১৮. দুঃখের দিনগুলো কাটতে চায় না

দুঃখের দিনগুলো কাটতে চায় না কিন্তু সুখের দিনগুলো কেমন যেন ঝড়ের বেগে উড়ে যায়। বন্দনা-বিকাশকে নিয়ে তরুণের দিনগুলিও অমনি উড়ে গেল। দেখতে দেখতে বিকাশের ছুটি ফুরিয়ে এলো।

কটি দিন কত কি করল! কত কি দেখল! রবিবার সকালেই বিকাশ চলে যাবে। শনিবার সন্ধ্যায় তরুণ ওদের নিয়ে মার্কেটিং-এ বেরুল।

তোমরা তো লন্ডনে হাস পাপির জুতো পরে হৈ হৈ কর। এদের হাতে তৈরি জুতো জোড়া নিয়ে পরে দেখে কি চমৎকার।

বিকাশ বলল, আমার তিন-চার জোড়া ভালো জুতো আছে। আবার জুতোর কি দরকার।

তরুণ সেকথা কানেও তুলো না। এবার ঘুরতে ঘুরতে ছোট্ট একটা গলির মধ্যে এক এজেন্সি হাউসে হাজির হল।

হাউ আর ইউ মিঃ নোয়েল?

ফাইন, থ্যাংক ইউ স্যার।

এই হচ্ছে আমার বোন আর ব্রাদার-ইন-ল। ওদের জিনিসটা রেডি আছে তো?

বিকাশ-বন্দনা একটু মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।

নোয়েল সাহেব বললেন, আপনার জিনিস রেডি রাখব না?

এক মিনিটের মধ্যে ভিতর থেকে ঘুরে এসেই টেবিলের ওপর ব্রাউনের টুরিস্ট মডেল একটা টিভি সেট খুলে দেখালেন।

বন্দনা বলল, একি দাদা! টিভি সেট কিনছ কেন?

চুপ করে থাক।

এবার বিকাশ বলে, একি করছেন দাদা?

আর একি করছেন! মাস কয়েক আগে সেটটা দেখেই ওর ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। তারপর ওদের আসার খবর পাবার পরই নোয়েলকে দাম-টাম মিটিয়ে দিয়ে গেছে।

তরুণের সঙ্গে তর্ক করার সাহস ওদের কারুরই নেই। তবুও বার বার আপত্তি করেছি।

শেষকালে আর সহ্য করতে না পেরে তরুণ বলেছিল, জীবনে কাউকেই তো কিছু দেবার সৌভাগ্য হলো না। লোকেরা বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-পুত্রকে কত কি দেয়! তোমরা না হয় আমাকে সেই সৌভাগ্যটুকু উপভোগের প্রথম সুযোগ দাও।

বন্দনা-বিকাশের মুখ দিয়ে আর একটি কথা বেরোয়নি।

কিছুক্ষণ পরে তরুণ আবার বলল, দাদার কাছে ছোট ভাইবোনেরা কত কি আবদার করে। কই, তোমরা তো আমার কাছে কিছুই আবদার করলে না?

এই দুনিয়ায় স্নেহ, ভালোবাসা পাবার সৌভাগ্য চাই। কিন্তু সেই স্নেহ-ভালোবাসা অপরকে দিতে পারার মতো দুর্ভাগ্য নেই। মানুষকে ভালোবেসেই মানুষের স্বার্থকতা, পূর্ণতা, পরিতৃপ্তি। তরুণের জীবনে সেই পূর্ণতা, পরিতৃপ্তি হলো না। একথা বন্দনা-বিকাশ জানত কিন্তু সেদিন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করল।

কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ থাকল। খানিকক্ষণ পরে বন্দনা বলল, এই একমাস আমি এমন জ্বালাতন করব যে তোমার আর দুঃখ থাকবে না দাদা।

বিষণ্ণ তরুণের মুখে শুকনো হাসির রেখা ফুটে উঠল। শুধু এই একমাস তো জ্বালাতন করবে, তারপর তো নয়।

পরের দিন বিকাশকে সি-অফ করতে গিয়ে তরুণের মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। বন্দনা, তুমিও চলে গেলে পারতে। ও বেচারির একলা থাকতে ভীষণ কষ্ট হবে।

তোমাকে একলা ফেলে গেলে তোমার বুঝি কষ্ট হবে না?

বিকাশও সঙ্গে সঙ্গে বলল, না না দাদা, আমার কিছু কষ্ট হবে না। তাছাড়া বন্দনাও তো কতদিন ধরে একঘেয়ে জীবন কাটাচ্ছিল।

বিকাশ চলে গেল। বন্দনাকে নিয়ে তরুণ ফিরে গেল হান্স কোয়ার্টারের অ্যাপার্টমেন্টে।

একটা অ্যালুমিনিয়াম ডেক-চেয়ার নিয়ে তরুণ দক্ষিণের বারান্দায় বসল। বন্দনা চলে গেল ভিতরে।

কিছুক্ষণ পরে দু হাতে দু কাপ কফি নিয়ে বন্দনা এলো বারান্দায়।

হাসতে হাসতে তরুণ জিজ্ঞাসা করল, কি, কফি?

হ্যাঁ।

দাঁড়াও, দাঁড়াও। আর একটা বসবার কিছু আনি।

তুমি ধর। আমি আনছি।

না না, আমিই আনছি।

তরুণ চট করে ভিতর থেকে একটা ইজিপসিয়ান মোড়া আনল।

কফির কাপে চুমুক দিয়েই বন্দনা বলল, একটা মাস বেশ মজায় কাটানো যাবে, তাই না দাদা?

হ্যাঁ, তা বেশ কাটবে। খুশিভরা হাসি হাসি মুখে তরুণ জবাব দেয়।

জান দাদা, আমার ভাগ্যটা যে এমন করে পাল্টে যাবে তা কোনোদিন ভাবিনি।

আত্মস্মৃতির সবগুলি অধ্যায় মনে মনে পর্যালোচনা করে বন্দনা যেন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছল।

এর মধ্যে আবার ভাগ্য পাল্টাল কোথায়?

ভ্রূ দুটো তুলে চোখ ঘুরিয়ে বন্দনা বলে, ভাগ্য না হলে তোমার মতো দাদা পাই? হালা কোয়ার্টারে থাকতে…

তরুণ আর হাসি চাপতে পারল না। হাসতে হাসতেই বলল, একটা আস্ত পাগলী না হলে কেউ একথা বলে?

হঠাৎ ডোর-বেলটা বেজে উঠল।

তরুণ উঠতে গেলেই বন্দনা বলল, তুমি বসো, আমি দেখছি।

বন্দনা দরজা খুলেই আনন্দে প্রায় চিৎকার করে উঠল, আপ আ গিয়া! আইয়ে আইয়ে! তাড়াতাড়ি তরুণ উঠে গিয়ে দেখল ট্যান্ডন সাহেব এসেছেন।

ট্যান্ডন সাহেব মুচকি হাসতে হাসতে বললেন, আই ওয়ানটেড টু চেক আপ দুই ভাই-বোনে কেমন মজা করছ?

বন্দনা মজা করে বলে, এই তো সবে এক কাপ কফি নিয়ে শুরু করেছি। কদিন অপেক্ষা করুন-তারপর দেখবেন।

ট্যান্ডন সাহেব বন্দনার কাঁধে হাত দিয়ে একটু কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, এই বুড়ো দাদাকেও একটু শেয়ার-টেয়ার দিও।

তরুণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছিল। এবার বলে, আগে তো বসুন তারপর ভাগাভাগি করা যাবে।

তরুণ আর ট্যান্ডন সাহেব লিভিং রুমের কোণার কৌচে বসলেন। পাকা গিন্নীর মতো বন্দনা জানতে চাইল, হোয়াট উইল ইউ হ্যাভ টি অর কফি?

শুধু টি অর কফি? আর কিছু খাওয়াবে না?

আপনার মতো সিনিয়র ডিপ্লোম্যাটের তো অধৈর্য হওয়া চলে না। ইউ সুড ওয়েট অ্যান্ড সী।

বন্দনার শাসন করার কায়দা দেখে দু জনেই হাসলেন।

ট্যান্ডন সাহেব কপালে হাত দিয়ে বললেন, খোদা হাফিজ! এ তো দারুণ মেয়ে। এবার তরুণের দিকে তাকিয়ে বললেন, সি সুড হ্যাভ বিন ইন ডিপ্লোম্যাটিক সার্ভিস।

ইউ গো অন পন্ডারিং, আমি যাচ্ছি।

কার্ডিগানের হাত গোটাতে গোটাতে বন্দনা পা বাড়াল প্যান্ট্রির দিকে। ট্যান্ডন সাহেব প্রায় চিৎকার করে বললেন, তরুণ, আউটস্ট্যান্ডিং ডিপ্লোম্যাটদের মতো সি ক্যান ইগনোর টু!

তরুণ কিছুই জবাব দেয় না কিন্তু মনে মনে যেন বন্দনার জন্য গর্ব অনুভব করে।

ট্যান্ডন সাহেব এবার বলেন, ভারি চমৎকার মেয়ে! দেখলেই যেন আদর করতে ইচ্ছা করে।

সত্যি, বন্দনা খুব ভালো মেয়ে।

তুমি খুব লাকী।

অ্যাজ ফার অ্যাজ বন্দনাজ কনসার্নড়, আমি নিশ্চয়ই লাকি।

ট্যান্ডন সাহেব হঠাৎ একটু হাসলেন, অ্যান্ড সী ইজ ভেরি প্রাউড অফ ইউ।

তাই নাকি? হাসতে হাসতে তরুণ পাল্টা প্রশ্ন করে।

কিছুক্ষণ পরে বন্দনা ট্রলি-ট্রে নিয়ে হাজির হলো। প্লেট ভর্তি পাকোড়া আর কফি ছাড়াও আরো কি কি যেন।

ট্যান্ডন সাহেব ঠাট্টা করে বললেন, এত বেলায় পাকোড়া-কফি? ভেবেছিলাম লাঞ্চ খাওয়াবে।

আজকে আমাদের একটু স্পেশাল খাওয়া-দাওয়া আছে। সো ইউ মাস্ট এক্সকিউজ।

বন্দনার কথা শুনে দুজনেই হাসল।

বেশ কাটছিল দিনগুলো। এর আগে মহাশূন্যতার মধ্যে তরুণ ভেসে বেড়াত। আজকাল? সব শূন্যতা যেন পূর্ণ করেছে বন্দনা। একটি মুহূর্তের জন্যও তরুণ নিঃসঙ্গতার বেদনা অনুভব করতে পারে না।

তরুণের মুখটা তুলে ধরে বন্দনা বলল, তুমি চুপটি করে কি ভাবছ দাদা? আমি রান্না করছি, চলো না, তুমি ওখানে গিয়ে বসবে।

তরুণ আর চুপটি করে একলা বসতে পারে না। বন্দনা রান্না করে আর ও পাশে ইজিপসিয়ান মোড়াটা নিয়ে বসে বসে গল্প করে।

আচ্ছা দাদা, তুমি রান্নাঘরে গিয়ে মাসিমার সঙ্গে গল্প করতে?

খুব ছেলেবেলায় মার পাশে পাশেই কাটাতাম কিন্তু বড় হবার পর আর সে সুযোগ পেতাম না।

কেন?

ছোট্ট একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তরুণ হাসল। পুরনো দিনের কথা মনে হতেই কোথায় যেন তলিয়ে গেল।

উদাস ফ্যাকাশে দৃষ্টিটা বাইরের দিকে ফিরিয়ে তরুণ বলল, পরের দিকে ইন্দ্রাণী না হলে মার এক মুহূর্তও চলত না। ইন্দ্রাণীকে কাছে পেলেই মার ফিসফিস শুরু হয়ে যেতো।

মাসিমা ওকে ভীষণ ভালোবাসতেন। আপন মনেই বন্দনা বলল।

কথা বলতে বলতেই মাছ ভাজা হয়ে গেল। একটা মাছ ভাঙা প্লেটে তুলে তরুণের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এই নাও দাদা।

সে কি? এখন মাছ খাব কেন?

আমি দিচ্ছি, খেয়ে নাও না।

আরো এগিয়ে চলে। তরুণ ফিলহারমনিক অর্কেস্ট্রার দুটো টিকিট কিনে এনেছে। বন্দনাকে বলেছে একটু ভালো কাপড়-চোপড় পরে যেতে। ভিতরের ঘরে সাজগোজ করছে সে। তরুণ সিগারেট খেতে খেতে পায়চারি করছে।

দাদা, একটু এদিকে আসবে?

কি হলো?

একটু এসো।

ও-ঘরে গিয়ে বন্দনাকে দেখেই তরুণ বলল, বাপরে বাপ! বার্লিনার্সরা ভাববে ইন্ডিয়ান কুইন এসেছে।

আমি কুইন না হতে পারি বাট সিস্টার অফ অ্যান ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাট!

ঠোঁটটা উন্টে তরুণ বলে, এই গহনা-টহনা কাপড়-চোপড় দেখে, কি বিশ্বাস করবে?

বন্দনাকে দেখতে ভালোই। চোখ-মুখ বেশ শার্প। নাকটা যেন একটু চাপা। তবে তা নজরে পড়ে না। চেহারার গড়নটাও বেশ ভালো। লন্ডনের একদল ইন্ডিয়ান ছোঁকরা যে বন্দনার সঙ্গে ভাব জমাবার জন্য টি বোর্ডের দোকানে আড্ডা জমাত, সেজন্য ওদের দোষ দেওয়া যায় না। আজ আবার একটা কালো বেনারসী পরেছে। আই-ল্যাশ দিয়ে চোখ দুটোকে আরো সুন্দর করেছে। পেন্ট করেনি বটে তবে একটু বিউটি ট্রিটমেন্ট করায় সুন্দর মুখটা আরো সুন্দর দেখাচ্ছে।

দাদা, এই দুলটা পরিয়ে দাও তো। দুল দুটো এগিয়ে দিয়ে বলল, এমন বিশ্রী ডিজাইন যে পরাই একটা ঝামেলা।

এই মাটি করেছে। আমি কি পারব?

পারব না বললে কি বন্দনা ছাড়ে!

বন্দনাকে কাছে পেয়ে নতুন করে বাঁচার আশা পায় তরুণ। আনন্দ পায়, উৎসাহ পায়। জীবনযাত্রার ধরনটাও পাল্টে গেল। কফি আর স্যান্ডউইচ খেয়েই দিন কাটে না। প্রতিদিন কত কি রান্না করে বন্দনা।

এত কি খাওয়া যায়?

তুমি বড্ড বেশি তর্ক কর, দাদা। অন্তত খাওয়া-দাওয়ার ভারটা আমাকে ছেড়ে দাও।

তরুণ আর তর্ক করে না। হার স্বীকার করেও যেন জিতে যায়।

রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর দুজনে গল্প করত কত রাত পর্যন্ত। ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে কত কথা হতো।

চল, এবার তুমি শুতে চল।

তরুণ বুঝত এ অনুরোধ নয়, অর্ডার। এই তো যাচ্ছি।

আর এই তো যাচ্ছি নয়, এবার ওঠ।

তরুণ উঠে পড়ে। বন্দনা আগেই বিছানাপত্র ঠিক করে রেখেছে। তরুণ শুতে না শুতেই বন্দনা ব্ল্যাঙ্কেট ঠিক করে দেয়!

আমি কি বাচ্চা? কম্বল-টম্বলও গায়ে দিতে পারি না?

এত আদরে মানুষ হয়েছ যে এসব শেখার সুযোগ পেলে কোথায়?

বন্দনা ভোরবেলায় উঠে পড়ে। একবার উঁকি দিয়ে তরুণকে দেখে নেয়। হয়তো কম্বলটা একটু টেনে দেয়। মুহূর্তের জন্য একটু যা ভালো করে দেখে নেয়।

দুঃখে-কষ্টে মানুষ হয়েছে বন্দনা। ঝড়-বৃষ্টি বড় বেশি সহ্য করতে হয়েছে। তরুণের স্নেহচ্ছায়ায় এসেই প্রথম একটু পরিষ্কার আকাশ দেখার সুযোগ পেয়েছে। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠেই এই মুখোনা দেখে যেন সে অনুপ্রেরণা পায়, আনন্দ পায়। দাদার ওপর আধিপত্য করে আত্মতৃপ্তি পায় মনে মনে।

সুখের দিনগুলো আবার ঝড়ের বেগে উড়ে যায়। বন্দনার বার্লিন বাসের পালা প্রায় শেষ হয়ে আসে।

সব অভ্যেসগুলো তো নষ্ট হয়ে গেছে। এবার যে কিভাবে একলা থাকব আর স্যান্ডউইচ খাব, তাই ভাবছি।

সেইদিন দুপুরেই বন্দনা বিকাশকে লিখল, দাদাকে ছেড়ে যেতে মনটা ভীষণ খারাপ লাগছে। তুমি যদি রাগ না কর তাহলে আরো সপ্তাহ দুই থাকতাম।

বিকাশের উত্তর আসতে দেরি হল না। তুমি নিশ্চয়ই আরো কিছুদিন থাকবে। দাদাকে দেখলে কি আমি রাগ করতে পারি? ভুলে যেও না ওঁর চাইতে আমাদের আপন আর কেউ নেই।

পরের দিন সকালে অফিস বেরুবার সময় তরুণ বলল, আজ তোমার টিকিট কাটতে দেব।

না না, দাদা। আমার টিকিট কাটতে হবে না। তোমাকে আর একটু জ্বালাতন করি।

সে কি? বিকাশ আর কতদিন হাত পুড়িয়ে খাবে?

ওই আমাকে থাকতে বলেছে।

একটু শুকনো হাসি হাসল তরুণ। আমার সঙ্গে তোমরা এত জড়িয়ে পড়ো না। তাহলে আমার পাপে তোমাদেরও দুঃখ পেতে হবে।

সে সব তোমার ভাবতে হবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *