আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে (১৯৯০:১৩৯৬)

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে
হুমায়ুন আজাদ

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
 আমার খাদ্যে ছিলো অন্যদের আঙুলের দাগ,
আমার পানীয়তে ছিলো অন্যদের জীবাণু,
আমার বিশ্বাসে ছিলো অন্যদের ব্যাপক দূষণ।
আমি জন্মেছিলাম আমি বেড়ে উঠেছিলাম
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি দাঁড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,
আমি হাঁটতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,
আমি পোশাক পরতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো করে,
 আমি চুল আঁচড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো করে,
 আমি কথা বলতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো।
তারা আমাকে তাদের মতো দাঁড়াতে শিখিয়েছিলো,
তারা আমাকে তাদের মতো হাঁটার আদেশ দিয়েছিলো,
তারা আমাকে তাদের মতো পোশাক পরার নির্দেশ দিয়েছিলো,
তারা আমাকে বাধ্য করেছিলো তাদের মতো চুল আঁচড়াতে,
তারা আমার মুখে গুঁজে দিয়েছিলো তাদের দূষিত কথামালা।
তারা আমাকে বাধ্য করেছিলো তাদের মতো বাঁচতে।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম,
 আমি হাঁটতে চেয়েছিলাম নিজস্ব ভঙ্গিতে,
আমি পোশাক পরতে চেয়েছিলাম একান্ত আপন রীতিতে,
আমি চুল আঁচড়াতে চেয়েছিলাম নিজের রীতিতে,
 আমি উচ্চারণ করতে চেয়েছিলাম আমার আন্তর মৌলিক মাতৃভাষা।
 আমি নিতে চেয়েছিলাম নিজের নিশ্বাস।
আমি আহার করতে চেয়েছিলাম আমার একান্ত মৌলিক খাদ্য,
আমি পান করতে চেয়েছিলাম আমার মৌলিক পানীয়।
আমি ভুল সময়ে জন্মেছিলাম। আমার সময় তখনো আসে নি।
আমি ভুল বৃক্ষে ফুটেছিলাম। আমার বৃক্ষ তখনো অঙ্কুরিত হয় নি।
 আমি ভুল নদীতে স্রোত হয়ে বয়েছিলাম। আমার নদী তখনো উৎপন্ন হয় নি।
আমি ভুল মেঘে ভেসে বেরিয়েছিলাম। আমার মেঘ তখনো আকাশে জমে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি গান গাইতে চেয়েছিলাম আমার আপন সুরে,
ওরা আমার কণ্ঠে পুরে দিতে চেয়েছিলো ওদের শ্যাওলা-পড়া সুর।
আমি আমার মতো স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম,
 ওরা আমাকে বাধ্য করেছিলো ওদের মতো ময়লা-ধরা স্বপ্ন দেখতে।
 আমি আমার মতো দাঁড়াতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলো ওদের মতো মাথা নিচু করে দাঁড়াতে।
 আমি আমার মতো কথা বলতে চেয়েছিলাম,
 ওরা আমার মুখে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলো ওদের শব্দ ও বাক্যের আবর্জনা।
আমি খুব ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিলাম,
 ওরা আমাকে ওদের মতোই দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলো বাইরে।
 ওরা মুখে এক টুকরো বাসি মাংস পাওয়াকে ভাবতো সাফল্য,
ওরা নতজানু হওয়াকে ভাবতো গৌরব,
ওরা পিঠের কুঁজকে মনে করতো পদক,
 ওরা গলার শেকলকে মনে করতো অমূল্য অলংকার।
 আমি মাংসের টুকরো থেকে দূরে ছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি নতজানু হওয়ার বদলে নিগ্রহকে বরণ করেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
 আমি পিঠে কুঁজের বদলে বুকে ছুরিকাকে সাদর করেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি গলার বদলে হাতেপায়ে শেকল পরেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি অন্যদের সময়ে বেঁচে ছিলাম। আমার সময় তখনো আসে নি।
ওদের পুকুরে প্রথাগত মাছের কোনো অভাব ছিলো না,
ওদের জমিতে অভাব ছিলো না প্রথাগত শস্য ও শব্জির,
ওদের উদ্যানে ছিলো প্রথাগত পুষ্পের উল্লাস।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো দিঘি খুঁড়েছিলাম ব’লে
আমার দিঘিতে পানি ওঠে নি।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো চাষ করেছিলাম ব’লে
 আমার জমিতে শস্য জন্মে নি।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো বাগান করতে চেয়েছিলাম ব’লে
আমার ভবিষ্যতের বিশাল বাগানে একটিও ফুল ফোটে নি।
তখনো আমার দিঘির জন্যে পানি উৎসারণের সময় আসে নি।
তখনো আমার জমির জন্যে নতুন ফসলের সময় আসে নি।
তখনো আমার বাগানের জন্যে অভিনব ফুলের মরশুম আসে নি।
 আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।

আমার সব কিছু পর্যবসিত হয়েছে ভবিষ্যতের মতো ব্যর্থতায়,
 ওরা ভরে উঠেছে বর্তমানের মতো সাফল্যে।
ওরা যে-ফুল তুলতে চেয়েছে, তা তুলে এনেছে নখ দিয়ে ছিঁড়েফেড়ে।
আমি শুধু স্বপ্নে দেখেছি আশ্চর্য ফুল।
ওরা যে-তরুণীকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছে, তাকে জড়িয়ে ধরেছে দস্যুর মতো।
 আমার তরুণীকে আমি জড়িয়ে ধরেছি শুধু স্বপ্নে।
ওরা যে-নারীকে কামনা করেছে, তাকে ওরা বধ করেছে বাহুতে চেপে।
আমার নারীকে আমি পেয়েছি শুধু স্বপ্নে।
চুম্বনে ওরা ব্যবহার করেছে নেকড়ের মতো দাঁত।
আমি শুধু স্বপ্নে বাড়িয়েছি ওষ্ঠ।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার চোখ যা দেখতে চেয়েছিলো, তা দেখতে পায় নি।
 তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার পা যে-পথে চলতে চেয়েছিলো, সে-পথে চলতে পারে নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার হৃদয় যা নিবেদন করতে চেয়েছিলো, তা নিবেদন করতে পারে নি।
 তখনো আমার সময় আসে নি।
 আমার কর্ণকুহর যে-সুর শুনতে চেয়েছিলো, তা শুনতে পায় নি।
 তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার ত্বক যার ছোঁয়া পেতে চেয়েছিলো, তার ছোঁয়া পায় নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
 আমি যে-পৃথিবীকে চেয়েছিলাম, তাকে আমি পাই নি।
তখনো আমার সময় আসে নি। তখনো আমার সময় আসে নি।
 আমি বেঁচে ছিলাম
অন্যদের সময়ে।

*

কথা দিয়েছিলাম তোমাকে

কথা দিয়েছিলাম তোমাকে রেখে যাবো
পুষ্ট ধান মাখনের মতো পলিমাটি পূর্ণ চাঁদ ভাটিয়ালি
গান উডডীন উজ্জ্বল মেঘ দুধেল ওলান মধুর চাকের মতো গ্রাম
 জলের অনন্ত বেগ রুইমাছ পথপাশে শাদা ফুল অবনত গাছ
 আমের হলদে বউল জলপদ্ম দোয়েল মৌমাছি
তোমার জন্যে রেখে যাচ্ছি নষ্ট ফলে দুষ্ট কীট
ধানের ভেতরে পুঁজ টায়ারের পোড়া গন্ধ পঙ্কিল তরমুজ
দুঃস্বপ্নআক্রান্ত রাত আলকাতরার ঘ্রাণ ভাঙা জলযান অধঃপাত
সড়কে ময়লা রক্ত পরিত্যক্ত জ্বণ পথনারী বিবস্ত্র ভিখারি
শুকনো নদী হন্তারক বিষ আবর্জনা পরাক্রান্ত সিফিলিস

কথা দিয়েছিলাম তোমাকে রেখে যাবো
নিকোনো শহর গলি লোকোত্তর পদাবলি রঙের প্রতিভা
মানবিক গূঢ় সোনা অসম্ভব সূত্রে বোনা স্বাধীনতা শুভ্র স্বাধিকার
অন্তরঙ্গ অক্ষরবৃত্ত দ্যুতিময় মিল লয় জীবনের আনন্দনিখিল
 গাঢ় আলিঙ্গন সুবাতাস সময়ের অমল নিশ্বাস

তোমার জন্যে রেখে যাচ্ছি নোংরা বস্তি সৈন্যাবাস
বর্বর চিৎকার বুট রাষ্ট্রধর্ম তেলাপোকা মধ্যযুগ অন্ধ শিরস্ত্রাণ
 মৌলবাদ রেখে যাচ্ছি মারণাস্ত্র আততায়ীর উল্লাস পোড়া ঘাস সন্ত্রাস
 মরচে-পড়া মাংস রেখে যাচ্ছি কালরাত্রি সান্ধ্য আইন অনধিকার
সমূহ পতন খাদ তোমার জন্যে রেখে যাচ্ছি অসংখ্য জল্লাদ

*

তৃতীয় বিশ্বের একজন চাষীর প্রশ্ন

আগাছা ছাড়াই, আল বাঁধি, জমি চষি, মই দিই,
বীজ বুনি, নিড়োই, দিনের পর
দিন চোখ ফেলে রাখি শুকনো আকাশের দিকে। ঘাম ঢালি
খেত ভরে, আসলে রক্তই ঢেলে দিই
 নোনা পানি রূপে; অবশেষে মেঘ ও মাটির দয়া হ’লে
খেত জুড়ে জাগে প্রফুল্ল সবুজ কম্পন।
 খরা, বৃষ্টি, ও একশো একটা উপদ্রব কেটে গেলে
 প্রকৃতির কৃপা হলে এক সময়
 মুখ দেখতে পাই থোকা থোকা সোনালি শস্যের।
 এতো ঘামে, নিজেকে ধানের মতোই।
 সেদ্ধ করে, ফলাই সামান্য, এক মুঠো, গরিব শস্য।
 মূর্খ মানুষ, দূরে আছি, জানতে ইচ্ছে করে
দিনরাত লেফ-রাইট লেফ-রাইট করলে কমন শস্য ফলে
এক গণ্ডা জমিতে?

*

তরুণী সন্ত

যেখানে দাঁড়াও তুমি সেখানেই অপার্থিব আলো।

তুমি হেঁটে যাচ্ছো, আমি বহু দূর থেকে দেখেছি, তোমার স্যাণ্ডল
থেকে পুঞ্জপুঞ্জ জোনাকিশিখার মতো গলে পড়ছে আলো,
কংক্রিট, ধুলোবালি, ঝরা পাতা রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে অলৌকিক হীরে মুক্তো
 সোনা প্রবাল পান্নায়। তোমার স্যাণ্ডলের ছোঁয়ায় সোনা-হয়ে-যাওয়া
 এক টুকরো মাটি আমি সেই কবে থেকে বুকে বয়ে বেড়াচ্ছি দিনরাত।

যে-দিকে তাকাও তুমি সেদিকেই গুচ্ছগুচ্ছ আশ্চর্য গোলাপ।

একবার, চোতমাসের প্রচণ্ড দুপুরে, তুমি দাঁড়ালে পথের পাশে।
তোমার পেছনে একটি মরা গাছ–হাড়ের মতো শুকনো ডাল, জংধরা
 পেরেকের মতো সংখ্যাহীন কাঁটা ছাড়া কিছুই ছিলো না তার।
তোমার আঁচল উড়ে গিয়ে যেই স্পর্শ করলো সেই মরা গরিব গাছকে
অমনি তার কাঁটা আর শুকনো ডাল ঢেকে দিয়ে থরেথরে
 ফুটে উঠলো লাল লাল আশ্চর্য গোলাপ।

যে-দিকে ফেরাও মুখ সেদিকেই আবির্ভূত অমল সুন্দর।

 কলাভবন থেকে বেরোচ্ছিলে তুমি–হঠাৎ দুটো গুণ্ডা, হয়তো তোমার
 সহপাঠী, হোন্ডায় চেপে এসে থামলো তোমার পাশে। তুমি ফেরালে মুখ
 ওদের কুৎসিত মুখের দিকে;–আমি দেখলাম ওদের ঘা
 আর দাগ-ভরা মুখ নিমেষেই হয়ে উঠলো দেবদূতদের
মুখের মতোন জ্যোতির্ময়।

 যে-দিকে তাকাও তুমি সেদিকেই অভাবিত অনন্ত কল্যাণ।

 বাসস্টপে পড়ে-থাকা কুষ্ঠরোগীটির মুখের দিকে তুমি তাকিয়েছিলে
একবার। তখন কুষ্ঠরোগীটিকে মনে হয়েছিলো
 রূপসীর করতলে পড়ে আছে রজনীগন্ধার বৃষ্টিভেজা অমল পাপড়ি।

তুমি তো তাকাও সব দিকে; শুধু তুমি আমার মুখের দিকে,
মানুষের দুরূহতম দুঃখের দিকে, এক শতাব্দীতে
একবারো–ভুলেও–তাকালে না।

*

যে তুমি ফোটাও ফুল

যে তুমি ফোটাও ফুল ঘ্রাণে ভরো ব্যাপক সবুজ,
জমিতে বিছিয়ে দাও ধান শিম খিরাই তরমুজ
 কুমড়োর সুস্বাদ, যে তুমি ফলাও শাখে ফজলি আম
 কামরাঙা পেয়ারা, বাতাসে দোলাও গুচ্ছগুচ্ছ জাম,
যে তুমি বহাও নদী, পাললিক নদীর ভেতরে
লালনপালন করো ইলিশ বোয়াল স্তরেস্তরে,
যে তুমি ওঠাও চাঁদ মেঘ ছিঁড়ে নীলাকাশ জুড়ে
বাজাও শ্রাবণ রাত্রি নর্তকীর অজস্র নূপুরে,
যে তুমি পাখির ডাকে জেগে ওঠো, এবং নিশ্চুপে
 বালিকার সারা দেহ ভরে দাও তিলেতিলে রূপে
আর কণকচাপার গন্ধে আর ভাটিয়ালি গানে,
যে তুমি বইয়ে দাও মধুদুগ্ধ গাভীর ওলানে
 খড় আর ঘাস থেকে, যে তুমি ফোঁটাও মাধবী
আর অজস্র পুত্রকে দাও ছন্দ করে তোলো কবি,
যে তুমি ফোটাও ফুল বনে বনে গন্ধভরপুর
সে তুমি কেমন করে, বাঙলা, সে তুমি কেমন করে
দিকে দিকে জন্ম দিচ্ছো পালেপালে শুয়োরকুকুর?

*

রঙিন দারিদ্র্য

আমি ঠিক জানি না
কোন স্বাপ্লিকের কালে বাঙলাদেশে
 টেলিভিশন রঙিন হয়েছে।
যার কালেই হোক, তাকে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন
বলে মানতেই হবে। টেলিভিশনে
এখন আমাদের দারিদ্রকে
কী সুন্দর, রঙিন, আর মনোরম দেখায়।

*

আগুনের ছোঁয়া

আমি ছুঁলে বরফের টুকরোও জ্বলে ওঠে দপ ক’রে।
 আমি ছুঁলে গোলাপের কুঁড়ি জ্বলে,
 সারা রাত জ্বলতে থাকে আগুন-গোলাপ।
 বনে গেলে শুরু হয় লাল দাবানল।
পায়ের ঘষায় বারুদস্তূপের মতো লেলিহান
 হয়ে ওঠে সুসজ্জিত মঞ্চ।
আমি ছুঁলে তোমার শরীর জুড়ে
 দাউদাউ জ্বলে প্রাচীনতম রক্তের আগুন।
 ছুঁয়েছি গোলাপকুঁড়ি, বরফটুকরো,
 বনের সবুজ ত্বক, সাজানো মঞ্চ,
আর স্বপ্ন তোমাকে ছুঁয়েছি।
 সাধ আছে ছুঁয়ে যাবো নষ্ট সভ্যতাকে,
 যাতে এই ভেজাল বস্তু
ট্রেলপাম্পের মতো ভয়াবহভাবে জ্বলে ওঠে।

*

অশ্রুবিন্দু

ওই চোখ থেকে, মেয়ে, ঝরে জ্যোতি।
 তোমার ফসল দেখে ইচ্ছে হয় কায়মনোবাক্যে স্তুতি
করি শেষ পারমাণবিক বিস্ফোরণ অবধি।
 সাঁতারে অভিজ্ঞ তবু দেখি নাই এরকম খরস্রোতা নদী।
 ওই অসম্ভব গীতিভারাতুর গ্রীবা
 দেখে বুঝলাম কাকে বলে সৌন্দর্যের পরম প্রতিভা।
 কিন্তু যেই আসি হৃদয়ের কাছে
দেখতে পাই তোমার চোখের কোণে
 একবিন্দু কালো অশ্রু পেরেকের মতো গেঁথে আছে।

*

সমুদ্রে প’ড়ে গেলে

কখনো সমুদ্রে প’ড়ে গেলে আমাকে উদ্ধার করতে হয়তোবা
 ছুটে আসবে নৌবহর। বিমানবাহী যান থেকে উদ্ধত ডানার শোভা
 মেলে আসবে ছুটে উদ্ধারপরায়ণ ক্ষীপ্র হেলিকপ্টার।
 ছুঁড়ে দেবে দীর্ঘ দড়ি, ভাসমান বয়া, দশ দিক থেকে প্রচণ্ড সাঁতার
কেটে ছুটে আসবে ডুবুরীরা। অসংখ্য অতিমানবিক সাবমেরিন
আমাকে খুঁজবে সমুদ্রের স্তরেস্তরে সারা রাতদিন।
আমাকে পাবে না ওরা, আমাকে উদ্ধারের শক্তি ওদের তো নেই।
শুধু ওই হাতে আছে আমার উদ্ধার, তুমি যেই
বাড়াবে তোমার হাত–অনন্তের থেকে ব্যাপ্ত শুভ্র করতল
 উঠে আসবো আমি যে-কোনো পতন থেকে
নিষ্পাপ পবিত্র অমল।

*

মৃত্যু

যখন ছিলাম খুব ছোটো চারদিকে আমি
 প্রেতের মুখের মতো দেখতে পেতাম মৃত্যুর অদ্ভুত মুখচ্ছবি।
 ফুলে দুলে উঠতো তার মুখ, এলোমেলো
 জ্যোৎস্নায় আঁকা দেখতাম তার ভয়াল মুখের রূপরেখা।
ভয়ে মাকে আমার দু-লক্ষ হাতে জড়িয়ে ধরতাম।

যখন আঠারো তখন আমার সমগ্র বাস্তব-অবাস্তব জুড়ে
বিষণ্ণ চাপার গন্ধ, কার্তিকের কুয়াশার মতো
 ভাসতো মৃত্যুর দেহের ঘ্রাণ। তার শরীরের করুণ মধুর ঘ্রাণ
একযুগ ধরে আমি শুকেছি সঙ্গীতে, পূর্ণিমার ভয়াবহ
 চাঁদে, ভাটিয়ালি গানে, মেঘ, শস্য, উথালপাথাল বৃষ্টি,
কবিতার পঙক্তি, খাদ্য, পানীয়, প্রতিটি কিশোরী
যুবতীর অসম্ভব, অসহ্য সৌন্দর্যে। তখন যৌবন
প্রেমে আমি আমার দু-কোটি হাতে সারা পৃথিবীকে জড়িয়ে ধরতাম।

এখন চল্লিশ পেরিয়েছি, জীবনের সারকথা কিছুটা বুঝেছি।
 এখন অনেকটা স্পষ্ট দেখতে পাই মানুষ ও সভ্যতার পরিণতি,
অনেকটা বুঝি শিল্পকলা আর অসম্ভব সৌন্দর্যের অর্থ
 অদ্ভুত আঁধারে ঘেরা মানুষের আবেগ, উৎসাহ, প্রেম, কাম ও কামনা।
 এখন আমার মাঝে মাঝে মৃত্যুর কথা মনে পড়ে;
মনে পড়লেই আমার ভেতরে কে যেনো হঠাৎ
 হো হো করে হেসে ওঠে, হো হো করে হেসে ওঠে।

*

একবার তাকাও যদি

একবার তাকাও যদি পুনরায় দৃষ্টি ফিরে পাবো।
বড়োবেশি ছাইপাশ দেখে দেখে দুই চোখে ছানি পড়ে গেছে
 যদি চোখ ফিরে পাই তবে শুধু একবার তাকাবো
তোমার মুখের দিকে, তারপর পুনরায় অন্ধ হয়ে যাবো।
একবার তাকাও যদি লোকোত্তর অসহ্য গর্বে
আমি আর কোনো দিকে তাকাবো না। যদি একবার তাকাও তবে
 বাঙলা কবিতার ওপর তার পাঁচশো বছর ধরে প্রভাব পড়বে।

*

চুপ ক’রে থাকার সময়

আজ চুপ ক’রে থাকার সময়। চুপ ক’রে দেখে যেতে হবে
 ঘাতকের শিল্পকলা। এই রক্ত, ছুরিকা, ও উন্মাদের অশ্লীল উৎসবে
হ’তে হবে নির্বাক দর্শক। দেখবো বান্ধব
অনুপস্থিত হয়ে গেছে, শুনে যাবো সংঘবদ্ধ দস্যুর কলরব
ঢেকে দিচ্ছে পাখির সঙ্গীত, জানি আমরণ
স’য়ে যেতে হবে রাজপথে শ্যামল শিখার মতো কন্যার বস্ত্রহরণ।
জানতে চাইবো না পুত্রের দ্বিখণ্ডিত লাশ
পড়ে আছে কোনখানে, দেখে যাবো দূরের আকাশ
কীভাবে উপড়ে ফেলে জল্লাদের সংখ্যাহীন অন্ধ উন্মাদ কুঠার।
 চুপ করে আশরীর বুঝে নেবো কী রকম ঠাণ্ডা ওই কুঠারের ধার।

*

চ’লে গেছো বহু দূর

চ’লে গেছো বহু দূর বহু রাজধানি
 তোমাকে হারানো তবু অসম্ভব মানি।
সকালে ক্ষুরের ক্রোধে কেটে গেলে গাল
ফিনকি দেয় যেই রক্ত তুমি তার লাল।
সিঁড়ি ভেঙে ঘরে ঢুকে যখন হাঁপাই
 ভাঙা হৃৎপিণ্ড জুড়ে তোমাকেই পাই।
যখন রক্তের ক্ষোভে কাঁপি থরথর
ধসে পড়ে ঘরবাড়ি অজস্র শহর,
লাভাগ্রস্ত লোকালয় জ্বলে ধিকিধিকি
 বুক ভরে বাজো তুমি দ্রিমিকি দ্রিমিকি।
 রক্ত আর মাংস জ্বলে চারদিকে দাহ
ধমনীতে টের পাই তোমার প্রবাহ।
পাই নি তোমাকে ঠোঁটে থরোথরো বুকে
তবু তো তোমাকে পাই সমস্ত অসুখে।

*

পার্টিতে

অজস্র গাড়ল চারদিকে, মাঝেমাঝে মানুষের
মুখ চোখে পড়ে একটি দুটি। বাতাসে কর্কশ ক্রোধ,
ফেটে পড়তে চায় জলবায়ু। স্কচের আভাস পেয়ে
অসুস্থ শরীরে এসেছেন শ্রীমধুসূদন, তাঁকে
 কেউ চিনতে পারছে না। এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন
নিঃসঙ্গ বঙ্কিম, একঝোঁপ দাড়ি সত্ত্বেও মহান
 রবীন্দ্রনাথকে একটি বালিকাও চিনতে পারছে না।
শক্ত দাঁড়িয়ে আছেন সুধীন্দ্রনাথ, খুব কাঁপছেন
 বুদ্ধদেব, নজরুল, একটি গাধাও তাদের চিনতে
 পারছে না। রঙিন একটা গর্দভকে নিয়ে ব্যস্ত পাঁচটি
 মাংসবতী গাভী, একটা ভাঁড়ের গায়ে ঝুলে আছে
গোটা দুই আধাপণ্যনারী, দশটি বালিকা আর
দুটি খোজা চুমো খায় নপুংসক নিমাইয়ের গালে।
পা ঘষছেন রবীন্দ্রনাথ, তবু কেননা এই
অট্টালিকা খড়ের গাদার মতো দাউদাউ জ্বলে উঠছে না!

*

আমি আর কিছুই বলবো না

যা ইচ্ছে করো তোমরা আমি আর কিছুই বলবো না।
 রক্তে সাজাও উঠোন, শিরচ্ছেদ করো জনকের,
কন্যাকে পীড়ন করো, আমি আর কিছুই বলবো না।
বাইরে বাগান করে অভ্যন্তরে কুটিল গোখরো
ছাড়ো, বান্ধবের পানীয়তে মেশাও ঘাতক বিষ,
সৌন্দর্য ধর্ষণ করো, আমি আর কিছুই বলবো না।
সত্যের বন্দনা করো দিবালোকে, মিথ্যার মন্দিরে
 গিয়ে পড়ে থাকো নষ্ট আঁধারের নিপুণ আশ্রয়ে,
 মঞ্চে স্তব করো মানুষের আর শাণাও কুঠার
সংযোপন ষড়যন্ত্রে, আমি আর কিছুই বলবো না।
পাঠ করো কপটতা, দিনে দানবকে দুয়ো দাও
রাতে বসো পদতলে, আমি আর কিছুই বলবো না।
দেখবো শিশুর মুখ বৃষ্টিধারা পাখির উড়াল
অথবা দু-চোখ উপড়ে মুখ ঘষবো সুগন্ধী মাটিতে।

*

পর্বত

ছোটোবেলায় উঠোনের কোণে স্বপ্নের মতো একরত্তি লাল
একটা ঘাসফুল দেখে বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম।
 তারপর কতো ভোরে সেই একরত্তি ফুল হয়ে উঠোনের কোণে
আমি অত্যন্ত নিঃশব্দে ফুটেছি।

আট বছর বয়সে আমার খুব ভালো লেগেছিলো ডালিমের ডালে
 ঘুমের মতোন বসে থাকা দোয়েলটিকে।
তারপর অসংখ্য দুপুরে আমি ঘুম হ’য়ে ডালিমের শাখায় বসেছি।

পুকুরে পানির সবুজ কোমল ঢেউ হয়েছি অজস্র সন্ধ্যায়।
মাঝপুকুরে বোয়ালের হঠাৎ ঘাইয়ে জন্ম নিয়ে টলমল করে গিয়ে
মিশেছি ঘাস, শ্যাওলা, কচুরিপানার সবুজ শরীরে।

মেঘ হয়ে কতো দিন উড়ে গেছি আড়িয়ল বিলের ওপর দিয়ে,
গলগলে গজল হ’য়ে কতো রাতে ঝরেছি টিনের চালে,
নৌকো হয়ে ভেসে গেছি থইথই ঢেউয়ের ওপর।
কতো গোধুলিতে তারা হয়ে ফুটেছি আকাশের অজানা কোণে।
দুঃখ হয়ে বসে থেকেছি পার্কের বিষণ্ণ গাছের নিচে।
অশ্রু হয়ে টলমল করেছি তার চোখের কোণায়।

কিন্তু আজ, এই অসম্ভব দুর্দিনে, একরত্তি ফুল, পাখি, মেঘ,
বৃষ্টি, ঢেউ, নৌকো, তারা, অশ্রু, বা কুয়াশা নয়
 আমি মাথা তুলছি উদ্ধত পর্বতের মতো। চারপাশে নষ্টদের রোষ,
আর শুয়োরের আক্রোশ, বিচিত্র পশুদের আক্রমণ মাথা কুটে
মরে পাদদেশে। আমি বেড়ে উঠছি অবিচল পর্বতের মতো, যখন আমার
 পাদদেশে পশুদের কোলাহল, তখন আমার গ্রীবা ঘিরে মেঘ,
 বুক জুড়ে বৃষ্টি, আর চুড়োর ওপর ঘন গাঢ় নীল!

*

কিছু কিছু সুর আমার ভেতরে ঢোকে না

নানান রকম সুর ওঠে চারপাশে। কিছু কিছু সুর গোলগাল,
কিছু সুর চারকোণা, ত্রিভুজ আর সরল রেখার মতো সুর শোনা যায়
কখনো কখনো। সিল্ক, গোলাপপাপড়ি, ধানের অঙ্কুর, গমবীজ,
পেপারওয়েট, ডাস্টবিন, সাঁকো, ইস্ত্রি, বিষণ্ণ বালিকার মতো
 সুর ওঠে মাঝে মাঝে। কিছু সুর রক্তাক্ত, অশ্রুসিক্ত, ভেজা, গাদা ফুলের মতোই
অত্যন্ত হলদে, গোলাপের মতো লাল আর পাখির বুকের মতো
কোমল মসৃণ কিছু সুর। প্রথাগতভাবে একটি নির্দিষ্ট ইন্দ্রিয় দিয়ে
আমরা ভেতরে গ্রহণ করি ওইসব স্বরসুর। অর্থাৎ আমরা সুর শুনি।
শোনা একটি অক্রিয় ক্রিয়া–শোনার জন্যে সক্রিয় হতে হয় না
আমাদের। শব্দের সীমার মধ্যে থাকলে শব্দ নিজেই সংক্রামিত হয়ে
 যায় আমাদের রক্তের ভেতরে। তবে কিছু কিছু সুর আমার ভেতরে
ঢোকে না। তা ছাড়া আমি শুধু শ্রুতি দিয়ে শুনি না সর্বদা। চোখ দিয়ে
আমি নিয়মিত সুর শুনি–সূর্যাস্তের চেয়েও রঙিন তরুণীদের চিবুক,
ওষ্ঠ থেকে যে-সুর বেরিয়ে আসে, তা শোনার জন্যে আমার অজস্র
চোখ আছে। কাউকে নিবিড়ভাবে ছুঁলে শোনা যায় শোনা-অসম্ভব
স্বরসুর, ওই সুর এতো উচ্চ, এতো তীব্র, এতো দীর্ঘ, এতোই রঙিন
আর গভীর যে ওই সুর কান দিয়ে শোনার চেষ্টা করলে কানের পর্দা
ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। শুধু স্পর্শেরই রয়েছে অশ্রুতকে
শোনার প্রতিভা। লিলিআনকে প্রথম ছোঁয়ার কালে আমি যে-সুর শুনতে পাই
তা আমি কানে শোনার সাহস করি না। আমি কি অসংখ্য আণবিক বিস্ফোরণ
সম্ভোগের শক্তি রাখি? বহু সুর ঢোকে আমার ভেতরে, কিন্তু কিছু কিছু
সুর কিছুতেই আমার ভেতরে ঢোকে না। বীজ ছড়ানোর পর জমি যখন সবুজ
 সুরে মেতে ওঠে খুবই নীরবে, আমার ভেতরে সে-সুর সহজে ঢোকে।
নিঃসঙ্গ দিঘির পারে হিজলের সুর শুনি আমি প্রতিদিন হিজলের ছায়া
থেকে পঁচিশ বছর ধরে সুদূরে থেকেও। মাঝিদের গলা থেকে ঝরে-পড়া
ভাটিয়ালি আমার শরীরে ঢোকে জোয়ারের জলের মতোই। কিন্তু ধ্রুপদী
সুরমালা কিছুতেই ভেতরে ঢোকে না। আমি একবার সন্ধ্যে থেকে
সারারাত চেষ্টা করেছি আমার শরীর বা আত্মার ছিদ্র দিয়ে ওই
অলৌকিক স্বরমালা ভেতরে ঢোকাতে। সারারাত আমার শরীর,
আমার নির্বোধ আত্মা বন্ধ ও বধির হয়ে থাকে। ট্রাকের চাকার সুর
আমার ভেতরে ঢোকে অনায়াসে–মৃত্যু, মৃত্যু, মৃত্যু, সুর শহর–নগর
মহাকাল চুরমার করে ঢোকে অত্যন্ত ভেতরে; যেমন অনন্তকাল ভালোবাসি,
 ভালোবাসি, ভালোবাসি সুর তুলে আমার ভেতরে ঢোকে গীতবিতানের
পাতা। উদ্ভট, অসম্ভব, পাগল-মাতাল কবিতার সুর আমার ভেতরে,
ঢোকে, কিন্তু প্রথাগত জীর্ণ পদ্যের সুর কিছুতেই ভেতরে ঢোকে না।
জীর্ণ পদ্যের মতো একনায়কের গলা থেকে কেরোসিন, কংক্রিট, পিচ,
কাঠের মতোন বের হয়ে আসা সুরও আমার ভেতরে ঢোকে না। বন্দুকের
নলে যুগ যুগ কান পেতে থেকেও কখনো আমি কোনো সুর শুনতে পাই নি।
বন্দুকের সম্ভবত কোনো সুরতন্ত্রি নেই। কিছু কিছু বিখ্যাত বইয়ের
সুরও আমার ভেতরে ঢোকে না। ওই সব বই খুলে পাতায় পাতায় আমি
কান পেতে থেকেছি কয়েক জন্ম কিন্তু আমার ভেতরে সে-সবের কোনো
সুরই ঢোকে নি। সুর ওঠে, সুর ওঠে, সুর ওঠে চারদিকে
 নারীর সোনালি সুর, শস্যের রক্তিম সুর, শিল্পের আশ্চর্য সুর, প্রগতির
মানবিক সুর, মাটির মধুর সুর, প্রতিক্রিয়া-শোষণের দানবিক সুর।
সুর ওঠে, সুর ওঠে, সুর ওঠে চারপাশে–মাংসের কাতর সুর,
রক্তের পাগল সুর, শজির সবুজ সুর, ঠোঁটের তৃষ্ণার্ত সুর, রাত্রির গোপন
 সুর, প্লাস্টিকের শুষ্ক সুর, হোটেলের হাহাকার করা সুর। আমি
অনেক দেখেছি প্রায় সব সুরই আমার ভেতরে ঢোকে, শুধু প্রথা
ও প্রতিক্রিয়ার কালো দানবিক সুরগুলো কিছুতেই আমার ভেতরে ঢোকে না।

*

সাফল্যব্যর্থতা

আমার ব্যর্থতাগুলোর কথা মনে হলে
আমার দু-চোখে কোনো জলই জমে না।
 বুক থেকে ঠাণ্ডা নদীর মতো বেরিয়ে আসে না দীর্ঘশ্বাস।
আমার সাফল্যগুলোর কথা মনে হলেই
চোখে মেঘ জমে, বুকে দেখা দেয় কালবোশেখির হাহাকার।

*

কোনো অভিজ্ঞতা বাকি নেই

কে বলে আমার আণবিক বিস্ফোরণে ছাই হয়ে যাওয়ার
অভিজ্ঞতা নেই? অভিজ্ঞতা নেই তুষারধসের?
 আকণ্ঠ গরল পানের পরম অভিজ্ঞতা কে বলে আমার নেই?
কোব্রার দংশন কে বলে জানি না আমি?
 কে বলে উদ্বাস্তুর যন্ত্রণা আমি কখনো জানি নি?
এবং কে বলে আমার অভিজ্ঞতা নেই লক্ষ বছর ধরে স্বর্গবাসের?
তোমার সঙ্গে, মেয়ে, সাক্ষাতের পর
 বিস্ফোরণ থেকে স্বর্গবাসকে তো খুবই সামান্য, প্রাত্যহিক
অভিজ্ঞতা বলে মনে হয়।

*

বন্যা ১৯৮৮

কিছু কিছু ভয়ঙ্করের জন্যে আমার মোহ আছে।
এমনকি ভালোবাসাও রয়েছে। ঝড়, দাবানল, বজ্রবিদ্যুৎ
আমাকে মোহিত করে। আমি মনে মনে এসবের
 স্তব করে থাকি। বন্যা আমার প্রাকৃতিক দেবতাদের একজন।
বন্যার কথা ভাবতেই এক প্রচণ্ড–বিশাল–মহৎ
 সুন্দরের স্রোত আমাকে প্লাবিত আচ্ছন্ন করে; আমি তার
আদিম ঐশ্বর্যে খড়কুটোর মতো ভেসে যাই। নুহের প্লাবনের গল্প
আমি প্রথম যখন শুনেছিলাম, আমার তখন
খুব ইচ্ছে হয়েছিলো ওই প্লাবনের সাথে ভেসে যেতে। আমি যদি
তখন থাকতাম, তাহলে নুহের নৌকোয় উঠতে
অনিচ্ছা প্রকাশ করতাম। ছেলেবেলায় একবার বন্যা দেখেছিলাম
 যেনো মাটি আর বস্তু আর মানুষের আশ্চর্য স্বাদ
 পেয়েছে জলের জিভ, এমনভাবেই বাড়ছিলো জলের প্রবল সত্তা।
আমাদের বাড়িতে পানি উঠলো, আমরা ঘরে
উঠলাম। বুক জুড়ে ভয়, কিন্তু ভয়ের মধ্যেই আমি জলের রূপের
দিকে তাকিয়ে ভয়ঙ্কর মুগ্ধ হলাম। তারপর ছোট্ট নৌকো
নিয়ে কত দিন ভেসে গেছি বন্যার জলে।
আমাদের কাজের মেয়েটিকে একদিন আমি ওই জলের দিকে
এমনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিলাম, মনে হয়েছিলো ও এখনি
ঝাঁপিয়ে পড়বে ঢেউয়ের বুকের ওপর। চারদিকে মানবিক
অসহায়ত্বের মধ্যেও ছড়িয়ে ছিলো আশ্চর্য
 অসহ্য সুন্দর। আটাশির এই প্রচণ্ড বন্যায় ভাসছে বাড়ি, ঘর
পশু ও মানুষ। জলের কি দোষ আছে? জলের শুধু স্বভাব
রয়েছে। জলকে যেতেই হবে সমুদ্রের দিকে, সমুদ্রযাত্রায় জল কোনো
 বাধাই মানে না। ওই শক্তিমান সহজেই তৈরি করতে পারে
 পথ, শহরকে রূপান্তরিত করতে পারে থইথই সাগরে।
তাই তো তার পথ আজ কৃষকের কুঁড়েঘর, ধনীর দোতলা, পৌরসভা,
 ঝকমকে শহর, আর তথাকথিত তিলোত্তমা রাজধানি।
বন্যা কি শত্রু? যে-বন্যা হানা দেয় গুলশান, বারিধারা আর
উত্তরপাড়ায় তাকে কি শত্রু ভাবা যায়?
 একাত্তরে একবার আশ্চর্য বন্যা এসেছিলো, ওই বন্যায় ভেসে
গিয়েছিলো পাকিস্তান নামক একটা নোংরা বাঁধ।
আটাশির বন্যা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে এক গভীর বন্যার
কথা। বন্যা এলে হেলিকপ্টার ওড়ে, কিন্তু আজ
 এমন একটা প্রবল বন্যা দরকার যাতে বাঙলার মাটিতে কোনো
একনায়কের হেলিকপ্টার নামতে না পারে।
 পানি কোথা থেকে এসেছে, তা নিয়ে বেশ তর্ক হচ্ছে আজকাল
 নষ্ট রাজনীতিক আর পচা পানিবিশেষজ্ঞরা
 এরই মাঝে ঘোলা করে ফেলেছে বন্যার বিস্তৃত জল। কেউ বলে,
 পানি ভারত থেকে, হিমালয় থেকে এসেছে, কেউ আবার
পানির ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়। হিমালয়, অত্যন্ত দূরে,
 এ জন্যে আমার খুবই দুঃখ হয়। আমার তো মনে হয়, এখুনি
 আমাদের দরকার একটা একান্ত নিজস্ব হিমালয়।
পরদেশি প্লাবনে নয়, আমরা নিজদেশি প্লাবনে ভাসতে চাই।
আমাদের হিমালয় নেই বলে আমাদের এখনি
 সৃষ্টি করা দরকার একটা নিজস্ব হিমালয়–স্রোত আর প্লাবনের
অনন্ত উৎস। কোথায় পাবো সেই হিমালয়?
আমি স্বপ্ন দেখি–দশকোটি বাঙালি কঠিন বরফের মতো জমে
 গড়ে তুলছে একটি বিশাল বঙ্গীয় হিমালয়। একদিন
বরফ গলতে শুরু করবে সেই গণহিমালয়ের চূড়োয়, প্রবল বর্ষণ
 শুরু হবে পাদদেশে। গণহিমালয়ের গণবন্যায়
 ভাসবে গ্রাম, উপজেলা, শখের রাজধানি, খড়ের কুটোর মতো
 ভেসে যাবে শিরস্ত্রাণ, রাষ্ট্রধর্ম, জলপাইরঙ,
 সাজানো তোরণ, সচিবালয়, শুয়োরের ঘৃণ্য খোয়াড়।
 প্লবনের ভেতর থেকে জেগে উঠবে বাঙলাদেশ :
 পলিমাটির ওপর বাতাসে থরোথরো ধানের অঙ্কুর।

*

শিশু ও যুবতী

শিশু আর যুবতীর মধ্যে আশ্চর্য মিল রয়েছে।
 শিশুদের গাল লাল, যুবতীদের গালও লাল।
 শিশুদের ঠোঁট থেকে সোনা ঝরে,
 যুবতীদের ঠোঁট থেকেও গলগল করে সোনা ঝরতে থাকে।
শিশুরা নিজেদের মূল্য বোঝে না,
 যুবতীরাও মূল্য বোঝে না নিজেদের।
শিশুরা খুব সাবধানে ভুল জায়গায় পা ফেলে,
যুবতীরাও ভুল জায়গায় পা ফেলে নির্দ্বিধায়।
শিশু আর যুবতীর মধ্যে আশ্চর্য মিল রয়েছে।
 শিশু আর যুবতী দেখলেই দু-হাতে বুকের গভীরে টেনে
চুমোতে চুমোতে চুমোতে চুমোতে আদরে আদরে
আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়।

*

হ্যামেলিনের বাঁশিঅলার প্রতি আবেদন

ইঁদুরে ভরেছে রাজধানি, একথা বাস্তবিকই ঠিক।
আমাদের ঘর, বাড়ি, গলি, যুঁজি, অর্থাৎ চতুর্দিক
 ইঁদুরের অধিকারে : টেবিলের ওপরে ও নিচে,
 বইয়ের ভেতরে, বাক্সে, আলমারি, পেয়ালা, পিরিচে
ইঁদুরের বসবাস। কোনটি খেলনা কোনটি পুতুল
 বুঝে উঠতে খেলনাপ্রিয় শিশুদেরও হয়ে যায় ভুল
আজকাল। একদা নারীদের শিরে ছিলো মনোলোভা
 খোঁপা, সেখানে এখন শুধু ধেড়ে ইঁদুরের শোভা।
 ট্রাউজার বা জ্যাকেটের অভ্যন্তর থেকে অতিকায়
 ইঁদুর বেরিয়ে আসে; মেয়েদের ব্লাউজে, সায়ায়
ঢুকে থাকে ইঁদুরেরা। নিরূপায় সব–কে করবে সাহায্য
আমাদের রাজধানি আজ এক ইঁদুরসাম্রাজ্য।
 আমাদের বস্তুলোক জুড়ে ইঁদুরেরই আধিপত্য;
স্বপ্নেও আমরা ইঁদুরই দেখি, এও যথার্থই সত্য।

শুধু ইঁদুরই বা কেননা, কতো না বিচিত্র জন্তু
ঘোরে চারদিকে, আর আমাদের স্নায়ু-পেশি-তন্তু
 ছিঁড়ে ফেলে খুশিমতো। কতো বাঘ, খট্টাশ, গণ্ডার
 প্রবল প্রতাপে চলে রাজপথে; আমরা যার যার
প্রাণ নিয়ে টিকে আছি কোনোমতে, যদিও অনেকে
 ঘর থেকে বেরিয়েই নিরুদ্দেশ হয় রাস্তা থেকে।
পথে পথে অজগর; শহরে আমরা যারা আছি
 ওইসব প্রাণীদের কৃপায়ই তো কোনো মতে বাঁচি।
এমনকি আমাদের গৃহপালিত সারমেয়গণ
প্রচণ্ড প্রতাপে করে আমাদেরই প্রত্যহ শাসন।
 শুধু রাজধানি কেনো, আমাদের সংখ্যাহীন গ্রামে
শস্যক্ষেত্রে, আর কৃষকের ঘরে দলে দলে নামে
ইঁদুরবাহিনী। কৃষাণী ও কৃষককন্যার চুলে
নষ্ট শসার মতো দিনরাত সারি সারি ঝুলে
 থাকে ইঁদুরেরা–কুমড়ো খেতে পাকা কুমড়োর বদলে
শুয়ে থাকে ইঁদুরেরা–সব কিছু তাদেরই দখলে।
চাষীদের জীবনে এখন ইঁদুরই সর্বময়,
এমনকি আকাশকেও বিশাল উঁদুর মনে হয়।
শুধু ইঁদুরই বা কেনো, আমাদের গ্রামেও এখন
 ব্যতিক্রমহীন প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর শাসন।

তবে ইঁদুর বা জন্তুরা প্রধান সমস্যা নয় আজ।
যাদের পায়ের তলে পড়ে আছে সমগ্র সমাজ,
সমস্যা তারাই। আজ আমাদের কোনো পৌরপতি
 প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না কোনো; সত্য নাম্নী সতী
 কলুষিত তাদেরই সহবাসে। তাদের নিশ্বাসে
 দূষিত হচ্ছে আত্মা মানুষের; বিষাক্ত বাতাসে
 কেঁপে উঠছে রাজধানি। তারা যে দূনীতিপরায়ণ
এটা বলাই যথেষ্ট নয়, তারা অশুভপ্রবণ।
তারা লিপ্ত নানাবিধ পাপে;–সমস্ত সত্যকে তারা
করেছে বর্জন, আর কল্যাণকে করেছে দেশছাড়া
 বহু দিন। পৌরপতিদের পাপে পুষ্পের মুকুল,
 ঝরে যায় ফোঁটার অনেক আগে, খেলার পুতুল
 কেঁদে ওঠে শিশুদের কোলে; সেই জলভরা নদী
শুকোচ্ছে প্রত্যহ, একদা যা দেশে বইতে নিরবধি।
 পৌরপিতাদের পাপে কমছে সূর্য ও চন্দ্রের আলো,
 ধীরে ধীরে পবিত্র গ্রন্থের পাতা হয়ে যাচ্ছে কালো
 তাদের নিশ্বাসে। আমাদের যতো বাগানের গাছে
ফলের বদলে নোংরা আবর্জনা সব ঝুলে আছে
 দিকে দিকে। পৌরপিতাদের পাপে, মিথ্যাচারে ক্ষয়ে
যাচ্ছে মাটি, জ্ঞানের সমস্ত শিখা নিভছে বিদ্যালয়ে।
 নষ্ট হচ্ছে তরুণেরা, সুনীতিকে করছে বর্জন,
তাদেরও প্রিয় আজ হত্যাকাণ্ড, হরণ, ধর্ষণ।
এ-সবেরই মূলে আছে আমাদের সব পৌরপতি,
 পালন করে না যারা সত্য, আর কোনো প্রতিশ্রুতি।

আমরা তো নষ্ট হয়ে গেছি নষ্ট হঁদুরেরই মতো।
 তবুও আশ্চর্য! আমাদের ঘরে আজো জন্মে শতো
শতো নিষ্পাপ পুষ্পের মতো শিশু, যাদের অম্লান
 হাসিতে ঝিলিক দেয় সত্য, ঝরে শান্তি ও কল্যাণ।
তারাও তো নষ্ট হবে নষ্ট পৌরপিতাদের পাপে,
যেমন হয়েছি নষ্ট আমরা সামাজিক অভিশাপে।
বাঁশিঅলা তুমি একবার এসেছিলে হ্যামেলিনে,
 এ-সংবাদ জানে সবে পৃথিবীতে–পেরু থেকে চীনে
 জানি তুমি বেদনাকাতর, তবু আর একবার
এসো, এ-শহরে, করো আমাদের উজ্জ্বল উদ্ধার।
 তুমি এসে শহরকে ইঁদুরের উৎপাত থেকে
উদ্ধার করবে, তা চাই না। কেননা ইঁদুর দেখে দেখে
 সহ্য হয়ে গেছে আমাদের। তুমি পবিত্র বাঁশিতে
সুর তোলো, আমাদের শিশুগণ পবিত্র হাসিতে
 বের হোক গৃহ থেকে। তোমার বাঁশির সুরে সুরে
তোমার সঙ্গে তারা চলে যাক দূর থেকে দূরে
কোনো উপত্যকা বা পাহাড়ের পবিত্র গুহায়
পৌরপিতাদের পাপ যেনো না লাগে তাদের আত্মায়।
শিশুদের শোকে কষ্ট পাবো, তবু সুখ পাবো বুকে
নষ্ট হয় নি তারা আমাদের মতন অসুখে!

*

শামসুর রাহমানকে দেখে ফিরে

চৈত্রের কর্কশ বিকেলে ষোলো নম্বর কেবিনের দরোজায়
গিয়ে দাঁড়ালাম, দেখলাম শামসুর রাহমান, আপনি ঘুমিয়ে আছেন,
দারুণ খেলার শেষে শ্রান্ত শিশুর মতো। আপনার
হাঁ-খোরা মুখগহ্বর ভ’রে গুমোট আবহাওয়া। যে-অমল বাতাসের
 স্তব করছেন আপনি বত্রিশটি কাব্যগ্রন্থের ষোলো শো
 কবিতা জুড়ে, তার কূট ষড়যন্ত্রে ভয়াবহ পর্যদস্ত আপনার সমগ্র
 কাঠামো। আপনার বুকের ওপর জিভ বের করে
ঝুঁকে বসে আছে সেই কুখ্যাত আঁধার, যার হিংস্র নখের থাবায়
হৃৎপিণ্ড চিৎকার করে ওঠে বুনো শুয়োরের মতো।
আপনার মগজে হয়তো তখন রঙিন আঁচল উড়োচ্ছিলো
 রূপসী কবিতা; তার ওষ্ঠের অসহ্য আদরে ও আলিঙ্গনে কেঁপে
 উঠছিলেন আপনি অপ্রাপ্তবয়স্ক প্রেমিকের মতো। হয়তো
 দুঃস্বপ্নে দেখছিলেন আপনার গৃহপরিচারক কিশোরটি
রবীন্দ্রনাথের রূপ ধরে আপনার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে তার
কল্যাণকম্পিত হাত। হয়তো দেখছিলেন সারিসারি ট্যাংক
 বাঙলার গ্রামগঞ্জ ধানক্ষেত কৃষকের
সামান্য উঠোন সংখ্যাহীন অতিকায় কিস্তুত ট্যাংকের নিচে
 চাপা পড়ে যাচ্ছে দ্রুত; দেখছিলেন দিকে দিকে চৌকশ
কুচকাওয়াজ; আর বাঙলার প্রতিটি সড়ক বেয়ে গলগল করে
ব’য়ে যাচ্ছে নামপরিচয়হীন শহিদের রক্তের ঢল; এবং সমস্ত
 দুর্দশা, রক্তপাত, বিক্ষোভ, প্রগতি ও প্রতিক্রিয়াশীলতার মাথার ওপর
পদ্মের মতোন পা রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক আশ্চর্য রূপসী।

শামসুর রাহমান, যখন আপনার রক্ত আর বুক জুড়ে
 থরোথরো প্রেম আর প্রতিবাদী বিদ্রোহী রাজনীতি, তখনি
 হাসপাতাল ডাকলো আপনাকে। আপনার বুক ভরে
জন্ম নিলো ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলব্যাপী বিষণ্ণ বাঙলাদেশের
 মতো ভয়াবহ ব্যাধি। ভয়ানক অসুস্থ আপনি, তবে
একা আপনিই অসুস্থ নন শুধু, আমি নিজেও তো বার বার
 কেঁপে উঠি প্রচণ্ড ব্যথায়, বুকে হাত চেপে বসে পড়ি,
যেনো ভূমিকম্প হচ্ছে সৌরলোক জুড়ে। শাসুর রাহমান,
আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমাদের বিপন্ন বিষণ্ণ বাঙলায় আজ
প্রতিটি প্রকৃত মানুষই অসুস্থ, যাদের হৃদয়ে কাঁপে মানবিক
 জ্যোৎস্না, যারা মুগ্ধ হয় পালতোলা নৌকো আর সবুজ পাতার
 শিহরণে, যারা হাহাকার করে ওঠে ব্যাপক পাশবিকতা
 দেখে, তারা সবাই অসুস্থ। এখন অসুস্থ ওই দূরের নীলিমা, নদী,
ধানের গুচ্ছ, বাঁশের বাশরী ও কবিতার প্রতিটি স্তবক।
শুধু সুস্থ আজ পাড়ার মাস্তান, গুণ্ডা, খুনি, ছিনতাইকারী, সুস্থ
 তারা যাদের মগজ ও হৃৎপিণ্ড অবস্থিত প্রচণ্ড পেশিতে।
 আপনি যদি স্বপ্ন আর শব্দের শোভার জন্যে উৎসর্গ না করতেন
 এতোগুলো সংরক্ত দশক, যদি যত্নে বানাতেন পেশি,
 আপনি হতেন যদি উৎকোচনিমগ্ন আমলা, চোরাকারবারি,
পেশাদার রাজনীতিক দালাল; দশকে দশকে যদি অপদেবতাদের
 প্রণাম করতে পারতেন নির্দ্বিধায়, যদি মানুষের সঙ্গ ছেড়ে
 সংঘবদ্ধ হতে পারতেন দানবদের সাথে, তাহলে এমন অসুস্থ
হতে হতো না আপনাকে। মানুষই অসুস্থ হয়
দানবেরা কোনো কালে কখনোই অসুস্থ হয় না।

সম্প্রতি আপনি খুব আশাবাদী আর প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন।
 কিন্তু আপনি কি জানেন যে আমরা কোথাও নেই? যারা
স্বপ্ন দেখে সুন্দরের, পচে যাওয়া সমাজ-রাষ্ট্রকে যারা গোলাপের
 মতো সুন্দর দেখতে চায়, যারা মনুষ্যত্ব-মানবিকতাকে
ভোরের আলোর মতো সত্য বলে মানে, আপনি কি জানেন তারা
কোথাও নেই? আমরা তো উদ্বাস্তুর মতোই রয়েছি বাঙলায়।
 আপনি কি খুব জোর দিয়ে বলতে পারবেন যে আপনার
পায়ের নিচের মাটি খুবই শক্ত? শক্ত মাটি তো শুধু নষ্টদের
পদতলে। আমরা, শামসুর রাহমান, চোরাবালির ওপর
 দাঁড়িয়ে রয়েছি। পচা অমরতা ধুয়ে ধুয়ে খেয়ে বেঁচে থাকতে
 চান আপনি লোকন্তরিত হওয়ার পর? তাও মিছে স্বপ্ন আজ,
বাঙলায় এখন নষ্টরাই অমর ও প্রাতঃস্মরণীয়। আপনাকে,
 আমাকে সমকাল প্রত্যাখ্যান করেছে, ভবিষ্যও অবলীলায়
আমাদের প্রত্যাখ্যান করে কোলাহল করবে নষ্টদের নিয়ে।
তাকিয়ে দেখুন, আপনি কোথায় আর সারাদেশ যাচ্ছে কোন দিকে।
 কেনো অকস্মাৎ থেমে যায় রাস্তার গণজাগরণ? কারা লিপ্ত
 ষড়যন্ত্রে, কেননা ব্যর্থ হয় শহিদের উদার রক্ত?
আশা কি এখনো আপনাকে নর্তকীর মতোন নাচায়?
শামসুর রাহমান, আপনি যখন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসবেন
 তখন ঢুকবেন এক বিশাল হাসপাতালে, দেখবেন দুরোরোগ্য
 বক্ষব্যাধিতে আক্রান্ত সমগ্র বাঙলা, তার মাটি নদী ও আকাশ।

*

বন্ধুরা, আপনারা কি জানেন আপনারা শোষণ উৎপাদন করছেন

ঘামে গোশল করা, কালিঝুলিমাখা আমার প্রিয় শ্রমিক বন্ধুরা,
আমার আদমজির বন্ধুরা,
ডেমরার বন্ধুরা,
টঙ্গির বন্ধুরা,
খালিশপুরের বন্ধুরা,
 আপনাদের সাথে আমার কিছু কথা আছে। তবে আপনাদের সাথে
আমার দেখা হওয়ার কোনো উপায়ই নেই। এই সমাজ
এই রাষ্ট্র আপনাদের ও আমার মধ্যে
তুলে দিয়েছে
আকাশের সমান উঁচু আর পাথরের থেকে শক্ত আর মৃত্যুর চেয়ে
হিংস্র নির্মম দেয়াল। ওই দেয়ার পেরিয়ে আপনারা
আমার দিকে আসতে পারেন না, আর আমি যেতে পারি না
আপনাদের দিকে। আমার চুলের ভাঁজ,
শার্টের রঙ,
আর কথা বলার ভঙ্গি থেকেই বুঝতে পারছেন আমরা পরস্পরের
থেকে কতো দূরে। আমরা দেয়ালের এপারে ও-পারে।
 এই ধরুন রোম্যানটিসিজম শব্দটি আপনারা কেউ শোনেন নি,
 বোদলেয়ারের নাম আপনারা জানেন না,
শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঘরে আপনারা কেউ কোনো দিন ঘুমোন নি।
 আর আমি জানি না হুইশালের শব্দে লাফিয়ে ছুটতে কেমন লাগে,
আমি জানি না বস্তিতে ঘুমোতে কেমন লাগে,
 আমি জানি না খালিপেটে থাকার অভিজ্ঞতাটা কেমন।
বন্ধুরা, আপনাদের ও আমার মধ্যে হিংস্র দেয়াল
এই রাষ্ট্র এই সমাজ।
তবু আপনাদের সাথে আমার কিছু কথা আছে। জানি না
 আমার সাথে আপনাদের কোনো কথা আছে কিনা?
বন্ধুরা একঝক পিঁপড়ের মতো আদমজির বন্ধুরা
বন্ধুরা, একপাল ক্রীতদাসের মতো ডেমরার বন্ধুরা
 বন্ধুরা, একদল দণ্ডিতের মতো টঙ্গির বন্ধুরা
 খালিশপুরের,
রাজশাহির,
চাটগাঁর বন্ধুরা,
আপনারা কি জানেন আপনারা শোষণ উৎপাদন করছেন?
আপনাদের বলা হয় আপনারা উৎপাদন করছেন সম্পদ।
কিন্তু আপনারা কি জানেন কী ভয়াবহ, নিষ্ঠুর,
দানবিক সম্পদ আপনারা উৎপাদন করে চলেছেন শরীরের রক্ত
 ঘামে পরিণত করে? বন্ধুরা, প্রিয় শ্রমিক বন্ধুরা,
আপনারা দিনের পর দিন উৎপাদন করে চলেছেন শোষণ।
আপনারা যখন সুইচ টিপে একটা কারখানা চালু করেন
 তখন আপনারা চালু করেন একটা শোষণের কারখানা।
 এই সমাজে এই রাষ্ট্রে
একটা চাকা ঘোরার মানে হচ্ছে
 একটা ক্রুর শোষণের চাকা ঘোরা। এই সমাজে এই রাষ্ট্রে
একটি বেল্ট গতিশীল
হওয়ার অর্থ হচ্ছে শোষণের একটা দীর্ঘ বেল্ট গতিশীল হওয়া।
 এই সমাজ এই রাষ্ট্র একটা বিশাল শোষণের কারখানা।
যখন কারখানার যন্ত্রপাতি থেকে ঝকঝক ঝিকঝিক শব্দ ওঠে তখন কি
আপনারা শুনতে পান না শোষণ, আরো শোষণ বলে
 উল্লাসে চিৎকার করছে পুঁজিপতিদের আত্মা? এই সমাজে এই রাষ্ট্রে
যে-কোনো উৎপাদনই হচ্ছে ভয়াবহ হিংস্র শোষণ-উৎপাদন।
 যখন আপনারা ব্লো-রুমে তুলো উড়োন,
কার্ডিং করেন, টাকুতে সুতো প্যাচান,
একটার পর একটা মাকু চালু করেন,
তখন আপনারা নিজেদের অজান্তে চালু করেন স্বেচ্ছাচারী স্বয়ংক্রিয় শোষণ।
যখন আপনারা একগুচ্ছ সুতো তৈরি করেন,
তখন আপনারা উৎপাদন করেন একগুচ্ছ শোষণ।
যখন আপনারা এক বেল কাপড় উৎপাদন করেন,
তখন আপনারা উৎপাদন করেন এক বেল শোষণ।
 যখন আপনারা এক পাউণ্ড চা উৎপাদন করেন,
তখন উৎপাদন করেন এক পাউণ্ড কালচে শোষণ।
 আপনাদের ঘামে যখন তৈরি হয় একটি সুতোর তন্তু
 তখন পুঁজিপতির ঝকঝকে টেবিলে আসে এক ক্যান ঠাণ্ডা বিয়ার।
আপনাদের রক্তে যখন তৈরি হয় আধখানা শাড়ি
তখন গুলশানের পুঁজিপতির শীতল সেলারে ঢোকে এক বাক্স স্কচ।
 যখন আপনারা একটি পুরো শাড়ি বানান,
তখন তার দরোজায় হাজির হয় ঝকঝকে নতুন মডেলের একটা জাপানি গাড়ি।
যখন এক ট্রাক পণ্য বেরিয়ে যায় কারখানার গেইট দিয়ে,
তখন সে নিউইয়র্কের অভিজাত এলাকায় কেনে একটা সুরম্য প্রাসাদ।
কিন্তু তখন আপনাদের পেট খালি,
আপনাদের স্ত্রীদের শরীর উদোম
আর চাষীদের ঘরে ঘরে হাহাকার। অর্থাৎ বন্ধুরা,
আপনারা যখন উৎপাদন করেন, তখন উৎপাদন করেন কুৎসিত শোষণ।
 কিন্তু এই রাষ্ট্র এই সমাজ আপনাকে তা বুঝতে দেবে না, শুধু গোপনে গোপনে
দশকোটি মানুষকে শোষণের শেকলে জড়াবে।
বন্ধুরা, যখন আপনারা একটা সুইচ বন্ধ করেন তখনই
 আসল উৎপাদন করেন আপনারা। তখন আপনারা উৎপাদন করেন।
শোষণ
থেকে
মুক্তি।
একটা সুইচ বন্ধ করলে আপনারা
শোষণের একটা সুইচ বন্ধ করেন।
একটা চাকা বন্ধ করলে
আপনারা শোষণের একটা চাকা বন্ধ করেন।
 একটা বেল্ট বন্ধ করলে
আপনারা শোষণের একটা বেল্ট বন্ধ করেন।
একটা কারখানা বন্ধ করলে আপনারা বন্ধ করেন একটা শোষণের কারখানা।
আর যখন আপনারা ডাকেন ধর্মঘট, হরতালে যান, শহরের পর
শহর আর রাষ্ট্র জুড়ে বন্ধ করে দেন কারখানার পর
কারখানা, সমস্ত চাকা বন্ধ করে দেন ডেমরায়, আদমজিতে,
 খালিশপুর আর টঙ্গিতে তখন সারা রাষ্ট্রের শোষণ ব্যবস্থাকে
বন্ধ করে দেন আপনারা। আর তখনি আপনারা উৎপাদন করেন
আসল সম্পদ। সেই সম্পদের নাম
শোষণ
থেকে
মুক্তি।
বন্ধুরা, যখন আপনারা শোষণ উৎপাদন বন্ধ করে
 শোষণ-থেকে-মুক্তি উৎপাদন করতে থাকবেন
 দিনের পর দিন
সপ্তাহের পর সপ্তাহ
মাসের পর মাস
 তখন বন্ধ হয়ে যাবে শোষণের সবচেয়ে বড়ো কারখানা,
যার নাম পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। আর তখন দিকে দিকে
 বাঙলার মেঘে মেঘে নদীতে নদীতে খেতে খেতে মাঠে মাঠে
ঘরে ঘরে কারখানায় কারখানায় সোনার সুতোর মতো উৎপাদিত
হ’তে থাকবে
শোষণ-থেকে-মুক্তি
শোষণ-থেকে-মুক্তি
আর শোষণ-থেকে-মুক্তি…

*

গোলামের গর্ভধারিণী

আপনাকে দেখি নি আমি; তবে আপনি আমার অচেনা
নন পুরোপুরি, কারণ বাঙলার মায়েদের আমি
 মোটামুটি চিনি, জানি। হয়তো গরিব পিতার ঘরে
বেড়ে উঠেছেন দুঃখিনী বালিকারূপে ধীরেধীরে;
দুঃখের সংসারে কুমড়ো ফুলের মতো ফুটেছেন
 ঢলঢল, এবং সন্ত্রস্ত করে তুলেছেন মাতা
 ও পিতাকে। গরিবের ঘরে ফুল ভয়েরই কারণ।
তারপর একদিন ভাঙা পালকিতে চেপে দিয়েছেন
পাড়ি, আর এসে উঠেছেন আরেক গরিব ঘরে;
স্বামীর আদর হয়তো ভাগ্যে জুটেছে কখনো, তবে
অনাদর জুটেছে অনেক। দারিদ্র্য, পীড়ন, খণ্ড
প্রেম, ঘৃণা, মধ্যযুগীয় স্বামীর জন্যে প্রথাসিদ্ধ
ভক্তিতে আপনার কেটেছে জীবন। বঙ্গীয় নারীর
 আবেগে আপনিও চেয়েছেন বুক জুড়ে পুত্রকন্যা,
আপনার মরদ বছরে একটা নতুন ঢাকাই
 শাড়ি দিতে না পারলেও বছরে বছরে উপহার
 দিয়েছেন আপনাকে একের পর এক কৃশকায়
 রুগ্ন সন্তান, এবং তাতেই আপনার শুষ্ক বুক
ভাসিয়ে জেগেছে তিতাসের তীব্র জলের উচ্ছ্বাস।
চাঁদের সৌন্দর্য নয়, আমি জানি আপনাকে মুগ্ধ
আলোড়িত বিহ্বল করেছে সন্তানের স্নিগ্ধ মুখ,
আর দেহের জ্যোৎস্না। আপনিও চেয়েছেন জানি
 আপনার পুত্র হবে সৎ, প্রকৃত মানুষ। তাকে
দারিদ্র্যের কঠোর কামড় টলাবে না সততার
পথ থেকে, তার মেরুদণ্ড হবে দৃঢ়, পীড়নে বা
প্রলোভনে সে কখনো বুতদের সেজদা করবে না।
আপনার উচ্চাভিলাষ থাকার তো কথা নয়, আপনি
 আনন্দিত হতেন খুবই আপনার পুত্র যদি হতো
 সৎ কৃষিজীবী, মেরুদণ্ডসম্পন্ন শ্রমিক, কিংবা
 তিতাসের অপরাজেয় ধীবর। আপনি উপযুক্ত
শিক্ষা দিতে পারেন নি সন্তানকে;–এই পুঁজিবাদী
 ব্যবস্থায় এটাই তো স্বাভাবিক, এখানে মোহর
ছাড়া কিছুই মেলে না, শিক্ষাও জোটে না। তবে এতে
 আপনার কোনো ক্ষতি নেই জানি; কারণ আপনি
পুত্রের জন্যে কোনো রাজপদ, বা ও রকম কিছুই
 চান নি, কেবল চেয়েছেন আপনার পুত্র হোক
সৎ, মেরুদণ্ডী, প্রকৃত মানুষ। আপনার সমস্ত
 পবিত্র প্রার্থনা ব্যর্থ করে বিশশতকের এই
এলোমেলো অন্ধকারে আপনার পুত্র কী হয়েছে
আপনি কি জানেন তা, হে অদেখা দরিদ্র জননী?
কেনো আপনি পুত্রকে পাঠিয়েছিলেন মুঘলদের
 এই ক্ষয়িষ্ণু শহরে, যেখানে কৃষক এসে লিপ্ত
হয় পতিতার দালালিতে, মাঠের রাখাল তার
নদী আর মাঠ ভুলে হয়ে ওঠে হাবশি গোলাম?
আপনি কি জানেন, মাতা, আপনার পুত্র শহরের
অন্যতম প্রসিদ্ধ গোলাম আজ? আপনি এখন
 তাকে চিনতেও ব্যর্থ হবেন, আপনার পুত্রের দিকে
তাকালে এখন কোনো মস্তক পড়ে না চোখে, শুধু
একটা বিশাল কুঁজ চোখে পড়ে। দশকে দশকে
 যতো স্বঘোষিত প্রভু দেখা দিয়েছেন মুঘলদের
 এ-নষ্ট শহরে, আপনার পুত্র তাদের প্রত্যেকের
পদতলে মাথা ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে পৃষ্ঠদেশ জুড়ে
জন্মিয়েছে কুঁজ আর কুঁজ; আজ তার পৃষ্ঠদেশ
একগুচ্ছ কুঁজের সমষ্টি;–মরুভূমির কিম্ভুত
 বহুকু উটের মতোই এখন দেখায় তাকে।
সে এখন শহরের বিখ্যাত গোলাম মজলিশের
বিখ্যাত সদস্য, গোলামিতে সে ও তার ইয়ারেরা
এতোই দক্ষ যে প্রাচীন, ঐতিহাসিক গোলামদের
 গৌরব হরণ করে তারা আজ মশহুর গোলাম
পৃথিবীর। এখন সে মাথা তার তুলতে পারে না,
এমনকি ভুলেও গেছে যে একদা তারও একটি
মাথা ছিলো, এখন সে বহুশীর্ষ কুঁজটিকেই মাথা
বলে ভাবে। খাদ্যগ্রহণের স্বাভাবিক পদ্ধতিও
 বিস্মৃত হয়েছে সে, প্রভুদের পাদুকার তলে
 পড়ে থাকা অন্ন চেটে খাওয়া ছাড়া আর কিছুতেই
 পরিতৃপ্তি পায় না আপনার পুত্র, একদা আপনার
স্তন থেকে মধুদুগ্ধ শুষে নিয়ে জীবন ধারণ
করতো যে বালক বয়সে। এখন সে শত্রু পাখি
ও নদীর, শক্র মানুষের, এমন কি সে আপনার
স্তন্যেরও শত্রু। তার জন্যে দুঃখ করি না, কতোই
 তো গোলাম দেখলাম এ-বদ্বীপে শতকে শতকে।
কিন্তু আপনার জন্যে, হে গরিব কৃষক-কন্যা, দুঃখী
মাতা, গরিব-গৃহিনী, আপনার জন্যে বড় বেশি
 দুঃখ পাই;–আপনার পুত্রের গোলামির বার্তা আজ
রাষ্ট্র দিকে দিকে, নিশ্চয়ই তা পৌঁছে গেছে তিতাসের
 জলের গভীরে আর কুমড়োর খেতে, লাউয়ের
 মাচায়, পাখির বাসা আর চাষীদের উঠোনের কোণে।
তিতাসের জল আপনাকে দেখলে ছলছল করে
ওঠে, ‘ওই দ্যাখো গোলামের গর্ভধারিণীকে’; মাঠে
পাখি ডেকে ওঠে, ‘দ্যাখো গোলামের গর্ভধারিণীকে’;
আপনার পালিত বেড়াল দুধের বাটির থেকে
দু-চোখ ফিরিয়ে বলে, ‘গোলামের গর্ভধারিণীর
হাতের দুগ্ধ রোচে না আমার জিভে’, প্রতিবেশী
পুরুষ-নারীরা অঙ্গুলি সংকেত করে কলকণ্ঠে
 বলে, ‘দ্যাখো গোলামের গর্ভধারিণীকে।‘ এমন কি
প্রার্থনার সময়ও আপনি হয়তো বা শুনতে পান
 ‘গোলামের গর্ভধারিণী, ধারিণী’ স্বর ঘিরে ফেলছে
 চারদিক থেকে। আপনি যখন অন্তিম বিশ্রাম
 নেবেন মাটির তলে তখনো হয়তো মাটি খুঁড়ে
মাথা তুলবে ঘাসফুল, বাতাসের কানে কানে বলে
যাবে, এখানে ঘুমিয়ে আছেন এক গর্ভধারিণী
গোলামের। ভিজে উঠবে মাটি ঠাণ্ডা কোমল অশ্রুতে।
কী দোষ আপনার, মা কি কখনোও জানে দশমাস
ধ’রে যাকে সে ধারণ করছে সে মানুষ না গোলাম?

*

ঢাকায় ঢুকতে যা যা তোমাকে অভ্যর্থনা জানাবে

বাঁশবাগানের চাঁদের নিচের কিশোর, তোমার স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে গেছে এ-নরক
 চরপড়া নদীর বুকের যুবক, তোমার বুকের ভেতর জেগে উঠেছে এ-নরক
 বাঁশি-হারানো সবুজ রাখাল, তোমার কাতর সুরের ভেতরে বেজে উঠেছে এ-নরক
 তুমি বাঁশবন ভুলে পা বাড়িয়েছো নরকের দিকে
 তুমি ঢেউয়ের দিকে পিঠ ফিরিয়ে পা বাড়িয়েছো নরকের দিকে
তুমি মাঠের মায়া উপেক্ষা করে পা বাড়িয়েছো নরকের দিকে
নরকের হাতছানিতে ঝনঝন করে উঠেছে তোমার রক্ত
 নরকের গালের আভায় ঝলমল করে উঠেছে তোমার স্বপ্ন
নরকের ডাকে লেলিহান হয়ে উঠেছে তোমার সুর
 তুমি পা বাড়িয়েছে ঢাকার দিকে
তুমি তোমার স্বপ্নকে মেলে দিয়েছো ভয়াবহ নরকের দিকে
তুমি পা বাড়িয়েছে ঢাকার দিকে
 তুমি তোমার ভবিষ্যৎকে সমর্পণ করেছো আত্মাহীন নরকের হাতে
তুমি পা বাড়িয়েছে ঢাকার দিকে
 তুমি তোমার জীবনকে বন্ধক রেখেছো ক্ষমাহীন নরকের কাছে
 নরককে চিরকাল স্বর্গের থেকেও সুখকর মনে হয়
 নরকের মুখে থাকে সবচেয়ে সুন্দর মুখোশ
নরককে চিরকাল সবচেয়ে আলোকিত অঞ্চল বলে মনে হয়
তুমি ভাবছো ঢাকার পথে পথে নাচছে তোমার ভবিষ্যৎ
তুমি ভাবছো ঢাকার আকাশে উড়ছে তোমার স্বপ্ন
তুমি ভাবছো ঢাকার মিনারে মিনারে বাজছে তোমার জীবন
তুমি নরককে মনে করেছে স্বর্গ
তুমি আগুনকে মনে করেছো আলোক
 তুমি ধাঁধাকে মনে করেছো রহস্য
তুমি জানো না ঢাকা এখন নরকের থেকেও ভয়াবহ
 তুমি জানো না ঢাকা এখন নেকড়ের থেকেও হিংস্র
তুমি জানো না ঢাকা এখন কর্কট রোগের থেকেও অচিকিৎস্য
ঢাকা এখন চার লাখ আঠারো হাজার পাঁচ শো বদমাশের নগর
 ঢাকা এখন তিন লাখ আশি হাজার লম্পটের নগর
ঢাকা এখন পাঁচ লাখ চল্লিশ হাজার তিন শো প্রতারকের নগর
 ঢাকা এখন দুই লাখ বিশ হাজার পতিতার নগর
 ঢাকা এখন দশ লাখ পঁয়তাল্লিশ হাজার তিনশো ভণ্ডের নগর
ঢাকা এখন তোমাকে আর কিছুই দিতে পারে না
 ঢাকার হাত থেকে তুমি আর কিছুই নিতে পারো না
তুমি পা বাড়িয়েছে ঢাকা অভিমুখে
তোমার জন্যে খোলা পুব দিকে, তুমি ঢুকতে পারো পুব দিক দিয়ে
 তোমার জন্যে খোলা দক্ষিণের সাঁকো, তুমি ঢুকতে পারো দক্ষিণ দিয়ে
তোমার জন্যে খোলা উত্তর দিক, তুমি ঢুকতে পারো উত্তর দিয়ে
 তোমার জন্যে ভোলা পশ্চিম, তুমি ঢুকতে পারো পশ্চিম থেকে
 তুমি ঢুকতে পারো যে-কোনো দিক দিয়ে
নরকে প্রবেশে কখনোই পথের কোনো অভাব হয়
 না যে-দিক দিয়েই তুমি ঢোকো
তোমাকে অভ্যর্থনা জানাবে এক লাখ বিশ হাজার লুব্ধ পণ্যনারী
যে-দিক দিয়েই তুমি ঢোকো
তোমাকে অভ্যর্থনা জানাবে চার লাখ আঠারো হাজার পাঁচ শো বদমাশ
যে-দিক দিয়েই তুমি ঢোকো
তোমাকে অভ্যর্থনা জানাবে তিন লাখ আশি হাজার তিন শো প্রতারক
যে-দিক দিয়েই তুমি ঢোকো
 তোমাকে অভ্যর্থনা জানাবে পাঁচ লাখ চল্লিশ হাজার তিন শো প্রতারক
যে-দিক দিয়েই তুমি ঢোকো
তোমাকে অভ্যর্থনা জানাবে পথে পথে স্মিতহাস্য শয়তানের মুখ
 যে-দিক দিয়েই তুমি ঢোকো
তোমাকে অভ্যর্থনা জানাবে রাশিরাশি বিকৃত পোস্টার
যে-দিক দিয়েই তুমি ঢোকো
 তোমাকে অভ্যর্থনা জানাবে দেয়ালের অর্থহীন অশ্লীল লেখন
 তোমাকে অভ্যর্থনা জানাবে না অমল বাতাস
 তোমাকে অভ্যর্থনা জানাবে না বৃষ্টির কোমল বর্ষণ
তোমাকে অভ্যর্থনা জানাবে না ঘাসের নিশ্বাস
 তোমার হৃৎপিণ্ড নিয়ে খেলবে পণ্যনারীরা
 তোমার মুণ্ডু নিয়ে খেলবে আততায়ীরা
 তোমার স্বপ্ন নিয়ে খেলবে বদমাশেরা
তোমার স্বপ্ন নিয়ে খেলবে শয়তানেরা
তুমি জ্বলতে থাকবে নরকের দাউদাউ ক্ষমাহীন অশ্লীল আগুনে
 বাঁশ বাগানের চাঁদের নিচের কিশোর, তুমি পা বাড়িয়েছো নরকের দিকে
চরপড়া নদীর বুকের যুবক, তুমি ঢেউয়ের দিকে পিঠ ফিরিয়ে পা বাড়িয়েছো
নরকের দিকে
বাঁশি-হারানো সবুজ রাখাল, তুমি মাঠের মায়া উপেক্ষা করে পা বাড়িয়েছো
নরকের দিকে

*

জীবনযাপনের শব্দ

এক সময় আমরা শহরের এমন এক এলাকায় থাকতাম, যেখানে
 আমিই ছিলাম সবচে গরিব। গাড়ির কোমল হর্ণ
 ছাড়া আর কোনো শব্দই শোনা যেতো না সেখানে।
সোনালি নৈঃশব্দে পা থেকে মাথা পর্যন্ত মোড়া ছিলো
আবাসিক এলাকাটি। আমিই ছিলাম সবচে গরিব,
তাই আহারের পর মাঝে মাঝে আমি আয়েশের সাথে খক খক করে কাশতাম।
আমার কোনো অসুখ ছিলো না। কিন্তু একটু কাশলে আমার বেশ
ভালোই লাগতো। আমি যখন তখন চিৎকার করে কাজের
 মেয়েটিকে ডাকতাম। আমার স্ত্রী সম্ভবত আমার চেয়ে ধনী ছিলো, চিৎকার
করে সে কখনো কাউকে ডাকতো না। অবাক হয়ে আমি শুনতাম
 আমার স্ত্রীর কাশি কখনোই চুম্বনের শব্দের থেকে একটুও উঁচু নয়।
 তার হাঁচি গোলাপের পাপড়ি ঝরার মতোই নিঃশব্দ নীরব।
আমার মেয়ে দুটি জন্মে ছিলো সম্ভবত আরো ধনী হয়ে। ওদের কখনো
আমি কাঁদতে বা হাসতে শুনি নি।
একবার সাতদিন আমি ওদের কোনো কথা না শুনে ছুটে গিয়েছিলাম
এক নাককানগলা বিশেষজ্ঞের কাছে। তিনি জানিয়েছিলেন
 আমার কন্যাদের স্বরতন্ত্রি জোহাবার্গের সোনার চেয়েও উৎকৃষ্ট
ধাতুতে গঠিত। তাই সেখান থেকে
 নীরবতার সোনা ছাড়া আর কোনো বস্তুই ঝরে না।
একবার বাধ্য হয়ে আমাকে থাকতে হয়েছিলো শহরের এমন এক এলাকায়,
 যেখানে গরিব কাকে বলে তা কেউ জানে না।
সেখানে গাড়ির হর্ণ থেকেও কোনো শব্দ ওঠে না, শুধু ঝলকেঝলকে
 তাল তাল সোনা ঝরে পড়ে।
ওই এলাকার গোলাপগুলো গান গাওয়া দূরে থাক, অন্যমনস্ক হয়েও
উঁচু গলায় কারো নাম ধরেও ডাকে না। একটা গোলাপকে আমি- ‘এই যে গোলাপ’
বলতেই সে নিঃশব্দে লুটিয়ে পড়লো। বুঝলাম ওই রঙিন নিঃশব্দ সৌন্দর্য
এমন বর্বরের মুখোমুখি ইহজন্মে কখনো পড়ে নি।
একটু শব্দের জন্যে আমি প্রচণ্ড জোরে বন্ধ করলাম দরোজা,
ঐন্দ্রজালিক দরোজা কেমন নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেলো।
 স্নানাগারে পিছলে পড়লাম, আমার পতনে একটুও শব্দ হলো না।
একটা বেড়ালের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম,
 কিন্তু ওই রূপসীর গলা থেকে শুধু গলগল করে সোনা ঝরতে লাগলো।
এখন আমরা শহরের এমন এক এলাকায় থাকি, যেখানে
 আমরাই সবচেয়ে ধনী। আমাদের পাঁচতলা ঘিরে আছে গরিবেরা।
 গরিবদের প্রাণ কি বাস করে স্বরতন্ত্রিতে? তাদের জীবন কি গলা দিয়ে
 গলগল করে বেরিয়ে আসে প্রচণ্ড প্রচণ্ড শব্দ হয়ে?
ঘরে ঢোকার সময় গরিবেরা ভয়ংকরভাবে ডাকাডাকি করে,
আবার ঘর থেকে বেরোনোর সময় ডাকাডাকিতে কাঁপিয়ে তোলে পাড়া।
এমন জোরে তারা ঝাঁপ বন্ধ করে যে
 ওই ঝাঁপ আরো অনেক বেশি করে খুলে যায়।
এক সন্ধ্যায় মাইক বাজিয়ে বিকট শব্দে তারা ফিলিগান শোনে,
পরের সন্ধ্যায় একই মাইকে শোনে ধর্মের কাহিনী।
 তাদের অধিকাংশেরই ঘরে বিদ্যুৎ নেই, কিন্তু পাড়ায় বিদ্যুৎ চলে গেলে
তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একজোটে চিৎকার করে ওঠে
আবার যখন বিদ্যুৎ ফিরে আসে, তখনো তারা চিৎকার করে ওঠে একজোটে।
ওদের হাসির শব্দ শোনা যায় পাঁচতলা থেকে।
ওদের কান্নার শব্দ সম্ভবত শোনা যায় দশতলা থেকে।
সকালে বস্তির কোনো পুরুষের গলার আওয়াজ শুনেই বোঝা যায়
 রাত্রে শারীরিক মিলনে সে অসম্ভব তৃপ্তি পেয়েছে।
আর নারীর হাসির ঝংকার থেকে বোঝা যায় শরীর
সারারাত দলিতমথিত হয়ে ভোরবেলা তার কণ্ঠে
 জন্ম নিয়েছে এই বিস্ময়কর কলহাস্য।
পাঁচতলায় যখন নিচ থেকে একটা শিশুর তীক্ষ্ণ চিৎকার ছুটে আসে
 তখন বোঝা যায় মায়ের স্তনের বোঁটা থেকে খসে গেছে তার ওষ্ঠ।
ক্ষুধা এখানে চিৎকার হয়ে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে।
 আনন্দ এখানে কোলাহল হয়ে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে।
গরিবদের অশ্রু বেরোয় গলা দিয়ে বিশাল বিশাল শব্দের ফোঁটা হয়ে।
গরিবদের কাম গলা দিয়ে বিস্ফোরিত হয়।
তাদের জীবন গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে বজ্রের মতো।
 শুনেছি বার বার যে নৈঃশব্দ সোনালি।
কিন্তু এখন কে জানে না নৈঃশব্দ হচ্ছে কূটচক্রান্তের মাতৃভাষা?
তাহলে ধনীদের জীবন কি এক ধারাবাহিক
নিঃশব্দ সোনালি চক্রান্ত?

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে (১৯৯০:১৩৯৬)

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে

আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার খাদ্যে ছিল অন্যদের আঙুলের দাগ,
আমার পানীয়তে ছিল অন্যদের জীবাণু,
আমার বিশ্বাসে ছিল অন্যদের ব্যাপক দূষণ।
আমি জন্মেছিলাম আমি বেড়ে উঠেছিলাম
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি দাঁড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,
আমি হাঁটতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,
আমি পোশাক পরতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে,
আমি চুল আঁচড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে,
আমি কথা বলতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো।
তারা আমাকে তাদের মতো করে দাঁড়াতে শিখিয়েছিলো,
তারা আমাকে তাদের মতো করে হাঁটার আদেশ দিয়েছিলো,
তারা আমাকে তাদের মতো করে পোশাক পরার নির্দেশ দিয়েছিলো,
তারা আমাকে বাধ্য করেছিলো তাদের মতো করে চুল আঁচড়াতে,
তারা আমার মুখে গুজে দিয়েছিলো তাদের দূষিত কথামালা।
তারা আমাকে বাধ্য করেছিল তাদের মতো করে বাঁচতে।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম,
আমি পোশাক পরতে চেয়েছিলাম একান্ত আপন রীতিতে,
আমি চুল আঁচড়াতে চেয়েছিলাম নিজের রীতিতে,
আমি উচ্চারন করতে চেয়েছিলাম আন্তর মৌলিক মাতৃভাষা।
আমি নিতে চেয়েছিলাম নিজের নিশ্বাস।
আমি আহার করতে চেয়েছিলাম আমার একান্ত মৌলিক খাদ্য,
আমি পান করতে চেয়েছিলাম আমার মৌলিক পানীয়।
আমি ভুল সময়ে জন্মেছিলাম। আমার সময় তখনো আসে নি।
আমি ভুল বৃক্ষে ফুটেছিলাম। আমার বৃক্ষ তখনো অঙ্কুরিত হয় নি।
আমি ভুল নদীতে স্রোত হয়ে বয়েছিলাম। আমার মেঘ তখনো আকাশে জমে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি গান গাইতে চেয়েছিলাম আপন সুরে,
ওরা আমার কন্ঠে পুরে দিতে চেয়েছিলো ওদের শ্যাওলা-পড়া সুর।
আমি আমার মতো স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমাকে বাধ্য করেছিলো ওদের মতো ময়লা-ধরা স্বপ্ন দেখতে।
আমি আমার মতো দাঁড়াতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলো ওদের মতো মাথা নিচু করে দাঁড়াতে।
আমি আমার মতো কথা বলতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমার মুখে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলো ওদের শব্দ ও বাক্যের আবর্জনা।
আমি খুব ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমাকে ওদের মতো করেই দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলো বাইরে।
ওরা মুখে এক টুকরো বাসি মাংস পাওয়াকে বলতো সাফল্য,
ওরা নতজানু হওয়াকে ভাবত গৌরব,
ওরা পিঠের কুঁজকে মনে করতো পদক,
ওরা গলার শেকলকে মনে করতো অমূল্য অলংকার।
আমি মাংসের টুকরা থেকে দূরে ছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি নতজানু হওয়ার বদলে নিগ্রহকে বরণ করেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি পিঠ কুঁজের বদলে বুকে ছুরিকাকে সাদর করেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি গলার বদলে হাতেপায়ে শেকল পড়েছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি অন্যদের সময়ে বেঁচে ছিলাম। আমার সময় তখনো আসেনি।
ওদের পুকুরে প্রথাগত মাছের কোনো অভাব ছিলো না,
ওদের জমিতে অভাব ছিলো না প্রথাগত শস্য ও শব্জির,
ওদের উদ্যানে ছিলো প্রথাগত পুষ্পের উল্লাস।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো দিঘি খুঁড়েছিলাম ব’লে
আমার দিঘিতে পানি ওঠে নি।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো চাষ করেছিলাম ব’লে
আমার জমিতে শস্য জন্মে নি।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো বাগান করতে চেয়েছিলাম ব’লে
আমার ভবিষ্যতের বাগানে একটিও ফুল ফোটে নি।
তখনো আমার দিঘির জন্য পানি উৎসারণের সময় আসে নি।
তখনো আমার জমির জন্য নতুন ফসলের সময় আসে নি।
তখনো আমার বাগানের জন্যে অভিনব ফুলের মরশুম আসে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার সবকিছু পর্যবসিত হয়েছে ভবিষ্যতের মতো ব্যর্থতায়,
ওরা ভ’রে উঠেছে বর্তমানের মতো সাফল্যে।
ওরা যে-ফুল তুলতে চেয়েছে, তা তুলে এনেছে নখ দিয়ে ছিঁড়েফেড়ে।
আমি শুধু স্বপ্নে দেখেছি আশ্চর্য ফুল।
ওরা যে-তরুণীকে জরিয়ে ধরতে চেয়েছে তাকে ধরেছে দস্যুর মতো।
আমার তরুণীকে আমি জরিয়ে ধরেছি শুধু স্বপ্নে।
ওরা যে-নারীকে কামনা করেছে, তাকে ওরা বধ করেছে বাহুতে চেপে।
আমার নারীকে আমি পেয়েছি শুধু স্বপ্নে।
চুম্বনে ওরা ব্যবহার করেছে নেকড়ের মতো দাঁত।
আমি শুধু স্বপ্নে বাড়িয়েছি ওষ্ঠ।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার চোখ যা দেখতে চেয়েছিলো, তা দেখতে পায় নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার পা যে-পথে চলতে চেয়েছিলো, সে পথে চলতে পারে নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার হৃদয় যা নিবেদন করতে চেয়েছিলো, তা নিবেদন করতে পারে নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার কর্ণকুহর যে-সুর শুনতে চেয়েছিলো, তা শুনতে পায় নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার ত্বক যার ছোঁয়া পেতে চেয়েছিলো, তার ছোঁয়া পায় নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমি যে পৃথিবীকে চেয়েছিলাম, তাকে আমি পাই নি।
তখনো আমার সময় আসে নি। তখনো আমার সময় আসে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম
অন্যদের সময়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *