২০. নবেন্দুবাবু প্যারিস থেকে প্রায়

নবেন্দুবাবু প্যারিস থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দূরে থাকলেও প্রায় প্রত্যেক শুক্রবার বিকেলে এসে হাজির হতেন; তবে হ্যাঁ, আমার ওখানে উঠতেন না। আমার অ্যাপার্টমেন্টের কাছেই একটা ছোট হোটেলে উঠতেন। আমরা একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া, গল্পগুজব, ঘোরাঘুরি করতাম। বেশ কেটে যেত সপ্তাহের শেষ দুটো দিন।

মাস দুই এইভাবে চলার পর সত্যি আমরা দুজনে বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠলাম। প্রথম প্রথম বিদেশে আসার পর পুরুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে ভয় করত, দ্বিধা হতো। আস্তে আস্তে এই ভয় বা দ্বিধ সংকোচ কেটে গেল। তাই তো নবেন্দুবাবুর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হতে খুব বেশি সময় লাগল না।

কফি খেতে খেতে আমি বললাম, সারাদিনই তো আমার এখানে কাটান। রাত্তিরের কটা ঘণ্টা কাটাবার জন্য এতগুলো ফাঙ্ক নষ্ট করে হোটেলে থাকার কী দরকার?

নবেন্দুবাবু হেসে বললেন, শুধু তোমার জন্যই তো হোটেলে থাকি।

আমার জন্য আপনি হোটেলে থাকেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনার জন্য।

আমার জন্য আপনি কেন হোটেলে থাকবেন?

সত্যি বলছি কবিতা, তোমার জন্যই হোটেলে থাকি। দিনেরবেলা তবু কোনোমতে নিজেকে সংযত রাখতে পারি। সন্ধের পর কয়েক পেগ হুইস্কি বা দু-এক বোতল ওয়াইন পেটে পড়ার পর তোমাকে দেখে যে আমার কি মনে হয়…

অত ভূমিকা না করে আসল কথা বলুন।

এবার উনি হেসে বললেন, আমার মতো দস্যু রাত্তিরে তোমার এই অ্যাপার্টমেন্টে থাকলে কত কী সম্পদ যে লুঠ করবে, ত র কী ঠিকঠিকানা আছে?

আমিও হেসে বলি, কোনো স্যুই এত ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কিছু ক্ষতি করতে পারে না।

কথাটা সত্যি হলেই ভালো।

আরো কিছুদিন এইভাবে মেলামেশা করার পর মনে হল নবেন্দুবাবু চরিত্রহীন হলেও মানুষ হিসেবে ভালোই। তাছাড়া মনে হল, এত বিদ্যা-বুদ্ধি সাফল্যের মধ্যেও ওর মনে অনেক ব্যথা-বেদনা লুকিয়ে আছে।

.

ভাই রিপোর্টার, দুনিয়ার সবাই জানে মদ্যপানের অনেক দোষ, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে মদ্যপান মানুষকে সত্যবাদী করে। মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় যে কথা কোনোদিন কাউকে বলতে পারবে না, মদ্যপানের পর সেই মানুষই তার সব গোপন কথা মুক্তকণ্ঠে বলতে পারে। একদিন মদ্যপানের পর নবেন্দুবাবুও আমাকে অনেক দুঃখের কথা বললেন।

একে গরিব স্কুল মাস্টারের ছেলে, তার ওপর নটি ভাইবোন। এ ছাড়াও এক বিধবা পিসিমা ও তার কন্যা। অনেক দুঃখ কষ্টের মধ্যেই নবেন্দু স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হলেন। প্রথম বার্ষিকী পরীক্ষার খাতা দেখেই অধ্যক্ষ ঊষানাথ বসু চমকে উঠলেন। কয়েকদিন পরে ক্লাসে এসে নবেন্দুর খোঁজ করতেই টের পেলেন, দীর্ঘদিন মাইনে না দেবার জন্য ওর নাম রেজিস্টারে নেই।

অন্ধকার রাত্রির পরই সূর্যোদয়। অধ্যক্ষ উষানাথ বসুর কৃপায় নবেন্দু সসম্মানে অনা- নিয়ে বি.এ. পাশ করে এম. এ পড়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন।

নবেন্দুবাবু হেসে বললেন, এম. এ পড়ার সময় পেয়ে গেলাম ডক্টর সরকারকে। উনি না থাকলে আমার এম. এ. পাশ করা হতো না। বাড়িতে থাকলে লেখাপড়া করতে অসুবিধে হবে বলে পরীক্ষার আগের তিন মাস উনি আমাকে ওঁর বাড়িতেই রেখে দিলেন।

সত্যি, ডক্টর সরকারের মতো মানুষ হয় না।

সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ওঁর সংগ্রহ করা মেটিরিয়ালস আর নোক্স নিয়েই আমি আমার প্রথম বই লিখি। নবেন্দুবাবু একটু স্নান হাসি হেসে বললেন, আমি জীবনে আর কোনো অধ্যাপক দেখিনি যিনি ছাত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য এমন ভাবে স্বার্থত্যাগ করবেন।

তারপর?

পরীক্ষার ফল ভালোই হয়েছিল বলে অধ্যক্ষ ঊষানাথ বসু সঙ্গে সঙ্গে আমাকে একশো। পঁচিশ টাকার লেকচারার করে দিলেন গিরিডির এক কলেজে।

নবেন্দুবাবু গেলাসে শেষ চুমুক দিতেই আমি আবার গেলাস ভরে দিলাম।

এ কী? আবার দিলে?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ। তারপর কী হল বলুন।

নবেন্দুবাবু হেসে বললেন, অধ্যক্ষ মহাশয় লুকিয়ে আমার গরিব বাবাকে কিছু অর্থ দিয়ে। আমাকে কিনে নিলেন।…

আমি একটু বিস্মিত হয়েই প্রশ্ন করি, কিনে নিলেন মানে?

নবেন্দুবাবু গেলাসে চুমুক দিয়ে আবার একটু হাসেন। বলেন, অধ্যক্ষ কন্যা শ্রীমতী শিখারাণীর সঙ্গে আমার বিবাহ হল এবং মাত্র ছ মাস পরই তিনি একটি পুত্ররত্ন প্রসব করলেন।

ছ মাসে?

হা কবিতা, ছ মাসে। গুরুদক্ষিণা দেবার জন্য আমি না জেনে গর্ভবতী শিখারাণীকেই বিয়ে করেছিলাম।

কী আশ্চর্য! কিছু আশ্চর্যের না। এই পৃথিবীতে যে যত বেশি ঠকাতে পারে সে তত বেশি বুদ্ধিমান।

তারপর কী করলেন? শিখারাণী হাসপাতাল থেকে ফেরার আগেই আমি গিরিডি ছেড়ে পালালাম।

কোথায় গেলেন? বাড়িতে?

না, না। বাবা আর শ্বশুরমশায়ের ওপর এত ঘেন্না হল যে…

বাবা কি অন্যায় করলেন?

একে অধ্যক্ষ মশায়ের মেয়ে, তার ওপর নগদ কয়েক হাজার টাকায় বাবা এমনই বশীভূত হয়ে গেলেন যে বিয়ের আগে তিনি মেয়েও দেখতে গেলেন না।

হা ভগবান!

আরো শুনতে চাও কবিতা?

আপত্তি না থাকলে বলুন।

ছাত্র জীবনে নবেন্দুবাবু লেখাপড়ার নেশায় এমনই মত্ত ছিলেন যে অধ্যক্ষ মশায়ের বাড়িতে নিত্য যাতায়াত করলেও শিখারাণীর দিকে নজর দেবার তাগিদ বোধ করেননি। নবেন্দুবাবুর মতো আরো অনেক ছাত্রই ও বাড়িতে যাতায়াত করত কিন্তু দু-একটা মৌমাছি যে শিখারাণীর জন্যই অধ্যক্ষ মশায়ের অনুগত ছিলেন, তা উনি জানতেনও না।

যাই হোক, সংসার জীবনের শুরুতেই এমন বিশ্বাসঘাতকতার বলি হয়ে নবেন্দুবাবু হঠাৎ একদিন চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে গিরিডি থেকে উধাও হয়ে গেলেন। প্রথমে কিছু দিন পাগলের মতো ঘুরে বেড়ালেন যত্র-তত্র। তারপর আবার অধ্যাপনা শুরু করলেন। প্রথমে আগ্রা, তারপর লুধিয়ানা। কয়েক মাস লুধিয়ানায় থাকার পর ফিরোজপুর। না, ওখানেও বেশি দিন থাকতে পারলেন না। চলে গেলেন লক্ষ্মৌ; লক্ষ্মৌ থেকে কাশী।

বিদ্বান, বুদ্ধিমান, সুপুরুষ নবেন্দুবাবুর ওপর নজর পড়ল প্রবীণ অধ্যাপক প্রমোদ মিত্তিরের। এক রবিবার সকালে উনি হঠাৎ নবেন্দুবাবুর কাছে হাজির। 

নবেন্দুবাবু চমকে উঠলেন, আপনি! হ্যাঁ আমি। তুমি একলা থাক বলে মাঝে মাঝেই সন্ধের পর আসি, কিন্তু কোনো দিনই দেখা পাইনি।

আপনি আমার এখানে এসেছিলেন?

প্রমোদবাবু একটু হেসে হাতের ছড়িটাকে পাশে রেখে বললেন, এসেছিলেন মানে? বেশ কয়েকদিন এসেছি।

নবেন্দুবাবু অত্যন্ত লজ্জিতবোধ করেন। বলেন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, কিন্তু আমি তো জানতাম না, তাই…

প্রমোদবাবু আবার হাসেন। বলেন, তোমার মতো ব্যাচেলার হলে আমিও থাকতাম না। যাকগে, ওসব কথা বাদ দাও। আজ দুপুরে আমার ওখানে চলে এসো। আচ্ছাও হবে, খাওয়া-দাওয়াও হবে।

কিন্তু…

ওসব কিন্তু-টিন্তু বললে চলবে না। তোমাকে আসতেই হবে।

.

নবেন্দুবাবু আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, প্রমোদবাবুর বাড়ি গিয়ে দেখি, আমার শ্বশুর, শাশুড়ি ও শিখারাণী তার জারজ সন্তান নিয়ে হাজির।

তাই নাকি!

হ্যাঁ। আমি জানতাম না প্রমোদবাবু ওদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়।

আমি অধীর আগ্রহে প্রশ্ন করি, তারপর কি হল?

স্বামী পরিত্যক্তা স্ত্রীর মুখে যে দুঃখ বেদনা থাকে, তার চিহ্নমাত্রও শিখারাণীর মুখে দেখলাম না!

বলেন কি?

হ্যাঁ কবিতা ঠিকই বলছি। রাগে, দুঃখে ঘৃণায় আমি সঙ্গে সঙ্গেই প্রমোদবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম এবং সেই রাত্রেই কাশী ছেড়ে সোজা হরিদ্বার চলে গেলাম।

প্রশ্ন করলাম, আপনার বাবা-মার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখতেন না?

চিঠিপত্র লিখতাম না, কিন্তু প্রত্যেক মাসে মাকে টাকা পাঠাতাম।

আচ্ছা, তারপর বলুন।

নবেন্দুবাবু আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে বললেন, হরিদ্বারে গিয়ে অঘটন ঘটে গেল।

ওর হাসি দেখে আমারও হাসি পায়। বলি, কী আবার অঘটন ঘটল?

আবার কোনো প্রমোদবাবুর সঙ্গে যাতে দেখা না হয়, এই ভেবে আমি গুজরাতিদের একটা ধর্মশালায় উঠেছিলাম। আসার সময় ট্রেনে ঘুম হয়নি বলে প্রথম দিন ঘুমিয়েই কাটালাম। তারপর থেকে দু-এক ঘণ্টা ব্ৰহ্মকুণ্ডে ঘোরাঘুরি ছাড়া বাকি সব সময় ধর্মশালায় নিজের ঘরেই থাকতাম।

সারাদিন ঘরে বসে কী করতেন?

আমার ঝোলার মধ্যে সঞ্চয়িতা ছিল। সারাদিন আপন মনে কবিতা পড়তাম। কখনও জোরে জোরে, কখনও মনে মনে।

তারপর?

দু-একদিন পরে দুপুরের পর হঠাৎ এক ভদ্রমহিলা পাঁচ-ছ বছরের একটি ছেলের হাত ধরে নবেন্দুবাবুর ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু বলবেন?

ভদ্রমহিলা পরিষ্কার বাংলায় বললেন, না এমনিই এলাম।

নবেন্দুবাবু ওর হাতে শাখা, সিঁথিতে সিঁদুর না দেখে ভেবেছিলেন উনি গুজরাতি। তাছাড়া পরনে সাদা শাড়ি। তাই একটু অবাক হয়েই বললেন, আপনি বাঙালি?

হ্যাঁ।

নবেন্দুবাবু বিছানা থেকে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন, আসুন। তারপর ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার ছেলেটি তো ভারি সুন্দর।

ও আমার ভাইপো।

ও! এবার নবেন্দুবাবু শতরঞ্চিটা বিছিয়ে দিয়ে বললেন, বসুন।

ওরা শতরঞ্চিতে বসতেই নবেন্দুবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা বুঝি দল বেঁধে বেরিয়েছেন?

না, দাদা-বৌদির সঙ্গে এসেছি।

দাদা বৌদিকেও ডাক দিন।

ওরা আজ হৃষিকেশ গেলেন। কাল ওখান থেকে কেদার বদ্রী রওনা হবেন।

আপনি গেলেন না?

ভদ্রমহিলা একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, বিধবা বোনকে হরিদ্বার পর্যন্ত এনেছে, আর কত ঘোরাবে?

নবেন্দুবাবু চমকে উঠলেন। তারপর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ভাইপোকে আপনি কাছেই রেখে দিলেন?

হ্যাঁ, ও আমার কাছেই সব সময় থাকে।

সব সময় মানে?

ভদ্রমহিলা আবার একটু হাসেন। বলেন, আমার বৌদিও চাকরি করেন; তাছাড়া একটু বেশি ঘোরাঘুরি পছন্দ করেন।

এবার নবেন্দুবাবুও একটু হেসে বলেন, বুঝেছি।

ভদ্রমহিলাও হাসেন। বলেন, শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজের চেহারাটা বদলালেও চরিত্রটা বদলায়নি। যাক, আমার কথা বাদ দিন। আপনার কথা বলুন।

কী জানতে চান বলুন।

হরিদ্বারে কেন এলেন?

তীর্থস্থানে কেন এসেছি; তাও বলতে হবে?

আপনি তো তীর্থ করতে আসেননি। সারাদিন তো ঘরের মধ্যে শুয়ে বসে আবৃত্তি করেই কাটিয়ে দিচ্ছেন।

কোনোমতে কিছু সময় কাটাবার জন্যই এখানে এসেছি। তা আপনি কি করে দিন কাটাচ্ছেন।

গঙ্গস্নান, রান্নাবান্না, দিবানিদ্রা, গঙ্গারতি…

আপনি রোজ গঙ্গায় স্নান করেন?

হ্যাঁ। আপনি গঙ্গায় স্নান করেননি?

না। কেন, হরিদ্বারে এলেই বুঝি গঙ্গাস্নান করতে হয়?

তা নয়, তবে এখানকার গঙ্গায় স্নান করার একটা আলাদা আনন্দ আছে।

তাই নাকি?

নিশ্চয়ই। এবার ভদ্রমহিলা একটু হেসে বললেন, কাল কালে আপনাকে গঙ্গায় নিয়ে যাব। দেখবেন, স্নান করে কি আরাম।

নবেন্দুবাবু হাসেন। কিছু বলেন না।

ভদ্রমহিলা এবার বললেন, আমাদের এই ধর্মশালা থেকে গঙ্গা এত কাছে যে আমার তো মনে হয়, সময় পেলেই গঙ্গায় স্নান করে আসি।

গঙ্গাস্নান করতে আপনার এত ভালো লাগে?

গঙ্গাস্নান করতে ভালো লাগে না; তবে এখনাকার গঙ্গায় স্নান করতে সত্যি ভালো লাগে।

আমি হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, পরদিন গঙ্গায় স্নান করেছিলেন?

নবেন্দুবাবু হেসে বললেন, পরদিন ভোরবেলায় উমা যখন ডাকল, তখন আর না করতে পারলাম না।

গঙ্গাস্নান করে কেমন লাগল?

নবেন্দুবাবু আমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললেন, গঙ্গাস্নান করে সারা শরীরটা জুড়িয়ে গেল ঠিকই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উমাকে দেখে আমার সারা শরীরে আবার আগুন জ্বলে উঠল।

কেন?

ওখানে মেয়ে পুরুষের স্নান করার কোনো আলাদা ঘাট নেই।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, নবেন্দুবাবু একটু থামলেন; যেন হরিদ্বারের গঙ্গাস্নানের দৃশ্যটা একবার ভালো করে মনে করে নিলেন। তারপর বললেন, উমা ভাইপোকে স্নান করিয়ে আমার পাশেই স্নান করতে নামল। তারপর স্নান করে দুজনেই একসঙ্গে উঠলাম।

প্রশ্ন করলাম, তারপর?

ভেজা কাপড়ে ওকে দেখেই আমি চমকে উঠলাম। তারপর ওই অবস্থায় ওর পাশাপাশি ধর্মশালা পর্যন্ত আসতে আসতে…

উনি কাপড় বদলে নিলেন না কেন?

ঘাটের ওপর অত লোকের সামনে ও কাপড় বদলাতো না। গায়ে একটা গামছা জড়িয়ে ধর্মশালায় এসেই…।

তারপর বুঝি গঙ্গাস্নানের ব্যাপারে আপনিও খুব উৎসাহী হয়ে উঠলেন?

শুধু গঙ্গাস্নানের ব্যাপারে নয়, সব ব্যাপারেই অত্যন্ত উৎসাহী হয়ে উঠলাম।

নবেন্দুবাবুর কথায় কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও প্রশ্ন করলাম, সব কিছু ব্যাপারে মানে?

উনি একটু হেসে বললেন, উমার দাদা-বৌদি কেদার-বদ্রী ঘুরে আসার আগেই আমাদের নাটক জমে উঠল।

আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাতেই উনি বললেন অবাক হচ্ছ কেন? যে বাঘ একবার মানুষের রক্তের স্বাদ পেয়েছে, সে কী এমন শিকার ছেড়ে দিতে পারে?

কিন্তু বাঘিনী?

তার অবস্থাও তো আমারই মতো।…

কিন্তু…

উনি একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন, জোয়ারের জলে ওসব কিন্তু কোথায় যে চলে গেল, তা কেউই টের পেলাম না।

নবেন্দুবাবু এবার চুপ করে যান। কিছু বলেন না। বেশ কিছুক্ষণ পরে আমি প্রশ্ন করলাম, কী হল? চুপ করে গেলেন কেন? তারপর কী হল?

উনি খুব জোরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। শুধু জেনে রাখ, সত্যি আমি উমাকে ভালোবেসেছিলাম। আমি চেয়েছিলাম, ও নতুন করে বেঁচে উঠুক, কিন্তু  ও কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি হল না।

কেন?

বিধবা হবার পর বিয়ে করার জন্য মনের যে জোর চাই, তা ওর ছিল না।

আমি আর কোনো প্রশ্ন করি না। চুপ করে থাকি।

নবেন্দুবাবু বললেন, উমা বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় মনে হল, এ তো আরেক শিখারাণী। পর পর দুবার আঘাত পেয়ে আমিও ওদের মতো ব্যাভিচারী হয়ে উঠলাম।

এবারও আমি কোনো প্রশ্ন করি না।

উনি বললেন, তুমি বিশ্বাস কর কবিতা, ওদের দুজনের নোংরামির জন্যই আমিও নোংরা হয়ে গেলাম। এখন এতই খারাপ হয়ে গেছি যে আর ভালো হতে ইচ্ছা করে না। বোধহয় সম্ভব নয়।

জানো রিপোর্টার, নবেন্দুবাবু দেশে ফিরে যাবার দিন ওরলি এয়ারপোর্টে আমাকে বলেছিলেন, কবিতা, তোমার কাছেই প্রথম হেরে গেলাম, কিন্তু তবু মনে কোনো অতৃপ্তি নিয়ে দেশে ফিরছি না। জীবনে যে কোনো প্রয়োজনের দিনে আমাকে মনে করলে আমি সত্যি খুশি হব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *