৩. দিনগুলো বেশ কাটছে

দিনগুলো বেশ কাটছে। মিস্টার সরকার ডিভিশনাল ম্যানেজার হয়েছেন। বোম্বে বদলী হবার কথা হয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত কলকাতাতেই থেকে গেছেন। মাঝে অবশ্য এক বছরের জন্য পাটনা যেতে হয়েছিল, তবে শিবানী বা খোকনকে নিয়ে যাননি। ওরা পাটনা গেলে খোকনের পড়াশোনার গণ্ডগোল হতো। মিস্টার সরকার প্রত্যেক মাসে একবার আসতেন। বিহারী ছিল বলে শিবানীর কোন অসুবিধে হয়নি। তাছাড়া শ্বশুর-শাশুড়ি মাস ছয়েক ছিলেন।

.

বিহাইকাকা, ও বিহাইকাকা, শুনে যাও। পড়ার ঘর থেকেই খোকন বিহারীকে ডাকে।

কিরে খোকনদা?

কাছে এসো। কানে কানে বলব। খুব প্রাইভেট কথা।

মিস্টার সরকার হাসতে হাসতে স্ত্রীকে বললেন, শিবানী তোমার ছেলের মাথায় বোধহয় কোন মতলব এসেছে।

শিবানীও হাসেন। বলেন, বিহারী আদর দিয়ে দিয়েই ছেলেটার বারোটা বাজাবে।

বিহারী কোন মতে হাসি চেপে গম্ভীর হয়ে বলল, আমি কী করলাম বউদি?

না, না, তুমি কি করবে? তুমি কিছু করোনি।

বিহারী কিছু বলার আগেই আবার খোকন ডাকল, কি হলো বিহাইকাকা? এলে না?

মিস্টার সরকার খোকনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এখানে এসে বলে যাও না!

আমি যে পড়ছি।

খোকনের জবাব শুনে তিনজনেই হাসেন।

বিহারী আর দেরি না করে খোকনের কাছে যায়। খোকন কানে কানে ফিস ফিস করে কি যেন বলে। বিহারীও ওর কানে কানে জবাব দেয়।

বিহারী ড্রইংরুমে ফিরে আসতেই ওরা দুজনে ওর দিকে তাকালেন। বিহারী একটু হেসে খুব চাপা গলায় ফিস ফিস করে বলল, আজ গেমস পিরিয়ডে খোকনের কেডস জুতোটা কে ব্লেড দিয়ে কেটে দিয়েছে।

শিবানী বললেন, তাই নাকি?

মিস্টার সরকার বললেন, এর আগের মাসেই তো…

যাকগে। ওকে কিছু বলবেন না। বউদি, আমাকে দশটা টাকা দিন। ওর একজোড়া মোজাও কিনতে হবে।

শিবানী বললেন, ওর কি মাসে মাসেই এক জোড়া জুতোমোজা লাগবে?

ছেলেরা যদি দুষ্টুমি করে, ও কি করবে? বিহারী এক নিশ্বাসেই বলে, তাছাড়া যে গরু দুধ দেয়, তার চাটিও ভালো লাগে।

মিস্টার সরকার হাতের খবরের কাগজ না নামিয়েই বললেন, খোকনের সব ব্যাপারেই বিহারীর ওই এক যুক্তি।

শিবানী বললেন, ছেলে আমার কি এমন একেবারে বিদ্যাসাগর হয়েছে যে…

ওকথা বলবেন না বউদি; খোকনের মতন ছেলে ওদের ক্লাশে আর একটাও নেই;

আবার ওঘর থেকে খোকনের গলা শোনা গেল, বিহাইকাকা, আমার পড়া হয়ে গেল।

এবার শিবানী হাসেন। সোফা থেকে উঠতে উঠতে বললেন, নতুন জুতো-মোজা কেনার জন্য আর পড়ায় মন বসছে না।

.

খোকন আরো বড় হয়।

সকাল বেলায় স্কুল যাবার সময় বিহারীকে বলে, বিহাইকাকা, তুমি ঠিক তিনটের মধ্যে বাড়ি চলে এসো। সাড়ে তিনটের মধ্যে মাঠে না পৌঁছলে ভালো জায়গা পাব না।

তুমি স্কুল থেকে বাড়িতে এসেই একবার ফোন কোরো।

না, না, আমি বাবাকে ফোন করব না। অফিসে ফোন করলেই বাবা ভীষণ রেগে যায়।

তাহলে বউদিকে বোলো।

মার তখন ঘুমুবার সময়। মাকে ফোন করতে বললে মাও রেগে যাবে। তুমি চলে এসো।

বিহারীকে আসতেই হয়। না এসে পারে না।

সন্ধের পর মাঠ থেকে ফিরে এসেই বিহারী বলে, বউদি, এক বাটি সরষের তেল দিন।

সরষের তেল কি হবে?

খোকনদা আমার কাধ-পিঠ মালিশ করবে।

শিবানী হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করেন, কেন? কি হয়েছে?

বিহারী একবার খোকনের দিকে তাকিয়ে বলে, এত বড় বুড়োধাড়ী ছেলেকে কাঁধে করে খেলা দেখাতে হলে…

খোকন আর চুপ করে থাকে না। বলে, বিহাইকাকা, অযথা আমাকে দোষ দেবে না।

তবে কাকে দোষ দেবো খোকনদা?

খোকন এবার মাকে বলে, জানো মা, বিহাইকাকাই আমাকে বলল, খোকনদা, আমার কাঁধে চড়। তা নয়ত কিছু দেখতে পাবি না।

.

বিহারী হাসতে হাসতে বলে, হারে খোকনদা, তুই কি চিরকালই আমাকে বিহাইকাকা বলবি?

ওর প্রশ্ন শুনে খোকনও হাসে। জিজ্ঞাসা করে, কেন, আমার বিহাইকাকা ডাক তোমার ভালো লাগে না?

তুই যা বলে ডাকবি তাই আমার ভালো লাগবে।

তাহলে তুমি ওকথা বলছ কেন?

এমনি জিজ্ঞাসা করছিলাম। বিহারী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা খোকন, এখন তো তুই একটু বড় হয়েছিস, তবে কেন তুই এখনও দাদা বউদিকে সব কথা বলতে পারিস না?

খোকন দুহাত দিয়ে বিহারীর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, আমি তোমাকে বিরক্ত করি বলে তুমি রাগ করো?

দূর পাগল! তোর উপর আমি কখনও রাগ করতে পারি?

কিন্তু আমি তো তোমাকে খুবই বিরক্ত করি।

তুই বিরক্ত না করলে আমার পেটের ভাত হজমই হবে না।

দুজনে এক সঙ্গে হেসে ওঠে।

দুজনে আরো কত কথা হয়।

বিহারী বলে, আচ্ছা খোকন, আমি যদি কোনো কারণে তোদের বাড়িতে কাজ না করি…

খোকন একটু বিরক্ত হয়েই প্রশ্ন করে, তার মানে? তোমাকে কি মা বা বাবা কিছু বলেছেন?

না, না, কেউ কিছু বলেননি।

তাহলে তুমি হঠাৎ একথা বললে কেন?

কোনো কারণ নেই রে খোকনদা! এমনি বললাম। হাজার হোক মানুষের কথা কেউ কি কিছু বলতে পারে?

খোকন কিছুতেই বিশ্বাস করে না। বলে, না না বিহাইকাকা, তুমি চেপে যাচ্ছ।

বিহারী খোকনকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলে, সত্যি বলছি কিছু হয়নি। তবে মনে মনে নানা কথা ভাবতে ভাবতে এসব কথা প্রায়ই মনে হয়।

না না বিহাইকাকা তুমি আর এসব ভাববে না। ঠিক তো?

বিহারী হাসে। বলে, ঠিক আছে খোকনদা, আমি আর এসব কথা ভাবব না।

.

বেশ চলছিল কিন্তু হঠাৎ একদিন সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেল।

অ্যাকসিডেন্ট।

মিস্টার সরকারের টেলিফোন পেয়েই শিবানী প্রায় পাগলের মতন চিৎকার করে উঠলেন, অ্যাকসিডেন্ট! তোমার?

না, না, আমি গাড়িতে ছিলাম না। বিহারী…

বিহারী নেই?

আছে আছে। হাসপাতালে…

কোথায় অ্যাকসিডেন্ট হলো?

আমার এক কলিগকে নিয়ে টিটাগড়ের কারখানায় যাবার পথে…

তোমার কোন কলিগ?

মিত্তির। তার কিছু হয়নি।

কিভাবে অ্যাকসিডেন্ট হলো?

একটা লরি অ্যাকসিডেন্ট করে পালাবার সময় আমার গাড়িতে এমন ধাক্কা লাগিয়েছে যে…

বিহারীর কোথায় লেগেছে?

বোধহয় বুকের দু-তিনটে হাড় ভেঙেছে আর ডান হাতটা…

ডান হাত নেই?

আছে, তবে বোধহয় কিছু কাটাকাটি করতে হবে।

কি সর্বনাশ!

যাই হোক আমি আবার এক্ষুনি হাসপাতালে যাচ্ছি…

তুমি একলা?

না, না, অফিসের অনেকেই হাসপাতালে আছে।…

কোন্ হাসপাতালে?

আর. জি. কর-এ। যাই হোক খোকনকে কিছু বোলো না। ও শুনলে…

আমি হাসপাতালে আসব?

এখন গিয়ে কোনো লাভ নেই। বিহারীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেছে।

দিন পনেরো পরে খোনকে দেখেই বিহারী কাঁদতে কাঁদতে বলল, খোকনদা ছুটির ঘণ্টা পড়লেও যেতে পারলাম না। তোর জন্য থেকে যেতে হল।

খোকন কাঁদতে কাঁদতে বলল, বিহাইকাকা, আমার আর গাড়ি চালানো শেখা হল না।

দাদা তোমাকে শেখাবেন।

না বিহাইকাকা, আমি অন্য কারুর কাছে শিখতে পারব না।

নারে খোকনদা, ওই অস্টিনে চড়িয়ে তোকে আমি নার্সিং হোম থেকে এনেছিলাম। তোকে ওই গাড়ি চালাতেই হবে।

না বিহাইকাকা, আমি ও গাড়ির স্টিয়ারিং টাচ করব না, কোনদিনও না। তুমি দেখে নিও। তিনমাস কেটে গেল।

হাসপাতাল থেকে ছুটি পাবার আগের দিন বিহারী মিস্টার সরকার আর শিবানীর দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি বাড়ি গিয়ে কি করব দাদা? বউদি, কিভাবে আমার সংসার চলবে?

মিস্টার সরকার বললেন, অত চিন্তা কোরো না সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু যার ডান হাতের চারটে আঙুল নেই, সে কি কাজ করবে?

শিবানী বললেন, তোমার দাদা আর চৌধুরিদা যখন আছেন তখন তুমি অত ভাবছ কেন?

এই তিনমাস হাসপাতালে আসা যাওয়া করার জন্য বিহারীর স্ত্রী মিস্টার সরকারের সামনে একটু আধটু কথাবার্তা বলেন। বলতেই হয়। না বললে চলে না। উনি বিহারীকে বললেন, চৌধুরি সাহেব আর দাদা-বউদি যখন আছেন তখন আমিই সংসার চালিয়ে নেব তোমাকে কিছু করতে হবে না।

আমাকে যমের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনতে ওঁরা যা করলেন, তার কোনোই তুলনা হয় না। ওঁরা আর কত করবেন?

.

চৌধুরিদের পুরনো গ্যারেজ আর ড্রাইভারের থাকার ঘর মেরামত হল। সামনের দিকে ছোট মুদিখানা দোকান বিহারীলাল স্টোর্স তার পিছনেই ওদের থাকার ব্যবস্থা। বিহারীর ছেলে সন্তোষ ক্লাস টেন-এ উঠেছে। ও আগের মতনই পড়তে লাগল। বিহারী দোকান চালায়। ওর স্ত্রী সংসার চালায় আর স্বামীকে দেখে। বিহারীর মেয়ে কালীকে শিবানী নিজের কাছে নিয়ে এলেন।

মিস্টার সরকার বললেন, যাই বলো বিহারী, তোমার মেয়ে এমন কিছু কালো নয় যে ওকে কালী বলে ডাকতে হবে।

দাদা, ও কালো না?

না, ও শ্যামবর্ণ।

বিহারী হেসে বলে, কালী যদি শ্যামবর্ণ হয়, তাহলে আমি ফরসা।

কালী একটা সোনার টুকরো মেয়ে। তাই আমি ওর নাম দিয়েছি সোনালী।

সোনালী!

হ্যাঁ সোনালী।

স্নেহ বড় বিচিত্র সম্পদ। স্নেহ দিয়ে বনের পশুকেও বশ করা যায়। সোনালীকে তো যাবেই।

সোনালী!

কি জ্যাঠামণি?

বড়মাকে বলে এসো আমি পরশুদিন চিড়িয়াখানা যাব। বাড়িতে ফিরতে দেরি হবে।

তুমি একলা যাবে জ্যাঠামণি?

আর কে যাবে?

আমি আর খোকনদা যাব না?

ওখানে বাঘ-সিংহ আছে। তোমাদের ভয় করবে।

তোমার ভয় করবে না?

করবে, তবে অল্প অল্প।

তোমার অল্প ভয় করবে কেন?

আমি যে বড় হয়েছি।

সোনালী একবার নিজেকে আপাদমস্তক দেখে বলল, আমিও বড় হয়ে গেছি।

তাই নাকি?

হ্যাঁ জ্যাঠামণি আমি বড় হয়ে গেছি।

কি করে বুঝলে?

আমাকে মা-বড়মা কেউ কোলে নিতে পারে না।

সোনালী মাথা নেড়ে ছোট্ট দুটো বিনুনি দুলিয়ে বলতে লাগল, না! পারে না।

তাহলে আমার সোনালী সত্যি বড় হয়েছে।

তাছাড়া আমি তো লুডো খেলাও শিখে গেছি।

সত্যি?

আমি মিথ্যে কথা বলি না। বড়মা বলেছে মিথ্যে কথা বললে জিভে ঘা হয়।

রবিবার সবাই মিলে চিড়িয়াখানা গেলেন। বাড়ি ফেরার পথে বিহারীর ওখানে।

গাড়ি থামতেই সোনালী চিৎকার করল, বাবা, আমি হাতির পিঠে চড়েছি।

তাই নাকি?

হ্যাঁ বাবা।

খোকনদা, তুই চড়েছিস?

তুমি এর মধ্যেই ভুলে গেলে বিহাইকাকা? তুমি আমাকে কতবার চড়িয়েছ মনে নেই?

আজ চড়েছিস? চড়েছি।

সোনালী দৌড়ে ভিতরে গিয়ে মাকে খবরটা দিয়েই আবার বাইরে বেরিয়ে আসে। পিছন পিছন ওর মা।

মিস্টার সরকার হেসে বললেন, সোনালী বড় হয়ে গেছে। আর আমাদের চিন্তা নেই। ও বাঘ-সিংহ দেখেও ভয় পায় না, তাছাড়া লুডো খেলাও শিখে গেছে।

চিড়িয়াখানার বাঘ-সিংহ দেখে কেউ আবার ভয় পায় নাকি?

শিবানী জিজ্ঞাসা করলেন, সন্তোষ কোথায়?

বউদি, ও আজকাল এই পাড়ারই একটা ছেলের কাছে পড়তে যায়। সেখানেই গেছে।

দোকান কেমন চলছে?

এক পয়সা ভাড়া তো দিতে হচ্ছে না, আর দাদা টাকা-পয়সার ব্যবস্থা যেভাবে করে দোকান সাজিয়ে দিয়েছেন তাতে তিনজনের মোটামুটি চলে যাচ্ছে।

বিহারীর স্ত্রী বললেন, আগের মতন এখন আর অত ঘাবড়ে যান না। দোকান তো উনি একলাই চালিয়ে নিচ্ছেন।

আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর শিবানী বললেন, সোনালী, তুই আজ এখানে থাক। কাল বিকেলে তোর জ্যাঠামণি এসে তোকে নিয়ে যাবে।

ঠিক নিয়ে যাবে তো?

মিস্টার সরকার হাসতে হাসতে বললেন, তুই না থাকলে এই বুড়োকে কে দেখবে?

তুমি মোটেও বুড়ো হওনি।

রওনা হবার আগে বিহারী একবার গাড়িটা দেখে, স্টিয়ারিংটা নাড়াচাড়া করে। তারপর বলে, বউদি, দাদাকে যদি গাড়ি চালানো না শেখাতাম তাহলে আজ কত অসুবিধে হতে বলুন তো!

দিন আরো এগিয়ে চলে। সোনালী আরো কাছে আসে, আরো আপন হয়। তারপর একদিন স্কুলে ভর্তি হয়। ভোরবেলায় যায়। দশটায় ছুটি। দুপুরে বড়মার কাছে বসে পরের দিনের পড়াশুনা করে নেয়। কখনও খোকনের সঙ্গে গল্প করে, লুডো খেলে। নয়তো ক্যারাম। খেয়াল হলে ডাইনিং টেবিলে টেবিল টেনিস।

আজ সোনালীর জন্মদিন। আজ স্কুলে যায়নি। ভোরবেলায় উঠে স্নান করে নতুন জামা পরে জ্যাঠামণি, বড়মা, খোকনদাকে প্রণাম করে। আশীর্বাদ নেয়। তারপর অফিস যাবার সময় মিস্টার সরকার ওকে বাবা-মার কাছে পৌঁছে দেন। পরের দিন সকালে সন্তোষ পৌঁছে দিয়ে যায়।

দিনগুলো বেশ কেটে যায়। দেখতে দেখতে বছরের পর বছর পার হয়।

.

জানালায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে মিস্টার সরকারের গাড়ি দেখেই সোনালী দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে কেটলি গ্যাসে চড়িয়ে দেয়। তারপর উনি গলিটা পার হয়ে বাড়ির সামনে গাড়ি থামাতে-না-থামাতেই সোনালী গ্যাস বন্ধ করে কেটলির মধ্যে চা ফেলে দেয়! উনি ঘরে বসতে-না-বসতেই সোনালী ট্রেতে দু কাপ চা আর চারটে বিস্কুট নিয়ে ঢোকে। শিবানী চা-বিস্কুট নামিয়ে সেন্টার টেবিলে রাখতে রাখতে বলেন, আমার মেয়ে তোমাকে কি রকম ভালোবাসে?

মিস্টার সরকার সোনালীকে কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, তুই আমাকে সত্যি ভালোবাসিস?

সোনালী একটু হেসে মাথা নাড়ে।

আমি তোকে একটুও ভালোবাসি না।

সোনালী বেশ গম্ভীর হয়ে বলল, জ্যাঠামণি, তুমি মিথ্যে কথা বললে জিভে ঘা হবে আর বড়মা খুব রাগ করবে।

আমি মিথ্যে কথা বলছি না। আমি সত্যি তোকে একটুও ভালোবাসি না।

ভালো না বাসলে আমার ছবি অত বড়ো করে শোবার ঘরে ঝুলিয়ে রেখেছ কেন?

সোনালীর কথায় ওরা দুজনেই হাসেন।

সোনালী ভিতরে চলে যাবার পর শিবানী বললেন, সোনালী সত্যি তোমাকে খুব ভালোবাসে। তোমার আসার সময় হলে ও যেভাবে জানালায় দাঁড়িয়ে হাঁ করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে, তা দেখে আমিই অবাক হয়ে যাই।

মিস্টার সরকার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, তা ঠিক। আমার সবকিছু খুঁটিনাটি ব্যাপারেও ওর নজর আছে।

শিবানী হেসে বললেন, আজ স্কুল থেকে ফিরে আমাকে কি বলেছে জানো?

কি?

বলেছে, বড়মা, একটা লোকের পায়ে খুব সুন্দর একটা জুতো দেখলাম। জ্যাঠামণিকে ওই রকম জুতো কিনে দেবে? ওইরকম জুতো পরলে জ্যাঠামণিকে খুব সুন্দর দেখাবে।

মিস্টার সরকার হাসেন।

শিবানী চা খেতে খেতে বলেন, সেদিন ঢাকুরিয়ায় দাদাকে লখনৌ চিকনের পাঞ্জাবি পরতে দেখেই মেয়ে ধরল, বড়মা, জ্যাঠামণিকে ওই রকম পাঞ্জাবি তৈরি করে দাও।

তাই বুঝি তুমি লখনৌ চিকনের পাঞ্জাবি কিনে আনলে?

কি করব? সোনালী এমন করে ধরল যে পাঞ্জাবি না কিনে পারলাম না।

আজকাল আর খোকনের সঙ্গে ঝগড়া করে না?

না, আজকাল আর ঝগড়া হয় না। একটু বেশি তর্ক হলেই আমার কাছে ছুটে আসে।

বাড়িতে একমাত্র ছেলে বা মেয়ে সব সময় একটু বেশি আদুরে, একটু খামখেয়ালী হয়। সোনালী এসে সেদিক থেকে খোকনের উপকারই হয়েছে।

প্রথম প্রথম খোকনের মধ্যে একটু দ্বিধা ছিল।

দ্বিধা মানে?

মানে, ও ভারত ড্রাইভার বিহারীর মেয়ে, কিন্তু সে-ভাবটা আস্তে আস্তে চলে গেছে। এখন ওকে ঠিক নিজের বোনের মতনই ভালোবাসে।

দরজার ওপাশ থেকে সোনালী বলল, জ্যাঠামণি অফিসের জামা-কাপড় ছাড়বে না?

ওর কথায় ওরা দুজনেই হাসেন।

মিস্টার সরকার ওকে ডাকেন, সোনালী শুনে যা।

সোনালী ঘরে ঢুকে বলে, কী বলছ জ্যাঠামণি?

সোনালীকে কোলে বসিয়ে মিস্টার সরকার বললেন, এত খিদে লেগেছে যে উঠতে পারছি না।

আজ লাঞ্চের সময় কিছু খাওনি?

নারে।

কেন?

এত কাজে ব্যস্ত ছিলাম যে কিছুতেই উঠতে পারলাম না।

তার পরেও কিছু খেতে পারলে না?

মিস্টার সরকার ঠোঁট উল্টে বললেন, লাঞ্চের পর কি আর সময় হয়?

তাই বলে কি না খেয়ে কেউ কাজ করে নাকি? সোনালী উঠে দাঁড়িয়ে ওর হাত ধরে টানতে টানতে বলে, আর বকবক না করে এবার উঠে পড়ো।

মিস্টার সরকার সোনালীকে কোলে-তুলে নিয়ে বলেন,

আমাদের সোনালী
বেড়াতে যাবে মানালী
করে না হেঁয়ালি
আছে একটু খামখেয়ালি।

এক গাল হাসি হেসে সোনালী বলল, দেখলে বড়মা, জ্যাঠামণি কি সুন্দর কবিতা বানালো।

শিবানী হেসে বলল, তোর জ্যাঠামণি রবিঠাকুর হয়ে গেছে।

না বড়মা, ঠাট্টার কথা নয়। সত্যি কবিতাটি খুব সুন্দর হয়েছে।

মিস্টার সরকার হাসতে হাসতে বললেন, তোকে একটুও ভালোবাসি না বলেই তো কবিতাটা ভালো হল।

তুমি আমাকে ভালোবাস না? সোনালী মিট মিট করে হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল।

মিস্টার সরকার মাথা নেড়ে বললেন, না।

সোনালী হাসতে হাসতে বলল, তাই বুঝি রোজ রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে আমার জন্য…

মিস্টার সরকার হঠাৎ খুব জোরে চিৎকার করে বললেন, বাজে কথা বলবি না। আমি কোনোদিন কাউকে লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু দিই না।

সোনালী হাসি চাপতে পারে না। বলে, তুমি লুকিয়ে দিলেও আমি সবাইকে বলে দিই।

আজেবাজে কথা বললে একটা থাপ্পড় খাবি।

সোনালী আর শিবানী হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *