নিরুদ্দেশ

নিরুদ্দেশ

আপনিও স্যান্ড ডিউন দেখতে এসেছেন?

ভদ্রলোকের প্রশ্ন শুনে মেয়েটি একটু অবাক হয়। বোধহয় একটু বিরক্তও হয়। রাজস্থানের পশ্চিম প্রত্যন্তের জৈসালমেঢ় জেলার প্রায় পশ্চিম প্রান্তদেশের এই বালির পাহাড়ে! এখানেও আবার একজন বাঙালি! মেয়েটি জবাব দেয়, হ্যাঁ। সঙ্গে সঙ্গে একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না।

আমার নাম সুদীপ্ত ব্যানার্জী। কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছি। আপনাকে টুরিস্ট লজএ দেখেছি বলেই…

কিন্তু আমি যে বাঙালি, তা জানলেন কী করে?

সুদীপ্ত একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, গুনগুন করে অতুল প্রসাদের কে আবার বাজায় বাঁশি এ ভাঙা কুঞ্জবনে না গাইলে হয়তো জানতে আরো দুএকদিন…

মেয়েটি একটু হেসে বলে, আমি আমার কটেজের মধ্যে পাগলের মতো যা তা সুরে গুনগুন করছিলাম কিন্তু আপনি তা শুনলেন কী করে?

আপনার কটেজের জানালাগুলো খোলা ছিল; তাছাড়া আমি তো আপনার পাশের কটেজেই আছি।

তাই বলুন।

অহেতুক বেশি আগ্রহনা দেখাবার জন্যই সুদীপ্ত বললেন, যাই, একটু ঘুরেফিরে দেখি।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখুন!

এমন অবিশ্বাস্য দিগন্ত বিস্তৃত বালির পাহাড় দেখে সুদীপ্ত অবাক হয়। মুগ্ধ হয় বিদায়ী সূর্যের আলোয় এই বালুকাময সাম্রাজ্যের বিস্ময়কর রূপ দেখে বেশ কিছুক্ষণ দেশিবিদেশি টুরিস্টদের ভীড়ে মিলেমিশে ঘুরে বেড়াবার পর উটের পিঠে চড়েও অনেকক্ষণ এদিকওদিক চক্কর দেয়। তারপর জীপ গাড়িগুলোর কাছে উটের পিঠ থেকে নামতেই আবার ওদের দেখা।

সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করে, উটের পিঠে চড়ে ঘুরলেন না?

দুদিন উটের পিঠে চড়ে ঘুরেছি। তাছাড়া আজ শাড়ি পরে এসেছি বলে…

এর আগে আরো দুদিন এখানে এসেছেন?

আসব না? প্রকৃতির এই খামখেয়ালিপনা দেখার জন্যই যে এখানে এসেছি।

বাঃ! খুব সুন্দর কথা বলেছেন। আপনি কী লিটারেচারের ছাত্রী।

না, না, আমি হিস্ট্রি নিয়ে পড়াশুনা করেছি।

এবার সুদীপ্ত একটু হেসে বলেন, আপনার নামটা কিন্তু এখনও জানতে পারিনি।

সরি! আমার নাম অলকানন্দা সরকার।

উটের পিঠে চড়ে টুরিস্টদের ঘোরাঘুরি পর্ব শেষ হয়েছে। দেশিবিদেশি সব টুরিস্টদের মুখেই স্যান্ড ডিউনের বৈশিষ্ট্য আর সৌন্দর্যের আলোচনা। শহরে ফিরে যাবার জন্য জীপ গাড়িগুলির ড্রাইভাররা হর্ন দিতে শুরু করতেই অলকানন্দা বলে, হর্ন দিচ্ছে : যাই।

সূর্যদেব ঢলে পড়তে না পড়তেই গাড়িগুলো এই বালির সাম্রাজ্য থেকে পালাবার জন্য শহরের দিকে রওনা হয়। অন্ধকার নামলে এই মরুভূমির দেশে পথভ্রষ্ট দিগভ্রষ্ট হয়ে নিরুদ্দেশ হবার সম্ভাবনা ষোল আনা। টুরিস্ট লজএ ফিরতে আটটা বেজে গেল

কটেজে ঢুকেই সুদীপ্ত ক্লান্তিতে নেয়ারের খাঁটিয়ায় শুয়ে পড়ে। একটু পরে একটা সিগারেট ধরায়। চোখের সামনে শুধু অলকানন্দার বুদ্ধিদীপ্ত সুন্দর উজ্জ্বল মুখখানাই দেখতে পায়। নানা কথা ভাবে। আপনমনে একটু হাসে। সিগারেট টানতেও যেন ভুলে যায়। একটু পরে এ্যাসট্রেতে সিগারেটটা ফেলে দেয়।

এইভাবে আরো কিছুক্ষণ কেটে যায়। তারপর হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়েই লাফ দিয়ে ওঠে। বাথরুমে যায়। স্নান করে। প্রায় দৌড়ে ডাইনিং হলএ খেতে যায়। দুচারজনকে এদিক ওদিক ছড়িয়েছিটিয়ে বসে থাকতে দেখলেও অলকানন্দাকে দেখতে পায় না।

.

খাওয়াদাওয়ার পর সামনের লনএ অনেককে গল্পগুজব করতে দেখে সুদীপ্ত একটু এদিকওদিক পায়চারি করে, কিন্তু না, সেখানেও অলকানন্দাকে দেখতে পায় না। সুদীপ্ত নিজের কটেজের দিকে এগিয়ে যায়।

একি! একলা একলা এখানে বসে আছেন? আবছা আলোয় কটেজের বাইরে অলকানন্দাকে দেখেই সুদীপ্ত প্রশ্ন করে।

খেয়েদেখে উঠেই তো শোবার অভ্যেস নেই, তাই…

কিন্তু একলা কেন? আপনার বাড়ির অন্যান্যবা…

সুদীপ্তকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই অলকানন্দা বলে, আমি একলাই এসেছি।

একলা?

অলকানন্দা একটু হেসে বলে, কেন, একলা বেড়াতে বেরুনো কী অন্যায়?

না, না, অন্যায় কেন হবে!

সাধারণত আপনার বয়সী মেয়েদের তো বাবা-মায়েরা একলা একলা বেরুতে দেন না। তাছাড়া..

তাছাড়া মেয়েদেরও তো একলা একলা বিশেষ বেরুতে দেখেন না, তাই তো?

হ্যাঁ। ঠিকই বলেছেন।

অলকানন্দা একটি হেসে বলে, আপনিও তো একলা বেরিয়েছেন, তাই না?

হ্যাঁ, আমিও একলাই এসেছি।

এবার অলকানন্দা বলে, যদি এখুনি ঘুমুতে না যান তাহলে আপনার কটেজ থেকে একটা চেয়ার এনে বসুন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আনছি।

সুদীপ্ত নিজের কটেজ থেকে চেয়ার এনে বসতেই অলকানন্দা জিজ্ঞেস করে, আপনি চলকাতায় থাকেন?

হা; আপনি?

হ্যাঁ, আমিও কলকাতার বাসিন্দা।

আপনি নিশ্চয়ই বাবা-মায়ের খুব আদুরে?

অলকানন্দা একটু হেসে জিজ্ঞেস করে, কেন বলুন তো?

এই আপনি একলা একলা বেরিয়েছেন, তাই জিজ্ঞেস করলাম।

আমার বাবা নেই।

নেই?

না। মুহূর্তের জন্য একটু থেমে ও বলে, তবে বাবা আমাকে খুবই ভালোবাসতেন।

আমাকে অসম্ভব ভালোবাসেন।

সুদীপ্ত সঙ্গে সঙ্গে কোনো প্রশ্ন করতে পারে না। একটু পরে প্রশ্ন করে, আপনি নিশ্চয়ই পড়াশুনা করছেন?

আবছা আলোতেও সুদীপ্ত দেখে, অলকানন্দা একটু ভাবে, একটু হাসে। তারপর বলে, পড়াশুনা করছি, তাও বলা যায়, আবার করছি না, তাও বলতে পারি।

তার মানে?

অলকানন্দা একটু স্পষ্ট করেই হেসে বলে, কোনোমতে এম. এ. ডিগ্রী জোগাড় করে। ফেলোশিপও পেয়েছি কিন্তু পড়াশুনা বিশেষ কিছু করছি না।

ফেলোশিপ মানে ইউজিসির ফেলোশিপ?

হ্যাঁ।

সুদীপ্ত হাসতে হাসতেই বলে, আপনি তো দারুণ খারাপ ছাত্রী!

ওর কথা শুনে অলকানন্দা না হেসে পারে না। তারপর হাসতে হাসতেই বলে, এমন দেখাচ্ছেন যেন আপনি হায়ারসেকেন্ডারিও পাশ করেননি।

প্রায় সেইরকম। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে সুদীপ্ত জিজ্ঞেস করে, মাকে সঙ্গে আনলেন না কেন?

ওর মুখ থেকে কথাটা বের হতে না হতেই অলকানন্দা বলে, আমি যেভাবে এসেছি সেভাবে তো মাকে আনা যায় না।

আপনি কি উইদাউট রিজার্ভেশনেই ট্রেনে চড়ে পড়েছেন যে মাকে..

না, তা না।

আপনার মা কি ছোট ঘোট ভাইবোনদের দেখাশুনার জন্যই…

আমার আর কোনো ভাইবোন নেই।

তাহলে মাকে একলা রেখে এলেন কেন? তিনিও তো একটু ঘুরেফিরে গেলে…

মাকে একলা রেখে আসিনি; মা আমার এক মামার কাছে আছেন।

তাহলে ভালোই করেছেন। সুদীপ্ত মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, ভাইএর কাছে কদিন তারও নিশ্চয়ই ভালো লাগছে।

না, না, মা বেড়াতে যাননি। বাবা মারা যাবার পর থেকেই আমি আর মা ঐ মামার থাকি

ও!

আপনার ঘুম পাচ্ছে না?

কেন? আপনার ঘুম পাচ্ছে?

এত তাড়াতাড়ি আমার ঘুম আসে না। আমি আর মা রোজ একটাদেড়টা পর্যন্ত গল্প করি।

আচ্ছা।

অলকানন্দা একটু হেসে বলে, রাত্তিরের ঐ গল্পগুজবটুকু না করে আমরা ঘুমুতেই পারি না। আমার নট ওনলি বেস্ট ফ্রেন্ড, শী ইজ অলসো মাই ওনলি ফ্রেন্ড।

ওর কথাটা শুনে সুদীপ্ত খুশির হাসি হেসে বলে, ইউ আর নট ওনলি এ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট বাট অলসো এ ভেরি গুড ডটার?

কিন্তু মা আমার চাইতেও হাজার গুণ ভালো।

আপনার মা নিশ্চয়ই খুব ভালো কিন্তু আপনার মতো মেয়েও তো আজকাল দুর্লভ!

অলকানন্দা সঙ্গে সঙ্গে হাসতে হাসতে বলে, যে মেয়ে বাড়িতে কাউকে কিছু না চলে আসে, সেরকম মেয়ে নিশ্চয়ই দুর্লভ!

চোখ দুটো বড় বড় করে সুদীপ্ত বলে, কী আশ্চর্য! আপনি কাউকে না বলেই এসেছেন? আপনার মা কি রকম চিন্তা করছেন, ভাবুন তো!

বিন্দুমাত্র উত্তেজিত না হয়ে ও বলে, মা যাতে চিন্তা না করে, সে ব্যবস্থা করে এসেছি। তবে মামা-মামীকে কিছু জানাইনি।

কিন্তু…

সুদীপ্ত কথাটা শেষ করে না।

কিন্তু কী?

যদি মামামামী থানাপুলিশ করেন?

আমি কী চুরিডাকাতিখুন করে পালিয়েছি যে মামামামী থানাপুলিশ করবে? অলকানন্দা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়।

সুদীপ্ত বলে, না, তা না, কিন্তু বাড়ি থেকে ছেলেমেয়ে হঠাৎ উধাও হয়ে গেলে তো লোকজন থানাপুলিশ করেন।

জানি।

তাহলে?

তাহলে কী?

যদি আপনার মামা থানায় রিপোর্ট করেন, তাহলে তো পুলিশ আপনাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে।

অলকানন্দা অত্যন্ত দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলে, সুদীপ্তবাবু, আমি কচি বাচ্চা না। চব্বিশ বছরের একজন যুবতী। তাছাড়া আমি সুস্থ স্বাভাবিক। আমি আমার ইচ্ছা ঘোরাঘুবি, কাজকর্ম বিয়েথা সবকিছুই করতে পারি। মামামামী তো দূরের কথা, পুলিশে সে ব্যাপারে কিছু করার অধিকার নেই।

সুদীপ্ত একটু হেসে বলে, তা ঠিক কিন্তু তবুও বলছি, পুলিশ আপনাকে ধরে আপনার মামামামী বা মার কাছে পৌঁছে দিতে পারে।

অলকানন্দাও হেসে বলে, সামান্য পুলিশের কথা তো বাদই দিচ্ছি; নাগরিক হিসাবে আমার মৌলিক অধিকারে নাক গলাবার অধিকার প্রাইম মিনিস্টারেরও নেই।

যদি আজ রাত্তিরেই পুলিশ আপনাকে ধরতে আসে?

যে পুলিশ অফিসার ধরতে আসবেন, তার কপালে অশেষ দুঃখ আছে।

ওর কথা শুনে সুদীপ্ত হো হো করে হাসে। তারপর বলে, আপনি তো দারুণ মেয়ে!

হ্যা সুদীপ্তবাবু, সত্যি আমি দারুণ মেয়ে। আমি মানুষকে ভালোবাসতে জানি কিন্তু ভয় করতে শিখিনি।

দুএক মিনিট দুজনেই চুপচাপ। তারপর অলকানন্দই আবার কথা বলে, আমার কথা তো অনেক শুনলেন। এবার আপনার কথা বলুন।

আমার কথা আর কী শুনবেন? আমি অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন।

চোদ্দ আনা বাঙালিই তো মধ্যবিত্ত; সেজন্য দুঃখ বা আক্ষেপ করার কি আছে?

না, না, দুঃখ করছি না; আমি এতই সাধারণ যে বলার কিছু নেই।

আপনি সাধারণ কি অসাধারণ, সে বিচার তো অন্যেরা করবেন।

তা ঠিক।

বলুন। লেখাপড়া কোথায় করেছেন?

লেখাপড়ায় তো আপনার মতো ভালো ছিলাম না, তাই কি শুনবেন?

আঃ, আপনি তো আচ্ছা লোক মশাই। বলুন, কোন কলেজে পড়েছেন?

সেন্ট জেভিয়ার্সে।

কীসে অনার্স ছিল?

আমি অনার্স নিয়ে পড়েছি, তা কী করে ভাবলেন?

আবার তর্ক করছেন? বলুন, কীসে অনার্স ছিল।

ইংরেজিতে।

এম. এ. পড়লেন কোথায়? কলকাতায় না যাদবপুরে?

কলকাতায়।

কবে পাশ করেছেন?

সেকি আজকের কথা? আমি যখন পাশ করি, তখন স্যার আশুতোষ ভাইস চ্যান্সেলার।

অলকানন্দা চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলে, আপনি যে আশুতোষের আমলের মানুষ তা তো আপনাকে দেখেই বুঝতে পারছি। কোন কলেজে পড়াচ্ছেন, তাই বলুন।

এত ভালো রেজাল্ট করেছিলাম যে কলেজে পড়াবার স্বপ্ন দেখারও সাহস হয়নি।

তাহলে কী করছেন?

সে কথা জিজ্ঞেস করে আর লজ্জা দেবেন না।

কেন? আপনি কি চুরি করছেন যে বলতে লজ্জা হচ্ছে?

না, চুরি করছি না ঠিকই কিন্তু যা করছি, সেটাও খুব গৌরবের নয়।

অলকানন্দা সঙ্গে সঙ্গে বলে, আপনার বড্ড ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স! আপনি যদি এম. এ. পাশ করে দারোয়ানের চাকরিও করেন, তাহলে তো দেশের নেতাদের লজ্জিত হওয়া উচিত। আপনি লজ্জা পাবেন কেন?

সুদীপ্ত ঐ প্রসঙ্গে কোনো জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে, শুতে যান, অনেক রাত হয়েছে।

অলকানন্দাও উঠে দাঁড়িয়ে বলে শুতে যাচ্ছি কিন্তু কাল সকালে আবার ঝগড়া করতে হবে। এখানে কদিন থাকরেন?

আপনি যে কদিন থাকরেন, আমিও সেই কদিন থাকব।

আমি যদি কালই এখান থেকে চলে যাই?

আপনার আপত্তি না থাকলে আমিও আপনার সঙ্গে অন্য কোথাও যেতে পারি।

কলকাতা ফেরার তাড়া নেই?

তাড়াতাড়ি ফিরলেই ভালো হয়; তবে একটু দেরি হলেও অসুবিধে নেই।

আচ্ছা গুড নাইট! কাল সকালে আবার কথা হবে।

গুড নাইট!

.

পরের দিন সকালে সুদীপ্ত ব্রেকফাস্টের জন্য ডাইনিং হলএ ঢুকতেই কোণার দিকে একটা টেবিল থেকে অলকানন্দা ইশারায় ডাকল

সুদীপ্ত সামনের চেয়ারে বসতেই অলকানন্দা বলল, কাল রাত্তিরে বোধহয় আমার কথাবার্তায় আপনি খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন, তাই না?

সুদীপ্ত একটু হেসে বলে, না, না, অসন্তুষ্ট হবে কেন? বরং আপনার স্পষ্ট কথাবার্তা খুব ভালো লেগেছে।

অলকানন্দাও একটু হেসে বলে, আমি একটু স্পষ্ট কথাবার্তা বললেও মেয়েটা খুব খারাপ না।

সুদীপ্ত চাপা হাসি হেসে বলে, আমাকে পেটের দায়ে অনেক বিচিত্র ধরনের মানুষ ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়। আপনি যে খারাপ না, তা আমি অনেক আগেই বুঝেছি!

বেয়ারা খাবারের অর্ডার নিয়ে চলে যেতেই অলকানন্দা জিজ্ঞেস করে, আপনি কোথায় চাকরি করেন?

মুহূর্তের মধ্যে একটু চিন্তাভাবনা করেই ও জবাব দেয়, পুলিশ।

পুলিশে?

হ্যাঁ।

পুলিশেই যদি চাকরি করবেন, তাহলে এম. এ. পড়লেন কেন?

এম. এ. পরীক্ষা শুরু হবার ঠিক তিন দিন আগে মা মারা গেলেন। তাই রেজাল্ট বিশেষ ভালো হল না। তাছাড়া একটা চাকরি পাওয়া খুবই জরুরী ছিল।

বেয়ারা খাবার দিয়ে যায় কিন্তু খাওয়া শুরু না করেই অলকানন্দা জিজ্ঞেস করে, আপনার মার কী হয়েছিল?

ক্যান্সার। সুদীপ্ত একটু থেমে বলে, বাবা রিটায়ার করার ঠিক দুবছর আগে মার ক্যান্সার ধরা পড়ে। নবছর রোগ যন্ত্রণা ভোগ করে মা মারা গেলেন কিন্তু মার চিকিৎসার জন্য বাবা দেনার দায়ে ভিখারী হয়ে গেলেন। তাই…।

ইস্! কী দুঃখের কথা!

দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। তারপর আস্তে আস্তে খেতে শুরু করে।

খেতে খেতে অলকানন্দা জিজ্ঞাসা করে, আপনার বাবা কী করতেন?

স্কুলে মাস্টারি করতেন।

স্কুল থেকে রিটায়ার করার পর কোনো কোচিংটোচিং..

সুদীপ্ত একটু ম্লান হাসি হেসে বলে, মা মারা যাবার দেড় বছরের মধ্যেই বাবা চলে যান।

মাই গড!

আবার কিছুক্ষণ নীরবতার পর অলকানন্দা জিজ্ঞেস কবে, আপনারা কভাই বোন?

সুদীপ্ত একটু হেসে বলে, আমার ঠাকুর্দা বাবামায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন। বাবারও কোনো ভাইবোন ছিল না। তবে আমার এক দিদি আছে কিন্তু বিশেষ যোগাযোগ নেই।

কেন?

প্রশ্ন করেই অলকানন্দা লজ্জিত হয় কিন্তু আরো কিছু বলতে যাবার আগেই সুদীপ্ত বলে, দিদির রূপ দেখেই জামাইবাবু ওকে বিয়ে করেন। কিন্তু বড্ড অহঙ্কারী। তাছাড়া ওরা মালেশিয়ায় থাকে।

আপনার জামাইবাবু কী খুব বড়লোকের বাড়ির ছেলে?

কফির পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে সুদীপ্ত বলে, খুব বড়লোকের বাড়ির ছেলে না হলেও যথেষ্ট সচ্ছল পরিবারের। তাছাড়া জামাইবাবু ডাক্তার।

সো হোয়াট!

দুজনেরই কফি খাওয়া শেষ কিন্তু তবু দুজনেই চুপ করে বসে থাকে।

একটু পরে অলকানন্দা জিজ্ঞেস করে, বিয়ে করেছেন?

সুদীপ্ত একটু হেসে বলে, দেনা শোধ না করেই টোপর মাথায় দেব?

তাহলে আপনি একেবারেই একলা?

না, আমার বড় মাসী আমার কাছে থাকেন। ও একটু থেমে বলে, আমার বড় মাসী আমার মার বিয়ের আগেই বিধবা হন। আমার জন্ম হবার পর থেকেই বড়মাসী আমাদের কাছে আছেন!

ডাইনিং হল থেকে বেরুতে বেরুতেই অলকানন্দা বলে, তাহলে তো আপনারা মাসীরও অনেক বয়স হয়েছে।

হ্যাসুদীপ্ত একটু হেসে বলে, তবে বুড়ি বলে, আমার ছেলেকে না দেখে মরতে পারবে না।

ওর কথা শুনে অলকানন্দাও একটু হাসে।

শহরের এদিকওদিক ঘুরতে ঘুরতে ওরা সালিম সিং কী হাভেলী পৌঁছে যায়। তারপর খান থেকে চলে যায় পাটোও কী হাভেলী। সব শেষে নাথলজী কী হাভেলী। ইতিমধ্যে রোদ্দর অসহ্য মনে হতেই ওরা টুরিস্ট লজএর দিকে পা বাড়ায়।

কদিনের ছুটি নিয়ে এসেছেন? অলকানন্দা হাঁটতে হাঁটতেই সুদীপ্তর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।

ছুটি নিয়ে আসিনি; কাজে এসেছি।

কলকাতার পুলিশে কাজ করেন; এখানে আবার কী কাজ?

আপনিই তো আমাকে টেনে এনেছেন।

অলকানন্দা থমকে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, আমি আপনাকে টেনে এনেছি?

সুদীপ্ত চাপা হাসি হাসতে হাসতে শুধু মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ।

তার মানে? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। কী ব্যাপার বলুন তো!

সত্যি শুনতে চান?

নিশ্চয়ই।

টুরিস্ট লজএ গিয়ে সব বলছি।

***

বড়বাবু সব শোনার পর বললেন, দেখুন, যদি কোনো গ্রোনআপ ছেলেমেয়ে–আই মীন অ্যাডাল্ট স্বেচ্ছায় বাড়ি থেকে কোথাও চলে যায়, তাহলে সেটা কোনো বেআইনী হয় না।…

ওর কথার মাঝখানেই দীপুবাবু বলেন, কিন্তু হঠাৎ কোনো বিশেষ কারণে যদি…

বড়বাবু একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, আপনারা তো আপনাদের কথা বলছেন। এবার আমাকে কিছু বলতে দিন।

বিনয়বাবু সঙ্গে সঙ্গে বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি বলুন।

বড়বাবুর আবার শুরু করেন, মিঃ ঘোষ, আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, আপনার ভাগ্নীর চিঠি থেকে স্পষ্ট যে তাকে কেউ কিডন্যাপ করেনি বা…

সে তো একশবার স্বীকার করব।

তাকে কেউ ভয় দেখিয়ে নিয়ে গেছে, তাও নয়।

বিনয়বাবু মাথা নেড়ে সম্মতি জানান।

বড়বাবু বিনয়বাবুর দিকে তাকিয়ে বলেন, আপনি শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান। তাই আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, গ্রোনআপ ও শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা সাধারণত তিনটি কারণে বাড়ি থেকে পালায়।

উনি লাইটার জ্বেলে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, নাম্বার ওয়ান–প্রেমঘটিত কোনো…

দীপবাবু ওর কথার মাঝখানেই বলেন, না, ওর ওসব কোনো ব্যাপার ছিল না।

বড়বাবু এবার গলা চড়িয়ে বলেন, উড ইউ প্লীজ স্টপ! তাছাড়া মশাই, আপনি হচ্ছেন মেয়েটির মামার দূর সম্পর্কের শালা। এ ব্যাপারে আপনাকে বকবক করার অধিকার কে দিল?

বিনয়বাবু শালাবাবুকে বলেন, এই দীপু, কেন কথার মাঝখানে বকবক করছো। এবার উনি বড়বাবুকে বলেন, প্লীজ আপনি বলুন।

বড়বাবু সিগারেটে একটা টান দিয়ে বলেন, প্রেমট্রেম ছাড়া হয় পারিবারিক কারণে না হয় নিজের মতো নিজের কেরিয়ার গড়ে তোলার জন্যই শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা বাড়ি থেকে হঠাৎ কোথাও চলে যায়।

এবার উনি একটু হেসে বলেন, এসব ব্যাপারে আমরা পুলিশের লোক হয়ে কি করতে পারি বলুন?

বিনয়বাবু একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, তা ঠিক কিন্তু মেয়েটা হঠাৎ বাড়ি থেকে চলে গেল। আপনারা যদি সাহায্য না করেন তাহলে আমরা কোথায় যাই।

বড়বাবু কোনো মন্তব্য না করে সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে এ্যাশট্রেতে ফেলে দেন।

বিনয়বাবু আবার বলেন, খবরের কাগজে তো হরদম দেখি, ছেলেমেয়ে হারিয়ে গেল পুলিশ তাদের খুঁজে বের করে।

বড়বাবু টেবিলে একটু ঘুষি মেরে বলেন, ইয়েস দ্যাটস রাইট। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা চলে গেলে বা হারিয়ে গেলে তারা নানা ধরনের ক্রিমিনালদের হাতে পড়তে পারে বলেই…

তা ঠিক।

বড়বাবু এক গাল হাসি হেসে বলেন, চোরডাকাত, খুনিটুনি ধরাই আমাদের কাজ।

ছেলেমেয়ে হারিয়েটারিয়ে গেলে আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি, এ্যাজ এ সোস্যাল সার্ভিস।

বিনয়বাবু বললেন, সবই বুঝতে পারছি কিন্তু আপনারা যদি সাহায্য না করেন, তাহলে আমরা কোথায় যাই?

বড়বাবু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, নিশ্চয়ই সাহায্য করব; তবে আমাদের লিমিটেনশনটাও বুঝবেন। আমাদের কাজ বা দায়িত্ব অনুপাতে লোকজন অত্যন্ত কম। তার উপর এই কলকাতা শহরে রোজ একটা না একটা পলিটিক্যাল ঝামেলা লেগেই আছে। এ ছাড়া ভি আইপিদের জন্য স্পেশ্যাল ডিউটি ছাড়া আজকাল সব কেষ্টবিচ্ছুদের বিয়েবাড়িতেও আমাদের দুতিনজন কনস্টেবল পাঠাতে হয়।

বিনয়বাবু একটু হেসে বললেন, তা যা বলেছেন।

বড়বাবু আর কোনো কথা না বলে কলিং বেল টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে একজন কনস্টেবল ঘরে ঢুকতেই বললেন, শ্রীনাথ বা সুদীপ্ত আছে?

কনস্টেবলের উত্তরের অপেক্ষা না করেই উনি বললেন, ওদের একজনকে আসতে বলো।

একজন তরুণ সাবইন্সপেক্টর ঘরে পা দিতেই বড়বাবু বললেন, সুদীপ্ত, এদের কেসটার একটা জি. ডি. করে নাও তো।

সাব ইন্সপেক্টর বিনয়বাবুর দিকে তাকিয়ে বলেন, আসুন আমার সঙ্গে।

.

দিন তিনেক পরের কথা! বেলা সওয়া দশটা সাড়ে দশটা হবে। বেল বাজতেই একজন ভদ্রমহিলা দরজা খুললেন।

আমি থানা থেকে আসছি।

মিসেস ঘোষ বললেন, ভেতরে আসুন।

ড্রইংরুমে দুএক পা এগিয়েই সাবইন্সপেক্টর সুদীপ্ত ব্যানার্জী জিজ্ঞেস করলেন, আপনি অলকানন্দা দেবীর কে?

মামী। মিসেস ঘোষ এইটুকু বলেই বললেন, আপনি বসুন। আমি দরজাটা বন্ধ করে দিই।

সাবইন্সপেক্টর ব্যানার্জী সোফায় বসতে না বসতেই মিসেস ঘোষ বাইরের দিকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, চা খাবেন? নাকি কফি?

ওসব কিছুর দরকার নেই।

মিসেস ঘোষ একটু হেসে বললেন, কফি খেতে আপত্তি নেই তো?

না, আপত্তি নেই তবে…

মিসেস ঘোষ একবার ভেতরে গিয়েই আবার ড্রইংরুমে ফিরে আসতেই সাবইন্সপেক্টর ব্যানার্জী বললেন, আপনি বসুন। অলকানন্দা দেবীর চলে যাবার ব্যাপারে আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করব!

মিসেস ঘোষ সামনের সোফায় বসতেই সাবইন্সপেক্টর ব্যানার্জী জিজ্ঞেস করলে অলকানন্দা দেবী আর তার মা কতদিন আপনাদের এখানে আছেন?

অনেক বছর। মেজদি বিধবা হবার বছরখানেক পর থেকেই।

মেজদি মানে অলকানন্দা দেবীর মা?

হ্যাঁ।

সে কত বছর আগেকার কথা?

অলকা যখন ক্লাস সেভেনএ পড়ে, তখন থেকেই ওরা আমাদের কাছে আছে

অলকানন্দা দেবীর কী আরো মামামামী আছেন?

মিসেস ঘোষ একটু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বলে, থাকবে না কেন? কিন্তু নিজের নিজের সংসার সামলে কে আর এইসব দায়িত্ব নিতে চায় বলুন?

আপনারা এই দায়িত্ব নিলেন কেন?

আমরা এই দায়িত্ব না নিলে ওঁরা তো ভীষণ বিপদে পড়তেন।

কাজের মেয়েটি দুকাপ কফি দিয়ে যেতেই মিসেস ঘোষ বললেন, নিন, কফি খেয়ে নিন।

হ্যাঁ, ঠিক আছে। কফির কাপে চুমুক না দিয়েই সাবইন্সপেক্টর ব্যানার্জী জিজ্ঞেস করেন, অলকানন্দা দেবীর বাবা কী করতেন?

রেলে চাকরি করতেন।

কী পোস্টে?

তা বলতে পারব না।

অলকানন্দা দেবীর মা নিশ্চয়ই পেনসন পান?

হ্যাঁ, পান।

মাসে মাসে কত টাকা পান তা জানেন কী?

মিসেস ঘোষ হাসতে হাসতেই মাথা নেড়ে বলে, আমি ওসবের খবর রাখি না।

অলকানন্দা দেবীর মা পেনসনের টাকা দিয়ে কী করেন বলতে পারেন?

প্রশ্নটা শুনে মিসেস ঘোষ মনে মনে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হলেও তা প্রকাশ না করে বলেন, অলকা বাড়ি থেকে চলে যাবার সঙ্গে এসব নিছক পারিবারিক ব্যাপারের কী যোগাযোগ, তা ঠিক বুঝতে পারছি না।

সাবইনসপেক্টর ব্যানার্জী অত্যন্ত ধীর স্থিরভাবে বলেন, তার চলে যাবার সঙ্গে তো পারিবারিক ব্যাপারের সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক। তাই ও কথা জানতে চেয়েছি।

হ্যাঁ, পেনসনের কিছু টাকা মেজদি ওঁর ভাইকে দেন।

ধন্যবাদ। সাবইন্সপেক্টর এবার প্রশ্ন করেন, আচ্ছা মিসেস ঘোষ, অলকানন্দা দেবীর সঙ্গে কি কোনো ছেলের ভাব-ভালোবাসা ছিল?

মিসেস ঘোষ একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, এ প্রশ্নের জবাব কি দেব, ভেবে পাচ্ছি না। অলকার বয়স হয়েছে, সুন্দরী শিক্ষিতা। কলেজইউনিভার্সিটিতে যখন পড়েছে, তখন অনেক ছেলের সঙ্গেই ভাবটাব আছে কিন্তু কাউকে ভালোবাসে কিনা, তা কি আমার জানা সম্ভব?

উনি মুহূর্তের জন্য একটু থেমে বলেন, অলকা আবার বেশ স্বাধীনচেতা ও একগুঁয়ে। ও অদ্ভুত কিছু করলেও আমি অন্তত অবাক হবো না।

ওঁর অমতে কী বাড়ি থেকে বিয়ে দেবার চেষ্টা হয়েছে?

না, না, কোনোদিন না।

অলকানন্দা দেবীর মা বাড়িতে আছেন তো?

হ্যাঁ, আছেন।

তার সঙ্গে একটু কথা বলব।

মিসেস ঘোষ বাড়ির ভেতরে চলে যান। দুএক মিনিট পরই শীলাদেবীকে নিয়ে ড্রইংরুমে এসেই সাবইন্সপেক্টরকে বলেন, ইনিই অলকার মা।

সাবইন্সপেক্টর ব্যানার্জী দুহাত জোড় করে নমস্কার করার সঙ্গে সঙ্গেই অলকার মাও দুহাত জোড় করে নমস্কার করেন।

সাবইন্সপেক্টর ব্যানার্জী অত্যন্ত সসম্ভ্রমে বললেন, আপনার মেয়ে বাড়ি থেকে চলে গেছে। নিশ্চয়ই আপনার মন খুব খারাপ। তবু আপনাকে একটু বিরক্ত করব। দয়া করে কিছু মনে করবেন না।

শীলাদেবী মাথায় আঁচলটা একটু টেনেই বললেন, আপনি তো আমাদের সাহায্য করতে এসেছেন। আপনার উপর কী আমি রাগ করতে পারি?

মিসেস ঘোষ পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে সাবইন্সপেক্টর বললেন, প্লীজ, আপনি এ ঘরে থাকরেন না। আর যাবার সময় দরজাটা বন্ধ করে দেবেন।

ওর কথা শুনে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে মিসেস ঘোষ বললেন, আপনারা কথা বলুন। আমি পাশের বাড়ি থেকে ঘুরে আসছি।

মিসেস ঘোষকে ওভাবে চলে যেতে দেখে সাবইন্সপেক্টর একটু চাপা হাসি হাসেন। তারপর শীলাদেবীর দিকে তাকিয়ে বলেন, আমি আপনার ছেলের মতো। আপনি যদি বিশ্বাস করে আমাকে সব কিছু খোলাখুলি বলেন, তাহলে খুব ভালো হয়।

উনি সঙ্গে সঙ্গে বলেন, নিশ্চয়ই আপনি আমার ছেলের মতো। আপনাকে কোন কিছু বলতেই আমার আপত্তি নেই।

দেখুন, আপনার ভাইএর কাছ থেকে জেনেছি, আপনার মেয়ে বরাবর খুব ভালো রেজাল্ট করেছেন এবং এক কথায় অত্যন্ত ভালো মেয়ে।…

শীলাদেবী একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে আমার মেয়ে সত্যি খুব ভালো। আপনি ওর স্কুলকলেজইউনিভার্সিটির বন্ধুবান্ধব অধ্যাপকদের কাছে জিজ্ঞেস করলেও জানতে পারবেন…

সাবইন্সপেক্টর ব্যানার্জী একটু হেসে বলেন, সন্তানকে মায়ের চাইতে বেশি ভালো করে তো কেউ চিনতে জানতে পারে না। আপনি যখন প্রাণ খুলে তাকে ভালো বলছেন, তখন তিনি যে সত্যি ভালো, সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

সাবইন্সপেক্টর একটু থেমে প্রশ্ন করেন, আপনারা অন্য কোথাও না থেকে এই ভাইয়ের কাছে কেন আছেন?

আমার এই ভাই যখন বছরখানেকের, তখন মা খুব অসুস্থ হন। ওকে আমিই খাইয়ে দাইয়ে স্নান করিয়ে দিতাম। ও আমার কাছে ছাড়া কারুর কাছে ঘুমোতেও পারত না।

শীলাদেবী এক নিঃশ্বাসে বলে যান, আমিও যেমন এই ভাইকে ভালোবাসি, এই ভাইও আমাকে প্রায় মায়ের মতোই সম্মান করে, ভালোবাসে।

আপনারাই ভাইয়ের স্ত্রী বলছিলেন, আপনি পেনসনের কিছু টাকা ভাইকে দেন।

আমি পেনসনের পুরো টাকাই ভাইবউকে দিয়ে দিই।

পুরো টাকা মানে কত টাকা?

এখন আমি মাসে মাসে চোদ্দশ পঁয়ত্রিশ টাকা পাই। আগে কম পেতাম।

আপনারা বা আপনার মেয়ের জন্য কিছুই রাখেন না?

আমার স্বামীর গ্র্যাচুইটিপ্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তো ব্যাঙ্কে জমা আছে। দরকার হলে সেখান থেকে কিছু তুলে নিই।

আপনার মেয়ের পড়াশুনার খরচ?

ওর পড়াশুনার জন্য তো বিশেষ খরচ করতেই হল না। স্কলারশিপের টাকাতেই

আপনার ভাইয়ের কাছে জেনেছি, আপনাব মেয়ে তো ইউ.জি.সি. ফেলোশিপও পেয়েছেন।

হ্যাঁ।

এবার বলুন, আপনার মেয়ে কি কোনো ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চেয়েছে?

না। ও প্রেমটেম করার মধ্যে নেই।

উনি বিয়ে করবেন না?

করবে না কেন?

আপনারা কি বিয়ের চেষ্টা করেছেন?

শীলাদেবী একটু চুপ করে থাকার পর বলেন, তাহলে আপনাকে খোলাখুলি একটা কথা বলি।

হ্যা বলুন।

আমার ভাইবউয়ের পিসতুতো ভাই দীপু আমার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য পাগল। এ ব্যাপারে আমার ভাইবউও খুব উৎসাহী কিন্তু ঐ অশিক্ষিত ভালগার ছেলেটাকে আমার মেয়ে সহ্য করতে পারে না।

এবার সাবইন্সপেক্টর সোজাসুজি প্রশ্ন করেন, ওর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্যই কি আপনার মেয়ে এ বাড়ি থেকে চলে গেছেন?

খুব সম্ভব তাই, কিন্তু আমাকে সে কথা বলেনি।

আপনাকে কী বলে গিয়েছেন?

বলেছে, কিছুদিন ঘুরেফিরে বেড়াবে আর তার সঙ্গে সঙ্গে রিসার্চের কাজও করবে। তাছাড়া একটা চাকরিবাকরি জোগাড় করারও চেষ্টা করবে।

উনি মামামামীকে বলে গেলেন না কেন?

ওর মামী আর দীপু কিছুতেই ওকে যেতে দিত না।

আর মামা?

আমার ভাই খুবই শান্তিপ্রিয় মানুষ। ও স্ত্রীর সঙ্গে তর্কঝগড়া করা একেবারেই পছন্দ করে না।

আপনার মেয়ের সঙ্গে টাকাকড়ি আছে তো?

ফেলোশিপের বেশ কয়েক হাজার টাকা ওর কাছে আছে।

আপনার মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে না?

না। তেমন কিছু না।

কেন?

আমি জানি, আমার মেয়ে কোনো অন্যায় কাজ করবে না।

কিন্তু কোনো বিপদআপদে তো পড়তে পারেন?

বিপদআপদ ঘটার ভয় থাকলে কী মেয়েকে এভাবে লেখাপড়া করাতে পারতাম? বিপদআপদ কী এই কলকাতা শহরে ঘটতে পারে না?

শীলাদেবীর কথা শুনে সাবইন্সপেক্টর ব্যানার্জী একটু খুশির হাসি হেসে বলেন, আপনার মেয়ে কোথায় গিয়েছেন বলে আপনার মনে হয়?

ঠিক বলতে পারব না; তবে আমার ধারণা, ও উদয়পুরে গিয়ে প্রফেসর চ্যাটার্জীর সঙ্গে দেখা করার পর হয়তো রাজস্থানেই ঘুরে ফিরে বেড়াবে।

প্রফেসর চ্যাটার্জীর কাছে কেন যেতে পারেন?

প্রেসিডেন্সিতে প্রফেসর চ্যাটার্জীর কাছে ও পড়েছে। আমার মেয়েকে উনি নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করেন আর আমার মেয়েও ওকে পিতৃতুল্য শ্রদ্ধা করে।

প্রফেসর চ্যাটার্জী এখন উদয়পুরে আছেন?

হ্যাঁ, উনি ওখানে ডীন।

ও!

সাবইন্সপেক্টর ব্যানার্জী মুহূর্তের জন্য একটু ভেবে জিজ্ঞেস করেন, আপনার মেয়ে কী আর কারুর সঙ্গে গিয়েছেন।

না, বাবা, তা বলতে পারব না। মাথার ঘোমটা আবার একটু টেনে নিয়ে বলেন, আমি কোনো ব্যাপারেই মেয়ের কাছে খুব বেশি কিছু জানতে চাই না।

কেন? সাবইন্সপেক্টর একটু অবাক হয়েই জানতে চান।

উনি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেন, যেটুকু আমার জানার প্রয়োজন, তা সে নিজেই জানিয়ে দেয়। এবার একটু থেমে বলেন, হাজার হোক মেয়ে বড় হয়েছে, লেখাপড় শিখেছে; তার ব্যক্তিগত ব্যাপার সম্পর্কে কী আমার খুব বেশি কৌতূহল থাকা উচিত

সাবইন্সপেক্টর কলম বন্ধ করে পকেটে রেখেই কাগজপত্র গুছিয়ে নেবার পর বলেন আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম। মাফ করবেন।

না, বাবা, কী আর কষ্ট! বরং আমার মেয়ের জন্য আপনাকেই কষ্ট করে আসতে হল

এ তো আমাদের দৈনন্দিন কাজ।

সাবইন্সপেক্টর দুহাত জোড় করে নমস্কার করার পর দরজার বাইরে পা দিযে বললেন, আপনার ভাইকে বলবেন, আপনার মেয়ের কয়েকটা ছবি নিয়ে আমার সঙ্গে এক যোগাযোগ করতে।

হ্যাঁ, বলব কিন্তু আমার মেয়ের তো বিশেষ ছবিটবি নেই।

যে ছবি আছে, তাই পাঠাবেন।

***

বিনয়বাবু পরের দিন অফিস থেকে ফেরার পথে থানায় গিয়ে সাবইন্সপেক্টর সুদী ব্যানার্জীর টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই উনি জিজ্ঞেস করলেন, ছবি এনেছেন?

বিনয়বাবু সামনের চেয়ারে বসে ব্রীফকে খুলতে খুলতেই বলেন, ইদানীংকালে তে ওর কোনো ছবি তোলা হয় নি, তাই যা ছিল, তাই নিয়ে এসেছি।

কই, দেখি।

বিনয়বাবু ওর হাতে দুটি ছবি দিতেই উনি এক ঝলক দেখেই বলেন, এ ছবি তো অনেক দিন আগের।

হ্যাঁ, ও তখন স্কুলের সেভেনএইটে পড়ে।

এ ছবি দেখে তো ওকে এখন আইডেনটিফাই করা যাবে না।

কিন্তু আমাদের বাড়িতে তো ওর আর কোনো ছবি নেই।

বন্ধুবান্ধব বা আপনাদের সঙ্গে তোলা কোনো গ্রুপ ফটোও নেই?

বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ছবিটবি তুলেছে কিনা তা তো বলতে পারবো না; তবে আমাদের কাছে ওর কোনো ছবি নেই।

সাবইন্সপেক্টর ব্যানার্জী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রায় আপনমনেই বলেন, তাহলে তো মুশকিল হলো।

একটু চুপ করে থাকার পর বিনয়বাবু জিজ্ঞেস করলেন, আমার ভাগ্নীকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে কী একটু এগিয়েছেন?

তেমন কিছু না।

বেশ কদিন হয়ে গেল, তাই.. বিনয়বাবু কথাটা শেষ করেন না।

আজ আমি ওসির সঙ্গে কথা বলব। দেখি, উনি কি বলেন।

আমি কী কাল একবার আসব?

একবার টেলিফোন করবেন। যদি কিছু খবর থাকে, তাহলে আপনাকে জানিয়ে দেব

.

একটা লম্বা টানা দীর্ঘশ্বাস ফেলার পর অলকানন্দা আপনমনে একটু হাসে। মনে মনে কী যেন ভাবে। তারপর স্বগতোক্তি করে, জল তাহলে অনেক দূর গড়িয়েছে।

সুদীপ্ত কোনো কথা বলে না। চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

দুএক মিনিট পর অলকানন্দা সুদীপ্তর দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে থেকে একটু চাপা হাসি হেসে বলে, যদি আমি আপনার সঙ্গে না ফিরে যাই?

সুদীপ্ত কোনো ভাবাবেগ প্রকাশ না করে বলে, আমার বিশ্বাস, আপনি আমার সঙ্গে কলকাতা ফিরবেন।

যদি না যাই?

আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার উপায় আছে কিন্তু আমি তা চাই না।

গায়ের জোরে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান?

সুদীপ্ত মাথা নেড়ে বলে, না, কখনই না।

তাহলে?

আমার স্থির বিশ্বাস, আপনি আমার অনুরোধ রাখবেন।

কিন্তু কেন আমি আপনার অনুরোধ রাখব?

বোধহয় আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী।

শুভাকাঙ্ক্ষী? ঠোঁটের কোণায় চাপা কৌতুকের হাসি হেসে অলকানন্দা বলে, পুলিশের চাকরি করতে গিয়ে যেসব চোরডাকাতখুনীদের সঙ্গে আলাপপরিচয় হয়, তাদের সবারই কী আপনি শুভাকাঙ্ক্ষী?

সুদীপ্ত বিন্দুমাত্র উত্তেজনা প্রকাশ না করে বলে, অভাবঅনটনের জন্য পুলিশের চাকরি নিয়েছি বলে কি আমার সব মনুষ্যত্ব চলে গেছে?

ও মুহূর্তের জন্য থেমে আবার বলে, আপনি যত বিদ্রূপই করুন, তবু বলছি, আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী।

অলকানন্দা সঙ্গে সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারে না। বরং ওকে বিদ্রূপ করার জন্য, অপমান করার জন্য মনে মনে দুঃখ পায়। ও একটু সলজ্জ দৃষ্টিতে সুদীপ্তর দিকে তাকিয়ে বলে, আপনি কী করে পুলিশে চাকরি করছেন?

কেন বলুন তো? একটু অবাক হয়ে সুদীপ্ত পাল্টা প্রশ্ন করে।

আপনার মতো ভদ্র ছেলের পক্ষে পুলিশের চাকরি করা সম্ভব?

সুদীপ্ত একটু হেসে বলে, তিন বছর তো চাকরি করছি। তারপর একটু থেমে বলে, আপনি একটা ভালো চাকরি দিলেই পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিতে পারি।

ভালো চাকরি মানে?

এখনও তিরিশবত্রিশ হাজার টাকা দেনা আছে। ঐ দেনাটা শোধ করার পর হয়তো নিজেই আমি চাকরিটা ছেড়ে দেব।

কেন?

পুলিশের চাকরিতে যেমন পরিশ্রম, তেমনি ঝামেলা। তাছাড়া এ কাজ করে একটুও মনের আনন্দ পাই না।

কী ধরনের চাকরি আপনার পছন্দ?

আমার বাবা সারাজীবন স্কুল মাস্টারি করেছেন বলে ওঁর স্বপ্ন ছিল, আমি কলেজে পড়াব, কিন্তু তা তো আর সম্ভব না। যে কাজে একটু বিদ্যাবুদ্ধির দরকার হয়, আমি সে ধরনের যে কোনো চাকরি পেলেই খুশি।

সে ধরনের চাকরির চেষ্টা করেছেন?

সুদীপ্ত মাথা নেড়ে বলল, না।

কেন?

মার অসুখের দেনাগুলো শোধ না করা পর্যন্ত নতুন কিছু করার উৎসাহবোধ করি না। এবার ও একটু থেমে বলল, আমার কথা বাদ দিন। আপনি মামামামীকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ উধাও হলেন কেন?

মামামামীর ওখানে আর ভালো লাগছে না।

কিন্তু আপনার মামাকে তো বেশ ভালো মানুষ মনে হয়।

মামা সত্যি ভালো মানুষ কিন্তু ব্যক্তিত্বহীন। তাছাড়া যে কোনো কারণেই হোক, মামী আমাকে সহ্য করতে পারে না।

সে তো খুব স্বাভাবিক। সুদীপ্ত হাসতে হাসতেই বলে।

অলকানন্দা অবাক হয়ে বলে, স্বাভাবিক কেন?

আপনি মামীর চাইতে অনেক বেশি শিক্ষিতা, অনেক বেশি সুন্দরী। সুতরাং…

সুতরাং উনি মামী হয়েও আমাকে হিংসা করবেন?

সুদীপ্ত আবার একটু হাসতে হাসতেই বলে, শুনেছি, অনেক মা নিজের মেয়েকেও একটা বিশেষ বয়সে ঠিক সহ্য করতে পারেন না।

অলকানন্দা একটু হেসে বলে, আমার এক বন্ধুও বলতো, ওর মা ওকে সহ্য করতে পারেন না।

বাই দ্য ওয়ে, দীপুবাবুকে দেখলাম, আপনার ব্যাপারে খুব উৎসাহী।

হি ইজ এ স্কাউলে!

এবার সুদীপ্ত বলে, আচ্ছা, দীপুবাবু কী আপনাকে বিয়ে করতে চায়?

শুধু দীপুবাবুর না, আমার মামীরও তাই ইচ্ছা।

ওর উপর এত রাগের কারণ?

ঐ অশিক্ষিত রুচিহীন, লোভী মানুষটাকে আমি সহ্য করতে পারি না। বিয়ে করা তো দূরের কথা, ওকে দেখলেই আমার সারা শরীর জ্বলে যায়।

একবার বুক বরে নিশ্বাস নিয়ে অলকানন্দা আবার বলে, ঘটনাচক্রে আপনি আমাদে অনেক কথাই জেনেছেন। তাইতো আপনাকে বলতে আমার দ্বিধা নেই যে ঐ দীপু আর মামীর জন্যই আমি চলে এসেছি। গত চারপাঁচ বছর ধরে ওরা দুজনে আমাকে যে কি বিরক্ত করছে, তা আপনি কল্পনা করতে পারবেন না।

এ ব্যাপারে আমাকে কেউ কিছু না বললেও আমি বুঝতে পেরেছি।

দেখুন সুদীপ্তবাবু, আমার বারো বছর বয়সের সময় বাবা মারা যান কিন্তু তিনি আমাকে বা মাকে পথের ভিখারী করে যাননি। মামী আর দীপু খুব ভালো করেই জানেন, বাবা গ্র্যাচুইটি প্রভিডেন্ট ফ্যাক্ত ইন্সিওরেন্সের একটি পয়সাও মা নষ্ট করেননি। সব ব্যাঙ্কে জমা আছে।

স্কুলকলেজে পড়াশুনার খরচ…

সুদীপ্ত প্রশ্নটা শেষ করার আগেই অলকানন্দা বলে, আমার এক পিসী আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। তিনিই আমার স্কুলকলেজের সব খরচ দিতেন।

ও!

আমার ঐ পিসীর কোনো ছেলেমেয়ে হয়নি। পিসীপিসেমশাই দুজনেই আমাকে অসম্ভব ভালবাসতেন। পিসী মারা যাবার পর পিসেমশাই ওর সব গহনাপত্তর আমাকে দিয়ে দেন।

পিসেমশাই কোথায় থাকেন?

উনিও বছরখানেক হল মারা গিয়েছেন।

উনি কী করতেন?

মার্টিন বার্নে সাধারণ কেরানি ছিলেন। অলকানন্দা একটু থেমে বলে, পিসীর গহনাপত্তর যেমন আমাকে দিয়েছেন, তেমনি নিজের সব টাকাকড়ি রামকৃষ্ণ মিশন সেবা প্রতিষ্ঠান হাসপাতালে দিয়ে গেছেন।

একটু পর সুদীপ্ত একটু চাপা হাসি হেসে বলে, মোটকথা আপনি বেশ বড়লোক। সুতরাং আপনাকে বিয়ে করার ব্যাপারে দীপুবাবুর উৎসাহের যথেষ্ট কারণ আছে

আপনিও কী দাপুর সাপোর্টার হয়ে গেলেন? হাসতে হাসতে অলকানন্দা প্রশ্ন করে।

হাসতে হাসতেই সুদীপ্ত জবাব দেয়, অমন গুণী মানুষের সাপোর্টার হবার অধিকার আমার আছে?

হাসি থামলে সুদীপ্ত বলে, এবার বলুন, আপনি কী আমার অনুরোধ রাখবেন?

আপনিই বলুন না আমার কী করা উচিত।

আপনাকে পরামর্শ দেবার অধিকার কি আমার আছে?

ওসব অধিকার-টধিকারের কথা বাদ দিন। আমি যখন আপনার পরামর্শ চাইছি, আপনার তো দ্বিধা করার কারণ নেই।

সুদীপ্ত ওর দিকে তাকিয়ে বলে, দেখুন, আপনার আসল সমস্যা সমাধানের দুটি উপায় আছে। আপনি একটা চাকরি জোগাড় করে মাকে নিয়ে কোথাও চলে যেতে পারেন অথবা এমন কাউকে আপনাকে বিয়ে করতে হবে, যেখানে আপনার মা সসম্মানে থাকতে পারেন।

অলকানন্দা চুপ করে ওর কথা শোনে।

সুদীপ্ত আবার বলে, হঠাৎ মামামামীর সংসার থেকে উধাও হয়ে তো আপনার আসল সমস্যার সমাধান হয়নি, হবেও না।

ঠিক বলেছেন। অলকানন্দা গম্ভীর হয়ে বলে

কথায় কথায় অনেক বেলা হয়ে গিয়েছিল। সুদীপ্ত হাতের ঘড়ি দিকে তাকিয়েই বলে, চলুন, খেয়ে আসি। এর পর আর খাবার পাবো না।

হ্যা চলুন।

খাওয়াদাওয়ার পর কটেজের দিকে যেতে যেতে অলকানন্দা সুদীপ্তর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, দিবানিদ্রার অভ্যাস আছে নাকি?

সুদীপ্ত একটু হেসে বলে, পুলিশের চাকরি করার দৌলতে দিবানিদ্রা তো দূরের কথা, রাত্তিরে ঘুমোবার অভ্যাসও প্রায় চলে গেছে।

অলকানন্দা ওর কটেজের দরজা খুলতে খুলতে বলে, তাহলে ভিতরে আসুন; গল্প করা যাবে।

আপনি বিশ্রাম করবেন না?

সারা দিনরাত্তিরই তো বিশ্রাম করছি। অলকানন্দা ঘরের মধ্যে পা বাড়িয়েই বলে, আসুন, আসুন।

সুদীপ্ত ওর পিছন পিছন ঘরে ঢুকেই একবার ঘরের চারদিকে দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে নিতেই বেড সাইড টেবিলের ছবিটা দেখেই জিজ্ঞেস করল, আপনার বাবার ছবি?

হ্যাঁ।

বাঃ! ভারী সুন্দর দেখতে ছিলেন তো?

অলকানন্দা ওকে চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে বলে, বাবা সত্যি খুব সুপুরষ ছিলেন।

সুদীপ্ত চেয়ারে বসেই বলে, আপনার মা কিন্তু খুব স্নিগ্ধ শান্ত মানুষ।

উল্টো দিকের চেয়ারে বসেই অলকানন্দা বলে, মা সত্যি খুব স্নিগ্ধ শান্ত প্রকৃতির মানুষ।

সুদীপ্ত পকেট থেকে সিগারেটদেশলাই বের করে বলে, ঘরের মধ্যে সিগারেট খেলে কি আপনার অসুবিধে হবে?

অলকানন্দা একটু হেসে বলে, সিগারেট কেন, আপনি ড্রিঙ্ক করলেও আমার আপত্তি নেই।

সুদীপ্ত সিগারেট ধরিয়ে একটা টান দিয়েই বলে, আপনার মামা কি রেগুলার ড্রিঙ্ক করেন?

না, না, আমার মামার ওসব নেশাটেশা নেই। তবে আমার প্রিয়তম অধ্যাপক নিয়মিত ড্রিঙ্ক করেন।

আপনি কী প্রফেসর চ্যাটার্জীর কথা বলছেন?

হ্যাঁ।

আপনার সামনেই উনি ড্রিঙ্ক করতেন?

উনি লুকিয়েচুরিয়ে ড্রিঙ্ক করেন না। ওর স্ত্রী বা মেয়ে ছাড়াও আমিও কতদিন ওঁর গেলাসে হুইস্কী ঢেলে দিয়েছি।

আচ্ছা!

অলকানন্দা বলে, ড্রিঙ্ক করলেই যে মানুষ মাতাল বা খারাপ হয় না, তা ওঁকে দেখেই বুঝেছি।

তা ঠিক।

আপনি ড্রিঙ্ক করেন?

না।

কেন? ভয় করে, নাকি অপছন্দ করেন?

সুদীপ্ত বলে হাজার হোক স্কুল মাস্টারের ছেলে। একটু দ্বিধাসঙ্কোচ থাকা তো খুবই স্বাভাবিক। ঐসব সখআনন্দের জন্য খরচ করার ক্ষমতাও আমার নেই।

অলকানন্দা হাসতে হাসতে বলে, আপনি নিছকই একটা ভালো মানুষ।

সুদীপ্ত হাসতে হাসতে জবাব দেয়, যাক, বড় মাসী ছাড়া আরো একজনকে পেলাম যে মামাকে ভালো মনে করে।

বড় মাসী ছাড়া আর কেউ আপনাকে ভালো বলে না?

না। প্রায় সবার ধারণা আমি বোকা মানুষ।

এ ধারণার কারণ?

যে পুলিশ অফিসার ঘুষ নেয় না, পরের পয়সায় মদ খায় না, বা কলগার্লদের ভয় খিয়ে তাদের সঙ্গে স্ফুর্তি করে না, সে বোকা না?

কথাটা শুনে অলকানন্দার মুখখানা গম্ভীর হয়ে যায়। একবার চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, হতভাগারা তো জানে না, অসৎ বা চরিত্রহীন হবার চাইতে বোকা হওয়া অনেক সম্মানের।

সুদীপ্ত একটু হেসে বলে, আমার কথা বাদ দিন। বলুন, কবে কলকাতা যাবেন?

এখন কলকাতা ফিরে যাবো?

হ্যাঁ, তাই বোধহয় ভালো।

তারপর?

চাকরি নিয়ে অন্য কোথাও চলে যান বা বিয়ে করে স্বামীর ঘর করুন। তাছাড়া ইউ সির ফেলোশিপ পাওয়াও তো একটা চাকরির সমান।

তা বলতে পারেন। সত্যি, আজকাল ওরা বেশ ভালো টাকা দেয়।

কালকের টিকিট কাটতে বলে দেব?

অলকানন্দা অবাক হয়ে বলে, কাকে টিকিট কাটতে বলবেন?

একজন বুড়ো কনস্টেবলও আমার সঙ্গে এখানে এসেছে।

হা ভগবান! আপনি আমাকে ধরে নিয়ে যাবার জন্য একজন কনস্টেবলকেও সঙ্গে এনেছেন? অত্যন্ত উত্তেজিত হয়েই অলকানন্দা কথাগুলো বলে।

সুদীপ্ত অত্যন্ত ধীর স্থির ভাবে জবাব দেয়, আপনি ছেলে হলে আমি একলাই আসতে পারতাম।

আমি মেয়ে বলে একজন কনস্টেবলকে সঙ্গে আনতে হবে?

হ্যাঁ। সুদীপ্ত একটু হেসে বলে, একলা এসে আমি যদি মাঝপথে আপনার সঙ্গে কোনোরকম খারাপ কিছু…

বুঝেছি।

মিনিট খানেক চুপ করে থাকার পর সুদীপ্ত বলে, একটা কথা বলব?

বলুন।

এখান থেকে একটা ট্রেনে যোধপুর যেতে হবে; সেখান থেকে আরেকটা ট্রেনে দিল্লি। তারপর দিল্লি থেকে কলকাতা যেতে হবে।

জানি।

আমি কনস্টেবলকে কাল সকালেই দিল্লি পাঠিয়ে দিচ্ছি। ও আমাদের জন্য শনিবারের রাজধানী এক্সপ্রেসের দুটো টিকিট কেটে রাখুক।

আর ঐ সিপাহী মহারাজ কী করবে?

ও রবিবার সকালে কালকা মেলএ রওনা হবে।

তা হতে পারে, কিন্তু…

কিন্তু কী?

যোধপুর উদরপুর বা জয়পুরে কয়েকদিন না কাটিয়েই চলে যাব?

ওসব জায়গা তো পালিয়ে যাচ্ছে না, পরে আসবেন।

অলকানন্দা দুএক মিনিট ভাবনাচিন্তা করে বলে, ঠিক আছে, কিন্তু একটি শর্ত

বলুন কি শর্ত।

আপনার সঙ্গে আমি বাড়িতে ফিরব না। হাওড়া স্টেশন থেকে আমি একলাই যাবো। আপনি পরের দিন আমার খবর নিতে আমাদের বাড়ি আসবেন।

তাই হবে।

.

বেশ কয়েকদিন পর মাকে কাছে পেয়ে অলকানন্দা ছোট্ট বাচ্চার মতো ওকে জড়িয়ে শুয়ে কত কথা, কত আলোচনা করে।

আচ্ছা মা, মামা পুলিশে খবর দিল কেন?

দীপুই তো জোর জুলুম করে ওকে পুলিশের ওখানে নিয়ে গেল। শীলাদেবী একটু থেমে বলেন, তবে যে পুলিশ অফিসারটি বাড়িতে এসেছিল তাকে দেখে আমার মন। ভরে গেছে।

কেন?

ছেলেটাকে যেমন সুন্দর দেখতে, সেইরকম ভদ্রসভ্য ব্যবহার। ওকে দেখলে ভালোবাসতে ইচ্ছে করবে।

অন্ধকারে মুখ টিপে হাসতে হাসতে অলকানন্দা বলে, তাই নাকি?

শীলাদেবী মেয়ের মাথায় হাত দিতে দিতে বলেন, সত্যি বলছি, ঐ রকম একটা জামাই হলে বড় ভালো হত।

দাবোগাবাবুকে তোমার এতই ভালো লাগল যে জামাই করতে ইচ্ছে করছে?

শীলাদেবী একটু গম্ভীর হয়ে বলেন, দারোগা বলে ঠাট্টা করছিস কেন? দারোগারা মানুষ না?

উনি মুহূর্তের জন্য একটু থেমে বলেন, ছেলেটিকে দেখলেই বোঝা যায়, অত্যন্ত ভদ্র পরিবারের ছেলে। তাছাড়া কথাবার্তা শুনে বুঝেছি, লেখাপড়াও যথেষ্ট করেছে। তা না হলে কি আমার এমনি এমনি জামাই করতে ইচ্ছে করল?

অলকানন্দা দুহাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলে, সত্যি তুমিওকে জামাই করতে চাও?

আমার মন তো তাই চাইছে।

মার মুখের উপর মুখ নিয়ে অলকানন্দা খুব চাপা গলায় বলে, মা, আমারও তাই ইচ্ছে।

শীলাদেবী মেয়ের কপালে একবার চুমু খেয়েই দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বললেন, ঠাকুর! সবই তোমার ইচ্ছা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *