পাতারহাট

পাতারহাট

এমন অপ্রত্যাশিতভাবে ওর সঙ্গে আলাপ হবে, তা ভাবতে পারিনি। নাম শুনতেই চমকে উঠলাম। আমি কোনোকালেই রাজনীতি করিনি, বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। তবে বিয়াল্লিশের আন্দোলনের সময় দাদাও দাদার বন্ধুদের প্রয়োজনে ও নির্দেশে রেশন ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে রিভলবার পৌঁছে দিয়েছি এখানে ওখানে। আর কংগ্রেস অফিসের কোণায় মণিমেলা কেন্দ্র চালাবার সময় কিছু সর্বত্যাগী কর্মীর সান্নিধ্যে এসে শুনেছি নানা কাহিনি, পড়েছি কিছু বই, জেনেছি বিপ্লবীদের ইতিহাস। তাই তো চমকে উঠেই প্রশ্ন করলাম, আপনিই কী সেই অনাদি ঘোষ যিনি ডুরান্ড সাহেবকে…

কথাটা শেষ করার আগেই উনি হেসে ফেললেন। বললেন, তুমিও সে কাহিনি জানো।

জানব না?

উনি মাথা নেড়ে বললেন, সেসব কাহিনি আজকাল কেউ মনে রাখে না। মনে রাখার। দরকারও নেই।

ডেরাডুন বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল কিন্তু বেশীক্ষণ কথা বলার সুযোগ হল না। কন্ডাক্টর এসে হুইসেল বাজাতেই উনি হরিদ্বারের বাসে উঠলেন। তবে ঠিকানা বিনিময় হল বাস ছাড়ার আগেই। দুএকটা চিঠির আদানপ্রদানও হল কিন্তু তারপর দুপক্ষই নীরব।

.

বছর দশেক পার হয়ে গেল।

পাটনা।

জয়প্রকাশ সর্বোদয় বর্জন করে কদমফুঁয়ার বাড়িতে ফিরে এলেও আবার সংবাদপত্রের শিরোনামা। চম্পারণ সত্যাগ্রহ আর বহুকাল আগের বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পর বিহার আবার সর্বভারতীয় সংবাদ। সম্পাদকের নির্দেশে বিহার সফরের আগে গেছি কদমকুঁয়া। জয়প্রকাশের সঙ্গে দেখা করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার সময় ওঁর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা।

আপনি! আমি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করি।

উনি হেসে বললেন, আমি তো মাঝে মাঝেই আসি। তুমি কবে এলে?

কাল এসেছি।

কদিন থাকবে?

এখানে দুতিন দিন আছি। তারপর কয়েকটা জেলা ঘুরব।

এখানে কোথায় উঠেছ?

হোটেল পাটলিপুত্রে।

ঠিক আছে যোগাযোগ করব।

আর কথা হল না। অনাদিবাবু উপরে উঠে গেলেন। আমি বেরিয়ে এলাম।

বিহার সরকারের দুচারজন মন্ত্রী ও পদস্থ অফিসারের সঙ্গে কথাবার্তা বলে মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য যখন হোটেলে ফিরলাম, তখন দুটো বেজে গেছে। রিসেপসন কাউন্টারে। ঘরের চাবি নিতে গিয়েই একটা চিরকুট পেলামতোমার সঙ্গে গল্প করার জন্য সন্ধ্যার পর আসব। তুমি সাতটা সাড়েসাতটার মধ্যে ফিরে এলে ভালো হয়।–অনাদিদা।

রিসেপসনের সামনে দাঁড়িয়েই দুতিনবার পড়লাম। লিফটএর মধ্যে, ঘরে বসে লাঞ্চ খেতে খেতে মনে পড়ল, এই পাটনা শহরেই এই রকম একটা ছোট্ট চিরকুটের জন্যই অনাদিদা ধরা পড়েছিলেন।

.

গ্রামের অন্যান্য সবার মত অনাদিও লেখাপড়া শুরু করল ন্যায়রত্নের পাঠশালায়। পাঠশালার গুরুমশাই ন্যায়রত্ন না; ওর বাবা ছিলেন ন্যায়রত্ন। গুরুমশায়ের বিদ্যার দৌড় ব্যাকরণের মধ্যে। তা হোক। গ্রামের সবাই বলত,ন্যায়রত্নের পাঠশালা।ন্যায়রত্নের পাঠশালা শেষ করে কেউ চলে যেত সদর শহরে; কেউ বা আত্মীয়স্বজনের আশ্রয়ে অন্যত্র কোথাও। বরিশালের গ্রামের ছেলে অনাদি পিসীমার সঙ্গে চলে এল যশোর। ভর্তি হল সম্মিলনী স্কুলে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অনাদির নাম ছড়িয়ে পড়ল স্কুলের সব শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে। কারণ ছিল। অনাদি শুধু ভালো ছাত্র না, ভালো আবৃত্তি করে। সর্বোপরি কারণ ছিল, ওর মুখের হাসি আর মধুর স্বভাব।

ক্লাশ এইটনাইনে যখন পড়ে তখন অনাদির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। অংকে তত ভালো না হলেও আর সব বিষয়ে অনাদির সঙ্গে কেউ পেরে ওঠে না। বাংলা লিখত চমৎকার। স্কুলের ম্যাগাজিনে যে ছাত্রের লেখা প্রতিবার ছাপা হত, তার নাম অনাদি ঘোষ। ঐ অল্প বয়সেই ওর বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হতেন সবাই। চারিত্রিক মাধুর্যের জন্য সব ছাত্র ভিড় করতে আশেপাশে।

স্কুলের জনপ্রিয়তার ঢেউ পৌঁছেছে শহরের পাড়ায়পাড়ায়, ঘরেঘরে। শহরের বহুজনের সঙ্গেই অনাদির পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা।

গরমের ছুটির দিন দশেক আগে হঠাৎ একদিন স্কুলে আসার পথে লোন অফিসের সামনে অজয়দার সঙ্গে দেখা

কিরে অনাদি, কেমন আছিস?

ভালো। অনাদি হেসে জবাব দেয়। জিজ্ঞেস করে, আপনি কেমন আছেন অজয়দা?

অজয়দা হেসে বলেন, শারীরিক ভালোই আছি কিন্তু মানসিক অবস্থা ভালো না

উৎকণ্ঠিত অনাদি জানতে চায়, কেন? বাড়িতে কেউ অসুস্থ নাকি?

অজয়দা আবার হাসেন। বলেন, এ দেশে যার বুদ্ধিবিবেচনা আছে, সে কী সুখে থাকতে পারে?

কথাটা কেমন বেসুরো লাগল অনাদির। একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়।

অজয়দা আর হাসেন না। হঠাৎ ওঁর উজ্জ্বল সুন্দর মুখখানা কেমন ম্লান হয়ে যায়। দুঃশ্চিন্তার রেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে কপালে। বলেন, কাল রাত্তিরে পুলিশ নিত্যদাকে কোতোয়ালীতে নিয়ে গেলে ডুরান্ড সাহেব গুণে গুণে ওকে একশোবার লাথি মেরেছে

শুনে অনাদির খারাপ লাগে। বলে, তাই নাকি?

হ্যাঁ।

কিন্তু কারুর কাছে তো শুনলাম না।

শুনতে চাইলেই শুনতে পাবি।

ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই স্কুলের ফাস্ট বেল শোন যায়। অজয়দা বললেন, স্কুলে যা। একদিন আসিস।

নিশ্চয়ই আসব।

স্কুলে বসেও অনাদি সারাদিন ঐকথাই ভাবে। ইস! নিত্যদার মত সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষকে ডুরান্ড সাহেব একশোবার লাথি মেরেছে?

গত বছরই ডুরান্ড সাহেব স্কুলের পুরস্কার বিতরণী সভায় এসেছিল। অনাদি ওকে ঐ একবারই দেখেছে। দেখলেই বোঝা যায়, লোকটা কত দাম্ভিক আর বদমেজাজী। অনাদি ওর ইংরেজি বক্তৃতা ঠিক বুঝতে পারেনি কিন্তু হেড মাস্টারমশাইয়ের তর্জমা শুনেই বুঝেছে, লোকটা ভারতবর্ষের মানুষকে কত ঘেন্না, কত তুচ্ছজ্ঞান করে।

সেদিন বিকেলেই অনাদি অজয়দার ক্লাবে হাজির। পরদিনই দুআনা দিয়ে জগজ্জননী ক্লাবের সদস্য। গরমের ছুটিতে পড়াশুনার অছিলায় বরিশাল যাওয়া বাতিল করে ব্যায়াম চর্চার আড়ালে অনাদি আরো কত কি চর্চা করে। কত কি পড়ে, শোনে। জানতে পারে কত অজানা কাহিনি। বছর খানেক পরে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা। নবজন্ম হল অনাদির।

.

তারপরের বছর খানেক অন্ধকার। অনাদি স্কুলে যায়। পড়াশুনাও করে, কিন্তু আর কি করে সে খবর বাইরের দুনিয়ার কেউ জানতে পারে না।

সেকেন্ড ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করল অনাদি। নিত্যদার নির্দেশে অনাদি যশোর ছেড়ে চলে গেলে বরিশাল। ভর্তি হল ব্রজমোহন কলেজে।

পুজোর ছুটির ঠিক দুদিন আগে হঠাৎ এক দূত মারফত স্বয়ং ত্রৈলোক্য মহারাজ খবর পাঠালেন, ছুটি হবার সঙ্গে সঙ্গে যশোর পিসীমার বাড়ি বেড়াতে যাও।ইঙ্গিত বোঝে অনাদি।

ছুটি হবার পরদিনই স্টীমারে ওঠে অনাদি। প্রথমে খুলনা। তারপর যশোর।পিসীমা খুশি, পিসেমশাই খুশি। খুশি ভাইবোনেরাও।

গল্পগুজব করে শুতে শুতে অনেক রাত হল। মশারি ঠিক করতে এসে জয়া বলল, রাঙাদা, ঘুমিও না। একটা থেকে সওয়া একটার মধ্যে সুনীলদা আসবে। আমি চলে গেলে দরজায় খিল দিও না। আমিও ঘুমোব না। দরকার হলে জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার মাথায় হাত দিলেই উঠে পড়ব।

হ্যাঁ, ঠিক সওয়া একটায় সুনীল এল। মশারির মধ্যে বসে অনেকক্ষণ অনেক কথা বলল ফিসফিস করে।

তারপর?

তারপর যেমন চুপি চুপি এসেছিল, ঠিক তেমনি চুপি চুপি চলে গেল সুনীল। রেখে গেল ছোট একটা বালিশ।

বিছানা ছেড়ে উঠল অনাদিও। ঘর থেকে বেরুল পা টিপে টিপে। বারান্দা পার হয়ে পিছন দিক দিয়ে ঘুরে বোনেদের ঘরের জানলার সামনে এসে একটু দাঁড়াল। একবার ভালো করে এদিকওদিক দেখে জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে জয়ার মাথায় একটা টোকা দিতেই ও উঠে বসল। অনাদির মতই পা টিপে টিপে বেরিয়ে এল বাইরে। তারপর কোনো কথা না বলে ঐ অন্ধকার রাত্রে অনাদির হাত ধরে নিয়ে এল উত্তর দিকের বাগানে। চাঁপা গাছের নীচে গর্ত করাই ছিল। অনাদির হাত থেকে ছোট্ট বালিশটা নিয়ে ফেলে দিল ঐ গর্তের মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে দুজনে মিলে মাটি চাপা দিয়ে কিছু ঘাসপাতা ছড়িয়ে দিল। ওরা দুজনে ফিরে গেল নিজের নিজের ঘরে।

ভোরবেলায় দুজনেরই ঘুম ভাঙল হৈচৈ শুনে। পুলিশ। অনাদির পিশেমশাই, এ বাড়ির গৃহকর্তা চন্দ্রবাবু শহরের নামকরা উকিল। দারোগাবাবু তার সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করলেন না। বললেন, আই বির রিপোর্ট এই বাড়িতে সুনীল সরকার লুকিয়ে আছে। তাই আপনাদের একটু কষ্ট দেব।

চন্দ্রবাবু বললেন, কাল আমার শালার ছেলে অনাদি এসেছে। তাছাড়া আর কেউ তো…

পুণ্য কাজে দারোগাবাবুর সহযাত্রী আই বির কালাচরণবাবু বললেন, সে তো পাড়ার সবাই জানে।

যাই হোক সারা বাড়ি খানাতল্লাসী করে ওঁরা শুধু সুনীলকেই খুঁজলেন না, আরো কিছু খুঁজলেন তন্ন তন্ন করে। বাড়ির মেয়েপুরুষ ঝি-চাকর সবাইকে জেরা করলেন, কেউ কিছু রাখতে দিয়েছে কিনা।

সবাই বলল, না, কেউ কিছু রেখে যায় নি। জয়া বলল, শুধু মিত্তির কাকার মেয়ে ছায়া এসে এক কৌটো নাড়ু দিয়ে গেছে রাঙ্গাদার জন্য।

দারোগাবাবু আর কালাচরণবাবু প্রায় একসঙ্গেই চিৎকার করে উঠলেন, কোথায় সে কৌটা?

জয়া না, জয়ার মা না, ঝি এনে দিল সে কৌটো। হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ওঁরা দুজনেই। দুজনেই হতাশ।

জয়া হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কী খুঁজছেন?

কালাচরণবাবু রেগে বললেন, তাতে তোমার কী দরকার?

ঘণ্টা তিনেক ধরে খানাতল্লাসী করেও ওরা কিছুই পেলেন না। যাবার সময় দারোগাবাবু বলে গেলেন, ডুরান্ড সাহেবের হুকুম মতো এসেছিলাম। কিছু মনে করবেন না।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অনাদি আর জয়া।

কিছুক্ষণ পরেই অনাদি সাইকেলে চক্কর দিয়ে আসে সারা লোন অফিস পাড়া। ক্রীং ক্রীং ঘণ্টা বাজিয়ে অজয়দাকে জানিয়ে দেয়, সব ঠিক আছে। জলখাবার দিতে এসে জয়া অনাদিকে বলল, রাঙ্গাদা, খুব সাবধান। সুনীলদা যে আসবে, তা পর্যন্ত ওরা জেনে গেছে।

হ্যাঁ, তাইতো দেখছি।

তোমাদের মধ্যে কেউ কিছু…।

উচিত নয় তবে…। কথাটা শেষ না করেই অনাদি বলে, একটা কাজ করবি?

বল, কী করতে হবে?

একটা চিঠি দিচ্ছি। ওটা সুভাষের ঠাকুমাকে দিয়ে বলবি, কালীবাড়ির আরতির সময় জবাব নিবি।

সন্ধ্যার পর কালীবাড়ির আরতির সময় সুভাষের ঠাকুমার পাশে হাত জোড় করে বসল জয়া। প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে আরতি চলল। আরতি শেষ। এবার চোখ বুজে প্রণামের সময়। ব্যাস। ঐ সময় ছোট্ট একটা কাগজ এসে গেল জয়ার হাতে।

সকালবেলায় জয়াদের বাড়ি খানাতল্লাসী হবার খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গেই নিত্যদা সমস্ত পরিকল্পনাটা অদলবদল করে জানিয়ে দেন অজয়দাকে। নতুন পরিকল্পনার সব কিছু খবর জয়া এনে দিল অনাদিকে।

দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে। সারা শহরে আনন্দের বন্যা। ঢাকঢোল বাজছে চারদিকে। নতুন জামাকাপড় পরে ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে পূজা দেখতে। ছুটির আনন্দ উপভোগ করতে অফিস আদালতের অনেকেই গ্রামের বাড়ি গেছেন। ছুটি ডুরান্ড সাহেবেরও। অফিস না গেলেও বাংলোয় বসে কাজ করেন। পুলিশ অফিসাররা আসেন নানা খবর নিয়ে। ফিরে যান সাহেবের নির্দেশ নিয়ে। তবে সবাই জানে ছুটির দিনে সহেবমেমসাহেব ঘুমিয়ে থাকেন অনেক বেলা পর্যন্ত। খুব জরুরি কারণ না হলে সাহেব কখনই ভোরে ওঠেন না।

.

সেদিন মহাষ্টমী।

তখনও অন্ধকার কাটেনি। উষার আলো দেখা দেবে কিছুক্ষণ পর। সূর্য উঠবে আরো পরে। ডুরান্ত সাহেবের বাংলোর গেটের সামনে কিছু কাগজপত্র নিয়ে দুই দাবোগাবাবু হাজির। পাহারাদার কনস্টেবল হেসে বলল, এত ভোরে?

একজন দারোগাবাবু হেসে বললেন, কী করব? বড়কর্তারা যেমন হুকুম দেবেন, আমাদের তো তাই করতে হবে।

কনস্টেবল বলল, আজ তো ছুটি। সাহেব তো উঠবেন অনেক বেলায়।

আমরা বসে থাকব। সাহেব উঠলেই কাগজ সই করিয়ে ছুটব এস পি সাহেবের কাছে।

দারোগাবাবুরা ভিতরে ঢোকেন। কনস্টেবল গেট বন্ধ করে দেয়।

বিরাট এলাকার মাঝখানে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের দোতলা বাংলো। চারদিকের নেই ফুটবল খেলা যায়। গাছপালা দিয়ে ঘেরা সমস্ত এলাকা। সমনের লন পেরিয়ে বাংলোর বারান্দায় পৌঁছতেই দাবোগাবাবুদের মিনিট পাঁচেক লাগল। সেখানে খান কয়েক চেয়ার। দারোগাবাবুরা সেখানেই বসলেন। ভালো করে দেখেন চারদিক। না কেউ নেই। ছুটির দিনে এত ভোরে কোনো অর্ডালিবেয়ারা আসবে না। চাকরবাকর, খানসামারাও তাদের কোয়ার্টারে।

দারোগাবাবুদের হাতে বেশি সময় নেই। ওঁর দুজনেই উঠে দাঁড়ালেন। পায়চারি করার অছিলায় একবার ঘুরে দেখে নিলেন চারদিকের বারান্দা, সিঁড়ি। একজন সতর্ক পদক্ষেপ ফেলে উপরে উঠলেন। দেখলেন উপরের বারান্দা। না, কেউ নেই। ইশারা করলেন সহকর্মিকে। তিনিও তর তর করে উপরে উঠলেন। ডানদিকে এগিয়ে দেখলেন, ড্রইংরুমের মেঝেয় একজন ঘুমুচ্ছে। দরজা বন্ধই ছিল। একজন আলতো করে সামনের দিকে শিকল তুলে দিলেন। আর একটু এগিয়েই সাহেবের শোবার ঘর। হ্যাঁ, পশ্চিমের জানালা খোলা আছে। মেমসাহেবও নেই। কলকাতায় গেছেন গতকালই। সাহেব বিভোর হয়ে ঘুমুচ্ছেন প্রায় অর্ধউলঙ্গ হয়ে।

ইশারা বিনিময় হয় দুই দারোগার মধ্যে। একজন রইলেন সিঁড়িতে, অন্যজন সাহেবের শোবার ঘরের খোলা পশ্চিমের জানালার পাশে। দুজনের হাতেই রিভলবার। রেডি সিঁড়িব দারোগাবাবু বাঁ হাত তুলে ইশারা করতেই

দুম! দুম! দুম!

ডুরান্ড সাহেবের একটা বিকট আর্তনাদ। দুই দারোগাবাবুর চিৎকার, কে? কে? ছুটে আসে গেটের কনস্টেবল। ঘুম ভেঙে যায় দুএকজন অর্ডালীবেয়ারার। দারোগাবার রিভলবার হাতে নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে বলেন, ধরো, ধরো, ধরো। কনস্টেবল আর অর্ডালি বেহারাদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলেন, তোমরা পিছন দিকে দেখো, ধরো শালাদের

বিভ্রান্ত কর্মচারীরা এদিকেওদিকে দৌড়াদৌড়ি করে। ছুটে যান দারোগা বাবুরাও ছুটতে ছুটতে কত দূরে চলে যান ওঁরা।

ডুরান্ড সাহেবের বাংলোয় পুলিশের কর্তারা পৌঁছবার আগেই অজয়দা আর অনাদিদ জগজ্জননী ক্লাবে ব্যায়ামচর্চা শুরু করে দেন। ওদিকে কনস্টেবল আর অর্ডালিবেয়ারদের বক্তব্য শুনেই পুলিশবাহিনী ছুটে যায় ঝিনেদার রাস্তায়।

পরবর্তী চৰ্বিশ ঘণ্টায় যশোর আর ঝিনেদার পুলিশ জন পঞ্চাশেককে গ্রেপ্তার করল অজয়দাকে ধরল দুদিন পর কিন্তু সারাদিন জেরা করে ছেড়ে দিল। বিজয়া দশমীর দুদিন পর অনাদিদা যশোর ছাড়লেন। এলেন কলকাতা। পূজার ছুটি শেষ হবার ঠিক মুখোমুখি ওঁকে বলা হল, চলে যাও বরিশালের পাতারহাট। ওখানকার হিন্দু একাডেমীর হেডমাস্টারমশাইকে বলা আছে। কোনো চিন্তা নেই। তবে হ্যাঁ, ওখানে তুমি অনাদি ঘোষ থাকবে না, হবে বিমল চৌধুরী।

.

বরিশাল জেলার ঘোলা মহকুমায় মেঘনা নদীর পাড়ে পাতারহাট। সুপারী আর লংকাব এত বড় গঞ্জ বোধহয় আর কোথাও নেই। বিমল চৌধুরী পৌঁছতেই হেডমাস্টারমশাই বললেন, হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। তুমি এইট, নাইন, টেনএ বাংলা পড়াবে। লাইব্রেরির পাশে ঘরেই তুমি থাকবে। কোনো অসুবিধা হবে না।

না, বিমল চৌধুরীর কোনো অসুবিধে হয় নি বরং আনন্দেই কেটেছে দিনগুলো। কো এডুকেশন্যাল স্কুল। হাজার হোক গ্রামের স্কুল। ছাত্রছাত্রীদের বয়স একটু বেশি নতুন মাস্টারমশাইকে ওরা সবাই ভালোবাসে। প্রায়ই ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি নেমন্তন্ন জুটে যায়। যেদিন জোটে না, সেদিনও নিজেকে রান্না করতে হয় না। কোনো না কোনো ছাত্রী খুশি হয়েই রান্না করে দেয় ঝোলভাত।

মাস চারেক পরেই একদিন হেডমাস্টারমশাই বললেন, পালাও। আজই রাত্রে পালাও

প্রথমে কলকাতা, সেখান থেকে হাজারিবাগ। তারপর পাটনা। এই পাটনায় আসার দি তিনেক পরেই অনাদিদা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। একটা বাচ্চা ছেলের হাতে একটা চিরক দিয়ে পাঠান যতীন ডাক্তারের ডিসপেনসারীতে। উনি তখন রুগী দেখতে গিয়েছিলেন বে টেবিলের উপব চিরকুটটা রেখে চলে আসে ছেলেটি। ওখানেই বসে ছিলেন বিহার পুলিশে এক বাঙালী দারোগাবাবু। ব্যস। পরের দিন ভোরেই অনাদিদাকে ধরল।

সন্ধ্যের পর অনাদিদা হোটেলে এলে বললাম, আপনার চিরকুটটা পেয়েই সবকিছু মনে পড়ল।

অনাদিদা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এত সব জানলে কেমন করে?

ঐ পাতারহাট হিন্দু একাডেমীর হেডমাস্টারমশায়ের ছেলে আমার বন্ধু। ওদের বাড়িতে সবকিছু শুনেছি।

পাতারহাটের নাম শুনেই উনি একটু আনমনা হয়ে গেলেন। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন পাতারহাটের দিনগুলো সত্যি আনন্দে কেটেছে।

পাটনায় রোজ আমাদের দেখা হয়, গল্প হয়। ঐ দুতিন দিনের মধ্যেই আমরা এত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম যে অনাদিদাও আমার সঙ্গে বিহার ঘুরতে বেরিয়ে পড়লেন। প্রথমে হাজারিবাগ, রাঁচি, জামসেদপুর ঘুরে আবার পাটনা। তারপর সমস্তিপুব আর দ্বারভাঙ্গা। সব শেষে গয়া এসে আবিষ্কার করলাম আমরা বন্ধু হয়ে গেছি।

আচ্ছা অনাদিদা, একটা কথা বলবে?

অনাদিদা হেসে বললেন, তুই যা জানতে চাস, আমি তাই বলব। যেসব কথা কোনোদিন কাউকে বলিনি সেসব কথাও তো তোকে বলেছি।

দেখো অনাদিদা, তুমি বিখ্যাত বিপ্লবী। তোমার ত্যাগ, তোমার মহত্বের তুলনা হয় না। দেশ স্বাধীন করার জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করেছ।…

ওসব কথা ছেড়ে দে। তুই কী জানতে চাস, তাই বল।

আমি হেসে বললাম, অনাদিদা তুমি তো রক্তমাংসের মানুষ। তুমি কী কোনোদিন কাউকে ভালোবাসনি? কোনো মেয়ে কি তোমার জীবনে আসেনি?

সর্বত্যাগী বিপ্লবী অনাদিদা খুব জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বুদ্ধগয়ার মন্দিরের দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ, ভালোবেসেছি বৈকি

কাকে?

অশ্রুকে। অনাদিদা একটু থামেন। বুদ্ধগয়ার মন্দিরের চূড়া ছাড়িয়ে তার দৃষ্টি চলে যায় বহুদূরের নীল আকাশে কোলে। বোধহয় রোমন্থন করেন ফেলে আসা স্মৃতি। স্বপ্নভরা দিনগুলির টুকরো টুকরো ঘটনা, কাহিনি।

অনাদিদা পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকেন জানালার ধারে। অনেকক্ষণ। আমি একটু অপ্রস্তুত হই। লজ্জা পাই। আস্তে আস্তে উঠে যাই। ওর পাশে দাঁড়াই। ওর পিঠে হাত দিয়ে বলি, চলুন, একটু ঘুরে আসি।

অনাদিদা ঘুরে দাঁড়িয়ে একটু হাসেন। চোখে জল নেই কিন্তু ছলছল করছে। আষাঢ় শ্রাবণের ঘন কালো মেঘ। যে কোনো মুহূর্তে শুরু হতে পারে বর্ষণ। উনি আমার কাঁধে। হাত রেখে বললেন, না না, বেরুব না। আয়, তোকে অশ্রুর কথা বলি।…

.

ঘণ্টা বাজতেই অনাদিদা ক্লাশ নাইন থেকে বেরিয়ে আসেন। সঙ্গে সঙ্গে দুচারজন অনুরাগী ছাত্র। ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বারান্দা দিয়ে এগুতে গিয়ে থমকে দাঁড়ান। ক্লাশ টেনের দরজায় দাঁড়িয়ে অশ্রু কাঁদছে। অনাদিদা তাড়াতাড়ি এগিয়ে যান। জিজ্ঞেস করেন, কী হল অশ্রু, কাঁদছে কেন?

অশ্রু জবাব দিতে পারে না। জবাব দেয় ওরই এক বান্ধবী। অংক পারেনি বলে সীতানাথ স্যার ওকে খুব বকেছে।

অনাদিদা হেসে বলেন, আচ্ছা পাগল মেয়ে! এর জন্য কেউ কাঁদে? তুমি স্কুলের পর আমার কাছে এসো; আমি তোমাকে অংক বুঝিয়ে দেব।

অংক কোনোকালেই অনাদিদার প্রিয় বিষয় নয়। তবে ছাত্র তত ভালো। তার উপর আছে নিষ্ঠা। চেষ্টা করলে শুধু অংক কেন, ক্লাশ নাইনটেনের ছাত্রদের ফিজিক্সকেমিস্ট্রীও পড়াতে পারেন। প্রথমে একটু অসুবিধে হলেও শেষ পর্যন্ত অশ্রুকে অংক বুঝিয়ে দিতে পারলেন অনাদিদা। তারপর বললেন, তুমি রোজ ছুটির পর আমার কাছে চলে এসো। আমি তোমাকে অংক বুঝিয়ে দেব। অংকের জন্য তোমাকে আর কোনোদিন চোখের জল ফেলতে হবে না।

অশ্রু মহা খুশি। হাসতে হাসতে বাড়ি যায়।

পরের দিন স্কুল ছুটির পর আবার অশ্রু আসে কিন্তু অনাদিদার ঘরে ঢুকতে বোধহয় লজ্জা পায়। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। দেখে, অনাদিদা সঞ্চয়িতার পাতা ওল্টাচ্ছেন। তারপর হঠাৎ আপন মনে আবৃত্তি করেন।

সহস্র দিনের মাঝে
আজিকার এই দিনখানি
হয়েছে স্বতন্ত্র চিরন্তন।
তুচ্ছতার বেড়া হতে
মুক্তি তারে কে দিয়েছে আনি,
প্রত্যহের ছিঁড়েছে বন্ধন।
প্রাণদেবতার হাতে
জয়টিকা পরেছে সে ভালে,
সূর্যতারকার সাথে
স্থান সে পেয়েছে সমকালে
সৃষ্টির প্রথম বাণী
যে প্রত্যাশা আকাশে জাগালে
তাই এল করিয়া বহন।

শুনে মুগ্ধ হয় অশ্রু। হঠাৎ অনাদিদার চোখ পড়ে–আরে! তুমি দাঁড়িয়ে কেন? এসো এসো।

সারাদিন স্কুল করেও ক্লান্তি অবসাদের ছাপ থাকলেও ঢাকা পড়ে গেছে তার খুশির স্পর্শে। অনাদিার এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করেন না। পড়াতে শুরু করেন সঙ্গে সঙ্গে। পড়ার শেষে বলেন, আমি তো স্কুলের মধ্যেই সারাদিন থাকি। যখনই দরকার হবে চলে এসো। তাছাড়া ইচ্ছে করলে তুমি সব বিষয়ই আমার কাছে পড়তে পারো।

অশ্রু লজ্জায় খুশিতে কথা বলতে পারে না। মুখ নীচু করে চলে যায়।

কটা দিন কেটে গেল।

সেদিন স্কুল ছুটির পর অনাদিদা ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়ান। এত পরিপাটি করে কে গোছাল সারা ঘর? মাসখানেক ধরে বিছানায় যে চাদর পাতা ছিল, তা নেই; বিছানায় ধবধরে কাঁচা চাদর। ঘরের মেঝেয় একটা সিগারেটের টুকরো নেই; নেই ছেঁড়া কাগজপত্র। বইপত্র সুন্দর করে সাজান। ঘরের কোণার অস্থায়ী রান্না ঘরটিও সুন্দর করে গোছান। কে গোছাল? লাইব্রেরির বিনোদ? কিন্তু….

অশ্রু এল। সঙ্গে শুধু বইখাতা না; একটা এ্যাসট্রেও। এ্যাসট্রে টেবিলের ওপর রেখে বলল, স্যার এবার থেকে সিগারেটের ছাইটাই এর মধ্যেই ফেলবেন। অনাদিদা অবাক। প্রশ্ন করেন, তুমিই কি আমার ঘরদোর গুছিয়েছ?

কেন স্যার? কিছু ভুল করেছি?

অনাদিদা হেসে ওঠেন। বলেন, কিছু ভুল করো নি কিন্তু কি দরকার ছিল এত পরিশ্রম করার?

এতে আবার পরিশ্রম কী? অশ্রু একটু থেমে বলে, আপনি ভাবভোলা মানুষ। সারাদিন পড়াশুনা নিয়েই থাকেন। আপনার ঘরদোর তো আমাদেরই ঠিকঠাক করে রাখা উচিত।

ওর কথায় উনি খুশি হন। কিন্তু বলেন, হাতের কাছে কাগজকলম আর খানকতক বইপত্তর থাকলে আমি শ্মশানঘাটেও মহানন্দে থাকতে পারি।

আরো কটা দিন কেটে গেল। ইতিমধ্যে অশ্রুর বাবা নিজে এসে অনাদিদাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, বাড়িতে নেমতন্ন করেও খাইয়েছে দুদিন। স্কুলের মাস্টারমশাইরা, গ্রামের অন্যান্যরাও মাঝে মাঝে ওঁকে বাড়িতে নিয়ে খাওয়ান কিন্তু যেদিন ওঁকে নিজে রান্না করতে হয়, সেদিনই উনি চোখে সরষে ফুল দেখেন। অশ্রু তা বুঝতে পেরেছে। তাই সে মাঝে মাঝে নিজেই এগিয়ে আসে। অনাদিদার ওজর আপত্তি অগ্রাহ্য করেই ঝোলভাত বেঁধে দেয়।

দিন এগিয়ে চলে। মেঘনার পাড়ে পাতারহাটের গঞ্জে এসে ভীড় করে কত দূর দেশের পালতোলা নৌকা। সওদা বোঝাই করে চলে যায় মেঘনাপদ্মা পেরিয়ে জানাঅজানা, শহরেনগরে, গ্রামেগঞ্জে। শরৎ ফুরিয়ে যায়। হৈমন্তিকের গন্ধ আকাশে বাতাসে। মাঠের আমন ধানে দোলা দেয়।

শোনো অশ্রু, শুধু স্কুলের পড়াশুনা করলেই হবে না। আরো অনেক কিছু পড়তে হবে।

কনুইএ ভর দিয়ে হাতের ওপর মুখ রেখে অশ্রু মুগ্ধ হয়ে অনাদিদার কথা শোনে।

অনাদিদা বলেন, দেশে কত কি ঘটছে কিন্তু তোমরা জানতে পারো না, সেসব তোমাকে জানতে হবে।

অনাদিদা ওকে কত বই দেন। অশ্রু পড়ে। রোজ। নিয়মিত।

আর একটা কথা অশ্রু।…

বলুন স্যার।

রবীন্দ্রনাথকে খুব ভালো করে পড়তে হবে। পড়তে পড়তে মুখস্থ করতে হবে ওর কবিতা।

এই মাস দেড়েকের মধ্যেই অশ্রু কত বদলে যায়। ওর বাবামা খুশি, খুশি শিক্ষকরাও।

সেদিন কি কারণে যেন ফার্স্ট পিরিয়ডের পরই স্কুল ছুটি হয়ে গেল। এক মিনিটে সারা স্কুলবাড়ি ফাঁকা। টিচার্স কমনরুমে অনাদিদা কয়েকজন শিক্ষকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন। একটু পরে ওরাও চলে গেলেন। অনাদিদা আস্তে আস্তে ওঁর ঘরে এলেন।

ঘরের মধ্যে ঢুকেই উনি অবাক। কে? অশ্রু? তুমি কাঁদছ? কী হয়েছে তোমার?

অশ্রু কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না। দুচোখ দিয়ে আরো জল গড়িয়ে পড়ে।

অনাদিদা একটু এগিয়ে যান। ওর মাথায় হাত দিয়ে বলেন, বলো অশ্রু, কী হয়েছে। তোমার? কেউ বকেছে? কেউ কিছু বলেছে?

অশ্রু তখনও কাঁদে।

এবার অনাদিদার অভিমান হয়, আমাকে বলবে না? আমাকে তুমি বিশ্বাস কর না?

অশ্রু কাঁদতে কাঁদতে বলে, স্যার, ওরা সব…

আর বলতে পারে না।

অনাদিদা আবার ওর মাথায় হাত দিয়ে বলেন, বলো বলো। লজ্জা কি আমার কাছে?

অশ্রু আর বুকের মধ্যে চেপে রাখতে পারে না। কিছুতেই না। অবোধ শিশুর মত অশ্রু দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে অনাদিদাকে। বলে, স্যার, ওরা সবাই আমাকে ঠাট্টা করে।

কেন?

হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতেই ও বলে, আমি নাকি আপনাকে ভালোবাসি। তাই..

অনাদিদাও দুহাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরেন। ওর মাথার উপর নিজের মুখখানা রেখে অনাদিদা বলেন, তার জন্য কাঁদছ কেন? তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?

অশ্রু ওর বুকের মধ্যে মুখখানা লুকিয়ে রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলে, হ্যাঁ স্যার, ভালোবাসি; খুব ভালোবাসি।

আমি জানি। তাই তো তোমাকেও আমি ভালোবাসি।

সত্যি স্যার?

হা অশ্রু, সত্যি তোমাকে ভালোবাসি।

শুধু আমাকেই ভালোবাসেন স্যার?

হ্যাঁ, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।

অশ্রু আনন্দে, খুশিতে, উত্তেজনায় পাগলের মত অনাদিদাকে জড়িয়ে ধরে। অনাদিদার লোমশ বুকের উপর মুখ ঘষতে ঘষতে বলে, আপনি খুব ভালো। আপনার মতো মানুষ হয় না। আপনাকে আমি আরো, আরো অনেক ভালোবাসব।

.

গয়ার রেস্ট হাউসে বিছানার ওশর মুখোমুখি বসে অনাদিদার ভালোবাসার কাহিনি শুনছিলাম আর মনে মনে আমি চলে গেছি বহুদূরে। পূর্ব বাংলার বরিশাল জেলার ঘোল মহাকুমার পাতারহাট। কোনোদিন যাইনি, হয়ত ভবিষ্যতেও কোনোদিন যাব না। কিন্তু চোখের সামনে দেখছিলাম, সেই উদ্দাম, উত্তাল, অনন্তযৌবনা মেঘনাকে। পাতারহাটের গঞ্জ। এঁকেবেঁকে আলোছায়ায় সবুজ শ্যামল ক্যানভাসের ওপর দিয়ে চলে গেছে যে পথ সেটাই ডাইনে গিয়ে পৌঁছে যায় হিন্দু একাডেমীতে। স্কুল বাড়িটাও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। লম্বা বারান্দার মাঝামাঝি হেটমাস্টার মশায়ের ঘর, টিচার্স কমনরুম, লাইব্রেরি। তারপরই অনাদিদার ঘর।

ভাবতে গিয়েও একটু হাসি। সর্বত্যাগী বিপ্লবী অনাদিদার ঘর। ভাবভোলা অনাদিদার ঘর। কিন্তু ঘরের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারছি, এই ভাবভোলা বাউন্ডুলে জীবনেও নিশ্চয়ই কোনো অভয়া বা রাজলক্ষ্মীর আবির্ভাব হয়েছে।

হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই। এই ভাঙাচোরা অন্ধকার ঘরের এক কোণায় একটা টুকরো জ্যোৎস্নার আলো। টুপটুপ করে গলে পড়ছে। ছড়িয়ে যাচ্ছে সারা ঘর। অনাদিদার মুখে। বুকে। প্রাণে। পাতারহাট গঞ্জের পাশের যমুনার মতই টল টল ঢল ঢল করছে তার যৌবন। রূপসী বাংলার নকসী কাঁথার মাঠ সোজন বাদিয়ার ঘাটে তাকে দেখেছি বার বার বহুবার। দেখেছি আম, জাম, কাঁঠাল, অশ্বত্থ, হিজলের বনে, দেখেছি কাশ বনে, ভোরের কুয়াশায়, জোনাকির আলোয়। এরই নাম অশ্রু? আমাকে দেখে এত লজ্জা?

.

খুব জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনাদিদা বললেন, তখন আমাব ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। আছি আলিপুর জেলে। হঠাৎ একদিন অশ্রু তার স্বামীকে নিয়ে হাজির। ভেবেছিলাম, খুব কাঁদবে কিন্তু না, এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলল না।

অনাদিদা একটু থামেন। একবার বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে বলেন, অশ্রু কি বলল জানিস?

কী?

বলল, না, অনাদিদা, তোমার ফাঁসি হতে পারে না। তুমি মরলে যে আমি বিধবা হবো।, না, তা হতে পারে না। কিছুতেই না।

অনাদিদা থামলেন। আমিও কোনো প্রশ্ন করি না। দুজনেই চুপ করে বসে থাকি। মনের মধ্যে এত কথা, এত স্মৃতি আনাগোনা করে যে কেউই কথা বলতে পারি না।

হঠাৎ বেয়ারা এসে ডাকল, সাব খানা তৈয়ার।

স্বপ্ন ভঙ্গ হল অনাদিদার। বোধহয় আমারও। ওঁর মুখে একটু ম্লান হাসির আভা। বললেন, শুনলি আমার অশ্রুর কথা?

মুখে কিছু বললাম না; শুধু মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *