০৭. সেন্ট্রাল লাইনের টিউবে চড়তে

সেন্ট্রাল লাইনের টিউবে চড়তে না চড়তেই অক্সফোর্ড সার্কাসে নেমে পড়লাম। দু মিনিটের মধ্যেই বেকারলু লাইনের গাড়ি এলো। ভীষণ ভিড় তবু উঠে পড়লাম। কিছু দেখতে না পেলেও গাড়ি থামতেই বুঝলাম পিকাডিলি সার্কাস। তারপর ট্রাফালগার স্কোয়ার। চারিং ক্ৰশ। নেমে পড়লাম। স্ট্রান্ড দিয়ে হাঁটছি। কত দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মানুষ আমার এপাশ-ওপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। কত সুন্দরী। কত হট প্যান্ট। কিছু দেখতে পেলাম না। চোখের সামনে শুধু রঞ্জনার ছবিটাই ভেসে উঠলো।

সারাদিন খুব ঘুরেছি। হোটেলে এসেই হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম। ঘুম ভাঙল টেলিফোনের ঘণ্টায়। রিসেপসনের টোলিফোন, স্যার মিঃ চাউডারী ইজ হিয়ার।

আমার ঘরে পাঠিয়ে দিতে বলেই উঠলাম। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পরেই দেবু এলো। আসুন আসুন।

দেবু আমার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, আপনাকে বোধহয় ডিসটার্ব করলাম, তাই না?

ডিসটার্ব করবেন কেন? আমিই তো আপনাকে আসতে বলেছি।

দেবু বলল। আপনার দরজায় কয়েকবার নক করে কোনো রেসপন্স না পেয়ে রিসেপসন থেকে টেলিফোন করলাম।

সারাদিন ঘুরাঘুরি করে এত টায়ার্ড হয়েছিলাম যে ঘরে ঢুকেই শুয়ে পড়েছিলাম।

দেবু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল, তাহলে বরং আপনি রেস্ট নিন, আমি কাল আসব।

আমি দেবুর কাঁধে হাত দিয়ে বসিয়ে দিলাম, বসুন বসুন। হাতের ঘড়িটা দেখে বললাম, প্রায় দু ঘণ্টা ঘুমিয়েছি। আর রেস্ট নেবার দরকার নেই।

জুতার ফিরে খুলতে খুলতে বললাম, ঠিক পনেরো বছর আগে আপনার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। মনে আছে?

নিশ্চয়ই।

সেকেন্ড টাইম যখন লন্ডনে এলাম তখন আপনার ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে…।

আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ও বললো, আমরা দুজনে ডুরি লেন থিয়েটারে মাই ফেয়ার লেডী দেখেছিলাম…

লীডস যাওয়ার কথা মনে আছে?

সেই ডক্টর ঘোষের নতুন অস্টিনে চড়ে গিয়েছিলাম। মনে থাকবে না?

আর ওয়াই-এম-সি-এতে একদল আলজেরিয়ান ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে…

হাসতে হাসতে দেবব্রত বললো, সত্যি অমন পাগলের মতো সারারাত ডান্স কোনদিন করিনি।

তবে ছেলেগুলো সত্যি খুব ভদ্র ছিল।

 নো ডাউট অ্যাবাউট দ্যাট। তবে মোস্ট ইন্টারেস্টিং ছিল সেই রোমান্টিক ফ্রেঞ্চ ফটোগ্রাফার ছেলেটি।

দ্যাটস্ রাইট! তাহলে দেখছি আপনার সব কিছু মনে আছে।

সব কিছুই যে মনে থাকে সেইটাই তো বিপদ।

বিপদ কেন?

দেবু একটু শুকনো হাসি হাসল, সব কিছু ভুলে গেলেই ভালো হতো।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, কি ব্যাপার? মানের মধ্যে কিছু অভিমান জমা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে?

আপনি জামা কাপড় চেঞ্জ করে নিন। তারপর কথা হবে।

জামাকাপড় পাল্টে একটু বাথরুম থেকে ঘুরে এসেই দেবুর সামনের সোফায় বসলাম। প্রস্তাব করলাম, সুড উই হ্যাভ সাম হুইস্কি?

দেবু সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে একটা হোয়াইট হর্সের বোতল আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, উইথ কাইন্ডেস্ট রিগার্ডস!

আমি একটু বিস্মিত হয়ে বললাম, একি। আপনি আনলেন কেন?

ক্ষতি কি? এখন তো আমি ছাত্র নেই, চাকুরি করছি!

তাহলেও আপনার আনা ঠিক হয়নি।

কেন?

আমি আপনাকে আসতে বলেছি, খেতে বলেছি, সো ইট ইজ মাই ডিউটি টু এন্টারটেন ইউ।

আমার সঙ্গে ফর্মালিটি করার দরকার নেই। এর আগে যতবার আপনার এখানে এসেছি প্রত্যেকবারই আপনি আমাকে যথেষ্ট এন্টারটেন করেছেন। এবার না করলেও অন্যায় হবে না।

হবে না?

অফ কোর্স নট!

শেষ পর্যন্ত বোতল খুলে দুটো গেলাসে ঢেলে শুরু হলো, চিয়ার্স।

চিয়ার্স।

শুরু হলো কথাবার্তাও। হুইস্কির গেলাসটা নামিয়ে সিগারেট ধরাতে ধরাতে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি এখানে চাকরি নিলেন কবে।

দু বছর হয়ে গেল।

হঠাৎ ব্যাঙ্গাললারের চাকরি ছাড়লেন? ওখানে তো ভালোই ছিলেন।

শুধু ব্যাঙ্গালোরের চাকরি নয়, সব কিছুই ছেড়ে দিলাম।

তার মানে? গেলাসে চুমুক দিতে গিয়েও নামিয়ে নিলাম।

তার মানে সত্যিই সব কিছু ছেড়ে এসেছি। আই মীন স্ত্রী-পুত্র, ঘর বাড়ি দেশ–সব কিছু।

কি আজেবাজে কথা বলছেন? একটু শাসন করার সুরেই বললাম।

এখন তো হাফ পেগ হুইস্কিও পেটে যায়নি। আজেবাজে কথা বলার সুযোগ পেলাম কোথায়? তাছাড়া এখন এই পুরো বোতল হুইস্কি খেলেও আমি মাতাল হবে না।

আপনি কি আজকাল খুব ড্রিঙ্ক করেন?

খুব করি কিনা জানি না, তবে তিনশ পঁয়ষট্টি দিন ড্রিঙ্ক করি।

এত ড্রিঙ্ক করে টাকা পয়সা নষ্ট করছেন কেন? রোজ ড্রিঙ্ক করবেন না।

মানি ইজ নো প্রবলেম…

কেন?

একটু লেখাপড়া শিখেছি বলে বেশ ভালোই রোজগার করি। এর সিকি ভাগ আয় করে লোকে সংসার চালিয়েও বাড়ি-গাড়ি করছে।

আপনি গাড়ি কেনেননি?

আমার গেলাসের অর্ধেকও শেষ হয়নি, কিন্তু এরই মধ্যে ওর ড্রিঙ্ক শেষ। নিজেই আবার গেলাস ভরে নিলো। তারপর এক চুমুক দিয়ে বললো, ওসব ঝামেলায় আমি আর নেই। একবার স্ত্রী-পুত্রকে যখন চিরকালের মতো ছাড়তে পেরেছি তখন…

কথাগুলো শুনতে ভারি খারাপ লাগল। বললাম, আবার আজেবাজে কথা বলছেন।

সত্যিই বাজে কথা বলছি না। অন্তত আপনাকে নিশ্চয়ই বাজে কথা বলব না।

আমি তো তাই আশা করি।

দাদা মারা গিয়েছেন জানেন তো?

উনি তো ব্যাঙ্গালোরেই মারা যান?

হ্যাঁ।

সব কাগজেই তো সে খবর ছাপা হয়েছিল।

আমার শাশুড়িও মারা গিয়েছেন…

তাই নাকি?

হ্যাঁ। ইন ফ্যাকট দাদা মারা যাবার ঠিক মাস খানেক আগেই উনি মারা যান!

কি হয়েছিল জয়ন্তী বৌদির?

ক্যান্সার। ধরা পড়ল একেবারে লাস্ট স্টেজে।

বৌদির মৃত্যুর খবরটা শুনেই মন খারাপ হয়ে গেল। মনে পড়ল ওয়াশিংটনের কথা, কায়োর কথা। আরো কত কি! বড় ভালোবাসতেন আমাকে।

পৃথিবীর সব মানুষ ভালোবাসা চায়, কিন্তু খুব কম, মুষ্টিমেয় মানুষই ভালোবাসতে পারে। মানুষের সব চাইতে বড় সম্পদ প্রেম ভালোবাসা। সেই প্রেম, সেই ভালোবাসা, মনের সব চাইতে বড় ঐশ্বর্য অপরিচিত মানুষকে তো দূরের কথা নিজের প্রিয়জনদেরও সবাই বিলিয়ে দিতে পারি না আমরা। বৌদি পারতেন। অনায়াসে পারতেন। মানুষকে ভালোবাসতে জয়ন্তী বৌদির কার্পণ্য ছিল না। আমেরিকা থেকে চলে আসার দিন নিউইয়র্ক এয়ারপোর্টে ওঁকে বললাম, লোকে এখানে। এসে কত কি জিনিস সওদা করে, কিন্তু আমার মতো বিনা পয়সায় এমন সওদা করে নিয়ে যেতে পারে কজন?

কি আবার সওদা করলে? কিছুই তো কিনলে না।

আপনাদের ভালোবাসার যে সওদা করে নিয়ে যাচ্ছি তার চাইতে…

ভালোবাসতে জানলে ভালোবাসা পাওয়া যায় ভাই। তুমি ভালো না বাসলে কি আমরা ভালোবাসতাম?

আমি তর্ক করলাম না। সময় ছিল না, কিন্তু আসলে উনি ঠিক উল্টো কথাটাই বললেন। ভাদ্দরের অন্ধকার আকাশে সামান্য একটু বিদ্যুৎ চমকের মতো তর্জন গর্জন, কিন্তু কতটুকু তার আলো? কতক্ষণই বা তার মেয়াদ। আর সূর্য? অমাবস্যার সূচীভেদ্য অন্ধকার ভেদ করে সে মহাতপস্বী সাধকের মতো মাথা তুলে দাঁড়ায়, পৃথিবীর দশ দিকে নিজের সবটুকু আলো ছড়িয়ে দেয়, কিন্তু তার কোনো তর্জন-গর্জন নেই। সুভাষদা আর জয়ন্তী বৌদি ভালোবাসার মাধুর্য আপন চারিত্রিক মহিমায় আমাকে বিলিয়ে দিয়েছেন।

কায়রো থেকে আসার আগে বৌদির কাছে একটা ফটো চাইলাম।

আমার ছবি নিয়ে কি করবে ভাই?

কি আর করব? আমার কাছে থাকবে। মাঝে মাঝে দেখব, কথা বলব।

আমার আলাদা ছবি রাখতে হবে না। ছবি দেখে জোর করে আমাকে মনে করতে হবে না। যদি এমনি আমাকে মনে রাখতে না পার, তাহলে মনে রেখো না।

অনেকবার অনুরোধ করলাম, কিন্তু কিছুতেই উনি ওঁর একটা ছবি দিলেন না। সেদিন ঠিক খুশী হইনি। পরে বুঝেছিলাম সত্যি ওঁর ফটো রাখার দরকার নেই, ওঁর সান্নিধ্য যারা পেয়েছে তাদের কাছে ওঁর স্মৃতি অম্লান রইবেই।

বড় অপরাধী মনে হলো নিজেকে। ওঁরা কলকাতা চলে যাবার পর কতবার কলকাতা গেছি, কিন্তু একবারও দেখা করিনি। সাহস হয়নি। ভয় করেছে যদি কথায় কথায় বেরিয়ে যায় রমা আমাকে…

পারিনি। কিছুতেই পারিনি। প্রত্যেকবার ফেরার পথে মনে হয়েছে অন্তত একবার কয়েক মিনিটের জন্য অবশ্যই যাওয়া উচিত ছিল। ভীষণ অন্যায় হয়েছে। এর পরের বার কলকাতায় গিয়ে নিশ্চয়ই দেখা করব। পরের বার গিয়েও পারিনি। হেরে গেছি।

বৌদি মারা গেলেন আর সুভাষদা আমাকে একটা খবর দিলেন না? নিজেই যেন নিজেকে প্রশ্ন করলাম।

দেবব্রত বললো, উনি এত বেশি আঘাত পেয়েছেন যে, চিঠিপত্র লেখা তো দুরের কথা, কারুর সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তাও বলেন না।

আমি চুপ করে বসে রইলাম। একটা কথা বলতেও মন চাইল না। সুভাষদা আর বৌদির চিন্তায় তলিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ ওর কথায় চমক ভাঙল, রঞ্জনার ছেলে হয়েছে, জানেন তো?

কই না তো!

এই তো একটু আগেই বললাম স্ত্রী-পুত্র ঘর বাড়ি ছেড়ে এসেছি, শোনেননি?

স্ত্রীকে ছেড়ে এসেছে শুনেই মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। ইন এনি কেস, কনগ্রাচুলেশনস।

আমাকে নয়, রঞ্জনাকে কনগ্রাচুলেট করবেন।

ওর সঙ্গে দেখা হলে ওকে কনগ্রাচুলেট করব। এখন তো আপনাকেই করি। ইউ আর দ্য প্রাউড ফাদার…

দেবব্রতর সুন্দর মখখানা যেন হঠাৎ শুকিয়ে পাংশু বর্ণ হয়ে গেল মাথা নাড়তে নাড়তে বললো, আই অ্যাম নট…

আমার পিঠের উপর যেন একটা চাবুকের বাড়ি পড়ল। হুইস্কির গেলাসটা খুব জোরে সেন্টার টেবিলে রেখে প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, হোয়াট?

ধীর, স্থির, শান্ত দেবব্রত আবার মাথা নাড়তে নাড়তে বললে, আমি ঐ ছেলের বাবা না।

টেবিল চাপড়ে আমি পাগলের মতো চিৎকার করে বললাম, স্টপ টকিং ননসেন্স।

আমার চিৎকারে দেবব্রত একটু থতমত খেয়ে মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ আমি ওর মুখের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারলাম না। বেশিক্ষণ অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। দৃষ্টিটা আবার ঘুরিয়ে আনতেই দেখি দেবব্রতর দুটো চোখ জলে ভরে গেছে। বিশ্বাস করুন দাদা, আপনাকে আমি মিথ্যে কথা বলছি না, ভগবানের নামে মা কালীর নামে শপথ করে বলছি ও ছেলে আমার নয়।

কিন্তু দেবুবাবু, রঞ্জনা তো এমন কাজ করতে পারে না। আমি তা ওকে খুব ভালোভাবে চিনি।

আমি জানি রঞ্জনা ভালো। রঞ্জনা আমাকে ভালোবাসে। তবে একথাও জানি ও ছেলের জন্মদাতা আমি না।

আমি স্বীকার করতে পারলাম না, এ হতে পারে না, এ অসম্ভব।

এই পৃথিবীতে কিছুই অসম্ভব নয়।

তা ঠিক! তবুও…

আমার দাদা ডক্টর দেবতোষ চৌধুরীই ঐ ছেলের…

আঃ। দেবুবাবু। আপনি কি উন্মাদ হয়েছেন?

দেবু উন্মাদ না হলেও প্রায় পাগলের মতো হেসে উঠল, হইনি। হলে ভালোই হতো।

বেশ রেগে আমি ওকে বললাম, গেট রিড অব অল দিজ ডার্টি আইডিয়াস।

আই উইস, আই কুড, কিন্তু যা বলছি তা বর্ণে বর্ণে সত্যি। রঞ্জনা নিজেও স্বীকার করেছে।

বলেন কি?

হ্যাঁ। ও স্বীকার করেছে।

দুজনেই গেলাসের পর গেলাস হুইস্কি খেয়ে গেলাম। কিন্তু একটি কথা বললাম না কেউই। অনেকক্ষণ। বোধহয় ঘণ্টাখানেক। বা তারও বেশি।

আমার বড় দাদু ডাঃ জনার্দন চৌধুরীর কথা আপনার মনে আছে?

যিনি কাপুরতলার মহারাজার…

দ্যাটস রাইট। হি ওয়াজ এ গ্রেট ম্যান। কিন্তু আমার নিজের দাদু গদাধর চৌধুরী এক নম্বরের স্কাউলে ছিলেন। নিজের বিবাহিতা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে সিমলার এক পাহাড়ি মেয়েকে নিয়ে ঘর করতেন।

আমি চুপ করে শুনছি। তখনকার দিনে অনেক বাঙালিবাবুই এ কাজ করতেন। শুনে অবাক হলাম না।

আমরা ওঁর ঐ রক্ষিতারই বংশধর।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আমার বাবাকে বড় দাদুই মানুষ করেন এবং তিনি নিছক একজন ভদ্রলোক ছিলেন। বড় দাদুই আমার বাবার বিয়ে দেন এবং আমরা হই।

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললাম, আর কি শুনব আপনার কাছে?

দাদুর এসব কথা কাউকে বলি না। ভেবেছিলাম বলার দরকার হবে না। কিন্তু দাদার কাণ্ড দেখে। মনে হচ্ছে রক্তের ধারা পাল্টান বড় কঠিন। বোধহয় অসম্ভব।

জানি না।

আমার এক কাকা–আই মীন ওই পাহাড়ি মেয়েটির ছোট ছেলে–দিল্লিতে আন্ডার সেক্রেটারি।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আমাদের অনেক পরিচিত লোক এমনি পাহাড়ি মেয়েকে নিয়ে ঘর করতে করতে…

থাক, আর দরকার নেই। রঞ্জনা কি দিল্লিতেই আছে?

হ্যাঁ। দোতলায় থাকে। একতলা ভাড়া দিয়ে এগার শ টাকা পাচ্ছে।

টাকার হিসেব শুনতে চাইনি।

এমনি বলছিলাম। ওর সম্পর্কে আপনার চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক।

চিঠিপত্রের লেনদেন নেই নিশ্চয়ই?

। তবে পর পর কয়েকবার টাকা পাঠিয়েছি, কিন্তু ও নেয়নি।

না নেওয়াই তো উচিত।

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর দেবব্রত জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি পরশুই যাচ্ছেন?

কেন? আরো কিছু শোনাতে চান?

দেবব্রত উঠে দাঁড়াল। আমিও।ও একবার আমার দিকে তাকিয়েই দুহাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমার উপর রাগ করবেন না। আমি বড় দুঃখী। আমি বড় একা।

আমিও ওকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম, রাগ করিনি ঠিকই তবে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হলেই ভালো হতো।

আমার কাঁধের উপর ফোঁটা ফোঁটা ওর চোখের জল পড়ছিল। হয়তো আপনার ভালো হতো, কিন্তু আপনাকে সব কিছু বলে একটু হালকা হতে পারলাম।

অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। বললাম, বাড়ি যান। অনেক রাত হয়েছে।

যাচ্ছি।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানেই থাকবেন না কি দেশে ফিরবেন?

দেশে ফেরার ইচ্ছা নেই। এখানেই বেশ আছি।

বেশ আর কোথায় আছেন?

যারা দেশে সুখে থাকতে পারে তারা কেউ লন্ডনে আসে না। আসবে কেন? পৃথিবীর যত দুঃখী লোকের ভিড় তত এই লন্ডনে। আমিও ওদের মধ্যে দিনগুলো ঠিক কাটিয়ে দেব।

.

অনেক দিন বিদেশে কাটিয়ে দিল্লি ফিরলাম। রাধাকিষণকে আগেই খবর দিয়েছিলাম। ও এয়ারপোর্টেও এসেছিল। পালাম থেকে বাড়ি ফেরার পথে জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু জরুরী খবর। আছে নাকি?

।রাধাকিষণ বললো, অনেক চিঠিপত্র এসেছে আর চৌধুরী মেমসাব এসেছিলেন।

কবে এসেছিলেন?

তিন-চার দিন।

কিছু বলে গেছেন?

জিজ্ঞাসা করলেন আপনি কবে আসবেন, আর একটা চিঠি দিয়ে গেছেন।

উনি জানেন আমি আজ আসছি?

হ্যাঁ সাব। আমি বলেছি।

চিঠি কবে দিয়ে গেলেন?

আজই।

বাড়িতে এসেই রঞ্জনার চিঠি পড়লাম।…যত রাত্রিই হোক একবার আমার এখানে আসবেন।

হাতের ঘড়িতে দেখলাম দশটা বেজে গেছে। মিনিট খানেক ভাবলাম। তারপরই একটা ট্যাকসি নিয়ে চলে গেলাম।

আমি ট্যাকসি থেকে নামতেই দেখি রঞ্জনা দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। ট্যাকসি ছেড়ে দিলাম না, ড্রাইভারকে দাঁড়াতে বললাম।

এক পা এগুতেই রঞ্জনা বললো, আসুন।

আমি একটি কথা না বলে ওর পিছন পিছন উপরে উঠলাম। সামনের ঘরে ঢুকতেই বললো, বসুন।

বসলাম।

পাশের ঘর থেকে ছেলেকে কোলে করে এনে আমার সামনেই বসে পড়ে বললো, আজ এর জন্মদিন। আপনি যদি একটু আশীর্বাদ করতেন…

রঞ্জনা আর কথা বলতে পারল না।

আমি ওর কোল থেকে ছেলেটাকে দু হাতে তুলে নিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলাম।

আমার পায়ের উপর রঞ্জনার কয়েক ফোঁটা গরম চোখের জল পড়তেই ওকেও আমি বুকের মধ্যে টেনে নিলাম।

1 Comment
Collapse Comments

Enjoyed the book.Truth is stranger than fiction

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *