১০. বিদেশের মাটিতে পা দিয়েই

বিদেশের মাটিতে পা দিয়েই এমন একজন সহৃদয় মানুষের দেখা পাব, তা কল্পনাও করিনি।

হ্যামস্টেড-এ ওঁর আস্তানায় ঢুকতেই ডক্টর সরকার আমাকে বললেন, ট্রিট দিস হাউস অ্যাজ ইওর ওন।

আমি শুধু একটু হাসি।

হাসি নয়। আজ থেকে এ সংসার তোমার, আমি তোমার প্রজা।

চা খেয়েই উনি সবকিছু আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, সারা জীবন একলা থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছি। এখন মনে হয়, কেউ যদি আমার ওপর খবরদারি করত, তাহলে খুব ভালো লাগত।

কথাটা শুনেই আমি একটু আনমনা হয়ে গেলাম।

ডক্টর সরকার বললেন, যৌবনে বা প্রৌঢ় অবস্থায় নিঃসঙ্গ থাকা যায় কিন্তু বাধকে নিঃসঙ্গ থাকা সত্যিই অসহ্য।

এবার আমি বললাম, কোনো আত্মীয়স্বজনকে কাছে রাখেন না কেন?

আত্মীয়। ডক্টর সরকার যেন চমকে উঠলেন। তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, আগে দু-একজন আত্মীয় ছিলেন, এখন আর কোনো আত্মীয় নেই।

আমি একটু এগিয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বললাম, হতাশ হবেন না, আমিও আপনার দলে।

উনি হঠাৎ ঘুরে বসে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, আমিও এই রকমই আশা করছিলাম।

.

লন্ডনের জীবন বেশ ভালোভাবেই শুরু হল। ডক্টর সরকারের ফ্ল্যাটে তিনখানি ছোট বড় ঘর। কোটি ড্রইংরুম আর কোনটি বেডরুম, তা বোঝা যায় না। সব ঘরেই হাজার হাজার বই। তিনটি ঘরেই ডিভান আছে। পড়াশুনা করতে করতে ক্লান্ত হলেই যে কোনো ঘরে ঘুমানো যায়। কাগজ কলম আর চশমা যত্রযত্র ছড়িয়ে রয়েছে। আছে আরও অনেক কিছু। তার মধ্যে সবার আগে চোখে পড়ল ফ্রেঞ্চ ওয়াইন আর মার্টিনীর খালি বোতল। বুঝলাম, এই বোতলগুলো শূন্য করে ডক্টর সরকার তার মন পূর্ণ করার চেষ্টা করেন।

সন্ধের দিকে ডক্টর সরকার আমাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হ্যামস্টেড হিথ গেলেন। পাহাড়ের ওপর থেকে এমন সুন্দর বাগান দেখে খুব ভালো লাগল। ভেবেছিলাম আরো কিছুক্ষণ কাটাব কিন্তু উনি বললেন, চল, ওয়েল ওয়াক ঘুরে বাড়ি যাই।

ওয়েল ওয়াক! নাম শুনে কিছুই বুঝলাম না। চুপচাপ ওর সঙ্গে চলোম, হ্যামস্টেড হাই স্ট্রিটের কাছেই ওয়েল ওয়াক।

হঠাৎ ডক্টর সরকার আমাকে প্রশ্ন করলেন, বিখ্যাত কবি কীটস্ এর নাম নিশ্চয়ই শুনেছ?

হ্যাঁ।

উনি এখানে অনেক দিন ছিলেন।

আমি অবাক হয়ে চারদিক দেখি।

ডক্টর সরকার ডানদিকে হাত দেখিয়ে বললেন, ওদিকে খানিকটা গেলেই ওয়েস্ট ওয়ার্থ প্লেস। ওর বাগানে বসেই কীটস তার বিখ্যাত কবিতা ODE TO A NIGHTINGALE লিখেছিলেন।

তাই নাকি?

ডক্টর সরকার আপন মনে আবৃত্তি শুরু করেন,

My heart aches, and a drowsy numbness pains
My sense, as though of hemlock I had drunk,
or emptied some dull opiate to the drains
one minute past, and Le the-wards had sunk…

মনে পড়ে কবিতাটা?

মনে পড়ে তবে আপনার মতো মুখস্ত নেই।

আরেকটা কবিতার লাইন মনে পড়ছে।

A thing of beauty is a joy for ever;
Its loveliness increases; it will never
Pass into no thingness; but still will keep
A bower quiet for us, and a sleep
Full of sweet dreams, and health, and…

ওকে কবিতাটা শেষ করতে না দিয়েই বললাম, আমরা আজকালকার ছেলেমেয়েরা অত মুখস্থ করতে পারি না।

তোমরা যা পারো, তা আমরা পারি না।
আপনাকে দেখে মনে হয়, আপনি সবই পারেন।
বাহির হইতে দেখো না এমন করে,
আমায় দেখোনা বাহিরে।
আমায় পাবে না আমার দুঃখে ও সুখে,
আমার বেদনা খুঁজো না আমার বুকে
আমায় দেখিতে পাবে না আমার মুখে…

রবীন্দ্রনাথও আপনার মুখস্ত?

ওই সমুদ্র কি পাড়ি দেওয়া সম্ভব? তবে মাঝে মাঝে ওই সমুদ্রে স্নান করি।

বাড়িতে ফিরে এসে ডক্টর সরকার এক বোতল ফ্রেঞ্চ ওয়াইন নিয়ে বসলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাকে কি অফার করতে পারি?

আমি হেসে বললাম, প্রয়োজন নেই।

এবার উনি হেসে বললেন, এসব সময় সাহচর্য পেলে অনেক বেশি আনন্দ হয়।

আমি তো আপনার সামনেই বসে আছি।

নো, নো, নট দ্যাট…

আপনি ড্রিঙ্ক করুন। আমি গল্প করছি।

এটা হুইস্কি নয়, ফ্রেঞ্চ ওয়াইন। তোমার ভয় পাবার কোনো কারণ নেই।

আমার মতো বাঙালি মেয়ের কাছে দুইই সমান।

প্লিজ ডোন্ট সে দ্যাট। ফ্রেঞ্চ ওয়াইন হচ্ছে শরতের মেঘ; কোনো গ্লানি নেই, মালিন্য নেই, অহঙ্কার নেই। কালিদাসের মেঘদূতের মতো সে স্বচ্ছ প্রবাহিনী। আর হুইস্কি হচ্ছে…

শ্রাবণধারা!

ইয়েস, ইয়েস। যেমন গর্জন, তেমন বর্ষণ!

ডক্টর সরকার বোতল থেকে অমৃতধারা দুটি গেলাসে ঢালতে ঢালতে বললেন, যখন বিদেশে এসেছ, তখন একটু আধটু অভ্যেস থাকা ভালো।

চিয়ার্স!

চিয়ার্স।

গেলাসে এক চুমুক দিয়েই উনি আমাকে বললেন, তোমার কোনো ক্ষতি করার জন্য তোমাকে ওয়াইন খেতে দিলাম না।…

না, না, ও কথা আপনি বলবেন না।

তুমি সুন্দরী, শিক্ষিতা ও সর্বোপরি যুবতী। বেশি সহজ সরল হলে বোধহয় তোমার ক্ষতি হবে। তাই…

কিন্তু শুনেছি আমাদের দেশের চাইতে এসব দেশে আমার মতো মেয়ের পক্ষে একলা থাকা অনেক ভালো।

অনেক দিক থেকে ভালো হলেও কে যেন কোনো অসতর্ক মুহূর্তে তোমার ক্ষতি করবে, তা বলা মুশকিল।

আমি চুপ করে শুনি। ডক্টর সরকার একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, এখানে সবাই সম্পদ আর সম্ভোগের নেশায় মশগুল। এমন কি আমাদের দেশের মানুষও এখানে শুধু উপভোগ করতে চায়।

আমি এবারও কোনো কথা বলি না। উনি এক চুমুকে গেলাস খালি করে দিয়ে বললেন, দেখো মা, আজ তোমার বিদেশ বাসের প্রথম দিন। তোমাকে তাই সাবধান করে দিচ্ছি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে কাউকে বিশ্বাস বা শ্রদ্ধা করো না।

এবার আমি বললাম, আপনি তো আছেন। আমার অত ভয় কী?

না, না, আমাকেও বিশ্বাস করো না। আজ না হোক, ভবিষ্যতে যে আমি তোমার ক্ষতি করব না, তা কে বলতে পারে?

অসম্ভব!

আবার গেলাস ভর্তি করে নিয়ে ডক্টর সরকার রুক্ষভাবে বললেন, অসম্ভব!

আমি আবার জোর করে বললাম, একশোবার অসম্ভব।

হাতের গেলাসটা নামিয়ে রেখে ম্লান মুখে বললেন, না, না, অসম্ভব না। মানুষ যে কখন। পশু হয়ে যায়, তা কেউ বলতে পারে না।

এবার আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আমাকে দেখে কী খুব সাধু বলে মনে হয়?

আমি হাসতে হাসতে বললাম, সাধু বলে কেন মনে হবে? মনে হয়, আপনি একজন শিক্ষিত আদর্শবান মানুষ।

রাইট ইউ আর। সবাই তাই ভাবে, কিন্তু আমি তো জানি আমি কি রকম আদর্শবান।

তার মানে?

এককালে কত ছাত্রীকে যে উপভোগ করেছি…

সত্যি?

তোমাকে যখন মা বলে ডেকেছি, তখন তোমাকে মিথ্যা বলব না। তাইতো বলছিলাম, বাহির হইতে দেখো না এমন করে, আমায় দেখো না বাহিরে।

আমি একটু চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞাসা করলাম, আমিও তো কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি কিন্তু…

না, না, তারা নয়। যেসব ছাত্রীরা অধ্যাপনা করত বা আমার আন্ডারে রিসার্চ করত, তারা অনেকেই এই ব্যাচেলার অধ্যাপককে নিয়ে এমন মাতামাতি করত যে আমি নিজেকে সংযত রাখতে পারতাম না।

কী আশ্চর্য!

আবার আশ্চর্য হচ্ছ? এই পৃথিবীতে কোনো কিছুতেই আশ্চর্য হবে না। আমরা যাদের বেশি ভালো মনে করি, তারা যে কত খারাপ, তা ভাবা যায় না। আবার যাদের অত্যন্ত খারাপ ভাবি, তারা যে কত মহৎ হতে পারে, তা আমরা কল্পনাই করতে পারি না।

আমার গেলাস তখনও খালি হয়নি। আমার গেলাসের দিকে নজর পড়তেই উনি প্রশ্ন করলেন, একি! এখনও শেষ করোনি? চটপট শেষ করে নাও।

ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?

আরেক রাউন্ড নেবে তো।

না, না, আমি আর নেব না।

তাই কি হয় মা? বুড়ো ছেলের অনুরোধ মাকে শুনতে হয়।

আমার লন্ডনবাসের প্রথম সন্ধ্যায় ওই বুড়ো ছেলের অনুরোধে আমাকে গেলাসের পর গেলাস ফ্রেঞ্চ ওয়াইন খেতে হয়েছিল। উনিও খেয়েছিলেন। আর খেতে খেতে বলেছিলেন। ওর নিজের কথা।

ডক্টর সরকার বাংলাদেশের এক বিখ্যাত জমিদার বাড়ির ছেলে। আজকের কথা নয়, প্রায় একশো বছর আগে ওদের জমিদারির আয় ছিল সাড়ে তিন লাখ টাকা। আর বড় জমিদার বাড়ির ছেলে হয়েও ডক্টর সরকারের বাবা জমিজমা বিষয় সম্পত্তির ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন না। উনি পড়াশুনাই বেশি পছন্দ করতেন। অর্থের চিন্তা ছিল না বলে উনি কলকাতার বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করতেন এবং একে একে ইংরেজি, সংস্কৃত ও দর্শন শাস্ত্র নিয়ে তিনটি এম. এ. পাশ করেন!

শুনেই আমি চমকে উঠি, বলেন কী?

ডক্টর সরকার একটু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বলেন, বাবা সত্যি পড়াশুনা ভালোবাসেন। ওকে কোনোদিন তাস-পাশা খেলতে বা আড্ডা দিতে দেখিনি।

শুনেছি, কিছু কিছু জমিদার লেখাপড়া গানবাজনা নিয়েই জীবন কাটাতেন…

আমার মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে উনি বললেন, আর কিছু কিছু জমিদার মদ-মেয়েছেলে নিয়েই জীবন কাটাতেন।

হ্যাঁ, সেইরকমই শুনেছি।

আমার ঠাকুর্দা এই দ্বিতীয় ধরনের জমিদার ছিলেন।

আমি হাসি।

হাসছ? আমার ঠাকুর্দার কজন রক্ষিতা ছিল জানো? দশ-বারোজন।

আমি আবার হাসি। উনিও হাসতে হাসতে বলেন, ঠাকুর্দার দুজন রক্ষিতা আমাদের বাড়িতেই থাকতেন এবং আমার ছেলেবেলায় তাদের রাঙা ঠাকুমা আর গোলাপি ঠাকুমা বলে ডাকতাম।

আপনার আসল ঠাকুমা আপত্তি করতেন না?

না; কারণ সব জমিদার বাড়িতেই এ সব অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার ছিল।

আপনার বাবার মধ্যে তো এসব দোষ ছিল না।

একেবারেই না।

ডক্টর সরকার একবার মুহূর্তের জন্য কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, কিন্তু আমার মা বিশেষ ভালো ছিলেন না।

তার মানে?

তিনিও তো জমিদার বাড়ির মেয়ে ছিলেন। তাই আত্মভোলা পণ্ডিত স্বামী পেয়ে তিনি সুখী হতে পারেননি। আমার এক দূর সম্পর্কের কাকা আর এক ম্যানেজারবাবুর সঙ্গেই…

বলেন কি?

হ্যাঁ, মা, ঠিকই বলছি। তাছাড়া মা ড্রিঙ্ক না করে থাকতে পারতেন না।

এসব কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বললাম, আমাদের পক্ষে প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়।

বিশ্বাস কর মা, আমি এক বর্ণও মিথ্যা বলছি না।

না, না, আমি তা বলছি না।

আমাকে দেখতে ঠিক আমার বাবার মতো। যদি খুঁজে পাই তাহলে তোমাকে একটা অ্যালবাম দেখাবো। দেখবে, আমার আর বাবার চেহারায় বিন্দুমাত্র অমিল নেই।

তাই নাকি?

উনি আমার প্রশ্ন না শুনেই বললেন, আমার অন্য দুই ভাইকে দেখলেই বোঝা যাবে, তারা আমার বাবার সন্তান নয়।

আমি আর কোনো প্রশ্ন করি না, মন্তব্যও করি না।

এবার উনি হাসতে হাসতে বললেন, আমার চরিত্রের দশ আনা বাবার মতো আর দু আনা মায়ের মতো। লেখাপড়াও করেছি, জীবন উপভোগও করেছি।

বিয়ে করলেন না কেন?

ওই মায়ের সন্তান হয়ে বিয়ে করলেও কী সুখী হতে পারতাম?

বেশ কিছুক্ষণ কেউই কোনো কথা বললাম না। তারপর ডক্টর সরকারই বললেন, এয়ারপোর্টে তোমাকে দেখেই মা বলে কেন ডাকলাম, তা জানো?

কেন? বয়সে সন্তানতুল্যা বলে?

না। মনে হল তোমার মতো স্নিগ্ধ শান্ত একটা মেয়ে যদি আমার মা হতো, তাহলে বেশ হতো।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, এবার যদি আমি বলি, বাহির হইতে দেখো না এমন করে, আমায় দেখোনা বাহিরে।

আমার কথা শুনে উনিও হাসলেন। বললেন, তা বলতে পারো। তবে তোমাকে দেখেই মনে হয়, তোমার মধ্যে কোনো গ্লানি নেই, মালিন্য নেই।

যা দেখে মনে হয়, তাই কি ঠিক?

আমার মন বলছে, তুমি বড় পবিত্র। তাই তো তোমাকে মা বলে ডাকছি।

আমি মুখ নীচু করে চুপচাপ বসে রইলাম। কিছুতেই বলতে পারলাম না, আপনার সব ধারণা ভুল, সব মিথ্যা। আমি ভালো নই। আমি দিনের পর দিন মদ্য পান করেছি, অবিবাহিতা হয়েও রাতের পর রাত একজন পুরুষের কামনা-বাসনার আগুনে নিজেকে স্বেচ্ছায় আহুতি দিয়েছি।

ভাই রিপোর্টার, সত্যি কথা বলা যে এত কঠিন, তা এর আগে জানতাম না। এই পৃথিবীর সব মানুষ সব সময় নিজেকে মহৎ বলে প্রচার করতে চায় কিন্তু প্রত্যেক মানুষের জীবনেই এমন একটা সময় আসে, যখন যে জীবনের নিভৃততম গোপন কথা প্রাণপ্রিয় কাউকে বলতে চায়। তুমি আমার সেই প্রাণপ্রিয় ভাই ও বন্ধু। তাই না?

.

পরের দিন অনেক বেলায় দুজনের ঘুম ভাঙল। আমি আমার ঘর থেকে বেরুতেই ডক্টর সরকার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি মা, নতুন দেশে নতুন ছেলের বাড়িতে এসে ঘুম হয়েছিল তো?

সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠেই এমন মিষ্টি সম্বোধনে আমার মন প্রাণ পরিপূর্ণ হয়ে গেল। হেসে বললাম, ছেলের বাড়িতে এসেও মার ঘুম হবে না?

ডক্টর সরকার দু এক পা এগিয়ে এসে আমার কপালে একটা চুমু খেয়ে বললেন, চপটপ তৈরি হয়ে নাও। তারপর ব্রেকফাস্ট খেয়েই বেরিয়ে পড়ব।

কোথায় যাবেন?

তোমাকে শহরটা দেখিয়ে দেব না?

আপনার কাজকর্মের ক্ষতি হবে না?

না, না, কিছু ক্ষতি হবে না।

ডক্টর সরকার হাতের ঘড়িটা দেখে বললেন, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বেরুতে পারলে আমরা বার্কিংহাম প্যালেসের চেঞ্জিং দ্য গার্ডস্ দেখতে পাব।

আমরা ঘন্টা খানেকের মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম। বাকিংহাম প্যালেসের সামনে যখন আমরা পৌঁছলাম তখন সওয়া এগারোটা। চেঞ্জিং দ্য গার্ডস সাড়ে এগারোটায় কিন্তু ইতিমধ্যেই বেশ ভীড় হয়েছে। অধিকাংশই ট্যুরিস্ট। কিছু ইংরেজ তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসেছেন। ছেলেবেলা থেকে যে বার্কিংহাম প্যালেসের গল্প শুনেছি, পড়েছি, তার সামনে এসে বেশ লাগল, কিন্তু আরো ভালো লাগল চারপাশের মানুষ দেখে। হাসি খুশিতে প্রত্যেকটা মানুষ যেন আমাকে মুগ্ধ করল। এদের কেউই অসাধারণ নয়, সবাই সাধারণ মধ্যবিত্ত। অনেকে দেশে প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা মানুষ দেখা তো দুর্লভ ব্যাপার। অনেকে হাসিঠাট্টা হৈ-হুঁল্লোড় করলেও তাদের। মুখ দেখলেই মনে হয় ওরা সবাই ক্লান্ত, শ্রান্ত, বোধহয় পরাজিতও। চেঞ্জিং দ্য গার্ডস খুব ভালো লাগল কিন্তু আরো বেশি ভালো লাগল এতগুলি হাসিখুশি ভরা মানুষ দেখে।

ডক্টর সরকার বললেন, রাজপ্রাসাদ হিসেবে বার্কিংহাম প্যালেস খুব বেশি পুরনো নয়।

আমি বললাম, কিন্তু এই বার্কিংহাম প্যালেস সম্পর্কে এত শুনেছি ও পড়েছি যে মনে হয়, এটা অনেক পুরনো।

রাজপ্রসাদ হিসেবে কুইন ভিক্টোরিয়াই এটা প্রথম ব্যবহার করেন; তবে খুব নিয়মিত নয়।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। সপ্তম এডওয়ার্ডই এটা প্রথম সব সময়ের জন্য ব্যবহার করেন।

আমাদের এখনকার রানি এলিজাবেথ দ্য সেকেন্ড তো এখানেই থাকেন?

হ্যাঁ, তবে রানি হবার পর তিন মাস পর্যন্ত উনি ক্লারেন্স হাউসে ছিলেন।

কনস্টিটিউশন হিল আর ওয়েলিংটন আর্চ ঘুরে গ্রীনপার্কের পাশ দিয়ে রিজ হোটেল আর ডিভনশায়ার হাউস দূরে রেখে আমরা ল্যাঙ্কাস্টার হাউসের সামনে এলাম। ওখানে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন চলছিল বলে ভিতরে যাওয়া হল না। ডক্টর সরকার বললেন, প্যালেসগুলো বাদ দিলে লন্ডনে এত সুন্দর বাড়ি নেই।

এখানে কে থাকেন?

এখন এটা সরকারি অতিথিশালা। কখনও কখনও এখানে ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স হয়।

ল্যাঙ্কাস্টার হাউসের পাশেই সেন্ট জেমস প্যালেস। ইতিহাসের পাতায় বার বার এর উল্লেখ।

এর পাশেই ক্লারেন্স হাউস।

ডক্টর সরকার বললেন, রানির মা কুইন এলিজাবেথ এখানেই থাকেন।

এবার উনি হঠাৎ হাসতে হাসতে বললেন, এভাবে যদি তোমাকে লন্ডন দেখাই তাহলে কতদিন লাগবে জানো?

কত?

মোটামুটি দু-তিন বছর।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, তাহলে আমার আর এ শহর দেখা হল না।

উনি খুব জোরের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, কেন? তুমি কি এখানে বেশি দিন থাকবে না?

আমার অদৃষ্টে কি এত সুখ, এত ভালোবাসা সহ্য হবে?

ডক্টর সরকার হাসতে হাসতে আমার হাতটা ধরে বললেন, এ তো মায়ের মতো কথা হল না।

ওর কথায় আমার গাম্ভীর্য, আনমনা ভাব কোথায় ভেসে যায়। হাসি। বলি, না, আর বলব না।

এবার উনি বললেন, আজ আর ঘুরব না। কিছু খেয়ে-দেয়ে মার্বেল আর্চের ধারে বসে গল্প করি।

সত্যি বলছি ভাই রিপোর্টার, একজন বৃদ্ধ মানুষের সান্নিধ্য সাহচর্য হাসিঠাট্টা যে এত মধুর ও সুখের হতে পারে, তা আগে জানতাম না।

যৌবনে বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের উপেক্ষা আর অনাদর করাই নিয়ম বলে জানতাম। আমাদের বয়সী একজন ছেলেমেয়েকেও কোনো বয়স্ক মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে দেখিনি। ওরা চৈত্রের ঝরাপাতার মতো উপেক্ষিত, কিন্তু এই বৃদ্ধ ডক্টর সরকারকে দেখে জানলাম পরিণত বয়সে পরিণত মনের সৌন্দর্য ও মনের মাধুর্য সত্যি অনন্য। ভোরের সূর্য আর অস্তগামী সূর্যের রূপই যুগ যুগ ধরে অজস্র সহস্র কোটি মানুষকে বিমুগ্ধ করে রেখেছে। এই সুর্যের আলোতেই তো আমরা সবাই আলোকিত, আমাদের জীবন শক্তির প্রধান। তাই বোধহয় শৈশব আর বার্ধক্যের রূপ এত সুন্দর, এত মনোরম।

আজ হঠাৎ আমাকে জরুরী কাজে টরন্টো যেতে হচ্ছে। তাই বড্ড ব্যস্ত কিন্তু তবু তোমাকে চিঠি না লিখে পারলাম না।

তোমরা দুজনে আমার প্রাণভরা ভালোবাসা নিও।

শ্রদ্ধেয়া দিদি,

তোমার চিঠিগুলো পড়তে সত্যি খুব ভালো লাগছে। প্রথম যখন তুমি জানালে, চিঠি লিখে আমাকে তোমার বিচিত্র জীবন কাহিনি জানাবে, তখন বিশেষ উৎসাহবোধ করিনি। তোমার চিঠিগুলোর মধ্য দিয়ে শুধু তোমার বিচিত্র জীবন কাহিনিই জানতে পারছি না, জানতে পারছি। মানুষের নানা রূপ। আরো কত কি।

তোমার প্রশংসা করার জন্য এ চিঠি লিখছি না। যে কালো মেয়েটা তোমাকে দেবতার মতো ভক্তি শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছে আর তোমার ধারণা যার জন্য আমার সব কল্যাণ ও শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে, সেই মেয়েটা হঠাৎ একটা এরোগ্রাম এনে বলল, দিদিকে একটা চিঠি লেখ।

আমি বললাম, এই তো দুতিন দিন আগে দুজনেই দিদিকে চিঠি দিলাম; আজ আবার লিখব কেন?

ও হাসতে হাসতে বলল, খুব জরুরী দরকার।

আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, জরুরী দরকার?

ও হঠাৎ হাসতে হাসতে আমার মুখোমুখি বসেই বলল, আচ্ছা, তুমি তো স্বীকার কর রূপে-গুণে স্বভাব চরিত্রে দিদির কোনো তুলনা হয় না।

আমি দুহাত দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে ঠাট্টা করে বললাম, সুন্দরী, তুমি আমার জীবনে এলে হয়তো তোমার এই দিদিকেই আমি…।

আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ও রাগে আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, এ ধরনের নোংরা কথা বললে আর কোনো দিন আমি তোমার কাছে আসব না।

দিদি, তুমি তো জানো, ওই কালো মেয়েটার বড় বেশি অভিমান। আর যখন অভিমান হয় তখন ওকে দেখতে আরও ভালো লাগে। আমি ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে আদর না করে পারি না। আজও তার ব্যতিক্রম হল না।

তারপর আমার কাঁধের ওপর মাথা রেখে চাপা গলায় বলল, আচ্ছা, দিদি তো এত কথা লিখছেন কিন্তু কোনোদিন কাউকে ভালোবেসেছেন কিনা তা তো লিখছেন না।

আমি তোমাকে সমর্থন করার জন্য বললাম, দিদি হয়তো কাউকে ভালোবাসেনি।

ও সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করল, অসম্ভব।

অসম্ভব কেন?

তুমি পুরুষ। মেয়েদের মনের কথা তুমি বুঝবে না। সব মেয়েই চায় তাকে কেউ ভালোবাসুক, আদর করুক। কোনো একজন পুরুষের কাছে সে অনন্যা হতে চায়।

তুমি চাও?

ও একটু শুকনো হাসি হেসে বলল, চাই না বলেই তো সমাজ সংসার উপেক্ষা করে নিজেকে এভাবে বিলিয়ে দিয়েছি।

তোমাকে যখন দিদি বলে ডাকি, শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি, তখন আমাদের প্রেম, ভালোবাসার বিশদ বিবরণ তোমাকে না জানানোই উচিত।

যাই হোক, সুন্দরী জানতে চায় তুমি কাকে ভালোবেসেছিলে? কেন তাকে বিয়ে করলে? সবকিছু জানাবে; তা নয়তো ওর মন ভরবে না আর আমাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে পাগল করে তুলবে।

আমি ওকে বলেছিলাম, তুমিই দিদিকে লেখ।

ও বললে, না, আমি এসব কথা দিদিকে লিখতে পারব না। তুমিই লেখ।

দিদি, তুমি তো জানো, আমি ওর কথায় কুতব মিনারের ওপর থেকে লাফ দিতে পারি। তাই ওর কথা মতো এই চিঠি লিখছি। রাগ করো না।

আমাদের দুজনের সশ্রদ্ধ প্রণাম নিও।

-তোমার রিপোর্টার ভাই

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *