ডাক্তার

ডাক্তার

ডাক্তার আমার চাইতে বয়সে বড়ো হলেও বন্ধু। বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দিল্লিতে এলেই ডাক্তার আমাকে ফোন করবে। আমার শত কাজ থাকলেও আমাকে ছুটে যেতে হবে ইন্দ্রপুর এস্টেটের ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের উপর তলার ঘরে। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যে রাত্তির। সময়ের কোনো ঠিক নেই। ডাক্তার এ ব্যাপারে প্রায় নাদির শা। হুকুম অমান্য করা চলবে না। একদিন, দৃদিন, তিন দিন। ডাক্তার যে কদিন দিল্লি থাকবে সে কদিনই আমাকে ডিউটি দিতে হবে। এর অন্যথা ও বরদাস্ত করে না; আমিও ভাবতে পারি না।

আমি কলকাতা এলে ঠিক এর বিপরীতটা হয় না। হওয়া সম্ভব নয়। আমি দুচার দিনের জন্য আসি নানা কাজকর্ম নিয়ে। ডাক্তারও ব্যস্ত। মাঝরাতেও নিস্তার নেই। হঠাৎ কেউ রুগীর বুকে ব্যথাটা বাড়লেই হুড়মুড় করে উঠে নিজেই গাড়ি চালিয়ে ছুটবে। আমার ডাক্তার কার্ডিওলজিস্ট! হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। তবুও আমার ডাক্তারের আজ্ঞা হবেই। কখনও চেম্বারে, কখনও বা ক্লাবে ও হোটেলে। সৌভাগ্যক্রমে হাতে খুব সিরিয়াস রুগী না থাকায় ডাক্তার নিজেই ফিয়াট নিয়ে বেরুবে। তারপর আমাকে নিয়ে চলে যাবে কোথাও। শান্তিনিকেতন, ডায়মন্ডহারবার বা ঝাড়গ্রামের ওদিকে। একদিন দেড়দিন প্রাণ ভরে দিয়ে আবার কলকাতা ফিরে আসি।

এই আড্ডার ব্যাপারে আমার আর ডাক্তারের মধ্যে এক অলিখিত চুক্তি আছে। আমি ওর কাছে অসুখবিসুখের ব্যাপারে কিছু জানতে চাই না; ডাক্তার ও আমার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করবে না। এ ছাড়া বিশ্ব সংসারের যাবতীয় সব সৎ ও অসৎ ব্যাপার নিয়ে আলোচনা হয় আমাদের। তবে ডাক্তারের প্রেমের কাহিনি শুনতেই আমার সবচাইতে ভালো লাগে। এ ব্যাপারে ডাক্তারের ঔদার্য সীমাহীন। ডাক্তার হাসতে হাসতে বলে, সেকালে ভালো ভালো কবি ছিলেন বলে অর্জুনের প্রেম কাহিনি নিয়ে কবিতা রচনা হয়েছে। একালে যদি তেমন ভালো কবি থাকতেন তাহলে আমাকে নিয়েও অমন অনেক কাব্য রচনা হতে পারতো।

আমি হাসি।

ডাক্তার এক চুমুক হুইস্কি খেয়ে বলে, না, না, ভাই, হাসির কথা নয়। রবি ঠাকুর শরৎচন্দ্র বেঁচে থাকলেই দেখতে আমাকে নিয়ে কত কি লেখা হয়েছে।

সব যুগেই সব দেশের মানুষই প্রেম করেছে। ভবিষ্যতেও করবে কিন্তু ভারতবর্ষে প্রেম করা যেন মহাপাপ। এ মহাপাপ সবাই করে, সবাই লুকোয়। ডাক্তার সত্যি ব্যতিক্রম। ভালো ছাত্র বলে ডাক্তারের খ্যাতি ছিল মেডিক্যাল কলেজে। এডিনবরা থেকে এম. আর সি পি পাশ করেছে প্রায় অনায়াসে। তারপর এক অস্ট্রিয়ান যুবতীর মোহ ডাক্তারকে টেনে নিয়ে যায় ভিয়েনায়। কিছুদিন এই সুন্দরীকে নিয়ে দানিযুব খাল, ওপেরা হাউস, নাইট ক্লাব স্পেলডিড ফাস্ট ডিস্ট্রিকেটর অলিগলিতে ঘোরাঘুরি করতেই ডাক্তার আরো একটা পরীক্ষা দেয়। আশ্চর্য ব্যাপার। পাশও করল। সেদিন ডাক্তার ঐ মেয়েটিকে নিয়ে ইভএ নেচেছিল সারারাত।

মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময়ও ডাক্তারের জীবনে একাধিক মেয়ে এসেছে। সহপাঠিনী নীলিমা, ফাইনাল ইয়ারের জয়া, নার্স কৃষ্ণা ছাড়াও কিছুকালের জন্য ডাঃ মৈত্রের স্ত্রীর সঙ্গেও বড়ো বেশি জড়িয়ে পড়েছিলেন। বিলেত থেকে ফিরে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই ডাক্তার বিয়ে করে অপরূপাকে। অপরূপা সত্যি অপরূপা। রূপে, গুণে। অপরূপাকে বিয়ের পিছনেও একটু কাহিনি আছে।

.

ডাক্তার সবে বিলেত থেকে ফিরেছে। বিশেষ কেউই চেনে না। কিছু পুরনো বন্ধুবান্ধব ছাড়া আর কেউ নাম জানে না! রুগী আসে কম। কল আসে আরো কম। তবে হ্যাঁ, রুগী এলে ডাক্তার জানপ্রাণ লড়িয়ে দেয় তাকে সুস্থ করার জন্য। যে বাড়িতে কল পায়, ডাক্তার সেখানে বার বার যায় রুগী দেখতে। টাকা? না, না, ঐ একবারই নেয়, বার বার নয়। ডাক্তারের এই আগ্রহ, সঠিক চিকিৎসা, হাসিখুশি মুখখানা আর অমায়িক ব্যবহার রুগীর বাড়ির সবাইকে মুগ্ধ করে। ডাক্তারের খ্যাতি ছড়ায়।

রাত তখন এগারোটা। ডাক্তার শুয়েছে। হঠাৎ টেলিফোন পেয়েই ছুটল ল্যান্সডাউনে। মিঃ চৌধুরীর অবস্থা সত্যি সঙ্কটাপন্ন। ডাক্তার পর পর দুটো ইনজেকশন দিয়ে বার বার হার্ট আর পালস্ দেখে। ঘণ্টাখানেক পরে আবার ইনজেকশন। যুদ্ধ চলল সারারাত। ভোরের দিকে ডাক্তার বাড়ির সবাইকে বললেন, মনে হয় এখন মিঃ চৌধুরী ঘুমুবেন। এখন আমি যাচ্ছি। যদি দরকার হয় সঙ্গে সঙ্গে ফোন করবেন।

ফি?

না, না, এখন কিছু দিতে হবেনা। আগে উনি সুস্থ হয়ে উঠুন। তারপর ওঁর হাত থেকেই আমি আমার ফি নেব।

ডাক্তারের কথা শুনে বাড়ির সবাই অবাক। এ ডাক্তার সত্যি বিচিত্র। রুগীদের চিন্তায় এর ঘুম হয় না, স্বস্তি পান না। যখন তখন রুগী দেখতে আসেন। প্রয়োজন মনে করলে বার বার আসেন, থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দিনে, রাতে।

তারপর একদিন মিঃ চৌধুরী সম্পূর্ণ সুস্থ হলেন। নিজেই এলেন ডাক্তারের কাছে। বললেন, আপনি না হলে সত্যি আমি বাঁচতাম না। আপনার ঋণ কোনদিনই শোধ দিতে পারব না। তবু বলুন, কত দেব।

ডাক্তার হেসে বলে, না, না, আপনাকে কিছু দিতে হবে না।

তাই কি হয়? আপনি বলুন, কী দেব?

ডাক্তার মুখ নিচু করে একটু ভাবে

মিসেস চৌধুরী স্বামীর পাশেই ছিলেন। উনি বললেন, এতদিন আমাদের বাড়িতে যাতায়াত করে তোত বুঝতে পেরেছেন আমরা অত্যন্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত। আপনাকে যা দেওয়া উচিত তা দেবার ক্ষমতা আমাদের নেই কিন্তু কিছু না দিলে তো আমরাও শান্তি পাব না।

ডাক্তার এবার হেসে বলনে, সত্যি কিছু দেবেন?

ওঁরা স্বামীস্ত্রী প্রায় একসঙ্গেই বললেন, নিশ্চয়ই।

ডাক্তার দ্বিধা করে। বলে, কিন্তু যদি বেশি চেয়ে ফেলি তাহলে……

মিসেস চৌধুরী বললেন, আমরা জানি আপনি এমন কিছু চাইবেন না যা আমরা দিতে পারবো না।

এবার ডাক্তার যেন একটু সাহস পায়। বলিষ্ঠ হয়। বলে, ইচ্ছা করলে আপনারা দিতে পারবেন কিন্তু তা কি আমাকে দেবেন?

স্বামীস্ত্রী এবারও একসঙ্গে বলেন, নিশ্চয়ই দেব।

তাহলে অপরূপাকেই দিন।

আনন্দে, খুশিতে মিঃ চৌধুরী দুহাত দিয়ে ডাক্তারকে টেনে নিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেই কেঁদে ফেলেন। কাঁদতে কাঁদতেই বলেন, তুমি যে আমার কি উপকার করলে বাবা, তা পরমেশ্বরই জানেন।

মিসেস চৌধুরী দুহাত দিয়ে ডাক্তারের মুখখানা ধরে কপালে একটু চুমু খেয়ে বললেন, তোমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোটো করব না। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, তোমার খ্যাতি যশ সারা জগতে ছড়িয়ে পড়ুক।

ডাক্তার হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিয়ে বলে, এককালে বহু বড়ো বড়ো জমিদার সর্বস্বান্ত হয়েছে মদ আর রক্ষিতাদের কল্যাণে। বহু লোক সর্বস্বান্ত হয়েছে মামলামোকদ্দমা করে। কিন্তু আমাদের দেশে সব চাইতে বেশি লোকের সর্বনাশ হয়েছে রোগের জন্য।

আমি বলি, ঠিক বলেছ ডাক্তার।

ডাক্তার হেসে বলে, অন্যদের কথা আর কি বলব। আমার বাবা আর দিদির চিকিৎসা করতে গিয়েই মা পথে বসেন। ডাক্তার একটু থামে। তারপর বলে, তাই তো মা আমাকে

অনেক দুঃখকষ্টের মধ্যেও ডাক্তারি পড়ান।

ডাক্তার অধিকাংশ সময়ই বর্তমানের কথা বলে। অতীতকে নিয়ে টানাটানির অভ্যাস বিশেষ নেই। কিন্তু আজ ডাক্তার শুধু ফেলে আসা দিনগুলোর কথাই বলছে!

ডাক্তার হাসতে হাসতে বলে, মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় যেমন পড়াশুনা করেছি, তেমনি প্রেম করেছি। দুটোই করেছি প্রাণভরে। এমন একটা সময় এসেছিল যখন নীলিমা আর জয়ার মধ্যে টাগঅবওয়ার শুরু হল আমাকে নিয়ে। ঠিক এই সময় রিইউনিয়নে আলাপ হল শিখাদির সঙ্গে।

কে শিখাদি?

আরে, ডাঃ মৈত্রের স্ত্রী।

তারপর?

তারপর মাকে জগন্নাথ দর্শন করাবার জন্য পুরীতে গিয়ে হঠাৎ শিখাদির সঙ্গে দেখা।

.

আরে ডক, তুমি?

এখন তো সবে ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র। কেন আর ডক বলে লজ্জা দিচ্ছেন?

আজ না হোক কাল তো পাশ করে ডাক্তার হবে।

যদি ফেল করি?

এসব কথা ছাড়া। বেড়াতে এসেছ?

মা জগন্নাথ দর্শন করতে এসেছেন।

শিখাদি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কাকে দর্শন করতে এসেছ?

ডাক্তারের মুখ দিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে যায়, আপনাকে।

আমি শুনেই হাসি। বলি, তারপর?

ডাক্তারও হাসে। বলে, ডাঃ মৈত্র ওঁর ডাক্তার বন্ধুদের সঙ্গে বিয়ার খেতেন, ফ্ল্যাশ খেলতেনআর আমি শিখাদিকে নিয়ে পুরীর সমুদ্রে স্নান করতাম।

আর?

শিখাদি আমাকে আর মাকে নিয়ে কোনার্ক গেলেন। মা একটু দেখেই বসে রইলেন। আমি আর শিখাদি খুব ঘুরলাম।

তারপর?

কলকাতা ফেরার দুএক সপ্তাহ পর ডাঃ মৈত্রের বাড়ি ফোন করলাম।… …

শিখাদি অভিমানের সুরে বললেন, তুমি তো অদ্ভুত ছেলে!

কেন?

এতদিন পরে তুমি ফোন করছ?

কী করব বলুন। পড়াশুনা নিয়ে বড়োই ব্যস্ত ছিলাম তাছাড়া হসপিট্যাল ডিউটিও এমন পড়েছে যে… …

আচ্ছা থাক। অত লেকচার না দিয়ে চলে এসো।

এখন?

হ্যাঁ, এখন।

আপনার ওখানে যাতায়াত করতে করতেই তো আমার হসপিট্যাল ডিউটির সময় হয়ে যাবে।

সময় না থাকে ট্যাক্সিতে চলে এসো।

ট্যাক্সি! ট্যাক্সি চড়ার পয়সা কোথায়?

আচ্ছা, আচ্ছা, আমি ভাড়া দেব। তুমি চলে এসো।

ডাক্তার আবার এক চুমুক হুইস্কি খায়। বলে, ভালো ছাত্র, ভালো ডাক্তার বলে ডাঃ মৈত্রের সঙ্গে শিখাদির বিয়ে দেন ওর বাবা। হসপিট্যাল আর প্রাইভেট প্রাকটিশ করে ডাঃ মৈত্র যেটুকু সময় পেতেন তা তাস খেলেই কাটিয়ে দিতেন। স্ত্রীর প্রতি কোনো কর্তব্য করাই সময় ছিল না তার।

আমি সিগারেট টানতে টানতে ডাক্তারের কথা শুনি।

ডাক্তার আবার এক চুমুক হুইস্কি খায়। আবার বলে, শিখাদি অত্যন্ত প্রাণবন্ত ছিলেন। তাই এই স্বামীর পাল্লায় পড়ে তিনি সত্যি পাগল হয়ে উঠেছিলেন। আমার সঙ্গে শিখাদির কোনো দৈহিক সম্পর্ক ছিল না কিন্তু উনি আমাকে সত্যি ভালোবাসতেন।

তাই নাকি?

হা জার্নালিস্ট! শিখাদি আমাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন এবং ওরই তাগিদে আমি বামন হয়েও চাঁদে হাত দিতে সাহস করেছি।

তার মানে?

শিখাদি অমন করে আমার পিছনে না লাগলে আমি সত্যি বিলেত যেতাম না। ডাক্তার একটু থেমে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসে। তারপর বলে, আমার বিলেত যাবার জাহাজ ভাড়া শিখাদিই দিয়েছিলেন।

আচ্ছা!

হ্যা জার্নালিস্ট। কিন্তু বিলেত থেকে ফিরে এসে আর শিখাদিকে পেলাম না।

কেন?

শিখাদি আত্মহত্যা করেছিলেন।

কেন?

শিখাদি স্বামীর অবজ্ঞা অনেক সহ্য করেছিলেন কিন্তু যখন শুনলেন অমন ভাবভোল স্বামীরও আরেকটা সংসার আছে, তখন উনি সিন্ধান্ত নিতে দেরি করেননি।

সত্যি, কি দুঃখের কথা।

কলকাতার অনেক ডাক্তারের কাছেই শিখাদির নামে অনেক কুৎসা নোংরামী শুনতে পাবে। অনেকে বলে, শিখাদি বছর দুই আমার সঙ্গেই সংসার করেছেন।

এটা তো আমাদের জাতীয় চরিত্র।

সে যাই হোক, শিখাদির কথা আমি কাউকে বলি না কিন্তু তোমাকে বলছি, ওর জন্য আমি এমন একটা শূন্যতা বোধ করতাম যা তোমাকে বোঝাতে পারব না।

ঠিক বুঝতে না পারলেও আন্দাজ করতে পারি।

ডাক্তার একটু হেসে বলে, অপরূপাকে প্রথম দিন দেখেই আমি চমকে উঠেছিলাম।..

কেন?

অনেকটা শিখাদির মতো দেখতে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। তাইতো ওকে আমি বিয়ে করলাম।

খুব ইন্টারেস্টিং তো!

অপরূপাকে বিয়ে করার আরো একটা কারণ ছিল।

কী?

প্রথম দিন অপরূপার বাবাকে দেখতে গিয়েই বুঝলাম, ওরা ধনী নয়। আরো দু’চারদিন যাবার পর বুঝলাম, মিঃ চৌধুরীর অসুখের খরচ চালাবার মতো অর্থের সংস্থান ওদের নেই।

আমি ফি না নিলেও অন্য ব্যয় তো আছে।

তা তো বটেই।

তাই দেখলাম, অরূপাকে যদি বিয়ে করি, তাহলে ঐ পরিবারের অনেক উপকার হবে

শুনে আমার ভালো লাগে। বলি, ডাক্তার তোমাকে কি আমি এমনি এমনি ভালোবাসি।

ডাক্তার যেন আমার কথা শুনেও শোনে না। বলে, আমি অপরূপাকে ভরিয়ে দিয়েছি সব কিছু দিয়ে। ওর কোনো ইচ্ছাই আমি অপূর্ণ রাখিনি। কিন্তু ও আমাকে এমন দুঃখ দিয়েছে যে আজ আমি অপরূপার পাশে শুতেও ঘেন্না বোধ করি।

কেন? অবাক হয়ে আমি প্রশ্ন করি।

দুর্ঘটনাই বলতে পারে। কিন্তু এখন কলকাতার বাজারে আমার বেশ সুনাম। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার হেসে বলে, চরিত্রের ব্যাপারে নয়, ডাক্তার হিসেবে।

তারপরই ডাক্তার গম্ভীর হয়। বলে, কিন্তু লোকে তো চরম বিপদে পড়েই আমাকে ডাকে।

সে তো একশ বার।

তাই পেসেন্টদের বাড়ির অবস্থা খারাপ দেখেলেই আমার বাবার অসুখের সময়ের কথা মনে পড়ে যায়। আমি কিছুতেই ওদের কাছ থেকে টাকা নিতে পারি না।

আমি হেসে বলি, এই মন আছে বলেই তো তুমি এত বড়ো হয়েছ।

ডাক্তার একটু ম্লান হাসি হেসে বলে, একটা ঘটনা শোন। সেদিন শনিবার। রাত তখন গোটা নয়েক হবে। চেম্বারের রুগী দেখা শেষ করে দুটো একটা পেমেন্টের কিছু রিপোর্ট দেখছিলাম। হঠাৎ এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন

চিনতে পারছ বাবা?

চেহারা অনেক বদলে গেছে কিন্তু তবু ডাক্তার চিনতে পারে, হ্যাঁ স্যার, চিনতে পারব কেন?

না বাবা, সব ছাত্র তো চিনতে পারে না। তাছাড়া তুমি এখন বিরাট ডাক্তার।

ওকথা বলবেন না স্যার। আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে কিছু শিখেছি মাত্র। বলুন স্যার, কি ব্যাপার?

বাবা, পাড়ার ডাক্তার বললেন, জামাইয়ের নাকি হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।

সে কি?

হ্যা বাবা। বৃদ্ধ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, অন্য ডাক্তারের কাছে যাবার তো সাহস নেই, তাই তোমার কাছে ছুটে এলাম। তুমি যদি একটু দয়া……।

কী বলছেন আপনি? আমি এখুনি যাচ্ছি।

দুএক মিনিটের মধ্যেই ডাক্তার মাস্টারমশায়ের সঙ্গে গাড়িতে রওনা হয়।

গাড়ি মাস্টারমশায়ের বাড়ির সামনে থামতেই ডাক্তার ড্রাইভাবকে বলে, তুমি বাড়ি গিয়ে খাওয়াদাওয়া করে এসো। আর অপরূপাকে বলে দিও, আমি এখানে আছি।

পেসেন্টের ঘরে পৌঁছবাব সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তার যুদ্ধ শুরু করে। পাড়ার ডাক্তারবাবু ওকে সাহায্য করেন। দণ্টা তিনেক পরে যুদ্ধের প্রথম পর্ব শেষ হয়। ডাক্তার এবার একটু হেসে মাস্টারমশায়ের মেয়েকে বলে, দিদি, এবার এক কাপ চা খাব।

এখুনি দিচ্ছি ডাক্তারবাবু।

ডাক্তারবাবু না, আমি তোমার দাদা। বাবার ছাত্র দাদাই হয়, তাই না?

ডাক্তারের কথা শুনেই এই দুর্যোগের মধ্যেও আনন্দে মাস্টারমশায়ের মেয়ের চোখে জল আসে।

চা খেতে খেতেই পাড়ার ডাক্তারবাবু কিছু নির্দেশ দেন। পাড়ার ডাক্তারবাবু চলে যাবার পর ডাক্তার মাস্টারমশাইকে প্রেসক্রিপসন দিয়ে বলেন, শুধু এক নম্বর ওষুধটা কিনবেন। আর সব অষুধ আমার কাছে আছে। তারপর ডাক্তার মাস্টারমশায়ের মেয়েকে বলে দে কখন কোন ওষুধ খাওয়াতে হবে।

ডাক্তার যখন ও বাড়ি থেকে রওনা হয়, তখন রাত প্রায় দেড়টা। মাস্টারমশাই ডাক্তাবের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিতে যান। ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে হেসে বলে, কি করছে স্যার?

ডাক্তার আর কথা বলতে পারে না। গাড়ি চালাতে শুরু করে।

ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ এক নার্সিংহোম থেকে ডাঃ ঘোষ ফোন করেন ডাক্তারকে তুমি একটু আসবে এখুনি? আমার একটা পেমেন্টের ব্যাপারে তোমার ওপিনিয়ন….

ডাক্তার একটু হেসে জানতে চায়, পুরুষ না মেয়ে পেসেন্ট?

পুরুষ।

শালা, মেয়ে পেসেন্ট হলে তো কখনও আমাকে কনসাল্ট করার কথা মনে পড়ে না।

ডাঃ ঘোষও হাসেন। বলেন, ওরে শালা, তুমি তো আমার বউয়ের মেডিক্যা এ্যাডভাইসার। আচ্ছা, তাড়াতাড়ি এসো।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসছি।

ডাক্তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে নিজেই চালিয়ে চলে যায়। আধঘন্টার মধ্যেই নার্সিংহোম থেকে ডাক্তার বেরিয়ে পড়ে। সোজা চলে যা মাস্টারমশায়ের জামাইকে দেখতে। মাস্টারমশায়ের মেয়ে দরজা খুলেই দিয়েই অবাক আপনি? এত ভোরে?

ডাক্তার বলে, আগে বলুন, আমার পেসেন্ট কেমন আছেন?

এখনও ঘুমুচ্ছেন।

ডাক্তার পেসেন্টকে দেখে। আবার ইসিজি করে। আরো কত কি! একটা ইনজেকশন দেয় ডাক্তার। তারপর আবার ইসিজি, আবার ব্লাড প্রেসার দেখে। খুব মন দিয়ে নাডি স্পন্দন পরীক্ষা করে বার বার। স্টেথো কানে দিয়ে বুক পরীক্ষা করে বহুক্ষণ ধরে।

ঘরখানা অত্যন্ত ছোটো। তাই ডাক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় পা দিয়েই একৗ হেসে মাস্টারমশায়ের মেয়েকে বলে, চায়ের জল চাপিয়েছো?

সেও হাসে। বলে, চায়ের জল ফুটছে।

তাহলে এক্ষুনি পাব?

নিশ্চয়ই। এবার মাস্টারমশায়ের মেয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করে, কেমন দেখলে দাদা?

ডাক্তারের মুখে হাসি লেগেই আছে। বলে, আমাকে দেখেও বুঝতে পারছো না?

একটু ভালো, তাই না?

একটু না, বেশ ভালো।

পাশের ঘরে বসে চা খাবার সময় মাস্টারমশাই ডাক্তারকে জিজ্ঞেস কবলেন, অত রাত্তিরে গিয়ে আবার এই ভোরবেলায় না এসে একটু বেলায়..

সাড়ে চারটের সময় একটা নার্সিংহোমে একজন পেসেন্টকে দেখতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে ঘুরে গেলাম।

মাস্টারমশায়ের মেয়ে বলে, তাহলে তো ঘন্টা দুয়েকের বেশি ঘুম হয়নি।

ডাক্তার হেসে বলে, না, তা হয়নি।

দিনে কি ঘুমুবার সুযোগ হবে?

বছর খানেকের মধ্যে তো দিনে ঘুমুবার সুযোগ হয়নি। জানি না আজ কি হবে।

কিন্তু এভাবে পরিশ্রম করলে তো শরীর ভেঙে পড়বে।

বিধবা মা অনেক দুঃখ কষ্টের মধ্যে আমাকে মানুষ করেছেন। এই কষ্টে আমার শরীর ভেঙে পড়বে না।

দিন পাঁচেক পর মাস্টারমশায়ের জামাইয়ের অবস্থা সত্যি ডাক্তারকে ঘাবড়ে দিয়েছিল কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত সামলে যায়। তারপর থেকে আস্তে আস্তেই অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।

এই তিন সপ্তাহে ডাক্তারের সঙ্গে এ বাড়ির সবার সম্পর্কও অনেক ঘনিষ্ঠ হয়েছে। মাস্টারমশায়ের স্ত্রী আর ঘোমটার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখেন না। মাস্টারমশাযের সেই কৃপাপ্রার্থীর মনোভাব আর নেই। জামাই সৃজিত ডাক্তারের প্রায় বন্ধু হয়ে গেছে। হাসতে হাসতে সুজিত বলে, এখন মনে হচ্ছে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে এসে অসুস্থ হওয়ায় ভালোই হয়েছে। অসুস্থ না হলে তা তো আপনাকে পেতাম না। মাস্টারমশায়ের মেয়ে দেবকী বলে, আমরা এলাহাবাদ ফিরে গেলে আপনাকে একবার আসতেই হবে।

ডাক্তার হেসে বলে, সময় কোথায়?

ওসব জানি না। আপনাকে আসতেই হবে।

ডাক্তার ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, আসতেই হবে?

একশ বার আসতে হবে।

ডাক্তার সুজিতের দিকে তাকিয়ে বলে, জামাই, শুনছ তোমার বউয়ের কথা?

ও ঠিকই বলছে।

ডাক্তার বলে, তাহলে একবার নিশ্চয়ই এলাহাবাদ যেতে হবে।

এর দুচার দিন পরেই অপরূপা হাসতে হাসতে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল, মাস্টারমশায়ের বাড়িতেও কি আরেকটা অপরূপার দেখা পেলে?

ডাক্তার অবাক হয়ে বলে, তার মানে?

মানে দেখে শুনে মনে হচ্ছে ওখানেও একটা অপরূপা পেয়েছ। তা না হলে বিনা পয়সার চিকিৎসায় এত উৎসাহ কেন?

যাদের বেশি পয়সা নেই, যারা শুধু আমার উপর নির্ভর করে, সেরকম সব পেসেন্টদেব বাড়িতেই আমি বার বার যাই।

পয়সা পেলে কেন যাবে না?

শুধু পয়সার জন্য আমি চিকিৎসা করি না।

কেন তুমি কি রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী?

সন্ন্যাসী কেন হব?

তাহলে মাস্টারমশায়ের কাছ থেকে কিছু নিলে না কেন?

কারণ উনি আমার মাস্টারমশাই।

পেসেন্ট তো ওর জামাই। সে তো চাকরি বাকরি করে?

ডাক্তার হেসে বলে, ও বাড়ি থেকে টাকা নিইনি বলে কি তোমার কোনো কষ্ট হচ্ছে?

কষ্টের কথা তো বলি না। তোমার প্রাপ্য তুমি নেবে না কেন?

ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে পারে না। মুখ নিচু করে একটু ভাবে। বলতে পারে না, অপরূপা, আমি যদি আমার উচিত প্রাপ্য নিতাম তাহলে তোমার বাবা-মাকে পথের ভিখারী হতে হত। তোমারও বিয়ে হত কি না, তা ভগবান জানেন। ডাক্তার বলতে পারে না তার মায়ের কথা, দ্যাখ বাবা, পয়সার লোভে চিকিৎসা করবি না। যদি তোর খাওয়া পরার কষ্ট না থাকে, তাহলে কোনো গরিব লোকের কাছ থেকেই পয়সা নিস না। দেখবি ওদের আশীর্বাদে তোর আয় দশগুণ বেড়ে যাবে।

মার কথা ভাবতে গিয়েও ডাক্তারের চোখে জল আসে। ডাক্তার হুইস্কির গেলাসটা পাশে সরিয়ে রেখে আমাকে বলে, জানো জার্নালিস্ট, মার কথা বর্ণে বর্ণে সত্যি প্রমাণিত হয়েছে আমার জীবনে। একটা গরিব পেমেন্টের টাকা ছেড়ে দিলে দশটা বড়োলোকের বাড়ির পেসেন্ট হাতে আসে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, জার্নালিস্ট। আমি পদে পদে এর প্রমাণ পাই। ডাক্তার একটু হেসে বলে, মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমি কি ভবিষ্যতে বেশি পাবার লোভে এদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছি না? পর মুহূর্তে মনে হয়, না, না, তা কেন হবে? আমি তো আমার মাতৃ আজ্ঞা পালন। করছি।

তাই তো।

ডাক্তার গেলাসে এক চুমুক দিয়ে বলে, অপরূপা এত তাড়াতাড়ি তার অতীত ভুলে গেল যে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। তাছাড়া ও যত পেয়েছে, তত ওর লোভ বেড়েছে। আমি সত্যি এসব ভাবতে পারি না।

তুমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করেছ?

বহুবার, বহুভাবে। ডাক্তারের গেলাস খালি হয়। আবার ভরে নেয়। বলে, স্বামীস্ত্রীর সম্পর্ক এমনই অদ্ভুত যে একজনের সব মহত্বক্ষুদ্রতাই অন্যের কাছে ধরা পড়ে। তাই প্রতিদিন প্রতি পদক্ষেপে ওর এত ক্ষুদ্রতা এত দৈন্য দেখি যে আমি আর ওকে ভালোবাসতে পাবি না; বরং ঘেন্না করি। আমি আস্তে আস্তে ওর থেকে দূরে সরে যেতে যেতে আজ কতজনের মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিযেছি।

এবার আমি একটু হেসে বলি, অনেকের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছ?

হ্যাঁ, অনেকের কাছে। তারপর ডাক্তার একটু হেসে বলে, ছাত্রজীবনে অনেকের সঙ্গে প্রেম করেছি কিন্তু চরিত্রহীন ছিলাম না। একবার নীলিমা আমাকে কি বলেছিল জানো?

কি?

বলেছিল, ছেলেদের সঙ্গে একটু বেশি ঘনিষ্ঠতা হলেই তারা অনেক কিছু দাবি করতে শুরু করে কিন্তু তুমি বেশি কিছু দাবি কর না বলেই তোমার সঙ্গে এত প্রাণখুলে মিশতে পারি।

শুনে আমি হাসি!

ডাক্তার হুইস্কির গলাসটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে একটু ম্লান হাসি হাসে আপনমনে। তারপর সে যেন স্বগতোক্তি করে, নদীর জলে বাধা দিলেই সে দশদিক দিয়ে এগুবার চেষ্টা করে; এটাই জলের ধর্ম। মানুষেরও তাই স্বভাব। সে একজনের কাছে প্রাণ ভরে ভালোবাসা পেলে দশজনের কাছে ভালোবাসার ভিক্ষা চাইবে না, কিন্তু ঐ একজনের কাছে হতাশ হলে সে বিপথগামী হবেই।

আমি বলি, হা ডাক্তার, অনেকের জীবনেই এই ঘটনা ঘটে।

ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, জার্নালিস্ট, এখন অন্যের কথা বাদ দাও। আমার কথাই শোন।

পার্ক সার্কাসের এক তরুণ ডাক্তারের টেলিফোন পেয়েই ডাক্তার ছুটে গেল। ভদ্রলোক বয়স বেশি না, বড়ো জোর চৌত্রিশপঁয়ত্রিশ। কন্সট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার। বিলেতেই থাকেন। বিয়ে করেছেন বছর পাঁচেক আগে। একটি মেয়ে হয়েছে। তার বয়স বছর দেড়েক। ভদ্রলোকের স্ত্রীকে এককালে কলকাতার নানা মঞ্চে শ্যামার ভূমিকায় দেখা গেছে। সবচাইতে ছোটো ভাইয়ের বিয়ের জন্য লন্ডন থেকে এসেছেন। বিযেও বেশ ভালোভাবেই হয়েছে। বৌভাতও খুব সুষ্ঠভাবে হল। চার ভাই মহা খুশি। খুশি ওদের বৃদ্ধা মা ও বাড়ির সবাই।

দুদিন পর ভোরের দিকে হঠাৎ বুকে ব্যথা। অসহ্য ব্যথা! অবশ হয়ে যাচ্ছে এক দিক। সঙ্গে ঘাম। ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান ছুটে এলেন। একটু দেখেই তার মুখের চেহারা বদলে গেল। ওর টেলিফোন পেয়েই ডাক্তার ছুটে গেলেন। হ্যাঁ, যা সবাই আশঙ্কা করেছিলেন, তাই।

বড়ো ভাই ডাক্তারকে বললেন, ভাইকে সুস্থ করার জন্য যা দরকার তাই করুন। ডাক্তার নার্স ওষুধনার্সিংহোম, কোনো ব্যাপাবেই আপনার দ্বিধা করার প্রয়োজন নেই।

ডাক্তার বললেন, এ পেসেন্টকে নার্সিংহোম নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। তাই বাড়িতেই সবকিছু করতে হবে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই করুন।

পার্ক সার্কাসের এই বাড়িরে পেসেন্টের ঘরকেই আধুনিক নার্সিংহোমে পরিণত করা হল। কত রকমের মেসিন আনা হল। কার্ডিয়াক পেসেন্ট দেখাশুনা করে এমন নার্সদেরও আনা হল। ঘণ্টায় ঘণ্টায় দেখছেন ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান। এছাড়া ডাক্তার বার বার আসছেন ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকছেন।

বাহাত্তর ঘণ্টা কেটে গেল। সবার চোখেই আশার আলো। রাত সাড়ে বারোটার পর ডাক্তার বাড়ি যাবার সময় বলে গেলেন, হার্টের কন্ডিশন অনেকটা স্টেবিলাইজ করেছে। অবস্থা এইরকম থাকলে ভয়ের কিছু নেই।

রাত পৌনে তিনটের সময় হঠাৎ সিস্টারের ফোন, স্যার এখুনি চলে আসুন।

ডাক্তার পনের মিনিটের মধ্যে ছুটে যায়।

হ্যাঁ, হঠাৎ সেই ব্যথা, সিরিয়াস সেই ব্যথা। ডাক্তার যুদ্ধ করে, যুদ্ধ করে নার্স কিন্তু না, ওরা হেরে গেল। চারদিকে ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গেই এ বাড়িতে অমাবস্যার অন্ধকার নেমে এল। ডাক্তারের পায়ের উপর মুর্চ্ছা গেলেন পেসেন্টের স্ত্রী আর বড়ো ভাই। ডাক্তার চোখে অন্ধকার দেখে। হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যাবার উপক্রম। সামলে নেয় সিস্টার।

ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মৃত্যু অনেক দেখিছি কিন্তু এই পেসেন্টের মৃত্যুতে এমন শক্ পেলাম যে তখন গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরার মতো অবস্থা আমার নেই। সিস্টার কাছেই সি. আই. টি. রোডে থাকত। ও আমাকে ওর বাড়িতেই নিয়ে গেল।

তারপর?

ছোট্ট দুখানা ঘরের ফ্ল্যাট। আশা আর ওর দাদাবৌদি থাকেন। কখনও কখনও দেশ থেকে মা আর ছোটো ভাই আসে। ঘরে ঢুকলেই বোঝা যায়, অত্যন্ত সাধারণ অবস্থা কিন্তু আশার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে যান ডাক্তার।

ডাক্তার বলল, বোধহয় ঘন্টাখানেক আশার ওখানে ছিলাম কিন্তু ঐটুকু সময়ের মধ্যেই বুঝলাম, আশা মানুষকে ভালোবাসতে পারে, মানুষের সুখদুঃখ বোঝে।

তারপর প্রায় বছর খানেক আশার সঙ্গে ডাক্তারের দেখা হয় না। সেদিন রুগীরা চলে যাবার পরও ডাক্তার চেম্বারে বসে আছেন এক বন্ধুর অপেক্ষায়। একলাই। স্টাফদের ছুটি দিয়েছেন। হঠাৎ টেলিফোন…….

ইয়েস।

স্যার আমি আশা।

আশা। মানে সিস্টার আশা?

হা স্যার।

কেমন আছ? কাজকর্ম কেমন চলছে?

এমনি ভালো আছি, তবে কাজকর্ম কখনও ভালো, কখনও খারাপ।

তুমি কি কোনো নার্সিংহোমে চাকরি করতে ইন্টারেস্টেড?

হা স্যার।

ঠিক আছে, আমি দেখছি।

স্যার, আমি কিন্তু নিজের জন্য টেলিফোন করিনি।….

হ্যা বল, টেলিফোন করলে কেন?

স্যার আপনার শরীরটা বোধহয় ঠিক নেই, তাই না?

হ্যাঁ, খুব টায়ার্ড কিন্তু তুমি কি করে জানলে?

সেদিন কন্টিনেন্টাল নার্সিংহোমে আপনাকে দূর থেকে দেখেই……

তুমি ওখানে ছিলে নাকি?

হা স্যার, আমি পাশের কেবিনে ছিলাম কিন্তু আপনাকে দেখেছি। দেখেই মনে হল, আপনার রেস্ট দরকার।

সত্যি ডাক্তার বড়ো ক্লান্ত। হবে না কেন? এত রুগী সামলান কি সহজ ব্যাপার? খাওয়া দাওয়ার কোনো ঠিক নেই। ঘুম? না, বহুকাল ভালো করে ঘুমুতে পারে না কিন্তু কেউ তো ডাক্তারকে বলেনি, তুমি ক্লান্ত, তুমি বিশ্রাম নাও।

মুগ্ধ ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে পারে না। কয়েক মুহূর্ত পরে বলে, ঠিক বলেছ আশা, আমার রেস্ট দরকার।

অন্তত দশপনের দিনের জন্য কোথাও চলে যান স্যার।

অত দিন বাইরে থাকা মুস্কিল কিন্তু পাঁচসাত দিনের জন্য যেতে পারি। তবে একলা গেলে তো সারাদিন শুধু হুইস্কি খাব; তুমি যাবে আমার সঙ্গে?

আমি? আশা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ, তুমি।

আপনি সিরিয়াসলি বলছেন স্যার?

হ্যা আশা, আমি সিরিয়াসলি বলছি। তুমি কদিন দেখাশুনা করলে আমি সত্যি সুস্থ হব

আপনি যদি তাই মনে করেন তাহলে নিশ্চয়ই যাব স্যার।

ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, আশাকে নিয়ে চলে গেলাম গোপালপুর অন-সী। ওবেরয় পান বীচএ আগের থেকেই ঘর বুক করা ছিল। সত্যি বলছি জার্নালিস্ট, আমাকে আশা কত শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে, তা সেবার দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। সেবাযত্নের কথা তো বাদই দিচ্ছি।

আমি একটু হেসে বললাম, সো, ইউ হ্যাড এ ওন নাইস টাইম।

একশবার! মানসিক, দৈহিক সব দিক থেকেই মহানন্দে ছিলাম।

আশা এখনও কলকাতায় আছে? আমি হাসি চেপে প্রশ্ন করি

হ্যাঁ।

এখনও মাঝে মাঝে গোপালপুরেব সমুদ্রে দুজনে একসঙ্গে স্নান করো?

বছরে একবার নিশ্চয়ই যাই! তাছাড়া দুএক মাস অন্তর দুএকদিনের জন্য কোথাও কোথাও আশাকে নিয়ে চলে যাই।

তুমি কি আশাকে ভালোবাসো?

নিশ্চয়ই ভালোবাসি।

আর কাকে ভালোবাসো?

অনেককেই আমি ভালোবাসি।

অনেককে?

হ্যা অনেককে। যারা আমাকে ভালোবাসে, আমিও তাদের ভালোবাসি।

আমি হেসে বলি, নট এ ব্যাড থিওরি।

ডাক্তার আমার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরায়। পর পর দুনিটে টান দেবার পর বলল, এইতো দিল্লি আসার পথে দুদিন এলাহাবাদে কাটিয়ে এলাম।……

এলাহাবাদে?

হ্যাঁ। দেবকী আছে না?

কোনো দেবকী?

মাস্টারমশায়ের মেয়ে। যার স্বামীর… …

হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়ছে। তুমি তাহলে সত্যি এলাহাবাদ গেলে?

গেলে মানে? দিল্লি আসা-যাওয়ার পথে সব সময় এলাহাবাদ নামি! না নেমে পারি না।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

আমি হেসে জিজ্ঞাসা করি, তোমার হৃৎপিণ্ডের এক টুকরো কি ওখানেও জমা রেখেছ?

ইয়েস।

গুড গুড।

তাহলে শোনো।… …

আগে মনে পড়েনি। মনে পড়লে নিশ্চয়ই চিঠি লিখত, দেবকী, মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের কাজে দিল্লি যাচ্ছি। মাঝ পথে এলাহাবাদ। তাই ভাবছি নেমেই পড়ব দুএক দিনের জন্য। তোমাদের দুজনের সঙ্গে আড্ডা দেবার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারছি না। কিন্তু না, মনে পড়েনি। ডাক্তার এত ব্যস্ত থাকে যে অনেক কথাই মনে পড়ে না। রুগীদের চিন্তায় এত ব্যস্ত থাকে যে অন্য কোনো কিছু চিন্তার অবকাশ পায় না। মনে পড়ল কালকা মেলে উঠে। ডাক্তার মনে মনে অনুশোচনা করে চিঠি না দেবার জন্য। চিঠি না দিয়ে যাওয়া উচিত নয় কিন্তু মনে মনে বড়ো ইচ্ছে করছে দেবকীর কাছে যেতে।

কালকা মেলের বার্থে বসে হুইস্কি খেতে খেতে ডাক্তারের মনে পড়ে দেবকীর কথা।..

.

ডাক্তারদা।

কি? ডাক্তার মুখ না ফিরিয়েই জানতে চায়।

এই হরলিক্সটুকু খেয়ে নিন।

ডাক্তার বিস্মিত হয়ে ওকে দেখে। ওর স্বামী জীবনমরণের মাঝে ভাসছে কিন্তু তবু সে হরলিক্স এনেছে!

দেবকীর মুখে হাসি নেই কিন্তু সারা মুখে তার ঐকান্তিকতার ছাপ! বলল, এখন রাত প্রায় একটা। কখন বাড়ি গিয়ে খাওয়াদাওয়া করবেন, তার তো ঠিক নেই। এটুকু খেয়ে নিন

ডাক্তার একটু হেসে বলে, এই অবস্থার মধ্যেও তুমি আমার জন্য হরলিক্স তৈরি করলে?

তাতে কি হল? আপনার শরীরটাও তো দেখতে হবে।

হুইস্কির গেলাসের দিকে তাকালেই যেন ডাক্তার দেবকীকে দেখতে পায়। কি অপূর্ব শান্ত, স্নিগ্ধ মুর্তি! ঐ মহাবিপর্যয়ের মধ্যেও সে অবিচলভাবে কর্তব্য পালন করেছে। বিপদের মধ্যেও সে মুষড়ে পড়েনি; আবার যেদিন সম্পূর্ণ সুস্থ হল সেদিন আনন্দেও ভেসে যায় নি। ও যেন মাঝ গঙ্গায় আপন মনে ভাটিয়ালি গাইতে বিভোর। জোয়ার না ভাটা–সেদিকে খেয়ালই নেই।

জামাইয়ের ঘরে ডাক্তার ছাড়াও আরো অনেকে। হঠাৎ দেবকী এসে বলল, ডাক্তারদা, একটু হাত ধুয়ে নিন।

না, না, এখন কিছু খাব না

দুমিনিট পরেই দেবকী ঘুরে এল। সবার সামনে নির্বিবাদে বলল, শিগগির হাঁ করুন।

ডাক্তার অবাক হয়ে হাসে। দেবকী ঐ সুযোগেই ওর মুখের মধ্যে লুচি আলুর দম পুরে দেয়।

এ রকম আরো কত টুকরো ঘটনা ডাক্তারের মনে পড়ে। দেবকীর কথা ভাবতে ভাবতে এমন বিভোর হয়ে যায় যে হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিতেও ভুলে যায়। তারপরে হঠাৎ কালকা মেল খুব জোরে ব্রেক কষে থামতেই ডাক্তারের সংবিত ফিরে আসে।

ডাক্তার গেলাসের হুইস্কি শেষ করে আবার ভরে নেয়। আবার ভাবে দেবকীর কথা। জামাইয়ের কথা। খবর না দিয়ে গেলেও কোনো অসুবিধা নেই। ডাক্তারকে কাছে পেলে ওরা দুজনেই খুশি হবে। দারুণ খুশি হবে। পাঁচ পেগ হুইস্কি পেটে যাবার পর ডাক্তার ঠিক করল, এলাহাবাদে নামবে। নামতেই হবে।

কালকা মেল আধ ঘণ্টা দেরিতে এলাবাদ পৌঁছল। ঠিক মহল্লায় পৌঁছে যেতে বেশি সময় লাগল না কিন্তু বাড়িটা খুঁজতে খুঁজতে একটু সময় লাগল। ডাক্তার পৌঁছবার আগেই জামাই অফিস চলে গেছে। দরজা খুলেই ডাক্তারকে দেখে দেবকী আনন্দে খুশিতে চিৎকার করে উঠল, ডাক্তারদা!

দেবকী ওর হাত ধরে টানতে টানতে ঘরের মধ্যে নিয়েই টিপ করে প্রণাম করল। ডাক্তার দুহাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, খবর না দিয়ে এসে অন্যায় করলাম কি?

দেবকী ডাক্তারের বুকের উপর মুখখানা রেখে বলে, এমন অন্যায় রোজ করতে পারেন না?

রোজ?

হ্যা রোজ। রোজ আপনার কথা ভাবি

কাল সারারাত আমিও তোমার কথা ভেবেছি আর গেলাসের পর গেলাস হুইস্কি খেয়েছি।

তাই কি কাল সারারাতে আমিও ঘুমোতে পারিনি?

কাল রাত্তিরে বুঝি তোমার ঘুম আসছিল না? ডাক্তার আলতো করে হাত দিয়ে দেবকীর মুখখানা তুলে ধরে জিজ্ঞাসা করে।

ঘুমিয়েছি কিন্তু একেবারে ভোর রাত্রে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

জামাই কিছু বলল না?

ও জানে না।

তাহলে সত্যি তুমি আমাকে ভালোবাসো?

নিশ্চয়ই ভালোবাসি! প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি।

ডাক্তার ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে খুব চাপা গলায় বলল আমিও তোমাকে ভালোবাসি।

জানি।

সত্যি জানো?

হা জানি।

কি করে জানলে?

পরে বলব। এখন বসুন। চা করি।

ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে বাহুবন্ধন থেকে দেবকীকে মুক্তি দিয়ে বলে, হ্যাঁ, চা করো। কতদিন তোমার হাতে চা খাই না।

ডাক্তার কোট খোলে, টাই খোলে, জামার বোতামগুলো খুলে পাখার তলায় বসে।

দেবকী চা আনে। পাশে বসে। বলে, সত্যি, আমি ভাবতে পারছি না। আপনি এসেছে।

কেন?

মনে হচ্ছে, আমি যেন স্বপ্ন দেখছি।

কাল দুপুরেও আমি জানতাম না, আজ দুপুরে তোমাকে কাছে পাব।

কেন? আগের থেকে ঠিক করেননি?

না। ট্রেনে উঠে হুইস্কি খেতে খেতে ঠিক করলাম, দেবকীর কাছে যাব।

খুব ভালো করেছেন। চা খেতে খেতে দেবকী বলে, আপনি স্নান করুন। আমিও চটপট কাজ সেরে নিই। তারপর সারা দুপুর গল্প করব।

তোমার আবার কি কাজ?

একটু রান্না করব।

কেন? তোমার রান্না হয়নি?

হয়েছে, একটু বাকি।

না, না, তোমাকে আর কিছু করতে হবে না। যা আছে তাই দুজনে ভাগ করে খেয়ে নেব।

না, ডাক্তারদা তা হয় না।

ডাক্তার দেবকীর কাঁধে হাত রেখে বলেন, তাই হবে। তারপর একটু থেমে বলেন, তুমি যা দেবে তাতেই আমার পেট ভরবে।

না, না, আপনার কষ্ট হবে। দেবকী, আমি বিধবার ছেলে। শুধু সিদ্ধ ভাত খেতেও আমার কষ্ট হয় না।

না, দেবকী আর কিছু রান্না করে না। যা ছিল তাই দিয়ে দুজনে খেতে বসে–ডাইনিং টেবিলে না, মেঝেয় আসন পেতে। কোনো চায়নার প্লেটে না, কাঁসার থালায়। দেবকী হাসতে হাসতে বলল, খুব অসুবিধে হচ্ছে তো?

তা একটু হচ্ছে। মা মরে যাবার পর কেউ তো এমন আন্তরিকভাবে যত্ন করে খাওয়ায় নি, তাই অভ্যাসটা নষ্ট হয়ে গেছে।

দেবকী অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়। ডাক্তার আবার বলে, জানো দেবকী আমি নাকি নামকরা ডাক্তার। আমি চেম্বারে বসেই এক একদিন সাত আট হাজার টাকা আয় করি।..

তাই নাকি?

হ্যা দেবকী। সবাই একশ আঠাশ টাকা করে দেয়। পনের কুড়ি জন পেসেন্ট রোজই দেখি কিন্তু কোনো কোনো দিন পঞ্চাশ ষাটজনকেও দেখি। আজ আমার কত কি হয়েছে কিন্তু পাগলের মতো খুঁজে বেড়াই আন্তরিকতা আর ভালোবাসা। তারপর ডাক্তার একটু হেসে বলে, ঐ দুটোর লোভেই তোমার কাছে চলে এলাম।

দেবকী, মুখ নিচু করে বলে, ও দুটোর অভাব কোনদিন এখানে হবে না।

কোনোদিন হবে না?

না কোনদিন হবে না। ডাক্তার খেতে খেতেই দেবকীকে একবার চুমু খায়।

খেয়ে উঠেই ডাক্তার শুয়ে পড়ে। দেবকী ওর পাশে বসে গল্প করে– জানেন ডাক্তারদা, আপনাদের জামাই যেদিন অসুস্থ হয়, সেদিন বাবা খুব ভয়ে ভয়ে আপনার কাছে গিয়েছিলেন।

কেন?

বাবা আপনাকে স্কুলের নিচু ক্লাসে পড়াতেন। দীর্ঘকাল আপনার সঙ্গে বাবার যোগাযোগ হয়নি। ইতিমধ্যে আপনি বিখ্যাত ডাক্তার হয়েছেন।

তার জন্য ভয়ের কি আছে?

ভয় ছিল টাকাকড়ির ব্যাপারে। টাকা ব্যয় করে জামাইয়ের চিকিৎসা করাবার ক্ষমতা বাবার ছিল না। তাই…

দেবকী কথাটা শেষ করে না।

ডাক্তার জিজ্ঞেস করে, তাই কি?

তাই আপনি যখন টাকা নিলেন না তখন আনন্দে বাবা কেঁদে ফেলেছিলেন। আবার যখন ওষুধপত্র দিলেন তখন বাবার গর্ব দেখে কে?

ডাক্তার হাসে।

দেবকী আবার বলে, সত্যি আপনি ঐভাবে চিকিৎসা না করলে ওকে আমরা বাঁচাতে পারতাম না।

ডাক্তার দেবকীর হাতখানা নিয়ে খেলা করতে করতে বলে, না, দেবকী, ঠিক বললে না। টাকা ব্যয় করলেই কি রুগীকে বাঁচান যায়? এবার ডাক্তার একটু হেসে বলে, একটা কথা তোমাকে বলছি, কিন্তু কাউকে বল না।

না, না, বলব না।

মাস্টারমশায়ের জন্যই তোমাদের বাড়ি যাই কিন্তু জামাইয়ের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি শুধু তোমার জন্য।

আমার জন্য?

একশবার তোমার জন্য?

কেন? আমি কি করলাম?

সেদিন তোমাকে দেখেই মনে হয়েছিল, আহা এই মেয়েটা যদি আমাকে একটু ভালোবাসত তাহলে আমার জীবন ধন্য হত।

কি বলছেন আপনি?

হ্যা দেবকী সত্যি কথাই বলছি। তোমাকে খুশি করার জন্যে মিথ্যে বলছি না এবং বিশ্বাস করো, কোনোদিনই আমি তোমাকে মিথ্যে কথা বলতে পারব না।

দেবকী মুখে কোনো কথা বলে না। বলতে পারে না। শুধু মুগ্ধ দৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে থাকে।

ডাক্তার বলে, সেদিন তোমাকে দেখেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমি প্রাণপণে চেষ্টা করব যাতে দেবকী দুঃখ না পায়। ভগবান আমার মুখ রক্ষা করেছেন। ডাক্তার একটু থেমে বলে, তবে দুচারদিন পরে জামাইয়েরও প্রেমে পড়ে গেলাম। ভারি সুন্দর ছেলে।

দেবকী বলে আপনাকে যে ও কি চোখে দেখে তা বলে বোঝাতে পারব না।

তা আমি জানি, বুঝি।

দেবকী একটু কাত হয়ে বসে ডাক্তারের মাথায় হাত দিতে দিতে বলে, রাত্রে তো ঘুমোননি। এখন একটু ঘুমিয়ে নিন।

না, না, ঘুমোব না।

কেন? ঘুম পাচ্ছে না?

ঘুমালেই তো তুমি চলে যাবে।

না না, আমি চলে যাব না। আপনি ঘুমোন, আমি আপনার কাছেই থাকব। হঠাৎ ডাক্তার পাশ ফিরে শুয়ে দেবকীর কোমর জড়িয়ে ধরে বলে, দেবকী তোমাকে এত কাছে পেয়ে আমি যদি কোনো অন্যায় দাবি করি?

আপনার কোনো দাবিই অন্যায় হবে না।

কি বললে?

বললাম তো, আপনি যা ইচ্ছে দাবি করতে পারেন। আপনার কোনো দাবিকেই আমি অন্যায় মনে করব না।

আনন্দে, উত্তেজনায় ডাক্তার উঠে বসে দুহাত দিয়ে দেবকীকে জড়িয়ে ধরে বলে, সত্যি অন্যায় মনে করবে না?

না, কখনই না।

আমার চরম দুর্বলতা দেখেও রাগ করবে না?

না, ডাক্তারদা, আমি কোনোদিনই আপনার উপর রাগ করব না।

ডাক্তার দেবকীকে নিয়ে আনন্দে উন্মাদ হয়ে যায়।

দুজনে মুগ্ধ হয়ে দুজনকে দেখে। দুজনের মুখেই আত্মতৃপ্তি মাখা খুশির হাসি। মুখে না, শুধু চোখে চোখেই দুজনে কথা বলে। অনেক কথা যে কথা মুখে বলা যায় না, তা শুধু চোখের ভাষাতেই বলা যায়। অনেকক্ষণ এ ভাবেই কেটে যায়।

তারপর দেবকী বলে, কেউ ভাবতেও পারবে না এত বড়ো ডাক্তার আমার কাছে এসে এত ছেলেমানুষী করে।

আমি বুঝি খুব বড়ো ডাক্তার?

হ্যাঁ, তাবে আমার কাছে আপনি শুধু ডাক্তারদা।

ঠিক বলেছ দেবকী! যে বড়ো হয় সেও মানুষ।

আমি তো সেই মানুষটাকেই ভালোবাসি, বড়ো ডাক্তারকে না।

আমি জানি; বড়ো ডাক্তার ভাবলে তুমি এভাবে আমাকে কাছে টেনে নিতে পারতে না

আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করেই ডাক্তার বলে, দেবকী, চা খাওয়াও। তারপর চল আমরা দুজনে জামাইকে নিয়ে আসি।

ডাক্তারের কথা শুনে দেবকী অবাক হয়! বলে, আপনি ওর অফিস যাবেন?

যাব না কেন? আমরা দুজনে ওকে আনতে গেলে খুব মজা হবে।

মজা মানে? ও আপনাকে দেখে চমকে যাবে।

দেবকী চা করে। দুজনে পাশাপাশি বসে চা খেতে খেতে কথা হয়। ডাক্তার বলে, কাল এমন সময় আমি আবার ট্রেনে।

সে কি? আপনি কালই যাবেন?

পরশু যে দিল্লিতে মিটিং আছে। কাল দিল্লি এক্সপ্রেসে যাব

কী আশ্চর্য! তাহলে আপনি এলেন কেন?

কেন এলাম, তা এখনও বুঝতে পারনি?

দেবকী মাথা নেড়ে বলে, না, না, কাল যাওয়া হবে না। এসেছেন যখন তখন দু চারদিন থাকতেই হবে।

কিন্তু পরশু যে আমাকে দিল্লিতে থাকতেই হবে।

তা আমি জানি নে।

যদি তুমি বল, তাহলে ফেরার পথে আবার আসতে পারি।

সত্যি আসবেন?

তুমি বললেই আসব কিন্তু….

আবার কিন্তু কেন?

আমি যদি আবার পাগলামি করি?

যত ইচ্ছে পাগলামি করবেন কিন্তু আপনাকে আসতেই হবে। দেবকী ডাক্তারের হাত দুটো চেপে ধরে বলে।

চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে ডাক্তার দেবকীর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি না বললেও আমি আসতাম।

তবে কেন আমাকে ভয় দেখাচ্ছিলেন?

পাগলামি করার পারমিশনটা আগে থেকে আদায়ের লোভে।

লজ্জায় দেবকী উঠে যায়।

সাইকেল রিক্সায় উঠেই ডাক্তার দেবকীকে জিজ্ঞেস করল, জামাইয়ের ছুটি হতে কত দেরি আছে?

দেবকী ঘড়ি দেখে বলল, এখনও ঘন্টাখানেক।

তাহলে আমরা কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরেই জামাইয়ের অফিসে যাব।

কোথায় ঘুরবো?

এমনি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব।

হেঁটে হেঁটে।

না, না, এই সাইকেল রিক্সায়। তোমাকে পাশে নিয়ে ঘোরার মতো সুযোগ হয়নি তাই…….

দেবকী ডাক্তারের হাতখানা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে, আপনি সত্যি বিচিত্র মানুষ।

এজি অফিসের সামনে এসে যখন রিক্সা থামল, তখন ছুটির সময় প্রায় হয়ে এসেছে। দেবকী বলল, আমরা এখানেই অপেক্ষা করি। ও এখুনি বেরুবে।

হ্যাঁ, জামাই একটু পরেই বেরুল। ডাক্তারকে দেখেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। তারপর বাড়ি এসে কত হাসি, কত গল্প।

ডাক্তার মাঝখানে বসে দুহাত দিয়ে দুজনকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমার অনেক দোষ ত্রুটি আছে কিন্তু ভাই, আমি তোমাদের দুজনকে সত্যি ভালোবাসি। তোমরা আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না।

জামাই বলে, ডাক্তারদা, জানি আপনি অনেক বড় কিন্তু তবু আপনাকে আমাদেরই একজন মনে করি। আমরা ভুল করে আপনাকে সরিয়ে দিতে চাইলেই আপনি সরে যাবেন কেন? আমরা দুজনেই তো আপনার।

দেবকী বলে, ডাক্তারদা, আপনি যে আমাদের কত প্রিয়, কত আপন, তা কি আপনি বোঝেন না?

ডাক্তার বলে, তা জানি বলেই তো তোমাদেরই কাছে ছুটে এসেছি। আবার দিল্লি থেকে ফেরার পথে আসব। তারপর সময় পেলেই আসব। তোমাদের কাছে না এসে থাকতে পারব না।

সত্যি, ডাক্তার দিলি আসা যাওয়ার পথে সব সময় দুএকদিন এলাহাবাদে কাটিয়ে যায়। যাবেই। কেন ডাক্তারের বার বার মনে পড়ে সেই কটা কথা……

দেবকী, একটা কথা বলব?

বলুন ডাক্তারদা।

শেষ পর্যন্ত একজন চরিত্রহীন ডাক্তারের কাছে নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিলে?

দেবকী মাথা নেড়ে বলল, কে বলল আপনি চরিত্রহীন? যে ভালোবাসতে জানে সে কি চরিত্রহীন হয়? যে দেয়া-নেয়ার মধ্যে ভালোবাসা থাকে, তাতে কারুরই চরিত্র যায় না।

ডাক্তার মুগ্ধ হয়ে দেবকীকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *