি গিয়ে বসুন।

খানিক পরে লোকটা খাওয়া ফেলিয়া বলিল–মাছটা এক্কেবারে পচা। রামো রামো, কেন মরতে এ হোটেলে খেতে এসেছিলুম–ছি ছি–এই ঠাকুর এদিকে এসো–

পদ্ম ঝি হাঁ হাঁ করিয়া ছুটিয়া আসিয়া বলিল–কি হয়েছে বাবু, কি হয়েছে?

–-কি হয়েছে? যত সব ন্যাকামি? মাছ একদম পচা, লোকজনকে মারবার মতলব তোমাদের–না? আজই রিপোর্ট করে দিচ্ছি তোমাদের নামে–

রিপোর্টের কথা শুনিয়া পদ্ম ঝির মুখ শুকাইয়া গেল; সে তাড়াতাড়ি বলিল–বাবু, আপনার পায়ে পড়ি বসুন, না খেয়ে উঠবেন না, আমি দই এনে দিচ্চি। একদিন যা হয়ে গিয়েচে ক্ষ্যামা ঘেন্না করে নিন বড় বাবু।

সে তাড়াতাড়ি দই ও বাতাসা আনিয়া দিল। লোকটি খাইয়া উঠিয়া যাইবার সময় বেচু চক্কত্তি বিনীতসুরে নিতান্ত কাঁচুমাচু হইয়া বলিল, বাবু একটা কথা আছে, আপনার টিকিটের পয়সাটা ত নিতে পারি নে। আপনার খাওয়াই হোল না। পয়সা ক’আনা আপনি নিয়ে যান।

লোকটা বলিল–না না থাক। পয়সা দিতে হবে না ফেরত–কিন্তু এরকম আর যেন কখনও না হয়।

বেচু চক্কত্তি জোর করিয়া লোকটার হাতে পয়সা কয়েক আনা গুঁজিয়া দিল।

একটু পরে গদির ঘরে হাজারি ঠাকুরের ডাক পড়িল। হাজারি গিয়া দেখিল সেখানে পদ্ম ঝি দাঁড়াইয়া আছে।

বেচু চক্কত্তি বলিল–ঠাকুর, খদ্দেরদের সঙ্গে ঝগড়া করতে কদ্দিন শিখেচ?

হাজারি অবাক হইয়া বলিল–ঝগড়া? কার সঙ্গে ঝগড়া করলাম বাবু?

পদ্ম ঝি বলিল–ঝগড়া করেছিলে না তুমি ওই বাবুর সঙ্গে? সে মুখোমুখি তককো কি! বাবু তো চড় মারবেনই। আমি গিয়ে না পড়লে দিত কষিয়ে দু-চার ঘা। আগে কি বলেছে না বলেচে আমি তো শুনি নি, গিয়ে দেখি বাবু রেগে লাল হয়ে গিয়েচেন। ওর কি কাণ্ডজ্ঞান আছে? তখনও সমানে ঝগড়া চালাচ্চে–

বেচু চক্কত্তি বলিল–খদ্দের যাই কেন বলুক না তাই শুনে যেতে হবে, এ তুমি বুড়ো হয়ে মরতে চল্লে, আজও শিখলে না তুমি?

–বাবু, আপনি শুনে বিচার করুন। ঝগড়া তো আমি করিনি–উনি বল্লেন ন’টা বেজেচে, আমি বল্লাম সাড়ে-আটটা বেজেছে, এই উনি আমায় বল্লেন, আমি কি ঘড়ি দেখতে জানিনে?

পদ্ম ঝি বলিল–তোমার সব মিথ্যে কথা ঠাকুর। ও কথায় কখনো ভদ্দর লোক চটে। তুমি বেয়াদপের মত তককো করেচো তাই বাবু চটে গিয়েচেন। আমি গিয়ে স্বকর্ণে শুনিচি তুমি যা তা বলচো।

অবশ্য এখানে পদ্ম ঝিয়ের উক্তির সত্যতা সম্বন্ধে কোন প্রশ্নই চলিতে পারে না, এ কথা হাজারি ভাল করিয়া জানিত। বেচু চক্কত্তি মহাশয় কাহারও কথা শুনিবেন না, পদ্ম ঝি যাহা বলিবে তাহাই ধ্রুব সত্য বলিয়া মানিয়া লইবেনই। সে অগত্যা চুপ করিয়া বহিল।

বেচু চক্কত্তি বলিল–পচা মাছ কে এনেছিল?

হাজারি উত্তর দেবার পূর্বেই পদ্ম ঝি বলিল–ওই গিয়েছিল বাজারে। ওই এনেচে।

হাজারি বিস্ময়ে কাঠ হইয়া গেল। কি সর্বনেশে মিথ্যে কথা! পদ্ম ঝি খুব ভাল করিয়াই জানে, কাল রাত্রে প্রায় দেড়পোয়া আন্দাজ পোনা মাছ উদ্বৃত্ত হইলে, পদ্ম ঝি-ই তাহাকে বলিয়াছিল, মাছগুলা ঢাকিয়া রাখিতে এবং পরদিন কড়া করিয়া আর একবার ভাজিয়া লইয়া মাছের ঝাল করিতে; তাহা হইলে খরিদ্দার টের পাইবে না যে মাছটা বাসি। বাসি মাছ ভাজা সে খরিদ্দারকে দিতে যায় নাই, পদ্ম ঝি নিজেই ভাজা মাছ দিবার কথা বলিয়াছিল।

কিন্তু এ সব কথা বেচু চক্কত্তিকে বলিয়া কোন লাভ নাই।

বেচু চক্কত্তি বলিল–তোমার আট-আনা জরিমানা হোল। মাইনের সময় কাটা যাবে–যাও।

হাজারি রান্নাঘরে ফিরিয়া আসিল–কিন্তু তাহার চোখ দিয়া যেন জল বাহির হইয়া আসিতে চাহিতেছিল, কি অসহ্য অবিচার! সে বাজারে গিয়াছিল ইহা সত্য, মাছ কিনিয়াছিল তাহাও সত্য, কিন্তু সে মাছ পচা নয়, সে মাছ খরিদ্দারের পাতে দেওয়াই হয় নাই। অথচ পদ্ম ঝি দিব্য তাহার ঘাড়ে সব দোষ চাপাইয়া দিল, আর সেই মিথ্যা অপরাধে তাহার হইল জরিমানা।

পদ্ম দিদি তাহার সঙ্গে যে কেন এমন করিয়া লাগে–কি করিয়াছে সে পদ্ম দিদির?

রতন ঠাকুর আজ নাই, খাটুনি সবই তাহার ওপর। আট-দশজন লোক ইতিমধ্যে টিকিট কিনিয়া খাবার ঘরে ঢুকিল, চাকরে জায়গা করিয়া দিল। হাজারি তাড়াতাড়ি আলু ভাজিয়া ইহাদের ভাত দিল। তাহারা খুব গোলমাল করিতে লাগিল, শুধু আলুভাজা আর ভাল দিয়া খাওয়া যায়? ইহারা সকলেই রেলের যাত্রী। স্টেশন হইতে তাহাদের হোটেলের চাকর বলিয়া আনিয়াছে যে একমাত্র তাহাদেরই হোটেলে এত সকালে সব হইয়া গিয়াছে–মাছের ঝোল, অম্বল পর্যন্ত। এখন দেখা যাইতেছে যে ডাল আর আলুভাজা ছাড়া আর কিছুই হয় নাই, এ কি অন্যায়–ইত্যাদি।

পদ্ম ঝি দরজার কাছে মুখ বাড়াইয়া বলিল–ও ঠাকুর, দাও না মাছ ভেজে, বাবুরা বলচেন শুনতে পাও না? বাবুরা খাবেন কি দিয়ে?

অর্থাৎ সেই পচা মাছ ভাজা আবার দাও। আজকার মাছ এখনও কোটা হয় নাই পদ্ম তাহা জানে।

হাজারি ঠাকুর কিন্তু পচা মাছ আর খরিদ্দারদের পাতে দিবে না। সে বলিল–ভাজা মাছ আর নেই। যা ছিল ফুরিয়ে গিয়েছে।

পদ্ম ঝি বলিল–তবে একটু বসুন বাবুরা, একখানা তরকারী করে দিচ্ছে, বসুন আপনারা, উঠবেন না।

শিক্ষামত মতি চাকর আসিয়া বলিল–ও ঠাকুর, বনগাঁয়ের গাড়ী আসবার যে সময় হোল, রান্নাবান্না কিছু হোল না এখন? ঘণ্টা পড়ে গিয়েচে যে।

খরিদ্দারের ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া উঠিল। ইহারাও সেই গাড়ীতে কৃষ্ণনগরে যাইবে! একজন বলিল–ঘণ্টা পড়ে গিয়েচে?

মতি চাকর বলিল–হ্যাঁ বাবু, অনেকক্ষণ। গাড়ী গাংনাপুর ছেড়েচে–এল বলে।

মাছভাজা খাওয়া মাথায় থাকুক–তাহারা তাড়াতাড়ি উঠিতে পারিলে বাচে। গাড়ী ফেল হইয়া গেলে অনেকক্ষণ আর গাড়ী নাই।

পদ্ম ঝি বলিল–আহা-হা উঠবেন না বাবুরা, ধীরে সুস্থে খান। মাছ ভেজে দাও ঠাকুর, আমি তাড়াতাড়ি কুটে দিচ্ছি। বসুন বাবুরা।

খরিদ্দারেরা উঠিয়া পড়িল–ধীরভাবে বসিয়া খাওয়া তাহাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাহারা চলিয়া যাইতেই পদ্ম ঝি বলিল–যাক, এইবার মাছগুলো কুটি। এত সকালে কোন হোটেলে রান্না হয়েছে? ছ’খানা মাছের গাদা বেঁচে গেল।

এই জুয়াচুরিগুলা হাজারি পছন্দ করে না।

শুধু এখানে বলিয়া নয়, রেল-বাজারের সব হোটেলেই এই ব্যাপার সে দেখিয়া আসিতেছে। খরিদ্দারকে খাওয়াইতে বসাইয়া দিয়া বলে–বাবু, গাড়ীর ঘণ্টা পড়ে গেল। খরিদ্দার আধ পেটা খাইয়া উঠিয়া যায়, হোটেলের লাভ।

ছিঃ–ন্যায্য পয়সা গুনিয়া লইয়া এ কি জুয়াচুরি?

হাজারি ঠাকুর এতদিন এখানে কাজ করিতেছে, কখনো মুখ দিয়া একথা বাহির করে নাই যে ট্রেনের সময় হইয়া গেল।

অনেক সময় ট্রেনের সময় না হইলেও ইহারা মিথ্যা করিয়া ধুয়া তুলিয়া দেয়, যাহাতে খরিদ্দার ব্যস্ত হইয়া পড়ে–অধিকাংশই পাড়াগেঁয়ে লোক, রেলের টাইমটেবিল মুখস্থ করিয়া তাহারা বসিয়া নাই, ইহাদের ধাঁধা লাগাইয়া দেওয়া কঠিন কাজ নয়।

মতি চাকরকে শিখানো আছে, সে সময় বুঝিয়া রেল গাড়ীর ধুয়া তুলিয়া দিবে–আজ পাঁচবছর হাজারি দেখিয়া আসিতেছে এই ব্যাপার।

নিজের হোটেল যখন সে খুলিবে ব্যবসাতে লাভ করিবার জন্য এসব হীন ও নীচ কৌশল সে অবলম্বন করিবে না। ন্যায্য পয়সা লইবে, ন্যায্যমত পেট ভরিয়া খাইতে দিবে। এই সব নিরীহ পল্লীবাসী রেলযাত্রীদের ঠকাইয়া পয়সা না লইলে যদি তাহার হোটেল না চলে, না হয় না-ই চলিল হোটেল।

ফাঁকি দেওয়া যায় না হাটুরে খরিদ্দারদের!

আজ মদনপুরের হাট–এখানকারও হাট। পাড়াগাঁ হইতে দুধ ও তরিতরকারী লইয়া বহুলোক আসে–তাহারা অনেকে এখানে খায়। বার বার যাতায়াত করিয়া তাহারা চালাক হইয়া গিয়াছে–মতি চাকর প্রথম প্রথম দু-একবার ইহাদের উপর কৌশল খাটাইতে গিয়া বেকুব বনিয়াছে।

তাহারা বলে–হোক হোক গাড়ীর ঘণ্টা, লাও তুমি। না হয় পরের গাড়ীডায় যাবানি। তা’ বলে সারাদিন খাবার পরে ভাত ফেলে তো উঠতি পারিনে? হ্যাদে লিয়ে এসো আর দু-হাতা ডাল—ও ঠাকুর–

হাটুরে লোকজন খাইতে আসিতে আরম্ভ করিল। বেলা একটা।

ইহাদের জন্য আলাদা বন্দোবস্ত। ইহারা চাষা লোক, খায় খুব বেশী! তা ছাড়া খুব শৌখীন রকমের খাদ্য না পাইলেও ইহাদের ক্ষতি নাই, কিন্তু পেট ভরা চাই।

সাধারণ বাবু-খরিদ্দাররের জন্য যে চাল রান্না হয়, ইহাদের সে চাল নয়। মোটা নাগরা চালের ভাত ইহাদের জন্য বরাদ্দ। ফেন মিশানো ডাল ও একটা চচ্চড়ি। ইহাদের সাধারণত দেওয়া হয় চিংড়ি মাছ বা কুচা মাছ। পোনা মাছ ইহাদের দিয়া পারা যায় না। কুচো চিংড়ি কিছু বেশী দিতেও গায়ে লাগে না। ইহাদের মধ্যে অনেক সময় হাজারির নিজের গ্রামের লোকও থাকে–তাহাদের মুখে বাড়ীর খবর পাওয়া যায়, কিন্তু আজ তাহার গ্রাম হইতে কেহ আসে নাই।

রতন ঠাকুর নাই–একা হাতে এতগুলি লোকের রান্না ও পরিবেশন করিয়া হাজারি নিতান্ত ক্লান্ত দেহে যখন খাইতে বসিবার যোগাড় করিতেছে তখন বেলা প্রায় তিনটার কম নয়। পদ্ম ঝি অনেকক্ষণ পূৰ্বেই থালায় ভাত বাড়িয়া লইয়া চলিয়া গিয়াছে, বেচু চক্কত্তি গদিতে বসিয়া এবেলার ক্যাশ মিলাইতেছেন–এই সময় পাশের হোটেলের বংশীধর ঠাকুর আসিয়া বলিল–ও ভাই হাজারি, দুটো ভাত হবে?

বংশীধর মেদিনীপুর জেলার লোক, তবে বহুঁকাল রাণাঘাটে থাকায় কথার বিশেষ কোন টান লক্ষ্য করা যায় না। সে বলিল, আমার এক ভাগ্নে এসেচে হঠাৎ এখন এই তিনটের গাড়ীতে। আজ হাটবার, হাটুরে খদ্দেরদের দল সব খেয়ে গিয়েছে, আমাদের খাওয়াও চুকেছে, তাই বলে দেখে আসি যদি–

হাজারি বলিল -হ্যাঁ হ্যাঁ পাঠিয়ে দ্যাও গিয়ে, ভাত যা আছে খুব হয়ে যাবে।

বংশীধরের ভাগিনেয় আসিল। চমৎকার চেহারা, আঠারো-উনিশের বেশী বয়স নয়। তাহাকে আসন করিয়া ভাত দিতে গিয়া হাজারি দেখিল ডেকচিতে যা ভাত আছে, তাহাতে দু-জনের কুলায় না। বংশীধরের ভাগিনেয়টি পল্লীগ্রামের স্বাস্থ্যবান ছেলে, নিশ্চয়ই দুটি বেশ ভাত খায়–তাহারই পেট ভরিবে কিনা সন্দেহ।

হাজারি উহাকেই সব ভাতগুলি বাড়িয়া দিল–ডাল তরকারি যাহা ছিল তাহাও দিল, সে খাইতে খাইতে বলিল–মাছ নেই?

–না বাবা, মাছ সব ফুরিয়ে গিয়েছে। আজ এখানকার হাটবার, বড্ড খদ্দেরের ভিড়। মাছের টান, ডাল তরকারির টান, সবেরই টান। তোমার খাওয়ার বড্ড কষ্ট হোল বাবা, তা বোসো দু-পয়সার দই আনিয়ে দিই।

–না না থাক, আপনার দই আনাতে হবে না।

–না বাবা বসো! বংশীধরের ভাগ্নে যা, আমার ভাগ্নেও তাই। পাশাপাশি হোটেল– এতদিন কাজ করছি।

হাজারি নিজে গিয়া দই আনিয়া দিল। ছেলেটি জিজ্ঞাসা করিল–আচ্ছা মামা, এখানে কোন চাকরি খালি আছে?

–কি চাকরি বাবা?

–এই ধরুন হোটেলের রাঁধুনীগিরি কি এমনি। কাজের চেষ্টায় ঘুরচি। এখানে কিছু হবে মামা?

মামা বলিয়া ডাকিতে ছেলেটির উপর হাজারির কেমন স্নেহ হইল। সে একটু ভাবিয়া বলিল–না বাবা, আমার সন্ধানে তো নেই, কিন্তু একটা কথা বলি। হোটেলের রাঁধুনীগিরি করতে যাবে কেন তুমি? দিব্যি সোনার চাঁদ ছেলে। এ লাইনে বড় কষ্ট, এ তোমাদের লাইন নয়। পড়াশুনা কদ্দূর করেচ?

ছেলেটি অপ্রতিভের সুরে বলিল–না মামা, বেশী করি নি। আমাদের গায়ের ছাত্রবৃত্তি ইস্কুলের ফোর্থ ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিলাম, তারপর বাবা মারা গেলেন, আর লেখাপড়া হল না।

–তোমার নামটি কি?

–শ্রীনরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।

হঠাৎ একটা চিন্তা বিদ্যুতের মত হাজারির মনের মধ্যে খেলিয়া গেল, চমৎকার ছেলেটি, ইহার সঙ্গে টেঁপির বিবাহ দিলে বড় সুন্দর মানায়!…

কিন্তু তাহা কি ঘটিবে? ভগবান কি এমন পাত্র টেঁপির ভাগ্যে জুটাইয়া দিবেন।

ছেলেটি খাওয়া শেষ করিয়া উঠিয়া বলিল–আপনার খাওয়া হয়েছে মামা?

–এইবার খেতে বসবো বাবা। আমাদের খাওয়া এইরকম। বেলা তিনটের এদিকে বড় একটা মেটে না, সেইজন্যই তো বলচি বাবা এসব ছ্যাঁচড়া লাইন, তোমাদের জন্যে নয় এসব। রান্না কাজ বড় ঝঞ্ঝাটের কাজ।

ছেলেটি একটু হতাশ সুরে বলিল–তবে কোন্ লাইন ধরবো বলুন মামা? কত জায়গায় ঘুরে বেড়িয়ে দেখলাম। আজ ছ’মাস ধরে ঘুরচি। কোথাও কিছু জোটাতে পারিনি। আপনি বলছেন রাঁধুনীর কাজ–কলকাতায় একটা হোটেলের বাইরে লেখা ছিল–দুজন চাকর চাই। আমি গিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করলাম, বল্পে–কি? আমি বল্লাম–চাকরের কাজ খালি আছে দেখে এসেচি। বল্লে–-তুমি ভদ্রলোকের ছেলে, এ কাজ তোমার জন্যে নয়। কত করে বল্লাম, কিছুতেই নিলে না।

হাজারি অবাক হইয়া শুনিতেছিল। বলিল–বলো কি?

–তারপর শুনুন। কোথাও চাকুরি জোটে না। কলকাতায় শেষকালে খেতে পাইনে এমন হল। দু-একদিন তো না খেয়েই কাটলো। তারপর ভাবলাম, আমার এক মামা রাণাঘাটে হোটেলে কাজ করেন সেখানেই যাই। তাই আজ এলাম–উনি আমার আপন মামা নয়। মায়ের জ্ঞাতি ভাই। তা এখানেও আপনি বলছেন এ লাইন আমার জন্যে নয়–তবে কোথায় যাবো আর কি-ই বা করবো?

ছেলেটির হতাশার সুর এবং তাহার দুঃখ-কষ্টের কাহিনী হাজারির মনে বড় লাগিল। সে তখনও ভাবিতেছিল–আহা, ছেলেমানুষ! আমার বড় ছেলে সন্তু বেঁচে থাকলে এতদিন এত বড়টা হোত। টেঁপির সঙ্গে ভারি মানায়। সোনার চাঁদ হেন ছেলে! টেঁপি কি আর সে অদেষ্ট করেছে! নাই বা হোল চাকরি। ও গিয়ে টেঁপিকে বিয়ে করে আমার বড় ছেলে হয়ে আমার গায়ের ভিটেতে গিয়ে বসুক–ওকে কোনো কষ্ট করতে হবে না, আমি নিজে রোজগার করে ওদের খাওয়াবো। জমিজমাও তো আছে কিছু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *