০৯. হঠাৎ একটা পুরনো দিনের কথা

হঠাৎ একটা পুরনো দিনের কথা মনে পড়ল। তখন সবে স্কুলে ছেড়ে কলেজে ঢুকেছি। একটু আধটু স্বাধীনতা আর নতুন বন্ধুদের নিয়ে বেশ আনন্দে দিন কাটছে। কারণে অকারণে হাসি, অহেতুক ঘুরে বেড়াই, অপরিচিতকেও পরিচিত মনে হয়। একদিন তিন-চারজন বন্ধু প্রায় জোর করেই শিখা সরকারের বাড়ি নিয়ে গেল। ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম, শিখার কাকুর কাছে ওরা হাত দেখাতে এসেছে।

এসব ব্যাপারে কোনো কালেই আমার আগ্রহ ছিল না কিন্তু সবার শেষে কাকুর কাছে হাত এগিয়ে দিলাম।

আমার বেশ মনে আছে, আমার হাতের ওপর দিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েই উনি আপন মনে বললেন, ভারি অদ্ভুত হাত!

আমরা কেউ কিছু প্রশ্ন করার আগেই শিখা জিজ্ঞাসা করল, অদ্ভুত হাত মানে?

কাকু গম্ভীর হয়ে বললেন, এ রকম অদ্ভুত হাত খুব কম মেয়ের হয়।

শিখা একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, যা বলতে যাও, সোজাসুজি বল।

কাকু মুখ নীচু করে আমার হাত দেখতে দেখতে বললেন, তোদর সামনে বলব না। তবে তোরা জেনে রাখ, এ সবদিক থেকেই তোদর হারিয়ে দেবে।

একটা অদ্ভুত অস্বস্তি নিয়েই ফিরে এলাম এবং প্রয়োজন হলেও শিখার বাড়ি যেতাম না। বছর দুই পরে কি একটা জরুরি কারণে ওর বাড়ি গিয়ে দেখি কাকু ছাড়া আর কেউ নেই। বাধ্য হয়ে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করেছিলাম।

সেদিন কাকু আমাকে দেখেই হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছ?

ভালো। আপনি?

আমি খুব ভালো আছি। তোমাকে এতদিন দেখিনি কেন?

ঠিক আসা হয়ে ওঠেনি।

কাকু এবার আর কোনো ভূমিকা না করে বললেন, দেখি তোমার হাতটা।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাত এগিয়ে দিলাম। একটা নয়, আমার দুটো হাতই অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে দেখার পর কাকু বললেন, তোমাকে দু-চারটে কথা বলছি বলে কিছু মনে করো না।

কাকুর কথায় বেশ আন্তরিকতার স্বাদ পেয়ে বললাম, না, না, কি মনে করব।

সবচাইতে বড় কথা, তুমি কাউকে হাত দেখাবে না।

কেন?

তোমার জীবনের সব কথাই তোমার হাতে লেখা আছে। এসব কথা অন্য কারুর না জানাই ভালো।

আমি চুপ করে আছি। কাকু আপন মনে আমার হাত দেখছেন। কত কি ভাবছেন। বোধহয় মনে মনে নানারকম হিসাব নিকাশ করছেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, তুমি জীবনে অনেক উন্নতি করবে।…

উনি কথাটা বলতে না বলতেই আমি হাসি।

না, না, কবিতা, হাসির কথা নয়। তোমার অধিকাংশ বন্ধুদের চাইতে তুমি অনেক বেশি লেখাপড়া করবে। চাকরি-বাকরিতে এমন উন্নতি করবে যে…

আমি চাকরি করব?

নিশ্চয়ই করবে এবং তোমার কর্মজীবন বিদেশেই কাটবে।

আমি অবিশ্বাসের হাসি হেসে বলি, বিদেশে!

উনি যথেষ্ট আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে জবাব দিলেন, তুমি বহু দুর দেশে জীবন কাটাবে এবং আজ এ কথাও বলে দিচ্ছি যে, হঠাৎ এমন একজন পরম শুভাকাক্ষীর সঙ্গে তোমার দেখা হবে, যার ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টাতেই তুমি বিদেশ যাবে।

আমি একটু হেসে বললাম, এখন তো এসব কথা আমার কল্পনার বাইরে।

তোমার জীবনে বারবার এমন ঘটনা ঘটবে বা তুমি স্বপ্নেও ভাববে না।

যেমন?

কিছু মনে করবে না?

না।

যেসব কথা বলব, তা নিজের মধ্যে চেপে রাখতে পারবে?

নিশ্চয়ই পারব।

শিখা বা অন্য কোনো বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনকেও বলতে পারবে না।

না, কাউকে বলব না।

বারবার তোমাকে বহু পুরুষের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আসতে হবে।

তার মানে?

এর চাইতে বেশি পরিষ্কার করে বলার সময় এখনও আসেনি।

আমি চুপ করে ভাবি।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর কাকু বললেন, তবে তুমি হেরে যাবার মেয়ে নও। যাই হোক না কেন, তুমি এগিয়ে যাবেই।

মেয়েদের পক্ষে কি বেশি এগিয়ে যাওয়া সম্ভব?

অধিকাংশ মেয়েদের পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু তুমি অনেক দূর এগোবে।

কাকু, একটা প্রশ্ন করব? নিশ্চয়ই করবে।

আমাকে কি বিয়ে করতে হবে?

কেন, তুমি কি বিয়ে করতে চাও না?

না।

মনে হয় না তুমি বিয়ে করবে। আর বিয়ে করলেও অনেক পরে করবে।

.

এই কাকুর কথা আমি প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম। অমিয় যখন আমার বিদেশ যাত্রার সবকিছু ঠিক করল, তখন হঠাৎ কাকুর কথা মনে পড়ল। কাকুর কথাগুলো মনে মনে রোমন্থন করে দেখলাম, ওর প্রতিটি কথাই আমার জীবনে বর্ণে বর্ণে মিলে গেছে।

.

কলেজ ছাড়ার পর শিখার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। ওদের বাড়ির ঠিকানাটাও ভুলে গিয়েছিলাম। তিন-চারদিন নানা জায়গায় ঘোরাঘুরির পর শিখাদের বাড়ির ঠিকানা পেলাম তারপর সেখানে গিয়ে দেখি কাকু নেই। ওখান থেকে বারাসতের ঠিকানা নিয়ে আমি কাকুর কাছে হাজির হলাম।

প্রথমে উনি আমাকে চিনতে পারেননি। পরিচয় দিতে উনি তো অবাক! কাকু ও কাকিমা খুব আদর যত্ন করে খাওয়ালেন। তারপর কাকুকে একলা পেয়ে বললাম, আপনার অনেক কথাই মিলে গেছে।

কাকু বললেন, তখন তো তুমি ছোট ছিলে; তাই সব কথা বলতেও পারিনি।

আমি কোনো কথা না বলে হাত এগিয়ে দিলাম।

দু-তিন মিনিট ধরে আমার দুটো হাত খুব ভালোভাবে দেখে উনি জিজ্ঞাসা করলেন, নিশ্চয়ই অনেক পড়াশুনা করেছ?

এম. এ. পাশ করার পর রিসার্চ করেছি।

ডক্টরেট হয়েছ?

হ্যাঁ।

এবার তো তোমার বিদেশ যাওয়া উচিত।

সামনের সপ্তাহের শেষের দিকে লন্ডন যাচ্ছি।

কাকু আপন মনে হেসে বললেন, যেতেই হবে। কিন্তু…

কিন্তু কি?

খুব বেশি দিন ওখানে থাকবে না।

দেশে ফিরে আসব?

না, না। অন্য কোথাও চলে যাবে!

এবার আমি নিজের থেকেই বললাম, আপনি বলেছিলেন হঠাৎ এক শুভাকাক্ষীর চেষ্টাতেই আমি বিদেশ যাব। ঠিক তা-ই হল।

কাকু আমার কথার জবাব না দিয়ে বললেন, ইতিমধ্যে তোমার জীবনে একটা গুরুতর ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হয়।

হ্যাঁ কাকু, ঘটেছে।

এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটবে।

আমি চমকে উঠে বললাম, আরো ঘটবে?

তখন তুমি ছোট ছিলে বলে এসব কথা বলিনি কিন্তু এখন তুমি বড় হয়েছ, অনেক লেখাপড়া করেছ বলে সাবধান করে দিচ্ছি।

কাকুর কথাটা শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। উনি তা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তবে তুমি জীবনে খুব নিকৃষ্ট লোকের সান্নিধ্যে আসবে না কিন্তু, এরা প্রত্যেকেই তোমার কিছু কিছু উপকার করবেন।

এবার আমি বেশ গম্ভীর হয়েই বললাম, নিজেকে বিলিয়ে দিলে তো অনেক পুরুষই উপকার করবে।

না, না, তুমি নিজেকে বিলিয়ে দেবে না, কিন্তু ঘটনাচক্রে এ সব ঘটবেই। তুমি শত চেষ্টা করেও এদের হাত থেকে রেহাই পাবে না।

যদি বিয়ে করি?

কাকু অনেকক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করে বললেন, চট করে তুমি বিয়ে করবে না।

এবার আমি প্রশ্ন করি, আমার বিদেশ যাওয়া কি উচিত হবে?

তোমাকে যেতেই হবে। শুধু বিদেশে যাওয়া নয়, প্রায় সারা কর্ম-জীবনই বিদেশে থাকবে।

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললাম, কাকু, আমাকে কি সারা জীবনই এই সব গ্লানির বোঝ বইতে হবে?

কাকু একটু হেসে বললেন, বিদ্যা বুদ্ধি অর্থ প্রতিপত্তি বিদেশ ভ্রমণ যেমন উপভোগ করবে, তেমনি সঙ্গে সঙ্গে দুচারটে ঘটনাও ঘটবে। তার জন্য দুঃখ করছ কেন?

একটু চুপ করে থেকে উনি আবার বললেন, কোনো মানুষের জীবনই সরলরেখা নয়।

.

স্বয়ং ডক্টর সরকারই আমাকে লণ্ডন এয়ারপোর্টে অভ্যর্থনা করলেন। কাস্টমস্ এনক্লোজারের বাইরে এসে ওঁকে প্রণাম করতেই উনি বললেন, গড় ব্লেস ইউ মাই চাই!

আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ইয়েস ফাদার, ইউ উইল হ্যাভ টু লুক আফটার মী অ্যাজ ইওর চাইন্ড।

আই উইল।

.

আমি যখন লণ্ডন এলাম তখন ওখানে শরৎকালীন ছুটি চলছে। এয়ারপোর্ট থেকে বার্কিংহাম প্যালেস রোডের এয়ারওয়েজ টার্মিনালে যাবার পথেই ডক্টর সরকার বললেন, দিন সাতেক আমার ছুটি আছে। এই কদিন আমরা কোনো কাজের কথা বলব না। এই বুড়ো তোমাকে নিয়ে সারাদিন ঘুরবে।

কোথায় ঘুরবেন?

ঘুরে ঘুরে শহর দেখব।

কিন্তু আপনার তো সব কিছু দেখা। আপনি আবার কেন ঘুরবেন?

এটা কলকাতা বা দিল্লি বোষে নয়; এখানে সারা জীবন কাটিয়েও সব কিছু দেখা হয় না।

আমি মোটর কোচ-এর ভিতরে বসে জানালা দিয়ে দুচোখ ভরে লণ্ডন দেখছি। দু-চার মিনিট পরে ডক্টর সরকার আমাকে বললেন বেঞ্জামিন ডিসরেলী এই মহানগরী সম্পর্কে কি বলেছিলেন জানো?

না।

একবার বলেছিলেন, London-a nation not, a city।

আমি হাসি।

হাসির কথা নয় মা; উনি বোধহয় আরো এক ধাপ বাড়িয়ে বলতে পারতেন, এ শহরটা একটা ক্ষুদে পৃথিবী। তবে ডিসরেলী ঠিকই বলেছিলেন, London is roost for every bird!

আমি ওর কথা শুনে হাসি আর কোচের জানালা দিয়ে দেখি।

ডক্টর সরকার একটু হেসে বললেন, এ শহর যত দেখবে, ততই মনে হবে কিছুই দেখা হল না। আজকে বিশ্রাম নাও। কাল থেকে আমরা ঘুরব।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, কিন্তু আপনার মতো বুড়ো মানুষকে কষ্ট দেওয়া কি উচিত হবে?

উনি হাসতে হাসতে বললেন, নো ওয়ান ইজ টু ওল্ড ইন লন্ডন। তাছাড়া এটা তো কলকাতা নয়, সন্ধেবেলায় ফিরে এসে খানিকটা ওয়াইন খেলেই আবার যৌবন ফিরে আসবে।

আমি হাসি।

হাসির কথা নয় মা! এই মহানগরীতে শরীর ও মনকে সতেজ রাখার সব ব্যবস্থা আছে।

আমি হাসি মুখে বলি, সে সুযোগ বোধহয় সব বড় শহরেই আছে।

না, মা, তা ঠিক নয়। নিউইয়র্ক অনেক বড় শহর কিন্তু সারা শহরটাই যেন স্টক এক্সচেঞ্জ আর ডালহৌসি-চৌরঙ্গি।

আপনি আমেরিকাতেও গিয়েছেন?

উনি হাসতে হাসতে বললেন, শুধু কোনো সুন্দরী নারীর মনের মধ্যে প্রবেশ করতে পারিনি; তাছাড়া আর কোথাও যাওয়া বাকি নেই।

ওর কথা শুনে আমি আরও হাসি। জিজ্ঞাসা করি, আপনি বিয়ে করেননি?

বিয়ে করলে কি এমন বুক ফুলিয়ে তোমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারতাম?

হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বৃদ্ধ ডক্টর সরকার বললেন, একদিন জোর করে দুবোতল ফ্রেঞ্চ ওয়াইন খাইয়ে দিও। আমার জীবনের সব কথা বলে দেব।

এর পরের চিঠিতে ডক্টর সরকারের কথা লিখব। অবাক হবে ওর জীবন কাহিনি জেনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *