সিফন জর্জেট

সিফন জর্জেট

পিয়ন রেজিস্টার্ড পার্সেলের প্যাকেটটা এগিয়ে দিতেই চিত্রিতা মনে মনে একটু চঞ্চল হয়ে পারল না। পিয়ন চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা বন্ধ করে সোজা শোবার ঘরে চলে গেল। প্যাকেটটা খুলল না। খোলার দরকার নেই। মা যখন পাঠিয়েছেন তখন সেই সিফন জর্জেটটাই ভেতরে আছে।

সিফন জর্জেট!

ভাবতে গিয়েই চিত্রিতার একটা ছোট্ট দীর্ঘ নিশ্বাস পড়ল। পড়বেই। এ যে সেই সিফন জর্জেট। স্মৃতির অরণ্যে ছোট্ট একটা হাস্নাহানা। তা হোক। ভারি মিষ্টি গন্ধ। সুন্দর নিটোল একটা স্বপ্ন। মালিন্যমুক্ত একটু ভালো লাগা। অনন্য অনুভূতির ক্ষণিক জোয়ার।

ভেবেছিল স্নান করতে যাবে! চুল ঠিক করে বাথরুমে শাড়িটাড়িও রেখে এসেছে পিয়ন আসার আগে। এখন আর যেতে ইচ্ছা করছে না। কোলের পর প্যাকেটটা নাড়াচাড়া করতে করতে বিছানাতেই বসে রইল। চুপ করে বসে রইলো। কিন্তু মন? সে তো চুপ করে বসে থাকতে জানে না, পারে না। সামান্য একটু হাওয়াতেই সিফন জর্জেট উড়তে থাকে। মনে পড়ে সেদিনের কথা।

সুপার মার্কেটের বাস স্টপে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ব্যানার্জীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিত্রিতা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার? আপনি এখানে?

বাসের জন্য অপেক্ষা করছি।

কোথায় যাবেন?

কোথায় আবার? সুব্রত পার্কে ফিরব।

তা এখানে কেন? আসুন আমার সঙ্গে।

চিত্রিতার কথামতো ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এগুতেই বাস স্টপের লোকজন সবস দৃষ্টিতে ওদের দিকে চেয়ে রইল। দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে। একটু পরেই ব্যানার্জী জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোথায় যাবেন?

আমিও বাড়ি ফিরব।

এদিকে বুঝি বেড়াতে এসেছিলেন?

না, না। গানের ক্লাস করতে এসেছিলাম।

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট চিত্রিতার মুখের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করল, সুব্রত পার্ক থেকে কনট প্লেস?

চিত্রিতাও একটু হাসল। হ্যাঁ।

এখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার ভালো স্কুল আছে বুঝি?

দিল্লীতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার কোনো ভালো স্কোপ নেই বললেই চলে…

তাহলে?

আমি গন্ধর্ব মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। ক্লাসিক্যাল শিখছি।

হঠাৎ টপপা-ঠুংরীর প্রেমে পড়লেন?

চিত্রিতা আবার একটু হাসে। মার হুকুম তামিল করছি। মনে মনে ভাবে পরশুদিন রাত্রে যখন প্রথম পরিচয় হয়, তখন ভাবতে পারেনি উনি এত সুন্দর কথা বলতে পারেন।

আপনার মা বুঝি ক্ল্যাসিক্যালের ভক্ত?

স্টেটসম্যানের মোড় পার হয়ে চিত্রিতা জবাব দেয়, না, তা নয়। মেনলি গলা ভালো হবে বলেই মা ক্ল্যাসিক্যাল শিখতে বললেন।

আপনার গলা যথেষ্ট ভালো। আর ভালো হবার দরকার নেই।

জনপথের মোড়ে থমকে দাঁড়িয়ে চিত্রিতা হাসিমাখা ফ্লাইট লেফটেন্যান্টের দিকে ঘুরিয়ে বলল, তাই নাকি?

অব কোর্স!

সিফন জর্জেটের প্যাকেটটা পেয়ে সবকিছু মনে পড়ছে চিত্রিতার। মনে পড়ে মেল ট্রেন মাঝে মাঝে হঠাৎ ছোট্ট স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়লে ভারি ভালো লাগে। অনেক দিন পর্যন্ত ভোলা যায় না স্টেশন মাস্টারের মুখখানা। বার বার মনে পড়ে রেলকোয়ার্টারের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা স্টেশন মাস্টারের স্ত্রীর বিবর্ণ বিস্মিত মুখের ছবি। বিয়ের নেমন্তন্নে গিয়ে অনেক সময় বরের চাইতে একজন বরযাত্রীর কথা বেশিদিন মনে থাকে।

.

গ্রুপ ক্যাপ্টেন ঘোষ আর স্কোয়ার্ডন লীডার রায়ের কোয়ার্টার প্রায় পাশাপাশি। গ্রুপ ক্যাপ্টেন কমান্ড হেড কোয়ার্টাসে আর কোয়ার্ডন লীডার পালামে পোস্টেড। তা হোক পরিচয় বহু দিনের। সম্পর্ক নিবিড়। এই গ্রুপ ক্যাপ্টেন যখন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তখন চিত্রিতার জন্ম। চৈতালী যখন খুব ছোট্ট, তখনই রায় কাকুর সঙ্গে মাধুরী মাসীর বিয়ে হয়। আবার মিঠ যখন হয় তখন চিত্রিতারাও আগ্রায়। মিঠু হবার পর মাধুরী নাসীর শরীরটা বেশ খারাপ। মাধুরী মাসী ওর কিছুই দেখাশুনা করতে পারত না। মি? চিত্রিতার মার কাছেই থাকত। দিন রাত। তাই তো মি ওকে বড়মা বলে। মিঠ আজ কত বড় হয়ে গেছে; তবু বড়মার কাছে আব্দার করতে সঙ্কোচ নেই।

অনেক কাল পরে আবার দুটি পরিবার দিল্লিতে। সুব্রত পার্কে প্রায় পাশাপাশি কোয়ার্টার। ভারি মজা। চিত্রিতার মা আর মাধুরী মাসী পালামের ফেটেতে একসঙ্গে ঈল খুলছেন, লুচিআলুর দম বিক্রি করছেন। আবার রবিবার সকালে দুজনে একসঙ্গে ডিলাইটে সত্যজিৎ রায়ের অরণ্যের দিনরাত্রি দেখছেন। আরো কত কি! দুর্গাপূজার সময় আর কেউ না গেলেও ওঁরা দুজনে ঠিক সারা রাত জেগে শ্রীমতী অপেরার যাত্রা দেখবেনই। চৈতালীকে না হলেও চিত্রিতাকে ওরা দলে টানতে চান। বিশেষ করে মাধুরী মাসী। কিরে চিত্রা, যাবি নাকি যাত্রা দেখতে?

না মাসী, যাত্রা দেখার কথা বোলো না।

কেন রে?

যাত্রাটাত্রা আমার ভালো লাগে না।

যাত্রা কোনোদিন দেখেছিস?

না!

তাহলে ভালো লাগবে না কি করে জানলি?

চিত্রিতা হাসতে হাসতে বলে, সারা রাত ধরে রাজারানি ষাড়ের মতো চেঁচাবে আর মন্ত্রীরা টিনের তলোয়ার ঘোরাবে, তা আমি সহ্য করতে পারব না।

ওর কথা শুনে মাধুরী মাসীও হাসে। হাজার হোক কলেজ গার্ল তো! গ্রেগরি পেক বা রিচার্ড বার্টনকে না দেখলে ঠিক মন ভরে না তোদের।

দুই ফ্যামেলির জয়েন্ট সেসন বসলে চিত্রিতার যাত্রা না দেখার কথা উঠবেই। সব কিছু শোনার পর স্কোয়ার্ডন লীডার রায় আবার সঙ্গে সঙ্গে একটা কবিতা তৈরি করে বলেন,

আমাদের চিত্রা
দেখে না যাত্রা।
খায় শুধু কেক
পছন্দ করে গ্রেগরি পেক!
চুরি করে মটন
ভালোবাসে বার্টন
গাইতে পারে গান
আর আছে অভিমান।

কবিতার প্রত্যেকটি লাইন পর্যন্ত স্পষ্ট মনে পড়েছে চিত্রার। মনে পড়বে না? রক্তরাঙা কৃষ্ণচূড়ার মতো সেসব দিনের স্মৃতি জ্বল জ্বল করছে মনের মধ্যে। রোজ মনে পড়ে না। মনে পড়তে পারে না। নতুন জীবনের জোয়ারে পুরনো স্মৃতির পলিমাটি পড়ছে। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে। স্মৃতির সূর্য মনের আকাশে উঠলেই নতুন পলিমাটিতে ফাটল ধরে। চাপা পড়া সুখদুঃখের মিষ্টি মধুর ইতিহাস আবার মুখোমুখি দাঁড়ায়।

জনপথ পার হয়ে এলআইসি গ্রাউন্ডের পাশ দিয়ে পার্লামেন্ট স্ট্রিটের দিকে এগুতে এগুতে চিত্রিতা ফ্লাইট লেফটেন্যান্টকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি বুঝি সিনেমা দেখতে গিয়ে টিকিট পেলেন না?

মোটেও সিনেমা দেখতে আসিনি। অফিস ছুটির পরই এক বন্ধু জোর করে কফি হাউসে নিয়ে এলো। একটু থেমে বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

চিত্রিতা দুষ্টুমি করে জিজ্ঞাসা কবল, ভয় করছে? নাকি সন্দেহ হচ্ছে?

আমাকে দেখে কি তাই মনে হচ্ছে?

চিত্রিতা ওকথার কোনো জবাব না দিয়ে বলল, আমি আপনার মতো ভালো ফাইটার পাইলট না হলেও খারাপ ন্যাভিগেটর নই। ঠিক বাড়িতে পৌঁছে দেব।

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় ভারি মজা হল।

জান মাসি, আজ আর একটু হলেই পালামে হৈ চৈ পড়ে যেত।

মাধুরী মাসী উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল, কেন রে? কি হয়েছিল?

গ্রুপ ক্যাপ্টেন ঘোষ মেয়ের কথায় অবাক হয়ে স্কোয়ার্ডন লীডার রায়ের দিকে তাকালেন।

চিত্রিতা বেশ গম্ভীর হয়ে বলল, ফ্লাইং এয়ারক্রাফট মিসিং হয় কিন্তু আজ এয়ারক্রাফট ছাড়াই পাইলট মিসিং হচ্ছিল।

ওর কথা কেউ বুঝল না। সবাই হাঁ করে ওর দিকে চেয়ে রইল। মাধুরী মাসীই আবার প্রশ্ন করল, তার মানে?

তোমাদের ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আজ মিসিং হচ্ছিলেন। শুধু আমার মতো ন্যাভিগেটরের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হওয়ায়…

.

চিত্রিতার কথা শেষ হতে দেয়নি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। মিসেস রায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, বৌদি শুনেছেন আজকাল কটন প্লেসে বহু ইয়ং মেয়ে ছেলেদের ব্ল্যাকমেল করছে?

সিফন জর্জেটের প্যাকেটটা নিয়ে চিত্রিতা স্থির হয়ে বসে আছে। কিন্তু বিবর্ণ উদাস মন? ছাব্বিশ নম্বর লেক অ্যাভিনিউ থেকে ছুটে চলে গেছে দিল্লির সুব্রত পার্কে। পালামের রাস্তার ধারে এয়ার ফোর্স অফিসার্স কলোনীতে। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ব্যানার্জী মাত্র এক মাসের টেম্পোরারি ডিউটিতে এয়ার হেড কোয়ার্টার্সে এসেছিল। চিত্রিতা কলকাতায় বি. এ. পরীক্ষা দিয়ে দিল্লি এসেছে। হাতে অফুরন্ত সময়। শুধু সপ্তাহে তিন দিন গন্ধর্ব মহাবিদ্যালয়ে যাতায়াত। চৈতালীর সঙ্গে তেঁতুলের আচার চুরি করে খাবার পর বাকি সময়টা মাধুরী মাসীর কাছে কাটায়। ঠিক সেই সময়েই ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এলো মাধুরী মাসীর কাছে। এখানে না এসে উপায় ছিল না ওর। স্কোয়ার্ডন লীডার ভীষণ রেগে যেতেন। তাছাড়া মিঠু তো আছেই। আম্বালায় কাকার স্কুটারে চড়ে ঘুরে বেড়ালে মিঠু কিছুতেই খেতো না। তাছাড়া ঐ কাকু যে ওকে সুর করে কবিতা শোনাত! মিঠুকে ছেড়ে সেই কাকু দিল্লিতে কোথায় থাকবে?

ভাবতে গিয়েই চিত্রিতা হাসে। বিশেষ কিছুই না। নিছক একটু হাসিঠাট্টা গল্পগুজব। মাঝে মাঝে গান। মাঝে মাঝে মন্তব্য। শরতের আকাশে টুকরো টুকরো মেঘ। মনটা খুশিতে ভরে যায়।

মাধুরী বৌদি ফ্লাইট লেফটেন্যান্টকে বললেন, চিত্রার গান তোমার যখন এত ভালো লাগে তখন কয়েকটা গান টেপে তুলে নিলেই পার।

তা হয় না বৌদি।

চিত্রিতা বলল, টেপ করার যোগ্য নয় বলে।

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট একটু হেসেই গম্ভীর হল। ওর গান তোমাদের সবার সামনে শোনার অধিকার থাকলেও লুকিয়ে একা একা লোনার অধিকার আমার নেই।

মাধুরী বৌদি হঠাৎ বলে ফেললেন, কেন, সে অধিকার চাও?

লজ্জায় চিত্রিতা ছিটকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। লজ্জা পেয়েছিল ব্যানার্জীও। তাই তো পরের দিন আবার ও সুপার মার্কেটের বাসস্টপে না দাঁড়িয়ে পারেনি। চিত্রিতা বুঝেছিল ও কিছু বলতে চায়।

আজও কি কফি হাউসে এসেছিলেন?

হ্যা!

আজও কি বাসের জন্যে দাঁড়িয়েছিলেন?

না। ন্যাভিগেটরের জন্য।

আমার মতো হাতুড়ে ন্যাভিগেটর দিয়ে আপনার মতো কোয়ালিফায়েড পাইলটের কোনো উপকার হবে কি?

যেটুকু পথ চিনিয়েছেন তাতেই আমি খুশি। আর ভবিষ্যৎ? সে আমারও হাতে নয়, আপনারও হাতে নয়।

আরো দুচারটে টুকটাক কথার পর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বলল, কাল রাত্রে যা বলেছিলাম তা বলা বোধহয় ঠিক হয়নি। মনে কিছু করবেন না।

চিত্রিতা কিছুক্ষণ মুখ নীচু করে চুপচাপ থাকার পর বলল, না না, কিছু মনে করিনি।

কিছু মনে না করলেও লজ্জা পেয়েছিলেন, কিন্তু আপনাকে লজ্জা দেবার অধিকারও তো আমার নেই।

এই পৃথিবীতে প্রায় সবাই নিত্য নতুন অধিকার চায়। দাবি জানায়। অথবা মনে মনে আশা করে। স্বপ্ন দেখে। কিন্তু ফ্লাইট লেফটেন্যান্টের মতো কজন অধিকার ছাড়তে পারে? দাবি করার সুযোগ পেয়েও নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারে?

যারা হাত পাতে, দাবি জানায়, তাদের প্রত্যাখ্যান করা যায়। কিন্তু যারা নিজের জন্য কিছু চায় না, দাবি জানায় না, তাদের জন্য অনেকেরই মন ব্যাকুল হয়। হয়তো চিত্রিতারও হয়েছিল। বুঝতে পারেনি। হঠাৎ এতদিন পর মনটা বেদনায় ভরে গেল। পুরনো দিনের হিসেবের খাতা ওল্টাতে গিয়ে চিত্রিতা যেন আবিষ্কার করল ঋণের বোঝা শোধ করা হয়নি।

এখন উপায়?

ছাব্বিশ নম্বর লেক অ্যাভিনিউয়ের দোতলার ফ্ল্যাটের বেডরুমে বসে আর তো সে ঋণ শোধ করা যাবে না। কখনও যায় না। ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। কোনো রাস্তা নেই। ব্যাঙ্কে টাকা থাকলেই কি চেক কাটা যায়? চিত্রিতার সব কিছুই তো ফিক্সড ডিপোজিট আর সেফ ডিপোজিট ভল্টে। সব সম্পদই ওর, কিন্তু চাবিকাঠি তো ওর কাছে নেই। চুরি করতে পারে সে চাবিকাঠি! কিন্তু তবুও তো ঋণের বোঝা নামাবার উপায় নেই। ও নেবে কি সে সম্পদ?

কিছুতেই না। অসম্ভব। কল্পনাতীত।

.

কি ব্যাপার? এতদিন পর আবার সুপার মার্কেটের এখানে দাঁড়িয়ে?

এয়ার হেড কোয়াটার্সের কাজ শেষ হয়ে গেল তাই।

বড় বেসুরো লাগল চিত্রিতার কানে। কথাটা শেষ করতে দিতেও পারল না।

হ্যাঁ। এক মাস হয়ে গেল।

বারাখাম্বা। তারপর পার্লামেন্ট স্ট্রিট।

কথা বলা হল না কারুরই। তবু যেন দুজনেই অনেক কথা শুনেছিল।

কাল ভোরেই চলে যাচ্ছি।

কাল ভোরেই?

হ্যাঁ।

রিগ্যাল সিনেমা, খাদি গ্রামোদ্যোগ ভবন, আরউইন রোড।

রাস্তা পার না হয়ে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জিজ্ঞাসা করল, আজও কি সোজা বাস স্ট্যান্ডে যাব নাকি ডান দিকে ঘুরব।

চলুন।

বেশিক্ষণ নয়, বেশি দূরেও নয়। ইনার সার্কেলে সামান্য সময়ের জন্য দুজনে ঘুরেছিল।

আপনার জন্য বেশ কাটল কটা মাস।

মুখ নীচু করে চিত্রিতা বলল, আমি আর আপনার জন্য কি করলাম?

এত গান শোনাবার পরও বলছেন কি আর করলেন?

খুব শুনিয়েছি।

সত্যিই বলছি খুব ভালো লেগেছে আপনার গান। অনেক দিন মনে থাকবে।

আবার চুপ করে থাকে দুজনেই। কথা বলতে পারে না।

হঠাৎ একটু থমকে দাঁড়িয়ে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বলল, একটা অন্যায় অনুরোধ করব?

আপনি অন্যায় অনুরোধ করবেন কেন?

কেন জানি না তবে করব! করতে ইচ্ছে করছে।

আপনাকে হয়তো খুব বেশি চিনি না। তবে যতটুকু চিনেছি তাতে মনে হয় অন্যায় অনুরোধ আপনি করবেন না।

সত্যি বলছি অন্যায় অনুরোধ করব। রাখবেন?

আচ্ছা বলুন তো

রাখবেন তো?

চিত্রিতা হাসে, আচ্ছা রাখব।

ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সিফন জর্জেটের প্যাকেটটা এগিয়ে দিলে ফিরিয়ে দিতে পারে নি। কোনো কথা না বলে হাতে তুলে নিয়েছিল। এমন কি ধন্যবাদ পর্যন্ত জানাতে পারে নি।

সব কিছুই তো সবাই জানলেন। শুধু এই সিফন জর্জেটের কথাটুকু আমাদের থাক।

চিত্রিতা জানাতে পারেনি। মাকে বলেছিল, গানের ক্লাসের এক বন্ধু দিয়েছে। সেদিন বাড়ি ফিরেই ওই সিফন জর্জেটটা পরে ছুটে গিয়েছিল মাধুরী মাসীর কাছে। মা, মাসীকে শাড়িটা দেখিয়ে আসি।

স্কোয়ার্ডন লীডার রায় ড্রইংরুমে বসে ফ্লাইট লেফটেন্যান্টের সঙ্গে গল্প করছিলেন। ঝড়ের বেগে চিত্রিতা ড্রইংরুমে ঢুকেই এদিক ওদিক দেখল। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট একবার মুগ্ধ হয়ে দেখল। স্কোয়ার্ডন লীডার কিছু বুঝতে পারলেন না।

কাকু, মাসী কোথায়?

ও বোধহয় মিঠুকে খেতে দিচ্ছে।

মাসীও চমকে উঠেছিল। আঃ! কি লাভলি তোকে দেখাচ্ছে রে!

মাসী চিত্রিতাকে সঙ্গে নিয়ে ড্রইংরুমে এসে স্কোয়ার্ডন লীডারকে বললেন, দেখছ, সিফন জর্জেটটা পরে চিত্রাকে কি দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছে।

স্কোয়ার্ডন লীডার কিছু বলার আগেই ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বলল, তাই বলে সিফন জর্জেট পরলে তোমাকে মানাবে না।

বেশি রাগালে হাটে হাঁড়ি ভাঙব কিন্তু।

বিয়ের পর পুরনো শাড়ি কোনো মেয়েই পরে না, ভালো হলেও না। তখন পুরনো জিনিস ভালো হলেও বর্জনীয়। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তা জানে। তবুও চৈতালীকে সিফন জর্জেটটা পরতে দেখে মনে মনে বড় অতৃপ্তি বোধ করল। অসহ্য লাগল। চিত্রিতার চাইতে চৈতালীকে দেখতে আরো ভালো কিন্তু ফ্লাইট লেফটেন্যান্টের চোখে খারাপ লাগল। বড় বেমানান বলে মনে হলো।

.

হিন্দনে ট্রান্সফার হবার পর প্রত্যেক উইক এন্ডে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুব্রত পার্কে আসত। হঠাৎ চৈতালীর আসাযাওয়া বাড়তেই ও আসা বন্ধ করে দিল। কিন্তু কেউ বুঝল না, জানল না। মাধুরী বৌদি টেলিফোন করলেই বলে ভীষণ ব্যস্ত।

তারপর একদিন ব্যানার্জী হঠাৎ নিজেই টেলিফোন করল, বৌদি, তোমার ওখানে আমার যে স্যুটটা রয়েছে, ওটা কাচিয়ে রেখো তো।

আচ্ছা রাখব।

আর ওর পকেটে একটা নতুন ডায়েরি আছে। ওটা কিন্তু একটু সাবধানে রেখো।

রাখব কিন্তু তুমি আসছ কবে?

সামনের রবিবারেই আসব।

ঠিক?

ঠিক।

কল্যাণীয়া চিত্রা,
তো বিয়ের পর এই প্রথম তোকে চিঠি লিখছি। ভাবতে পারিনি প্রথম চিঠিতেই একটা মারাত্মক খবর দিতে হবে। আজ সকালে হিন্দনে ফ্লাইং আকসিডেন্টে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মারা গেছে। ঠিক ভাবতে পারছি না কি হয়ে গেল। ওর একটা স্যুট আমার কাছে ছিল। ড্রাই ক্লিন করতে দিয়েছি। রবিবার নিয়ে যাবার কথা। কোটের পকেটে একটা নতুন ডায়েরি ছিল। বলেছিল সাবধানে রাখতে। রেখেছিলাম। এতদিন ডায়েরিটা আলমারিতেই ছিল, কিন্তু আজ ওটা না দেখে পারলাম না। ডায়েরির একটা পাতাতেও কিছু লেখা নেই। গত বছর এপ্রিলে সুপার মার্কেট থেকে কেনা একটা সিফন জর্জেটের ক্যাশ মেমো ছাড়া আর কিছু ঐ ডায়েরিতে নেই। তোকে না লিখে পারলাম না। তুই আমাকে ক্ষমা করিস।
তোর মাধুরী মাসী

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *