০২. ইউরোপের সবচাইতে গরিব দেশ

ইউরোপের সবচাইতে গরিব দেশ পর্তুগালে আইন আছে, রাজধানী লিসবনে সবাইকে জুতো পরতে হবে। পয়সা কোথায়? লিসবনে হাজার হাজার মানুষের জুতো কেনার সামর্থ্য নেই। তবুও জুতোর মতোই একটা কিছু পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এই হতভাগ্য মানুষের দল। দূর থেকে পুলিশ দেখলেই পরে নেবে। আবার পুলিশ একটু দূরে চলে গেলেই খুলে পকেটে রেখে দেয়।

চোখ মেলে চারদিক দেখলেই এসব দেখা যায়, জানা যায়। টুরিস্টদের মতো শুধু বাহ্যিক চোখের দেখাই ডিপ্লোম্যাটদের কাজ নয়। আরো অনেক কিছু দেখতে হয়, জানতে হয় এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয়। দশটা-পাঁচটার চাকরি করলে ডেপুটি সেক্রেটারি দায়িত্ব শেষ হয়, কিন্তু কেনসিংটনে বা ফিফথ অ্যাভিনিউতে ককটেল পার্টিতে গিয়ে ছ পেগ আট পেগ হুইস্কি খাবার পরও ডিপ্লোম্যাটকে সতর্ক থাকতে হয় গোপনে খবর জানার জন্য। হাজার হোক ডিপ্লোম্যাটরা মর্যাদাসম্পন্ন ও স্বীকৃত গুপ্তচর ছাড়া আর কিছুই নয়। ফ্রেন্ডশিপ, আন্ডারস্টাডিং শুধু বকুনি মাত্র। ক্লোজ কালচারাল টাইস তেল দিয়ে খবর জোগাড় করার কায়দা মাত্র। অন্যান্য দেশের মতিগতি বুঝে নিজের দেশের সুবিধা করে দেওয়া অর্থাৎ স্বার্থরক্ষাই ডিপ্লোম্যাসির একমাত্র ধর্ম। এসব কথা সারা পৃথিবীর সমস্ত ডিপ্লোম্যাটরা জানেন। ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটরাও জানেন।

সব জেনেশুনেও চলেছে এই লুকোচুরি খেলা। এক-এক দেশে এক-এক রকমের লুকোচুরি খেলা চলে। মস্কো বা ওয়াশিংটনের যে কোনো ডিপ্লোম্যাটিক মিশনে যান। দেখবেন, কেউ কোনো ঘরে বসে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছেন না। বাইরে বরফ পড়ছে, তবু পরোয়া নেই। ভেতরের গার্ডেনেই কথাবার্তা হবে। কেন? কেন আবার, জুজুর ভয়। কোথা দিয়ে কে সব কিছু টেপ রেকর্ড করে নেয়। আজকাল তো পয়সা দিলেই ওয়াচ রেকর্ডার পাওয়া যায়। ডিপ্লোম্যাটদের পিছনে টিকটিকি ঘোরাঘুরি করেই। টেলিফোনে কথাবার্তা নিরাপদ নয়। বড় বড় দেশের অনেক সামর্থ্য, কত কিছুই তারা করতে পারে। কিন্তু ওই ছোট্ট দেশ আফগানিস্থান! এমনই জুজুর ভয় যে কাবুলে সব ডিপ্লোম্যাটকেই টেলিফোনের প্লাগ খুলে রাখতে দেখা যাবে।

আরো কত কি আছে! তবুও এরই মধ্যে হাসিমুখে কাজ করে যান ডিপ্লোম্যাটরা। সুন্দরী যুবতী আর মদের প্রতি পৃথিবীর প্রায় সবদেশের মানুষের দুর্বলতা। বিশেষ করে উপটৌকন হিসেবে, সৌজন্য হিসেবে যখন এসব আসে, তখন অনেক মানুষই লোভ সম্বরণ করতে পারেন না। মদ বা মেয়েদের বর্জন করে ডিপ্লোম্যাসী করা অনেকটা কলের জলে কালীপুজো করার মতো। কাজকর্মের তাগিদেই রোজ সন্ধেয় ডিপ্লোম্যাটদের, ককটেল-লাউঞ্জ স্যুট পরে মদ খেতে হয়, মেয়েদের সঙ্গে নাচতে হয়, খেলতে হয়, হাসতে হয়। বারুদ নিয়ে খেলা করলেও বারুদের আগুনে পুড়তে পারেন না ডিপ্লোম্যাটরা। আরো অনেক সতর্কতা দরকার। পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট বা সিভিল সাপ্লাই অফিসার বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ঘুষ খেলে ক্ষতি হয় কিন্তু দেশ রসাতলে যায় না। ডিপ্লোম্যাটিক মিশনের থার্ড সেক্রেটারি বা একজন অতিসাধারণ অ্যাটাচি ঘুষ খেলে দেশের মহা সর্বনাশ হতে পারে। এভাবে বহু দেশের বহু সর্বনাশ হয়েছে, ভবিষ্যতেও নিশ্চয় হবে না

বড় বড় দেশের তুলনায় ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটদের মাইনে অ্যালাউন্স অনেক কম। তবুও সারা দুনিয়ার ডিপ্লোম্যাটদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মেলামেশা করতে হয় ওঁদের। চারিদিক থেকে প্রলোভন কম আসে না।

ইউনাইটেড নেশনস্-এর করিডরে বা কাফেতে মাঝে মাঝে দেখা হতো দুজনের। হাউ ডু ইউ ডু, ফাইন, থ্যাঙ্ক ইউ পর্যায়েই পরিচয়টা সীমাবদ্ধ ছিল। কদাচিৎ কখনও ডিপ্লোম্যাটিক পাটিতে দেখা হতো, সামান্য কথাবার্তা হতো। এর বেশি নয়।

কিছুকাল পরে আর্ট সেন্টার অফ দি ওরিয়েন্টের আমন্ত্রণে যশস্বিনী ভারতীয় নর্তকী কুমারী পদ্মবতী আমেরিকা ভ্রমণ শেষে এলেন নিউইয়র্ক। ইন্ডিয়ান মিশনের উদ্যোগে ও নিউইয়র্ক সিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপনায় এই যশস্বিনী নর্তকীর নাচ দেখাবার ব্যবস্থা হলো।

পরের দিনই ভদ্রলোক ইউনাইটেড নেশন-এ মিঃ নন্দাকে ধরলেন। ইন্ডিয়ান মিউজিক, ইন্ডিয়ান ডান্স আমার ভীষণ ভালো লাগে। যদি কাইন্ডলি মিস পদ্মাবতীর প্রোগ্রাম দেখার…।

মিঃ নন্দা বললেন, নিশ্চয়ই। এই সামান্য ব্যাপারের জন্য এত করে বলবার কী আছে?

ভালো করে আলাপ-পরিচয়ের সেই হলো সূত্রপাত।

ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ঘনঘটা দেখা দিল। একটা আমেরিকান প্লেন ইউনাইটেড নেশন-এ ডিউটি দেবার সময় উত্তর কোরিয়ার আকাশ থেকে উধাও হয়ে গেলে চীনাদের গুলি খাবার পর। আরোহী ও বিমান-চালকদের সম্পর্কে কিছু জানা গেল না। প্রায় একবছর পর খবর পাওয়া গেল এগারো জন বিমান-চালক। ও তাদের সঙ্গীরা গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে দীর্ঘ কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন।

শুরু হলো মারাত্মক স্নায়ুযুদ্ধ। আশঙ্কা দেখা দিল বিশ্বযুদ্ধের। ইউনাইটেড নেশনস্-এ ঝড় বইতে লাগল।

এমন সময় ইউ-এন কাফেতে নন্দার সঙ্গে ভদ্রলোকের দেখা।

আপনি বলেছিলেন আপনার কাছে সিটারের অনেক রেকর্ড আছে…।

হ্যাঁ, আছে।

বেশি কিছু নয়, সামান্য টেপ করার অনুমতি চাইলেন। অনুরোধটা ঠিক পছন্দ না করলেও ভদ্রতার খাতিরে না বলতে পারলেন না মিঃ নন্দা। বললেন, ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। তবে কদিন একটু ব্যস্ত…।

কারেন্ট ক্রাইসিস নিয়ে ব্যস্ত বুঝি?

যাই হোক কদিন পর ভদ্রলোক সত্যি সত্যিই টেপ রেকর্ডার নিয়ে নন্দার ফিফটি সিক্স স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে হাজির হলেন। ডাইরেক্ট রেকর্ডিং চ্যানেলে টেপ রেকর্ডারটা ফিট করে খোস-গল্প শুরু করলেন। বেশ কিছুক্ষণ আজেবাজে কথাবার্তা বলার পর এলো সেই প্রশ্ন, এতবড় ক্রাইসিসে আপনারা নিশ্চয়ই চুপ করে বসে নেই?

নন্দা বললো, আর সবার মতো আমরাও চিন্তিত।

দ্যাটস্ টু, বাট ইন্ডিয়ার তো একটা স্পেশ্যাল পজিশন আছে। বোথ আমেরিকা আর চীনের বন্ধু হচ্ছে একমাত্র ইন্ডিয়া।

আরো অনেক দেশ আছে।

তবুও…।

ওয়ার্লড ওয়ার হলে আমাদের এরিয়ার অনেক দেশের ক্ষতি হবে। তাই আমরা চাই ব্যাপারটা মিটমাট হয়ে যাক।

ভদ্রলোক অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ইউ আর পারফেক্টলি রাইট মিস্টার নল্ডা। আমি সিওর, তোমরা চুপচাপ বসে থাকবে না। তাই না?

উদাসীন ভাবে মিঃ নন্দা উত্তর দিলেন, জানি না। আমার মতো চুনোপুঁটি ডিপ্লোম্যাট কি এসব খবর জানতে পারে?

নন্দা যে ইন্ডিয়ান মিশনের একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বহন করছিলেন, এ খবর ভদ্রলোক নিশ্চয়ই জানতেন। তা না হলে ওদের মিশনের পার্টিতে নন্দাকে এতবার করে যাবার কথা কেউ বলতো না এবং ভদ্রলোকও সীটার রেকর্ড করার জন্য ওর ফ্ল্যাটে যেতেন না।

অবস্থা আরো জটিল হল। ওয়াশিংটনের হুমকি আর পিকিংয়ের অবজ্ঞা চলল সমান তালে। তাড়াহুড়ো করে আমেরিকা ফরমোজার সঙ্গে সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করল, মার্কিন নৌবহরের সেভেনথ ফ্লীট চীনের চারপাশে মহড়া দিতে শুরু করল। তবুও চীন বিন্দুমাত্র ভীত না হয়ে বার-বার বলল, হুশিয়ার আমেরিকা।

ডালেস-ম্যাকার্থীর মতবাদের জোর যখন কমতে শুরু করেছে ঠিক তখন এই আন্তর্জাতিক ঘন-ঘটায় আমেরিকা আবার ক্ষেপে উঠল। ভারতবর্ষ সত্যি চিন্তিত হলো। এশিয়ার শান্তি বিঘ্নিত হবার আশঙ্কায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী চিন্তিত বলে দুনিয়ার খবরের কাগজে খবর ছাপা হলো। অনেকেই আশা করছিলেন ইউনাইটেড নেশনস-এ ভারত কিছু করবে ও পিকিং-এর সঙ্গে দিল্লির নিশ্চয়ই কথাবার্তা হয়েছে।

মিসিসিপি-ইয়াংসী নদীর জল আরো গড়াল। ইউনাইটেড নেশনস্-এর সেক্রেটারি জেনারেল দাগ হ্যাঁমারশিন্ড গেলেন পিকিং। জানুয়ারি মাসের প্রাণান্তকর শীতের মধ্যেও হাসিমুখে চীনা নেতাদের সঙ্গে দিনের পর দিন কথাবার্তা বললেন। এক ফাঁকে ছ-মাইল দূরে দুঃসাহসিকা। মহারাণীর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক সামার প্যালেস দেখলেন। এই প্যালেসের পাশে ওই সুন্দর লেকের স্বচ্ছ জলে হ্যাঁমারশীল্ড হয়তো নিজের মুখের প্রতিবিম্ব দেখার অবকাশ পাননি। যদি সে প্রতিবিম্ব দেখতে পেতেন তবে নিশ্চয়ই অন্তরের অস্থিরতা বুঝতে পারতেন। সেক্রেটারি জেনারেল শূন্য হাতেই ফিরে গেলেন ইউইয়র্ক। তবে কেউ কেউ বললেন, আশা পেয়েছেন। আমেরিকাকে আর একটু শিক্ষা দিয়ে চীনারা ওই আটক বিমানচালকদের মুক্তি দেবে।

এবার সারা পৃথিবীর দৃষ্টি পড়ল দিল্লির উপর।

ঠিক এমন সময় নন্দা বদলি হলেন আমাদের হংকং মিশনে। সীটার প্রেমিকের মতো কিছু ডিপ্লোম্যাট অনুমান করলো, স্পেশ্যাল অ্যাসাইনমেন্টে নন্দা হংকং যাচ্ছে।

সহকর্মীদের সহযোগিতায় ঘর-বাড়ি দেখে সংসার পাতার আগে নন্দা কয়েকদিনের জন্য হোটেলে আশ্রয় নিলেন। মান্দারিন বা হংকং হিলটনে থাকার মতো ট্যাকের জোর কোনো ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটেরই নেই। নন্দারও ছিল না। তাই তো তিনি আশ্রয় নিলেন উইনার হাউসে।

পর পর কদিন রাত্রে ডিনার খাবার সময় পাশের টেবিলে এক ভদ্রলোককে দেখেই নন্দার সন্দেহ হলো। পরে ইন্ডিয়ান মিশনের এক সহকর্মীর সঙ্গে কান্ লিঙ ক্যাস্টনিজ রেস্টুরেন্টে গিয়েও এক কোণায় ডাইনিং হলের ওই ভদ্রলোককে দেখলেন। আবার একদিন উইনধাম স্ট্রিটে। মার্কেটিং করার সময় মহাপ্রভুর পুনদর্শন হওয়ায় নন্দার আর সন্দেহ রইল না।

নন্দা সতর্ক হয়ে গেলেও বুঝতে দিল না। মিশনের দু একজনকে ঘটনাটা জানিয়ে রাখল। তারপর একদিন ডিনার টেবিলে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হলো।

তোমাদের ইন্ডিয়ার মতো চার্মিং ও ফ্রি সোসাইটির কোনো তুলনা হয় না।

মেনী থ্যাঙ্কস্ ফর দি কমপ্লিমেন্টস্।

সত্যি বলছি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড চালাতে গিয়ে কত দেশই ঘুরলাম কিন্তু ইন্ডিয়া ইজ ইন্ডিয়া।

চিকেন-ফ্রায়েড রাইস আর পোর্ক শেষ করে কফির পেয়ালায় হাত দিতেই রাজনীতি এসে গেল।

আই অ্যাম সিওর ইন্টারন্যাশনাল আফেয়ার্সে ইন্ডিয়া ইউনিক রোল প্লে করবে।

নন্দা ছোট্ট উত্তর দেয়, আন্তর্জাতিক ব্যাপারে আজকাল সব দেশ…।

দিন কয়েকের মধ্যেই দুজনের আলাপ বেশ জমে উঠল ও একই সময় ডিনার খাওয়া শুরু হলো।

একদিন ভদ্রলোক যেন একটু তাড়াহুড়ো করে কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে উঠে গেলেন। এক্সকিউজ মী, সিঙ্গাপুর থেকে একটা টেলিফোন আসার কথা!

ভদ্রলোক চলে যাবার পর নন্দার খেয়াল হলো ভদ্রলোকের সিগারেট, লাইটার আব পার্স ডিনার টেবিলে পড়ে আছে। কফি খাওয়া শেষ করে নন্দা তিনটিই হাতে তুলে নিয়ে ভদ্রলোকের ঘরে গিয়ে ফেরত দিল।

মেনি মেনি থ্যাঙ্কস্! পার্সে অনেকগুলো ডলার আছে। অন্য কোথাও ফেললে আর উপায় ছিল না।

নন্দা জানতেন, দিল্লি থেকে পিকিং-এ ও পিকিং থেকে দিল্লিগামী ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগের দেখাশুনা ও লেনদেনের দায়িত্ব যে কুটনীতিবিদদের উপর থাকবে, তাদের এমন টোপ অনেকেই গেলাতে চাইবে।

প্রলোভন কি শুধু বাইরে থেকে আসে? বিদেশ-বিভুইতে সব মানুষেরই কিছু কিছু শৈথিল্য দেখা দেয়। সেটা আশ্চর্যের কিছু নয়। পটুয়াটোলার গিরীশবাবুর মতো লোকও পুজোর ছুটিতে সপরিবারে বেনারস বেড়াতে গেলে দু-একদিন গান-বাজনা শোনার জন্য রাত করে ধর্মশালায় ফিরলে তাতে কেউ কিছু মনে করত না। কারুর বা আহার-বিহারের তীব্র শাসনে শৈথিল্য দেখা যায়। কলকাতায় যারা চা-সিগারেট খায় না, তারাই বিলেতে গিয়ে বাঁদরের মতো মদ গেলে। পরিচিত সমাজ-জীবন থেকে মুক্তি পেলে সব মানুষই বেশ একটু পাল্টে যায়। প্রথম প্রথম ফরেন পোস্টিং পেলে অনেক ডিপ্লোম্যাট আত্মগরিমায় বিভোর হয়ে পড়ে, শৈথিল্য দেখা দেয় দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে। শৈথিল্য দেখা দেয় আরো অনেক কারণে। তবে সুন্দরী যুবতীর খপ্পরে পড়লে কথাই নেই।

মে আই কাম ইন?

দরজা একটু ফাঁক করে একজন ছিপছিপে সুন্দরী ভারতীয় মেয়ে এমন অপ্রত্যাশিতভাবে প্রশ্ন করতে চমকে গেল থার্ড সেক্রেটারি সেনগুপ্ত। মুহূর্তের জন্য মনের মধ্য দিয়ে একটা আনন্দ তরঙ্গের ঢেউ খেলে গেল।

একঝলক দেখে নিয়ে সেনগুপ্ত উত্তর দিল, ইয়েস প্লিজ।

মেয়েটি ঘরে ঢুকে হাত থেকে বড় ট্রাভেলিং ব্যাগটা নামিয়ে রেখে প্রশ্ন করল, এক্সকিউজ মী, আর ইউ মিঃ সেনগুপ্তা?

দ্যাটস রাইট।

এবার পরিষ্কার বাংলায়, নমস্কার।

সেনগুপ্ত চেয়ারে বসে রইল কিন্তু মনটা আনন্দে উল্লাসে উচ্ছাসে নেচে উঠল। ছত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বলল, নমস্কার।

মেয়েটি একটু হাসল। বলল, বসতে পারি?

সৌজন্য দেখাতে ত্রুটি হবার জন্য লজ্জিত হল ডিপ্লোম্যাট সেনগুপ্ত। আই অ্যাম সরি, বসুন, বসুন।

ইউরোপে এই হচ্ছে সেনগুপ্তের প্রথম পোস্টিং। রেঙ্গুনে থাকার সময় ভারতীয়দের সান্নিধ্য-লাভ এত দুর্লভ ছিল না কিন্তু বেলজিয়ামে এই একটা বছর ভারতীয় সান্নিধ্য লাভ প্রায় একেবারেই হয়নি। লন্ডনে ইন্ডিয়ান হাই-কমিশনে যাঁরা চাকরি করেন, তারা ভারতীয় দেখলে বিরক্ত হন। ব্রাসেলস, দি হেগ বা স্ক্যান্ডেনেভিয়ার অন্যত্র যাঁদের চাকরি করতে হয়, তারা ভারতীয় দেখলে খুশি হন। বাঙালি বা বাংলা কথা জানা লোক তো দূরের কথা! বেলজিয়ামের স্পেশ্যাল স্টিল কেনার জন্য যে ডেলিগেশন এসেছিল তাতে একজন বাঙালি ছিলেন। ব্রাসেলস্-এর। ইন্ডিয়ান এম্বাসিতে কাজ করতে গিয়ে আর কোনো বাঙালির সাক্ষাৎ পায়নি সেনগুপ্ত। বহুদিন বাদে একজন বাঙালি মেয়ের আবির্ভাবে সেনগুপ্ত সত্যি নিজেকে ধন্য মনে করল।

কতদিন পর বাংলা কথা বললাম জানেন?

সেনগুপ্তের সাধারণ বুদ্ধির জোরেই একথা জানা উচিত ছিল যে এ প্রশ্নের উত্তর সদ্য পরিচিত মেয়েটির পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তবুও।

অনেকদিন পর।

অ্যাট-লিস্ট ছমাস হবে।

কেন, ব্রাসেলস্-এ বাঙালি নেই?

শুনেছি কয়েকজন আছেন, তবে এখনও কারুর সঙ্গে দেখা হয়নি, আক্ষেপ করে সেনগুপ্ত জানাল।

সেই হলো শুরু। তারপর! অসংখ্য ভারতীয় যুবক-যুবতীর মতো চিত্রলেখা সরকারও পড়াশুনা করার আশায় লন্ডন গিয়ে শেষ পর্যন্ত চাকরি নি। দেখতে দেখতে বছর তিনেক কেটে গেছে লন্ডনে। গত বছর একদল ইন্ডিয়ান ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কোচে করে কন্টিনেন্ট ঘুরেছে কিন্তু ঠিক মন ভরেনি। ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, জার্মানী দেখেই ফিরে গিয়েছে। তাছাড়া এমন গ্রুপে নানা ধরনের বিচিত্র ছেলেমেয়ে থাকে এবং দু-চারজনের ব্যবহার সহ্য করাই দায়। বিশেষ করে মিউনিখে বেভেরিয়ান ফোক্ ডান্স দেখতে গিয়ে প্রদীপ সরকার, বড়াল ও রায়চৌধুরীর…।

বিশ্বাস করুন মিঃ সেনগুপ্ত, ওদের ওই বড় বড় জাগে করে দু-তিনবার বিয়ার খাবার পর এমন বিশ্রী অসভ্যতা শুরু করল যে কি বলব।

হাসতে হাসতে এক গাল সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে সেনগুপ্ত বললো, আপনাদের মতো ইয়ং অ্যান্ড অ্যাট্রাকটিভ মেয়েরা সঙ্গে থাকলে বেভেরিয়াতে গিয়েও ছেলেরা একটু মাতামাতি করবে না?

সিগারেটের ধোঁয়া গোল গোল পাক খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে কোথায় মিলিয়ে গেল। হঠাৎ নটরাজন ঘরে ঢুকে সেনগুপ্তকে একটা চিঠি দিয়ে বলল, হিয়ার ইজ এ ক্লোজড লেটার ফর ইউ।

ক্লোজড লেটার বাট কান্ট এক্সপোজ এনিথিং, হাসতে হাসতে পাল্টা জবাব দেয় সেনগুপ্ত।

নটরাজন কথার মোড় ঘুরিয়ে বলে, অ্যাম্বাসেডর কাল এগারোটায় আমাদের মিট করছেন, জান তো? জানি।

নটরাজন বিদায় নিল।

চিত্রলেখা বললো, একটু সাহায্যের জন্য এম্বাসীতে এসে আপনার নেমপ্লেট দেখে ঢুকে পড়লাম।

বলুন না কি করতে হবে?

আমার এক পুরনো বন্ধুকে স্টেশনে এক্সপেক্ট করেছিলাম কিন্তু আসেনি। স্টেশন থেকে টেলিফোন করে জানলাম ও আর ওখানে নেই। অথচ…।

নতুন ঠিকানাও জানা নেই, এবং যদি এম্বাসীতে লোক্যাল ইন্ডিয়ানদের ঠিকানা থাকে, তাহলে?

হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে চিত্রলেখার।

আই অ্যাম প্লিজড টু ইনফর্ম ইউ মিস সরকার, ইন্ডিয়ান এম্বাসীতে সব খবর পাওয়া যায়, শুধু ইন্ডিয়া আর ইন্ডিয়ানদের বিষয় ছাড়া। চরম সত্যি কথাটা হাসতে হাসতে বললো সেনগুপ্ত।

মিস সরকার কথা আশা নিয়ে এসেছিলেন এম্বাসীতে কিন্তু এমন মর্মান্তিক দুঃখসংবাদ এত সহজে জানতে পারবেন, ভাবতে পারেননি। বেশ মুষড়ে পড়লেন। মুষড়ে পড়বারই কথা। সারা বছর পরিশ্রম করে মাত্র দুসপ্তাহের ছুটি। সামান্য সঞ্চয় নিয়ে মিস সরকারের মতো অনেকেই বেরিয়ে পড়েন দেশ দেখতে। এদের পক্ষে হোটেলে বা মটেলে থাকা অসম্ভব। সেনগুপ্ত সেসব জানে। একটু ভাবল, একটু দ্বিধা করল। হয়তো মনে মনে একটু বিচারও করল।

সেনগুপ্ত বলল, যদি কিছু মনে না করেন একটা প্রস্তাব করতাম।

না না, মনে কি করব।

যদি কোনো আপত্তি না থাকে তবে আমার ফ্ল্যাটে থাকতে পারেন। কোনো অসম্মান বা অসুবিধা হবে না।

সেনগুপ্তের কথাটা শেষ হবার আগেই মিস সরকার বললেন, তা তো আমি বলছি না, তবে…!

হাসতে হাসতে সেনগুপ্ত বলল, জাগ জাগ বেভেরিয়ান বিয়ার খেয়ে বেভেরিয়ান ফোক ডান্স দেখাব না। তবে আমার হাতের রান্না খেতে হবে।

কলকাতা শহরে এমন প্রস্তাব করা বা গ্রহণ করা শুধু অন্যায় নয়, অসম্ভবও। কিন্তু ব্রাসেলস্ শহরে এমন প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা সহজ নয়। তাছাড়া বছর তিনেক বিদেশে বাস করার পর আমাদের দেশের মেয়েদেরও পুরুষের সঙ্গে মিশতে অ্যালার্জি হয় না।

চিত্রলেখা মিঃ সেনগুপ্তের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল, কিন্তু সমস্যা দেখা দিল রান্না করা নিয়ে। চিত্রলেখা বলল, আমি থাকতে আপনি রান্না করবেন? অসম্ভব। তা কিছুতেই হতে পারে না।

দু-একদিনের জন্য আপনি আমার আতিথ্য গ্রহণ করায় আপনাকে খাঁটিয়ে নেব? অসম্ভব। তা কিছুতেই হতে পারে না।

তর্কবিতর্কের পর ঠিক হলো কেউই রান্না করবে না, বাইরে রেস্তোরাঁয় খাওয়া হবে। চিত্রলেখা আর সেনগুপ্ত গ্রান্ড প্লেসে ঘুরে বেড়াল, অপূর্ব গথিক স্থপতি দেখল, টাউন হলের সিঁড়িতে বসে গল্প করল। ব্রাসেলস-এর বিশ্ববিখ্যাত ওপন-এয়ার ফ্লাওয়ার মার্কেটে ঘুরল ঘন্টার পর ঘন্টা আর রেস্তোরাঁয় মহানন্দে বেলজিয়াম-বাসীদের প্রিয় হুইস্কি, সস দিয়ে গলদা চিংড়ি ও ওয়াটারজুই-চিকেনের ঝোল খেল।

ব্রাসেলস্ ত্যাগের আগের দিন সন্ধ্যায় চিত্রলেখা নিজে হাতে রান্না করে সেনগুপ্তকে খাইয়েছিল। খাবার পর সেনগুপ্ত বলেছিল, কেন অভ্যাসটা নষ্ট করে দিলেন বলুন তো।

চিত্রলেখা বলেছিল, আপনি কি আমার কম ক্ষতি করলেন?

তার মানে?

আত্মীয়স্বজন ছাড়া বিদেশ-বিভুইতে একলা একলা বেশ ছিলাম। এই আত্মীয়তা করে কেন আমার মনটাকে খারাপ করে দিলেন বলুন তো?

আর সেনগুপ্তের? সত্যি, নিজের আত্মীয়-বন্ধু সমাজ-সংসার ছেড়ে একলা একলা বিদেশে-বাস যে কত মর্মান্তিক তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। দূর থেকে মনে হয় ডিপ্লোম্যাটরা কত সুখী। কত অফুরন্ত আনন্দের সুযোগ। কিন্তু সত্যিই কি তাই? ওদের কি ইচ্ছা করে না সাধারণ মানুষের হাসি-কান্নায় ফেটে পড়তে? কত কি ইচ্ছা করে।

তাই তো দুটি দিনের কাহিনি দুটি দিনেই শেষ হলো না। দুদিনের স্মৃতির সুর কানে বাজতে লাগল দুজনেরই। ডিপ্লোম্যাটকে কতরকমের হঠকারিতা করতে হয় কিন্তু নিজের মনের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা, হঠকারিতা করা যে কত বেদনার, কত দুঃসহ তা সেনগুপ্তের মতো নিঃসঙ্গ ডিপ্লোম্যাট ছাড়া কেউ বুঝবে না।

হাজার হোক হিউম্যান মেটিরিয়্যাল, মানুষ নিয়েই ডিপ্লোম্যাট ও ডিপ্লোম্যাসি। তাই তো মাঝে মাঝে মনটা উড়ে যায় চালেরী বিল্ডিং থেকে অনেক দূরে, ঘুরে বেড়ায় টুকরো টুকরো স্মৃতির রাজ্যে। চিত্রলেখার চিত্রকে ঘিরে।

তরুণ এসব জানে, মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে, আগ্নেয়গিরির আগুন যেমন সবার চোখের আড়ালে লুকিয়ে থাকে, ডিপ্লোম্যাটদেরও মনের দুঃখ, প্রাণের আক্ষেপ নজরে পড়ে না। স্মৃতির জ্বালায় দগ্ধ হবে কিন্তু কর্তব্যে ত্রুটি হলে ক্ষমা নেই, মার্জনা নেই। হয়তো একটা গোপন খবর বেফাঁস বেরিয়ে যেতে পারে, একটা গোপন সংবাদ জানতে পেরেও ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে ভুলে যেতে পারে। হতে পারে অনেক কিছু, কিন্তু শিকার ফসকে গেলে ডিপ্লোম্যাটের ক্ষমা নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *