ফিরোজা বেগম ০৭ পরিচ্ছেদ

বেগমকে লইয়া মুরলা দ্রুতপদে অক্রবক্র রাস্তা অবলম্বন করিয়া একটি পল্লীর মধ্যে প্রবেশ করিল। এই পল্লীতে একটি প্রাচীন শিব-মন্দির ছিল। শিব-মন্দিরের চতুর্দিকে নানাজাতীয় বৃহৎ বৃহৎ বৃক্ষাদি থাকায় স্থানটি অন্ধকারপূর্ণ ছিল। রাত্রিতে ভয়ে এ মন্দিরে কেহই প্রবেশ করিত না। মুরলা এবং ফিরোজা দুইজনে মন্দিরে প্রবেশ করিয়া দরজা বন্ধ করিয়া প্রদীপ জ্বালাইল। প্রদীপ জ্বালাইয়া দুইজনে পরামর্শ করিতে লাগিল যে, কিরূপ বেশে সেতারা হইতে বাহির হওয়া আবশ্যক।

ফিরোজা বলিলেন, “আমরা উভয়েই যুবতী। সুতরাং নারীবেশে দূর দূরান্তরে গমন করা অসঙ্গত।”

মুরলাঃ ঠিকই বলেছেন। নারীবেশে বের হলেই আবার বিপদে পড়তে হবে। আপনার কমনীয় কান্তি, রমনীয় শ্রী এবং ললিত লাবণ্য যে দেখবে সেই বিমোহিত হবে। আপনি যে মারাঠি মহিলা নন, তা’ স্পষ্টতই ধরা পড়বে। অন্যদিকে পুরুষ বেশেও মহাবিপদের সম্ভাবনা। এ জন্য আমি মনে করি, আমরা দু’জনেই সন্ন্যাসিনী বেশে বহিগর্ত হ’লে আর বিপদের আশঙ্কা থাকে না। আমি তার বন্দোবস্ত করে রেখেছি। আমরা মারাঠি রাজ্য ত্যাগ করে নিজাম-রাজ্যে পৌঁছলে সেখানে আপনি রাজ সরকারেও অনেক সাহায্য পেতে পারবেন। অথবা তথা হতে দিল্লী বা রোহিলাখণ্ডে সংবাদ প্রেরণও বেশী কিছু কঠিন হবে না। আপনি ত বলেছেন যে, নিজাম-দরবারে আপনার উচ্চ পদস্থ আত্মীয় আছেন।

ফিরোজাঃ আমি ত সন্ন্যাসিনীর আচার-ব্যবহার কিছুই জানি না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেই বা কি বলব?

মুরলাঃ আপনি নিশ্চিত থাকুন। আমি ঠিক করে দিব। সন্ন্যাসিনীর নামধাম, ধর্মমত কেউ জিজ্ঞাসা করবে না। এরূপ জিজ্ঞেস করা নিয়মবিরুদ্ধ। জিজ্ঞেস করলেও নিরুত্তর থাকবেন। তা’তে কেউই দোষ ধরবে না।

ফিরোজাঃ সঙ্গে অস্ত্র থাকা আবশ্যক।

মুরলাঃ একটি একটি করে আমাদের দু’টি ত্রিশূল ত থাকবেই।

ফিরোজাঃ তরবারি হলেই ভালো হয়। আমি তরবারি ভালো চালাতে জানি।

মুলাঃ তরবারি থাকলে লোকে সন্দেহ করবে। আমরা যে যথার্থ সন্ন্যাসিনী নই, তাই বুঝাবে। লোকের সন্দেহের উদ্রেক হবে।

ফিরোজাঃ তা’ হলে তরবারির আর প্রয়োজন নাই।

অতঃপর মুরলা বেগমকে ভৈরবী সাজাইতে আরম্ভ করিল। গিরিমাটি ঘষিয়া চুলগুলির তৈলাক্ত ভাব দূর করিয়া ললাটোপরি শিব-চূড়া বাঁধিয়া ধিল। বস্ত্র পরিবর্তন করিয়া রক্তবর্ণ চেলী পরাইয়া দিল। হস্তে এবং গলে রুদ্রাক্ষের মালা, ললাটে রক্তচন্দ্রনের ত্রিপুণ্ড্রক।

ফিরোজার বর্ণ কিছু মলিন করিবার জন্য প্রথমে মুখে কিছু ছাই মাখিয়া পরে গৈরিক আমর্শন করিয়া দিল। এইরূপভাবে পিরোজাকে সাজাইয়া দর্পণে মুখ দেখিতে বলিল। ফিরোজা আপনার মূর্তি দেখিয়া আনন্দে স্মিতহাস্য করিলেন।

মুরলা বলিল “এবার এ ভৈরবীর রূপ দেখলে তেত্রিশ কোটি দেবতা স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যে এসে শ্রীচরণতলে গড়াগড়ি দিবে। দেবাদিদেব মহাদেব ভৈরব পর্যন্ত ত্রিলোকমোহিনী চির উদ্বিন্নযৌবনা কমলাননা পার্বতীকে পর্বতে ত্যাগ করে তোমার নীলোৎপলনিন্দিত নয়নের সন্মোহন বাণে বিদ্ধ হয়ে ঐ লোলিতাব্জ-সঙ্কাশ প্রেমিকজন-শরণ চরণতলে লুণ্ঠিত হবেন।”

মুরলার কথা শুনিয়া ফিরোজা স্মিতহাস্য করিয়া বলিলেন, “এখন রঙ্গরস রাখ। পলায়নের উপায় দেখ। নিজে শীঘ্র সজ্জিত হও।”

“আমার শহরের বাইরে বের হয়ে পড়েছি। সুতরাং রাত্রিতে রওয়ানা হলে আর কোন আশঙ্কা নাই।” – এই বলিয়া মুরলা নিজেও ভৈরবীর বেশে সত্বর সজ্জিত হইয়া ফিরোজার হস্তে একখানি ত্রিশূল ও তাঁহার স্কন্ধে গৈরিক একটি ঝুলি ঝুলাইয়া দিয়া তদনুরূপ নিজেও ত্রিশূল এবং ঝুলি ধারণ করতঃ নির্গত হইয়া পড়িল।

সমস্ত রাত্রি গমনের পরে প্রভাতে তাঁহারা ত্র্যন্বকনাথ নামক গ্রামে “বাবা একলিঙ্গের” মন্দিরে যাইয়া উপস্থিত হইলেন। ভৈরবীযুগলকে দেখিয়া মন্দিরের সেবাইতরা পরম যত্নে আহারের বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন। উভয় ভৈরবীর একত্র সম্মিলন এবং তন্মধ্যে একজনের বিস্ময়কর রমনীয় কান্তি ও তেজস্বিনী প্রকৃতি দেখিয়া সকলেই ভয়, বিষ্ময় এবং ভক্তিতে গড় করিতে লাগিল।

সমস্ত দিন বিশ্রাম করিয়া অপরাহ্নে আবার দুইজনে পথাতিক্রমে বাহির হইয়া পড়িলেন। আমাদের ভৈরবীযুগল যে পথ দিয়া যাইতে লাগিলেন, সেই পথের দুইপাশে বহু নরনারীর ভীড় হইতে লাগিল। অনেকেই বলিল, “স্বয়ং মা পার্বতী ভৈরবী মূর্তি ধারণ করে সখীসহ দাক্ষিণাত্য-ভ্রমণে বের হয়েছেন।”

রমণীর তপ্তাকাঞ্চন-সন্নিভ বর্ণের কথা অনেকেই শুনিয়াছে, কিন্তু কেহ কখনও চোখে দেখে নাই। কিন্তু আজ সকলে রক্ত চেলী পরিহিতা ভৈরবীর প্রতপ্ত স্বর্ণ-সিন্নভ বর্ণ দর্শনে বিস্ময় মানিল। এমন টানা টানা বাঁকা বাঁকা জোড়া ভুরু, ভাসা ভাসা উজ্জ্বল অথচ প্রশান্ত চক্ষু, এমন প্রভাত প্রস্ফুটিত কমলের ন্যায় প্রফুল্ল বদনমন্ডল, এমন ঊষার সিন্দু রসুবর্ণরাগমিশ্রিত রক্তিমা মাখা পেলবগও তাহারা কখনও দেখে নাই। দেখামাত্র মনে হয়ঃ

বিরলে বসিয়া ভাবিয়া ভাবিয়া
একেলা গড়েছে বিধি
কামলার ধন ত্রিলোকমোহন
অতুল রূপের নিধি!
বাছনি করিয়া সুষমা লইয়া
সারাজি জগৎ হ’তে,
শতবার করি ভাঙ্গি আর গড়ি
গড়িলা মনের মতে।
সে রূপমাধুরী আহা! মরি! মরি!
দেখিয়া মেটে না আশা,
রূপের প্রতিমা প্রেমের মহিমা
কহিতে নাহি ক ভাষা।
চরণ-পরশে ধরণীর অঙ্গে
থরে থরে ফুল ফুটে,
নয়ন-কটাক্ষে কাদম্বিনী-অঙ্গে
শতেক দামিনী ছুটে।
গগনেরি গায় চারু নীলীমায়
অয়ুত তারকা জ্বলে।
প্রেমিক সুজন পেলে দরশন
ভাসে প্রেমরস-জলে।
যুগ যুগ ধরি সে রূপমাধূরী
দরশে না মিটে আশা;
দেখে তারে যত রূপ বাড়ে তত
সৃজিয়া অসীম তৃষা।
হেন রূপবতী হেন রসবতী
হেন গুনাবলী বালা,
দেখিল যে জন মজিল সে জন
হইয়ে আপন ভোলা।

1 Comment
Collapse Comments

uponnash ta sesh korcen na kno?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *