ম্যানহাটানে মুনস্টোন – ১৫

পনেরো

ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছি, দেখি প্রমথ আর ভিক্টর! একেই বলে যোগাযোগ!
আমি বললাম, “তোদের দু’জনের কথাই আমি এতক্ষণ বসে ভাবছিলাম। কী অদ্ভুত যোগাযোগ বল তো!”
প্রমথ বলল, “কেন, পকেটে পয়সা নেই বুঝি!”
“হোয়াট ডু ইউ মিন?”
“নইলে লাঞ্চের সময় আমাকে মনে পড়বে কেন? ধার করে খাস, পয়সা ফেরত্ দিস না!”
প্রমথটা একটা যাচ্ছেতাই! হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আমি ধার করি বটে, কিন্তু বরাবরই পয়সা ফেরত দিই। কিন্তু সেসব নিয়ে তর্ক না তুলে ভিক্টরকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা ভিক্টর, স্যাম ওয়াকারের বাবা কবে মারা গিয়েছিলেন তুমি জান?”
ভিক্টর একটু অবাক হয়ে বলল, “হঠাৎ এ প্রশ্ন?”
“কারণটা এখন বলতে পারব না, কিন্তু উত্তরটা আমার দরকার।”
ভিক্টর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই প্রমথটা বলে উঠল, “তুই বেকার স্যামকে সন্দেহ করছিস। ও যদি খুনই করে থাকবে, তাহলে পরদিন বিকেলে কিরিট প্যাটেলকে ফোন করতে যাবে কেন?”
তাই তো! প্রমথর কথাটা ভুল নয়। কিন্তু এ-সব আলোচনা কি ভিক্টরের সামনে না করলেই নয়? কোনও কথা যদি পেটে ধরে রাখতে পারে!
ভিক্টর অবশ্য প্রমথর কথায় এতটুকু অবাক হল না। তার থেকে বুঝলাম যে, মিস্টার প্যাটেলের কেস-টা নিয়ে প্রমথ-র সঙ্গে ওর আগেও যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে! ও শুধু বলল, “স্যাম ইস এ নাইস বয়। খুন-টুনের মধ্যে কখনও নিজেকে জড়াবে না।”
প্রমথ আমার সঙ্গেই বাড়ি ফিরল। আমি ওকে মিস্টার প্যাটেলের চিঠি সম্পর্কে আমার ইণ্টারপ্রেটশনটা বললাম। ও খুব একটা পাত্তা দিল না। বলল, “তুই তিলকে তাল করছিস!”
সারা সকালের চিন্তাটা এ-ভাবে মাঠে মারা যেতে, বেশ ক্ষুণ্ণ হলাম। বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই ফোন। ফোন করেছেন শৈলেন সাঁপুই। জিজ্ঞেস করলেন, একেনবাবু পলা জোগাড় করতে পেরেছেন কিনা।
আমি বললাম, “যদ্দুর জানি না।”
শৈলেন সাঁপুই জানালেন যে, ওঁর হাতে কিছু পলা এসেছে। উনি তার থেকে একটা একেনবাবুকে দিতে পারেন।
আমি বললাম, “সে তো খুব ভাল কথা। কিন্তু দামটা কী রকম পড়বে সেটা যদি বলেন, তা হলে একেনবাবুকে জানিয়ে রাখব।”
শৈলেন সাঁপুই ওদিক থেকে হাঁ হাঁ করে উঠলেন। “খেপেছেন নাকি! ভারি একটা পলা আপনার বন্ধুকে দেব, দামের কোনও প্রশ্নই নেই।”
শুধু দান করা নয়, তার ওপর বললেন যে, আমরা বাড়ি থাকলে পলাটা আজ রাত্রেই আমাদের বাড়িতে দিয়ে যেতে পারেন। আসলে শৈলেন সাঁপুই কোনও কাজে বিকেলে এদিকে আসছিলেন। সেই জন্যই অফারটা করলেন।
আমি ওঁকে ডিনার খেয়ে যেতে বললাম। উনি প্রথমে একটু কিন্তু-কিন্তু করছিলেন। আমার পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেলেন।
খানিক বাদে একেনবাবু উদয় হতেই আমি ওঁকে শৈলেন সাঁপুইয়ের খবরটা দিলাম।
“কী আশ্চর্য স্যার!” একেনবাবু বললেন।
“কেন বলুন তো?”
“আজ সকালে হঠাৎ খেয়াল হল, ওঁর পেনটা আমি সেদিন ভুলে নিয়ে এসেছি। আসলে দেশে চিঠি লিখতে বসেছিলাম। পকেট থেকে পেন বার করতে গিয়ে দেখি একটা ক্রস পেন। তখনই মনে পড়ল, পেনটা ওঁর কাছ থেকে নিয়েছিলাম গয়নার দোকানের ঠিকানা লেখার জন্য। ফেরত আর দেওয়া হয় নি।”
“তা হলে সেই খোঁজেই আসছেন,” প্রমথ চায়ের জল চাপাতে-চাপাতে বলল। “আপনি দামি একটা ক্রস পেন এত সহজে হজম করে ফেলবেন ভেবেছেন!”
“আরে ছি ছি স্যার, কী যে বলেন!” একেনবাবু লজ্জা পেলেন। তারপর বললেন, “তবে যাই বলুন স্যার, আমাদের দেশের তিন টাকার ডট পেন কিন্তু এর চেয়ে কিছুমাত্র খারাপ নয়। চিঠি লিখব কি – অর্ধেক লেখাই পড়ছে না!”
“মিস্টার সাঁপুই তো দিব্বি লিখলেন সেদিন, ” আমি বললাম।
“তা লিখেছিলেন, কিন্তু পুরো যায়গায় কালি পড়ে নি। সংখ্যাটা শুধু পড়া যাচ্ছিল।”
“সেটা পেনের দোষ নয়, ইঙ্ক ড্রাই হয়ে গেছে।” আমি বললাম।
“ওসব স্যার আমেরিকাকে সাপোর্ট করার জন্য আপনাদের অজুহাত।” কথাটা বলেই একেনাবু, “খোল খোল দ্বার …” সুর ভাঁজতে-ভাঁজতে কিচেন ক্যাবিনেট খুলে বিস্কুটের খোঁজ শুরু করলেন।
“আপনার মনটা খুব প্রফুল্ল দেখছি আজ,” প্রমথ কমেণ্ট করল।
“এটা স্যার ঠিক বলেছেন। কাল মিস্টার দোশির সঙ্গে ব্রুস স্প্রিংস্টিনের রক কনসার্ট শুনতে গিয়েছিলাম। দুর্দান্ত মিউজিক স্যার। আর সেখানে বসে-বসেই অনেক কিছু ক্লিয়ার হয়ে গেল।”
“মিউজিক শুনতে-শুনতে?” আমি ঠাট্টা করলাম।
“মিউজিককে আণ্ডার-এস্টিমেট করবেন না স্যার। তানসেন মিউজিক দিয়ে আগুন ধরাতে পারতেন, আমি তো শুধু খুনি ধরছি।”
“সে কী মশাই, আপনি ধরে ফেলেছেন কে খুনি?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।
“পুরোপুরি নয় স্যার। একটু একটু করে এগোচ্ছি। রাত্রে গান শোনার সময় একটু এগোলাম। সকালে চিঠি লেখার সময় আরেকটু এগোলাম। এখন আপনাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে হয়ত আরেকটু এগিয়ে যাব।”
“আপনার ওই হেঁয়ালিগুলো রাখুন,” প্রমথ এবার বিরক্ত হয়ে বলল। “কাকে সন্দেহ করছেন?”
“দোহাই স্যার, আমাকে চাপ দেবেন না। ফাইন পয়েণ্টগুলো এখনও একটু ট্রাবল দিচ্ছে। ভাল কথা আপনি একটা কাজ করতে পারেন?”
“কি কাজ?”
“আপনি অবিনাশবাবু, ব্রিজ শাহ, আর স্যাম ওয়াকারকে আজ ডিনার খেতে ডাকুন। মিস্টার সাঁপুই আসছেন ভাল হয়েছে, ওঁকেও আমার একটু দরকার। আপনি আর বাপিবাবু তো আছেনই।”
“সেরেছে, আপনি কি এরক্যুল পোয়ারো সাজবেন নাকি!” আমি বললাম।
“আরে ছি ছি স্যার, কার সঙ্গে কার তুলনা ।”
“যাই করুন, আমাদের কিন্তু ডোবাবেন না। বাড়িতে ডেকে এনে অপমান করেছি বলে কেউ হয়ত মানহানি মোকদ্দমা লাগিয়ে দিতে পারে।”
“বিশেষ করে অবিনাশ,” প্রমথ যোগ করল।

প্রমথ চাইলে ক্যান ডু ওয়াণ্ডার! কি করে এত অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলো লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করল, এবং শুধু যোগাযোগ করা নয়, তাদের কি বুঝিয়ে অন্য সব কাজ ফেলে আমাদের অ্যাপার্টমেণ্টে আসতে রাজি করালো – আই উইল নেভার নো! যাই হোক, সবাই যখন আসছে, তখন কাজ হচ্ছে ঘরদোরগুলো একটু পরিষ্কার করে ডিনারের ব্যবস্থা করা। একেনবাবুর ইচ্ছে খাওয়া এবং মিটিং দুটোই নীচে প্রমথর অ্যাপার্টমেণ্টে হোক। আমি একটু আপত্তি তুলেছিলাম, কিন্তু একেনবাবুর ঘ্যানঘ্যানানির কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানলাম।
প্রমথ আর একেনবাবু রান্নার ভার নিল, আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল অ্যাপার্টমেণ্টটা একটু ভদ্রস্থ করা। এই ডিলে একেনবাবুরই সবচেয়ে সুবিধা। প্রমথ কাউকে রান্না করতে দেবে না। একেনবাবু শুধু একটু ফাই ফরমাস খাটবেন। আর আমার দায়িত্ব? প্রমথর নোংরা আগোছাল অ্যাপর্টমেণ্টটা যারা দেখেছে, তারাই শুধু বুঝবে কাজটা কী দুরূহ! ঘর গোছাচ্ছি, আর মনে-মনে একেনবাবুর মুণ্ডুপাত করছি! এরকম নাটকীয়ভাবে সবাইকে ডাকার অর্থটা কি! কি এমন হাতিঘোড়া উনি আবিষ্কার করেছেন ব্রুস স্প্রিংস্টিনের রক কনসার্ট শুনে আর সকালে চিঠি লিখতে-লিখতে! আমি জানি, প্রশ্ন করে কোনও লাভ নেই। মতলববাজ একেনবাবুর পেট থেকে একটা কথাও বার করা যাবে না!