১০. বাংলা ও পাঞ্জাবের মতো জার্মানিও

বাংলা ও পাঞ্জাবের মতো জার্মানিও দু টুকরো হয়েছে কিন্তু কলকাতা বা লাহোরের মতো বার্লিন আর সেই আগের মতো নেই। একটা নয়, দুটো নয়, চার চারটে টুকরো হয়েছে বার্লিন ব্রিটিশ সেকটর, ফ্রেঞ্চ সেকটর, আমেরিকান সেকটর ও রাশিয়ান সেকটর। অ্যালায়েড ফোর্সেস-এর তিনটি সেকটর নিয়েই আজকের পশ্চিম বার্লিন ও রাশিয়ান সেকটর হচ্ছে পূর্ব বার্লিন। পশ্চিম বার্লিন বাহ্যত ও কার্যত মুক্ত হলেও আইনত আজও ইংরেজ-ফরাসি আমেরিকা অধীন। শহরটাকে চক্কর দিতে গিয়ে বার বার নজরে পড়বে, ইউ আর লিভিং ব্রিটিশ সেকটর, ইউ আর এস্টারিং ফ্রেঞ্চ সেকটর অথবা আমেরিকান সেকটর।

বিরাট ও বিচিত্র শহর হচ্ছে বার্লিন। বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে বার বার এর উল্লেখ। আয়তনে পূর্ব বার্লিনের চাইতে পশ্চিম বার্লিন কিছুটা বড়। দুটি বার্লিন একত্রে ওয়াশিংটনের সাড়ে তিনগুণ। আজকের পশ্চিম বার্লিনের আমেরিকান সেকটরই প্যারিসের চাইতে বড়।

দুটি জার্মানি, দুটি বার্লিন দিন-রাত্তিরের মতো সত্য হলেও ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে শুধু পশ্চিম জার্মানির। পশ্চিম বার্লিনে আছে কন্সাল জেনারেলের অফিস। সেই কাল জেনারেল অফিসে পলিটিক্যাল ডিপার্টমেন্টের প্রধান হতে চলেছে তরুণ।

সাধারণত কন্সাল জেনারেলের অফিসের দুটি কাজ। কনসুলার ও কমার্শিয়াল। অর্থাৎ পাসপোর্ট-ভিসা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগিতা করা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর সঙ্গে থাকে প্রচার বিভাগ। বার্লিন যদি সানফ্রান্সিসকোর মতো একটা বিরাট শহর ও ব্যবসা কেন্দ্র হতো, তাহলে ওই দুটি-তিনটিই কন্সাল জেনারেল অফিসের কাজ হতো। কিন্তু বার্লিন আন্তর্জাতিক রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। পৃথিবীর দুটি বিবাদমান শক্তি এখানে মুখোমুখি। তাই তো শুধু পাসপোর্ট-ভিসা আর এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের কাজই নয়, কন্সাল জেনারেলের অফিসে কুটনৈতিক বিভাগটি অন্যতম প্রধান অংশ। তরুণ সেই গুরুত্বপূর্ণ পলিটিক্যাল ডিভিশনের প্রধান হতে চলেছে।

পূর্ব জার্মানিতে ভারতীয় কুটনৈতিক মিশন নেই, বার্লিনে নেই আমাদের দূতাবাস বা কাল-জেনারেল। বিশ্বের অন্যতম প্রধান শিল্পসমৃদ্ধ দেশ পূর্ব জার্মানির সঙ্গে ভারতের শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক। তাই তো আছে ট্রেড মিশন।

দ্বিধাবিভক্ত বাংলার কাছে দ্বিখণ্ডিত বার্লিনের কাহিনি হাসির খোরাক যোগাবে। পশ্চিম বার্লিন পশ্চিম জার্মানির অন্তর্গত নয়। তবে রাজধানী বনের চাইতে পশ্চিম জার্মানির অনেক বেশি সরকারি কর্মচারী পশ্চিম বার্লিনে কাজ করেন। বার্লিন দু টুকরো হলেও মিউনিসিপ্যালিটির কাজকর্ম একইভাবে চলছিল। মাটির উপরের রেল ইউ-বান চালাত পূর্ব জার্মানি, মাটির তলার রেল ইউ-বান চালাত পশ্চিম জার্মানি। প্রায় পঞ্চাশ হাজার পূর্ব বার্লিনবাসী প্রতিদিন চাকরি করতে আসত পশ্চিমে, কয়েক হাজার পশ্চিমের বাসিন্দাও নিত্য যায় পূর্বে চাকরি করতে।

বার্লিনের মজার কাহিনি আরো আছে। পশ্চিম বার্লিন থেকে যে বাইশ জন ডেপুটি বনে প্রতিনিধিত্ব করে, তাদের একজন তো পূর্ব বার্লিনেই থাকতেন। ভাবতে পারেন খুলনা বা বরিশালে বাস করে, কলকাতা থেকে নির্বাচিত হয়ে দিল্লির পার্লামেন্টের সদস্য হওয়া? কলকাতার মতো পূর্ব জার্মানির থিয়েটারের মানে বেশ উঁচু। পশ্চিম বার্লিনের বনেদি ও ধনী বা থিয়েটার রসিকের দল তাই রোজ সন্ধ্যায় পূর্ব বার্লিনে গিয়ে থিয়েটার দেখেন। আবার আমেরিকান খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিন পড়ার জন্য আমেরিকান প্রচার দপ্তরের পৃথিবীর বৃহত্তম। লাইব্রেরি-পশ্চিম বার্লিনের ইউ-এস-আই-এ-তে পূর্ব বার্লিনের হাজার হাজার কর্মী নিত্য আসেন।

এই বার্লিনে-পশ্চিম বার্লিনে এলো তরুণ। পশ্চিম বার্লিনের টেমপেলহ এয়ারপোর্টটি একেবারে শহরের মধ্যে। কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়ারের মতো না হলেও পার্ক সার্কাস আর কি! এয়ারপোর্টটিও বেশ অভিনব। মাঠের মধ্যে রানওয়ের ধারে বা টার্মিনাল বিল্ডিং থেকে মাইলখানেক দূরে প্লেনে ওঠা-নামা করতে হয় না। প্লেন একেবারে টার্মিনাল বিল্ডিং-এর বিরাট হল ঘরের মধ্যে থামে। প্লেনে ওঠা-নামার সময় এয়ার হোস্টেসের কৃত্রিম হাসি দেখার আগে বা পরে রোদ-জল ঝড় সহ্য করতে হয় না যাত্রীদের।*

কন্সাল জেনারেল একটু জরুরি কাজে আটকে থাকায় নিজে এয়ারপোর্ট যেতে পারেননি তরুণকে অভ্যর্থনা জানাতে। সহকর্মী মিঃ সুরী ও মিঃ দিবাকরকে পাঠিয়েছিলেন।

তরুণ বলল, আপনারা দুজনে কেন কষ্ট করলেন? আই অ্যাম সরি, আমার জন্য আপনাদের বেশ কষ্ট হলো।

মিঃ দিবাকর বললেন, কি যে বলেন স্যার! আপনাদের দেখাশুনা করা ছাড়া আমাদের আর কি কাজ?

মিঃ সুরী শুধু বললেন, দ্যাটস্ রাইট স্যার। হান্স কোয়ার্টারে তরুণের ফ্ল্যাট ঠিক করা ছিল। দিবাকর আর সুরী ফ্ল্যাটের সব কিছু দেখিয়ে দেবার পর বললেন, স্যার আপনি একবার সি-জি-র (কন্সাল জেনারেল) ওয়াইফকে টেলিফোন করুন।

কেন? এনিথিং স্পেশ্যাল?

সি-জি বার বার করে বলেছেন?

তরুণ হাসে। দিবাকর আর সুরী মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন।

তরুণ বলল, টেলিফোন করার দরকার নেই। আপনারা কাইন্ডলি মিসেস ট্যান্ডনকে বলে যান আমি একটু পরেই আসছি।

দিবাকর আর সুরী বিদায় নিলেন। বলে গেলেন, একটু পরেই গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি স্যার।

দ্যাটস অল রাইট।

ওঁরা বিদায় নেবার পর তরুণ একটু ঘুরে ফিরে ফ্ল্যাটটা দেখল। ছোট্ট ফ্ল্যাট। ছোট্ট ফ্ল্যাটই সে চেয়েছিল। একটা বড় লিভিং রুম, একটা মাঝারি সাইজের বেডরুম, ছোট্ট একটা স্টাডি আর কিচেন, টয়লেট ইত্যাদি। এ ছাড়া দুটি বারান্দা-একটি ছোট, একটি বড়। বড়টি লিভিং রুমের সঙ্গে, ছোটটি বেডরুমের সঙ্গে। দুটি বারান্দাতেই অ্যালুমিনিয়াম ডেকচেয়ার রয়েছে। হান্স কোয়ার্টারের অ্যাপার্টমেন্টে ক্রটি কিছু নেই। ফার্নিচার, বিছানাপত্তর, লাইট স্ট্যান্ড-সব কিছুই ঝকঝ তক্ত করছে।

পৃথিবীর কিছু কিছু দেশ আছে যেখানে শিল্পীর সঙ্গে শিল্পের সমন্বয় হয়েছে। মুষ্টিমেয় এই কটি দেশে সব কিছুতেই একটা শিল্পীসুলভ মনোবৃত্তি, রুচির পরিচয় পাওয়া যাবে। রাইফেল সব দেশেই তৈরি হচ্ছে। আমেরিকা-রাশিয়া থেকে শুরু করে আমাদের ইছাপুর, কাশীপুরে পর্যন্ত। কিন্তু চেকোশ্লোভাকিয়াই একমাত্র দেশ যে দেশের রাইফেলেও চমৎকার শিল্পীমনের পরিচয় পাওয়া যাবে। লোহার তৈরি পুল তো সব দেশেই আছে। কলকাতা-লন্ডন-নিউইয়র্কে। কিন্তু প্যারিসের ওই প্রাণহীন লোহার পুলগুলির মধ্যেও সমগ্র ফরাসি জাতির যে শিল্পীমনের পরিচয়। পাওয়া যায়, তা আর কোথাও পাওয়া যাবে না। জাপান, জার্মানিও অনুরূপ। সব কিছুতেই প্রয়োজনের সঙ্গে রুচির সমন্বয়।

পৃথিবীর বহু শহরে-নগরে আধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট দেখা যাবে, কিন্তু বার্লিনের হান্সা কোয়ার্টারের অ্যাপার্টমেন্টে কি যেন একটু অতিরিক্ত পাওয়া যাবে। এই অতিরিক্ত পাওয়াটুকুই এক একটা জাতির বৈশিষ্ট্য। রাশিয়া রকেটের সঙ্গে সঙ্গে বলশয় থিয়েটার আর ব্যালেরিনার জন্য বিখ্যাত। জাপান শুধু ইলেকট্রনিকসে নয়, চমৎকার পুতুল তৈরি করে পৃথিবীকে চমকে দিয়েছে। সুইস মেশিনারী ঘড়ির মতো সুইস চকোলেটও সবার প্রিয়। বার্লিনেও বড় বড় কলকারখানার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত বার্লিন ফিলহারমনিক অর্কেস্ট্রা।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখতে বেশ লাগছিল তরুণের। দূরের রেডিও টাওয়ারের দিকে নজর পড়তেই মনে পড়ল ফিলহারমনিক ও সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার কথা। নিউইয়র্কে গত বছরই শুনেছিল হাবার্ট ভন্ কারজনের পরিচালনায় বার্লিন ফিলহারমনিক অর্কেস্ট্রা। মনে পড়ল আরো অনেক কথা।

রমনার মজুমদার বাড়ির বিনয়বাবু বি-এ ফেল করার পর বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন। অনেক খোঁজ-খবর করেও ফল হলো না। ফটো দিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছিল কিন্তু তবুও বিনয়বাবুর কোনো সন্ধান দিতে পারেনি কেউ। পারবে কোথা থেকে। খবরের কাগজে যখন বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে উনি তখন আরব সাগরের মাঝ দরিয়ায় ভেসে চলেছেন।

দেখতে দেখতে বছরের পর বছর কেটে গেল। ঢাকার লোক প্রায় ভুলে গেল বিনয় মজুমদারের কথা। ওয়াড়ীর মাঠে, বুড়ীগঙ্গার পাড়ের জটলাতেও বিনয় মজুমদারকে নিয়ে আলাপ-আলোচনাও ক্রমে ক্রমে বন্ধ হয়ে গেল। ইন্দ্রাণী ভুলতে পারল না তার বিনেকাকুকে। ভুলবে কেমন করে? ও যে বিনেকাকুর কোলে চড়ে প্রায়ই বেড়াতে যেত, লজেন্স খেতো। বিনেকাকু যে ওর সব আব্দার হাসিমুখে বরদাস্ত করতেন। বড় হবার পরও বিনেকাকুর দেওয়া পুতুলগুলো বেশ যত্নে সাজিয়ে রেখেছিল ইন্দ্রাণী।

দীর্ঘদিন পরে অকস্মাৎ বিনেকাকু ফিরে এলেন ঢাকায়। রমনা, ওয়াড়ী, বুড়ীগঙ্গার পাড়ে আবার চাঞ্চল্য দেখা দিল। দীর্ঘদিন জার্মানিতে থেকে অদৃষ্ট পাল্টেছেন, অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেছেন জীবনে। যুদ্ধ শুরু হবার পর প্রায় বাধ্য হয়ে সুইডেনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষ হবার পর বিনয়বাবু এলেন আবার মাতৃভূমিকে দেখতে।

বিনেকাকুর কাছে যেতে ইন্দ্রাণীর দ্বিধা, সঙ্কোচ হচ্ছিল। তরুণ কিছু না বলে কলেজ যাবার পথে বিনেকাকুর ওখানে গিয়েছিল।

কাকু, আমার নাম তরুণ। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন।

তোমার বাবার নাম কি?

কানাই সেনগুপ্ত।

ওই উকিলবাড়ির কানাইদার ছেলে তুমি?

তরুণ হাসতে হাসতে বলেছিল, হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন।

বিনয়বাবু আদর করে কাছে টেনে নিয়েছিলেন তরুণকে। অনেক কথাবার্তার পর তরুণ। ইন্দ্রাণীর কথা বলেছিল।

ওই ফুটফুটে ছোট্ট মেয়েটা? যে আমাকে বিনেকাকু বলত?

হ্যাঁ।

বিনয়বাবু একটু যেন উদাস হলেন। হারিয়ে যাওয়া অতীতের ভিড়ের মধ্যে মনটাকে নিয়ে গেলেন। একটু পরে বললেন, ও কি এখনও সেই রকম আদুরে আছে?

তরুণ কি জবাব দেবে? চুপ করে থাকে। বিনয়বাবু আরো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, জান তরুণ, প্রথম প্রথম বিদেশে গিয়ে ছোট্ট বাচ্চাদের টফি খেতে দেখলেই মনে পড়ত ওর কথা। বড় ইচ্ছে হতো ওর একটা ছবি কাছে রাখি কিন্তু তা আর মনে হয়নি।

তরুণ জিজ্ঞাসা করল, কেন কাকু?

বিনয়বাবু হেসে বললেন, বাড়ি থেকে যে পালিয়ে গিয়েছিলাম, তাই ঢাকার কাউকেই চিঠি দিতে পারতাম না।

ইন্দ্রাণীকে আসতে হয়নি, বিনয়বাবুই গিয়েছিলেন। পকেট ভর্তি টফি নিতে ভুলে যাননি।

বার্লিনের হান্স কোয়ার্টারের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তরুণের সে সব কথা পরিষ্কার মনে পড়ল। আর মনে পড়ল বিনেকাকু শেষে বলেছিলেন, ঢাকায় থেকে ইলিশ আর গঙ্গাজলি খেয়ে কিছু হবে না। একদিন টুপ করে পালিয়ে জার্মান যাও, বার্লিনে এসো।

ঢাকার সেই বিনেকাকু জার্মান নাগরিক হয়েই বার্লিনে থাকেন বলেই তরুণ জানত। স্থির করল খুঁজে বের করতেই হবে সেই পরম শুভাকাঙ্ক্ষীকে।

বিনেকাকুর কথা মনে হতেই ইন্দ্রাণীর স্মৃতিটা একটু বেশি সচেতন হয়ে পড়ল মনের মধ্যে। এই ওপাশের ব্যালকনির ডেক-চেয়ারে বসে যদি ইন্দ্রাণী গুনগুন করে গান

হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠল।

তরুণ স্পিকিং?

হ্যাঁ। আমি তরুণ বলছি।…নমস্কার মিঃ ট্যান্ডন, হাউ আর ইউ?

আই অ্যাম সরি, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কিছুতেই এয়ারপোর্টে যেতে পারলাম না।

না না, তাতে কি হয়েছে…

আর দেরি করতে পারল না।

ট্যান্ডন সাহেব সরকারি চাকুরি থেকে প্রায় বিদায় নিতে চলেছেন। বার্লিনেই তার লাস্ট পোস্টিং। ফরেন সার্ভিসের অনেক অফিসারই ট্যান্ডন সাহেবের অধীনে কোনো না কোনো ডেস্কে কাজ করেছেন। তরুণও করেছে! মিসেস ট্যান্ডনকে ভাবীজি বললেও ফরেন সার্ভিসের জুনিয়র অফিসাররা তাকে মাতৃতুল্য সম্মান দেন। কেউ একটু সম্মান দিলে, কেউ একটু মর্যাদা দিলে মিসেস ট্যান্ডন ক্ষমতার অতিরিক্ত না করে শান্তি পান না।

এর অবশ্য একটা কারণ আছে। ট্যান্ডন সাহেব কর্মজীবন শুরু করেন অধ্যাপনা করে। কনিষ্ঠদের আজও তাই ছাত্ৰজ্ঞান করেন।

খাওয়া-দাওয়ার পর তরুণ বলল, জানেন ভাবীজি, ইউনাইটেড নেশনস ছাড়তে মনটা বড় খারাপ লাগছিল। কিন্তু যেই মনে পড়ল আপনার রান্নার কথা, তখন আর এক মুহূর্তও নিউইয়র্কে থাকতে মন চাইল না।

ভাবীজি বললেন, এবার তো তোমাদের ট্যান্ডন সাহেব রিটায়ার করছেন। আর আমি তোমাদের রান্না করে দিতে পারব না। এবার বিয়ে কর, তাকে রান্না-বান্না শিখিয়ে দিয়ে আমিও রিটায়ার করি।

তাহলে আর এ জন্মে হলো না ভাবীজি।

ওসব বাজে কথা ছাড়। ফরেন সার্ভিসে থেকে আজও ইন্দ্রাণীকে খুঁজে বের করতে পারলে?

ফরেন সার্ভিসের কথা বাইরে না ছড়ালেও গোপন থাকে না। ভালো, মন্দ, কোনো খবরই। সুধীর আগরওয়ালা দিল্লিতে থাকার সময় সবাইকে চমকে দিল। ড্রিংক তো দূরের কথা, পান-সিগারেটও খেত না। মঙ্গলবার শুধু উপবাসই করত না, আরউইন রোডের হনুমান মন্দিরে পুজো দিয়ে অফিসে এসে সবাইকে প্রসাদ দিত। সন্ধেবেলা বাসায় ফিরে কোট-প্যান্ট ছেড়ে ধুতি-চাঁদর পরে পুজো করত ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

যারা ফরেন অফিসে কাজ করেও ফরেন যেতেন না, বা যেতে পারতেন না, তারা বাহবা দিতেন। কিন্তু যারা বহু ঘাটে জল খেয়ে এসেছেন, তারা মন্তব্য করতেন, প্রথম ওভারেই ক্লিন বোল্ড হয়ে যাবে। আই-এফ-এস সুধীর আগরওয়ালাকে তাই ঠাট্টা করে অনেকেই বলত আই-জি-বি-এস-ইন্ডিয়ান গুড বয় সার্ভিস।

আগরওয়ালার প্রথম ফরেন পোস্টিং হলো ম্যানিলায়। বিকৃত পশ্চিম, বিস্মৃত পূর্বের মিলনভূমি ফিলিপাইন। ট্রান্সফার অ্যান্ড অ্যাপয়েন্টমেন্ট বোর্ডের সিদ্ধান্ত জেনেই অনেকেই মুচকি হেসেছিলেন।

দুচারজন অনভিজ্ঞ প্রবীণ প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ইউ ইউ পিপুল ডোন্ট স্পয়েল হিম, আগরওয়াল ঠিক থাকবে।

বিদেশ যাত্রার আগে সুধীর ছুটি নিয়ে বাবা মাকে দেখার জন্য শুধু কানপুরই গেল না, হরিদ্বার আর বেনারসও গেল। নিয়ে এল নির্মাল্য, গঙ্গাজল আর অসংখ্য দেবদেবীর ফটো। কনট প্লেসে শপিং করবার আগে চাঁদনী চক থেকে ডজন ডজন ভালো ধূপকাঠি কিনল। অন্যান্য সহকর্মীদের মতো সেই সঙ্গে কিনল রেকর্ড। তবে বিলায়েৎ খাঁ-রবিশঙ্করের সেতার বা লতা মঙ্গেশকারের লাইট মডার্ন সঙস্ নয়। কিনল যুথিকা রায়, শুভলক্ষ্মীর ভজন।

শুভদিনে শুভক্ষণে সুধীর আগরওয়াল রওনা হল সিঙ্গাপুর এন রুট টু ম্যানিলা।

বিদায় জানাতে আরো অনেকের সঙ্গে ইন্ডিয়ান গুড বয় সার্ভিসের মহেশ মিশ্রও গিয়েছিল। মিশ্র বার বার করে আগরওয়ালাকে বলেছিল ডোন্ট হেসিটেট, যা কিছু দরকার আমাকে লিখো। আমি পাঠিয়ে দেব।

ম্যানিলায় পৌঁছেই আগরওয়াল বহু সহকর্মীকে চিঠি দিল। মিশ্রকে লিখল, তোমাদের সবাইকে ছেড়ে এসে বড় নিঃসঙ্গ বোধ করছি। তবে আমার পরম সৌভাগ্য মিঃ ডুরাইস্বামীর ছোট্ট ফ্ল্যাটটা আমাকে দেওয়া হয়েছে। মোটামুটি সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়েছি। দু-একজন সহকর্মী আমাকে বেশ সাহায্য করেছেন। তবে সন্ধ্যার পর নিজের ঘরে বসেই কাটিয়ে দিচ্ছি। সারা শহরটা যেন হঠাৎ উন্মত্ত হয়ে ওঠে। তুমি তো জান আমার ওসব ভালো লাগে না। তাই শুধু পড়াশুনা করছি।

আর কারুর কাছে না হোক, মিশ্রের কাছে প্রতি সপ্তাহে ম্যানিলা থেকে চিঠি আসত। কখনও লিখত, ভাই আরো দুচারটে ভালো ভালো ভজন বা ক্লাসিক্যাল গানের রেকর্ড পাঠিয়ে দাও। আবার লিখত, বইপত্তর যা এনেছিলাম তা যে কতবার করে পড়লাম তার ঠিকঠিকানা নেই। এখানে আমার মনের মতো বই পাওয়া অসম্ভব। তাই তুমি যদি একটু কষ্ট করে ভারতীয় বিদ্যাভবনের কয়েকটা বই পাঠাও তবে বড়ো ভালো হয়।

আরও কত কি লিখত আগরওয়াল।-এদের ন্যাশনাল মিউজিয়াম দেখলাম। সত্যি দেখবার মতো অনেক কিছু আছে। কয়েক শতাব্দীর অস্ত্রশস্ত্রের যে কালেকশন আছে, শুধু তাকে নিয়েই পৃথিবীর এদিককার মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস লেখা সম্ভব। আর আছে পোশাক-এর কালেকশান। এক কথায় অপূর্ব। মানব সভ্যতার প্রগতির অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে তার পোশাক। মানুষের সৃজনী শক্তি কি সুন্দরভাবে, ধাপে ধাপে এগিয়ে গেছে তার মধ্যে যে ছন্দ আছে, আনন্দআত্মতৃপ্তি আছে তা এদের মিউজিয়ামের পোশাকের কালেকশান দেখলে বেশ অনুভব করা যায়। আমাদের দেশে কত বিচিত্র ধরনের পোশাক ব্যবহার হয়েছে ও হচ্ছে কিন্তু দুঃখের বিষয় এসব পোশাকের কোনো সংগ্রহশালা নেই।

নিঃসঙ্গ আগরওয়াল সন্ধ্যাবেলায় হয় পড়াশুনা করত, নয়তো চিঠিপত্র লিখত। লিখত সহকর্মীদের কথা, শহরের কথা।-দিনের বেলা সবই যেন ক্যাজুয়াল। কাজকর্ম, পোশাক-আশাক, সব কিছু। একটা শর্ট স্লিভের সার্ট পরেও ফরেন মিনিস্টারের কাছে যাওয়া যাবে। কাজকর্ম সবাই করছে, তবে মনটা পড়ে থাকে সন্ধ্যার দিকে। রাত্রির নেশাতেই দিনের বেলা যা কিছু করা সম্ভব আর কি! শুধু হোটেল, রেস্তোরাঁ, নাইট ক্লাবে নয়, জনে জনের বাড়িতেও রসের মজলিশ বসে। মানুষগুলো হঠাৎ চলে যায় যুগ যুগ পিছনে। আদিম মানুষের মতো সে হিংস্র হয়ে ওঠে-নারী পুরুষ সবাই।…এই যে আমাদেরই সহকর্মী মিঃ চাচ্ছা! কিভাবেই জীবন কাটাচ্ছেন। রোজ সন্ধ্যায় কোথা থেকে যে এক একটা মেয়েকে শিকার করে নিজের ফ্ল্যাটে আনেন, ভাবলেও অবাক লাগে, ঘেন্না করে।

ফরেন সার্ভিসের সর্বত্র ছড়িয়েছিল আগরওয়ালের অভিজ্ঞতার কাহিনি। পরে যখন ওর চিঠিপত্র আসা কমতে থাকল, সে খবরও মুখে মুখে, ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগের কৃপায় অথবা ডিপ্লোম্যাটদের নিত্য আনাগোনার ফলে ছড়িয়ে পড়ত পৃথিবীর প্রায় সব ইন্ডিয়ান মিশনেই

কয়েক মাসের মধ্যেই আরো অনেক কাহিনি ছড়িয়েছিল।

ম্যানিলা থেকে যারা অন্যত্র বদলি হতেন, তারা জানতেন আগরওয়ালের বিবর্তনের ইতিহাস। দেবদেবীর ভজন-পূজন শেষ হয়ে গেছে। মদ খেয়ে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা ছুকরীদের নিয়ে বেলেল্লাপনা করবার সময় বহুদিন আগেই ভেঙে চুরমার করেছে। এখন আর আগরওয়াল জঙ্গল বার নাইট ক্লাবে বসে ধেনো মদের মতো ফিলিপাইনের তালের রসে তৈরি তুরা মদ খেতে খেতে গার্ল ফ্রেন্ডের সঙ্গে গল্প করে খুশি হয় না। শিকার যোগাড় করেই নিজের অ্যাপার্টমেন্টে আনে!

তরুণের কাহিনিও ছড়িয়েছিল ফরেন সার্ভিসের সর্বস্তরে। মিসেস ট্যান্ডনও জানতেন ইন্দ্রাণী-হারা তরুণের দীর্ঘনিশ্বাসের কথা। তাই তো ইন্দ্রাণীর বিষয়ে প্রশ্ন করতেই তরুণের নীরবতা দেখে ভাবীজি বললেন, ঠিক হ্যায়। তোমার মতো ইনকপিটেন্ট ডিপ্লোম্যাটকে দিয়ে কিছু হবে না। এবার আমিই দেখি কি করতে পারি।

তরুণ কিছু না বলে বিদায় নিল।

———
* দুটি বার্লিনের কথা ১৯৬১ সালে বার্লিন প্রাচীর ওঠার আগেকার পট ভূমিকায় লেখা। এই রচনার ঘটনাকালও তখনকার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *